শঙ্কর দা

শঙ্কর দা

অবসর-এর নবজন্মের প্রথম সংখ্যায় ডক্টর শঙ্কর সেন সম্পর্কে দু-চার কথা লেখার জন্য সম্পাদকের হুকুম। ওঁর বিশাল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি কতটুকু জানি! তাই সে সবের মধ্যে না গিয়ে আদি অবসর-এর প্রায় জন্ম-লগ্ন থেকে যে-ভাবে উনি যুক্ত ছিলেন সেই নিয়েই লিখছি।

ডক্টর শঙ্কর সেনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সত্তর দশকে,  শঙ্কর দা তখন বি ই কলেজের অধ্যাপক। দেশে বেড়াতে গেলে দাদার বি ই কলেজের কোয়ার্টারে গিয়ে উঠতাম। তারপর তো উনি যাদবপুরে ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে গেলেন, পরে বিদ্যুৎমন্ত্রী। যোগাযোগ হওয়ার তেমন অবকাশ ছিল না। নব্বই দশকে দেশে মোবাইল ফোন আসার প্রস্তুতি-পর্বে দিল্লীতে কিছুদিন চাকরি-সূত্রে ছিলাম। তখন কলকাতায় গেলে বার কয়েক দেখা হয়েছে। মোবাইল ফোন নিয়ে দেশে আমাদের কী কাজ, তাই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একদিন কথাও হল – এইটুকুই।

দু-হাজার সালের গোড়ার দিকে উনি ক্যানাডায় এসেছিলেন ওঁর বড় মেয়ের কাছে। আমি আর সুমিত দা তখন সবে অবসর ওয়েবসাইট চালু শুরু করেছি। বাংলা ওয়েব টেকনোলজি-তে তখন অনেক সমস্যা ছিল। সুমিত দা ওর উদ্ভাবিত ‘হরফ’ ফন্টটা কী ভাবে কাজে লাগানো যায় … সেই সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, আমি কন্টেন্ট নিয়ে। সুমিত দা ছিল আবার বি ই কলেজে শঙ্কর দা-র অন্যতম প্রিয় ছাত্র। কোথাও অবসর-এর খবর পেয়ে ফোনেই জানতে চাইলেন, এটা নিয়ে আমরা ঠিক কী করতে চাইছি। অবসর-এর পিছনে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল সহজ বাংলায় মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া – স্বাস্থ্য, আইন, ইত্যাদি বিষয়ে। আমার স্ত্রী শমীতাই এটা আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল। শঙ্কর দা-র কথাটা খুব মনে ধরল। ‘বাঃ, দেশের গ্রামাঞ্চলে স্কুল-লাইব্রেরিতে ভালো বই-পত্তর মেলে না, ইন্টারনেট আসতে শুরু করেছে, শিগগিরি হয়তো চেষ্টা-চরিত্র করে সোলার বা অন্যান্য পাওয়ার দিয়ে কম্পিউটার চালানো যাবে … এইসবও মাথায় রেখো। সুমিত-দাও বলল, অবসর-কে একটা এনসাইক্লোপেডিয়াইক সাইট করলে কেমন হয়?

অবসর-এর একটা উপদেষ্টা কমিটি করা হল। শঙ্কর দা-কে ধরলাম, ‘আপনি সভাপতি হন।’

‘না, না, সভাপতি কেন? দলে আছি।’

অনেক কষ্টে রাজি করলাম।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর পবিত্র সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতিও নেওয়া হল অনলাইনে ‘ভারতকোষ’ তোলার। কিন্তু হাজার হাজার এন্ট্রি টাইপ করবে কে?

‘তাতে কি? আমি সাহায্য করব।’

শঙ্কর-দা বেশ কিছুদিন আগেই মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন।

‘কি বলছেন শঙ্কর দা, আপনি কেন করবেন?’

‘আরে ছাড়ো, বসেই তো আছি! বসে বসে কী করব?’

আর কি করব মানে! মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু অজস্র কাজে জড়িয়ে আছেন – একবার উষাগ্রামে যাচ্ছেন, একবার সিকিমে  … বিভিন্ন এনজিও-তে গিয়ে গাইড করছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন। এই জন্যেই বোধহয় কিছুদিনের মধ্যেই আমার থেকে শমীতার সঙ্গেই কথাবার্তা হত বেশি। শমীতাকে স্নেহভরে ‘ঝাঁসির রানি’ ডাকা শুরু করলেন। ওঁর বাড়ি গেলেই শমীতা বলত, ‘শঙ্করদা চা খাব।’

নিজের হাতে চা করে নিউ জার্সিতে শমীতাদের গড়া ‘মানবী’-তে মেয়েদের সমস্যা নিয়ে কী ধরণের কাজকর্ম হচ্ছে শুনতেন।

সুমিত-দা একদিন বলল, ‘হ্যাঁরে, বাংলা সিনেমার একটা ডাটাবেস করলে কেমন হয়?’

তখন IMDB সবে শুরু হয়েছে, কিন্তু বাংলা সিনেমার তথ্য সেখানে প্রায় কিছুই নেই। সুমিত দার বেশ কিছু বই ছিল, সেগুলো থেকেই কিছু একটা খাড়া করা যায়, কিন্তু আরও রিসার্চের প্রয়োজন। সুমিত-দা ইতিমধ্যেই একটা ডেমো ডাটাবেস স্ট্রাকচার বানিয়ে ফেলল। কিছু তথ্য তাতে ঢোকালাম, যাতে ব্যাপারটা বোঝানো যায়। কিন্তু তথ্য তো অজস্র, পাওয়া যাবে কোথায়? আর সেগুলো ডাটা-বেসে ঢোকানোও তো অনেক কাজ, সেটাই বা করবে কে? একটা প্রজেক্ট যদি খাড়া করা যায় কোনও ইউনিভার্সিটির জন্য … শঙ্কর দা-কে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।

শঙ্কর-দা-কে বলতেই বললেন, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, যাদবপুরে তো ফিল্ম ডিপার্টমেন্ট চালু করেছিলাম। সঞ্জয় তো এখন ওখানেই পড়াচ্ছে!’

পরের দিন শঙ্কর দার বাড়িতে গিয়ে দেখি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বসে আছে।

ডেমো দেখে সঞ্জয় এক্সাইটেড। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ করা তো যেতেই পারে।’

‘মৃণাল সেনকে জড়ালে কেমন হয় এই ব্যাপারে?’ শঙ্কর দা জানতে চাইলেন।

‘উনি কি এসবে সাড়া দেবেন?’

‘কথা বলতে সমস্যা কি? আমি ওঁকে ভালো করেই চিনি।’

‘একটা প্রপোজালও তৈরি করো, জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গেও কথা বলা যেতে পারে। যেতে পারবে আমার সঙ্গে?’

‘তিনি কে?’

‘ওই যে যিনি ভারতের সেনা-প্রধান ছিলেন, এখন রিটায়ার করে রাজ্যসভার মেম্বার। সল্ট লেকে থাকেন। হয়তো সাহায্য করবেন।’

নানান চিন্তা শঙ্কর-দা-র মাথায়।

আমি তো কাউকেই চিনি না। সুমিত-দা দেশে আসতে পারছে না। শঙ্কর-দার লেজুড় হয়ে গেলাম সব জায়গায়।

পিয়ারলেসের এস কে রায়কেও ধরলাম। অনেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। আসলে ইন্টারনেট জিনিসটাই তখনও সবার কাছে পরিষ্কার নয়।

টুকরো টুকরো এরকম অনেক কথা মনে পড়ছে …

এগুলো লিখলাম শঙ্করদাকে বোঝাবার জন্য। উনি ছিলেন ভিশানারি, লক্ষ্যে স্থির থেকে অদম্য উৎসাহ নিয়ে লড়াই করতেন। ইন্টারনেট-এ বাংলায় তথ্য সংরক্ষণের মূল্য উনি যে-ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যরা তা পারেননি। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যেতাম। শঙ্কর-দাকে বলতাম, ‘মনে হচ্ছে শুধু শুধুই অনেক সময় নষ্ট করছি!’

‘সুজন, হতাশ হলে চলবে না, ‘যদি ডাক শুনে কেউ না আসে, একলা চল রে।’’

দেশে গিয়ে আমার প্রথম কাজ ছিল শঙ্কর দাকে একটা ফোন করা।

‘কি করছ? বাড়িতে আছি, চলে এসো।’

দুপুরে গেলে লাঞ্চ না খাইয়ে ছাড়তেন না।

ভাবতে কষ্ট হয়, শঙ্কর-দা নেই। দেশে গেলে প্রথম ফোনটা কাকে করব? শেষ কথা হয়েছিল এদেশ থেকে।

‘অবসর আর চালাতে পারা যাচ্ছে না, শঙ্কর দা! আমার চোখ নিয়ে সমস্যা, সুমিত দার পক্ষেও একা সামলানো কঠিন। তবে খুঁজছি কাদের ভার দেওয়া যায়, যাতে লেখাগুলো থেকে যায়।’

খুশি হয়েছিলেন শুনে।

একটাই আফসোস নতুন অবসর শঙ্কর দা দেখে যেতে পারলেন না।

সদ্য প্রয়াত সুজন দাশগুপ্ত ছিলেন পাঁচ দশকের বেশি আমেরিকা প্রবাসী। গোয়েন্দা একেনবাবু-র মানস-পিতা এবং অবসর.নেট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সম্পাদক। রম্যরচনা, ধাঁধা, উপন্যাস ও রহস্যকাহিনীর ওপর গোটা পঁচিশেক বই আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *