রসায়নের মহাগুরু

রসায়নের মহাগুরু

আমাদের সায়নদা রসিক মানুষ এবং পানাসক্ত। না, না, এই পান বলতে ইথানল-জলের অনুপান গলাধঃকরণ করা নয়, বরং ইংরাজি pun. সায়নদা রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, আমাদের সঙ্গে দেখা হলেই মাঝেমধ্যে টুকটাক রাসায়নিক pun-এর পিক ফেলতেন। এই যেমন আজ সকালেই বলে উঠলেন, – “জানিস, ব্রিটিশ রসায়নবিদরা বেশি পাউন্ড আয় করবার লোভে কম্পাউন্ড বানাতেন রসায়নাগারে?”

আমরা বললাম, “বেশি পাউন্ড আয় করার লোভে কম পাউন্ড? সেটা কী রকম?”
সায়নদা বললেন, “ওরে হাঁদা, কম পাউন্ড নয়, কম্পাউন্ড, মানে যৌগিক পদার্থ। কেমিক্যাল। কেন বানাতেন? যাতে বেশি বয়সে ‘রিফ্লেক্স’ কমে না যায়, তার জন্যে কোনো তরলকে একটা বিশেষ ফ্লাস্কে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ‘রিফ্লাক্স’ করতেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা যখন পাকা রাস্তা বানাতে কাঁচা রাস্তার ওপর পাথরকুচি ছড়িয়ে দুরমুশ করে তার গ্যাপগুলো ‘ফিল’ করত ‘টার’ অর্থাৎ আলকাতরা দিয়ে, রসায়নবিদরা তরল থেকে কঠিন কম্পাউন্ডের গুঁড়ো আলাদা করার জন্যে অদ্ভুতদর্শন ফোঁদলে নিয়ে তার মধ্যে দামী কাগজ ভরে ‘ফিল্টার’ করত।”
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, “হেঁয়ালি না করে খোলসা করে বলো না, কী বলতে চাও!”
সায়নদা বলল, “বলব বলেই তো এলাম। ভালো করে বুঝিয়ে বলছি, মন দিয়ে শোন। বকযন্ত্র দেখেছিস? না দেখলে কোনো পুরনো আমলের ইস্কুলে গিয়ে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে ঢুঁ মারিস, দেখিয়ে দেবে। কাচের তৈরি একটা গোল ফ্লাস্কের মুণ্ডুটা বকের গলার মতো লম্বা (নীচের প্রথম ছবিটার মতো)। এই বকযন্ত্রে যদি একটা তরল নিয়ে তলা থেকে গরম করা হয়, তবে তরলটা স্ফুটনাংকের ওপরে গেলেই বাষ্পীভূত হয়ে সেই বাষ্প ওই গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। বেরোনোর সময় যদি ঠাণ্ডা হয়ে ফের তরল হয়ে যায়, তবে সেই তরল ফোঁটা ফোঁটা করে সংগ্রহ করা যেতে পারে (যেমন করা হচ্ছে দ্বিতীয় ছবিতে একটা বিকারে, অথবা তৃতীয় ছবিতে একটা ফ্লাস্কে)। প্রয়োজনে বাষ্পটা ঠাণ্ডা করার জন্যে ওই ফ্লাস্কের ওপর জল ঢালা যেতে পারে (যেমন তিন নম্বর ছবিতে করা হচ্ছে), বা জলে ভেজা গামছা জড়িয়ে রাখা যেতে পারে বকযন্ত্রের ওই সরু গলায়। তো এইভাবে যেমন দুই বা তার বেশি তরলের মিশ্রণ থেকে তাদের আলাদা করা যায়, তেমনি কোনো দ্রবীভূত কঠিন থেকে তরলও আলাদা করে ফেলা যায়। যেমন চিনির সিরাপ এইভাবে ফোটালে জল বাষ্প হয়ে বেরিয়ে আসবে, তাকে ঠাণ্ডা করে ফের জলে পরিণত করে নেওয়া যাবে, চিনিটা পড়ে থাকবে বকযন্ত্রের ফ্লাস্কে।”

আমরা বললাম, বেশ। এ তো আমরা দেখেছি। তুমি আরও কী কী যে বললে? রিফ্লাক্স না কী?

সায়নদা বললেন, রিফ্লাক্স করা মানে তরলের স্ফুটনাংকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় গরম করলে তরলটা বাষ্পীভূত হয়ে যাতে উবে আলাদা না হয়ে যায়, তার জন্যে বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে সঙ্গে সঙ্গে তরলে রূপান্তরিত করে আবার ওই ফ্লাস্কে আনিয়ে নেওয়া হয়। গরম আর ঠাণ্ডা একই সঙ্গে তো করা যায় না, তাই গরম করা হয় একটা ফ্লাস্কে নিয়ে, তলা থেকে তাপ দিয়ে। ফ্লাস্কের গলা দিয়ে সেই বাষ্পটা বেরিয়ে ওপরে এলে তাকে পাস করানো হয় একটা উল্লম্ব টিউবের মধ্যে দিয়ে যার গায়ে আর একটা টিউবের চাদর পরানো আছে। একটা বড় ব্যাসের নলের মধ্যে একটা ছোট ব্যাসের নল ঢোকানো আর-কি! এই

 

 

 

দুই নলের মধ্যের যে ফাঁকা জায়গা, তা দিয়ে কোনো ঠাণ্ডা তরল, যেমন ঠাণ্ডা জল, সার্কুলেট করা হয়। বাষ্পটা ছোট নলের মধ্যে দিয়ে যেই বাইরে এল, অমনি এই ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে ফের তরল হয়ে গেল। সেই তরলটা তার নিজের ওজনেই ড্রপ ড্রপ করে আবার পড়তে থাকে ঐ ফ্লাস্কের মধ্যেই। এর ফলে ফ্লাস্কের তরল আলাদা হয়ে অন্য কোথাও জমা হয় না বলে ফ্লাস্কে মোট তরলের পরিমাণ মোটামুটি একই থাকে (নীচের ছবি)।

সায়নদা বলে চলল, “মনে করা যাক এইভাবে কিছুক্ষণ রিফ্লাক্স করলে ফ্লাস্কের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনো কঠিন পদার্থ বালির মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে জমা হবে, যেটা সংগ্রহ করতে হবে। এই হচ্ছে একটা কেমিস্ট্রি এক্সপেরিমেন্ট। এই পাতি জিনিসটা, যেটা যে কোনো রান্নার শোয়ে কত সহজভাবে বর্ণনা করে দেয়। যেমন – কী কী সবজি কেমনভাবে কেটে কতখানি করে মিশিয়ে ডিমের সাদা অংশটা তার ওপরে কেমনভাবে ছড়িয়ে আর কুসুমটা আলাদা বাটিতে সরিয়ে রেখে কত ডিগ্রিতে কতক্ষণ বেক করে কী দিয়ে গার্নিশ করতে হবে, ঘি পরিমাণ মত আর নমক সোয়াদ অনুসার, ইত্যাদি ইত্যাদি, কেমিস্ট্রির লোকেরা এটাকেই লিখবে যাবতীয় টেকনিক্যাল টার্ম দিয়ে হেজিয়ে গেঁজিয়ে, যাতে অন্যেরা ভাবে, ‘বাব্বা, কেমিস্ট্রি কী কঠিন!’ তোরাও নিশ্চয় তাই ভাবিস, সেইজন্যে কেমিস্ট্রি শুনলেই পড়িমড়ি করে পালাস। আরে বাবা, কেমিস্ট্রি ওই রান্নার মতোই।”

আমরা বললাম, “তার মানে আমাদের মা-ঠাকুমারা সবাই কেমিস্ট বলতে চাও?”

 

সায়নদা বললেন, “আলবাৎ কেমিস্ট। একশোবার কেমিস্ট। তবে তোরা তো মানবি না, তোদের যে ইকুয়েশন দেখেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। ওরে নাদান বালক, জিনিসটা খুব ইজি। আচ্ছা, ঠিক আছে, এখন কেমিস্ট্রি বাদ দে, এই যে প্রক্রিয়াটার কথা বললাম, তার শুধু সরঞ্জামের নামগুলো বলি আপাতত। ঠিক আছে?”

আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সায়নদা বলে চলল, “ওপরের এই ব্যাপারটার জন্যে চাই একটা ‘আর্লেনমায়ার’ ফ্লাস্ক, যাতে ঐ তরল আর যাদের মধ্যে বিক্রিয়া, সেগুলো সব মেশানো হয়। একে গরম করা হয় ফ্লাস্কটার নীচে একটা ‘বুনসেন’ বার্নার জ্বালিয়ে। ফ্লাস্কের মুখে ফিট করা হয় একটা ‘লিবিগ’ কনডেন্সার, যাতে তরলটা বাষ্প হয়ে গিয়ে ফের ঠাণ্ডায় তরল হয়ে অর্থাৎ কনডেন্স করে ওই ফ্লাস্কের মধ্যে পড়বে। বিক্রিয়ার শেষে গুঁড়োগুলো ছেঁকে নেওয়া হয় একটা ‘বুকনার’ ফানেলের ওপর ‘হোয়াটম্যান’ ফিল্টার পেপার দিয়ে। খুব সিম্পল ব্যাপার, তাই না? কিন্তু এই যে প্রত্যেকটা সরঞ্জামের নামের আগে একটা করে বিশেষণ, (যেটা লেখার জন্যে আমি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বসালাম), সেগুলো কি ‘সানফ্লেম’ বার্নারের ওপর বসানো ‘প্রেস্টিজ’ প্রেশার কুকারের মত কোনো ব্র্যান্ড? কী মনে হয় তোদের?”

আমরা চুপ করে আছি দেখে সায়নদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে চলল, “ওয়েল, এগুলো সবই খুব খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের নাম, যদিও হোয়াটম্যান একটা ব্র্যান্ডও বটে। জেমস হোয়াটম্যান (James Whatman, the Elder) নামে এক ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ কাগজ তৈরির আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে। তাঁর আগে কাগজ ছিল অসমতল, যাকে বলা হত লেইড পেপার। হোয়াটম্যান প্রথম সমতল কাগজ (ওভ পেপার) তৈরি করলেন, যার গুণমান আরও উন্নত হল তাঁর পুত্র জেমস হোয়াটম্যান জুনিয়রের (James Whatman, Jr.) হাতে (নীচে ছবি)।”

 

বিভিন্ন রকম কাগজের ব্যবসা শুরু করলেন এঁরা হোয়াটম্যান কর্পোরেশন নামের কোম্পানি খুলে। ২৬৮ বছর পরে জি-ই হেলথকেয়ার এই কোম্পানি কিনে নেয়।

বাকি নামগুলো সব অতি প্রসিদ্ধ রসায়নবিদদের। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক জার্মান ইয়াস্টাস ফন লিবিগ (Justus von Liebig), জন্ম ১৮০৩ সালে, তাঁর কথা পরে বলছি।

 

তাঁর প্রায় সমসাময়িক হচ্ছেন রবার্ট বুনসেন (Robert Bunsen), জন্ম জার্মানির গটিনজেনে। বুনসেন বার্নার (নীচে ছবি দেওয়া) তিনি আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট পিটার ডিসাগার (Peter Desaga) সঙ্গে। কোনো পদার্থকে আগুনে ধরলে গরম হয়ে তা থেকে যে শিখা নির্গত হয়, তার বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ কারশ্যপের (Gustav Kirchhoff) সঙ্গে তিনি দু’ দুখানা নতুন মৌলিক পদার্থ – সিজিয়াম ও রুবিডিয়াম – আবিষ্কার করেন ১৮৬০ সালে। লিবিগের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন।

এমিল আর্লেনমায়ার (Emil Erlenmeyer) লিবিগের ছাত্র, জন্ম ১৮২৫ সালে। গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়তে গেছিলেন কিন্তু লিবিগের লেকচার শুনে রসায়নে উৎসাহ এসে গেল, তিনি তাতেই নাম লেখালেন। জৈব যৌগের, বিশেষ করে ন্যাপথালিনের, গঠন নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। তাঁর সময় ঐ একই ল্যাবরেটরিতে লিবিগের অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন অগাস্ট কেকুলে (August Kekulé), যিনি বেঞ্জিনের রিং স্ট্রাকচারের ধারণা দিয়েছিলেন। ১৮৫৫ সালে তিনি সার, বিশেষ করে সুপারফসফেটের ওপর কাজকর্ম করার জন্যে হাইডেলবার্গে রবার্ট বুনসেনের ল্যাবরেটরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

 

 

তাঁর নামাঙ্কিত আর্লেনমায়ার ফ্লাস্ককে (নীচে ছবি দেওয়া) কনিক্যাল ফ্লাস্কও বলা হয়, যা প্রধানত ব্যবহার করা হয় টাইট্রেশনের কাজে। আর্লেনমায়ার এর প্রবর্তন করেছিলেন ১৮৬০ সালে।

আর্নস্ট বুকনারের (Ernst Büchner) জন্ম ১৮৫০ সালে, জার্মানিতে। তিনি একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট, তাঁর বাবার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ছিল। ১৮৬৫ সালে জুলস পিকার্ড (Jules Piccard) নামে এক সুইশ কেমিস্ট প্রথম ভ্যাকুয়াম ফিলট্রেশন চালু করেন যাতে ছাঁকার ব্যাপারটা ত্বরান্বিত করা যায়। এর জন্যে তিনি সাধারণ শঙ্কু-আকৃতির ফানেলই ব্যবহার করেছিলেন, তার সঙ্গে ভ্যাকুয়ামের জন্যে লাগিয়েছিলেন একটা ওয়াটার অ্যাসপিরেটর বা গিসলার পাম্প (Geissler pump)। এতে ফিলট্রেশন একটু তাড়াতাড়ি হলেও ভ্যাকুয়ামটা যেহেতু পড়ে শুধুমাত্র শঙ্কুটার ঐ বিন্দু-আকৃতি মাথায়, এতে বিশেষ কাজ হয় না। এটা দেখে অটো উইট (Otto Witt) নামে একজন ঐ ফানেলের নীচের দিকে একটা কাচের বা পোর্সেলিনের গর্ত-গর্ত করা বৃত্তাকার প্লেট বসিয়ে জিনিসটা একটু ত্বরান্বিত করলেন। ১৮৮৮ সালে হার্শ (R. Hirsch) নামে একজন ঐ প্লেটটা ফানেলের সঙ্গে পাকাপাকি লাগিয়ে দিয়ে তাকে হার্শ ফানেল নাম দিয়ে পেটেন্ট করলেন। একই বছরে আর্নস্ট বুকনার শঙ্কু-আকৃতির ফানেলের পরিবর্তে প্লেটটা বসালেন একটা সিলিন্ড্রিকাল পাত্রের তলায়, নীচটা থাকল শঙ্কু আকৃতিরই। এই ফানেলই (নীচে সবগুলোর ছবি দেওয়া) বুকনার ফানেল (নীচের দ্বিতীয় ছবিতে এর ওপরের অংশ আলাদা করে দেখানো) নামে পরিচিত হল।

 

অনেকে অবশ্য বুকনার ফানেলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন জার্মান রসায়নবিদ এডুয়ার্ড বুকনারকে (Eduard Buchner) যিনি ১৯০৭ সালে ফার্মেন্টেশন বিক্রিয়ার ওপর তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ইস্টের (yeast) বদলে তাকে চিপে ছিবড়ে করে তার জুস নিয়ে তিনি চিনিকে ফার্মেন্ট করে অ্যালকোহল বানিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এই পদ্ধতির জন্যে জীবিত প্রাণী নয়, বরং তাদের শরীরস্থ রাসায়নিক (এনজাইম) এই ‘সেল-ফ্রি’ ফার্মেন্টেশনের জন্যে দায়ী। ১৯৬০ সালে জার্মানির মিউনিখে জন্মানো এই বুকনার ছিলেন অ্যাডলফ ফন বেয়ারের (Adolf von Baeyer) ছাত্র। বেয়ার অগাস্ট কেকুলের ছাত্র, কেকুলে লিবিগের ছাত্র।

এবারে ফিরে আসি লিবিগের কথায়। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন এবং একের পর এক নক্ষত্রের মত ছাত্র তৈরি করতে থাকেন। জৈব রসায়ন তাঁর ও তাঁর ছাত্রদের হাতে পড়ে নতুন মাত্রা লাভ করে। সে কথা লিখতে গেলে অনেক সময় লাগবে। এমনকি লিবিগের নামওয়ালা কনডেন্সারের গল্পও আপাতত থাক (পাশে লিবিগ কন্ডেন্সারের ছবি)। সায়নদা গলায় এক অদ্ভুত রহস্যময়তা এনে বলতে লাগলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হচ্ছে এটা –

১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া চালু হয়। ১৯৫৪ সালে লাইনাস পাউলিং (Linus Pauling) রসায়নে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে ৫৩ বছরে আট বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে যেমন ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কাল (১৯১৬, ১৯১৭, ১৯১৯, ১৯৪০-৪২), তেমনই অন্য দু’ বছর যখন উপযুক্ত কাউকে ‘নাকি’ পাওয়া যায়নি যাঁরা পুরস্কারের যোগ্য (১৯২৪, ১৯৩৩)। এই আট বছর বাদ দিলে প্রথম ৫৩ বছরে ৪৫ বার রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, কোনবার একজনকে, কোনবার একাধিক জনকে একত্রে, ওই ৪৫ বারে মোট ৫৬ জনকে।

এই ৫৬ জনের মধ্যে ৩৪ জন অর্থাৎ শতকরা ষাট জনের বেশিই লিবিগের ছাত্রদের ছাত্র, বা তাঁদের ছাত্র, বা তাঁদের ছাত্র বা তাঁদের ছাত্র। রসায়নে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ভ্যান্ট হফ (Jacobus Henricus van’t Hoff), তিনি লিবিগের ছাত্র কেকুলের ছাত্র। রসায়নে দ্বিতীয় নোবেল এমিল ফিশার (Emil Fischer), তিনি লিবিগের ছাত্র কেকুলের ছাত্র বেয়ারের ছাত্র। তৃতীয় নোবেল আরহেনিয়াসের (Svante Arrhenius), তিনি লিবিগের ছাত্র কার্ল স্মিথের (Carl Ernst Heinrich Schmidt) ছাত্র অসওয়াল্ডের (Wilhelm Ostwald) ছাত্র। পঞ্চম নোবেল বেয়ারের, সপ্তম নোবেল বেয়ারের আর এক ছাত্র এডুয়ার্ড বুকনারের (যাঁর কথা ওপরে বলা হয়েছে), নবম নোবেল অসওয়াল্ডের। বেয়ারের আরও দুজন ছাত্র নোবেল লরিয়েট (রিচার্ড উইলস্ট্যাটার [Richard Willstätter] ১৯১৫, হাইনরিখ ওয়াইল্যান্ড [Heinrich Otto Wieland] ১৯২৭)। অসওয়াল্ডেরও আরও দুজন ছাত্র নোবেল লরিয়েট (থিওডোর রিচার্ডস [Theodore William Richards] ১৯১৪, ওয়ালথার নার্স্ট [Walther Nernst] ১৯২০)। এমিল ফিশারের তিনজন ছাত্র নোবেল লরিয়েট, যাদের একজন অটো ওয়ারবার্গ [Otto Heinrich Warburg] (১৯৩১), যার দুজন ছাত্র নোবেল লরিয়েট (হান্স ক্রেবস [Hans Krebs] আর ফ্রিজ লিপম্যান [Fritz Albert Lipmann] ১৯৫৩)। এইভাবে ব্র্যাঞ্চ করে করে করে গেছে। ৫৬ জনের মধ্যে ৩৪ জন! গত বছর অবধি ১২১ বছরের ইতিহাস ধরলে এই সংখ্যা আরও অনেক অনেক বাড়বে।

বুঝলি হাঁদার দল, সায়নদা তাঁর থিসিসের সমাপ্তি টানলেন এই কথা বলে, নোবেল লরিয়েটের ল্যাবে কাজকর্ম করেই নতুন নোবেল লরিয়েট এসেছে কেমিস্ট্রিতে। আর এই বিপুল কর্মযজ্ঞে ইয়াস্টাস ফন লিবিগকে রসায়নে নোবেলদের আদিগুরু বললে মোটেও অত্যুক্তি হয় না।”

 

আমরা হাঁ করে শুনছিলাম। সায়নদা চলে যেতে যেতে বললেন,

“ঠিক সেই রকম আমাদের এই উপমহাদেশে – মানে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান মিলিয়ে – আধুনিক রসায়নচর্চার মহাগুরু হচ্ছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এখন এই তিন দেশে যতজন রসায়ন পড়ান বা রসায়ন নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের গুরু, তাঁদের গুরু, তাঁদের গুরু – এইভাবে পেছিয়ে যেতে যেতে আমরা যাঁর কাছে গিয়ে ঠেকব, তিনি ওই আচার্য পি সি রায়। তাঁর আর তাঁর শিষ্যদের কথা বলব আর একদিন।”

(পাশের ছবি – রসায়নের মহাগুরু –

জার্মান ইয়াস্টাস ফন লিবিগ (Justus von Liebig),

জন্ম ১৮০৩ – মৃত্যু – ১৮৭৩)

ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। পেশায় গবেষক, নেশায় pun-দোষ আছে। আদতে রসায়নের ছাত্র, কিন্তু শখ ইতিহাসের বইপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করা আর ছড়া লেখা। ‘হাফ সেঞ্চুরির পর’ নামে একটা ছড়ার বই আছে। সংস্কৃত ছন্দ, রবি ঠাকুর, ভারতীয় দর্শনে বৈজ্ঞানিক উপাদান – এইসব নিয়ে চর্চার বিশেষ শখ। নিয়মিত লেখেন পরবাস, ম্যাজিক ল্যাম্প, জয়ঢাকের মত ওয়েব ম্যাগাজিনে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Dipa Das , April 30, 2022 @ 3:28 am

    ইসসস, বাচ্চারা এটা যদি পড়তো। কি করে পড়ানো যায়, দেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *