পরিস্থান

পরিস্থান

প্রকৃতিতে যতটুকু রঙের আয়োজন, তাহা তাহার আবরণ কী আভরণ নহে। তাহা প্রকৃতির প্রত্যয়। চিরন্তন বিপুলা এই প্রকৃতির কোথাও এক তিলও নাই, যাহা বর্ণের উজ্জ্বল সম্মান হইতে বঞ্চিত। এই রং তাহার বহিরঙ্গ হইতে আসে নাই, কেহ তাহাকে বাহির হইতে রাঙ্গাইয়া দেয় নাই। এই রং তাহার পাইবার নয়, হইবার বিষয়।

এই সকল কথা ভাবিতেছিলাম একটি কাঁঠালি চাঁপা গাছের সম্মুখে দাঁড়াইয়া। কর্মসূত্রে আসিতে হইয়াছে শহর হইতে দূরে একটি আপিসে। আসিয়া আবিষ্কার করা গেল, আপিসটির সম্মুখে একটি সুদৃশ্য বাগিচাও আছে। এই সকল ক্ষেত্রে কর্মের সহিত আমার ব্যক্তিগত অকর্মের এক নিবিড় আয়োজন থাকে। নানাবিধ ব্যক্তিগত কারণে চিত্ত খানিক বিমর্ষ হইয়াছিল। বিমর্ষ নাগরিক চিত্তের জন্য প্রকৃতির চাইতে উপযুক্ত বিশল্যকরণী অপর কেহ হইতে পারে না। তাই কর্মের মধ্যে মধ্যে বারংবার আসিয়া দাঁড়াইতেছিলাম অকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে।

শহরের রাখাল বৃক্ষ চিনে না। উক্ত বৃক্ষের নাম কাঁঠালি চাঁপা, তাহা আলোকচিত্র দেখিয়া এক বন্ধু জানাইল। পুষ্পটির শুভ্র পাঁচটি পাপড়ি, মধ্যে ডিমের কুসুমের ন্যায় হরিৎ আভা। শহরের রাস্তায় কী গলিতে এই পুষ্প দেখি নাই বলিলে মিথ্যাচার হইবে। কিন্তু দৃষ্টির দৌড় সর্বত্র সমান হইলেও পরিবেশ দর্শনের তারতম্য ঘটাইয়া তোলে। চারিদিকে এক নিস্পৃহ স্তব্ধতা, কোলাহল নাহি কোথাও, একপার্শ্বে বেলিফুল গালিচার মতন বিছাইয়া রাখিয়াছে কেহ, অপর পার্শ্বে সূর্যমুখী ফুটিয়া আছে প্রিয় মানুষের মতন। এই সকল অরূপের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুটিয়া আছে নরম শুভ্র পাপড়ি লইয়া কাঁঠালি চাঁপা। কিছু সামনের সবুজ ঘাসের উপর বিছাইয়া আছে। দেখিয়া মনে হইতেছে, ঘাসের উপর লুটোপুটি করিবার জন্যই উহাদের প্রস্ফুটিত হইবার এত আয়োজন!

আপিসে প্রবেশ করিলাম। অকর্মের অধিকার সুরক্ষিত করিবার জন্যই কর্মক্ষেত্র অবহেলা করা চলে না। তাই প্রাণ যেখানেই পড়িয়া থাকুক, দেহ, মন এবং কলম লইয়া কর্মে মনোনিবেশ করা গেল।

অফিসের ভিতর অন্তর্জাল ভালো ধরে না। দেখিয়া আনন্দিত হইলাম। মনে হইল বাহিরের জগতের সহিত সম্পর্ক খানিক সময়ের জন্য টুটিল। সম্মুখে নানাবিধ হিসাবের কাগজপত্তর, টেবিলের পার্শ্বে চায়ের কাপ এবং মাথার ভিতর ইতস্তত ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনার সূত্র। সুন্দরকে ভাবিলে মনের ভিতর এক ভাব আসে। সেই ভাব সুন্দর নহে, তাহার নাম একাকীত্ব। সুন্দরকে মানুষ কেবল একলা অবস্থাতেই গ্রহণ করিতে পারে। ভিড়ের ভিতর যে সুন্দরকে দেখা যায়, তাহা মধুর নয়, তাহা পূজ্য।

যে আপিসের আজ কপাল পুড়িল আমাদের আগমন হেতু, তাহাদের কয়েকটি হিসাবের কাগজে লাল দাগ দিয়া কলম পার্শ্বে রাখিলাম। মনে হইল প্রকৃতির এই রঙের ভিতরেও একটি বৃহৎ ফাঁক আছে। কিন্তু তাহা যে কী, সেই মুহূর্তে মাথায় আসিল না। ম্যানেজার আসিয়া জোড়হস্তে বলিল, “স্যার খাবার রেডি আছে, দিয়ে দিই?”

খাবারের পর সিগারেট খাইতে বাগানে আসিলাম। দেখিলাম তড়বড় তড়বড় করিয়া একটি গিরগিটি চলিয়া যাইল। দেখিয়া বোধ হইল সংসারে তাহার চাইতে ব্যস্ততম আর কেহই বোধকরি নাই। লিকলিকে চারিটি ঠ্যাং তুলিয়া মখমলি সবুজ ঘাসের উপর সেই অযাচিত দৌড় বহুদিন স্মরণে থাকিবে। গরম হাওয়ায় তখন হলকা লাগিয়াছে। তথাপি শহরের ন্যায় তাহা অসহ্য বোধ হইতেছিল না। সূর্যমুখী দেখি খানিক হাওয়ায় নত হইয়া পড়িতেছে। আরো কয়েকটি কাঁঠালি চাঁপা ঘাসের উপর নিজেদের বিস্তার ঘটাইয়াছে।

দুপুর কাটিল সকালের মতনই। কাজ এবং অকাজের চিন্তায়। সন্ধ্যার দিকে আকাশ কালো করিয়া ঝড় আসিল। খুব বিধ্বংসী কিছু নহে। শীতল ঝোড়ো হাওয়ার সহিত কয়েক বিন্দু শীতল বৃষ্টি। ইচ্ছা করিয়া বাহিরে যাইলাম। চারিদিক গভীর তমসাচ্ছন্ন, টিমটিম করিয়া অফিসের চারিপার্শ্বে কয়েকটি আলো জ্বলিতেছে। উহা অন্ধকারকে প্রশমিত নহে, আরো প্রকট করিয়া তুলিয়াছে। এমন সময় আকাশের দিকে চাহিয়া দেখি অনন্ত তমিস্রাচ্ছন্ন আকাশ চিরিয়া যাইল বিদ্যুৎরেখায়। বাগিচা তখন অন্ধকারে, আকাশ জাগিয়াছে। বৃষ্টির বেগ বাড়িতেছে। আপিসে পলায়ন করিলাম।

কার্য অনেকাংশে আগাইয়া গিয়াছিল বলিয়া খানিকক্ষণ চুপটি করিয়া বসিলাম। শান্ত হইয়া কোনোকিছু ভাবা কী চিন্তা করাও যে একটি মহৎ কার্য, আজকালকার মানুষ তাহা মানিতে চাহে না। তাহারা মনে করে যে কার্য খুব ঢোল করতাল সহ জাঁক করিয়া দেখাইবার মতন নহে, তাহা প্রকৃত কার্যই নহে। তাই কর্মের মধ্যে তাহারা মুক্তির স্বাদ পায় না, প্রলোভনের ডাক পায়। প্রলোভনের আকাশ উন্মুক্ত, তাহাতে বঞ্চিত করিয়া বাঁচাইবার প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসে না। হতভাগারা অকর্মের উদযাপন হইতেও চিরতরে বঞ্চিত রহিয়া যায়।

তৎক্ষণাৎ অনুভব করিলাম প্রকৃতির ভিতর যে শূন্যস্থান মনে আসিতেছিল তাহা আসলে এক শৃঙ্খল। উহার বাহিরে যাইবার কাহারও উপায় নাই। বেলিফুল গাছে গোলাপ ফুটিবে না, গিরগিটি তিন পায়ে দৌড়াবে না, কাঁঠালি চাঁপা কোনোদিন সূর্যমুখী হইতে পারিবে না। নিবিড়ভাবে দেখিলে বোঝা যায়, এই সমস্ত আয়োজনই আসলে নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। নিয়মের বাহিরে যাইবার ইচ্ছা বা স্বাধীনতা ইহাদের নাই। প্রকৃতির একটিমাত্র সৃষ্টিই আছে, যাহারা নিয়মের প্রস্তরে উৎকীর্ণ লিপি অস্বীকার করিবার স্পর্ধা দেখাইতে পারে, তাহার নাম মানুষ।

ইহার জন্য প্রকৃতির রাজ্যে কোনো প্রশ্ন নাই, কোনো ধূসর অবস্থান নাই। সে হইতে পারিলেই সার্থক। তাহার যেমন সংকীর্ণতা নাই, তেমনি তাহার ক্ষমাও নাই। প্রশ্ন, ধূসর অবস্থান এবং আপনাকে ছাপিয়া যাইবার প্রয়াস তাই মানবজাতি ভিন্ন আর কাহারও ভিতর পরিলক্ষিত হয় না। মানুষ করিতে পারে, কারণ সে আপনাতে আপনি সন্তুষ্ট নহে। শৃঙ্খলের নিগড়ে যে ভক্তি এবং শক্তির পরাকাষ্ঠা আছে, মানুষ তাহার ঊর্ধ্বে, কারণ সে ভালোবাসিতে পারে। ইহার জন্যই সে একাধারে দেবতা এবং দানব হইবার ক্ষমতা ধারণ করে।

যে কর্মের জন্য এইস্থানে আগমন, তাহা একদিনে শেষ হইবার নয়। অন্ততঃ একরাত্রিবাস খুব সাধারণ বিষয় এইসমস্ত ক্ষেত্রে। রাত্রির খাবারের পর ঘুমাইয়া পড়িলাম। বাহিরে তখনও ঝড়ের বাতাস, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।

নিজগৃহে যতই আলস্যরাজ উপাধি ধারণ করি না কেন, নূতন জায়গায় তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙিয়া যায়। ঘড়িতে দেখিলাম সোয়া পাঁচটা। সকলেই নিদ্রামগ্ন তখনও পর্যন্ত। চোখে মুখে জল দিয়া বাগিচায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। ভোরের ভিতর একটি স্নিগ্ধ পরি বাস করে। সে সকলকে নিজের অদৃশ্য স্পর্শে নবীন রূপ দেয়। গতকালের কথাই মনে আসিতেছিল বারংবার। এই যে এত সুন্দরের আয়োজন, তাহার মূলে মনে হয় প্রেম। আসলে প্রকৃতির সবচাইতে বড় কবচ তাহার নিপাতনে সিদ্ধ মানবিক অংশটুকু, যাহা স্পর্ধিত, শৃঙ্খল মানে না। ফলতঃ সর্বনাশ ঘটাইতেও সে পটু, তবু তাহার শিক্ষা হয় না। কারণ প্রেমের ভিতর সৃষ্টির স্বতঃসিদ্ধ অমৃত বিধৌত থাকে। ভালোবাসা তো অহেতুক, নিপাতনে সিদ্ধ। তাহা সৃষ্টি করিতে হয়। পূর্বে অস্তিত্ব ছিল না, অকস্মাৎ আসিয়া চারিদিক ভাঙ্গিয়া কোথায় কোন সর্বনাশা যমুনার তীরে লইয়া চলিয়াছে! যাহা ছিল, তাহার প্রস্তুতি সাজে। যাহা কস্মিনকালেও ভাবি নাই, তাহাই যখন আসিয়া জাগরণ এবং নিদ্রার সবটুকু হরণ করিয়া লয়, তখন কোথা পথ! কাহার নিকট নালিশ জানাই! তবু সে মরণ কী সীমাহীন মধুর!

কলিকাতা হইতে প্রায় একশত মাইল দূরে ভোরবেলা এক পরিস্থানে দাঁড়াইয়া আমার কেবল একটি কথাই মনে আসিতে লাগিল, এই সকল বৃক্ষ, এই সকল কীট পতঙ্গ, হাওয়া বাতাস আলো জানিতে পারিল না, সুখের বেদন আর বেদনের সুখ কী নিবিড় অমৃতময়!

একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য হাসিমুখে লইয়া প্রকৃতি চলিয়াছে, তাহার বিরাম নাই, তাহার ক্লান্তি নাই। মানুষ মধ্যখান হইতে একবার প্রবৃত্তির পানে চায়, একবার চায় প্রেমের পানে। এই দ্বন্দ্বই মানবসভ্যতার চিরন্তন চালিকাশক্তি। এই দ্বন্দ্বই মানুষকে কখনও দেবতার রূপ প্রদান করিয়াছে, কখনো বানাইয়াছে দানব। ইহার জন্যই সাদা আর কালোয় তাহাকে বাঁধিবার উপায় নাই। সে ধূসর, সে অপরূপ।

ম্যানেজার পিছনে আসিয়া কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলিল, “স্যার সকালের চা!”

হাসিমুখে বলিলাম, “চলুন তাড়াতাড়ি করে শেষ করা যাক এবার, বাড়ি টাড়ি যেতে হবে তো!”.

নয়ন বসুর জন্ম কলকাতায়, পেশায় আয়কর আধিকারিক। নেশায় পাঠক, শ্রোতা, দ্রষ্টা এবং একদম শেষে লেখালিখি। বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন এবং জানলা দিয়ে পাহাড় দেখা গেলে হোটেল থেকে বেরোতে চান না। ভূতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ভয় পান। ভয় পান উচ্চতা, প্রিয়জনের দূরত্ব এবং পাঁচ বছরের সন্তানের কান্না। প্রিয় খাবার বিরিয়ানি, প্রিয় মানুষ যারা বিরিয়ানি খাওয়ান। অপছন্দ মিথ্যে কথা। পছন্দ পুরোন আমলের বাড়ি, মেঘ আর ঘুম। প্রকাশিত বই একটি, নাম জামিলা। জীবনের লক্ষ্য চোখ বুজবার আগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতাটি লিখে যাওয়া।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Antara Chatterjee , July 20, 2022 @ 5:31 am

    খুব খুব সুন্দর করে লেখা।

    • নয়ন বসু , July 21, 2022 @ 3:18 am

      অনেক ধন্যবাদ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *