তুমি রবে, নীরবে

তুমি রবে, নীরবে

“এই চন্দ্র! কেমন আছ? অসময়ে কল করে বিরক্ত করলাম না তো? তোমার সংগে আমার অনেক কথা আছে…” …কানে এখনো বাজছে কথাগুলো। 

বাড়িতে গেছি দেখা করতে… “এই, তুমি কফি খাবে? সঙ্গে দুধ? চিনি?” তড়বড় করে জলের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছেন, খুব ব্যস্তসমস্ত, কেমন একটা দিশেহারা ভাব, কী ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করবেন! আমরা বলতাম, “সুজন-দা, একটু বসুন তো! ‘বুই’কে আমরা বলব আপনি আমাদের দারুন খাতির করেছেন।” বুই মানে শমীতা-দি। তা কে কার কথা শোনে? এই রকমটি ছিলেন আমাদের সুজন-দা!

আজ তুমি সব্বার ধরা-ছোয়াঁর বাইরে চলে গেলে, যেমন করে ‘সোনার কেল্লা’র ডক্টর হাজরা  “ভ্যানিশ!” হয়ে গেছিলেন চক্ষের নিমেষে?

বরিস আর আমি, দুই dance-dad মেয়েদের নিয়ে মিত্রা-দি র বাড়িতে যাই নাচ শেখাতে। পাশের স্টুডিওতে ওডিসি নাচের রিহার্সাল চলছে, সুন্যায়া আর গিনি তালিম নিচ্ছে। এদিকে ল্যাপটপএ কাজের ফাঁকে অল্পস্বল্প কথাবার্তা হচ্ছে আমার আর বরিস-এর, সেই থেকে আলাপ সুন্যায়ার বাবার সঙ্গে। 

“তুমি একেন বাবু দেখেছ? হইচই চ্যানেল-এ হচ্ছে।” 

বরিসের কথায় মনে পড়ল কয়েকমাস আগে আমি আর অদিতি দেখেছি বটে। ব্যোমকেশ, কিরীটি, কাকাবাবু-র পর বেশ সাড়া-জাগানো গোয়েন্দা কাহিনি। প্রথম সিরিজটা বেশ টানটান সাসপেন্স, ডিটেক্টিভএর চরিত্রটি এক্কেবারে unique, গল্প বিন্যাসও বেশ জমজমাট। বাংলায় এরকম একজন সুপারহিট ডিটেক্টিভ, আজকের দিনে? এক কথায় সুপার্ব! স্রষ্টা সুজন দাশগুপ্ত।

সাংঘাতিক রসিক ছিলেন আর নিজেকে নিয়ে অবলীলাক্রমে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসর মাতিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। কত না সে গল্প! সাউথ এন্ড পার্ক-এর জীবন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে  মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রাবস্থা, দিল্লিতে কর্ম-সূত্রে অবস্থান। পুস্তক আকারে সেইসব মজাদার ঘটনাগুলো “সুজন-কথা”তে লিপিবদ্ধ করেছেন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, “আপনি কী লেখেন?” জবাব দিতেন, “আমি ধাঁধা লিখি!” “ধাঁধা-পুরী” বইতে যত ইন্টারেস্টিং সমস্যা সমাধান করেছেন হাসির ছলে।

সামনে পেলে ছাড়তেই চাইতেন না। সুজন-দা ও শমীতা-দি কলকাতা রওনা হবার আগের দিন সন্ধেবেলা অদিতি আর আমি গেলাম দেখা করতে, একটা পাঞ্জাবি শমীতা-দির হাতে কলকাতা পাঠাতে হত, পাঁচ-দশ মিনিটের ব্যাপার। আমাদের দেখে দুজনেই বললেন, “আরে বোসো তো, সব গোছগাছ হয়ে গেছে, অত তাড়া নেই!” এই না বলে চা আর কফি বানিয়ে, তার সঙ্গে চানাচুর আর সুজন-দা র গল্পের ঝুলি! পাক্কা দুটি ঘন্টা কাটিয়ে প্রায় জোর করে উঠি, বলি, “আরে তোমরা তো বিশ্রাম নেবে? এতো লম্বা journey!” গাড়িতে উঠে দেখি সুজন-দা গ্যারাজ-এর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন, এগিয়ে দিতে এসেছেন, বিদায় জানাতে। বেশ ঠান্ডা ছিল সেই রাত্রে, বললাম, “সুজন-দা ভিতরে যাও, কাল কলকাতা যাচ্ছ, ঠান্ডা লাগিও  না।” স্বপ্নেও ভাবিনি সেটাই তাঁর শেষ বিদায়!

পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই যেন চিরজীবনের অদৃশ্য বন্ধন হয়ে গেল আমাদের তিনটি পরিবারের। এরপর থেকে সব সময় আমরা পাঁচটি মাথা কতই না আড্ডা মেরেছি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন বাড়িতে! নিছক চায়ের আসর অথবা সাক্ষাৎকার শমীতা-দি সুজন-দার, বিজয়া দশমীর এদেশ-স্বদেশের গল্প। কেন্দ্রবিন্দু সুজন-দা, শমীতা-দি আর সঙ্গে গুণগ্রাহী আমরা তিনজন, সংগ্রামী, অদিতি, ও আমি। অপার স্নেহ করতেন, গভীর ভালোবাসতেন, আর ডাকলেই হল, তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতেন। আমাদের “আড্ডা নিউ জার্সি” পরিবারের একজন অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক।

লোকে জানে সুজন দাশগুপ্ত বেসমেন্ট-বাসী, সচরাচর কোথাও যেতেন না। আমরা তো অবাক শুনে, যে ওনারা আমাদের স্টেজ অভিনয়ও দেখেছেন পারসিপেনির পুজোতে! “আড্ডা নিউ জার্সি”র বৈঠকে জুম্ লিংকএ সুজন-দা বেসমেন্ট থেকে আর শমীতা-দি নিজের ঘর থেকে যোগ দিতেন, একবার আমাদের আবদারে দু-জনে পাশাপাশি সোফায় বসে অনুষ্ঠান দেখলেন। জীবনে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না, শুধু বাগানে হরিণ তাড়ানোর গুঁড়ো ছড়াতে ভুলে যেতেন মাঝেমধ্যে। তার ফলে কিছু ফুলগাছ হরিণের পেটে যেত আর বকুনি খেতেন শমীতা-দির কাছে ।

“বুই”কে নিয়ে ভীষণ গর্ব ছিল। সবসময় বলতেন, “বুই যে কত কাজ করল, কটা লোক আর জানল বল?” আমরা বললাম, “তা তুমি লেখো না কেন? তোমার থেকে বেশি কারই বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হবে এই বিষয়ে?”  

সাউথ এন্ড পার্ক আর যাদবপুর বিশ্বাবিদ্যালয়ের রকে বসে আড্ডা দেবার মত উপযুক্ত কোনো জায়গা পাননি এই নিউ জার্সিতে বিগত পঞ্চাশোর্ধ বছরে। তাঁর অন্তরের সেই আড্ডাবাজ সত্ত্বা তাই কলকাতা আর বইমেলা যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। মানুষের সাহচর্য ছিল সুজন-দা র সবচেয়ে প্রিয়, নির্মল ভাবের আদান প্রদান, মুক্ত চিন্তাধারা, আগল বিহীন মনের মিল খুঁজে বেড়াতেন আর জলের মতন মিশতেন সব্বার সঙ্গে। তাই ওনার অমর সৃষ্টি “একেন বাবু” হলেন ভীষণ ভাবে সাংসারিক, সাদামাটা, বকুনতুরে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, বুদ্ধিদীপ্ত  সুজন-দা র ই প্রতিচ্ছবি।

আমরা কি কল্পনাতেও আনতে পারি যে কাল সূর্যোদয় হবে না? বাতাস থাকবে না? সুজন-দা র চলে যাওয়াটা যেমন আকস্মিক, তেমনই অবিশ্বাস্য। বড্ডো ভরসা করেছিলাম যে তুমি আরো অনেকদিন ধরে থাকবে ছাতার মতো, বটগাছ হয়ে থাকবে, অজর অমর! হায় রে বাস্তব ! সব্বার বিশ্বাসকে এক নিমেষে ফাঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলে, সব ধাঁধার উত্তর মেলে না, কাল-এর বিন্যাসে আমাদের কোনোই হাত নেই! বজ্রপাতের মতো এক রাতের মধ্যে সব ওলোট পালট হয়ে গেল। তুমি নেই! এক বিষম অভিমান নিয়ে এখনো অবিশ্বাস করি যে তুমি আর সামনে আসবে না, হঠাৎ করে ফোন করবে না। তুমি আছ চিরদিন যে আমাদের মাঝে মধ্যমণি  হয়ে!

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • শেখর বসু , March 21, 2023 @ 5:16 am

    ভালো লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *