ভ্রমণ
এপ্রিল ১৫, ২০১৬
রাজস্থলী
অদিতি সরকার
বছরের কয়েকটা সময় বাঙালির হঠাৎ তেড়ে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে বেড়াতে যাওয়ার রোগে আক্রমণ করে। তার আবার সীজন অনুযায়ী ভাগাভাগি থাকে, গরমে পাহাড় কিংবা সমুদ্র, শীতে জঙ্গল টঙ্গল, আবার পুজোর ছুটিতে ছোট্ট করে একটু ঐতিহাসিক ডোজ। আর ইতিহাস দেখতে গেলে রাজস্থান তো যাকে বলে মাস্ট। যোধা আকবর রিলিজ করার পর থেকে আরও মাস্ট।
আজকাল মাঝে মাঝেই ফেসবুকে দেখছি জনতা দলবলিয়ে রাজস্থান বেড়াতে যাচ্ছে, কতরকম পোজ দিয়ে কত ছবিটবি দিচ্ছে, দেখেটেখে আমারও পুরোনো স্মৃতি যেন কেমন উথলে উথলে উঠছে। তা ভাবলাম আমিও তাহলে দু কলম নয় লিখেই ফেলি। কিন্তু ওই চেনা রাজস্থান নিয়ে লিখব না তাই বলে। সেই দিল্লি আগ্রা রাজস্থান টুরিস্ট সার্কিট, সেই কিলো কিলো সাহেব মেম, সেই গণ্ডা গণ্ডা দুর্গ, সেই কলবেলিয়া নাচ... নাঃ।
বাজরার ক্ষেত
|
গ্রাম দেখবেন রাজস্থানের, গ্রাম? চলুন তবে।
কেউ কেউ জানেন, আবার অনেকেই হয়ত জানেন না, আমার কত্তাটি প্রাক্তন ভারতীয় বায়ুসেনা আধিকারিক। তার এক প্রাণের বন্ধু, এয়ারফোর্স কোর্সমেট এই রাজস্থানের সন্তান। একসঙ্গে বহু রগড়া খেয়েছে ট্রেনিংকালে। এয়ারফোর্স শ্যামলকান্তি কোমল বাঙালি আর ছয়ফুটিয়া তাগড়া মরুনন্দনের মধ্যে কোনো তফাৎ করেনি। সেই বিষম ভোগান্তিজাত বন্ধুত্ব আজও অক্ষয়, অটুট। বন্ধুটি শেখাওয়ত রাজপুত, গ্রামের সরপঞ্চের একমাত্র ছেলে। ঠাকুরসাব। বহু বছর আগে, প্রথম আলাপে ভেতো বাঙালিনী আমি অতি সরলভাবে জিগিয়েছিলাম, ‘তোমাকে কি গ্রামের লোক ছোটে ঠাকুর ডাকে?’
সে ততোধিক সরল বিস্ময়ে উলটে জিগালো, ‘আর কী ডাকবে তা না হলে?’ যাক গে।
মেঘহীন বাওলি |
গ্রামের নাম কেরপুরা। জেলা সিকর, রাজস্থান। বিকানের থেকে দুশো সত্তর কিলোমিটার, জয়পুর থেকে একশো পাঁচ। তাও গ্রামের দোরগোড়ায় নামতে পারবেন না তা বলে। বাস আসে খাণ্ডেলা পর্যন্তই। ওখান থেকে হয় উটের গাড়ি, নইলে গাধার গাড়ি। ওখানে বলে গদ্ধোগাড়ি। সেও দশ কিলোমিটার। দোকান বাজার যা করবেন সব ওই খাণ্ডেলায়। গ্রামে কিচ্ছুটি নেই।
আকাশ অনেক উঁচুতে নীল হয়ে ভেসে থাকে এখানে। উজ্জ্বল, চোখ ঝলসে দেওয়া নীল। কালো কেন, সাদা মেঘের রেখাটুকুও দেখা যায় না। তিন বছরে একবার বৃষ্টি হয় হয়তো। হলে ভালো, সে বছর ছোলা আর বাজরার ফসল যা ঘরে ওঠে তাতে টেনেটুনে সম্বৎসর কুলিয়ে যায়, না হলে কিনতে তো হবেই। কী আর করা। সকাল বিকেল সরকারি জল আসে ক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য। ঠাকুরসাহেবের বাড়িতে পোষা উট আছে, ট্যাংক ভরে সে জল টেনে টেনে আনে, তার পর সেই জল বাড়ির ঘড়া মটকা সবেতে ভরা হয়। যাদের উট নেই, তারা মাথায় করেই আনে। অবশ্য খাণ্ডেলার রাজাসাহেব মস্ত বড় বাওলি তৈরি করিয়ে রেখেছেন, তাতে নেহাত চরম খরাটরা না হলে কিছুটা হলেও জল থাকেই। বাওলি জানেন না? এই যে দেখুন। ধাপকাটা কুয়ো। পাহাড়ে, টিলায় বৃষ্টি পড়ে, সে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে এসে জড়ো হয় বাওলিতে।
রুক্ষ মাঠের মধ্যে কোনো শেখাওত রাজপুতের ছত্রী
উঠোনে দানা খোঁটে ময়ূর |
গ্রামের চেহারা আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের মত নয় মোটেই। রুখাসুখা, লাল লাল, ধুলোটে। দু পা হাঁটলেই একখানা করে ছত্রী, অর্থাৎ স্মৃতিস্তম্ভ। ক্ষেতে ছাগলের সাইজের হরিণ ঘোরে, এবড়োখেবড়ো পাথুরে উঠোনে দানা খেতে আসে ময়ূর। উট বাঁধা থাকে পাছদুয়োরে, তার নাক ফুঁড়ে কাঠের গোঁজ। সেই গোঁজে দড়ি বেঁধে রাখাল তাকে ইচ্ছে মতন চালায়। বাঁধা থাকতে থাকতে বোর হয়ে উট যদি মাটিতে ধপধপ করে নাগাড়ে পা ঠুকতে থাকে তাহলে নাকি ভীষণ অলক্ষণ। পালটাও পালটাও, এ উট বেচে শিগ্গির অন্য উট আনো।
আমি তো বিশ্বন্যাকা, যথারীতি উট দেখে গলে গিয়ে জানতে চাইলাম উটের নাম কী? আচ্ছা আপনারাই বলুন, পোষা কুকুর, পোষা বেড়াল, পোষা পাখি সবারই তো একটা নাম থাকে। এমন কি পোষা গাড়িরও নাম দেন অনেকে বলে শোনা যায়, তো বেচারা ট্যাংক টানা উটের নাম থাকবে না?
আমার বান্ধবীর সেই অবাক দৃষ্টি আমি কোনওদিনও ভুলব না, জানেন। আমার প্রশ্নের উত্তরটাও।
উঁট কা নাম উঁট, ঔর কেয়া হোগা?
উঠোনে উট |
তাই তো। ওই রুক্ষ শুকনো জীবনযাত্রায় উটকে আদরের পোষ্য বানিয়ে তাকে মুনুপুষু নাম দেওয়ার কল্পনাও বোধহয় আসে না। উটের নাম উট, আর কী নাম হবে তার।
আপনি শহুরে টুরিস্ট, গ্রাম দেখতে বেরিয়েছেন, হঠাৎ দেখবেন টুপটাপ করে এ দরজা ও দরজায় দাঁড়ান সব মেয়েগুলো এক হ্যাঁচকায় কপালের ওপর থেকে একেবারে হাঁটু পর্যন্ত ঘোমটা টেনে ফেলল। সবাই নয়, ভুল বললাম, কেউ কেউ।
‘ও ভাইসা, ওরা ঘোমটা টানে কেন?’
‘বাঃ, আমি যাচ্ছি যে রাস্তা দিয়ে।’
‘তাতে কী? সবাই টানছে না তো!’
‘যারা এ গ্রামে বিয়ে হয়ে এসেছে তারা সব আমার বহু লাগে না? ঘুংঘট তো করতেই হবে। যারা ঘোমটা টানছে না তারা তো এখানকারই বেটি সব। এ গ্রামের মেয়েরা তো আমারও মেয়ে, তারা আমার সামনে মুখ খোলা রাখলে দোষ হয় না।’
মনে রাখবেন সুধী পাঠক, এই কথোপকথন একুশ শতকের ভারতে দাঁড়িয়ে।
মন্থন |
এই যে আমার বান্ধবী, সারাটা যৌবনকাল যে ভারতের নানান শহরে নানান সেনাছাউনিতে অনায়াসে ঘোমটাহীন কাটিয়েছিল। হাভেলির উঠোনে বসে দুধ থেকে মাখন তুলছে এখন। সকালবেলা ঘরে ঘরে মাখন তোলার আওয়াজ আসে এখানে। যে বাড়িতে বউ মাঠঠা তুলতে জানে না সে তো অলক্ষ্মীর বাড়ি!
হাভেলি কাকে বলে বলুন তো?
সভ্যতার সেই আদিম যুগে, যখন আজকের আন্তর্জাল তথা ফেসবুক জনতার বেশির ভাগই সদ্য হামাগুড়ি পর্যায়ে, তখন দূরদর্শন নামক যন্ত্রটিতে একখান বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যেত। সিয়ারাম কোম্পানির বিজ্ঞাপন। তার ক্যাচলাইনটি ছিল, কামিং হোম টু সিয়ারাম। বিশাল এক অট্টালিকার অলিগলি দিয়ে সুন্দরী তরুণী ওড়নি উড়িয়ে সিয়ারামের কাপড়ে তৈরি স্যুট পরিহিত নায়কের সঙ্গে লুকোচুরিতে মেতেছেন। কী সেই অট্টালিকার কারুকাজ, কী বুলন্দি। সেই শুটিং নাকি হয়েছিল জয়সলমের নগরের এক বিখ্যাত হাভেলিতে।
তারপর তো সঞ্জয় লীলা বনশালি আমাদের শিখিয়েই দিলেন, কারুকার্যখচিত প্রাসাদকেই হাভেলি বলে। যার ঘরগুলো হয় আড়ে বহরে ফুটবল খেলার মাঠের মত, দেওয়ালগুলোয় মার্বেল থেকে হিরে জহরত যা ইচ্ছে খচিত থাকতে পারে।
হাভেলির দেউড়ি |
ঠিকই শিখেছিলাম, কিন্তু আবার একটু ভুলও। হাভেলি প্রাসাদোপম হতেই পারে, কিন্তু সব প্রাসাদই হাভেলি হবে এমন কোনো কথা নেই। সব হাভেলিকেও যে প্রাসাদ হতেই হবে তাও নয় মোটেই। আসলে হাভেলি শব্দটা এসেছে আরবি থেকে। যে কোনো ঘেরা দেওয়া, একান্ত জায়গাকেই প্রথমে হাভেলি বলা হত। দিন যেতে যেতে এখন যেটা দাঁড়িয়েছে, সেটা হল এমন একটা বাড়ি, যেটার ঠিক মাঝমধ্যিখানে থাকবে একটা বড় চৌক, মানে উঠোন। তার চার দিক ঘিরে থাকবে ঘর। হাওয়া খেলবে রুজুরুজু, গরম জমতেই পাবে না, উড়ে যাবে মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ওপর পানে। এমনি হাওয়া খেলা গড়নের বাড়িই হাওয়েলি, মানে হাভেলি আর কি। এই যে, আমাদের ঠাকুরসাহেবের ছোটখাটো হাভেলি।
মাঝখানে উঠোন কিন্তু একটা হলে চলবে না। তার আবার ভাগ থাকতে হবে। জেনানা আর মর্দানা। সদর ফটক দিয়ে ঢুকে প্রথমেই পড়বে মর্দানা চৌক। সেখানে থাকে উট আর তার রাখাল। ছাগলও থাকে। আর থাকে প্রাগৈতিহাসিক এক খাটিয়া। সন্ধে গড়ালে বুড়ো ঠাকুর আর উটওয়ালা সেখানে বসে দু পাত্তর গলায় ঢালেন, হুক্কায় দুটি টান দেন। তারপর আটটা বাজলে জনানা চৌকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একটু গলা খাঁকারি দেন, পাছে বহুর ঘোমটা খসে গিয়ে থাকে। শ্বশুরের সামনে আঢাকা মুখ মাথা! সে যে বড়ই বেআদবি।
জনানা চৌকের হাওয়া অন্য রকম। কোলে থালা নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে সেখানে শুঁটি থেকে ছোলা মটর ছাড়ানো হয়, সঙ্গে ফিসফিস, খিলখিল। মাংস টাংস রাঁধতে হলেও ওখানেই। পাকা রান্নাঘরে তো হবে না। এক পাশে মাটির উনুন গড়া আছে, তাতে শুকনো ডালপালা দিয়ে আঁচ পড়ে। হৈমন্তী সন্ধ্যায় গরম গরম বাজরে কি রোটি, তার ওপর সেই সকালের কাঁচা মাখন, আর ঝাল ঝাল রসুনের আচার। দেবতারা নেমে আসেন কুয়াশায় ভর করে ওই গন্ধে।
হাভেলির ঠিক পেছন দিয়ে উঠে গেছে চাঁই চাঁই পাথর। তারও ওপরে সাদাসিধে একখানি বাড়ি। সেখানে থাকেন বালাজি মহারাজ। সকাল সন্ধে ঘন্টা বাজে, দীপ জ্বলে আরতির। বাঁশের আগায় ধ্বজা ওড়ে লাল। বালাজি কে বলুন তো? উঁহু, ইনি বাঙালির চেনা সেই দক্ষিণী তিরুপতি বালাজি নন মোটেই। ইনি অন্য ব্যক্তি। গোটা রাজস্থানে বালাজি একজনই। বালক হনুমান। যত্রতত্র এঁকে দেখবেন এখানে। মন্দিরের ঘণ্টা শুনে ঠাকুরাইন হাভেলির ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালান।
এই পাথরের স্তূপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন গনগনে সুজ্জিঠাকুর। ঝাঁঝালো, আগুনরাঙা। যাকে বলে এক্কেবারে জবাকুসুমসঙ্কাশং। একবার দেখা দিলেন তো আর সন্ধে না হওয়া পর্যন্ত রক্ষে নেই। নিজেও জ্বলবেন, চারদিকেও জ্বলন ছড়াবেন দাউদাউ।
ওই পাথরের আড়ালে আড়ালে সূর্য ওঠার ঠিক আগে, আর সূর্য ডোবার ঠিক পরে এক বিচিত্র মিছিল চলে। এক দিকে মর্দানা মিছিল, আর অন্য দিকে জনানা আর বাচ্চাদের মিছিল। সবার হাতে প্লাস্টিকের বোতলে এক বোতল জল। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ওই কাজেরই মিছিল এটি। যদিও এদের অনেকের ঘরেই সরকার বাহাদুর পাকা ‘শৌচালয়’ বানিয়ে দিয়েছেন।
নাক কোঁচকাচ্ছেন তো? এরা আর শোধরাবে না, এটাই ভাবছেন মনে মনে, তাই না?
ঠিকই ভাবছেন। তবে কিনা, অঙ্কটা অত সরলও নয় যে।
সরকার বাহাদুর স্যানিটারি টয়লেট তো দিলেন। সেপটিক ট্যাংকও হল। কিন্তু, ঘরে ঘরে জলের লাইনটা দিলেন না যে। সরকারি জল তো আসে বহুদূরে, চাষের ক্ষেতে। মোটা পাইপ বেয়ে, সকাল বিকেল দুবার। সেখান থেকে রান্না খাওয়ার জন্য সে জল বয়ে আনতেই প্রাণ যায় যায়। যে রুক্ষ ঊষর দেশে জলের অভাবে এঁটো বাসন শুধু বালি দিয়ে মেজে তোলা হয়, সেখানে বার বার মলমূত্র ধুয়ে ফেলার জন্য বালতি বালতি জল ঢেলে দেওয়ার বিলাসিতা কি কল্পনাতেও আনা যায়? একটু ভাবুন না ।
টিলার ওপর খাণ্ডেলারাজার গ্রীষ্মপ্রাসাদ |
আচ্ছা এই যে শেখাওয়ত রাজপুতদের নাম করলাম শুরুতেই, এরা ঠিক কারা সেটা জানা আছে তো? বলছি শুনুন। রাজপুত বংশলতিকা কিন্তু একখানা সাংঘাতিক জিনিস। কীরকম? প্রথমে বংশ। রাজপুতরা তিনটে প্রধান বংশকে স্বীকার করেন, সূর্যবংশ, (বচ্চন সাহেবের ছবি মনে আছে কি কারও-সূর্যবংশম্?) চন্দ্রবংশ আর অগ্নিবংশ। আরও আছে কিছু ছোটোখাটো, যেমন যদুবংশ, পুরুবংশ, ঋষিবংশ, তবে সেগুলো সব এই তিনটেরই ছানাপোনা। হিসেব খুবই সোজা-সটান সূর্য চন্দ্র আগুন থেকেই জন্মেছেন এঁয়ারা, তাই না অমন আন বান আর শান!
বংশ থেকে বেরোলো কুল। মানে ওই আদি বংশের কোনও এক পুরুষ থেকে সরাসরি যেটা নেমে আসছে। তিনি কুলপুরুষ। তার থেকে আবার বেরোলো শাখা। এই যে শেখাওয়ত রাজপুত, এঁরা হলেন আদতে সূর্যবংশী। এঁদের কুলপুরুষ রামের যমজ পুত্রের একজন, যাঁর নাম কুশ। হ্যাঁ, সেই লব কুশের কুশ। এই কুশের নাম থেকে এঁদের কুলের নাম হয়েছে কুশওয়াহা। কুশওয়াহাদের ৭১টি শাখা। মানে এক একজন যেই জমিজমা সৈন্যটৈন্য জুটিয়ে বেশ একজন কেষ্টবিষ্টু হয়েছেন অমনি তাঁর নিজের নামে একটা করে শাখা চালু করে দিয়েছেন আর কি। রাও শেখাজি থেকে যে শাখাটি জন্ম নিয়েছিল, তারই নাম শেখাওয়ত। এঁদের নামে একটা পুরো অঞ্চলেরই নাম হয়ে গেছে শেখাওতি।
এই অঞ্চলে প্রধান দুই প্রতিবেশী, রাজপুত আর জাঠ। দেখতে মোটামুটি একই রকম, জামাকাপড়ও প্রায় এক। চিনবেন কী করে?
পাগড়ির প্যাঁচে আর মেয়েদের ওড়না কোনদিকে আছে তা দেখে। রাজপুতাইন ওড়নি পরে সামনে থেকে ঘুরিয়ে। এক প্রান্ত ঝোলে পিছনে, অন্য প্রান্ত মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে এসে বুকের ওপর দিয়ে নেমে যায় কোমরে, ঘাগরির খাঁজে গোঁজা থাকে খোঁট। জাঠনির কিন্তু ওড়নি সামনে আনার অধিকার নেই। তার ঘোমটা যতই লম্বা হোক, দোপাট্টার পুরোটাই ঝুলবে পিঠের ওপর। আর ওই যে ব্রোশারে দেখেন কবজি থেকে বাহুমূল পর্যন্ত হাতির দাঁতের (এখন প্লাস্টিক) বালা পরা কাজলনয়না উলকিভূষণা বালিকাদের, ভুলেও যেন ওদের রাজপুতানী বলে ভুল করবেন না। ওরা তো নটনী, ভানমতী। কলবেলিয়া সাপুড়ে নাচ , কাঠপুতলির খেলা , কবুতরী জিমন্যাস্টিক্স, ওসব দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে ওরা। কোথায় সারা দুনিয়াকে মুখ দেখিয়ে বেড়ানো চালচুলোহীন জিপসি আর কোথায় সূজ্জিমামার ছানাপোনা!
আমাকেও আজকাল কেরপুরা গেলে ঘোমটা টানতে হয়, জানেন তো। প্রথমে যেতাম ছোটে ঠাকুরের আদরের বোনটি হয়ে, ও বাড়িরই বিটিয়ারানি। কিন্তু বুড়ো ঠাকুর মুশকিল বাধালেন। কী যে ভালোবেসে ফেললেন তাঁর পুত্রের বন্ধুটিকে , হঠাৎই একদিন নিজের মাথার পাগড়িটি খুলে আমার কর্তার মাথায় পরিয়ে দিলেন। এবার বহুরানি হয়ে আর কী করে তাঁর সামনে খোলা মাথায় চলাফেরা করি।
সালোয়ার কামিজ, শাড়ি এসব ওখানে ভীষণ অসভ্য পোষাক, জানেন তো। অতিথি হয়ে দুদিন গেলেন, সে নয় ঠিক আছে, থাকতে গেলে কিন্তু ওই ঘাগরা চোলিই পরতে হবে। নইলে শুনতে হবে, শহরের হাওয়া লেগেছে তো গায়ে, বড়বুড়োর সম্মান জানে না, ফ্যাশন শিখেছে খুব।
কেরপুরা থেকে একটু দূরেই ঝুনুঝুনু, যেখানে রূপ কাঁওয়ারের সতী হওয়া নিয়ে কাগজে কাগজে এককালে ঝড় বয়েছিল। কাগজওয়ালারা কী জানে, অ্যাঁ? সতী হওয়া মুখের কথা? সবাই পারে? যাও না, দেখে এসো গিয়ে মেহরানগড় দুর্গে, কুম্ভলগড়ের দেওয়ালের গায়ে গাযে, কতশত ছোট্ট ছোট্ট সিঁদুর মাখানো হাতের ছাপ। দশ বছর, চোদ্দ বছরের মেয়েদের হাত। সবাই জহরব্রত করেছিল এরা, জানো? আগুনে ঝাঁপানোর আগে নিজেদের হাতে সিঁদুর মাখিয়ে ওই দেওয়ালে দেওয়ালে ইতিহাসকে বলে গিয়েছিল, আমরা ছিলাম। ওদিকে গেলে আমাদের বহুরা, বেটিরা এখনও ওই ছাপে মাথা ঠেকায়। পুণ্য হয়। বংশে একটা সতী নেই যার সে রাজপুত আবার কীসের গুমর করে? জয়, সতীমাতার জয়।
তর্ক করবেন না। শহুরে তর্ক এখানে খাটে না।
লেখক পরিচিতি - অনেককাল আগে পড়াশোনা হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। এখন পেশা বাণিজ্যিক অনুবাদ, আর নেশা পড়া, পড়া। আরও, আরও পড়া। তারই সঙ্গে নামী অনামী নানা পত্রিকায় লেখালেখি - ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য। আনন্দবাজার, দেশ, সানন্দা, ঊনিশ কুড়ি ফেমিনা গৃহশোভা ইত্যাদি পত্রিকাতে গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।