করোনাকালে নারী নির্যাতন

করোনাকালে নারী নির্যাতন

“আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? কী যে করি বুঝতে পারছি নামহিলার গলার স্বর ফিসফিসে, আতঙ্ক মিশ্রিত।

এই ধরনের ফোনকল এলে কী করতে হয় আমি জানি। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা আমায় বলে দেয় এই কথার ফাঁকেই খোঁজ নিতে হবে মহিলার প্রাণের আশঙ্কা কতটা, ওঁর অর্থনৈতিক অবস্থা কী, প্রয়োজনে কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন, তাঁর সন্তানেরা কেমন আছে। আমার দিক থেকে জানাব আইন তাঁকে কী কী সুবিধে দিতে পারে, আইনের চোখে তাঁর অধিকার কী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন অস্থায়ী আবাসনে গেলে নিরাপদ হতে পারেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রশ্ন এবং তথ্য ইদানীং অবান্তর হয়ে গেছে। এখন এই মহিলার কথা শুনে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কী করতে পারি তা নিজেই ভালো জানি না।

এ বছরের প্রথম থেকে এক ভয়ঙ্কর মহামারী পৃথিবী ওলট পালট করে দিয়েছে। কোয়ারেন্টাইন, সেলফ আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসটান্সিং ধরনের বিষয় অভিধানের পাতা থেকে লাফিয়ে এসে গ্যাঁট হয়ে বসেছে আমাদের দৈনিন্দিন জীবনে। এদের ধমকে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এরই মধ্যে যতটা পারা যায় মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালাচ্ছে সবাই।

প্রথম যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার ফরমানজারি হল, আমি আঁতকে উঠেছিলাম। প্রথমেই মনে হয়েছিল যে মহিলারা নিজেদের পরিবারে নির্যাতিত হচ্ছেন তাঁদের কথা। যখন প্রায় প্রতি দেশের সরকার নির্দেশ দিল নিজের বাড়িই হল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল পারিবারিক অত্যাচারের শিকার মহিলাদের কথা তাঁরা কি ভুলে গেছেন? হোম আইসোলেশন বা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দিত্ব কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হতে পারে, কিন্তু বহু মহিলাই এতে সুরক্ষিত থাকবেন না। আমরা, যারা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করি, খুব ভালো করেই জানি পরিবার এবং বাসগৃহ কোনোটাই নারীর জন্যে নিশ্চিন্ত নিরাপদভূমি নয়। বস্তুত, কোভিড-১৯-এর চেয়ে অনেক পুরনো এক অতিমারী পৃথিবীকে বহুকাল ধরে অসুস্থ করে রেখেছে- নারী নির্যাতন। আর এই অতিমারীর সিংহভাগ বলি নারী (রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকারের মধ্যে ৯৭% হলেন মহিলা)।

পরিসংখ্যান জানায় পৃথিবীর নারী সমাজে প্রায় তেত্রিশ শতাংশের বেশী গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার। অর্থাৎ, তিনজন মহিলার মধ্যে একজনের জন্যে গৃহ হল সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান। প্রিয়জনের হাতে প্রতিদিন বাড়িতেই খুন হন ১৩৭ জন নারী।[i] গাড়ি দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, এবং ডাকাতিতে যত মহিলা জখম হন, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মহিলা আহত হন স্বামী বা প্রেমিকের দৈহিক নিগ্রহে। শুধু ২০১৯ সালের গুনতি অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের ২৪.৩ ক্রোর প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং নাবালিকা কন্যা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে (রাষ্ট্রসংঘ রিপোর্ট, এপ্রিল ২০২০)।

নারী নির্যাতনের রূপ

পরিবারের মধ্যে নারী নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রতিরোধ বেড়েছে ১৯৭০-এর দশক থেকে। এর আগে অবধি ধরে নেওয়া হত প্রিয়জনের হাতে নির্যাতিত হওয়া মেয়েদের ভবিতব্য, অতএব বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যেটুকু বিরোধিতা, তা আসত দু’একজন মহিলা এবং কিছু সমাজসংস্কারকের সাহসিকতা থেকে। সত্তরের দশকে নারীবাদী আন্দোলনের ফলস্বরূপ, সঙ্ঘবদ্ধ এবং সুপরিকল্পিত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সমাজের প্রতি পরতে নারীর প্রতি অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতিতা মহিলারা দাবী করলেন গার্হস্থ্য অত্যাচার মহিলাদের মানবিক অধিকার খর্ব করছে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান যে অধিকার নাগরিকদের দিতে প্রতিশ্রুত, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারী। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের অর্ধেক নাগরিক-সমাজের সুস্থতা সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতেই হবে।

সেই সময় থেকে শুধু সুরক্ষা নয়, কেমন করে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যায় তার প্রচেষ্টা চলছে- গবেষণায়, পরিষেবা প্রবর্তনে, আইন প্রণয়নে, এবং পুলিশি পরিবর্তনে। এরই সঙ্গে চলেছে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে আন্দোলন এবং শিক্ষার প্রসার।

আজকের দিনেও নারী নির্যাতনের কোনো খবর শুনলেই অনেকেই জিজ্ঞেস করে বসেন ‘মহিলা কী করেছিলেন?’ প্রশ্নটির নিহিত অর্থ হল এই অত্যাচার ঘটেছে মহিলার নিজের দোষে। অর্থাৎ মহিলা নিজে চেষ্টা করলে অত্যাচার বন্ধ করতে পারতেন।

এই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। পারিবারিক অত্যাচারের চাবিকাঠি নির্যাতিতার হাতে থাকে না, থাকে নির্যাতনকারীর হাতে এবং তার মানসিকতায়। নির্যাতিতার আচরণ বা ব্যবহার অত্যাচারীকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং তার উল্টো। আজ যদি নির্যাতনের আপাত-কারণ হয় ‘ডালে নুন বেশি হয়েছে,’ কাল হতে পারে ‘লাল শাড়ি কেন পরেছ,’ আবার পরশু হয়ত হবে ‘বেশি খেলে কেন।’ বস্তুত নির্যাতনের কারণ খোঁজা অবান্তর। এর গূঢ় উদ্দেশ্য ভিক্টিমের থেকে তার জীবন ও পারিপার্শ্বিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। নির্যাতনের ফলে ভিক্টিমের থেকে ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অত্যাচারীর হাতে।

গার্হস্থ্য অত্যাচার বা পরিবারের মধ্যে নারী নির্যাতনকে ইংরেজিতে বলা হয় ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। সাধারণভাবে আমরা বুঝি এর মানে দৈহিক নির্যাতন। কিন্তু এই অত্যাচারের পরিধি বিস্তৃত। মানসিক নির্যাতন (হেয় করা, পাগল প্রমাণ করা), আবেগ জনিত অত্যাচার (গালাগাল করা, নিঃসঙ্গ করা, ছোটোখাটো ব্যাপারে কৈফিয়ত দাবী করা), অর্থনৈতিক নিগ্রহ (নিজস্ব উপার্জনের ও পরিবারের জমা টাকার ওপর অধিকার কেড়ে নেওয়া, খরচ করার স্বাধীনতা না থাকা), সন্তানের কাছে ছোটো করা, যৌন অত্যাচার, পুরুষ বলে আধিপত্য খাটানো, সবই গার্হস্থ্য নির্যাতনের আঙিনায় পড়ে। পারিবারিক নারী নির্যাতনের মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ, দখলদারি। শুধু শারীরিক অত্যাচার করে ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা হয় না। অন্যান্য বহু পন্থা ব্যবহার করা হয়। অনেক পরিস্থিতিতে মারধরই বরং কম হয়। কিন্তু দৈহিক এবং যৌন অত্যাচারের সম্ভাবনা সবসময় প্রচ্ছন্ন থাকার ফলে নির্যাতনের শিকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটায়। অত্যাচারী বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে নারীর মানসিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাকে অসহায়, নির্ভরশীল করে তোলে। ডল্যুথ, মিনেসোটার ডোমেস্টিক অ্যাব্যুস ইন্টারভেনসন প্রজেক্টের তৈরি এই নকশাটি নির্যাতনের কৌশলগুলি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়। বৃত্তের ভেতরের কৌশলগুলিতে মারধর নেই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে পুরোপুরি।

নারী নির্যাতনের উৎস পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে নারীর অবস্থান পুরুষের নিচে। ধরে নেওয়া হয় সেটাই স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দিই। মোটামুটি সব দিক থেকেই সংসারে স্ত্রীর পদমর্যাদা (যেমন, বিদ্যা, উচ্চতা, বয়স, উপার্জন, পরিবারের বিত্ত, ইত্যাদি) স্বামীর চেয়ে কম না হলে সেই পুরুষ হয়ে ওঠে সকলের পরিহাসের পাত্র। (একটু ভেবে দেখুন তো, স্ত্রীর শাসনে কম্পমান স্বামীকে নিয়ে কত শত রসিকতা চারদিকে ছড়িয়ে আছে!) সামাজিক পদের এই বৈষম্য বজায় রাখতেই স্ত্রী-নির্যাতন জরুরি হয়ে ওঠে।

পাশ্চাত্য সমাজ অণুপরিবারে গঠিত বলে অত্যাচার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। যে সমাজ যৌথ পরিবার ভিত্তিক (যেমন, ভারত), নারী অত্যাচারে শামিল হয় পরিবারের বহু সদস্য। দু’ক্ষেত্রেই ফল একঃ নারী ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও তার প্রতিভূ ব্যক্তি-পুরুষ।

সংখ্যা – সংখ্যা

এই মর্মান্তিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে জানতে ইচ্ছে করে আজকের কোভিডকালে কেমন আছেন মহিলারা?

কোভিডের জন্যে লকডাউন চলছে প্রায় প্রত্যেক দেশে। ফলে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি মাশুল গুনতে হচ্ছে দরিদ্র সম্প্রদায়কে। তবে সমাজের প্রতি স্তরে লোকসানের দিক থেকে এগিয়ে আছেন মহিলারা। নিজে গৃহবন্দি, ছেলেমেয়েরা তাদের অপর্যাপ্ত চাঞ্চল্য নিয়ে বাড়িতে বন্ধ,[ii] পরিবারের পুরুষেরা কাজে বেরোতে পারছেন না, বহু পরিবারেই টাকাপয়সার অভাব ঘটছে। সকলেরই মানসিক চাপ বাড়ছে, আর তার আগুন ছিটকে এসে পোড়াচ্ছে মহিলাদের। যে মহিলারা চাকরি করেন, তাঁরা যে বাড়ি থেকে কাজ করবেন অনেকক্ষেত্রেই সে উপায় নেই। পৃথিবীর কর্মরত মহিলাদের সিংহভাগ কাজ করেন সেবার জগতে- বিউটি পার্লার, পরিচারিকা, বাচ্চাদের দেখভাল, নার্স, সেবিকা, যৌনকর্মী। প্রতিটি কাজে চাই অন্য মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাত, ঘনিষ্ট সংযোগ। কোভিডের ফলে আজ তা সম্ভব নয়। আর কাজ নেই মানে রোজগারও নেই। মানে যে সামান্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মহিলাদের ছিল, তাও প্রায় উধাও।

দিনের চব্বিশ ঘণ্টা পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে গৃহবন্দি থাকা, আর্থিক অসচ্ছলতার চাপ, দৈনিক জীবনে পুরুষের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, সবই পারিবারের মধ্যে নারীর অত্যাচারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। বস্তুত, পৃথিবী জুড়ে সেটাই ঘটছে।

রাষ্ট্রসংঘের জনসংখ্যা ফান্ডের (UN Population Fund) সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুসারে কোভিড লকডাউনের প্রথম তিন মাসে পৃথিবীতে নারী নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ- মানে আগের অঙ্কের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ১৫০ লক্ষ মহিলা। লকডাউনের প্রথম তিনমাসে ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, আর সাইপ্রাসে নারী নির্যাতনের জন্যে সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০%, অস্ট্রেলিয়ায় ৪০%, আর্জেন্টিনায় ২৫%, আয়ারল্যান্ডে ৬০%, আর গ্রেট বৃটেনে অভাবিত ৯৭%। সেই অনুপাতে বেড়েছে পরিবারের মধ্যে নারীহত্যা। গত এগারো বছরে যতজন মহিলা গ্রেট বৃটেনে পারিবারিক নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন, লকডাউনের মাত্র একুশ দিনে খুন হয়েছেন তার চেয়ে বেশি- চোদ্দজন মহিলা আর দুটি শিশু। মেক্সিকোতে পরিবারের মধ্যে নারীহত্যা বেড়েছে ৮%। লকডাউনের প্রথম তিন মাসে সেখানে প্রিয়জনের হাতে খুন হয়েছেন ১০০০+ মহিলা। তবে এই সংখ্যার সত্যতার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না। রাষ্ট্রসংঘের অনুমান, নির্যাতিত মহিলাদের মধ্যে মাত্র ৪০% বাইরে সাহায্য চাইতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা নীরবে অত্যাচার সহ্য করছেন। তাছাড়া ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রমুখ আরও বহু দেশ এই সময়ে নির্যাতনের পরিসংখ্যান সংগ্রহের চেষ্টাই করছে না।

কেন এই নীরবতা?

মেয়েরা মুখফুটে পারিবারিক নির্যাতনের কথা চাউর করবে না, তাই ছিল সমাজের চিরন্তন নিয়ম। “পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই।” সত্তরের দশকে নারীবাদী আন্দোলন আরম্ভ হবার পর বিভিন্ন অঞ্চলে সেই অনুশাসন কিছুটা কমেছে, তবে একেবারে উবে যায়নি। সেই অবধি বেশির ভাগ দেশের সরকার এবং আইনি ব্যবস্থা মনে করত, পরিবারের মধ্যে যা ঘটছে তাতে নাক না গলানোই ভালো। ফলে মহিলাদের নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি কোথাও ছিল না। ধরে নেওয়া হত মেয়েদের এমনি করেই বাঁচতে হবে। এর অন্যথা হত না বললেই চলে।

আগেই লিখেছি, সত্তরের দশকে আমেরিকায় নারী-অত্যাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান কৌশল ছিল দেশের অর্ধেক নাগরিকদের (নারী) সুরক্ষা দিতে না পারার জন্যে সরকারকে দায়ী করা – সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকে আইনের দোরগোড়ায় এনে ফেলা। প্রতি দেশের সংবিধান অনুসারে সরকারের প্রধান কর্তব্য হল নাগরিকদের নিরাপদে রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদী আন্দোলন দাবী করল পারিবারিক অত্যাচার উপেক্ষা করে সরকার সে কাজে গাফিলতি করেছে। প্রথম দিকে সকলেই মনে করেছিল ব্যাপারটা হাস্যকর। তারপর আদালতে দু’একটি কেস হেরে মোটা টাকা খেসারৎ দেওয়ার পর মার্কিন সরকার বাধ্য হল পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন প্রবর্তন করতে। এখন একমাত্র মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নারী-নির্যাতন বিরোধী আইন রয়েছে। এই সব আইনের ফলে সমাজে কিছুটা সচেতনতা এসেছে, মহিলাদের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার সাহস আর ক্ষমতাও বেড়েছে।

ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বৃত্তের ছবি থেকে বোঝা যায় নারী নির্যাতনের একটি পাকাপাকি পন্থা হল যে মহিলাকে নিগ্রহ করা হচ্ছে, তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা। বাবা-মা, ভাই-বোন, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পড়শি, এমনকি কাজের জগত থেকে সরিয়ে দিয়ে নিগৃহীত মহিলাকে একা করে ফেললে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধে হয়। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে ধীরে ধীরে মহিলারা শুধু অসহায় হয়ে পড়েন না, বাস্তবের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অত্যাচারী যা বোঝায়, তাই বিশ্বাস করে বসেন (gaslighting)। মহিলাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার এ হল একটি নিশ্চিত উপায়।

কোভিডের সময় আমরা সকলেই গৃহবন্দি, বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা আইনসিদ্ধ, চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুমোদিত। পারিবারিক নির্যাতনের যা উদ্দেশ্য, একাকীত্ব এনে নারীর ওপরে নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো, তা এখন আইনানুগ সম্পন্ন করা হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার মহিলাদের অত্যাচারীর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে থাকত হচ্ছে। টাকাপয়সা ছাড়াও বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগের জন্যে বেশির ভাগ সময় পুরুষের ওপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে, ফলে অত্যাচারীর ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতনকারী অনেক সময় স্ত্রীকে শুধু বন্দিই করছে না, সেই বন্দিত্ব স্থায়ী করার জন্যে মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে বাড়ির বাইরে পা ফেলা চলবে না। যদি পরিবারে কারোর রোগ হয়, দায়িত্ব হবে মহিলার। সুতরাং বাইরে থেকে সাহায্য চাওয়া মহিলাদের পক্ষে আরও মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মল্লিকার বিয়ে হয়েছে প্রায় বারো বছর। ফুলশয্যার রাত থেকে তার স্বামী তাকে বকাবকি, গালিগালাজ করে চলেছে। সেই ব্যবহার বেড়ে গেছে আমেরিকায় আসার পর। এবারে মৌখিক গালমন্দের সঙ্গে যোগ হয়েছে চড়চাপড়, হাত মুচড়ে দেওয়া, সে কী খাবে পরবে তা নিয়ন্ত্রণ করা, শরীরে চিমটি কেটে কালশিটে ফেলে দেওয়াকোভিড সংক্রমণ মহামারী রূপ নেবার সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার স্বামীর অত্যাচার আরও ভয়ানক হয়ে উঠেছেস্বামীর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দেওয়া চলবে না। এমনকি দুটি বাচ্চারও বাইরে যাওয়ার  অনুমতি নেই আবার মল্লিকার ওপরই দায়িত্ব পড়েছে প্রয়োজন মত বাজার এবং বাইরের কাজ করার। মল্লিকাকে কোনোদিনই টাকাপয়সা ধরতে দেওয়া হয়নি। এখন তাকে পাই পয়সার হিসেব দিতে হয়। তাকে ভয় দেখানো হয়েছে, তার বা স্বামীর যদি কোভিড হয়, বাচ্চাদের কেড়ে নিয়ে মল্লিকাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মল্লিকার দিন কাটছে অপরিমেয় শঙ্কায়[iii]

যেহেতু বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় এখন টেলিফোন, নির্যাতিত মহিলারা সহজে সাহায্য চাইতে পারেন না। হয়তো মহিলার একান্তে ফোন করার সুযোগ নেই। মুঠোফোন ব্যবহার করলেও কার সঙ্গে কথা বলছেন কলের তালিকা ঘেঁটে অত্যাচারী তা জেনে যেতে পারে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্যে কারোর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা যাবে না, নিরাপদ আবাসনে যাওয়া অসম্ভব, এবং পুলিশ ডাকলেও তারা সাড়া দিতে দেরি করছে।

এদিকে আবার পুরুষদের চাকরি না থাকায় আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার ফলে মানসিক চাপ বাড়ছে। বহু পুরুষ বাড়িতে আটকে থাকার একঘেয়েমি কাটাতে বেশি মদ খাচ্ছেন বা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। লকডাউনের ফলে অস্ট্রেলিয়ায় মদ বিক্রি বেড়েছে ৩৬%। সেই সঙ্গে বার, রেস্ট্যুরেন্ট, কাজের জায়গা বন্ধ থাকায় বাড়িতে বসেই মদ খাওয়া চলছে দিনে রাতে। এতে পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি অত্যাচার আরো বাড়ছে।

তবে নারী নির্যাতনের ব্যাপ্তি এতেই শেষ নয়। সাধারণত যুদ্ধ বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে সমাজে নারী ও শিশু পাচার অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যায়। ইদানীং বহু বেসরকারি সংস্থা ভয় পাচ্ছে কোভিড সংক্রমণ আয়ত্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে নারী ও শিশু পাচার। বেশির ভাগ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার দরুন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ চক্র আবার সংগঠিত হয়ে তাদের কাজকর্ম আরম্ভ করবে। তার মধ্যে নারী ও শিশু পাচার হবে অন্যতম লাভজনক ব্যাবসা। কী ভাবে এই ব্যাবসা শুরু হবার আগেই বন্ধ করা যায়, তাই নিয়ে এখন থেকে প্রস্তুতি না নিলে নারী নির্যাতন আরোই বিধ্বংসী হয়ে দাঁড়াবে।

অতঃ কিম?

লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়ম প্রচলনের আগে রাষ্ট্রসংঘ থেকে সব দেশের প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছিল যে নারী নির্যাতন বাড়তে পারে। প্রথমে সে দিকে কেউই বিশেষ কর্ণপাত করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র দু’একটি সচেতন ও সংবেদনশীল রাজ্য সরকার এ নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা আরম্ভ করেছে। বাকিরা এখনও এসব উপেক্ষা করে চলেছে। এ ব্যাপারে অগ্রণী হল নিউ ইয়র্ক রাজ্যের রাজ্যপাল অ্যানড্রু কোমো। কোভিডের সময় গার্হস্থ্য অত্যাচারের মোকাবিলা করতে মে মাসের মাঝামাঝি কোমো একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে।

 

অবিলম্বে প্রকাশের উদেশ্যে: 5/20/2020                                       গভর্নর অ্যান্ড্রু এম. কুওমো

COVID-19 মহামারি চলাকালীন পারিবারিক সহিংসতার বৃদ্ধি অনুসরণ করে, গভর্নরের সেক্রেটারি মেলিসা ডেরোসা এবং নিউ ইয়র্ক স্টেট কাউন্সিল অন উইমেন অ্যান্ড গার্লস (NYS COUNCIL ON WOMEN & GIRLS) এই সমস্যার জন্যে এক উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পেতে টাস্ক ফোর্স চালু করলেন

এই বিষয়টির পরিধি এবং হুমকির স্বীকৃতিস্বরূপ টাস্ক ফোর্স উদ্ভাবনী সমাধানগুলি সনাক্ত করে যা ভুক্তভোগীদের কেন্দ্র করে এবং অতীতে যেই প্রকারে পরিষেবা প্রদান করা হয়েছে তার বাইরে দেখতে চেষ্টা করে…

নিউ ইয়র্কের বিশাল বাঙালি (ভারত এবং বাংলাদেশের অভিবাসী) সমাজের জন্যে এই বিজ্ঞপ্তিটি লেখা হয়েছে। ভাষার প্রাঞ্জল্য না থাকলেও প্রচেষ্টাটি যে উপযোগী ও প্রশংসার্হ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ তো শুধু মার্কিন দেশের একটি রাজ্যের কথা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা এখনও ভালো জানা যায়নি।

অবশ্য নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামীরা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। আধুনিক প্রথা অনুসারে জুম, মোবাইল ফোন, স্কাইপ, ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা সাহায্যপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলছেন, মদদ দিচ্ছেন। মানসিক থেরাপি, চিকিৎসা, পুলিশ, আদালত, ইত্যাদি জায়গায় প্রযুক্তির সাহায্যে পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। পুলিশ ও আদালতের পক্ষে এই পরিষেবা অত্যন্ত জরুরি যাতে নির্যাতিত মেয়েরা আইনি সুরক্ষা পেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্যাতিতা মহিলাদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ হটলাইন এখন ২৪/৭ কার্যকরী রয়েছে।

এছাড়া অনেক সংগঠন আঞ্চলিক প্রতিরোধ ও সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে উদ্ভাবনমূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এক একটি অঞ্চলে কয়েকটি বাছাই করা পরিবারের সদস্যদের শেখানো হচ্ছে (ভার্চুয়াল ট্রেনিং) নির্যাতিত মহিলাদের কেমন করে সাহায্য করা যায়। দেওয়া হচ্ছে ‘কোড’ যা জরুরি অবস্থার ইঙ্গিত দেবে। এই সব বাড়িগুলো চিহ্নিত হচ্ছে ‘নিরাপদ বাড়ি’ (safe home) হিসেবে। দরকার হলে যতটা সম্ভব সংক্রমণ বাঁচিয়ে মহিলাদের স্থান দেওয়ার ব্যবস্থা বাড়িগুলিতে করা হয়েছে। অঞ্চলের মহিলাদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যদি তাঁরা কোনো বিপদে পড়েন, এই সব বাড়িতে গিয়ে ‘কোড’ বলে সাহায্য চাইতে পারেন।

ধরে নিচ্ছি এই জরুরি অবস্থা একসময় কেটে যাবে। কোভিড মহামারী শেষ হবে। কিন্তু নারী-পুরুষের অসম সামাজিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতি যে অতিমারী- নারী নির্যাতন- তার সমাপ্তি হবে কবে? নিঃসন্দেহে যে মহিলারা প্রত্যক্ষ ভাবে শারীরিক ও যৌন অত্যাচারের শিকার হন, তাঁদের প্রয়োজন তাৎক্ষণিক সাহায্য। জরুরি অবস্থার পর তা না হয় সুষ্ঠুভাবে দেওয়া যাবে। কিন্তু এ ধরনের সাহায্য দিয়ে থেমে গেলে এই অতিমারীর সমাধান কোনদিনই হবে না। যে পুরুষপ্রাধান্যের (patriarchy) জন্যে নারী-নির্যাতন সম্ভব হচ্ছে, তা উৎখাত না করতে পারলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

রেভারেন্ড ডেসমন্ড টুটুর মতে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তিনটি পদক্ষেপের প্রয়োজনঃ

(১) যে ধরনের সামাজিক ক্ষতি ঘটেছে বা ঘটছে তার সোচ্চার স্বীকৃতি দেওয়া। অর্থাৎ সামাজিক সমস্যা লুকিয়ে না রেখে তা প্রকট করা;

(২) যে সামাজিক ক্ষতি ঘটেছে তা যতটা সম্ভব পূরণ করা; এবং

(৩) যে পরিস্থিতির জন্যে এই ক্ষতি ঘটেছে তার আমূল পরিবর্তন করা, যাতে ভবিষ্যতে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

আশা করি কোভিড-১৯ আর নারী নির্যাতন এই দুই মহামারী এক সঙ্গে নিপাত যাবে।

এখানে দুটি সংগঠনের নাম ও যোগাযোগের তথ্য দিচ্ছি। প্রয়োজনে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার সঙ্গে এরা যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে।

কলকাতাঃ স্বয়ম, www.swayam.info ফোনঃ ৯১ ৯৮৩০৭ ৭২৮১৪

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রঃ মানবী, www.manavi.org ফোনঃ ৭৩২-৪৩৫-১৪১৪

[i] United Nations Office on Drugs and Crime (UNODC) (2019). Global study on homicide: Gender-related killing of women and girls. Vienna: UNODC.

[ii] রাষ্ট্রসংঘের হিসেবে পৃথিবীতে ১.৫ বিলিয়ান শিশু ও কিশোর কোভিড সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্কুলে যেতে পারছে না; বাড়িতে বসে আছে।

[iii] সত্য ঘটনা অবলম্বনে। পরিচিতি গোপন রাখার জন্যে কাল্পনিক নাম লেখা হয়েছে।

শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। বিগত পাঁচ দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অপরদিকে গোয়েন্দা গল্প রচনাতেও সুপটু। প্রথম উপন্যাস ‘দ্বন্দ্ব’ সানন্দা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। নিয়মিত লেখালেখি করে চলেছেন ‘সাপ্তাহিক বর্তমান,’ ‘সুখী গৃহকোণ,’ ও বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *