হে মহাজীবন

হে মহাজীবন

আমরা শিবপুরের বিই কলেজ থেকে ১৯৮২তে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি।  আমাদের স্নাতকোত্তর ৩৫ বছর পূর্ণ হয় ২০১৭ সালে।  সে বছরের মাঝামাঝি থেকেই বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে খবর পাচ্ছিলাম, একটা মিলনমেলা হবে। তারপর ঠিক হলো, সেটি হবে ২০১৮র জানুয়ারিতে। সঙ্গে অজস্রবার আহ্বান, ‘চলে আসিস’।

আমার মতো যারা ৩৫ বছর প্রবাসী, সংসারে, বৃথা-কর্মে, ধনে-জনে জড়িয়ে পড়েছি, তাদের কাছে কলকাতার সঙ্গে যৌবনের আবেগমন্দ্রিত রসায়ন এখন অনেকটাই ম্লান। তাদের পক্ষে ‘চলে আয়’ বললেই হুট করে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার ভাবনাই বেশ কষ্টকর। সাত-পাঁচ যখন হিসেব করছি আর আগুপিছু চিন্তা করছি, তখন একদিন অরুণের বার্তা পেলাম,

২৭-২৮ দু-দিনের প্রোগ্রাম, ২৭শে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাবার প্ল্যান হচ্ছে, তুই এত কি চিন্তা করছিস?’

এরপর আর কোন দোনোমোনো করার অবকাশ রইল না।

‘স্যার’ অর্থাৎ প্রফেসর সেন। দেশের মানুষ যাঁকে এক অসামান্য শিক্ষাবিদ, বিশেষত ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষণের এক পথিকৃৎ ও মহীরুহ, এক অত্যন্ত সুদক্ষ এবং সফল প্রশাসক, এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানে, সেই ডঃ শংকর কুমার সেন। আমাদের স্যার।

আমরা যখন তাঁর ছাত্র হবার সৌভাগ্য অর্জন করি, তখন তিনি তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষকজীবনের মধ্যগগনে। এক সুপরিচিত কিংবদন্তী বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর শিক্ষণপ্রক্রিয়া, শৃঙ্খলা-পরায়ণতা , পাণ্ডিত্যের খ্যাতি, বাচনপদ্ধতি, এমন কি তাঁর হাঁটাচলা পর্যন্ত, মানুষটির সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্ব যে কোন সদ্যযুবককে এক মোহমিশ্রিত সম্ভ্রমে আবিষ্ট করতে যথেষ্ট ছিল। জানিনা, আজও role model শব্দযুগলের কোন সার্থকতা রয়ে গেছে কিনা, কিন্তু ৪০ বছর আগে আমাদের ছাত্রাবস্থায় জীবন্ত role model যদি কেউ হতে পারতেন, তিনি নিঃসন্দেহে শঙ্কর সেন।

তবে এ কথা স্বীকার করতে আজ আর কুণ্ঠা নেই, নিয়মিত তাঁর ক্লাস করে গেলেও, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের করিডরে তাঁর দৃপ্তপদে সপৌরুষ হেঁটে চলার সাক্ষী হয়ে থাকলেও, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যলাভের সুযোগ বা সাহস সে সময়ে আমার হয়নি। শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম আর নিশ্চয় কিছুটা ভয়মিশ্রিত প্রতিবন্ধকতা ছিলো। তাই এখন যখন তাঁর জীবনসায়াহ্নে মানুষটির কাছে অন্তত কিছুক্ষণ আসার এই সংযোগ এসে গেল, তা হেলাফেলা করে হারানোর কোন প্রশ্নই ছিল না। অবসর-এর এই সংখ্যায় ডঃ সেনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শের, অভিজ্ঞতার, ঘটনার কথা অন্য আরও লেখায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমার লেখায় শুধু সেই এক সকালের বিবরণ, যথাসম্ভব তাঁরই মুখের কথায়, যা তাঁর এক অত্যন্ত পরিপূর্ণ, সার্থক জীবনের এক নিষ্ঠাবান, সংবেদনশীল মননের মাত্র কিছুটা উপলব্ধিই আমাদের দিয়েছিল।

শুরুটা কিন্তু খুব সহজ হয়নি।

২৭শে জানুয়ারি, ২০১৮র সেই সকালটা, কলকাতায় অপসৃয়মাণ শীতের মৃদু ঠাণ্ডা আমেজ আর নরম রোদের মোলায়েম উষ্ণতার আবেষ্টনে, বড়ই উপভোগ্য ছিল। তখনও জানিনা, পরে আরও কি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

সকাল সকাল পৌঁছে তো গেলাম গলফ গ্রিনে। স্যারের আবাসন ঐখানেই কোথাও, কিন্তু সঠিক অবস্থান জানা ছিল না। কে কে আসছে তাও জানা নেই। ফোনে সমীরকে যোগাযোগ করে জানলাম সে ইতিমধ্যেই উপস্থিত। তাকে পাওয়া গেলো একটি বাসস্টপে অপেক্ষমাণ। কিছুক্ষণের মধ্যে শুভও এসে গেলো। সমীর জানালো, অরুণ আসতে পারছে না, রি-ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনায় আটকে পড়েছে। কিন্তু তারপরেই বজ্রপাতের মত খবর এল ফোনে, স্যার দেখা করতে রাজি হননি, অতএব প্রোগ্রাম বানচাল।

আমরা যখন নিরাশ মনে নিজেদের মধ্যে কিছু সময় গল্পগুজব করে ফেরৎ যাবার কথা চিন্তা করছি, তখন সুদীপের ফোন এলো। বললো, ‘আমি প্রায় এসে গেছি, তোরা একটু wait কর।’

শুভ অবশ্য বলছিল, একবার গিয়েই দেখা যাক না। কিন্তু যথেষ্ট সাহস আর জোর পাওয়া যাচ্ছিল না। স্যার যখন রাজী হননি, জোর করে গিয়ে পড়াটা কি ঠিক হবে? উনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন, না জানি কি বলবেন! এই দ্বিধার অবসান হল সুদীপের আগমনে।

সে বললো, দেখ, আমরা এত দূর দূর থেকে এত আশা করে এলাম। একবার অন্তত চোখের দেখা না দেখেই ফিরে যাব? বলব, ‘দু-  মিনিটের জন্যে শুধু একবার প্রণাম করতে এসেছি। তাতে যদি স্যার রাগও করেন, না হয় একটু বকুনি দেবেন। স্যারের কাছে বকা খাওয়াও তো আশীর্বাদ পাওয়ার সমান!’

সুদীপের চিন্তা-ভাবনা বরাবরই খুব পরিষ্কার। ওর বক্তব্যে একটা নির্ভীক জোর ছিল। তাছাড়া, আমাদের সময়ের batch topper। সেই সুবাদে ডঃ সেনের স্নেহভাজনও ছিল, পরেও স্যারের সঙ্গে ওর একাধিকবার দেখা হয়েছে। তাই, মনে মনে একটা সংকোচ রয়ে গেলেও, ওকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়াই স্থির হলো। যা হবার হবে, দেখা যাবে।

ঠিকানাটা কে যেন এনেছিল। জায়গা বার করতে খুব একটা অসুবিধে হল না। আবাসন চত্বরের ভেতরে একই রকম দেখতে অনেকগুলি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। নম্বর মিলিয়ে একটির সামনে হাজির হওয়া গেলো। এই বাড়ীরই দোতলায় স্যারের আবাস। দুরু দুরু বুকে উঠে এসে চারজন দরজার সামনে দাঁড়ালাম। কে বেল বাজাবে? এর মধ্যে জানা গিয়েছিল, শুভর সঙ্গেই নাকি স্যারের সম্প্রতিকালের মধ্যে শেষবার দেখা হয়েছিল, আর সেও শিক্ষাসমাজে কর্মরত। তাই তাকেই এগিয়ে দেওয়া হলো। বেল তো বাজানো হলো, কিন্তু যিনি দরজা খুললেন, স্যারের মেয়ে অনসূয়াদি, তিনি জানালেন, উনি তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাহলে কি ফিরে যেতে হবে? আমরা জানালাম, আমরা তাঁর ছাত্র ছিলাম, মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য একবার শুধু শ্রদ্ধা জানাতে আসা। এমন পুরাতন ছাত্র তিনি নিশ্চয়ই অনেক দেখে থাকবেন। বললেন, আপনারা ঘন্টাখানেক পরে আসুন।

 এখন অনেকটা যেন আশা পাওয়া গেল। এবার বোধহয় ফিরে যেতে হবে না। একঘন্টা চার বন্ধু মিলে কাটিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। পরিশেষে একবার দেখা যদি পাওয়া যায়। বেরিয়ে এসে আমরা গল্পে-গুজবে এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম, তার মধ্যে অনেকটাই স্যারের সামনে কিভাবে কোন কথা বলে, তাঁর যদি কোন অসন্তোষ থাকে, তার নিরসন করা যায়, তাই নিয়ে।

অবশেষে আবার আমরা হাজির দোতলার সেই দরজায়। এবার আবার অনসূয়াদি দরজা খুললেন, এবং পাওয়া গেলো প্রবেশাধিকার। ইতস্তত পায়ে, হয়তো বলা যায়, অনুপ্রবেশ করেই, দেখা পাওয়া গেল প্রায় নবতিবর্ষীয় এক প্রতিষ্ঠান, ডঃ শঙ্কর সেন, আমাদের দিকে পিছন ফেরানো, উল্টোদিকের দেওয়ালের লাগোয়া একটি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে, ল্যাপটপে একাগ্রমনে কোন কাজে নিমগ্ন।

অসময়ে তাঁর কাজ ব্যাহত করলাম কি? আমরা লজ্জিত এবং দ্বিধাগ্রস্ত।

‘এঁরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন মেয়ের ডাকে পিছন ফিরে তাকালেন। বয়সের প্রলেপ হয়তো মুখে কিছুটা পড়েছে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি সেই আগের মতই উজ্জ্বল এবং গভীর।

আমরা তড়িঘড়ি নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলতে লাগলাম যে আমরা ৮২ সালের ব্যাচ, দেশবিদেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে আসা শুধু একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে, বেশী সময় আমরা তাঁর নেব না, ইত্যাদি। উনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। প্রণাম করার জন্য নত হতেই হাত দিয়ে ধরে আটকে দিলেন, বললেন,-

‘না, না, এসব আমি পছন্দ করি না বোসো, বোসো, তোমরা বোসো

 উনিও এবার আমাদের দিকে ঘুরে বসলেন।

ও, তোমরা ৮২তে পাশ করে বেরিয়েছিলে? ঐখানেই বুঝতে ভুল হয়ে গেছে আমার ধারনা হয়েছিল ৮২তে তোমরা ঢুকেছিলে তাই বলেছিলাম, তাহলে তো ৮৬তে পাস-আউট হবে তখন তো আমি বি ই কলেজে ছিলামই না তাহলে শুধু শুধু কেন কষ্ট করে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে?

আমাদের মিলনীতে অবশ্য তাঁকে যাবার জন্য রাজী করানো গেল না। কিন্তু এই প্রাথমিক পরিচয়পর্বের পরেই তাঁর আন্তরিক ও সহজিয়া আলাপচারিতায় সমস্ত অন্তরাল যেন কোথায় মিলিয়ে গেলো। অত বড় মাপের এক ব্যক্তিত্ব কোন সময়ের চারজন নেহাতই সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ সময় বাহিত করলেন শুধু এইজন্যেই যে আমরা কোনকালে তাঁর ছাত্র ছিলাম। সেদিনের তাঁর সেই বাক্যালাপে ছিল সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রজ্ঞা, বিদগ্ধতা, ছিল প্রত্যয়, সহমর্মিতা, স্নেহ আর সৌজন্য। ছিল না কোন অভিনয়ের আভাস, কোন মেকী ভণিতা বা অসার আস্ফালন। দুর্ভাগ্যবশত কথোপকথনের সম্পূর্ণ রেকর্ডিং সম্ভব হয়নি। তাই স্যারের জবানিতে যে সংলাপ এখানে লিপিবদ্ধ করলাম তা অবিকল না হলেও যথাসম্ভব নিকট। এ ছাড়া, মূল বিষয় উপস্থাপনার উদ্দেশ্যে কোথাও কোথাও অন্য সাক্ষাৎকার, বা অন্যের লেখা থেকেও রসদ নিয়েছি।

গভীর মূল্যবোধের এক সিদ্ধান্ত

 স্যার বললেন,

‘ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই চাকরী পেলাম ডিভিসি-তে ওদের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাচ কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, সদ্য স্বাধীন দেশের দ্রুত উন্নয়নের জন্যে তখন প্রয়োজন ছিলো মানবসম্পদের বিকাশ, আর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার তাই সে চাকরীর অফার প্রত্যাখ্যান করে নিলাম ভারত সরকারের, সেও প্রথম, এক সিনিয়র রিসার্চ ফেলোর পদ যদিও তার সম্মানমূল্য ছিলো ডিভিসির অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের অর্ধেক আত্মীয়-বন্ধুরা তো অবাক কিন্তু সমর্থন করলেন আমার বাবা তিনি নিজেও তো ছিলেন ফিজিক্সের স্বনামধন্য অধ্যাপক, হয়তো তাই বুঝলেন

 ‘ভেবে দেখো, ডিভিসিতে হয়তো দু-চারটে প্রজেক্ট করতাম, কোনদিন বড়জোর হয়তো চেয়ারম্যান হতাম কিন্তু দেশের জন্যে এত বছর ধরে এত সক্ষম ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করতে পারতাম কি?

 শিক্ষাও শিক্ষকতা

মাত্র কয়েকটি কথায় তাঁর কাছে শিক্ষার প্রকৃত সংজ্ঞা কি, তার আভাস দিলেন এইভাবে।

‘আমি এমন সব মানুষের সংস্পর্শে এসেছি – ডঃ এ সি রায়, ডঃ ত্রিগুণা সেন, ডঃ এস আর সেনগুপ্ত – তোমরা তো এঁদের কাউকে দেখোনি সংস্পর্শ মানে- অত্যন্ত close সংস্পর্শে

[গুণী ব্যাক্তিদের সান্নিধ্যে তাঁদের কথায়, আচরণে, ক্রিয়ায় যে শিক্ষা প্রাপ্তি হয়, তার দিকে ইঙ্গিত]

‘যাদবপুর আরো অনেক উঁচুতে উঠতে পারত যদি residential হতো [ছাত্র-ছাত্রীরা আবাসিক জীবনে যে স্বনির্ভরতা ও সহমর্মিতার মূল্যবান পাঠ শেখে, প্রাচীন গুরুকুল প্রথার নবরূপে]

‘আমি যখন যাদবপুরে (ভি সি), তখনও আমি কিন্তু regularly ক্লাস নিতাম’  [একজন প্রকৃত শিক্ষককে শুধু প্রশাসনিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকলে চলে না]

‘আমি নিজের মনের কথা বলছি বিশ্বাস করো, I live within my students এখনো তোমাদের কথা ভাবি আমি তোমাদের মধ্যেই বেঁচে আছি, honestly আমি তোমাদের থেকে যা পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি, আমি তার যোগ্য নই

 এক সর্বার্থসাধক শিক্ষকের পক্ষেই এই চূড়ান্ত উপলব্ধি বোধহয় সম্ভব।

 বি ই কলেজ, শিবপুর

জানতে চাইলেন, ‘এখন ইনস্টিট্যুটের খবর কি, কেমন চলছে?’

 তাঁকে জানানো হল, বেশ ভালো চলছে। পড়াশোনার পরিবেশ, রাজনীতি নেই। ছাত্ররা বিদেশে পর্যন্ত ইনটার্নশিপ পাচ্ছে, অনেকে পাশ করে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট, এমন কি পোস্ট-ডক্টরাল করছে। শুধু অবাঙালী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে।

বললেন, ‘তা হোক তারাও তো competition থেকেই আসছে’ তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার কাছে কিন্তু যা খবর, পড়ানোটা যেমন হওয়া উচিত, তেমনটা ঠিক হচ্ছে না

 শিবপুর-অন্ত প্রাণ এই মানুষটিকে কি করে বলা যায়, ‘আমি ছাত্রদের মধ্যেই বাঁচি’, আক্ষরিক অর্থে এমন কথা অনায়াসে বলার লোক এ যুগে মুষ্টিমেয়।

আমাদের ৮২র ব্যাচের যেবার ২৫ বছর হয়, সে বছর একটি শুভেচ্ছাবার্তায় স্যার লিখেছিলেন,

‘আত্মবিশ্বাস এবং সাহস যে কোন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আমাকে আলো দেখায় তাই  যখন আমি আমার মাতৃশিক্ষায়তন থেকে শিক্ষকতার প্রস্তাবনা পাই, আমার পক্ষে সহজ ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়া যদিও সেটি ছিল আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কারণ যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেই আই আই টি খড়্গপুর থেকে যে চাকরীটি পেয়েছিলাম, সেটি প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল

বললেন, ‘আমি কলেজের কথা, তোমাদের কথা, যখন ভাবি, মনে হয় যে, কলেজ ছিলো the best part of my life। আমি ৩৬ বছর চাকরী করেছি এই কলেজে। তখনই এসেছি ঐ সব মানুষের সংস্পর্শে। তখন মনে হয়, পৃথিবীটা খুব সুন্দর ছিল।’

বি ই কলেজ, তার পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় যাই হোক, তার জন্য স্যারের মনে সর্বদা যে ভালোবাসার স্থান বজায় ছিল, তার একটি দৃষ্টান্ত পাই, স্যারের প্রয়াণের পর, আমাদের আর এক শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ডঃ আনন্দ মোহন ঘোষের এক আলাপচারিতায়। ডঃ ঘোষ বলছেনঃ

‘ডঃ সেন যখন যাদবপুরের ভি সি, বোধহয় তাঁর দ্বিতীয় টার্মে, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ভারত সরকারের মাধ্যমে ২৮টি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা গ্র্যান্টের প্রস্তাব দেয় তাদের শর্ত ছিল, ইনস্টিট্যুটগুলোর নির্বাচন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কই করবে ওরা PSU এবং অন্য industry survey করে দেখেছিল, আই আই টি ইত্যাদির ছাত্ররা বেশীর ভাগ বিদেশে চলে যায় তাই দেশের উন্নয়নে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রত্যক্ষ অবদান, তাদেরই চয়ন করা হবে, কিন্তু একটি করে surprise inspectionএর পর সেই লিস্টে যাদবপুর এবং শিবপুর ছিল ওরা যেদিন visitএ আসবে, তার আগের দিন খবরটা কি করে যেন স্যারের কাছে পৌঁছে যায়, কিন্তু শিবপুরে পৌঁছয়নি আমি সেদিন যাদবপুরে কোন একটা viva নিতে গেছি উনি তলব পাঠালেন, আনন্দ যেন এক্ষুনি আমার চেম্বারে দেখা করে আমি যেতেই বললেন, শোন, তুমি আমার গাড়ীটা নিয়ে এখনই বি ই কলেজ চলে যাও এখন তিনটে বাজছে, গিয়েই গাড়ী ফেরত পাঠিয়ে দিও, এরপর আমাকে আবার একটা মিটিঙে যেতে হবে আমি অবাক হয়ে বললাম, কি ব্যাপার, স্যার? তখন স্যার সব বুঝিয়ে বললেন, দেখো, ওরা কালই আসছে, বিমল (ডঃ বিমল সেন, শিবপুরের তৎকালীন প্রিন্সিপাল) তো কিছুই জানে না ওকে বুঝিয়ে বলো, যেন আজকের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে রাখে আমার অনুরোধে লিখে দিলেন কোন কোন point দেখাতে হবে সেদিন রাত ন’টা পর্যন্ত বসে প্রিন্সিপাল সাহেব সব ব্যবস্থা করলেন, আর পরের দিন ঠিক তারা এসে হাজির স্যার সে যাত্রা যে কি বাঁচান বাঁচিয়েছিলেন! কিন্তু এসব উনি কেন করলেন? নাও তো জানাতে পারতেন

 যাদবপুর

তাঁর অন্য কর্মক্ষেত্র যাদবপুর আলোচনায় ফিরে এলো একাধিকবার।

তখন যাদবপুরে খুব গণ্ডগোল চলছে সেই সময় আমাকে ধরে নিয়ে গেল ভাইস চ্যান্সেলর করে অবশ্য এর পেছনে ত্রিগুণা সেনের কিছুটা অবদান ছিল

‘ওখানে তখন আর্টস ভার্সাস সায়েন্স ভার্সাস ইঞ্জিনিয়ারিং, একটা দ্বন্দ্ব ছিল তবে আমার outlook অনেক broad-based আমার রিসার্চ থেকে দেখলাম, অনেক ভালো কাজ কোথায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে কারণ ডিপার্টমেন্টগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ নেই তখন আমি কতকগুলো Inter-disciplinary School বানাবার প্রস্তাব দিলাম আশ্চর্যের কথা, ইউ জি সি সঙ্গে সঙ্গে approveও করে দিলো তাই নয়, দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের স্কুল চালু করলো But JU was the first সেসব এখনো চলছে

রাজ্যপাল নুরুল হাসান আমাকে বললেন, সাগরের তলায় যে বিশাল সম্পদ আছে, সেই নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণার জন্য oceanography department করুন গোয়ায় একটা ইনস্টিট্যুট আছে, এখানেও হওয়া দরকার তা আমরা যাদবপুরে শুরু করলাম ওরা খুব ভাল কাজ করছে

I had a very nice time in Jadavpur আমাকে ঘেরাও হতে হয়নি কারণ ওরা জানতো, স্যার যে কোন দিন হুট করে ছেড়ে চলে যেতে পারে

 মন্ত্রিত্ব

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্যার বললেন, ‘রাজ্যপাল নুরুল হাসান আমার সমবয়সী ছিলেন। মাঝে মাঝে আমাকে চায়ের আমন্ত্রণ করতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েও। আমার কাছে কিছু কিছু খবর আসতো। সেসব তাঁকে বলতাম। যেমন, ব্যান্ডেলে কেমন করে routine maintenanceএর মেয়াদ শেষ হবার আগেই রাজনৈতিক ইউনিয়নের চাপে প্ল্যান্ট চালু করে দেওয়া হল, আর বয়লার ধ্বসে পড়ল, এইরকম।

ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার হলো তখন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার এদের একটা অ্যাসোসিয়েসন ছিলো, ‘ফেটো’ বলে তারা ধর্মঘট করে বসে, প্রায় তিন মাস ধরে চলছিল সেই ধর্মঘট আমি তখন যাদবপুরে ওরা মাঝে মাঝে আমার বাড়ীতে আসতো সব young ছেলে, খুবই খারাপ অবস্থা কেউ কেউ বিয়ে করেছে, টাকা নেই তো, একদিন বুদ্ধ ভটচায এসে বললেন, জ্যোতিবাবু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান ওঁরই গাড়ীতে গেলাম মুখ্যমন্ত্রীর কাছে উনি বললেন, আপনার ছাত্রেরা আর কতদিন স্ট্রাইক চালাবে? আমি বললাম, ওরা তো আমার বাড়ীতেও আসে বললেন, সে আমি জানি তা আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না ওদের

আমি ওদের ডেকে কথা বললাম ওদের সেক্রেটারী ছিলো আই আই টি খড়গপুরের প্রাক্তন ছাত্র যা হয়, বিরাট দাবী-দাওয়ার ফর্দ কমিয়ে সেটাকে চারটে মূল দাবীতে আনলাম তার মধ্যে প্রধান ছিলো, টেকনিকাল দফতরগুলোর administrative head করতে হবে টেকনিকাল লোকেদের বললাম, এই নিয়ে তোমরা জ্যোতিবাবুর কাছে চলো, আমিও থাকব, কথা হবে কিন্তু ওঁকে কোনরকম অসম্মান করবে না

‘মিটিঙে টেবিলের একদিকে মুখ্যমন্ত্রী, আরো দু-তিনজন বাঘা বাঘা মন্ত্রী বসে, অন্যদিকে ঐ ‘ফেটো’র জনাচারেক ছেলে আর এক কোনায় আমি জ্যোতিবাবু পোড়খাওয়া রাজনীতিক ছেলেদের বললেন, ‘জ্যোতি বসু না হয় খুব খারাপ কিন্তু রাজ্যের লোক কি দোষ করলো? বর্ষা চলে গেল, এখনই তো কাজ করার সময়’ নেতারা সব চুপ আবার বললেন, ‘তোমরা আমার কাছে আসার কথা একবারও ভাবোনি?’ ওদের কেউ বললো আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু দেখা করতে দেওয়া হয়নি তখন ঐ চারটে দাবী লেখা কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, এইগুলো এরা চায় এর মধ্যে এই টেকনিকাল হেডের দাবীটা অনেকদিনের, সিদ্ধার্থ রায়ের সময়েও এই নিয়ে একটা আন্দোলন হয়েছিলো তাতে শিবপুর থেকে আমরাও যোগ দিয়েছিলাম উনি কাগজটা দেখে বললেন, ‘এগুলো তো করাই যায়’ তখন আমি বললাম, তাহলে একটা মিনিট টাইপ করে যদি আপনার সেক্রেটারী সই করে দেন, ওদেরও তো গিয়ে mass meetingএ একটা কিছু দেখাতে হবে অসীম দাশগুপ্ত বলে উঠলেন, না না, ওসবের দরকার নেই জ্যোতিবাবু বললেন, ‘টাইপ করিয়ে আনুন, আমিই সই করে দিচ্ছি’ এইভাবে মিটিং শেষ হল স্ট্রাইকটাও উঠে গেল

‘আসলে, এদের handle করতে জানা চাই একটু ভালোবাসা দিলেই অনেক কিছু হয় জমিদারী মেজাজ দেখিয়ে কিছু হয় না

‘ত্রিগুণা সেন এবং নুরুল হাসান আমাকে বলছিলেন মন্ত্রী হবার জন্যে, আমি রাজী হইনি এই ‘ফেটো’র ঘটনার পর রাজ্যপাল বললেন, এতদিনের ধর্মঘট উঠিয়ে দিলেন! আপনি পারবেন, মন্ত্রী হয়ে যান আমি আবার বললাম, আমি সি পি এম এর মেম্বার নই তাছাড়া ওরা আমাকে কাজ করতে দেবে না উনি বললেন, না, না জ্যোতিবাবুর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে, আপনাকে full freedom দেওয়া হবে তখন আমি বললাম, আচ্ছা, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে আমি কথা বলবো কথা হলো উনিও বললেন, যখন আপনার মনে হবে, আপনি ছেড়ে দেবেন

‘আর হলোও তাই মন্ত্রী তো এইভাবে হলাম, কিন্তু যখন দেখলাম আর হচ্ছে না, তখনই ছেড়ে দিলাম

 আজীবন শিক্ষাবিদ ডঃ সেনের রাজনৈতিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও মন্ত্রিত্ব স্বীকার করা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় এসেছিল। এ বিষয়ে নিজের মেয়ে অনসূয়া চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে স্যার যা লিখেছিলেন, আমাদের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয় না হলেও, তার কিছু পংক্তির উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বটির মানসিকতার কিছুটা সম্যক পরিচায়ক হবে বলে মনে করি। চিঠিটি ব্যক্তিগত হলেও এখন social mediaয় উপলব্ধ। স্যার লিখেছেন –

“তুমি লিখেছো আমি academician ছিলাম এখন politician হলাম আমি কিন্তু একমত নই বি. ই. কলেজে অধ্যাপনা করতাম; যাদবপুরে academic-administrationএ যোগ দিয়েও পড়াশুনা ছাড়িনি, বরং পড়াশুনার পরিধি অনেক বেড়ে গিয়েছে – বিশেষতঃ social scienceএর বিষয়ে মন্ত্রী হলে academic activities কমে যাবে এটা ঠিক নয় তা হয়তো প্রমাণ করতে পারবো

“তোমরা জানো আমি honesty ও disciplineএ বিশ্বাসী – তা সে সময়ের ব্যাপারেই হোক বা কাজের ব্যাপারেই হোক যদি সেই discipline নিয়ে কাজ করতে না পারি সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নেবো …… সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে আমি কোন আপোষ করবো না এটুকু বলতে পারি যাদবপুরের সংগে deep involvement থাকা সত্ত্বেও ছাড়ার সময় sentimental attachmentএ কষ্ট পাইনি – এখানেও তাই হবে যদি positive development work করতে পারি থাকবো – নয়তো পত্রপাঠ বিদায়

“……. আমার ওপর বিশ্বাস রেখো আমার কোন ambition নেই – জ্যোতিবাবু ও নুরুল হাসানের অনুরোধ রাখতে নেমেছি কাজ করতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবো

 মন্ত্রী হিসেবে রাজ্যে তাঁর যে অবদান, তার সাক্ষী সমসাময়িক ইতিহাস। কিন্তু ওই positive development work এর প্রকৃত পরিধি তাঁর সংজ্ঞায় কত ব্যাপক এবং গভীর ছিল, তা বুঝতে পরবর্তী আলোচনা সহায়ক হতে পারে।

ব্যতিক্রমী, মানবদরদী

‘আমি লোকাল ট্রেনে চেপে কোলাঘাট চলে যেতাম আমি তো কোন নেতা নই, তাই কেউ আমাকে চিনতো না যাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতো, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েও

 এই ব্যতিক্রমী মন্ত্রী কেমন করে সরকারি গাড়ীতে দফতর যাওয়ার পথে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখার জন্য গাড়ী থামিয়েছিলেন বলে হিসেব কষে ঐ দূরত্বের গাড়িভাড়া সরকারকে ফেরত দিয়েছিলেন, সে কাহিনী অন্যত্র পড়েছি।

বললাম, ‘আপনি তো বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অনেক সুরাহা করে দিয়েছিলেন।

 ‘আমি সব ইঞ্জিনিয়ার আর কর্মীদের থেকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছি এর বেশী কিছু বললেন না। বললেন অন্য কথা। ‘আরো অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম, জানো?’

কি সেই অন্য অনেক কিছু? এক-আধটা উদাহরণ যা দিলেন, তার থেকে পরিচয় পাওয়া যাবে জনহিতে সমর্পিতপ্রাণ এক দরদী মননের।

 ‘আমি যখন শিক্ষাজগতে, মাঝে মাঝে যেতাম জঙ্গলমহলে, আমার স্ত্রীও যেতেন আমার সঙ্গে জঙ্গলমহল পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর নিয়ে অনেক বড় জায়গা ওখানকার মানুষদের মধ্যে এত দারিদ্র্য, তোমরা চিন্তা করতে পারবে না একবার তো ওখানকার এক মহিলার দুরবস্থার কথা শুনে আমার স্ত্রী কেঁদেই ফেলেছিলেন

 ‘ওখানে কিছু কাজ করেছিলাম মেদিনীপুর ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক এলেন আমার কাছে বাঁকুড়া-মেদিনীপুর বর্ডারে উষমাসুরি বলে সাঁওতালদের খুবই অনগ্রসর একটা গ্রামে ওঁরা ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে চান, তার জন্য কিছু solar lamp চাইলেন আমি বললাম, ওরা এত বেশী deprived, শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গেলে তাড়িয়ে দেবে স্বামীজী বলেছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর মাথার ওপর এক চিলতে ছাদ, মানুষের মৌলিক প্রয়োজন আপনারা বরং স্বাস্থ্য দিয়ে শুরু করুন পরে আমি ওখানে গিয়ে দেখেছি, কি সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন ওঁরা একদিকে সব বাড়ী, হসপিটাল, খোলা মাঠে রান্নার ব্যবস্থা, বাড়ী থেকে সব এসে রান্না করে দিয়ে যায়, খাওয়ানো হয়

 ‘এরই মডেলে জ্যোতিবাবুকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, one teacher school করবো কথা হলো, উনি অসীম দাশগুপ্তকেও ডাকলেন বললাম, আমার কোন বড় বাড়িঘর বা লোকবল চাই না একজনই শিক্ষক আর একটা ঘর চাই ঘর না হলেও চলবে, খোলা যায়গায়, যখন বর্ষা থাকবে না, শান্তিনিকেতনের মত, ক্লাস হবে কুড়ি জন করে ছাত্র

‘তখন সব renewable energy projectএর কাজে কেন্দ্রীয় সরকার ৩ পারসেন্ট গ্র্যান্ট দিতো স্টাফদের জন্য কিন্তু স্টাফদের ব্যয় তো রাজ্য সরকারই বহন করতো তাই ঐ টাকাটা আমি অন্যভাবে খরচ করতাম যেমন, মাদার টেরিজার নির্মল হৃদয়ে solar water heating system করেছিলাম; বাঁকুড়ায় এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের কুষ্ঠরোগীদের আবাসে solar powerএর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, ইত্যাদি আমি বললাম, power থেকে এই ৩ পারসেন্ট গ্র্যান্টের টাকা আমি দেবো

‘আরেকটা টাকার source বলেছিলাম, সেটা নিয়ে তো ল্যাজে-গোবরে অবস্থা সেটা হলো, বিদ্যুতের ওপর সরকার একটা ট্যাক্স নেয়, in the form of a duty আমি রিসার্চ করে দেখলাম ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট এটা বসিয়েছিল, সেই থেকে চলছে কিন্তু কেন নেওয়া হয়, কেউ জানে না আমি বললাম, বিদ্যুৎ একটা অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস, এর ওপর ট্যাক্স কেন? এই টাকা আমার স্কুল প্রজেক্টে দেওয়া হোক

 ‘জ্যোতিবাবু পার্টির নেতাদের মিটিং ডাকলেন আলিমুদ্দিনে, আমাকেও ডাকলেন প্রস্তাবটা বোঝাবার জন্যে আলিমুদ্দিনে আমি বড় একটা যেতাম না কিন্তু যাই হোক, গেলাম ওদের চারতলার ছাদের ওপর shade বানিয়ে বসবার ব্যবস্থা আছে মঞ্চে জ্যোতিবাবু, বিনয় চৌধুরী আর আমি, আর একটা podium জ্যোতিবাবু বললেন, ও তো মাস্টার, তাই আমি ওকে বলেছি ভালো করে পড়াতে আপনারা মন দিয়ে শুনুন আমি বললাম আমার এই one teacher schoolএর economicsটা, বললাম আমাকে ঐ dutyর টাকাটা দিন

‘আরেকটা জিনিস বলেছিলাম এই ‘Build, Operate, Own’ ব্যাপারটা পার্টি accept করতো না আমি যখন বললাম এটা চীনও করেছে, দেখলাম নেতারা একটু নড়ে চড়ে বসলেন সেখানে প্রায় শ’খানেক লোক, সোমনাথ চ্যাটার্জীর মত বরিষ্ঠ নেতারাও বসে

‘দেখলাম, কেউ হ্যাঁ-ও বলে না, না-ও বলে না জ্যোতিবাবু বলেছিলেন আধঘন্টা-৪৫ মিনিটের মত বলতে বলা শেষ করে ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি, হয়েছে? মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললেন, এরা কিছুই বোঝে না, আমাকেই ধরতে হবে

‘উনি বলেছিলেন, একটা ছোট write up দাও, এটা budget speechএ যাবে সেও দিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা করলো না

‘এর পর ভাবলাম, এভাবে আর থাকা যাবে না ছেড়ে দিলাম

 সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমাগত বেসরকারী বিদ্যুতের ‘অযৌক্তিক’ শুল্কবৃদ্ধি নিয়ে যে মতবিরোধের কথা সে সময়ে প্রচলিত হয়েছিল, সে নিয়ে অবশ্য স্যার কিছুই বললেন না।

অদম্য অনুসন্ধিৎসা, অমলিন ধীমত্তা

ছাত্রাবস্থায় কলেজ থেকে সাঁওতালডি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আমাদের যে সফর হয়েছিল, তাতে স্যারও গিয়েছিলেন। তখন দেখেছিলাম, টারবাইনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সেখানকার ইঞ্জিনিয়াররা (অবশ্যই তাঁরই সব প্রাক্তন ছাত্র) স্যারকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর পরামর্শ নিচ্ছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও টারবাইন-বয়লার নিয়ে তাঁর এত জ্ঞান কি করে হলো। বিষয়টিকে যেন কোন গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, ‘ও হয়ে যায়

কিন্তু কি করে হয়? সকলের তো হয় না।

পড়ে পড়ে’, এবার বললেন। ‘আসলে ইচ্ছে থাকলে সবই করা যায় যখন লোকাল ট্রেনে কোলাঘাট যেতাম, তখন শুনতাম অন্য যাত্রীরা আমার সম্বন্ধে বলাবলি করছে, এ মন্ত্রী তো হেঁটে হেঁটে বয়লারে চড়ে যায় প্রথম ৫০০ মেগাওয়াট বয়লার দেখতেও আমি উঠেছিলাম।

একটি বহু পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্রমপর্যায়ে ultra super critical করে তোলার পরিকল্পনা মন দিয়ে শুনলেন।

তারপর, কথা হচ্ছিল সৌরশক্তির বিকাশ নিয়ে। সৌরশক্তি সঞ্চিত রাখার একমাত্র সাধন যে ব্যাটারি, তার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য গবেষণার প্রয়োজনের ওপর জোর দিলেন। সর্বাধুনিক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে বলে তিনি মনে করেন। যখন তাঁকে বলা হলো, আমেরিকায় টেসলা কোম্পানী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে প্রভূত উন্নতি এনেছে, এবং বৈদ্যুতিক গাড়ীতে এর প্রয়োগ অত্যন্ত সফল হয়েছে, উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, ‘আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তুমি ওদের literatureগুলো আমাকে পাঠাতে পারবে?’ এমন কি আমাদের যাবার সময়েও আবার করে মনে করিয়ে দিলেন, ব্যাটারির literatureগুলো কিন্তু পাঠাতে ভুলো না

ঘরে ঢুকেই সামনে টেবিলে একটা মোটা বই দেখেছিলাম, Vivekananda As The Turning Point: The Rise Of A New Spiritual Wave। আমাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন, ‘ওটা আমি অনুবাদ করছি। কোন publisherএর পছন্দ হলে ছাপবে।’

মনে রাখতে হবে, আমরা কথা বলছি এক নব্বই ছুঁই-ছুঁই মানুষের, যে বয়সে অধিকাংশেরই মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা হীন হয়ে আসে, অথবা শরীরের মত মানসিক কর্মক্ষমতাও বিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ইনি যে এক অনন্য মানুষ।

‘অবসর’ পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা বিষয়কে তিনি বহুদিন যাবৎ সাধারণ পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তুলেছিলেন। সে সম্বন্ধে বললেন, ‘ওদের সঙ্গে আমি শুরুর থেকেই ছিলাম নিজে লিখেছি বা অন্যের লেখা পাঠিয়েছি তবে ইদানীং অনেকদিন লেখা হয়নি এখন শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিতে হয় তাছাড়া, এখন বোধহয় বিজ্ঞানের থেকে সাহিত্যের প্রতিই ওদের জোরটা বেশী

 অচেনা মনন

ঘরে প্রবেশ করেই দেখা যাবে, এক দেওয়ালে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, অন্য দেওয়ালে শ্রীমা’র। তৃতীয় ছবির মহিলাকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি আমার স্ত্রী খুব সুন্দরী ছিলেন, জানো তো? ঐ যে বেঞ্চিটা দেখছো, ঐখানে উনি বসতেন

এ কোন ডঃ সেন? কলেজ জীবনে যে স্যারকে দেখেছি, তাঁর বহির্মন্ডলে একটি রাজকীয় গাম্ভীর্য ছাত্রদের সমীহ আদায় করতো। আর তাঁর অন্তরে যে কমনীয়তা, যে ভাবপ্রবণতা, তার পরিচয় সেদিন তাঁর কাছে না পৌঁছলে পেতাম কি?

ডঃ শঙ্কর সেনের জীবনে তাঁর স্ত্রীর যে অনস্বীকার্য সহায়ক ভূমিকা ছিল, সে সম্বন্ধে অন্যত্র জেনেছি। তিনি নিজে স্নেহময় ও সহানুভূতিশীল হৃদয়ের মহিলা ছিলেন, এবং স্যারের সব জনহিতকর কাজে সর্বদা অনুপ্রেরণা ও সঙ্গিনী ছিলেন। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তো ছিলই, কিন্তু আরও ছিল  পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের আবেষ্টন।

যাক সে কথা। কিন্তু এক বামপন্থী জমানার মন্ত্রীর ঘরে বিবেকানন্দ, শ্রীমা? কোন আপাত বৈসাদৃশ্য?

 তাঁর সঙ্গে এই সময় কাটিয়ে বুঝলাম, সত্যিকারের কত broad-based ছিলো স্যারের ধ্যানধারণা। কোন ismএর সংকীর্ণ বেষ্টনীতে এই মানুষটির জীবনকে আবদ্ধ করতে যাওয়া মূর্খতা। কারণ তাঁর জীবনদর্শন তাঁর শিক্ষা, সংস্কৃতি, নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি গভীর মানবিকতা প্রসূত। তাই তাঁর ব্যক্তিত্বকে দিয়েছিলো সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণতা।

আরো বিস্ময় বাকী ছিলো। মাত্র পাঁচ মিনিটের সময় নিয়ে যাঁকে শুধু প্রণাম করতে আসা, তাঁর সহজ অন্তরঙ্গ সংস্পর্শে কোথা দিয়ে কখন যে প্রায় দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেছে, বোঝাই যায়নি। এবার স্যারকে বিশ্রামের অবকাশ দেওয়া উচিত।  তাই আমরা উঠে দাঁড়ালাম। স্যার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে গেয়ে উঠলেন  – ‘অরূপ সায়রে লীলা-লহরী’। শ্রীমায়ের গান।

পারলাম কি তাঁকে সম্যক চিনতে?

দরজায় দাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সেঞ্চুরিটা ঠিক করে নেবো

শেষ কথা কিন্তু তিনি রাখেননি।

আমার সতীর্থরা: সুদীপ মজুমদার, সমীর ভৌমিক, শুভ চৌধুরী। আর অরুণ ভট্টাচার্য্য আসতে পারেনি।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার: সুদীপ মজুমদার – লেখাটির জন্য তথ্য, রসদ ও অনুপ্রেরণা যোগানোর জন্য।

শ্রীমতি অনসূয়া চক্রবর্তীর ফেসবুক ব্লগ, Dr Sankar Sen In Remembrance

 

 

 

জন্ম, শৈশব, প্রথম যৌবন কলকাতায়, তারপর দীর্ঘ কর্ম- ও অবসর জীবন বেঙ্গালুরুতে । আজীবন নাগরিক । এক অত্যাশ্চর্য্য, উদ্দীপনাময়, বিবর্তনকারী প্রজন্মের সাক্ষী ও হয়তো ভাগীদার । অবসরে সঙ্গীত, লেখা, পড়া ও আরও কিছু নান্দনিকতার সখ ও আগ্রহ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *