রঙ্গমঞ্চের অন্তরালে - প্রচারবিমুখ প্রচারবিদ
বিবাহসূত্রে আমি যে বাড়িতে এসেছি, সেই সেনগুপ্ত পরিবারের বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যবসা ছিল। বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার যোগাযোগ থাকে। সেই সূত্রেই পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তাঁদের অন্তরঙ্গতা। নেপথ্যে, সবার অগোচরে থেকেও সেনগুপ্ত পরিবার বাংলার রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। পারিবারিকসূত্রে জেনেছি সে কাহিনি। আমার স্বামী, শ্রীপ্রবাল সেনগুপ্তের কাছে আমি যা শুনেছি তাই লিখছি। লেখাটি তাঁরই জবানিতে।
১৯৫২-৫৩ সালের কথা। দেশ স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আবহে। দুর্ভিক্ষে মারা গেছেন বহু মানুষ। কলকাতায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছে। শুধু বেঁচে থাকার জন্যেই কঠিন লড়াই, বিনোদন বা আমোদপ্রমোদের সাধ, সাধ্য – কোনোটাই নেই। বাংলার রঙ্গমঞ্চগুলি দর্শকের অভাবে ধুঁকছে। প্রেক্ষাগৃহে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গুটিকয়েক মাত্র দর্শক। জরাজীর্ণ মঞ্চ, বিবর্ণ দৃশ্যপট সম্বল করে একদল নাটক-পাগল মানুষ তাঁদের নাটকের নিয়মিত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। ভালো নাটকেরও দর্শক নেই, মঞ্চমালিকরা ধারদেনায় ডুবে আছেন।
প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত অনেকগুলো বছর স্টার থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার বেশ কয়েকবছর আগেই চাকরি ছেড়ে এসেছেন। একের পর এক উৎকৃষ্ট নাটক উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের ‘টিপু সুলতান’ তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। এই নাটকেই প্রথম অভিনয় করতে আসেন শিশু অনুপকুমার, যিনি পরে চলচ্চিত্রের মহীরূহ হয়ে উঠেছিলেন। উনিশশো আটচল্লিশে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ নাটক তিনি শুধু পরিচালনাই করেননি, রামেশ্বরের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। ‘কঙ্কাবতীর ঘাট,’ ‘রাজসিংহ,’ ‘সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত,’ ‘রাণী ভবানী’ – স্টারে একের পর এক মঞ্চসফল নাটক এসেছে তাঁর হাত ধরে।
সে সময় স্টার থিয়েটারে সবে মহেন্দ্র গুপ্তর জমানা শেষ হয়েছে। কঠিন, টালমাটাল পরিস্থিতিতে একটার পর একটা নাটক ফ্লপ। স্টার থিয়েটারের মালিক শ্রীসলিল কুমার মিত্র আর পেরে উঠছেন না। হাল ছেড়ে দিয়ে আমার জ্যাঠামশাই শ্রীযোগেন্দ্রচন্দ্র সেনগুপ্তকে বললেন, “আমি আর থিয়েটার চালাব না, আপনি একটা কিছু ব্যবস্থা করুন।” জ্যাঠামশায় ব্যবসায়ী মানুষ, অনেক চেনাজানা। সলিলবাবুর কথা শুনে তিনি মিনার, বিজলি, ছবিঘর সিনেমা হলের মালিক শ্রীহরিপ্রিয় পাল মশাইয়ের সঙ্গে স্টার থিয়েটারে সম্বন্ধে কথা বললেন। কিন্তু স্টার অধিগ্রহণ করার ব্যাপারে পাল মশাই যেসব শর্ত দিলেন তা জ্যাঠামশাইয়ের পছন্দ হল না। সলিলবাবুকে জ্যাঠামশাই বললেন, “আপনি থিয়েটার চালিয়ে যান।” সলিলবাবু বললেন, “আমি থিয়েটারের কাউকে চিনি না। কাকে নিয়ে থিয়েটার করব?”
সত্যিই সমস্যা। জ্যাঠামশাই ভাবতে লাগলেন। মহেন্দ্র গুপ্ত বিদায় নিয়েছেন, নতুন নাট্যকার চাই। সেই সময়ে রংমহল-এর মালিক ছিলেন শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। না না, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র নন, ইনি অভিনেতা ছিলেন। রংমহলে তিনি যে সব নাটক পরিবেশন করতেন, সেগুলি খুব একটা ভাল চলত না। সেই সময়ে নাট্যকার শ্রীদেবনারায়ণ গুপ্ত রংমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু নাটক না চলার জন্য নিয়মিত মাইনে পেতেন না। দেবনারায়ণ গুপ্ত রংমহল ছাড়তে রাজি হয়ে গেলেন।
জ্যাঠামশাই দেবনারায়ণবাবুকে নিয়ে গেলেন সলিলবাবুর কাছে। দেবনারায়ণবাবু তাঁর বন্ধুবর শিশির মল্লিককে অনুরোধ করলেন, স্টার থিয়েটারে নাটক পরিচালনা করতে হবে। শিশিরবাবু রাজি হলেন এই শর্তে যে যামিনী মিত্রকে সঙ্গে নিতে হবে। যামিনীবাবু এলেন যুগ্ম পরিচালক হিসেবে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল নিরুপমা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে ‘শ্যামলী’ নাটক’ মঞ্চস্থ হবে। এক আধুনিক ও উদার মনের যুবক অনিল বিয়ে করেছে শ্যামলীকে। শ্যামলী বোবা মেয়ে, কথা বলার ক্ষমতা নেই। অনিলের পরিবার শ্যামলীকে মেনে নেয় না। কিন্তু শত প্ররোচনাতেও অনিল অটল থাকে। অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা ও আনুগত্য এতটুকুও টাল খায় না। কাহিনিতে নাটকীয়তা আছে, আছে টানটান উত্তেজনা। সকলেরই গল্প পছন্দ হল। নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণবাবু নিজে। শিশির মল্লিক কথা দিলেন উত্তমকুমার, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, জহর গাঙ্গুলিকে তিনি নাটকে অভিনয় করতে নিয়ে আসবেন। কথা রেখেছিলেন তিনি। একঝাঁক প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী এলেন নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে। উত্তমকুমার, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, জহর গাঙ্গুলি ছাড়াও এলেন অনুপকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি রায়, অপর্ণা দেবী, সরযুবালা দেবী, প্রমুখ আরও অনেকে। নাটকের রিহার্সাল চলছে জোরকদমে। এই অবসরে শ্রীসলিল মিত্র প্রেক্ষাগৃহের আমূল সংস্কার করলেন। দর্শকদের আসনগুলি আরামদায়ক করলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বসালেন। আরামদায়ক, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসে যাতে নাটকের অভিনয় উপভোগ করা যায়, সেদিকে চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না। মঞ্চে আনলেন নতুন ধরণের কলাকৌশল। অনেক খরচ করে মঞ্চে রিভলভিং ডিস্ক লাগিয়েছেন। নাটকের কলাকুশলী সমেত মঞ্চটি ঘুরতে থাকে, দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন হয়। ‘শ্যামলী’ নাটকের বুকলেটে থাকত সেই ঘুরন্ত মঞ্চের ছবি।
১৯৫৩ সালের ১৫ই অক্টোবর, দুর্গাপুজোর সময় আরম্ভ হল ‘শ্যামলী’ নাটকের অভিনয়। শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্র যুগ্ম পরিচালক। মঞ্চসজ্জা ও আলোয় আছেন সতু সেন। ঘূর্ণায়মান মঞ্চে, মনোরম দৃশ্যপটের আবহে, একদল ক্ষমতাশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীর দলগত বোঝাপড়া ও অপূর্ব অভিনয় দর্শকের মন কেড়ে নিল। ‘শ্যামলী’ নাটক সুপার ডুপার হিট। চলল একটানা ৪৮৬ রজনী। পাঁচশো রাত্রির মাইলস্টোন থেকে মাত্রই ষোলোটি অভিনয় দূরে। মুমূর্ষু, ধুঁকতে থাকা স্বাধীনতা-পরবর্তী রঙ্গমঞ্চগুলির কাছে ‘শ্যামলী’ নাটক ছিল প্রাণদায়ী অক্সিজেন।
সিনেমা ও মঞ্চে অভিনয়ের অত্যধিক চাপে উত্তমকুমার অসুস্থ হয়ে পড়েন ও ৪৮৬ রাত্রির আগেই বিদায় নেন। শ্যামলীর বিপুল জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রংমহল রঙ্গমঞ্চকেও ঢেলে সাজানো হল। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসের দু তারিখে আরম্ভ হল অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের আবেগধর্মী নাটক ‘উল্কা।’ দর্শকের কাছে প্রভূত জনপ্রিয়তা পেল সে নাটক। কিন্তু সাফল্য ধরে রাখা গেল না। পরের কয়েক বছর রংমহলের নাটকে বিশেষ দর্শক হল না। রংমহল মঞ্চের মালিকানা ছিল ‘শ্রীরঙ্গম’ থিয়েটারের হাতে। সরকার ব্রাদার্স, দক্ষিনেশ্বর সরকার এবং রাসবিহারী সরকার এবার মঞ্চটি কিনে নিলেন। মালিকানা বদল হয়ে রংমহলের নতুন নাম হল “বিশ্বরূপা।”
বিশ্বরূপায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’। অভিনয় করলেন নীতীশ মুখার্জি, শান্তি গুপ্তা, বসন্ত চৌধুরী। পরের নাটক বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘ক্ষুধা।’ অভিনয় করলেন নরেশ মিত্র, শান্তি গুপ্তা, বসন্ত চৌধুরী, কালী ব্যানার্জী, তরুণ কুমার, তপতী ঘোষ প্রমুখ স্বনামধন্য অভিনেতারা।
এই নাটকের একটি মজার ঘটনার কথা লিখি। আরম্ভের পর প্রথম কয়েকটা শো ভালো চলেনি। ফলে আলোচনায় বসলেন পরিচালক নরেশ মিত্র, নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য, এবং পরামর্শদাতা হিসেবে ডেকে নিলেন জ্যাঠামশাই শ্রীযোগেন্দ্রচন্দ্র সেনগুপ্তকে। অনেক বাদানুবাদের পর জ্যাঠামশাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী শেষ দৃশ্য পরিবর্তন করা হল। এবার নাটক জমে গেল। সেই দিনের আলোচনার টেবিলে মাত্র কয়েকজন বাদে আর কেউ জানল না জ্যাঠামশাইয়ের অবদানের কথা। সত্যিই প্রচার বিমুখ মানুষ।
মনে পড়ে মিনার্ভায় উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘অঙ্গার’ নাটকের শেষ দৃশ্য – আলোর কারসাজিতে মঞ্চের কয়লাখনির মধ্যে ধীরে ধীরে জল ঢুকছে আর সব কিছু ডুবে যাচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহ চুপ, রুদ্ধশ্বাসে দর্শক দেখছে কী ভাবে কয়লাখনির শ্রমিকেরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। সেই দৃশ্যে রবি ঘোষের অভিনয় ভোলার নয়।
নাটক শেষে আলোকশিল্পী তাপস সেনকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত দর্শক। ভিড় ঠেলে তাপসবাবু চলে এলেন জ্যাঠামশাইয়ের কাছে, “যোগেনদা, সব ঠিক আছে তো?” জ্যাঠামশাই গম্ভীরভাবে তাপসবাবুকে জবাব দিলেন, “অনেক ডিফেক্ট আছে। আপনি যে সিল্কের কাপড় দিয়ে জলের ব্যাপারটা বোঝাতে চাইছেন সেটা হলের প্রথম কয়েকটি সারির দর্শকেরা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে বুঝতে পারবে।” এই ঘটনা দুপুর তিনটের শো’য়ের পর। পরের শো’য়ে তাপসবাবু সেই দৃশ্যের কারু-কুশলতার পরিবর্তন করলেন। সেই পরিবর্তন জ্যাঠামশাইয়ের পছন্দ হল, উনি তাপসবাবুর প্রশংসা করলেন।
এইরকম অনেক ঘটনা জ্যাঠামশাইয়ের জীবনে ঘটেছে, কিন্তু তাঁর এই অবদানের কথা তিনি কখনও কোথাও প্রচার করেননি। এতটাই প্রচারবিমুখ ছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে “শ্যামলী” নাটক মঞ্চস্থ না হলে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের ভবিষ্যৎ কী হত, সেটা ইতিহাস বুঝবে।
সঙ্গের ছবিটি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।