বাঙালি বিজ্ঞানী আর তেলখোর ব্যাকটেরিয়া

বাঙালি বিজ্ঞানী আর তেলখোর ব্যাকটেরিয়া

১৯৬৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুয়েতের আল-আহমেদি তেল শোধনাগার থেকে অশোধিত তেল ভর্তি একটি বিশাল জাহাজ রওনা দিয়েছিল। গন্তব্য ওয়েলস। তেল পরিবহনকারী অতিকায় জাহাজকে বলা হয় সুপার-ট্যাঙ্কার। ওয়েলসগামী সেই সুপার-ট্যাঙ্কারের নাম টোরি ক্যানিয়ন। সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সুপার-ট্যাঙ্কার ছিল টোরি ক্যানিয়ন। তার গর্ভে ছিল প্রায় এক লক্ষ আঠারো হাজার লিটার তেল। ১৮ মার্চ সকাল ৯টা ৩৩ মিনিটে পর্যটকদের প্রিয় কর্নিশ উপকূল ধরে এগোনোর সময় ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অতলান্তিক সমুদ্রের তলায় থাকা তীক্ষ্ণ পাথরের সাথে সংঘর্ষে ফেঁসে গেল টোরি ক্যানিয়নের তলদেশ। আঠেরোটি ট্যাঙ্কের মধ্যে চোদ্দোটি ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গল গল করে বেরিয়ে আসতে লাগল তেল। কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ল কর্নিশ উপকূলে। অতলান্তিক সমুদ্রের প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল দশ ইঞ্চি পুরু তেলের স্তর। ব্রিটেন তো বটেই, প্রমাদ গুণল বিশ্ববাসী। এত বড়ো তেল বিপর্যয় বিশ্ববাসী কখনও দেখেনি।

ওয়েলসগামী সেই সুপার-ট্যাঙ্কার –  টোরি ক্যানিয়ন

তেল নষ্ট করতে তখন বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল একটাই প্রযুক্তি – ডিটারজেন্টের ব্যবহার।

কেন ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা হত?

এটা জানতে গেলে তরল পদার্থের পৃষ্ঠটান বা সারফেস টেনশন বিষয়টি আগে জানতে হবে। জল আর তেলের মধ্যে একেবারেই বনিবনা নেই। জলের অণুগুলো পৃষ্ঠটান ধর্মের জন্য পরষ্পরকে আকর্ষণ করে নিজেদের মধ্যে যুক্ত থাকতে ভারি পছন্দ করে। এই আকর্ষণ বল হল সংশক্তি বল (Cohesive force)। আবার তেলের অণুগুলো তখনই জলের অণুর সাথে যুক্ত হতে পারবে যদি জলের কিছু হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙে যায়। কিন্তু জলের অনুগুলোর মধ্যে সংশক্তি বল এত বেশি যে তাদের হাইড্রোজেন বন্ধন ভাঙা সহজ নয়। আর তাই বেচারা তেল জলের সাথে মিশতে পারে না। জল অণুগুলোর এই জোটবন্ধন ভাঙতে হলে তাই দরকার কোনও সারফেকট্যান্ট। ডিটারজেন্ট হল তেমনই এক রাসায়নিক যা জলের অণুগুলোর মধ্যে আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। কীভাবে? ডিটারজেনেটের রয়েছে দু’হাত – ধরা যাক ডান হাত যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলবো হাইড্রোকার্বন মস্তক, আর বাম হাত যা হাইড্রোকার্বন পুচ্ছ। ডিটারজেন্ট ডান হাতে ধরে জলের অণুকে, আর বামহাতে তেলের অণুকে। এর ফলে যে লবন তৈরি হল তা আয়নিত হয়ে যায়। এতে তেলের কণা হয়ে যায় ঋণাত্মক আধানগ্রস্ত।  তখন তেলের কণাগুলো বিকর্ষিত হয়ে পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ফলে জলের ওপর তেলের আস্তরণ ক্রমশঃ পাতলা হয়ে যেতে থাকে। এই হল জল থেকে তেল সরাতে ডিটারজেন্টের কারিকুরি।

যাইহোক, দমকল ও সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে প্রায় দশ হাজার টন ডিটারজেন্ট ছড়ানো হল সমুদ্রে ভাসমান তেলের ওপর। কিন্তু তাতেও কি সব তেল নষ্ট করা যায়? নিরূপায় ব্রিটেন সরকার ট্যাঙ্কারের অবশিষ্ট তেল পুড়িয়ে ধ্বংস করার জন্য বিমানবাহিনীর সাহায্যে টোরি ক্যানিয়নের ওপর শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করল। ভয়ানক বিষ্ফোরণ হল। কিন্তু আগুন বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না সমুদ্রের জোরালো ঢেউয়ের জন্য। ফলে ধ্বংস হওয়া ট্যাঙ্ক থেকে আরও তেল বেরিয়ে এল। ১৯০ কিলোমিটার কর্নিশ উপকূল, এমনকি ফ্রান্সের ৮০ কিলোমিটার উপকূল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।  এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় পনেরো হাজার সামুদ্রিক পাখি মারা গেল। পরে সংখ্যাটা প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছোয়। হাজার হাজার সামুদ্রিক প্রাণী মারা পড়ে। ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে এমন তেল বিপর্যয় থেকে দ্রুত উদ্ধারের কোনও উন্নত প্রযুক্তি সেই সময়ে ছিল অধরা। আসলে সেই সময়ে এ নিয়ে তেমন গবেষণাও হয়নি। আর তাই টোরি ক্যানিয়ন তেল বিপর্যয় থেকে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার দ্রুত ও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত জ্ঞান ছাড়া বিজ্ঞানীরা অন্য কোনও উন্নততর প্রযুক্তির কথা জানাতেও পারেননি।

এমন বিপর্যয় তো ঘটতে পারে আবারও। তখন কী হবে! বিশ্বের তাবড় তাবড় শিল্প সংস্থা এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে বিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হলেন। বিজ্ঞানীরাও নেমে পড়লেন নতুন প্রযুক্তির খোঁজে। অশোধিত তেল হল বিভিন্ন কার্বন সমন্বিত অণু (হাইড্রোকার্বন) দ্বারা গঠিত যৌগ। লন্ডনে ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ওই সময় এককোশি ছত্রাক ইস্টের বংশবৃদ্ধি করে ইস্টকে দিয়ে হাইড্রোকার্বন খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন। ঠিক সেই সময় আমেরিকায় জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির গবেষণা বিভাগে কাজ করছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি ইম্পেরিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজের বিজ্ঞানীদের ওই গবেষণার কথা জানতেন। তিনিও সমুদ্রে তেল বিপর্যয় থেকে পরিবেশকে রক্ষা করার বিষয়ে ভাবছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, হাইড্রোকার্বনকে ভাঙতে পারে এমন বিভিন্ন এনজাইম প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারে তাঁর কিছু পূর্ব ধারণা আছে, কারণ তিনি এই বিষয়ে বেশ কিছুদিন গবেষণা করেছেন।

ওই সময় বিজ্ঞানীদের কাছে কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার কথা জানা ছিল যেগুলি তেলের হাইড্রোকার্বনকে ভক্ষণ করতে সক্ষম। এদের তৈলখাদক বা সোজা বাংলাতে তেলখোর ব্যাকটেরিয়া (Oil eating Bacteria) বলে। তবে এককভাবে একটি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষমতা অনেক কম। আবার তেলখোর ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন স্ট্রেন একসাথে থাকলে তারা পরস্পর প্রতিযোগিতা করে তেল ভক্ষণের হার আরও কমিয়ে দেয়।

তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানীটি সেই ব্যাকটেরিয়াগুলির অন্যতম সিউডোমোনাস পুটিডা (Pseudomonas putida) নিয়ে গবেষণা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর গবেষণার বিষয় তেল ভক্ষণ ছিল না। তিনি ওই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণার সূত্রেই শিকাগোর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী জৈব রসায়নবিদ ও ব্যাকটেরিয়া বিশেষজ্ঞ আরউইন গুনসালাসের আহ্বানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট করতে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন।

আরউইন গুনসালাস            বাঙালি বিজ্ঞানী – ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী

সিউডোমোনাস পুটিডা হল মাটিতে বাসকারী একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়াটি মাটির জৈব বস্তুকে ভেঙে সুগার ও অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত করে। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেন সিউডোমোনাস পুটিডা একটা বাদামি রঙের রঞ্জক তৈরি করে যা জলে দ্রবীভূত হলে হলুদ রঙ হয় এবং অতিবেগুনি রশ্মি প্রয়োগ করে উত্তপ্ত করলে সবুজ রঙের দ্যুতি ছড়ায়। কলকাতায় বাঙালি তরুণ গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন নামী অধ্যাপক ড. শৈলেশচন্দ্র রায়। তিনি তাঁর গবেষক ছাত্রটিকে ওই রঞ্জকের চরিত্র ও ভূমিকা নির্ণয় করতে নির্দেশ দেন। গবেষক ছাত্রটি অনেক কষ্টে মাত্র ২৫ মিলিগ্রাম রঞ্জক নিষ্কাশন করতে সমর্থ হন। এর চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেন এটি টেরিডাইন (Pteridine) নামক একপ্রকার অনু দ্বারা গঠিত যা ছত্রাক, পতঙ্গ ও কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীতে দেখা যায়, কিন্তু ব্যাকটেরিয়াতে বিরল। তবে অনেক চেষ্টা করেও ওই ব্যাকটেরিয়াতে রঞ্জকটি কী ভূমিকা পালন করে তা নির্ণয়ে তিনি ব্যর্থ হন।

তাঁর এই গবেষণাপত্র ড. গুনসালাসের নজর এড়ায়নি। তিনিও সিউডোমোনাস পুটিডার একটি স্ট্রেন নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, ব্যাকটেরিয়াটি কর্পুরকে বিয়োজিত করে তা ভক্ষণ করতে সক্ষম। গুনসালাস ওই বাঙালি তরুণ গবেষকটিকে চিঠি লিখলেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য। দু’চোখে স্বপ্ন মেখে তরুণ গবেষক কলকাতা থেকে পৌঁছোলেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এখানেই তিনি আবিষ্কার করলেন ব্যাকটেরিয়াটির একটা বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য। তিনি দেখলেন, কর্পুরকে বিয়োজিত করার জন্য পুরো জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি যে জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা ব্যাকটেরিয়াটির আসল DNA তে নেই, রয়েছে প্লাজমিডে (Plasmid)। প্লাজমিড হল ব্যাকটেরিয়ায় উপস্থিত অতিরিক্ত একটি অতি ক্ষুদ্রাকার ও চক্রাকার DNA। প্লাজমিড সব ব্যাকটেরিয়ার সব স্ট্রেনে থাকে না। যে স্ট্রেনে প্লাজমিড রয়েছে সে সংযুক্তি (Conjugation) নামক একপ্রকার বিশেষ যৌন জনন পদ্ধতিতে যে ব্যাকটেরিয়ায় ওই প্লাজমিড নেই তাকে প্লাজমিড সরবরাহ করে। এভাবেই ব্যাকটেরিয়ার যে স্ট্রেনে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল না সে তা পেয়ে যায়। সিউডোমোনাস পুটিডা নিয়ে বাঙালি গবেষকটির গবেষণার অগ্রগতি ছিল ওই পর্যন্তই কারণ এর পর পর তিনি জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে যোগদান করেন। আর এখানে তিনি ভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষনায় লিপ্ত হয়ে যান, ফলে সিউডোমোনাস পুটিডার প্লাজমিড নিয়ে আর চর্চা করা সম্ভব হয়নি। ঠিক এই সময়েই ঘটেছিল টোরি ক্যানিয়ন বিপর্যয়।

বাঙালি তরুণ বিজ্ঞানীটি ভাবলেন, যে সব ব্যাকটেরিয়ার তেল ভক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে তাদের সেই তেল ভক্ষণকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনকে যদি শনাক্ত করা যায় এবং তা প্লাজমিডে অবস্থিত কিনা নির্ণয় করা যায় তবে সেই সব জিনের একত্র সমাবেশের চেষ্টা করে নতুন একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া উদ্ভব করা যেতে পারে। ভাবনাটা প্রকাশ করতেই জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা দারুণ তারিফ করলেন এবং তাড়াতাড়ি ওই গবেষণা শুরু করতে বললেন। সত্যিই এমনটা তো আগে কেউ ভাবেননি। তরুণ বিজ্ঞানীটি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেন থেকে চারটি প্লাজমিড চিহ্নিত করলেন যেখানে তেল ভক্ষণকারী জিন অবস্থিত। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে তিনি প্লাজমিডগুলোর কম্বিনেশন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। শেষে দুটি প্লাজমিডকে তাঁর বেশ মনে ধরল। এবার অতিবেগুনি রশ্মি প্রয়োগ করে তিনি দু’প্রকার প্লাজমিড একসাথে জুড়ে দিয়ে সিউডোমোনাস পুটিডা ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তা প্রবেশ করালেন এবং দেখতে লাগলেন ওই জোড়া প্লাজমিডের তেল ভক্ষণকারী দুটি জিন একসাথে সক্রিয় হয় কিনা।

ইউরেকা! দুটি জিনই সক্রিয় হল। দেখা গেল সংযোজিত প্লাজমিড সমন্বিত সিউডোমোনাস পুটিডা তেল ভক্ষণে অনেক বেশি পটু হয়ে উঠেছে। দুটি জিন পৃথক পৃথকভাবে তেল বিয়োজনে যতটা কার্যকর, দেখা গেল সংযোজিত অবস্থায় তারা দ্বিগুণের বেশি কার্যকর। তিনি তো এটাই চাইছিলেন। সময়টা ১৯৭১ সাল। তৈরি হয়ে গেল ইতিহাস। বিশ্বে এই প্রথম ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব হল জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে এক নতুন ব্যাকটেরিয়া (Genetically engineered bacteria)। আর এর সাথে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে গেল সেই তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম – ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত এই ব্যাকটেরিয়ার নাম দিলেন “Multiplasmid hydrocarbon degrading Pseudomonas”। সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়লে জিন প্রকৌশলে প্রস্তুত সিউডোমোনাস পুটিডার ওই স্ট্রেন তেলের দুই তৃতীয়াংশ হাইড্রোকার্বন বিয়োজিত করতে সক্ষম।

তবে গল্পের শেষ এখানেই নয়, বরং দ্বিতীয় এক অধ্যায় শুরু। ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী এবার ওই ব্যাকটেরিয়ার পেটেন্টের জন্য আবেদন করলেন। ড. চক্রবর্তী অবশ্য পেটেন্টের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তাঁকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির সহ-সভাপতি আর্থার বুচে। তিনি ড. চক্রবর্তীকে পেটেন্ট অফিসে আবেদন করতে বলেন এবং পেটেন্ট পাওয়ার আগে এই আবিষ্কারের ব্যাপারে প্রচার করতেও মানা করেন। ১৯৭২ সালের ৭ জুন ড. চক্রবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্টের পেটেন্ট অফিসে আবেদনপত্র জমা দেন। এই আবেদনপত্র ছিল বিশ্বে প্রথম কোনও জিন-পরিবর্তিত জীবের (Genetically Modified Organism বা GMO) পেটেন্টের জন্য আবেদনপত্র।

কিছুদিন পর পেটেন্ট অফিস থেকে চিঠি এল – আবেদন খারিজ। কারণ হিসেবে বলা হল, জীবিত কোনও বস্তুর পেটেন্ট দেওয়ার আইন নেই।

কথাটা মিথ্যেও নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো প্রাকৃতিক জীবের কথাই ধরা হয়েছে। যে জীব প্রকৃতিতে নেই, কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে, তার ক্ষেত্রে কেন পেটেন্ট হবে না? তৎকালীন মার্কিন পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক কমিশনার সিডনি ডায়মন্ড পেটেন্ট না-মঞ্জুর করার জেদে অটল রইলেন। বাধ্য হয়ে ড. চক্রবর্তী US Court of Customs and Patent Appeals –এ আবেদন করলেন। রায় এল ড. চক্রবর্তীর পক্ষে।

ঐতিহাসিক এই রায়ে বলা হল, “The fact that microorganisms are alive is without legal significance for purpose of patent law.”। কিন্তু পেটেন্ট কমিশনার এই রায় মানলেন না। তিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলেন। এই মামলাও স্থান পেল ইতিহাসের পাতায় “Diamond Vs Chakrabarty” মামলা হিসেবে। আট বছর ধরে চলেছিল সেই মামলা। অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৬ জুন ন’জন বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করল আরো এক ঐতিহাসিক রায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির (পাঁচ জন) সম্মতির ভিত্তিতে GMO এর ওপর পেটেন্ট দেওয়ার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। এই লড়াইয়ে ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী কেবল জয়ী হলেন না, সারা বিশ্বে GMO এর ওপর পেটেন্টের পথ খুলে গেল। আন্তর্জাতিকভাবে বিরাট পরিচিতিলাভ করলেন ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী। বিজ্ঞানীমহলে তাঁর নতুন নামকরণ হল “প্রফেসর সিউডোমোনাস”।

কিন্তু আফশোসের কথা, এই খ্যাতিমান প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানীকে বাঙালি সেভাবে চেনেইনি। আরও ভালো করে বললে, চেনানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বীরভূম জেলার সাঁইথিয়ায় এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে আনন্দমোহনের জন্ম হয় ১৯৩৮ সালের ৪ এপ্রিল। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। বাবা ও তাঁর অগ্রজ ভাইদের উৎসাহে তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। জীবন বিজ্ঞান ও জৈব রসায়ন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। সাঁইথিয়া হাইস্কুল ও বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করে স্নাতক স্তরে পড়ার জন্য কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পি এইচ ডি করেন।

ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী তৈলখাদক ব্যাকটেরিয়া উদ্ভাবন ও তার পেটেন্ট নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর একাধিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। পাশাপাশি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগে অধ্যাপনাও করেছেন। ২০০১ সালে তিনি শিকাগোতে CDG Therapeutics নামে একটি নিজস্ব কোম্পানি খোলেন। তাঁর এই কোম্পানি বর্তমানে পাঁচটি পেটেন্টের মালিক। ২০০৮ সালে তিনি গুজরাটের আমেদাবাদে Amrita Therapeutics Ltd নামে একটি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিও খোলেন। মূল উদ্দেশ্য ক্যানসার ও নানা ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগের ঔষধ ও টিকা আবিষ্কার করা। HIV-র বিরুদ্ধে কার্যকরী ওষুধ ATP-01 এবং স্লিপিং সিকনেশ রোগের দাওয়াই Protozoal এই কোম্পানি থেকেই তৈরি হয়েছে।

১৯৮০-র দশকের শুরুর দিক থেকে আমেরিকায় আণবিক জীববিদ্যা ও জৈব প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে নানা বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করল। শিল্পপতিরা তাঁদের দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন আগামীদিনে আণবিক জীববিদ্যা ও জৈবপ্রযুক্তি মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জও বুঝতে পেরেছিল, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ণ করতে হলে জৈবপ্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। ১৯৮৪ সালে প্রফেসর চক্রবর্তী ভিয়েনাতে United Nations Industrial Development Organization –এর সভায় যোগ দিলেন এবং সেই সভা থেকেই গঠিত হয়েছিল International Centre of Genetic Engineering and Biotechnology (ICGEB)। শুরু থেকেই প্রফেসর চক্রবর্তী এর বৈজ্ঞানীক উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ICGEB পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করে। ICGEB-এর প্রথম ডাইরেক্টর হন প্রফেসর চক্রবর্তীর পোস্ট ডক্টরেট গাইড প্রফেসর গুনসালাস। ইতালিতে ICGEB-এর প্রথম গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার পর দ্বিতীয় গবেষণাকেন্দ্র নতুন দিল্লিতে গড়ে তোলার পেছনে প্রফেসর চক্রবর্তীর উৎসাহ ছিল অনস্বীকার্য। এইসব গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সদস্য দেশগুলোতে জৈবপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য জৈবপ্রযুক্তিতে আগ্রহী ও দক্ষ কর্মী তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। সম্প্রতি ভারতের এক জৈবপ্রযুক্তি শিল্প সংস্থা থেকেই তৈরি হওয়া এইডস, হেপাটাইটিস বি ও সি এবং ডেঙ্গু নির্ণয়ের কিট চল্লিশটির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তাই ভারতে জৈবপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে অনেকটাই অবদান রয়েছে এই কৃতী বঙ্গসন্তানের।

কিছুদিন আগে প্রফেসর চক্রবর্তী মেক্সিকোর উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিগুয়েল গোমেজ লিম এবং পর্তুগালের ক্যানসার-বিজ্ঞানী আর্সেনিও ফিয়ালহোর সাথে যৌথভাবে অসাধারণ একটি কাজ করেছেন যা আগামীদিনে ক্যানসার গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হতে পারে। তাঁরা জিন-প্রতিস্থাপিত টমাটোর মধ্যে টিউমার প্রতিরোধী ওষুধ ইন্টারলিউকিন-২ উৎপাদন করতে সমর্থ হয়েছেন। তারপর সেই টমাটো তাঁরা ক্যানসার আক্রান্ত ইঁদুরকে খাইয়ে দিব্যি সুস্থ করে তুলেছেন। ২০১৫ সালে তাঁরা ক্যানসার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত জিন-পরিবর্তিত খাদ্যের পেটেন্টের জন্য আবেদনও করেছেন। এ যেন সুকুমার রায়ের হাঁসজারু বা হাতিমির মতো ব্যাপার! টমাটোর মধ্যে ক্যানসার প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি করার কথা শুনে অনেকের কাছে কল্পকাহিনি মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি, বাস্তব। পথ দেখিয়েছেন বঙ্গসন্তান আনন্দ মোহন চক্রবর্তী। আর সেজন্য তিনি বলেছেন, “স্বপ্ন দেখা থামিও না। আজ ইঁদুরে সফল হয়েছে। আগামীকাল বানরে হবে। আর আগামী পরশু মানুষ ক্যানসারের ওষুধ পাবে টমাটো স্যুপের ক্রিমে, পালং স্যালাডে কিংবা গাজর স্টিকে। আমি এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছোতে চাই যাদের দামী ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। মানুষ এটাকে স্বপ্ন ভাবতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি এটা কার্যকরী করার ভালো সুযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞানী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামও দেশের যুবসমাজকে স্বপ্ন দেখা না-থামাতে আহ্বান করেছিলেন। প্রফেসর চক্রবর্তীও করেছেন। কারণ স্বপ্নের পথ ধরেই তো সাঁইথিয়ার অখ্যাত গাঁয়ের এক সাধারণ ছেলে আজ বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন প্রফেসর সিউডোমোনাস নামে।

বাঙালিরা খুব বেশি না চিনলেও বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী এক সমীহ জাগানো নাম। তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জে United Nations Industrial Development Organisation-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের National Academy of Science and National Research Council –এর সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এমনকি তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিচারপতিদের পেটেন্ট সংক্রান্ত বিষয়ে অন্যতম পরামর্শদার ভূমিকাও পালন করেছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান পরামর্শদাতা বোর্ডের সদস্য থেকেছেন, যেমন মিচিগান বায়োটেকনোলজি ইন্সটিটিউট, মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর বায়োফিল্ম ইঞ্জিনিয়ারিং, মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর মাইক্রোবিয়াল ইকোলজি, কানাডায় ব্যাকটেরিয়াল ডিজিস নেটওয়ার্ক ইত্যাদি। কিছুদিন আগে তিনি কানাডার সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞান পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ২০২০ সালের ১০ জুলাই ৮৩ বছর বয়সে এই খ্যাতিমান বাঙালি বিজ্ঞানীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। কিন্তু যতদিন অণুজীববিদ্যা বা মাইক্রোবায়োলজি এবং জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি কথা দুটি মানবসভ্যতায় বিরাজ করবে ততদিন প্রফেসর সিউডোমোনাসের নাম বিজ্ঞানাকাশে জ্বলজ্বল করবে।

 

বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *