বিদ্রোহী ও রোম্যান্টিক – কবি নজরুল

নজরুলের কবিতা: বিদ্রোহী সত্তা ও রোম্যান্টিকতার মেলবন্ধন

“রবীন্দ্রনাথ যুগোত্তর আর নজরুল একটা পরিপূর্ণ যুগ।”

             -নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্য ও সাহিত্যিক।

বাংলা কাব্যের আসরে নজরুল যখন এলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্য প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিখ্যাতি বহু প্রচারিত। মোহিতলালের দেহাত্মবাদী কবিতা পাঠকের কণ্ঠে। যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ প্রায় প্রবাদ হতে চলেছে। নজরুলের সামগ্রিক কাব্যসাধনায় এঁদের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়।

নজরুল সেই যুগের জাতক, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলার সমাজ রাজনীতি পরিবর্তনের, ভাঙা গড়ার আবেগে উদ্বেল। দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসি নীতির নরম ও মোলায়েম নিয়মতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তারা ক্ষুব্ধ। মহাত্মাজীর অহিংস আন্দোলন বাঙালীর প্রাণে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গড়ে তুলেছেন তার স্বরাজ্য দল। অহিংস নীতির পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় সহিংস আন্দোলন, প্রয়োজনে যা আত্মঘাতী হতেও দ্বিধাহীন।

সমকালীন কবিদের সঙ্গে তুলনায় বলা যায় মোহিতলালের বলিষ্ঠ কাব্যভাষা, ক্ল্যাসিক সংযম ও নিয়মানুবর্তিতা নজরুলের কাব্যধারার চরিত্রবিরোধী। সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যিক শৃঙ্খলা ও আঙ্গিকের পরিপাটি গঠন তাঁর অনায়ত্ত। যতীন্দ্রনাথের ভাবনিবিড়তা নজরুলের জীবনদর্শনের পক্ষে কিছুটা দুর্বহ। কিন্তু তবুও একথা মানতেই হবে, বাংলা কাব্যধারায় নজরুল একটা স্বতন্ত্র জগৎ নির্মাণ করতে সমর্থ হলেন। সেটা তিনি করতে পারলেন কেন? এর মূল কারণ হল কবির অপরাজেয় জীবনমুখীনতা।

এই সমাজের চালচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে নজরুল যুগকণ্ঠ হয়ে ধিক্কার জানান,

“সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, ব’সে ব’সে কাল গুণি!

জাগো রে জোয়ান! বাত ধ’রে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি! (সব্যসাচী)

হিসাব বা বিচারের ধৈর্য রাখার সময় তখন ছিল না, অতৃপ্তি, অসন্তোষ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছিল যুগমানস। সব কিছু ভেঙে ধূলিসাৎ করে অত্যাচারী শক্তির ধ্বংসকামী মনন ক্রমশ আগ্নেয় বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। যুগজীবনের এই বিশেষ পটভূমিতে বাংলা কাব্যে বিদ্রোহের গতি আনলেন নজরুল।

“আমি দুর্ব্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!

আমি মানি নাকো কোনো আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,

ভাসমান মাইন!

আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!

আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!

বল বীর –

চির উন্নত মম শির!”(বিদ্রোহী)

এই বিদ্রোহী শক্তি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতায় প্রলয়ের দেবতা নটরাজের মতো, বিধ্বংসী সাইক্লোনের মতো, অকাল বৈশাখীর রুদ্ররূপের মতো ভয়াবহ টর্পেডো বা ভাসমান মাইনের মতো দুর্দমনীয়।

শুধু ধ্বংসই এই বিদ্রোহীসত্তার একমাত্র কাম্য নয়, তার লক্ষ্য নতুন সৃষ্টি। আর সেই প্রেরণায় জরা-জীর্ণ পুরাতনকে সে দুমড়ে মুচড়ে দিতে চায়। তাই মুক্ত জীবনের আনন্দে কখনো সে চপল, চঞ্চল, আবার প্রয়োজনে সে বিশ্বের ত্রাস। শাসন-শোষণের অবসান ঘটিয়ে চিরঅধীর এই শক্তি চির উন্নত শির। তাই কবি শেষে বলেন,

“মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত!”( বিদ্রোহী)

১৯২৭ সালে লেখা একটি ব্যক্তিগত পত্রে কবি নজরুল লিখেছেন, “নতুন করে গড়তে চাই বলে ভাঙি, শুধু ভাঙার জন্যই ভাঙার গান আমার নয়। আর ওই নতুন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি।”

অর্থাৎ যুগের হিড়িকে শুধু অচলায়তন ভেঙে তছনছ করে দেওয়াই তার লক্ষ্য নয়। পুনর্নিমানেই তার ভাবনা স্থিতি পায়।

দেশের তরুণ যুবশক্তির অনির্বাণ বিপ্লবচেতনার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা, বিদেশি শাসকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং সমাজের অত্যাচারী ক্ষমতালোভী তোষণকারীদের প্রতি বিদ্রুপ আর প্রতিবাদ নজরুলের কবিতার অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে।

তাই ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’, ‘চির বিদ্রোহী কবি নজরুল’ এই হল বাংলা ও বাঙালীর কাছে নজরুলের প্ৰচলিত পরিচয়।

কিন্তু বিদ্রোহী সত্তার মধ্যে কোথাও কোথাও দেখা যায় স্ববিরোধ।

আস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী নজরুল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলে লেখেন, “আমি জানি এবং দেখেছি- আজ এই আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় একা আমি দাঁড়িয়ে নেই আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাাঁড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনি নীরবে তাঁর রাজ্যবন্দ্রী সত্য-সৈনিকের পশ্চাতে এসে দন্ডায়মান হন।”

সৃষ্টিকর্তার ওপর নজরুলের এই প্রত্যয়ীমূলক বক্তব্য, এবং সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী নজরুলের এই বিশ্বাস বলতে গেলে একেবারে রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্যবাদিতার কাছাকাছি। কিন্তু আবার এই নজরুলই আপন সত্য আর নীতি ছাড়া কোনো দৈবী শক্তিকে অস্বীকার করে বলেন, “আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন”।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এই বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তিনিই ভগীরথ নন। যদি বিদ্রোহ বলতে বোঝায়, প্ৰচলিত নিয়মতন্ত্রের বাইরে স্পর্ধিত পদক্ষেপ, তাহলে বাংলা কাব্যধারায় সর্বব্যাপক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন শ্রী মধুসূদন। ঈশ্বরগুপ্ত, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও দেশাত্মবোধ, দেশমাতৃকার সংকট মোচনের জন্য কলম তুলেছেন, কাব্যে প্রতিবাদী গনচেতনার জয়গান গেয়েছেন। কাজেই , নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’, শুধু এটুকুই বললেই কবিমানসের স্বাতন্ত্র স্পষ্ট হয়না। প্রকৃতপক্ষে, নজরুলের কণ্ঠে বিদ্রোহ এত গভীর, তীব্র আর আন্তরিক হয়ে শোনা গেল যে , মনে হল এই আবেদন একদম নতুন। আগে ঠিক এই রকম করে সোচ্চার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের স্ফূরণ ঘটেনি। মানব সত্তার জয় ঘোষণার এত জোরালো কণ্ঠ আগে আসেনি,

“গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”(মানুষ)

মানুষের পক্ষে যা মঙ্গল ও শুভ তাইই কবির কাঙ্খিত। সে জন্য প্রচলিত রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে ঘোষিত বিদ্রোহ এনেছেন তিনি তার কবিতায়। বিদ্রোহী কবিতায় যখন তিনি বলেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’ তখন যে চরম আত্মপ্রত্যয় শোনা যায় কবির কণ্ঠে সেটাই তার বিদ্রোহী সত্তার মূল স্তম্ভ।

অধ্যাপক প্রীতি কুমার মিত্র এটিকে ‘উল্লম্ব ব্যক্তিত্ববাদ’ বলে অভিহিত করেছেন, সেটির চরম প্রকাশ হচ্ছে কবিতাটির শেষ পঙক্তিদ্বয়ে : ‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর…/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’

‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কবি জোর দিচ্ছেন ব্যক্তি-মানুষের বিবেকের ওপর। তাঁর মতে, “নিজেকে চিনলে, নিজের সত্যকেই নিজের কর্ণধার মনে জানলে নিজের শক্তির ওপর অটুট বিশ্বাস আসে। … আত্মাকে চিনলেই আত্মনির্ভরতা আসে। এই আত্মনির্ভরতা যেদিন সত্যি সত্যিই আমাদের আসবে, সেই দিনই আমরা স্বাধীন হব, তার আগে কিছুতেই নয়।” অর্থাৎ প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করা শুধু নয়, নিজের অন্তরের শাসন মেনে চলা। কোনো আড়াল না রেখে নিজেকে সৎভাবে প্রকাশ করা। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই বলেছিলেন, “অরুগ্ন-বলিষ্ঠ-হিংগ্র-নগ্ন-বর্বরতা তার অনবদ্য ভাবমূর্তি রয়েছে কাজীর কবিতায় ও গানে। কৃত্রিমতার ছোঁয়া তাঁকে কোথাও ম্লান করেনি, জীবন ও যৌবনের সব ধর্মকে কোথাও তা অস্বীকার করেনি। মানুষের স্বভাব ও সহজাত প্রকৃতির অকুণ্ঠ প্রকাশের ভেতর নজরুল ইসলামের কবিতা সব দ্বিধা-গুণের ঊর্ধ্বে তা আসন-গ্রহণ করেছে।”

বিদ্রোহকে জনমানসে সঞ্চারিত করে দেবার জন্য ‘ধূমকেতু’ নামে একটি পত্রিকা ১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট তিনি প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন,

“ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।”

এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর ঘোষণা,

“দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা ভণ্ডামি মেকি তা সব দূর করতে ধূমকেতু হবে আগুনের সম্মার্জনী।” পত্রিকাকে অভিনন্দন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণীতে লিখেন- “আয় চলে আয়, যে ধূমকেতু /আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালো হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন।” বিপ্লবী কার্য কলাপকে সরাসরি সমর্থন জানাতে দ্বিধায় কুণ্ঠিত হননি নজরুল। এই পত্রিকা একটা পরাধীন দেশের নাগরিকদের বাঙময় ভাষ্য হয়ে ওঠে।

নজরুল সাম্যবাদের কবি, নজরুল জন ও জনতার কবি। মানবপ্রেম, উদার অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতার মূল আকর্ষণের বিন্দু। তাই অনেক বড় অংশের জনগণের মনে তাঁর কবিতা আবেদন সৃষ্টি করেছিল। তিনি চড়া সুরে প্রতিবাদ জানান। তীব্র আবেগে থরো থরো কম্পিত হয় তার কণ্ঠ। এই আবেগ প্রকৃতপক্ষে কবিমানসের আরেকটি দিকের আলোচনাস্থল উন্মুক্ত করে। তা হল তাঁর রোম্যান্টিকতা। একটু গভীরে গিয়ে অনুভব করলেই বোঝা যায়, নজরুলের যাবতীয় বিদ্রোহ মূলত তাঁর রোম্যান্টিক মানসিকতারই অনিবার্য পরিণাম।

“নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহ এবং রোম্যান্টিকতা একই মানসিকতার দ্বৈত প্রকাশ মাত্র।”

-শ্রী শশিভূষণ দাশগুপ্ত/ কবি যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম পর্যায়।

কবি Walt Whitman একদা বলেছিলেন, “who touches the books, touches a man.” নজরুল সম্পর্কে মন্তব্যটি অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত। এক প্রবল ব্যক্তিচরিত্রের স্পর্শ পাওয়া যায় তাঁর গানে ও কবিতায়। সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত দোষ ত্রুটি সবই প্রতিফলিত। এই দীপ্ত আবেগের প্রাবল্যই নজরুলের ব্যক্তি পরিচয় ও কাব্য পরিচয়। এই জন্যই কবি বুদ্ধদেব বসু নজরুলের সম্পর্কে একটি সঠিক বিশেষণ ব্যবহার করেছেন, “স্বভাব কবি”। (রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক)

নজরুল মূলত হৃদয়নির্ভর প্রেরণায় বিশ্বাসী। কিন্তু সেই তদ্গত আবেগকে যথাযথরূপে পাঠকমনে স্থায়ী ইম্প্রেশন রূপে গড়ে দিতে সাহিত্যিক প্রকাশে যে নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন, তা নজরুলের মধ্যে ছিল না। তাই , “নজরুলের কবিতা অসংযত, অসমবৃত, প্রগলভ। আগাগোড়াই তিনি প্রতিভাবান বালকের মত লিখে গেছেন।”(বুদ্ধদেব বসু)

তবুও তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও অনুভূতির সততা এই সব বিচ্যুতিকে ঢেকে দেয়।

নজরুলের প্রতিভার যথার্থ পরিচয় মেলে বিদ্রোহী ভাবনার কবিতার চেয়েও বেশি রোম্যান্টিক ভাবনার কবিতায়। ‘বিদ্রোহী’ , ‘সাম্যবাদী’ বা ‘মানুষ’ ইত্যাদি কবিতায় হৈ চৈ আছে, আবেগের ফেনায়িত তরঙ্গ আছে, শব্দের অতিরেক আছে। কিন্তু যখন বিদ্রোহী সত্তার তরঙ্গ সরে যাবার পরে আত্মপ্রকাশ করে কবির রোমান্টিক কবি সত্তা – ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ‘গানের আড়াল’, ‘অভিশাপ’ জাতীয় বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবিতাইয়, মনে হয় তা যেন কবি নজরুলের স্বগত সংলাপ।

বিদ্রোহী সত্তা ও রোমান্টিক কবিসত্তা, এই পরস্পর দুই বিরোধী প্রবণতা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে অবস্থান করেছে নজরুলের কাব্যচর্চায়। ফলে ‘অগ্নিবীণা’ র বিদ্রোহের পর ‘দোলন চাঁপা’য় এসেছে প্রেমের কথা। ‘ছায়ানটে’ কবি ছন্দের নেশা ও ভাবের মাধুর্যে বিভোর। আবার তারপরেই ‘ভাঙার গান’ , ‘বিষের বাঁশি’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণী মনসা’য় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সমকালীন রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বা রাজনীতির আবর্তে। এরপর যখন ‘সিন্ধু হিন্দোল’এ ‘আবার ফিরে এল বসন্ত দিন’ তখন তিনি জীবন রহস্য অনুসন্ধানে যেমন মনোযোগী, তেমনই নিবিষ্ট চিত্র রচনায়। এই পর্যায়ে তিনি কখনও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বা বুদ্ধদেব বসুর সহযাত্রী। এই বৈপরীত্যের বোধ অনুভব করেই শ্রী শশিভূষণ দাশগুপ্ত তার

‘কবি যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম পর্যায়’ গ্রন্থে বলেছেন, “তাঁহার কবিতায় তাণ্ডব ও লাস্য পাশাপাশি স্থান পাইয়াছে।”

‘দোলনচাঁপা’র অন্তর্গত ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ র উল্লেখ করা যায়। সৃষ্টির আনন্দসুধা আর নির্মাণের গৌরবই এই কবিতার মূল সুর। নজরুলের এই রোম্যান্টিক পর্যায়ের কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। ‘অন্তর হতে আহরি বচন’ রবীন্দ্রনাথ চিত্রা কাব্যে যে ‘আনন্দ লোক’ রচনার কথা বলেছেন, একটি কবিতা হয়ে ওঠার যে আনন্দময় উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন, তারই কিছুটা স্পর্শ যেন নজরুলের অনুভবের সাথে মিশে যায়,

“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–

মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে –

বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।

আসল হাসি, আসল কাঁদন

মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,

মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।

ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে –

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!”

আনন্দের অপরিমেয় উদ্বেলতা, এবং বেদনার লবণাক্ত অশ্রুজলরাশি দুইই কবির রোমান্টিকতার মূলে।

রোম্যান্টিকতার অন্যতম লক্ষণ , return to nature, প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন। পাশ্চাত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ প্রমুখ কবিদের কাব্যে লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তনের এই আন্তরিক আকুলতা। বাংলা কাব্যে বিহারীলাল থেকে যে রোমান্টিকতার সূচনা, রবীন্দ্রনাথে যার পরিণতি সেখানে প্রকৃতি দীর্ঘ অংশ জুড়ে আছে। প্রকৃতি বর্ণনায় কবি নজরুলেরও সৌন্দর্যপ্রিয় মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় গুবাক তরুকে প্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। চিত্রময়তার সঙ্গে সঙ্গীতময়তার অপূর্ব সংমিশ্রন ঘটেছে।

প্রেম ও প্রকৃতি নিয়েই রোমান্টিক কবির কাব্যলোক। শব্দ ও ছন্দের সৌরভে তিনি তার পূর্ণতা আনেন। বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবিতা উৎকর্ষ পায় রাধা কৃষ্ণের লীলায়। আধুনিক যুগে মাইকেলের কাব্যে রোমান্টিক ভাবাবেগের সঙ্গে মিশে গেছে ভাবগভীরতা। বিহারীলালের কাব্যে প্রেমের ভাব বিভোরতা থাকলেও গভীরতা নেই। প্রেমের গভীরতা আবেগের বিচিত্র প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা প্রেম করি এবং প্রেমকে গড়ি।’

এ পটভূমিতেই নজরুলের প্রেম বিচার্য। তত্ত্ব নয়, প্রেমের আবেগই তাঁর কাছে মুখ্য। মানবিক জীবনের অতি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি প্রেম। কিন্তু নজরুল কাব্যের স্পর্শে সুপ্ত প্রেম চেতনা যেমন জেগে উঠেছে, তেমনি প্রকৃতি পরিবেশ ও পৃথিবীকে মায়াজালের স্পর্শে অপূর্ণ করে তুলেছে। তাঁর প্রেমের কবিতায় অভিমান আছে, অভিযোগ আছে,

ব্যর্থতাজনিত হা-হুতাশ আছে, বিরহের তীব্র জ্বালা আছে, এমনকি তাঁর অনেক কবিতায় ভোগবাদী দর্শনেরও প্রভাব আছে। এ ধরনের কবিতায় দৈহিক বাসনা ও কামনার নিরাভরণ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

”তোমারে করিব পান, অনামিকা, মত কামনায়

ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়।”( অনামিকা)

প্রকৃতির মাঝে আত্মভাবের বিস্তার এবং একই সঙ্গে প্রকৃতির উপাদান সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবির সহজাত বৈশিষ্ট্য। কবি নজরুলের কবিতাতেও তার প্রকাশ মেলে,

“আজ লালসা আলসমদে বিবশ রতি

শুয়ে অপরাজিতায় ধনী স্মরিছে পতি।

তার নিধুবন – উন্মন

ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন

বুকে পীন যৌবন

উঠিছে ফুঁড়ি

মুখে কাম কণ্টক ব্রণ মহুয়া কুঁড়ি।”(মাধবী লতা)

এভাবেই রুদ্র থেকে রতি, আবার রতি থেকে রুদ্র, প্রেম থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে প্রেম, এভাবেই তার কবিমন যাতায়াত করেছে বারবার। নজরুলেরই একটি কবিতার চরণ উদ্ধৃত করছি, তাঁর এই প্রবণতা বোঝাতে, “একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য।”

পরিশেষে বলা যায়, নজরুলের বিদ্রোহীসত্তাই বেশি প্রকট। রোমান্টিক কবি সত্তাকে ছাপিয়ে গিয়ে নজরুল বাঙালি পাঠকের কাছে ‘বিদ্রোহী কবি’। আর সে বিদ্রোহ অত্যন্ত চড়া সুরের। আসলে, যে যুগের প্রতিনিধি কবি নজরুল, সেটা একটা নেতিবাদী যুগ। আতিশয্যই তার স্বভাবধর্ম। তার কবিকণ্ঠে সমগ্র বাংলা ও বাঙালী যেন মুখর হয়ে ওঠে। এই যুগযন্ত্রণাকে যেমন যুক্তি দিয়ে সংযত করা যায় না, অসহায় আর্তনাদকে যেমন শিল্পবোধের মানদণ্ডে বিচার করা যায় না , নজরুলের কবিতার বিচার শুধু শিল্পমূল্যে নয়। নজরুলের কবিতা যেন একটা যুগ, বিদ্রোহী বাঙালির মর্মবাণী। কবি নিজেও সেটা বুঝতেন। তাই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নিজের কবিসত্তার মূল্যায়ন করে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে পেরেছেন,

“বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’

কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি !

কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে

ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে !

যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে –বাণী কই, কবি ?’

দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী !”

কিন্তু যে ভবিষ্যৎ তিনি আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তাতেও তিনি প্রাসঙ্গিক। হয়ত বিপ্লবের কালাপাহাড় বন্দনার যুগগত প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে কিন্তু, মানবপ্রেমের যে বাণী তাঁর কবিসত্তার মূল চালিকাশক্তি তার উত্তরাধিকার বহন করে আমরা আজও প্রতিজ্ঞা করি,

“প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।”

****সমাপ্ত*****

সহায়ক গ্রন্থ

***********

১। গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ। সাহিত্য ও সাহিত্যিক। কলকাতাঃ ডি এম লাইব্রেরি, ১৯৫৬।

২। দাশগুপ্ত, শশিভূষণ।কবি যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম পর্যায়। কলকাতাঃ এ মুখার্জি এন্ড কোং প্রাঃ লিঃ, ১৯৫৮।

৩। খান, আজহারউদ্দীন। বাংলা সাহিত্যে নজরুল। আজহারউদ্দীন খান। কলকাতাঃ ডি এম লাইব্রেরি, ১৯৫৭।

৪। মুর্শিদ, গোলাম। বিদ্রোহী রণক্লান্ত। ঢাকাঃ প্রথমা প্রকাশন, ১৯১৮। 

হৈমন্তী ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষিকা। মূলত নিবিড় পাঠক। তুলি নিয়ে রঙের বাহারে প্রকৃতির ছবি আঁকা এবং কলমে ভাবনাকে রূপ দেওয়াই প্যাশন। ছাত্রাবস্থায় লেখালিখির সূচনা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও সংকলনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *