শান্তিনিকেতনের ‘বাল্মীকি কোকিলম’
দীপক সেনগুপ্ত
দিনটা ছিল ১৯শে মে ১৯১৪। ঢাকার রমনায় (এখন বাংলাদেশে) ঈশানচন্দ সেনের ব্রাহ্ম পরিবারে যখন একটি নবজাতিকা ভূমিষ্ঠ হ’ল তখন বাবা, কাকা, জেঠিমা, ঠাকুমা ও একান্নবর্তী পরিবারের সবার মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সেদিন শাঁখ ও উলুধ্বনির মধ্যে যাকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল পরবর্তী কালে তার বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ হয়েছিল আশ্চর্য রকম। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে চীৎকার করে জহরলাল পান্নালাল পড়তে শুনে ও বাইরে টানানো ব্যানারে লেখা দেখে বই নিয়ে বসে নিজেই সে পড়ল জহরলালঅ পান্নালালঅ। অবাক হয়ে গেল সবাই। কে শেখালো তাকে পড়তে ? মেয়েটির নাম রাখা হ’ল অমিতা, আদরের ডাক নাম খুকু।
অমিতা সেন (খুকু) |
ঠাকুরদা ঈশানচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করায় তখনকার দিনে অনেকের মতই তাকে সমাজে একঘরে করে রাখা হয়েছিল। খুকুর মা সুহাসিনী ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তুলনায় বাবা ক্ষিতিশচন্দ্র ছিলেন শুধুমাত্র ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক, আয় ছিল খুবই সামান্য। অর্থোপার্জনের জন্য তাকে চাকরির সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়েছে, অনেকবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে। সমাজসেবী অবলা বসুর পরামর্শে পিসিমা হেমবালা সেন শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং শ্রীসদনে ছাত্রীনিবাসের অধ্যক্ষা হিসাবে কাজে যোগদান করেন। পড়াশোনার সুবিধার জন্য সঙ্গে নিয়ে গেলেন খুকুকে ও তার পরের বোন ললিতা দাস বা তাতুকে।
ছো্টবেলা থেকেই মায়ের কাছে গান শিখত খুকু। মা তাকে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে উৎসাহিত করতেন। এভাবে গান শ্বাস প্রশ্বাসের মতই খুকুর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে যে সঙ্গীত ভবন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খুকু ও তাতু সেখানেই ভর্তি হ’ল।
খুকুর বয়স যখন মাত্র ছ’বছর তখন গান্ধীজিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিল সে, পরে কবিতাটিতে সুর সংযোগ ক’রে পাটনায় বাঁকিপুর সেমিনারির ময়দানে পরিবেশন করেছিল। ঐ বয়সের একটা মেয়ের পক্ষে কবিতা রচনা করা এবং সুর দিয়ে সেটা জনসমক্ষে পরিবেশন করা কি করে সম্ভব সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই ঘটনা ভবিষ্যতে তার সৃষ্টিক্ষম প্রতিভা বিকাশের ইঙ্গিত দিয়েছিল। গান্ধীজিকে নিয়ে কবিতাটি ছিল –
পিসিমা হেমবালা সেন খুকুকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যান এবং গান্ধীজিকে নিয়ে লেখা গানটি কবিগুরুকে শোনাতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য হয়ে যান মেয়েটির প্রতিভায়। তিনি খুকুকে তার গানের জগতে টেনে নেন। দিনেন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন তাকে গান শেখাতে।
শান্তিনিকেতনে তিন কন্যা। মাঝে অমিতা সেন (খুকু), তার ডান পাশে বোন ললিতা সেন (তাতু) ও বা-পাশে আশ্রমকন্যা অমিতা সেন (অমর্ত্য সেনের মা) |
খুকু শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ন’বছর বয়সে। শান্তিনিকেতনে তখন তিন জন অমিতা। বড় অমিতা ছিলেন অধ্যাপক অজিত চক্রবর্তীর কন্যা, পরে যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র অজিন ঠাকুরকে বিয়ে করে অমিতা ঠাকুর হন। দ্বিতীয় অমিতা কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের কনিষ্ঠা কন্যা। আগাগোড়া শান্তিনিকেতনেই মানুষ হয়েছেন তিনি এবং নিজে ‘আশ্রমকন্যা’ নামে পরিচিত হতেই ভালবাসেন। পরে ইনি বিজ্ঞানী আশুতোষ সেনকে বিয়ে করেন; তাদেরই সুযোগ্য পুত্র অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। আর তৃতীয় অমিতা সেন হলেন খুকু।
আশ্রমকন্যা অমিতা আর খুকুর বয়স ছিল প্রায় একই, একই ক্লাসের ছাত্রীও ছিল তারা। ‘শ্রেয়সী’ পত্রিকায় আশ্রমকন্যা স্মৃতি রোমন্থন করেছেন –
এরকমই সহজ সরল ছিল খুকু। দ্বিধা সঙ্কোচের বাইরে বেরিয়ে তার নির্মল হৃদয় দিয়ে যে কোন মানুষকেই মুহূর্তে আপন করে নিতে পারত সে।
শান্তিনিকেতনে খুকুর সহপাঠী উমা দত্ত শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ফিরে গিয়েছেন সেই সময়ের কথায় –
হস্টেলে কয়েকজনের ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে হঠাৎ সে গেয়ে উঠল –‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে।’ বিরক্ত হয়ে অনেকে বলে উঠলো –“দেখ দেখ খুকু আবার গান ধরেছে।”
খুকুর পরের বোন ললিতা দাস (তাতু), তার প্রিয় দিদির সম্বন্ধে যা লিখে গেছেন তা থেকেই খুকুর চরিত্রের অন্যান্য দিক গুলি সুন্দর ফুটে ওঠে। তার লেখা থেকে উধৃত করা যাক –
খুকুর স্নেহ-কোমল স্বভাবের সঙ্গে তার প্রতিবাদী চরিত্রের কথাও অনেকের জানা ছিল। পরবর্তী কালে আমরা এর আরও পরিচয় পাব। বহু ক্ষেত্রে অন্যায় দেখলে সে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করত। বাইরের কলেজের ছেলেদের বাচালতা দেখলে ফোঁস করে উঠত। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্যই শান্তিনিকেতনের নিশিকান্ত রায় চৌধুরী খুকুকে নিয়ে কবিগুরুর ‘কৃষ্ণকলি’র ধাঁচে একটি প্যারোডি তৈরি করেছিলেন –
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে দিনু ঠাকুরের কাছে গান শিখতে শুরু করেছিল খুকু। খুকুর সহাধ্যায়ী রমা চক্রবর্তী লিখেছেন –
গান তো খুকুর প্রিয় ছিলই, পড়াশোনাতেও তার গভীর আগ্রহ ছিল। বিদ্যালয়ের পাঠ শান্তিনিকেতনে বসেই হয়েছিল। শান্তিনিকেতন তখন কোন স্বীকৃত পরিষদের অধীনে না থাকায় খুকু ব্যক্তিগত পরীক্ষার্থিনী হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসেন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বাংলায় তিনি শতকরা ৯৬ নম্বর পেয়ে সে বিষয়ে সবার শীর্ষে থাকেন।
খুকুকে দেখতে কেমন ছিল ? সতীর্থদের ভাষায় – “গায়ের রঙ ছিল খুকুর কালো, মুখ চোখ ছিল খোদাই করা মূর্তি যেন, বুদ্ধিদীপ্তিতে সে ছিল শ্রীময়ী।” খুকুর জন্মের পরেই তার গায়ের কালো রঙ নিয়ে আত্মীয়বর্গের অনেকের মধ্যেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল। একে মেয়ে, তারপর রঙ কালো। তার ছোটবেলায় তাই একটা ঠাট্টা চালু ছিল – ‘ কে বেশি ফর্সা কাক, না কোকিল, না খুকু ?’ অন্যকে খ্যাপাতে বা tease করতে রবীন্দ্রনাথ কম যেতেন না, দিনেন্দ্রনাথ তো শোনা যায় এ ব্যাপারে একেবারে সিদ্ধ ছিলেন। এটা তাদের বংশগত বলে অনেকে বলেছেন। একবার খুকু রবীন্দ্রনাথের কোল ঘেঁসে বসে আছে। হঠাৎই রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন – “তোকে আমার পাশে দেখে এরা সবাই কি বলবেন ?” খুকু হেসে খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল –“ কি আর বলবে ? বলবে চাঁদের কলঙ্ক।” অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। নিজের সম্বন্ধে এ ধরণের কথাবার্তা তখন হয়ত তার গা-সওয়া হয়ে গেছে।
তবে এ সবই রবীন্দ্রনাথের বাহ্যিক রূপ। তিনি প্রকৃতপক্ষে খুকুকে শুধু স্নেহের চোখে দেখতেন তা নয়, তিনি হয় তো দিনেন্দ্রনাথের পরে ভবিষ্যতে তাকেই তার নিজের গানের ভান্ডারী, ধারক এবং বাহক হিসাবে মনে মনে স্থির করে রেখেছিলেন। গায়িকা হিসাবে খুকুর স্বীকৃতি ধরা রয়েছে খুকু সম্বন্ধে কবিগুরুর কয়েকটি কথায়। আশ্রমকন্যা অমিতা সেনের একটি লেখায় সেটি সুন্দর ভাবে ধরা রয়েছে –
রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা নিয়ে এক সময়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সহ সেকালের অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও লেখক কবিগুরুর অনেক কবিতা সম্বন্ধে অস্পষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। কবি কি বলতে চেয়েছেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় না বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এসব কবির অজানা ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে একদিনের ঘটনা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। কবি একদিন শান্তিনিকেতনে তার বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের ডেকে পাঠালেন। সবাই উদয়নের দোতলায় এসে হাজির। কবি তখন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে সেখানে বসে রয়েছেন। বাকিটা পড়া যাক আশ্রমকন্যা অমিতা সেনের লেখা থেকে –
শান্তিনিকেতনের শান্তিময় পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক গান লিখে চলেছেন, নব নব সুর সৃষ্টির মাধ্যমে তার গানে তিনি প্রাণসঞ্চার করছেন। কত সুর যে ভিড় করে আছে তাঁর মনে। মুশকিল একটাই, সুর বেশিক্ষণ কবি মাথায় ধরে রাখতে পারেন না, হয় তো অন্য কোন গানের সৃষ্ট সুর প্রথমটিকে সরিয়ে দেয়। তাই সুর মনে এলেই গানটি কারো গলায় তুলে নিতে হত অথবা স্বরলিপি তৈরি করে তাকে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে হত। কোন গানের সুর শুনে অনায়াস দক্ষতায় সেটিকে গলায় তুলে নিতে খুকুর সমকক্ষ কেউ ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই ঘন ঘন তার ডাক পড়েছে। হয়তো ফাল্গুন মাসের প্রচন্ড রোদ মাথায় করে সবে তিনি উত্তরায়ণ থেকে শ্রীভবনে ফিরে এসেছেন, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন তার। ঠিক সেই সময়েই গুরুদেব আবার তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন উত্তরায়ণে। এইমাত্র একটা গানে সুর দিয়েছেন, এখনই সেটা খুকুর গলায় তুলে নিতে হবে, নয় তো সেটা মনেই বিলীন হয়ে যাবে। ক্লান্তিহীন খুকু আবার চলে উত্তরায়ণে।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ রমা চক্রবর্তীর লেখা থেকে আমরা সেদিনের অনেক কথা জানতে পারি। বিয়ের পর তিনি (রমা) শান্তিনিকেতন ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থলে চলে গেছেন। সেবার খুকুর আন্তরিক আহ্বানে একমাসের জন্য শান্তিনিকেতনে এসে শ্রীভবনে খুকুর ঘরে এসেই উঠেছেন রমা। একদিনের অভিজ্ঞতার কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন –
১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। খোলা গলায় উদাত্ত সুরে গাইতে পারার জন্য এবং ছেলেদের মত গলায় একটা জোয়ারি থাকায় খুকুই নির্বাচিত হয়েছিলেন বাল্মীকির ভূমিকায়। বিধুশেখর শাস্ত্রী তখন শান্তিনিকেতনে। বাল্মীকির ভূমিকায় খুকুর গলায় গান শুনে তিনি মোহিত হয়ে খুকুকে ডাকতেন ‘বাল্মীকি কোকিলম’ নামে।
রবীন্দ্রনাথ তার স্নেহের খুকুর অটোগ্রাফ খাতায় একবার লিখেছিলেন –
গান খুকুর অত্যন্ত প্রিয় হলেও লেখাপড়াতেও ছিল তার সমান আগ্রহ। ১৯৩০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন হল থেকে ৫ই জুন লিখেছেন
উল্লেখ করা যেতে পারে, খুকু নন্দলাল বসুর কাছে চিত্রাঙ্কন শিক্ষাও করেছিলেন কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেদিকে বেশি মন দিতে পারেন নি। তিনি আরবি, উর্দু, পালি এবং জার্মান ভাষাও রপ্ত করেছিলেন।
শান্তিনিকেতন থেকেই ১৯৩২ সালে ব্যক্তিগত পরীক্ষার্থিনী হিসাবে তিনি আই. এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হ’ন। সংস্কৃতে তার নম্বর ছিল ৮০%। বাংলাতে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে লাভ করেন নগেন্দ্র স্বর্ণপদক। সে বছরের শেষেই তিনি বি. এ. পড়তে কলকাতায় চলে আসেন এবং সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হ’ন। সংস্কৃতে তিনি ছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শান্তমণি রৌপ্যপদক লাভ করেন। বেস্ট লেডি গ্রাজুয়েট হয়ে লাভ করেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। খুকু শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে এলে কিছুদিন পরেই, ২১শে ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছেন –
এর কিছুদিন পরে খুকু কোন কারণে হয়ত শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। সেখান বসেই ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারী কবিগুরুকে একখানি চিঠি লেখেন। দীর্ঘ সেই চিঠি। বয়স তখন তার উনিশ, কিন্তু চিঠিটি পড়ে মনে হয় যেন একজন পরিণত বয়স্ক দার্শনিক তার গভীর উপলব্ধির কথা রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন। সব কথা মুখোমুখি বসে হয়ত বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে খুকু একটা দীর্ঘ পত্রে মনের মধ্যে জমে থাকা অনেক না-বলা কথা লিখে হাল্কা হতে চেয়েছেন। সে চিঠি সবটা উদ্ধৃত করা সম্ভব না। কিছু কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি -
রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, শান্তিনিকেতনের প্রতি তার নাড়ীর টান, আশ্রমদুহিতা হিসাবে তার সস্নেহ দাবী সবই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হয়ে বিধৃত রয়েছে এই চিঠির প্রতি ছত্রে।
খুকু শান্তিনিকেতন থেকে বি. এ. পড়তে কলকাতায় চলে এসেছেন ১৯৩২ সালের শেষের দিকে। এর কিছু পড়ে শান্তিনিকেতনে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ১৯৩৪-এর গোড়ার দিকেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে গেছেন। এ ব্যাপারে দিনেন্দ্রনাথের বক্তব্য জানা যায় নি। এ নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি কিছু বলে থাকলেও কোথাও লিপিবদ্ধ হয় নি। রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু মন্তব্য থেকে ব্যাপারটা অনুমান করা যায় মাত্র। এ বিষয়ে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক নিত্যপ্রিয় ঘোষ তার ‘কালনাগিনীর ফোঁস’ নামক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে কিছুটা তথ্য নেওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ অভিযোগ করেছেন - টাকা দিয়েও দিনেন্দ্রনাথকে দিয়ে স্বরলিপি করানো যাচ্ছে না। অথচ দিনেন্দ্রনাথ তার গান শেখানো বা বিশ্বভারতীর অন্যান্য কাজের জন্য অথবা সঙ্গীতভবন বা কলাভবন থেকে কোন পারিশ্রমিক নিতেন না। তা হলে কোন অর্থের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ? জমিদারি থেকে প্রাপ্য অংশ নিয়ে দিনেন্দ্রনাথের মনে ক্ষোভ ছিল বলে জানা যায়। স্বরলিপি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তার গানের যোগ্য কান্ডারী দিনেন্দ্রনাথের উপর সব সময়ে সুবিচার করেননি। ১৯২৬-এ দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অভিযোগ করার পরেও ‘গীতমালিকা-১’ (১৯২৬), ‘গীতমালিকা-২’ (১৯২৯)-এর অধিকাংশ এবং ‘তপতী’-র (১৯৩১) সব স্বরলিপি দিনেন্দ্রনাথই তৈরি করেছেন ; তবু তার নাম কোথাও থাকল না। হয় ত সব স্বরলিপি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি। রমা চক্রবর্তীর একটি ঘটনার উল্লেখ এ বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, একবার খুকু এবং অন্য সবাই উত্তরায়ণে গান শিখতে গিয়েছেন। দিনেন্দ্রনাথ তখনও সেখানে এসে পৌঁছোননি। রবীন্দ্রনাথই গান গেয়ে তাদের শেখাচ্ছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গাইয়েরা সব চুপ করে গেল। কি ব্যাপার ? সাহসী মেয়ে খুকু। সে বলল, দিনেন্দ্রনাথ তাদের অন্য সুর শিখিয়েছিলেন। নিত্যপ্রিয়র লেখা থেকে জানা যায়-
গভীর অভিমান নিয়ে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছেন তিনি। অথচ ১৯১৬ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটক দিনেন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটেছে হয়ত।
১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে দিনেন্দ্রনাথ পরলোক গমন করেন। ১৯৩৫-এর ২৬শে জুলাই রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছেন –
[ প্রসঙ্গতঃ অমিতা সেন খুকুর লেখা ‘দিনেন্দ্রনাথ’ নামক একটি লেখা ‘অবসরে’ ‘নির্বাচিত কিছু পুরানো রচনা’ নামাঙ্কিত ধারাবাহিকে প্রকাশিত হয়েছে।]
এই চিঠি পড়ে কখনই মনে হয় না দিনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোন বিরূপ মনোভাব পোষণ করে রেখেছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের করা স্বরলিপি নিয়ে যে সব কথা শোনা যায় তার কোন প্রতিফলনই এই চিঠিতে পড়ে নি। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য অজানাই রয়ে গেছে।
দিনেন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে এলে তার অতি প্রিয় খুকু জোড়াসাঁকোতে এসে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন কি না সে তথ্য কোথাও নেই। সম্ভবত দেখা হয়নি কারণ, এর পরে খুকুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেক চিঠিপত্র আদান প্রদান হয়েছে, তাতে দিনেন্দ্রনাথের ঘটনার কোন ছাপ পড়ে নি। দিনেন্দ্রনাথের কলকাতা চলে যাওয়া সম্বন্ধে খুকু যদি বিতর্কিত কিছু জেনেই থাকে, তবে সেটা পরে শান্তিনিকেতনে এসে।
হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে খুকুর গানের প্রথম রেকর্ডটি বেরিয়েছিল ১৯৩৫ সালের মে মাসে। রেকর্ডের গায় লেখা ছিল :
বি. এ. পাশ করে কলকাতায় এসে খুকু বীণাপাণি পর্দা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তখন এটি মেয়েদের বেশ নাম করা স্কুলই ছিল। কিছুদিন বেথুন স্কুলেও পড়িয়েছেন তিনি। শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি ১৯৩৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
খুকু কলকাতায় চলে এলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। কোন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেও খুকুর সঙ্গে হয় ত দেখা হয়েছে।
১৯৩৫ সালের ১১ই ও ১২ই ডিসেম্বর কলকাতায় ‘নিউ এম্পায়ারে’ ‘রাজা’ ও ‘অরূপরতন’ মিলিয়ে একটা নাটক অভিনয় হয়েছিল। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ খুকুকে অনেকগুলি চিঠি লিখেছেন। খুকুর যে মঞ্চে অভিনয় করতে যথেষ্ট অনীহা ছিল রবীন্দ্রনাথ সেটা জানতেন। তাই ২৭শে নভেম্বর চিঠি লিখে জানিয়েছেন, -“খুকু, গোটা তিনেক নতুন গান হয়েছে বাকি সব পুরোনো। তোকে কিছু সাজতে হবে না, কিন্তু গাইতে হবে। আশ্রমে আজকাল সুকন্ঠের একান্ত অভাব।” এর পর ১৯৩৫-এর ২রা ডিসেম্বরের চিঠিতে ২১ টা গানের একটা তালিকা পাঠিয়ে লিখেছেন –
নিজের লেখা গান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে সব সময়েই একটা অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার ভাব উদয় হয়েছে। কার ভরসায় রেখে যাবেন তার গানের বিপুল সম্ভার? অনেক চিঠিপত্রে এর উল্লেখ আছে। গানে খুকুর প্রতিভা পারদর্শিতা লক্ষ্য করে বহুদিন থেকে তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন খুকু যাতে আশ্রমে এসে এ কাজের ভার নেয়। খুকু উচ্চশিক্ষিত হয়ে শান্তিনিকেতনের বাইরে চাকরী করবে এটা রবীন্দ্রনাথ কোন ভাবেই চান নি। খুকুর উপর তিনি যে স্নেহ এবং স্বীকৃতি অকাতরে বর্ষণ করেছেন, তার মেধা ও প্রতিভাকে সম্মান জানিয়েছেন, তাতে খুকু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শান্তিনিকেতনে যোগদান করে তার ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে আসবে এমন চিন্তা অস্বাভাবিক নয়। ১৯৩৭ সালের ৬ই জানুয়ারী (তখনো সম্ভবত খুকু এম.এ. পরীক্ষা দেন নি) উত্তরায়ণ থেকে খুকুকে লেখা একটি চিঠি –
১৯৩৮-এর ১০ই ফেব্রুয়ারী “ C/O Sri Haripada Roy / 89 Raja Dinendra Street / Calcutta” ঠিকানায় খুকুকে লেখা আর একখানি চিঠি –
খুকুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রতিলিপি |
কিশোরীর চিঠি থেকে জেনেছিস এই কর্মের জন্য মাসিক পঁচাত্তর টাকা তোর বৃত্তি আমরা স্থির করেছি।
রবীন্দ্রনাথ উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করলেও খুকু ১৯৩৮ সালের ২৮শে এপ্রিল বিনীত ভাবে ক্ষমা চেয়ে তাকে জানালেন একটি ব্যক্তিগত কারণে তার হাত-পা বাঁধা, কাজেই সঙ্গীত ভবনের কাজে সে যোগদান করতে অপারগ। রবীন্দ্রনাথ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই তবু তিনি উদার চিত্তে এটা মেনে নিলেন। মে মাসের প্রথম দিকে একটা চিঠিতে তিনি খুকুকে লিখলেন –
যে কোনো কারণেই হোক খুকু মত পরিবর্তন করে ১৯৩৮-এর জুন (?) মাসে সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপিকার পদে যোগদান করেন। অনুমান করা যায় এই সময় হয় ত দিনেন্দ্রনাথের আশ্রম ত্যাগ সহ শান্তিনিকেতনের আরও অনেক অস্বস্তিকর বিষয় তার কানে এসেছে। এছাড়া তার একটা ব্যক্তিগত সমস্যাও ছিল, সে কথায় পরে আসছি।
প্রায় বছর খানেক খুকু শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এর পরে ১৯৩৯-এর ২০শে জুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ রমা চক্রবর্তীকে একটি চিঠি দিয়ে জানান যে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে রমা চক্রবর্তী লিখেছেন –
খুকু তার একটা ব্যক্তিগত বিষয়ে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। কী সেটা? এটা জানতে হলে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। এম. এ. পড়ার সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শম্ভুনাথ গাঙ্গুলী নামে এক মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে খুকুর বন্ধুত্ব হয়। সব মেয়ের মতই খুকুর মনের গহনে বিয়ে করে সংসার করার বাসনা হয় ত ছিল। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই সুপ্ত ইচ্ছার অস্পষ্ট একটা আভাস মেলে ১৯৩৩-এর ৭ই জুলাই বি. এ. পড়াকালীন বন্ধু রমাকে তার লেখা এক চিঠিতে –
হয়তো শম্ভুনাথ খুকুকে ভালবাসা জানিয়েছিল, খুকুর নির্মল তৃষিত হৃদয় আন্তরিক ভাবেই সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। খুকু এক বছর শান্তিনিকেতনে থেকে হঠাৎ চলে এসেছিলেন কেন তার সম্পূর্ণ কারণ গবেষকরা অনুমান করেছেন, কিন্তু অস্পষ্টতা থেকে গিয়েছে। দুটি কারণ অনুমান করা গিয়েছে। প্রথমটি হ’ল, ‘রিহার্সালের অশুচিকর ও দুঃখকর আবেষ্টন’। মঞ্চে অভিনয় করতে খুকু যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এটা রবীন্দ্রনাথের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল ; যে কারণে একবার তিনি খুকুকে লিখেছিলেন –“ তোকে কিছু সাজতে হবে না, কিন্তু গাইতে হবে। আশ্রমে আজকাল সুকন্ঠের একান্ত অভাব।” ভাল না লাগা এক জিনিস কিন্তু ‘অশুচিকর’, ‘দুঃখকর’ এই কঠিন শব্দগুলি ব্যবহার করার পিছনে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল সেটা বোঝা শক্ত। তবে এ বিষয়ে আশ্রম নিবাসী দীর্ঘায়ু উমা দত্তর স্মৃতিচারণ প্রণিধানযোগ্য –
মঞ্চে রিহের্সাল ও অভিনয়ের সময় সকলের সঙ্গে যে স্বাভাবিক সৌহার্দ্যপূর্ণ মেলামেশা হত সেটাই কি খুকুর চোখে ‘অশুচিকর’ বা ‘নৃত্যকলার মলিন প্রভাব’ মনে হয়েছিল ? তা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছিলেন যে এ বিষয়টা তিনি অধ্যক্ষদের জানাবেন।
খুকুর আশ্রম ছেড়ে যাবার দ্বিতীয় কারণটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছিলেন যে শুধু সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপিকা নয়, তার ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বও তাকে গ্রহণ করতে হবে। এর উত্তরে খুকু জানিয়েছিলেন যে তিনি রাজি, তবে তার সেই ছেলে বন্ধু শম্ভুনাথকেও একটা চাকরি দিতে হবে। আশ্রমে তখন কোন শূণ্য পদ ছিল না, তবু রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন বিষয়টা তিনি কর্ত্তৃপক্ষের নজরে এনেছেন। হয়তো চাকরিটা হয়েও যেত কিন্তু খুকু মনে করেছিলেন গুরুদেব তো ইচ্ছা করলেই তার বন্ধুটিকে চাকরিতে নিয়োগ করতে পারেন, তার জন্য আবার কর্ত্তৃপক্ষকে টানা কেন। রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য - তিনি একক ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ২৫শে মে ১৯৩৯-এ খুকুকে লিখেছেন,
খুকু তার চিঠিতে দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও কোনো প্রশ্ন হয়ত তুলে থাকবেন। এতে রবীন্দ্রনাথ নিরতিশয় ক্রুদ্ধ। তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘তোমার নিজের সাফাইয়ের প্রসঙ্গে তুমি দিনুর নাম টেনে এনেছ। এটা সম্পূর্ণ অসত্য ও তোমার অধিকার বহির্ভূত।’ তার বিরাগ তিনি চেপে রাখেন নি। ১৯৩৯-এর ২৪শে জুন কিশোরীমোহন সাঁতরাকে চিঠি লিখে বলেছেন, -
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে খুকুর লেখা একটি দীর্ঘ চিঠির প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। নানা কথায় অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে খুকু পরিশেষে লিখেছিলেন, “আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে আশ্রম সম্বন্ধে আমার ধারণা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার আমার আছে।” কিছুটা সেই অধিকারের দাবীতেই হয় তো খুকু তার প্রেমিকের চাকরির জন্য কবিগুরুর কাছে দরবার করেছিলেন। খুকু ছিলেন স্বাধীনচেতা প্রকৃতির, রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও আচ্ছন্ন হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেন নি। এই নির্ভীক চরিত্রের জন্যই আশ্রমের অন্য সবাই যখন চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে, তখন দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে খুকু দ্বিধা বোধ করেন নি।
এদিকে খুকুর বন্ধু শম্ভুনাথ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তখন রোগটি দুরারোগ্য ছিল। একটা ঘর ভাড়া করে শম্ভুনাথকে সেখানে রেখে তার চিকিৎসা ও সেবার সম্পূর্ণ ভার খুকু তার নিজের হাতে তুলে নেন। খুকুর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। চিকিৎসার খরচ মেটাতে তার নিজের পুরস্কার প্রাপ্ত মেডেল বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করতে হয়েছে। একদিন বিকেলে তাকে দেখতে গিয়ে খুকু দেখে তার ঘরটি তালা বন্ধ। বাড়িওয়ালা তাকে জানায়, এক প্রফেসরের মেয়ে এসে তাকে নিয়ে চলে গেছে পাহাড়ে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য। খুকু যেন ভাড়া মিটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে ঘর খালি করে দেয়। অকৃতজ্ঞ ছেলেটির এই বিশ্বাসঘাতকতায় খুকুর মন ভেঙে পড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। যতদূর জানা যায় খুকুর রক্ষণশীল ব্রাহ্ম পরিবার খুকুর সঙ্গে ছেলেটির বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি করেছিল। যাই হোক না কেন, শম্ভুনাথ যক্ষারোগাক্রান্ত হ’লে যে মেয়েটি সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণপাত করে তার সেবা করেছে, অর্থের অভাবে নিজের পুরস্কার পাওয়া মেডেল বিক্রি করে দিয়েছে, যার চাকরির জন্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়েছে তাকে কিছু না জানিয়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে এভাবে চলে যাওয়া ছেলেটির অবশ্যই চরম স্বার্থপরতা ও হৃদয়হীনতার পরিচায়ক।
কিন্তু শান্তিনিকেতনের সেদিনের সেই ছোট্ট কালো মেয়েটির উপর ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন না। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল খুকু। তার ভাই দেবপ্রসাদ (দেবু) তখন কারমাইকেল (বর্তমান আর. জি. কর) কলেজে ডাক্তারি পড়ছে। সেখানেই তাকে ভর্তি করা হ’ল। ডাক্তার বললেন, ‘টি-বি’ হয়েছে। সেই মত চিকিৎসা চলল। খুকু ইচ্ছা প্রকাশ করল, তার সেই প্রেমিক শম্ভুনাথকে একবার সে দেখতে চায়। যে তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গিয়েছিল, তার প্রতি তখনো খুকুর ভালবাসা অটুট। ঠিক হ’ল দশ মিনিটের জন্য ছেলেটি আসবে কিন্তু কোন কথা বলা চলবে না। ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী আশ্রমিক উমা দত্ত তার সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, -
এদিকে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন রাগ পোষণ করে রাখেন নি। যখনই শুনেছেন তার সেদিনের স্নেহের খুকু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার আরোগ্য কামনা করে চিঠি দিয়েছেন। ১৯৪০-এর জানুয়ারী মাসের ২৭ তারিখে Carmichael Medical College, Female Medical Paying Ward, Bed No 87- ঠিকানায় প্রেরিত চিঠি –
আবার পরদিনই ২৮ তারিখে লিখেছেন –
বুলা মহলানবীশকে ডেকে বললেন, খুকুর যে রেকর্ডগুলো এতদিন প্রকাশের অনুমতি পায়নি সেগুলি বাজারে ছেড়ে দিতে এবং হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিকেও নির্দেশ দিলেন যথাযথ রয়্যাল্টি দেবার জন্য। এমন কি খুকু খেতে ভালবাসত বলে তার প্রিয় হান্টলি পামারের বিস্কুট প্রতি রবিবার শৈলজারঞ্জনকে দিয়ে হাসপাতালে তার কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। অবশ্য আর. জি. কর হাসপাতালে রবীন্দ্রনাথ খুকুকে দেখতেও গিয়েছিলেন এরকম একটি তথ্য একমাত্র সুনন্দিতা সেনগুপ্তর (খুকুর পরের বোন ললিতা দাসের কন্যা) একটি লেখাতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও এটি উল্লেখিত হয় নি।
রোগ প্রশমিত হবার কোন লক্ষণ না দেখায় খুকুকে পাটনায় তার মেজোমাসিমার কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। সেখানে ড: শরদিন্দু ঘোষাল টি. বি. রোগের চিকিৎসা শুরু করেন। পরে নিজেই বুঝতে পারেন রোগ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে, এটি আসলে নেফ্রাইটিস। এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা তখন ছিল না। তিন বছর বয়সে খুকুর একবার এই রোগ হয়ে হাত-পা ফুলে গিয়েছিল, বাইশ বছর পরে আবার সেই রোগ ফিরে এসেছে। খুকু যখন জানলো এ রোগ ভালো হবার নয়, তখন যেখানে সে জন্মেছে সেই ঢাকাতেই সে ফিরে যেতে চাইল, সেখানেই সে মরতে চায়। ঢাকাতে খুকুর জেঠিমা, জেঠামশাই, কাকা-কাকিমা সবাই তাকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করল। শুরু হয় কবিরাজি চিকিৎসা। এরপর অনসূয়া সেনের লেখা থেকে –
২৭শে মে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি ঢাকায় এসে পৌঁছোয়। অবিনাশচন্দ্র সেনকে লেখা সেই চিঠিটি –
খুকুর মৃত্যুর পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৪৭ আষাঢ় সংখ্যায় (এই লেখার সঙ্গে প্রতিলিপিটি সংযোজিত হয়েছে) এবং Visva-Bharati News-এ শোক সংবাদটি প্রকাশিত হয়। Visva-Bharati News-এ লেখা হয়েছে “ ......... By her death Bengal has lost one of her most talented daughters. She has ceased to be, her voice has for ever merged into the profound calm of death, but her memory will linger long in our minds and long shall we mourn the abrupt end of a youthful life so rich in possibilities. ……”
খুকুর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি। তবে সুনন্দা দাশগুপ্ত ‘মহিলা মহল’ পত্রিকার লেখা উধৃত করে জানিয়েছেন,
খুকুর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪০-এর ২৪শে মে। এর এক বছর আড়াই মাস পরে রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। শরীর মোটেই সুস্থ নয় কবির। এই অবস্থাতেই প্রতিমাদেবীর চাপেতে, ”মুখে মুখে গল্প বলতে বলতে, ‘লগি ঠেলে-ঠেলে চলা যাকে বলে’ ” একটা গল্প লিখেছিলেন, নাম ‘প্রগতিসংহার’। আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল এটি। ‘নীহার’ এবং ‘সুরীতি’ গল্পটির দু’টি চরিত্র। এটা নিশ্চিত ভাবেই খুকু এবং তার প্রেমিক শম্ভুনাথকে নিয়ে লেখা। গল্পটিতে প্রেমের কাহিনী স্থান পেলেও খুকুর সঙ্গীত প্রতিভার কোন উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে ইলিনা সেন লিখেছেন –
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটা ছোট্ট কালো মেয়ে শান্তিনিকেতনে এসে যে তার খুকুর মতই সারল্যে সকলের আপন হয়ে উঠেছিল, যা্র খোলা গলার গান আশ্রমের গন্ডী পেরিয়ে খোয়াই-এর উপর ভেসে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যেত, স্বয়ং গুরুদেব যাকে ভবিষ্যতে তার গানের ভান্ডারী নির্বাচিত করেছিলেন, স্বল্পায়ু জীবনের প্রান্তে এসে ব্যর্থ প্রেমের আঘাত যাকে অসহায় ভাবে সহ্য করতে হয়েছিল, প্রায় বিস্মৃতিতে চলে যাওয়া সেই অমিতা সেন খুকুর ছাব্বিশ বছর জীবনের কিছু কথা এখানে তুলে ধরা হল। এটা সম্ভব হয়েছে ইলিনা সেনের জন্য।
খুকুর মৃত্যুতে ‘প্রবাসী’র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
ছোট বেলা থেকেই শান্তিনিকেতনে বহু লোকের স্নেহের সান্নিধ্যে এসে বেড়ে ওঠা এই আশ্রম দুহিতার কথা কেন সে ভাবে লিপিবদ্ধ হল না বা প্রচার লাভ করল না সেটা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মূল কারণ হয়তো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠা। শান্তিনিকেতনের কিছু অন্তর্দ্বন্দ, অব্যবস্থা ও অবিচার স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক প্রকৃতির খুকুকে বিচলিত করেছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিকে কেন্দ্র করে দিনেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়া খুকু মেনে নিতে পারে নি। এ সম্বন্ধে কিছু প্রশ্নও হয়ত তিনি তুলেছিলেন। তার লেখা সব চিঠি পাওয়া যায় নি। এ ছাড়া খুকুর সঙ্গে তার এক সহপাঠীর অনুরক্তি ও তাদের ব্যর্থ প্রেমের অধ্যায়টিকেও তার পরিবারের অনেকে প্রকাশ্যে আনতে চান নি। এই গড়ে ওঠা সম্পর্কের টানেই খুকু গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে ফিরে আসার সস্নেহ আহ্বান উপেক্ষা করেছেন ; রবীন্দ্রনাথ এটা ভাল ভাবে নেন নি। একান্ত ভাবে রবীন্দ্রভক্ত পরিবারটি তাই স্বেচ্ছাকৃত ভাবেই হয়তো বিষয়টি সম্বন্ধে মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন।
সম্প্রতি খুকুর আত্মীয়বর্গ ও বন্ধুদের বেশ কিছু লেখা সংগ্রহ ও একত্রিত করেছেন ইলিনা সেন। খুকুর লেখা অনেক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ এবং বেশ কিছু চিঠিপত্রও রয়েছে এই সংগ্রহে। একই পরিবারভুক্ত হওয়ায় তিনি হয়তো কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন তবু নিঃসন্দেহে তাকে ধৈর্য সহকারে বহু শ্রম স্বীকার করতে হয়েছে। এটা যদি তিনি না করতেন তাহলে এই স্বল্পায়ু মেধাবী সংগীত প্রতিভার ছোট্ট জীবন কথা এবং শান্তিনিকেতনে তার ফেলে আসা দিনের নানা কাহিনী এক সময়ে বিস্মৃতির অতল গর্ভে বিলীন হয়ে যেত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ইলিনা সেন কেন হঠাৎ উদ্যোগী হয়ে এ কাজটা করতে গেলেন। এ সম্বন্ধে তিনি নিজেই লিখেছেন –
গভীর নিষ্ঠা সহকারে প্রকাশনার কাজটি করার জন্য ইলিনা সেনের তাই অসংখ্য সাধুবাদ প্রাপ্য।]
ঋণ স্বীকার –
‘অমিতা’ – ইলিনা সেন ;
‘যাত্রাপথে আনন্দগান’ – শৈলজারঞ্জন মজুমদার ;
‘বুলবুলি’ – পার্থ বসু ;
‘পথে চলে যেতে যেতে’ – রমা চক্রবর্তী ;
‘শান্তিনিকেতনে আশ্রমকন্যা’ – অমিতা সেন।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.