প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য: সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে

জুলাই ১৫, ২০১৬

 

জীবন ও যৌবন

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

 

যে কোনো পুরুষেরই দুর্বলতা থাকে আর আলী সায়েবও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আবার সেই পুরুষ মানুষটি যদি – সুদর্শন, বিদগ্ধ, রসবোধ, শিল্প –সুষমা-মণ্ডিত বাক্ নৈপুণ্যে পটু হন, তাহলে তো কথাই নেই ।
দেশ- বিদেশের বহু মহিলা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং এই ব্যাপারে কোনো গোপনীয়তাও অবলম্বন করেন নি আলী সায়েব ।

মুজতবা আলী

বৃদ্ধ বয়সেও কত অবলীলায় কবুল করেছেন :- “কোনো রমণীর সান্নিধ্য লাভের জন্য আমি কোনোরকম প্রস্তুতি নিতে রাজী নই । তবু যদি কেউ আমার প্রতি, শুধুমাত্র আমারই আকর্ষণে ধরা দেয়, তবে আমিই বা মুখ ফিরিয়ে নেবো কেন ?”

গুরুদেবকে তিনি সবসময়ই স্মরণ করেছেন । হৃদয়বৃত্তির ক্ষেত্রেও বিশ্বকবির “পুরুষের উক্তি” তাঁর শিষ্যের জীবনে বাস্তবতা লাভ করেছে ।

“ আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে
তাহারেই ভালো বলে জানি ।
সব প্রেম প্রেম নয় ছিল না তো সে সংশয়—
যে আমার কাছে টানে তারে কাছে টানি ।

আলী সায়েব কখনো এই উদারতায় বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ রাখেন নি ।

কোলকাতাতেও বহু রমণীর উষ্ণ সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন এবং এঁদের দু একজন তাঁর মনোলোকে কিছুটা ছায়া বিস্তারও করেছিলেন। সে যাই হোক, এটা আমাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় নয়, কারণ অপূর্ণতা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং অসাধারণ ব্যক্তির অপূর্ণতা, দুর্বলতাই সাধারণের দৃষ্টিতে প্রকটভাবে ধরা পড়ে ।
সার্বিক বিচারে- ভুল ত্রুটির কথা মনে রেখেও, এটা দেখতে পাই, পিতা- স্বামী- আত্মীয়- বন্ধু হিসেবে আলী সায়েব ছিলেন সবরকম সংস্কারমুক্ত একজন সুন্দর, প্রাণবান মানুষ, যাঁর সংবেদনশীল হৃদয় ছিল মানবরসে পরিপূর্ণ।
দুর্বলতা সত্ত্বেও এক এত ভালো, উদার, হৃদয়বান, স্নেহপ্রবণ মানুষ সহজে মেলে না।

এদিকে, মুজতবা-চরিত্র সম্বন্ধে সব জেনেই রাবেয়া খাতুন ( আলী) আলী সায়েবকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে, মুজতবা ছিলেন ভারতে আর স্ত্রী রাবেয়া আলী ছিলেন ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সরকারের চাকুরে।

আলী সাহেব কখনও চাকরী করেছেন, কখনো লিখে টাকা আয় করেছেন, কিন্তু কখনই তাঁর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায় সেটা কখনওই ছিল না।

পরিবার পরিজনের কাছে থাকতে চেয়েছেন, স্ত্রীকে নিজের কাছে রাখার সাধও জেগেছে কিন্তু নিজের সাধ্যের প্রতি অনাস্থাও ছিল সঙ্গত কারণেই আর সেটা তিনি বুঝতে ভুল করেন নি। তাই স্ত্রীর জন্য শান্তিনিকেতনে চাকরীর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটা হয় নি। তাই প্রিয়জনকে কাছে রাখার ইচ্ছেটাও ত্যাগ করতে হয়েছে ।

এই প্রসঙ্গে প্রয়াত অন্নদাশঙ্কর রায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন :-

“ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক চাকুরী চেয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক কারণে তখন তাঁদের চাকুরী দেওয়া সম্ভব হয়নি । আনন্দবাজার গ্রুপও তাঁকে চাকুরী দেননি। পরে, শান্তিনিকেতনে মুজতবার চাকুরী হয়”

শুধুমাত্র “কলম”কে ভরসা করে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সালের অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত , হালভাঙা নৌকোর মত কোনোক্রমে নিজেকে চালিয়েছেন ।

এর মধ্যে শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাস বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্বভার পান।
নীরোদবিহারী রায়ের মৃত্যুতে বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাসের পদ শূন্য হলো। সুধীরঞ্জন দাসের আগ্রহ এবং আন্তরিকতার ফলে এই শূন্য পদে “এড- হক্” ভিত্তিতে মুজতবা সায়েব ১৯৬১ সালের ১৮ ই অগাস্ট এই পদে যোগ দিলেন।

শান্তিনিকেতনে সাড়ে চার বছর বাস করে এই অধ্যাপনার কাজ পাওয়া হলো মুজতবা সাহেবের।

২০ শে অগাস্ট ১৯৬১ তে সোমেন চট্টোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে আলী সায়েব লিখলেন:-

“শেষটায় আমিও চাকরী নিয়েছি । গত শুক্রবার, পয়লা ভাদ্র বিশ্বভারতীতে জঈন ( বানান অপরিবর্তিত) করেছি as Reader of Islamic History and German. 15th August... দেশ স্বাধীন হয়েছিল আর আমি 18th August স্বাধীনতা হারালুম। এই কাজ নিয়ে হয়তো মুহম্মদের জীবনীটি লেখা হয়ে যাবে- এই যা সান্ত্বনা।”

ইসলামিক স্টাডিসে অধ্যাপক হলেন বটে, কিন্তু ছাত্র ছাত্রী না থাকায় মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী আলী সাহেব জার্মান পড়াতেন এবং উচ্চতর গবেষণার দায়িত্বও মিলেছিল তাঁর। কিন্তু মুজতবার জীবন দেখলে এটাই বুঝতে পারি- দায়িত্বের গণ্ডীতে বন্দী হওয়ার মানসিকতা তাঁর কোনোদিনই ছিল না। জীবন ধারণের তাগিদে তিনি চাকরীতে যোগ দিয়েছিলেন বটে কিন্তু একনিষ্ঠ ভাবে বা স্থায়ী ভাবে লেগে থাকার জন্য নয় – ছেড়ে দেবার কথা মনে রেখে।

যাই হোক্, ১৯৬২ সালে বিশ্বভারতী থেকে রিডারের স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়।
আবেদনকারীদের মধ্যে বিভাগীয় প্রার্থী মুজতবা সহ তিনজনকে ডাকা হয়। কিন্তু সাক্ষাৎকারে মুজতবা সহ আরেকজন আসেন।

১৯৬২ সালে মুজতবা সাহেব ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে স্থায়ী ভাবে রিডার পদে যোগ দেবার জন্য মনোনীত হলেও কোনো ইনক্রিমেন্ট পান নি, তবে প্রবেশন পিরিয়ডের সময়টা শিথিল করা হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স আটান্ন আর ডক্টরেট পেয়েছিলেন আঠাশ বছর বয়েসে। এই ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার কোনো উপকার বা সুবিধা পান নি।

শান্তিনিকেতনে রিডার পদে যোগ দিয়ে তিনি টের পেতে লাগলেন – যুগের পরিবর্তন। এদিকে মুজতবা সায়েব বিদেশে বাস করার জন্য জীবন ধারার পরিবর্তন ঘটেছিলো। এই পরিবর্তন সবাই মেনে নিতে পারেন নি।
আলী সায়েব পানাসক্ত হলেও শান্তিনিকেতনে এসে প্রকাশ্যে কোনো অশালীন আচরণ করেন নি। তবু তাঁর এই অভ্যাস নিয়ে গুঞ্জন উঠতেই থাকে ।

এই সময়ে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে, তাই খ্যাতি লিপ্সু ঈর্ষাকাতর অক্ষমজনদের আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মূলত তিনটি গুঞ্জরিত অভিযোগ ওঠে।
১। মদ্যপান ।
২। ক্লাসে তথা কর্তব্যকর্মে অনিয়ম।
৩ । গবেষণার কাজে অনীহা ।

সুতরাং তাঁকে অধ্যাপকপদে রাখার পক্ষে কোনো যুক্তিপূর্ণ কারণ নেই। দু একটা কারণে আলীসায়েবও শান্তিনিকেতনের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন। সেই সময় বিভিন্ন লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তায় এবং লেখা চিঠিতে তাঁর এই ক্ষোভ গোপন থাকে নি।

বিশ্বভারতীর নিয়ম অনুসারে অবসরের সময় ষাট্ হলেও অনেককে পঁয়ষট্টি বছর বয়েস পর্যন্ত চাকরী করতে দেওয়া হতো। তাই মুজতবা আলীর মনে হয়েছিল- তিনিও পঁয়ষট্টি বছর বয়েস পর্যন্ত চাকরী করবেন।
১৯৬৪ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর আলী সায়েবের বয়স ৬০ হলেও চাকরী থেকে অব্যাহতি দানের কোনো চিঠি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেন নি। তাই আলী সায়েব সঙ্গত কারণেই ভেবে নেন যে তাঁকেও এক্সটেনশন দেওয়া হবে। কিন্তু ৬০ বছর পূর্তির আট মাসের মাথায় হঠাৎ জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে চাকরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

যে মুজতবা আলী সবসময় চাকরি থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজেছেন সব সময়, সেই তিনিই এরকম হঠাৎ একটা খবর পেয়ে মর্মান্তিক আহত হন, এবং সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান। বন্ধু বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে যে চিঠিটা লেখেন, তার শেষ লাইনটা ছিল:-

I am leaving. Now either I will hear you are dead or you will hear I am dead.

আসল ঘটনাটা হলো – আলী সায়েবকে যে গবেষণার কাজটা দেওয়া হয়েছিল Life and teachings of Muhammad, সেটা তিনি শুরুই করেন নি চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়া সত্বেও। তাই তাঁর গুণমুগ্ধ হলেও, বিদ্যা ভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ কালিদাস ভট্টাচার্য নিয়ম অনুসারে extension দিতে পারেন নি।

মুশকিলটা হলো শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর, আলী সায়েবের মদ খাওয়ার মাত্রটা বেড়ে যায়। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় পান করাটা ছিল পরিমিত আর লিখতেনও সময়মত। কিন্তু বোলপুরের নীচাপট্টিতে চলে যাবার পর পরিবার পরিজন না থাকায় তাঁর পানের মাত্রাটা কেউ কমাতে পারে নি, উল্টে কোলকাতা থেকে লোকজন এসে তাঁরই পয়সায় মদ খেয়ে আড্ডা মেরে চলে যেতেন। নয়তো, আমরা আরও লেখা তাঁর কাছ থেকে পেতে পারতাম।

সুনীতি বাবু বলেছিলেন :-

“মুজতবা আলী তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের প্রচণ্ড গবেষক হতে পারতেন, তুলনামূলক ভাষা তত্ত্বে সার্থক অন্বেষণ চালাতে পারতেন, ভারতীয় ইতিহাসের অনুদ্ ঘাটিত দিক উন্মোচন করতে পারতেন,কিন্তু কিছুই করেন নি । শুধু ব্যঙ্গ রসিকতায় নির্বাসন দিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করলেন ।”

আসলে রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতনে যে আড্ডার ট্র্যাডিশন গড়ে দিয়েছিলেন- তার থেকে বেরুতে পারেন নি আলী সায়েব ।

আমিন

তথ্য ঋণ :-
সৈয়দ মুজতবা আলী:জীবনকথা - জনাব নূরুর রহমান খান ( ঢাকা)
ছবি :- জনাব সৈয়দ জগলুল আলী


পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট, দোতালা বাস এবং নাট্যে উপেক্ষিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।