প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য: সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে

জুন ১৫, ২০১৬

 

জীবনই অভিজ্ঞতা

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

 

আলী সায়েব বিশ্বাস করতেন, তাঁর জীবনে –

“এমন কোনো বাণী নেই, এমন কোনো message নেই, যা না বললে- এই সোনার বঙ্গভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সর্বসমক্ষে কোনো কিছু বলতে বড়ই লজ্জা বোধ করি । হয়, সত্য গোপন করতে হয়-নয় ডাহা মিথ্যে কথা কইতে হয় ।”

মুজতবা আলী

প্রচার বিমুখ আলী সায়েব কেন এইরকম লিখেছিলেন- সেটা এখন আর জানার উপায় নেই। হতে পারে, তিনি নিজের সম্বন্ধে জানাতে চান নি বা কিছু একটা অভিমান ছিল – যেটা আমরা জানি না। এই জ্ঞান সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব, নানা “কিস্সা” লিখলেও নিজের সম্বন্ধে স্পিকটি নট্। সমসাময়িকরা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু একেবারেই ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়েছে বারবার। আমাদের কাছে এটা বড়ই দুঃখের এবং না জায়েজ কাজ।

খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা বার বার চেষ্টা করেও বিফল মনোরথ। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র – প্রথিতযশা সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী, স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে, আলী সায়েব ১৯২১ য়ে শান্তিনিকেতনে কোথায় থাকতেন, কি পড়তেন, এই সমস্ত জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আলী সায়েব, সেই সব এড়িয়ে গিয়ে- তখন শান্তিনিকেতনে যাঁরা ছিলেন , তাঁদের সম্বন্ধে সবিস্তার লিখে পাঠিয়েছিলেন।

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, কোনো এক লেখক লিখেছিলেন :-

লাইফ ইজ নাথিং বাট এ ফ্লিকার অফ্ লাইট বিটুইন মাদারস্ উম্ব টু দ্য টুম্ব।
মাতৃজঠরের অন্ধকার থেকে কবরের অন্ধকারের মধ্যে – জীবন একটি জ্বলন্ত বিদ্যুৎশিখা।

মনে হয় – জি কে চেষ্টারটন। ভুল হতে পারে নামের, তবে তিনি সার কথাটা বলে গেছিলেন।
জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝে যে জীবন, সেটাকে কয়জনে ব্যবহার করতে পারেন – ঠিকঠাক মত ?
কেউই পারেন না, এমন কি বিখ্যাত, অখ্যাত, কুখ্যাতরাও না। কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকেই।
তবু, জীবনটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন, যে কয়েকজন, তাঁরাই নমস্য। রবীন্দ্রনাথের শার্গিদ – সৈয়দ মুজতবা আলী, তাঁদের মধ্যে একজন। গত ১৯৭৪ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারিতে তিনি এন্তেকাল করেন। দেখতে দেখতে ৪২ বছর কেটে গেল, তবু অনেক পাঠকের কাছে তিনি আজও অমলিন।

তিনি লিখেছিলেন :-

“দম্ভ করে বলছি, আমি (মুজতবা) শঙ্কর কপিল পড়েছি, কান্ট হেগেল আমার কাছে অজানা নন। অলঙ্কার, নব্যন্যায় খুঁচিয়ে দেখেছি ভয় পাই নি।
উপনিষদ, সূফিতত্ত্বও আমার কাছে বিভীষিকা নয়।……… পুনরপি দম্ভ করে বলছি, জ্ঞান বিজ্ঞানের হেন বস্তু নেই, যার সামনে দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে বলেছি, এ জিনিস? না, এ জিনিস আমাদ্বারা ক্কখনো হবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও হবে না।

ব্যাজোক্তির মধ্য দিয়ে সিতু মিঁঞা বক্তব্যটি সরস ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছেন:-

আমি যে শিক্ষা দীক্ষায় নিরঙ্কুশ ডডনং হয়ে রইলুম, তার জন্য কবিগুরু গুরুদেবও খানিকটা দায়ী।
অবশ্য তাঁর প্রতি আমার ভক্তি অচলা থাকবে। কারণ :-
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ী যায়।
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।।
কেন এই অচলা ভক্তি ?

গুরুদেবের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তাঁর ভাষাজ্ঞান বেড়েছিল। গ্রামীণ গণ্ডীমুক্ত হয়ে শান্তিনিকেতনের এমন উদার পরিবেশে, বৃহত্তর জগতের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন – মুজতবা সায়েব।
চোখে তাঁর বিস্ময়, যা দেখেন – মনের ক্যামেরায় বন্দী করে নেন।
সংস্কৃত, সাংখ্য ও বেদান্ত শিখলেন – ফরমিকি এবং বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে। ডঃ মার্ক কলিন্সের কাছে ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান।
তুচ্চির কাছে পড়লেন :- ইতালিয়ান। বগ্ দানফের কাছে – আরবী ও ফার্সী।
হিন্দির প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন শ্রীহট্টে এক মাড়োয়ারি দোকানদারের কাছে – যাকে তিনি ওস্তাদজী বলে সম্বোধন করতেন।
এই সব নানা ভাষা থেকে রাজহংসের মত ছেঁকে নিয়েছিলেন – খাঁটি দুধটুকু। তাই তাঁর লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে – বিরিয়ানি থেকে বাটি চচ্চড়ির সুঘ্রাণ।

আলী সায়েব অভিমান ভরে লেখেন :-

“………. অতিশয় অনিচ্ছায় সবিনয় নিবেদন, আল্লা সামনে, আমি সস্তা দামী কোনো হাততালির জন্য লিখিনি। তবে, এ কথা সত্য – আমি পণ্ডিত জনের জন্য লিখেছি অতি অল্পই।
প্রধানত লিখেছি সেই ম্যান অফ দি স্ট্রীটের জন্য, যে হয়তো সামান্য ইংরেজী জানে, বাংলাটা মোটামুটি বোঝে এবং সিরিয়াস বই পড়তে নারাজ”

তিনি আরও লিখেছিলেন “…….Posterity (উত্তরাধিকারী) র জন্য যারা লেখে তারা Generation after generation , (প্রজন্মের পর প্রজন্ম) কাউকেই কিছু দিতে পারে না। আমার লক্ষ্য তো আরও সীমাবদ্ধ।
আমি লিখি – যারা পানি পিয়ে জাত বিচার। রসের বাজারে যারা ছুঁৎবাই গ্রস্ত নয়। কিছুটা সফল হয়েছি , কারণ আনলাকিলি ফর মাদার বেঙলি অ্যাণ্ড লাকিলি ফর মাই সেল্ফ।”
এর পরেই লিখছেন :-

“জীবনই অভিজ্ঞতা,আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খণ্ড খন্দ করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবী-মালা হয় তারই নাম জীবন।”

বাবা প্রয়াত রামনারায়ণ ভট্টাচার্য গরমের ছুটির সময় ওডিশা ( বর্তমানে সরকারী নাম ) থেকে কলেজ ষ্ট্রিটে আসতেন শুধু আড্ডার লোভে। তার সঙ্গে বই কেনার অভ্যাস তো ছিলই।

মাঝে মাঝে আমি সঙ্গে আসতাম ঠিকই, তবে ওনাদের আড্ডার বিষয় বোঝার মত বয়েস ছিল না বলে বড্ড বিরক্ত লাগতো ( হায় রে!) তখনই একটা ব্যাপার আমার কানে এলেও খুব একটা গায়ে মাখি নি।
আলী সায়েব নাকি প্রচণ্ড মদ খান। কোলকাতার -৫ নং পার্ল রোডের বাড়ীতে অনেক পরে তাঁকে আমি মদ খেতে দেখেছি। কিন্তু তখন আমি , সেয়ানা আর লায়েক এবং নিজেও একটু আধটু খাই বলে বিশেষ পাত্তা দেই নি।
আজ লেখাটি লিখতে লিখতে অনেক কথা মনে পড়ছে যেগুলো স্মৃতির রিসাইকেল বিন থেকে রিট্রিভ হলো।

যেমন :- ১৯৪৮ সাল। তখনও ভারত আর পাকিস্তানের পাসপোর্ট চালু হয় নি। যোগানন্দ গুপ্ত (নসু গুপ্ত) কাজের জন্য শিলং থেকে বাসে সিলেট যাচ্ছেন। বেলা প্রায় আড়াইটার সময় “ডাউকী” সীমান্তে পৌঁছে কাষ্টমস্ অফিসারের কাছে শুনলেন – একটা প্রাইভেট কারে দুজন ( একজন ব্যবসায়ী, আরেকজন পণ্ডিত এবং সাংবাদিক) মদ নিয়ে সিলেট যাচ্ছিলেন, তাঁদের ডিটেন করা হয়েছে।

নসু বাবু চলে গেলেন স্থানীয় ডাকবাংলোতে। গিয়ে দেখলেন- তাঁরা হলেন সিতু মিঞাঁ আর তাঁর বন্ধু প্যারীমোহন মুখার্জ্জী। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় আলী সায়েব মনোরম সিলেটি ভাষায় কাষ্টমস্ অফিসারকে বললেন :-

ক্বিতা বা ! আর দরতায় নি ? পেটো করি নিলাম ( পৃ:- ২৮৭- নূরুর সায়েবের বই থেকে)।

মদ তাঁকে খেয়ে নিয়েছিলো। তাই সেভাবে টাকা পয়সা থাকতো না তাঁর কাছে। অথচ পয়সা কম কামান নি। এ বিষয়ে অনুযোগ করলে তিনি এক বিদেশী লেখকের উদাহরণ সহ বলতেন :- কে বলে আমি টাকার মর্ম বুঝি না ? ফুরিয়ে গেলেই টের পাই।

সীমা পেরিয়ে গেছেন মদ্যপানের অথচ আলী সায়েবের ভেতরকার অনিন্দ্য সুন্দর রূপটি কখনও নষ্ট হয় নি, এমন কি পার্ল রোডে ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে থাকলেও।

পাকিস্তানে তিনি পরিচিত ছিলেন – মুসলমান বেশ ধারী হিঁদু হিসেবে আর ভারতে নেড়ে। এই বেপোরয়া জীবনেও তাঁর পিতৃ হৃদয় কেঁদে যেত তাঁর দুই ছেলে ফিরোজ আর ভজু/ কবীরের জন্য ( সৈয়দ মশাররফ্ আলী, সৈয়দ জগলুল আলী )।

মুজতবা আলীর পশ্চিমবঙ্গের র‍্যাশন কার্ড

বগুড়া কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন, তিনি যখন তখন বলতেন :- মা কালী রক্ষা করো। তাই নিয়ে সবার কি রাগ ! কথায় কথায় , মা কালী রক্ষা করো – এই শব্দবন্ধটা ছিল, শান্তিনিকেতনের সাইড এফেক্ট।

এক রাতে, এক পোষাকে পালিয়ে আসতে হয় তাঁকে। ভাগ্গিস একটা ট্রেন সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিলেন - না হলে তিনি খুন হতেন, এখনকার ব্লগারদের মত। কিন্তু তিনি যে বারবার আল্লার স্মরণ কতবার যে নিয়েছেন – কেউ খেয়াল রাখে নি।

ব্যাটা কাফের – এ লোকটা পাকিস্তানের শত্রু।

উল্টো দিকে আনন্দ বাজারের অন্যতম স্বত্বাধিকারী – প্রফুল্ল চন্দ্র সরকারের শ্রাদ্ধ বাসরে গেছেন নিমন্ত্রণ পেয়ে। উপস্থিত ব্রাহ্মণরা নাক সিঁটকেছে তাঁকে দেখে। গীতা পাঠে ভুল হচ্ছে দেখে বলাতে শুনতে হলো :- তুমি মুসলমানের বাচ্চা , গীতার কি জানো হে ?

অনর্গল মুখস্থ বলে গেলেন বই না দেখে। এমনই ছিল তাঁর স্মৃতি শক্তি !!!

সব চুপ !

সুনীতি বাবু বলেছিলেন :-

“মুজতবা আলী তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের প্রচণ্ড গবেষক হতে পারতেন, তুলনামূলক ভাষা তত্ত্বে সার্থক অন্বেষণ চালাতে পারতেন, ভারতীয় ইতিহাসের অনুদ্ঘাটিত দিক উন্মোচন করতে পারতেন,কিন্তু কিছুই করেন নি।
শুধু ব্যঙ্গ রসিকতায় নির্বাসন দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করলেন।”

আসলে রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতনে যে আড্ডার ট্র্যাডিশন গড়ে দিয়েছিলেন- তার থেকে বেরুতে পারেন নি আলী সায়েব। আর পারেন নি বলেই তো আমরা লাভবান- পেয়েছি :- ধূম্র- মদ্য- এসপেরেগাস-আবদুল্লা- শবনম- টুনি মেম – কাসুন্দোর স্বাদ ! পাব- কফিখানার টাটকা সুগন্ধ।

নিজের সম্বন্ধে কিছু বলছেন না – অথচ লিখে চলেছেন :-

ও মুর্শীদ তোমার লগে নাই তো অভিমান
আইলে আও, যাইলে যাও, ঠেলে মারো টান
ও মুর্শীদ, নাই তো অভিমান !

আরও লিখছেন :-

“ডাক্তার যদিও জর্মন তবু হাত দু’খানি আকাশের দিকে তুলে ধরলেন ফরাসিস্‌ কায়দায়। বললেন, ‘অবাক করলেন, স্যার! সর্দির ওষুধ নেই? কত চান? সর্দির ওষুধ হয় হাজারো রকমের।’

বলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুললেন লাল কেল্লার সদর দরজা পরিমাণ এক আলমারি। চৌকো, গোল, কোমর-মোটা, পেট-ভারী বাহান্ন রকমের বোতল-শিশিতে ভর্তি। নানা রঙের লেবেল আর সেগুলোর উপর লেখা রয়েছে বিকট বিকট সব লাতিন নাম। এবারে খানদানী ভিয়েনীজ কায়দায় কোমরে দু’ভাঁজ হয়ে বাও করে বাঁ হাতটা পেটের ওপর রেখে ডান হাত দিয়ে তলোয়ার চালানোর কায়দায় দেরাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি দেখিয়ে বললেন, ‘বেছে নিন, মহারাজ (কথাটা জর্মন ভাষায় চালু আছে) সব সর্দির দাওয়াই।’
আমি সন্দিগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকালুম। ডাক্তার মুখব্যাদন করে পরিতোষের ঈষৎ হাস্য দিয়ে গালের দুটি টোল খোলতাই করে দিয়েছেন- হা’ টা লেগে দিয়েছে দু’কানের ডগায়।
একটা ওষুধের কটমটে লাতিন নাম অতি কষ্টে উচ্চারণ করে বললুম, ‘এর মানে তো জানিনে।’
সদয় হাসি হেসে বললেন, ‘আমিও জানিনে, তবে এটুকু জানি, ঠাকুরমা মার্কা কচু-ঘেঁচু মেশানো দিশী দাওয়াই মাত্রেরই লম্বা লম্বা লাতিন নাম হয়।’
আমি শুধালাম, ‘খেলে সর্দি সারে?’
বললেন, ‘গলায় একটু আরাম বোধ হয়, নাকের সুড়সুড়িটা হয়ত একটু আধটু কমে। আমি কখনো পরখ করে দেখিনি। সব পেটেন্ট ওষুধ-নমুনা হিসাবে বিনা পয়সায় পাওয়া। তবে সর্দি সারে না, এ কথা জানি।’
আমি শুধালুম, ‘তবে যে বললেন সর্দির ওষুধ আছে?’
বললেন, ‘এখনো বলছি আছে কিন্তু সর্দি সারে সে কথা বলিনি।’
বুঝলুম, জর্মনি কান্ট হেগেলের দেশ। বললুম, ‘অ’।
ফিসফিস করে ডাক্তার বললেন, ‘আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামো ওষুধে সারে না।’
ততক্ষণে আবার আমি হাঁচ্ছো হাঁচ্ছো আরম্ভ করে দিয়েছি। নাক-চোখ দিয়ে এবার রাইন-ওড়ার না এবারে পদ্মা-মেঘনা। ডাক্তার ডজন দুই কাগজের রুমাল আর একটা ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
ধাক্‌কাটা সামলে ওঠে প্রাণভরে জর্মন সর্দিকে অভিসম্পাত দিলুম।
দেখি, ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছেন।
আমার মুখে হয়ত একটু বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। বললেন, ‘সর্দি-কাশির গুণও আছে।’
আমি বললুম, ‘কচু, হাতী, ঘণ্টা!’
বললেন, ‘তর্জমা করে বলুন।’
আমি বললুম, ‘কচুর’ লাতিন নাম জানিনে; ‘হাতী’ হল ‘এলেফান্ট’ আর ‘ঘণ্টা’ মানে ‘গস্নকে’।
‘মানে!
আর বুঝে দরকার নেই; এগুলো কটুবাক্য।’
আকাশ পানে হানি যুগলভুরু করে বললেন, ‘অদ্ভুত ভাষা! হাতি আর ঘণ্টা গালাগালি হয় কি করে! একটা গল্প শুনবেন? সঙ্গে গরম ব্রান্ডি?’

এই ভাবেই প্রেমের গল্প আরম্ভ করে মাতিয়ে রাখেন তিনি , অথচ নিজের সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

অধুনা, ভারতে নিযুক্ত, বাংলাদেশের মাননীয় হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী, যুবক বয়সে “শবনম্” পড়ে- একবার আলী সায়েবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন :- চাচা, আপনি কতজন মহিলার সংস্পর্শে এসেছিলেন কাবুলে ?

আলী সায়েব গম্ভীর ভাবে বলেছিলেন :- মাত্র একজন

তিনি কে ছিলেন? ( মুয়াজ্জেম সায়েব হয়তো আশা করেছিলেন , চাচা শবনমের কথা বলবেন )

আমাকে যে দুধ দিত, সেই বৃদ্ধা মহিলা !

এখানেও তিনি নিশ্চুপ আত্মীয়দের কাছে। জর্মনি কান্ট হেগেলের দেশ হলে ভারতও দর্শনের দেশ। সেই দার্শনিক সুলভ ঔদাসীন্যে এড়িয়ে গেছেন নিজের সম্বন্ধে তথ্য।

এই দার্শনিক ঔদাসীন্যেই তিনি নির্লিপ্ত হয়ে লেখেন :-

“আমার ব্যক্তিগত শাবাসী সেই হাস্যরসের, সেই ব্যঙ্গরসের উদ্দেশে যেখানে রসস্রষ্টা নিজেকে নিয়ে নিজেই হাসেন,নিজেকে নিয়ে হাসেন, নিজেকে ব্যঙ্গ করেন –লাফস্ অ্যাট হিস ওন কস্ট্।”

তিনি নিজের এক বন্ধুর কথা লিখেছিলেন – যিনি আলী সায়েবের গায়ের রং দেখিয়ে, দোকান থেকে বুটপালিশ চেয়েছিলেন।

যাঁরা ওনাকে দেখেন নি – তারা বুঝতে পারবেন না, নিজের গায়ের টকটকে ফর্সা রঙ নিয়ে কি ভাবে হাস্যরস বিলিয়েছেন।

আরেক জায়গায় লিখছেন :-

“অধুনা মৃত ভাস্কর এপস্টাইন আমাকে “বৃদ্ধ নিগ্রোর” মডেল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পার্টিতে উপস্থিত সুন্দরীরা ভেবেছিলেন – আম্মো ফিলিম স্টার। স্যুটিংয়ের ড্রেস না ছেড়েই দাওয়াতে এসেছি।”

একবার স্কুলে শিক্ষক গরু সম্বন্ধে রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। বন্ধুরা বলেছিল –আত্মজীবনী লেখা কঠিন নয়।

এই ভাবেই জীবনই যে অভিজ্ঞতা সেটা লিখেছেন – নিজের জীবনকে লুকিয়ে রেখে।

কদমবুশী- আলী জেঠু।

[' সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে' লেখকের আরও কয়েকটি লেখা অবসর-এ প্রকাশিত হবে]


পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট, দোতালা বাস এবং নাট্যে উপেক্ষিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।