ইন্দ্রধনু

ইন্দ্রধনু

গানে গানে ইন্দ্রধনু দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে কারণ আমরা যে শৈশব থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছি। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি সাত সুরে সাত রঙ থাকে। ‘ইন্দ্রধনুউউউ’ যতবার বলেছেন তিনি অর্থাৎ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ততবার আমি দেখেছি রঙের পর রঙ মিশে যাচ্ছে। ছায়াছবির গানে পরিচিত দৃশ্যায়নের ওপরে উঠে যাচ্ছে এই গান তার নিজস্ব অবয়ব, চরিত্র, কল্পদৃশ্য নিয়ে। এখানেই সার্থকতা সুরকার, গীতিকার এবং অবশ্যই গানে যিনি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁর। আর এমনই ম্যাজিক ইন্দ্রধনুর রঙ কখনও ফিকে হয় না। সেই পঞ্চাশ দশকের গান! আজও অমলিন। একটুও কমেনি ম্যাজিক। আমাদের সুরহীন জীবনে কিংবা পালটে যাওয়া সুরের গল্পে ওই সুরগুলো চিরস্থায়ী।

সাধনা, চর্চা, চর্যা এই শব্দগুলো তখনকার শিল্পীদের সঙ্গেই মানাত বেশি। তাদের সাদামাটা, উচ্চমার্গের জীবনে অহেতুক বিতর্ক, ফ্ল্যাশি পোশাক, এক্স ফ্যাক্টর, গানের সীমা অতিক্রম করে ইভেন্টের রমরমা ছিল না। বিশুদ্ধ সঙ্গীত ছিল। তাই মূলত আধুনিক ও ছায়াছবির গান গাওয়া সন্ধ্যা মুখার্জির সাঙ্গীতিক শিক্ষা একেবারে পর্বত সমান। তাঁর আসন ছায়াছবি কিংবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সবেতেই সর্বাগ্রে। ১৯৪৬ সালে প্রথম হয়েছিলেন ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে। প্রথম হয়েছিলেন ভজনেও। বিচারকের আসনে ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ মহম্মদ দবির খান, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখরা। তারপরই সুযোগ পেয়েছিলেন মার্গ সঙ্গীতের বটবৃক্ষ উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর বাংলা বেসিক গানের প্রথম রেকর্ড। ১৯৪৮ সালে করেছিলেন প্রথম প্লে ব্যাক, ‘অঞ্জনগড়’ ও ‘সমাপিকা’ ছবিতে। বাংলা ছায়াছবির গানে হেমন্ত- সন্ধ্যা জুটি সুচিত্রা-উত্তমের মতোই ম্যাজিকাল। তারপর তো আর পিছনে ফিরে তাকাননি। একের পর এক অসাধারণ গান। এমনকি একথা অনস্বীকার্য উত্তম সুচিত্রা জুটি চিরঋণী এই গানের জুটির কাছে। অনেক গড়পরতা ছবি এদের দুজনের গানের জোরে হিট করে গেছে। কঠিন, সহজ, মার্গ ঘরানা কিংবা পাশ্চাত্য সুর সবেতেই সন্ধ্যা এত সাবলীল যে মনে হয় না সেসব গান গাইতে তাঁর পরিশ্রম হয়েছে, এমন অনায়াস বিস্তার তাঁর সঙ্গীতের সবখানে। ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ যখন গাইছেন, পায়রাদের ডানায় যে রোদের কুচি তা তো সন্ধ্যা মুখার্জির গলাতেও। ওই জায়গাটা মনে করলে এখনও শিহরিত হই ‘ হে কপোত পারাবত পায়রা যেদিকে দু চোখ যায়, দেখা যায় যতদূর…’ গানের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখ ভেসে যায় তত দূর… মনও নিঃসীম নিখিলে ডানা মেলে… কিংবা আর একটি মাইলফলক গান… ‘কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে’ … ছবির নাম ‘পথে হল দেরি’। ওই রকম করে আর কেউ বলতে পেরেছে ‘কিছুক্ষণ’ শব্দটি! পর্দায় সুচিত্রা সেন আর হৃদয়ে শ্রোতার প্রেয়সীর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে যতবার তিনি বলবেন আরো কিছুক্ষণ। ‘জয় জয়ন্তী’ ছবির গানগুলো আমায় চমকিত করে, এই ছবিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে কত রকমের গান গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখার্জি! তাঁর ব্যাপ্তি ও গায়কীর অন্যতম পরিচায়ক ‘জয় জয়ন্তী’ ছবির গানগুলো। “ওগো মোর গীতিময়” বইতে সন্ধ্যা মুখার্জি বলেছেন, “আজ পর্যন্ত সরাসরি ক্যাসেট শুনে আমি কখনও গান তুলিনি। আজও আমার রেকর্ডিং থাকলে সেই গান সবসময় ঘু্রতে ফিরতে গুনগুন করে গেয়ে প্র্যাক্টিস করে নিই। আর একটা কথা, রেকর্ডিংযের সময় মাইক্রোফোনের সামনে কাগজ রেখে কখনও গান করিনি।”

ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে গান। অনেক সাধারণ মানের ছবিতে অসাধারণ মানের গান থাকার জন্য উতরে গেছে ছবি। চিত্রনাট্য, অভিনয়, ফর্মুলা মাফিক বোরিং গল্প সব কিছু ছাপিয়ে থেকে গেছে গান। তাই এখন স্মার্ট ছবির সংজ্ঞা বদলালেও অতীতে অনেক আনস্মার্ট ছবিতে তুখোড় গান আসলে বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। আবার এও ঠিক অনেক ক্ষেত্রেই ছবির গান ছবির গুণমানের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে তৈরি হত। ভালো ছবিতে গানের সিকোয়েন্স তৈরি হত চিত্রনাট্যের গতিকে বাধা না দিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সেসব ছবি ভারতীয় দর্শক কোনোদিন ভুলতে পারেনি, পারবে না। ‘সপ্তপদী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘মায়ামৃগ’, ‘সবার উপরে’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘নতুন জীবন’ ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ‘নিশি পদ্ম’ প্রভৃতি ছবি ও ছবির গান দুইই অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে গেছে আজও বাঙালির জীবনে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর এত কম দিনের ব্যবধানে চলে যাওয়াতে ছবিতে গানের ব্যবহার ও পরিবেশনের কথাগুলো মনে হচ্ছে বারবার। বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁদের গানের জগৎটা আসলে একটা রূপকথার মতো। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি তাঁদের হাতে। বাকিটুকু এক অভাবনীয় ম্যাজিক। স্বর্ণযুগ বলে যদি কিছু নাও থাকে তাহলে ওই পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে যে গান তৈরি হয়েছে ছবির জন্য তা তো আমাদের চিরকালের সম্পদ। ছবিতে গানের প্রয়োজন আছে কি নেই সেই তর্কে যদি মেতে উঠি তাহলে ওই গানগুলোর জন্ম নিয়েই দ্বিধান্বিত হতে হয়। তা একেবারেই অসম্ভব। চিত্রনাট্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে আছে গান। ভালো ছবিতে অভিব্যক্তি, আবেগ, আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমই হল গান আর মশালা ছবিগুলোতেও কিছু গান একেবারে অলঙ্কারের মতো। বাড়িয়ে তোলে দৃশ্যের গুরুত্ব। ‘তু জাঁহা জাঁহা চলেগা’ এই গানটিতো ছাপিয়ে গেছে ছবি, বাণিজ্যিক প্লট, রোম্যান্টিক আবহ সবকিছুকে। এক অমোঘ বাণীর মতো এই গান পিছু নেয় আমাদের আজীবন। কিংবা ‘আকাশের অস্তরাগে আমরই স্বপ্ন জাগে তাই বুঝি হৃদয়ে দোলা লাগে’… যে দিনটা ভালো কাটে, সূর্যাস্তটা চমৎকার হয়, শেষ সোনালি আলো চুরি করে নেয় হৃদয় তখন এই গান সত্যিই দোলা দিয়ে আজও, হয়তো আগামী আরো অনেক বছর এমনই অনুরণন চলতেই থাকবে।

সাধনা, অধ্যবসায়, গানের প্রতি যত্ন কী অভাবনীয় মাত্রার ছিল তখনকার শিল্পীদের এসব কারো অজানা নয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান থাকত উনি তখন বেশ কিছুদিন লঘু সঙ্গীত গাইতেন না। সমস্ত মনোযোগ, রেওয়াজ, দায়বদ্ধতা তখন ধ্রুপদী ঘরানার প্রতি নিবেদিত। আর তখনকার শিল্পীদের রুচিবোধ সম্পর্কে ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। শুধুমাত্র নাম বা পয়সার জন্য কিছু করেননি, যাতে মন সায় দিয়েছে তাই করেছেন। একটি ঘটনার কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ দিকে সুরকার হিসেবে একটি ছবির গানের জন্য তিনি ডাক পাঠিয়েছেন সন্ধ্যা মুখার্জিকে। গানটা শেখার পরও তিনি কুন্ঠিত। “এই গান কি গাইব আমি হেমন্তদা?” “হ্যাঁ গাইবি, কী হয়েছে?” বললেন হেমন্ত। বাড়িতে ফিরে যখন মেয়ের আবদারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গানটি গেয়ে শোনালেন, মেয়ে বলেছিল, “মা তুমি এই গান গাইবে?’ মেয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে গেলেন খুব। বাইজির গান কতখানি উচ্চাঙ্গের হতে পারে তিনি জানেন কিন্তু এ গান তো তেমন নয়। এত হালকা কথা গানের লাইনে, মন সায় দিচ্ছে না। এত দ্বিধা দেখে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী ও প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্ত মহাশয় ফোন করে আপত্তির কথা জানিয়ে দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। এই বয়সে এসে সন্ধ্যা মুখার্জি গাইতে চাইছেন না “তোমার গা ছুঁইয়ে দিব্যি করে বলছি/ আমি তোমায় ভালোবাসি।”এত চপল কথা যে গানে তিনি কেন গাইবেন?

প্রেমের দিন ঘিরে উৎসবগুলো আধুনিক অনুষঙ্গ কিন্তু প্রেমের গান আমাদের মতো আর কেউ লিখেছে, বেঁধেছে, গেয়েছে কি না জানা নেই। হাজার হাজার প্রেমের গান আর তার বেশিরভাগই আইকনিক। সুরকার, গীতিকার, গায়ক গায়িকার কাছে কতবড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল ভাবি তাই। প্রেমের কিংবা বিরহের গানকে নতুন নতুন রূপে, সাজিয়ে গুছিয়ে এমন ভাবে পরিবেশন করতে হবে যে সে ছাপিয়ে যাবে আগের গানটিকে। শ্রোতার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আরো কয়েক দশক। বারবার ফিরে আসতেই হয় ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু আজ স্বপ্ন ছড়াতে চায়, হৃদয় ভরাতে চায়’ গানটিতে কারণ ছবির গানগুলো দিয়েই কিন্তু উতরে গিয়েছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিটি। আর গানটির শিকড় ছড়াতে ছড়াতে কোথায় যে পৌঁছে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। বিরাট মহিরুহ… সন্ধ্যা মুখার্জি যখন বলেন ‘ মিতা মোর কাকলি কুহুউউউউ’… ওই গাছে বসা অনন্ত যৌবন এক পাখিকেই তো দেখি! আর বুঝতে শিখি সব ছাপিয়ে গান কীভাবে জীবন হয়ে ওঠে। ভালো কথা, সুর আর এমন গায়কী একটি গানকে একটি অধ্যায়ের সূত্রধর করে তোলে। সন্ধ্যা মুখার্জি তাঁর জীবনীগ্রন্থে বলছেন, “কুহু শব্দটা আমার গানে যখন আসছে অনেকেই ভেবেছেন, ওটা বেহালার সুর। আসলে এটা গলার একটা অলঙ্কার। এর আগে এ ধরণের জিনিস বাংলা ছবির গানে প্রয়োগ করা হয়নি। অগ্নিপরীক্ষা ছবির মুক্তির পর বহু বাংলা এমনকি হিন্দি ছবিতেও এধরণের প্রয়োগ দেখা গেছে। অনুপম ঘটক কুহু শব্দের আন্দোলনের বৈচিত্র্য শুনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। সন্ধ্যা মুখার্জিকে বলেছিলেন, “সন্ধ্যাদিদি এই গানটা আমি এক্সপেরিমেন্ট করছি। দেখি রেজাল্ট কী হয়।” এইসব পড়ি আর ভাবি ইতিহাস এভাবেই তৈরি হয়। তখন ভেসে যায় সব মন খারাপ, কে পুরস্কার পেলেন আর কে পেলেন না… শ্রবণে এবং মস্তিষ্কে শুধুই অনুরণন্‌, “কে জানে গো তার বাঁশি আজ — কী সুর প্রাণে ধরাতে চায়।” মহানায়ক, মহানায়িকা এই বাজারি শব্দগুলো শুনলে খুব বিরক্তি আসে মনে। মহাগায়িকা, মহাগীতিকার, মহাপরিচালক নেই কেন? সব উপাধির সমবন্টন হোক। তারপর তো সম্মান। পুরস্কার।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা। যাদবপুর থেকেই স্প্যানিশ ভাষা এবং মাস কমিউনিকেশনে ডিপ্লোমা। লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিলই কিন্তু পরবর্তীকালে লেখাটাই জীবন জুড়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা, দি ওয়াল, এশিয়ানেট বাংলা, আরেক রকম, বিতর্ক, ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম, পান্থজন, ষান্মাসিক রবীন্দ্রনাথ, এবং সইকথা, কবিতাউৎসব, রংরুট, দক্ষিণের জানালা, পূর্বাশা এখন, গুটিপোকার সুতো, বাতিঘর অনলাইন, প্রবচন পত্রিকা, ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকা, মকটেল পত্রিকা, পেট্রোনাস, রা প্রকাশনের অভয়া, রায়ান, অভিব্যক্তি নিউ জার্সি, উদ্ভাস, ও কলকাতা, সৃজন ব্লগজিন, তিতিক্ষা প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ভালোবাসেন লিখতে, পড়তে, বেড়াতে, সিনেমা দেখতে আর আড্ডা মারতে। প্রকৃতির কাছে উদারতা শেখেন আর মানুষের কাছে খোঁজেন গল্প। দেবব্রত বিশ্বাস আর মহম্মদ রফির গান তাঁর সুখ দুঃখের সহচর। আবেগ আর রোমান্সে ভরপুর সমর্পিতা সবচেয়ে ভালোবাসেন বাংলা অক্ষর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *