গুরবে নমঃ

গুরবে নমঃ

ডক্টর সেন, ডক্টর শঙ্কর সেন, প্রফেসর সেন, স্যার …।

আর শঙ্করদা। তাঁর সহস্রাধিক ছাত্রদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন তাঁকে এই সম্বোধন করার সুযোগ পেয়েছিলো। যারা তাঁর শিক্ষকজীবনের গোড়াতেই তাঁর কাছে পড়তে পেয়েছিলো, তারা। আমি বিইকলেজে ঢুকেছি উনিশশো ছাপ্পান্ন সালে, শঙ্করদা সেই বছরই সেখানে পড়াতে এলেন। শঙ্করদা ক্লাস নিতেন থার্ড ইয়ার থেকে, তার মানে আমাদের ঠিক তাঁর ফার্স্ট ব্যাচ বলা যায় না, তাঁর তৈরী প্রথম ব্যাচও নয়, তবে তার খুব কাছাকাছি। আমরা দু বছর পরে থার্ড ইয়ারে পৌঁছলাম, তার মধ্যেই শঙ্করদার যাদুগরী পড়ানোর খবর চাউর হয়ে গেছে। ফোর্থ ইয়ারে উঠলো আর পাশ করে বেরোতে চলেছে এমন সব দাদাদের কাছ থেকে উপদেশ পেলাম –হ্যাঁ, পড়ায় বটে দুই ডাক্তার, ফাণ্ডা একেবারে ঝরঝরে, আর যাই করো বাপু ওঁদের ক্লাসে ফাঁকি মেরোনা। এই দুই ডাক্তারের একজন অবশ্যই ডক্টর শঙ্কর সেন (অন্যজন ডক্টর চক্রবর্তী, এস্‌.কে. চক্রবর্তী, থার্ড ইয়ার ইলেক্‌ট্রিক্যালদের বিশেষ গণিত পড়াতেন)।

বিইকলেজের দাদারা সত্যদ্রষ্টা, দুটি উপদেশই খাঁটি। শঙ্করদা পড়াতেন মেশিন্‌স্‌, থার্ড আর ফোর্থ দুই ইয়ারেই কিনা তা মনে করতে পারছি না। কী পড়িয়েছেন সেসব বহুকাল গুলে খেয়েছি, যেটা মনে আছে সেটা হলো শঙ্করদা কখনো পঞ্চান্ন মিনিটের ক্লাস পুরো পড়াতেন না, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট পড়িয়ে ছেড়ে দিতেন। যতক্ষণ পড়াতেন ততক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো থাকতাম। কোনো নোট দেখতেন না বলে মনে পড়ছে, আমাদের নোট নেবার জন্য যতোট দরকার ততোটাই লিখতেন ব্ল্যাকবোর্ডে, চল্লিশ মিনিট শেষ হয়ে গেলো বলে একটু আপশোষই হতো। একেবারে পুরোপুরি ঠিক নয়, তখন সদ্য সিগারেটের নেশা ধরেছি, দশ মিনিট সুখটান দেবার জন্য পাওয়া গেলো, সেটা কিছু ফেলনা নয়। তবু মনে হতো কম্যুটেটর আর রোটেটিং ফিল্ডের রহস্যের আকর্ষণও কম নয় — আর শঙ্করদা সেসব রহস্যের যেসব চাবি ধরিয়ে দিয়েছিলেন তা ঘুরিয়ে পরে অর্থসংস্থানও করেছি । অনেকদিন পর শঙ্করদাকে প্রশ্ন করেছিলাম এই সময় সংক্ষেপের ব্যাপারটা নিয়ে, বলেছিলেন, দেখো, যত্ন নিয়ে, ঠিকমতো গুছিয়ে, ছাত্রদের মনোগ্রাহী করে যদি বলা যায় তাহলে এই কম সময়েই যা বলা যায়, ছাত্রদের সঠিকভাবে বুঝে নেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। আর বেশী দিলে আমার প্রিপারেশনের শ্রম একটু কম হতে পারে বটে কিন্তু ছাত্রদের পক্ষে তা গুরুভার হয়ে যাবে।

ব্যক্তিত্বপূর্ণ রাশভারী চেহারা, ধোপদুরস্ত পোষাক, যতোদূর মনে পড়ে বেশী পরতেন হাওয়াই শার্ট, দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। কিন্তু খেয়াল করলে চশমার আড়ালে চোখে একটু কৌতুকের ঝিলিক নজর এড়াবার কথা নয়। শঙ্করদা ক্লাসে বলেছিলেন, যদি কোনো জায়গা বুঝতে অসুবিধে হয় তাহলে ক্লাসের আগে অফিসে এসে দেখা কোরো। ওই কৌতুকের ঝিলিকে ভরসা পেয়ে আমরা দুই গাঁইয়া — আমি আর আমৃত্যু আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু অরুণ কাঞ্জিলাল — একদিন ক্লাসের আগে শঙ্করদার অফিসে গেলাম, উনি ডাকতে ভেতরে গিয়ে দেখি মেসিনের বই খুলে পড়ছেন। আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, প্রশ্নের উত্তর দিলেন খুঁটিয়ে, তারপর বললেন, এবার এসো, আমার প্রিপারেশনটা শেষ করতে হবে, এখুনি তো তোমাদের ক্লাস আছে। তারপর নিজেই বললেন, তোমাদের ক্লাসের ছাত্ররা সবাই গুণী ছেলে, তাদের সময়ের দাম আছে, সেই সময়ের দাম তো আমাকে দিতেই হবে, আমি তৈরী না হয়ে গিয়ে সে সময় তো নষ্ট করতে পারিনা।

এই একটা ঘটনা থেকেই শঙ্করদা আমার জীবিকার আদর্শ, রোল মডেল হয়ে গেলেন। এবং সারা জীবন তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছিলাম সে সময়কার স্বাধীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ হবার ঢেউয়ের তোড়ে, তারপর বছর দুই ঘষার পর কারখানায় কুলি তাড়িয়ে বা মাঠে ঘাটে ঘুরে বাড়ী বানিয়ে বা বাঁধ বেঁধে জীবন কাটানোতে বিশেষ উৎসাহ পেতাম না, মন বসতোনা পড়াশোনায়। তার পর আস্তে আস্তে অধ্যাপনার, এবং তার সঙ্গে গবেষণার ব্যাপারটা আকর্ষণীয় মনে হতে আরম্ভ করেছে। সেই সময়ে শঙ্করদার এই যে ছাত্রদের মান দেওয়া, তাদের অবজ্ঞা না করে তাদের নিজের কর্মপ্রয়াসের কেন্দ্রস্থানে বসানো — এটা আমার চোখে এই পেশায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করে দিলো, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসার সার্থকতা নিয়ে যে দোলাচল আমাকে বিব্রত করছিলো, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেলো। পাশ করার পরেই আমার গবেষণা / অধ্যাপনার জগতে ঢোকা হয়নি, কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তবে লক্ষ্যটা মোটামুটি ধ্রুব ছিলো, অপেক্ষা খালি সুযোগের।

অনেকদিন পরে শঙ্করদার কাছে এই ঋণটির স্বীকৃতি দেবার একটা সুযোগ পাওয়া গিয়েছিলো। পঁচানব্বই সালে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু দেশের ব্যবসায়ী প্রধানদের এক দল নিয়ে আমেরিকায় আসেন বাণিজ্যিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনার জন্য। সে বছর উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে তাঁদের নিয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়, আমি তার প্রধান সঞ্চালকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। শঙ্করদা সে দলে ছিলেন না, তখন তিনি জ্যোতিবাবুর ক্যাবিনেটে বিদ্যুৎমন্ত্রী। একটা বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে আমি বলেছিলাম যে আমার কর্মজীবনের শুরুতে আমি দুই রোল মডেল স্থির করেছিলাম — যদি অধ্যাপনার কাজে যাই, তাহলে ডক্টর শঙ্কর সেন আর যদি বাণিজ্যিক কাজে জুটি তাহলে সাধন দত্ত, যাঁর কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। সাধনদা তাঁর কুলজিয়ানের দল নিয়ে সে সভায় ছিলেন, তিনি সেই অনুরোধ রক্ষা করে তাঁর ঔদার্যের পরিচয় দেন। সেই বছরই দেশে শঙ্করদার সঙ্গে দেখা করে বুঝলাম খবরটা কানে পৌঁছেছে, শঙ্করদা বকুনি দিলেন, এ্যাই, জ্যোতিবাবু আমার বস, আমার বসের কাছে আমার নামে কী সব লাগিয়েছো? চোখ চকচক করছিলো তাই কৌতুকটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

সোদরপ্রতিম অরুণের একটা মহৎ গুণ, সে মানুষকে চট করে নিজের করে নিতে পারতো। ফোর্থ ইয়ারে পড়ি, অঙ্ক বুঝে নেওয়া দরকার, কাল কলেজ খোলা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। অরুণ বললো চল, শঙ্করদার কোয়ার্টারেই যাই। আমি আঁৎকে উঠেছি, অরুণ বললে, আরে চল্‌ই না। আমি সন্দেহ নিয়ে পায়ে পায়ে অরুণের সঙ্গে গেলাম, সে ডাউনিং ধাঁচে পুরনো আমলের টানা পাখা চলবার মতো উঁচু ছাত, বিরাট জানলাদরজাওলা বাড়ীতে। সে আর এক স্বর্গরাজ্য। সেখানে শঙ্করদা রাশভারী প্রফেসরের সাজ নামিয়ে ফেলে একেবারে ঘরের লোক, দেখি আমার প্রাক্তন পাড়াতুতো দাদা, প্রমথদা, প্রফেসর পি এন ব্যানার্জিও উপস্থিত। দুটো ছোট্টো পাখির কাকলিতে বাড়ী মুখর। উনিশশো ষাট সাল, অর্থাৎ মৌ তখন চার বছর, কথা বলে মিনিটে এক মাইল। দুবছরের ছোট মুন্নি কুতূহলী কিন্তু এখনও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না, থেকে থেকেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। আমাদের খটোমটো নাম মুখস্থ করার সময় মৌয়ের নেই, আমাদের নতুন নামকরণ হয়ে গেলো — সম্প্রতি চশমা নিয়েছি, তাই চশমা কাকাই, অরুণের বিহারী স্টাইলের মোচ, সে হলো গোঁফ কাকাই আর প্রমথদা হলেন গোল গোল চোখ কাকাই। বাস্তবতার চূড়ান্ত!

আর আছেন বৌদি, বুলুবৌদি। মূর্তিমতী লক্ষ্মী, কৌতুকপ্রিয়া, লাস্যময়ী — একেবারে বাংলা উপন্যাস থেকে উঠে আসা নির্ভেজাল বাঙালী বৌদি। চা-জলখাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে, গুষ্ঠির তত্ত্ব নেওয়া হচ্ছে, আমাদের আর আমাদের ভাবীদের নিয়ে ফুট কাটা হচ্ছে, নিতান্তই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপার না হলে আমাদের আলোচনায় মন্তব্য হচ্ছে — সারা আড্ডাটায় বৌদি ছড়িয়ে আছেন। সে না দেখলে বোঝানো যাবে না। তারপর কতোবার শঙ্করদার বাড়ী গেছি, আমরা সবাই অল্পবিস্তর বদলেছি কিন্তু আমাদের বৌদি সেই একই রকম। তারপর একদিন সবাইকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। আমি সুদূর আমেরিকায় বসে খবর পেয়ে নির্বাক হয়ে রইলাম। সে বছর কলকাতায় এসে শঙ্করদার সংগে দেখা করতে গেলাম, বাড়ী যেন কাঁদছে, মূর্খের মতো দুয়েকটা ছেঁদো কথা বলে শঙ্করদার কাছে বকুনি খেলাম। বললেন, জানো, তিনি ছিলেন এমন একজন, বাড়ী ফিরে যাঁর কাছে সারাদিনের সব গ্লানি, ক্লেদ, দুঃখ, কষ্ট, ভয়ের কথা বলে মন হালকা করা যেতো, যেন সর্বংসহা পৃথিবীর মতো সব শুষে নিতেন আর আমাকে দিতেন শান্তি। শঙ্করদা তখন উপাচার্য আর মন্ত্রিত্বের ধকল সামলে এসেছেন আর সামলাচ্ছেন, কাজেই তাঁর পক্ষে এই শান্তির আশ্রয়ের বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। আর বৌদিই সেই আশ্রয়দাত্রী, এটাও তর্কাতীত। বৌদি চলে যাবার পর আমি আর কয়েকবার শঙ্করদার বাড়ী গেছি, সে বাড়ী প্রাণহীন, শঙ্করদা তপোক্লিষ্ট আর আমরা থেকে থেকে ভেতরের দরজার দিকে চাওয়া থামাতে পারিনা, এই বুঝি হাস্যোজ্জ্বল বৌদি সবায়ের কুশল প্রশ্ন নিয়ে এসে গেলেন।

যাই হোক, কলেজ ছাড়ার পর শঙ্করদার সঙ্গে দেখা হতো মাঝে মাঝে, রিইউনিয়নের দিন তো নিশ্চয়। তারপর আমি বিদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, শঙ্করদা ভারী খুসী, সবরকমের সাহায্য করলেন, অ্যাপ্লিকেশনের রেফারেন্‌স লিখে দিলেন। এদেশের স্কুল বললে সিলেবাসের কপি দাও। শঙ্করদা বললেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গত পঞ্চাশ বছরে সিলেবাস বদলায়নি, সে সিলেবাস পাঠালে তোমাকে তো নয়ই, এখান থেকে জীবনে ওরা আর কাউকে নেবে না। বলে নিজে ফর্মামাফিক সিলেবাস তৈরী করে সই করে পাকা করে দিলেন। তারপর আমি বিদেশের জীবনযাত্রায় জড়িয়ে পড়লাম, চার পাঁচ বছরে একবার দেশে যাওয়া, গেলে অবশ্যই শঙ্করদার সঙ্গে দেখা করতাম। শঙ্করদা তখন কৃতির সিঁড়ি বেয়ে কোথায় কোথায় উঠে যাচ্ছেন। তার সরাসরি সাক্ষী না হতে পারলেও অরুণ মারফৎ খবর পেতাম, গর্বে বুক ফুলে উঠতো, আমার রোল মডেল তো! পিএইচডি শেষ করে দেখা করতে গেলাম বিইকলেজ রিইউনিয়নে। শঙ্করদা ডাক শুনে প্রণাম করা থেকে নিবৃত্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চারদিকে সেই সময়ের ছাত্রদের ভীড়। বললেন , এরা সব দেখুক আমাদের শিক্ষকদের আর তোমাদের ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক কতো মধুর আর গভীর হতে পারে। দেশে থাকতাম না বলে বুঝতে পারিনি, পরে জানলাম শঙ্করদার এই বিরক্তির উৎস তখনকার ছাত্র আন্দোলনের ঘেরাও, শিক্ষকদের অবমাননা ইত্যাদি বিরক্তিকর ব্যবহার। শঙ্করদার মতো উদারমনা, ছাত্রবৎসল শিক্ষকের মনস্তাপটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কোনো। মধুর ও গভীর — এই কথা মনে থাকবে বরাবর।

নতুন শতাব্দীর শুরুতে সোদরোপম সুজন দাশগুপ্তের সঙ্গে অবসর নামের এক ই-জিনে জড়িত ছিলাম। তখন আমেরিকায় ইন্‌টারনেটের ব্যবহার আস্তে আস্তে বেশ ব্যাপৃত হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া তখন একেবারেই শৈশবে, নেটের ব্যবহার জ্ঞানভাণ্ডার, এন্‌সাইক্লোপিডিয়া হিসেবেই বেশী প্রকট, অবশ্যই ইংরেজী মাধ্যমে। আমরা ভেবেছিলাম সেই সুযোগ বাংলাভাষাভাষীদের কাছেও পৌঁছে দেবার কথা — খানিকটা সাক্ষরতা প্রচারের কথাও ভেবেছিলাম। শঙ্করদা শুনেই উৎসাহ দিলেন, উপদেষ্টামণ্ডলীতে থাকতে রাজী হলেন, কিছু অনুরোধ-উপরোধের পর সভাপতিত্ব গ্র্হণেও। আমৃত্যু সেই পদে ছিলেন, আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন বিপদেসম্পদে। ২০০৫ সালে অবসরের আরব্ধ কাজের (এন্‌সাইক্লোপিডিক সাইট) একটা পরম সহায়ক পাওয়া গেলো, আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ভারতকোষ নামে একটি বিখ্যাত এন্‌সাইক্লোপিডিয়া অবসরের সাইটে ব্যবহার করার অনুমতি পেলাম। তা না হয় হলো, কিন্তু সেকেলে সাধু বাংলায় লেখা বিস্তৃত সব বিবরণ, আজকের মাপে মোটেই সহজপাঠ্য নয়, কিছু মরচে-ধরা, ডেটেড, সেসব তো কম্প্যুটারে সামিল করতে হবে। সেই বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধে কে? শঙ্করদা এগিয়ে এলেন, আরে আমি করবো, আমার তো নতুন অনেক কিছু শেখা হবে। শঙ্করদা তখন রিটায়ার করেছেন, কিন্তু বনের মোষ তাড়ানোর শেষ নেই। আমরা ভারতকোষ কিনে এনে দিলাম, বাংলা টাইপিং সড়গড় করে নিয়ে উনিও ধরলেন আর তারপর দশ বছরের বেশী সময় অবসরের প্রতি সংখ্যা ওঁর দানে সমৃদ্ধ হলো। শেষবার দেখেছি ওঁর কীবোর্ড বিধ্বস্ত, নতুন কিছুতেই কিনতে দিলেন না। তারপরে একদিন বৌদির কাছে চলে গেলেন।

শঙ্করদা আমার বিয়েতে এসেছিলেন, সেখানে আমার বাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিই। আমার বাবা বলেছিলেন, আমরা পিতারা জন্ম দিয়ে বাল্য, কৈশোর সন্তানদের রক্ষা করে, শিক্ষা দিয়ে আপনাদের মতো শিক্ষকদের হাতে তুলে দিই। আপনারাও সেই পিতারই কাজ করেন ওদের রক্ষা করে, শিক্ষা দিয়ে ঠিক পথে চলার যোগ্য করে বৃহৎ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। এই কথাটি শঙ্করদার খুব মনে ধরেছিলো, অনেকবার এ কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। শঙ্করদার কথা মনে হলে আমি ভাবি কথাটা ঠিক, শঙ্করদা ছিলেন নিছক রোল মডেলের বেশী, তিনি ছিলেন আমার মানসপিতা। ছোটো ছোটো উপদেশ, বড়ো বড়ো উদাহরণ, প্রকাশ্যে আর গোপনে, সব মিলিয়ে আমাকে বারবার পথনির্দেশ দিয়ে এসেছেন, আমার পিতা যেমনটি করেছেন। তাঁর মনন, কৃতি, কথা, কীর্তি — কিছুরই কাছাকাছি আসতে পারিনি। কিন্তু আদর্শ হিসেবে তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা, মানবহিতৈষা, নিজেকে আরো উন্নত করার অক্লান্ত চেষ্টা, ঋজুতার সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা — সব দেখেছি, চমৎকৃত হয়েছি আর অক্ষম হলেও অনুকরণের চেষ্টা করেছি, এই আমার সান্ত্ব্না রইলো।

তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ!

 

 

 

প্রয়াত সুমিত রায় (12/10/1940-5/26/2021) ছিলেন পাঁচ দশক আমেরিকাবাসী। চাকরিজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী। www.gitabitan.net - রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। মার্কিন মুলুক থেকে প্রকাশিত "অবসর" ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত, তার মধ্যে কিছু লেখালেখিও আছে। "পোনুসংহিতা" একটি প্রকাশিত রচনা-সঙ্কলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *