অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত – প্রাচী-প্রতীচ্যের মিলন

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত – প্রাচী-প্রতীচ্যের মিলন

কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ভারতীয় কাব্য-সাহিত্যে এক বিরল মনীষা। পঞ্চাশ-দশকের কবি হিসেবে তিনি খ্যাত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবন বাউল’ ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় এবং সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিয়েই তিনি বাংলা কাব্যজগতে নিজের নাম খোদাই করে ফেলেন। এমন বুদ্ধিদীপ্ত ও বহুধাবিভক্ত বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা কবিতা বাংলা কাব্যজগতে বেশি নেই। লেখার ধারাবাহিকতার দিক দিয়ে তিনি সমসাময়িক বহু কবিকে ছাপিয়ে গেছেন।

শুরু থেকেই অলোকরঞ্জন আকাদেমিক ঘরানায় বাস করেছেন। কর্মজীবনের শুরুতে বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে ও পরবর্তীকালে বাংলাভাষা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। সেই পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধ থেকে কাব্যজীবন ও পেশাগতজীবন, অর্থাৎ অধ্যাপনা পাশাপাশিভাবে চালিয়ে গেছেন। ‘যৌবনবাউল’-এর পর ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী,’ ‘রক্তাক্ত ঝরোখা,’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ পরপর প্রকাশ পেয়ে সারা বাংলার বিদ্বজ্জন ও কবিতাপ্রেমী মহলে সেই সময়ে আলোড়ন জাগিয়েছিল।

অলোকরঞ্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। তাঁর কর্মজীবনের শুরু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-এর নতুন একটি বিভাগ – তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে। তখন বিভাগটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সেই সঙ্গে রামতনু লাহিড়ির সহকারী হিসেবে তাঁর গবেষণার কাজ শুরু হয়। বিষয় ছিল ‘ভারতীয় লিরিক রূপকল্পের উৎস ও ক্রমবিবর্তন।’ গবেষণা অন্তে, ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম ইংরেজি গ্রন্থ, ‘The Lyric in Indian Poetry।’ ১৯৭১ সালে অলোকরঞ্জন ‘আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট ফাউন্ডেশনের’ কাছ থেকে ফেলোশিপ অর্জন করেন এবং জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারততত্ত্ব’ বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গী-সহকর্মী ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ লোথার লুৎসে। ১৯৭৫ সালে অলোকরঞ্জন গ্যেয়েটে ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখেন এবং তা প্রকাশ করে সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউট। সেই বছরেই তিনি ট্রুডবার্টা হেসলিঙ্গার-এর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।

১৯৮৪ সালে, ‘লঘু সঙ্গীত ভোরের হাওয়ার মুখে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘সুধা বসু’ পুরস্কারে ভূষিত করে। বিশ্বনাগরিকতায় অনুপ্রাণিত অলোকরঞ্জন ভারত ও জার্মানির সাহিত্যকর্মের পারস্পরিক অনুবাদকে নিজের কাজে প্রভূত গুরুত্ব দেন। তাঁর ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম এবং দুই দেশের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের স্বীকৃতিস্বরূপ, ১৯৮৫ সালে জার্মানি সরকার তাঁকে জার্মানির সাহিত্যক্ষেত্রের সর্বোচ্চ পুরষ্কার, ‘গ্যেয়টে পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। এর পরেও বহুবার তিনি বিবিধ সম্মাননা পেয়েছেন।

১৯৮৩- সুধা বসু স্মৃতি পুরস্কার – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
১৯৮৫- গ্যেয়টে পুরস্কার, গ্যেয়টে ইন্সটিটিউট, মিউনিখ, জার্মানি; আনন্দ পুরস্কার, কলকাতা; প্রবাসী ভারতীয় সম্মান (১৯৮৫ এবং ২০০৫), ভারত;
১৯৮৭- রবীন্দ্র [স্মৃতি] পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ;
সাল অজানা- ইন্দো-জার্মান সম্মান, স্টুটগার্ট, জার্মানি
১৯৯১- শিরোমণি পুরস্কার, কলকাতা;
১৯৯২- সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, ভারত।

এছাড়াও পেয়েছেন নজরুল পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, এবং অরবিন্দ পুরস্কার।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছিলেন আমার ‘অলোকদা।’ একটি ঘটনার কথা বলি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আরেক কবি ও অনুবাদক – এলিজাবেথ গান্থার।  

এলিজাবেথ গান্থার শিক্ষকতা করতেন জার্মানির ন্যুরেনবার্গ শহরে। তিনি ছিলেন অলোকরঞ্জনের একনিষ্ঠ পাঠক। শুধু অলোকরঞ্জনের টানেই বহুবার ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছেন। সেই ভিত্তিতেই ভারতবর্ষকে চিনেছেন, জেনেছেন, এবং তার উপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষ নিয়ে বই লিখেছেন – ‘শ্বাসপ্রশ্বাসে ভারত আমার।’ বইটি জনপ্রিয়তা পেয়ে ইংরেজি ও বাংলায় অনূদিত হয়েছে। এলিজাবেথের সঙ্গে আমার পরিচয়, অলোকদার সুবাদেই এবং তাঁর বাড়িতেই। পরে আমি ও এলিজাবেথ যৌথভাবে অলোকদার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দুটি বই প্রকাশ করি – Mosaics of a Rainbow Bridge এবং The Ether Shirt With Anguished Strokes। দুটি বই-ই ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়।

যে ঘটনার কথা লিখছি, তা বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখনও দুর্গাপুরে থাকি। অলোকদা কলকাতায় থাকাকালীন প্রতি উইকএন্ডে আমি কলকাতায় বোন এষার বাড়ি চলে আসতাম। তেমনই এক রোববার, সবে ঘুম থেকে উঠে বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছি। সেই সক্কাল সক্কাল অলোকদার ফোন। জরুরি তলব। তাঁর বাড়ি ‘দৃষ্টিকোণ’-এ হাজির হয়ে ডোরবেল বাজাতেই অলোকদা স্বয়ং দরজা খুললেন।

‘কী ব্যাপার অলোকদা, একেবারে জরুরি তলব? শরীর কুশল তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। বোসো, কথা আছে।’
ঘরে আর কেউ নেই। মুখোমুখি অলোকদা আর আমি, সোফায় সামনা-সামনি।

‘এলিজাবেথ আসছে। কলকাতায় এই প্রথমবার। পরের সপ্তাহে কলকাতায় চলে আসার কথা। আমাকে ফোন করেছিল। উঠবে এসে আলিপুরে হোটেল তাজ বেঙ্গল-এ। আমাকে তাজ বেঙ্গল-এ যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু, আমি বলেছি আমি তোমার হোটেলে কেন দেখা করতে যাব? হোটেল হচ্ছে হোটেল। তার চেয়ে আমার বাড়িতে তুমি এসো, এসে দেখ আমরা কেমন জায়গায় থাকি, কেমন আমাদের জীবনযাপন। যতই হোক, যেমনই হোক, এটা তো বাড়ি। আর বাড়ি হচ্ছে বাড়ি। ঘরোয়া একটা ব্যাপার থাকতে হবে তো, ঠিক বলিনি আমি?’

বলেই আমার সমর্থনের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও সম্পূর্ণ সহমত জানালাম অলোকদার এই সিদ্ধান্তে। দৃশ্যতই খুশির ঝিলিক দেখলাম চোখে। ‘হ্যাঁ, পরের ধাপগুলোই খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর এজন্যই তোমাকে সাত-সকালে ডেকে নিলাম।’

ধূমায়িত ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে অলোকদা শুরু করলেন, ‘আচ্ছা রন্তি, এলিজাবেথকে আমন্ত্রণ তো খুব জানালাম কিন্তু এটাও তো ঠিক, বৈভব, জাঁকজমক, বিলাসিতা, প্রাচুর্য, এইসব দিয়ে তো আমরা এলিজাবেথকে ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করব না, কারণ তা আমাদের সঙ্গতির বাইরে। সুতরাং ঐ রাস্তায় আমরা নিশ্চয়ই হাঁটব না, কী বলো?’

আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। অলোকদা খুশি হলেন।
‘তাহলে তুমিই বলো, আমরা ঠিক কীভাবে ওকে বরণ করব?’
এটা শুনে আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল, ‘আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দিয়ে।’
আমার কথা শুনে অলোকদার সহর্ষ প্রতিক্রিয়া, ‘একদম। এমন উত্তরই তোমার কাছে প্রত্যাশা করেছিলাম। বেশ, সংস্কৃতি বলতে তুমি কী বোঝো?’
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। বরং বলা যায়, প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়ায় আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হল, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত।’

তা শুনে অলোকদা যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ‘বাহ্, দারুণ বলেছ! এটাই আমাদের শ্লাঘা, আমাদের একমাত্র ঐহিক গর্বের বিষয়। বেশ তা না হয় হল। এইবার আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হবে এক্ষুণি। তোমার পরের কাজ হবে, এই ব্যাপারটা নিয়ে আজই এষার সঙ্গে কথা বলো। ওই আমাদের পারানির কড়ি। ওকে বলো, আমি বলেছি, এই প্রেক্ষিতে ওর পছন্দের দুটো গান বাছতে। সেটা আমাকে ফোনে জানাও। তারপর তোমার কাজ হবে ঐ গান দুটোকে অনুবাদ করে তোমার প্রিন্টারে দুটো প্রিন্ট আউট বের করে আমাকে একবার দেখাও। তারপর আরো কয়েকটা কপি বের করে রেখে দাও তোমার কাছে আর এষাকে খালি গলায় একটু রেওয়াজ করতে বলো।’

এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলেন। আমি অলোকদার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি আর ভাবছি, কী আন্তরিকতা দিয়ে তিনি গোটা ব্যাপারটাকে ভেবেছেন এবং ভিতরে ভিতরে এর একটা রূপরেখা তৈরি করে ফেলছেন, মুহূর্তের মধ্যেই।

সেদিনের জন্যে গান বাছা হয়েছিল ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না,’ আর ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে।’ অলোকদার কথায় গানদুটি অনুবাদ করলাম। বিকেল পাঁচটার মধ্যে অলোকদার বাড়ি পৌঁছে গান দুটো হ্যান্ডওভার করে দিয়ে সোফার এক কোণে দুরু দুরু বক্ষে বসে রইলাম। পড়তে পড়তে অলোকদার সম্মতিসূচক মাথা নড়ে উঠল, ‘খুব ভালো অনুবাদ হয়েছে। আমি জানতাম।’

নির্দিষ্ট বিকেলে এলিজাবেথ গান্থার, তাজ বেঙ্গল থেকে অলোকদার যাদবপুরের বিনীত, মধ্যবিত্তিয় আবাসনে পদার্পণ করলেন। সবাই মিলে তাঁকে সম্বর্ধনা জানালাম। আমাদের সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে অলোকদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর স্ন্যাক্স, মিষ্টি আর ব্ল্যাক কফি সহযোগে সারা হলো সান্ধ্য জলখাবার।

এরপর এলিজাবেথ-এর হাতে অলোকদা তুলে দিলেন দুটি গানের তর্জমার প্রিন্ট-আউট। এষার গান শুনে খুব খুশি হলেন এলিজাবেথ। খুব মনোযোগ দিয়ে ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ গানটির ইংরেজি তর্জমা পড়লেন। চোখে মুখে মুগ্ধতা। অলোকদার চোখ ‘ভরিল গৌরবে।’ অলোকদার এমন গদগদ চিত্ত আগে আমি দেখিনি। এরপর আমাকে এলিজাবেথ-এর কাছে ডেকে নিয়ে অলোকদা আমার অনুবাদকর্ম নিয়ে বিশদ বলে, আমার সদ্য প্রকাশিত অলোকদার কবিতার অনুবাদ সংকলন বইটি এলিজাবেথ-এর হাতে তুলে দিতে বললেন।

সেদিন গানে, কবিতায়, বন্ধুত্বে, এমন এক রমণীয় সন্ধ্যা কাটল যা স্মৃতির কোঠায় সারাজীবন জ্বলজ্বল করবে।

— 
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত 

কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। একাধারে কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, স্কেচার, প্রচ্ছদশিল্পী ও শৌখিন ফটোগ্রাফার। লিখেছেন বাংলা কবিতার বই - 'অমীমাংসিত চৌমাথা'। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র কবিতা ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন, যেটি কবির অনুবাদ বই হিসেবে প্রথমতম প্রকাশনা। পরে জার্মান কবি এলিজাবেথ গান্থারের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ বই প্রকাশ করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *