শুধুই সুখ দেয় যে স্মৃতি

শুধুই সুখ দেয় যে স্মৃতি

সুজনদাকে নিয়ে এত তাড়াতাড়ি এমন লেখা লিখতে হবে, একি কমাস আগেও স্বপ্নে ভাবতে পেরেছি? সকালবেলায় যে মানুষ ফোন করাতে আনন্দে লাফিয়ে উঠল মন, তিনিই কিনা সেদিন রাতে লাফিয়ে চড়ে পড়লেন অনন্তলোকের ট্রেনে? ইয়ার্কি মারতে মারতেই কি দৌড়ে পাদানিতে উঠে পড়লেন আপনি, সুজনদা?

সুজনদার সঙ্গে আলাপ অবশ্য বেশি দিনের নয়। প্রথম দেখা ২০১৯ সালের শেষের দিকে। নিউ জার্সির রাইটার্স ক্লাবের মিটিং। দেবজ্যোতিদা, মানে দেবজ্যোতি চ্যাটার্জি সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, সুজনদার পরম সুহৃদ। একটু আধটু লেখালেখির সূত্রে সেই ক্লাবে জায়গা জুটেছে। নিউ জার্সির আনন্দমন্দিরের একটা ছোট ঘরে বসেছে সে মিটিং। আমরা দুই সখী মানে আমি আর সংগ্রামী ছাড়াও আছেন বেশ কয়েকজন লেখক, চিনি না বেশির ভাগকেই।

সেখানেই দেখলাম সুজনদাকে। শুরু করলেন নানান মজার গল্প। জানলাম উনিও যাদবপুরের। আলাপ হল শমীতাদির সঙ্গেও। স্বামী স্ত্রীর খুনসুটি উপভোগ করলাম খুব। তার আগেই অবশ্য একেনবাবু পড়া আর হইচইতে দেখা হয়ে গেছে।

সুজনদাকে সে কথা বলতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি বইটা পড়েছো?” হ্যাঁ -বাচক ঘাড় নাড়তেই বলে উঠলেন, “এতদিন জানতাম তিনজন লোক আমার বই পড়েছে, আজ জানলাম চারজন।”

সুজনদার ফেসবুক পোস্টের ভক্ত হয়ে উঠেছি ওনাকে দেখার আগে থাকতেই। সে কথা বলতে শমীতাদি কটাক্ষ করলেন, “বাচ্চা ছেলেরা রং পেন্সিল হাতে পেলে যেমন দেওয়াল ভরায়, সুজন তেমনি ফেসবুকের দেওয়াল ভরায়!”

হো হো করে হেসে সুজনদা বললেন, “বুই (শমীতা) অবশ্য একথা বলতেই পারে, আমার অনেক আগে ওর বই আনন্দ থেকে বেরিয়েছিল। নাম ‘দ্বন্দ্ব!'”

অসামান্য এই দম্পতির সঙ্গে সেই প্রথম আলাপে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সারা রাস্তা দুই সখী সেই গল্পেই হয়েছিলাম মত্ত!

২০১৯ সালেই আমরা দুই সখী মিলে গড়ে তুলেছি ‘আড্ডা নিউ জার্সি’ নামে সাংস্কৃতিক ক্লাব। পৃথিবী জুড়ে যত বাঙালি আছেন, সবার দরজা খোলা আমাদের আড্ডায় – এই মতাদর্শ নিয়েই গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করেছি আমরা। করেছি দুটি সাহিত্য বৈঠক – পত্রবৈঠক আর ভূতবৈঠক। প্রথমটিতে সভাপতি ছিলেন দেবজ্যোতিদা। দুটি বৈঠকই জনপ্রিয় হওয়ায় আমরা ভাবলাম এবার হোক রহস্য-রোমাঞ্চ বৈঠক।

ইচ্ছে খুব সুজনদাকে বলি সভাপতিত্ব করতে। কিন্তু দুই সখী একে অপরকে শুধু ঠেলি – কে রাখবে প্রস্তাব? সংগ্রামী ফোন করল – রাখল আমাকেও কনফারেন্স কলে। আমাদের পরিকল্পনামতো নির্ধারিত দিনটির কথা সুজনদাকে বলাতে জানলাম আগে থেকেই ওঁর সেদিন একটি জায়গার যাওয়ার কথা আছে। আমরা তখন একটু হতাশ। কারণ, হল বুকিং হয়ে গেছে, দিন পালটানো মুশকিল। চুপ দুজনেই। নীরবতা ভেঙে সুজনদা স্বভাবসুলভ রসিকতার গলায় বললেন, “যাবার কথা আছে বলেছি, আমি যে যাচ্ছি সেটা তো বলিনি। আমি যাব তোমাদের অনুষ্ঠানে!”

কিন্তু সেই বৈঠকের পরিকল্পিত দিনটা ছিল ২০২০ সালের মার্চ মাসের একুশ তারিখ। সেই কালান্তক অতিমারির বছর। ১১ই মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করার পর আমরা বাধ্য হলাম অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে।

মনটা খুব খারাপ। চারদিকে মৃত্যুমিছিল। তারমধ্যেই দেবজ্যোতিদা ঠিক করলেন প্রতি শুক্রবার রাইটার্স ক্লাবের বৈঠক হবে। সত্যি বলতে কী ওই বৈঠক আমার মনের চুপসানো বেলুনে অনেকখানি হাওয়া ভরে দিয়েছিল। সবার সঙ্গে জুমের জানলায় দেখা, সাহিত্য আলোচনা করা, নিজেদের মধ্যে একটু আধটু রঙ্গ রসিকতা সব মিলে শুক্রবারের সন্ধে ভরে উঠত। প্রথম দু তিনদিন দেখতাম সুজনদা আর শমীতাদি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে লগ ইন করেন। তখনই প্রথম জানতে পারি, বেসমেন্টই সুজনদার কাজের জায়গা!

লেখালেখি একটু আধটু করি তখন, কিন্তু আস্থা থাকে না অনেক সময়ই নিজের কলম/কী-বোর্ডের ওপর। ঠিকমত লেখালেখিটা হচ্ছে কিনা, আরো কী করে ভালো করা যায়, কেউ যদি একটু পথ দেখিয়ে দেন।

ততদিনে সুজনদার সঙ্গে সম্পর্ক একটু সহজ হয়েছে, মানে ফোন করতে আর অতটা সংকোচ হয় না। সে দ্বিধা ভেঙে দিয়েছেন নিজেই, “আরে, যখন ইচ্ছে হবে ফোন করবে, আমি তো আর তেমন কিছু করি না!” কী যে করেন আর করেছেন এই মানুষটি তা গোনা মুশকিল, তবুও সব সময় দেখাতেন যেন সবার নিচে, সবার পিছে!

যাইহোক, মনের বাসনা জানাতে পারা গেল।

বললেন চোখের সমস্যার কথা। তারপরই বললেন, “তুমি শমীতাদিকে বলো। ও দীর্ঘদিন সম্পাদনার কাজ করেছে, আমার লেখাও বুই (শমীতাদির ডাকনাম) পরিমার্জনা (editing) করে দেয়।”

সেই থেকে শুরু হল আর এক অধ্যায় আমার আর সংগ্রামীর জীবনে। প্রত্যেক সপ্তাহে জুমের জানলাতে আমরা দুই মূর্তি আর আমাদের গুরু-মা। হ্যাঁ, গুরুই মানি শমীতাদিকে।

এদিকে আমাদের আড্ডা নিউ জার্সির আর এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে জন্ম নিল অভিব্যক্তি নিউ জার্সি, সুজনদার শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে।

খুবই ছোটো আকারে পিডিএফ ফর্মে বেরোল প্রথম সংখ্যা, সংগ্রামী, চন্দ্রশেখর, আর আমার প্রাণঢালা যত্নে। প্রচ্ছদ আর অলংকরণ করল আমার কন্যা, দিশারী।

অভিব্যক্তি শুধুমাত্র যে পাঠকের মন জয় করল তাই নয়, এনে দিল আর এক বিরাট পুরস্কার।

অভিব্যক্তি পড়তে দিলাম সুজনদা আর শমীতাদিকে।

তার কয়েকদিন বাদেই সুজনদা একদিন ফোন করলেন, একসঙ্গে আমাকে আর সংগ্রামীকে। জানালেন, নতুনভাবে সুজনদা আর সুমিতদার অপত্যসম অবসর পত্রিকা আসছে ‘দ্য কাফে টেবল’ প্রকাশনার হাত ধরে। ভাস্কর বসু হবেন প্রধান সম্পাদক। সংগ্রামী আর আমি নিউ জার্সি থেকে যদি সম্পাদনার দায়িত্ব নিই  – অনেক কিন্তু কিন্তু করে সে প্রস্তাব রাখলেন। বার বার একেবারে বিনয়ের সঙ্গে বলতে লাগলেন, “খুব সুন্দর সম্পাদনার কাজ করেছ তোমরা। বুই আর আমার দুজনেরই ভারি পছন্দ হয়েছে। যদি তোমাদের অসুবিধা না হয়, তোমাদের নিজেদের পত্রিকা সামলে যদি পেরে ওঠো…”

কী উত্তর দেব! এমন প্রস্তাবে চশমার কাচ ঝাপসা!

সত্যিই কি এতটা যোগ্যতা আছে?

অবসর পত্রিকা শুরু হল নতুন সম্পাদকমণ্ডলী নিয়ে। উপদেষ্টা থাকলেন সুজনদা আর শমীতাদি।

মূলত নন ফিকশনের পত্রিকা। লেখক আর পাঠক দুইই পাওয়া মুশকিল। কিন্তু অবসর পত্রিকাকে তো ছড়িয়ে দিতে হবে পাঠকের কাছে। একসময় প্রচুর পাঠক ছিল অবসরের। কিন্তু মধ্যে কিছুদিন ছেদ পড়েছে – তাই পুরনো আর নতুন সব পাঠকদের আবার অবসর পত্রিকা সম্বন্ধে জানাতে সংগ্রামী আর আমি মিলে শুরু করতে চাইলাম অবসর গ্রুপ! মত চাইলাম সুজনদার। হেসে বললেন, “আমার তো সম্মতি আছে, কিন্তু কে আসবে এই নন ফিকশন পত্রিকার গ্রুপে?”

আমরা দুজনেই কৃতজ্ঞ লেখক আর পাঠকদের কাছে, তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতায় আজ অবসর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুহাজার। মনে পড়ে সুজনদার হাসিমুখ। যেদিন সদস্য সংখ্যা হাজার ছাড়াল, কী খুশি!

“আরে, তোমরা করেছ কী! এত মানুষ অবসরকে ভালোবাসছেন, লেখা পাঠাচ্ছেন, পড়ছেন!”

গ্রুপের ওয়ালের প্রতিটি লেখা সুজনদা পড়তেন, উৎসাহ দিতেন।

আর একটা কথা আজ বড় মনে আসছে। প্রথমদিকে আমার লেখালেখি বলতে মূলত ছিল গল্প, তাই অবসরে লেখা দেবার কথা ভাবতেই পারতাম না।

সুজনদা বললেন, “অদিতি প্রবন্ধ না লিখলে একজন লেখকের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পূর্ণ হয় না!”

“আমি পারব সুজনদা?”

“নিশ্চয়ই পারবে!”

এই দুটি শব্দ ভরসা দিল আকাশসমান!

এরপর অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছি! প্রাণঢালা প্রশংসা করে অকুণ্ঠ উৎসাহ দিয়েছেন পুরে!

আরো কত যে স্মৃতি সুজনদাকে ঘিরে – শব্দ দিয়ে বাঁধা কি অতই সহজ?

আবার আর এক ঝাঁপি খুলব হয়তো আর একদিন।

তবে যতদিন এই তুচ্ছ প্রাণ পৃথিবীতে থাকবে, সুজনদার স্নেহ আর ভালোবাসা জড়ানো যে কটি মুহূর্ত পেয়েছি, সেই অমূল্য ধন সযত্নে থাকবে হৃদয়ের মণিকোঠায়।

অদিতি পেশায় গণিতের অধ্যাপক। নেশা লেখালেখি। বাস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, বাংলা লাইভ, অপার বাংলা, বাতায়ন, শব্দের মিছিল, ও কলকাতা, ড্যাশ পত্রিকা সহ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি নিউ জার্সি' পত্রিকার সম্পাদক।

5 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • শেখর বসু , March 18, 2023 @ 9:38 am

    ভালো লেখা…

    • অদিতি ঘোষ দস্তিদার , March 19, 2023 @ 5:39 pm

      শ্রদ্ধা নেবেন শেখরবাবু! অনেক ধন্যবাদ!

  • Debajyoti Chatterji , March 19, 2023 @ 2:45 am

    খুব ভালো লিখেছো, অদিতি ! সুন্দর স্মৃতিচারণ | সুজন ছিলো এক অদ্য়িতীয় মানুষ | ওকে আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না |

    • Aditi Ghosh Dastidar , March 19, 2023 @ 5:37 pm

      একদমই তাই দাদা! শ্রদ্ধা নেবেন আপনি!

  • অদিতি ঘোষ দস্তিদার , March 19, 2023 @ 5:44 pm

    একদমই তাই দাদা! আপনি আমার শ্রদ্ধা নেবেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *