প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য: সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে

জুন ৩০, ২০১৬

 

স্বদেশ

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

 

১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার তাদের সংবিধানে ধর্মীয় জিগির তুলে “সস্তায় কিস্তিমাত” করতে চাইলে করাচীর যুবসম্প্রদায় এর বিরুদ্ধে “দেয়ালে দেয়ালে” তাদের প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেছিল।

মুজতবা আলী

মুজতবা সাহেব, তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে যথাসম্ভব শাস্ত্রগ্রন্থে যুক্তি ও তথ্যের সন্ধান করেন।

‘বাইবেলে লেখা আছে, বাবিলনের রাজা বেল্ জাৎসর ইহুদিদের প্রধান মন্দির লুট করে তারই স্বর্ণ কোষাকুষি দিয়ে মদ্যপান করতে করতে ইহুদিদের কুলদেবতা যেহোভাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ দেয়ালের গায়ে আগুনের হরফে কি যেন লেখা হয়ে গেল। বেল্ জাৎসর ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই রাতেই বেল্ জাৎসর অজানা ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান। তার থেকেই প্রবাদ এসেছে – রাইটিং অন দি ওয়াল...

করাচীর মহাজনেরা যদি দেয়ালের ওপর ছোকরাদের লেখাগুলো ঠিকঠাক পড়তে পারেন, তবেই মঙ্গল”
মুজতবা সাহেবের সেই ভয় – সত্যি হয়েছিল, তাঁর জীবদ্দশাতেই। প্রমাণ- স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের উদ্ভব।

দেশ বিভাগের সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই, ১৯৪৭ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখ এক বক্তৃতায় এবং ১৯৪৮ সালের এক প্রবন্ধে তিনি অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন :-

“পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে।.....এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে .......। বর্ণের কৌলীন্য যেমন শোষণের কারণ হতে পারে, ভাষার কৌলীন্যও ঠিক সেই রকম শোষণ পন্থা প্রশস্ততর করে দেয়।”

বাস্তবে ঠিক এটাই হয়েছিল তখন। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পশ্চিমাদের রমরমা সব রকম উঁচু পদে। পূর্ব পাকিস্তানে ৬৮ সালের এক সমীক্ষায় জানা যায় – পশ্চিমাদের উঁচু পদে অধিষ্ঠিতদের হার ৩২ % আর পশ্চিমে, বাঙালিদের হার ২%।

অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে- মুজতবা আলী বগুড়া থেকে পালিয়ে এসে ১৯৪৯ সালে ভারতের নাগরিক হন। এটা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল। আসলে, ১৯৪৯ সালের জানুয়ারী মাসে তাঁকে কলকাতা থেকে এনে বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসানো হয়েছিল। বগুড়া কলেজে তিনি যখন তখন বলতেন :- মা কালী রক্ষা করো। তাই নিয়ে সবার কি রাগ !

এক রাতে, এক পোষাকে পালিয়ে আসতে হয় তাঁকে। জানুয়ারি একটা ট্রেন সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিলেন- না হলে তিনি খুন হতেন, এখনকার ব্লগারদের মত। এছাড়াও উদার মতালম্বী মুজতবা সাহেবকে সহ্যও করতে পারতেন না তখনকার পাকিস্তানের মৌলবাদীরা।

কিন্তু তিনি যে বারবার আল্লার স্মরণ কতবার যে নিয়েছেন – কেউ খেয়াল রাখে নি।

ব্যাটা কাফের – এ লোকটা পাকিস্তানের শত্রু। তাই তাড়াও “ব্যাটাকে”।

পাসপোর্ট প্রথা চালু হলে, স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের নাগরিক হিসেবে পাশপোর্ট নেন। তারপর থেকে তিনি আমৃত্যু ভারতীয় নাগরিক ছিলেন, যদিও বিয়ে করেছিলেন পারিবারিক ভাবে ঘটকালি করা সিলেট সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুনকে। বিয়ের পরে তিনি রাবেয়া আলী হন। পরে , রাজশাহী ডিভিশনের স্কুল ইন্সপ্রেক্টেস হয়েছিলেন তিনি।



মুজতবা আলীর পাসপোর্ট

তাই, তিনি পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে বগুড়া থেকে কলকাতায় “হিজরৎ” করেন নি। ( প্রফেটের মক্কা থেকে মদিনা যাওয়া। আর যাঁরা প্রফেটের সঙ্গে এসেছিলেন, তাদের নাম হয়েছিল – আনসার। আনসারী পদবী এখান থেকেই এসেছে )

বগুড়া থেকে চলে আসার পর মুজতবা সাহেব তাঁর অনুকরণীয় ভঙ্গীতে লেখেন :-

“..... ওরা ( পশ্চিমবঙ্গবাসী) এবং এপারের ( অধুনা বাংলাদেশ) বহু দূরের বগুড়া বাসীরা মাত্র গুহ্য তত্ত্বটি অবগত আছেন। পার্টিশনের পরেই একটি বিশেষ দ্রব্য ( গাঁজা- নওগাঁ এই জিনিসটির জন্য বিখ্যাত ছিল) হেথাকার নওগাঁ থেকে চালান বন্ধ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের ছেলে – সরাসরি নওগাঁ যাই কি প্রকারে ? তাই সেটাকে বগুড়াবাসের ক্যামুফ্লাজে ঢেকে সেখানে কয়েক মাস কাটাই। কিন্তু কপাল মন্দ। চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদ- আহা কি “আজিজ” ( পরাক্রমশালী) প্যারা দোস্তই না পেয়েছিল মহাপুণ্যবান মরহুম পূর্ব পাকিস্তান – তিনি আমাকে হাতের সামনে না পেয়ে , লাগলেন আমার ইষ্টিকুটুমের পেছনে। কিই বা করি তখন আর। গুটি গুটি ফের কলকাতা। মেহেরবান আজমুশ্ শান আজিজ আহমেদ খান, জান প্রাণ ভরে তসল্লীর ঠাণ্ডি শ্বাস ফেললেন। মশরিকি পাকিস্তানকে বরবাদ পয়মাল করার তরে যে বদ্- বখ্ৎ হিন্দুস্তানি এসেছিল হেথায়- সে ইবলিশ গেছে।”

বগুড়া কলেজের চাকরী ছাড়ার পরে মুজতবা আলী ১৯৫০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এই সময় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাকে দিল্লী ডেকে পাঠান। আজাদ ছিলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস-এর সভাপতি। তিনি ঐ সংস্থার জন্য একজন সেক্রেটারি খুঁজছিলেন।

মৌলানা তাকে জিজ্ঞাসা করেন: ভারতীয় ভাষা জানেন ?
আলী বললেন : বাংলা ও উর্দু।
আজাদ শুধালেন :সংস্কৃত ?
আলী জবাব দিলেন : সামান্য সামান্য।
আবার প্রশ্ন : ইউরোপীয় ভাষা কি জানেন ?
"একটু আধটু ইংরেজী, একটু ফ্রেঞ্চ ও একটু জার্মান।"
আবার প্রশ্ন: আরবী জানেন?
"কাজ চলা গোছের।"
আজাদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন: ব্যস ব্যস এতেই হবে।এই রকম একজন লোকই খুঁজছি।লেগে যান তাহলে।"

[সৈয়দ মূর্তাজা আলী (মুজতবা আলীর মেজদা) রচিত, 'সৈয়দ মুজতবা আলী: জীবন ও সাহিত্য ']

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস-এর সেক্রেটারি হতে গেলে যে ভারতীয় হতেই হবে, সে কথা গুজব রটনা কারীরা “চেপে” গেছিলেন।

১৯৩১ সালে মুজতবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনে এই ব্যাপারটা মুহতবা সাহেব সারাজীবন মনে রেখেছিলেন-

‘বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?
আমি অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে?


হাঁ হাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?’

মুজতবা সাহেব পান নি, তবে রবীন্দ্রনাথের এই কাঁচি আমরা এখনও খুঁজছি।

১। তথ্য কৃতজ্ঞতা :- অধ্যাপক নূরুর রহমান খান (ঢাকা) প্রণীত, সৈয়দ মুজতবা আলী:- জীবনকথা।
২। চিত্র সৌজন্য :- জনাব সৈয়দ জগলুল আলী ( মুজতবা আলীর ছোট ছেলে – ডাক নাম, কবীর)

[' সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে' লেখকের আরও কয়েকটি লেখা অবসর-এ প্রকাশিত হবে]


পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট, দোতালা বাস এবং নাট্যে উপেক্ষিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।