অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


সংগীত

অক্টোবর ১, ২০১৭

 

শান্তিনিকেতনের ‘বাল্মীকি কোকিলম’

দীপক সেনগুপ্ত

দিনটা ছিল ১৯শে মে ১৯১৪। ঢাকার রমনায় (এখন বাংলাদেশে) ঈশানচন্দ সেনের ব্রাহ্ম পরিবারে যখন একটি নবজাতিকা ভূমিষ্ঠ হ’ল তখন বাবা, কাকা, জেঠিমা, ঠাকুমা ও একান্নবর্তী পরিবারের সবার মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সেদিন শাঁখ ও উলুধ্বনির মধ্যে যাকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল পরবর্তী কালে তার বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ হয়েছিল আশ্চর্য রকম। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে চীৎকার করে জহরলাল পান্নালাল পড়তে শুনে ও বাইরে টানানো ব্যানারে লেখা দেখে বই নিয়ে বসে নিজেই সে পড়ল জহরলালঅ পান্নালালঅ। অবাক হয়ে গেল সবাই। কে শেখালো তাকে পড়তে ? মেয়েটির নাম রাখা হ’ল অমিতা, আদরের ডাক নাম খুকু।

অমিতা সেন (খুকু)

ঠাকুরদা ঈশানচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করায় তখনকার দিনে অনেকের মতই তাকে সমাজে একঘরে করে রাখা হয়েছিল। খুকুর মা সুহাসিনী ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তুলনায় বাবা ক্ষিতিশচন্দ্র ছিলেন শুধুমাত্র ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক, আয় ছিল খুবই সামান্য। অর্থোপার্জনের জন্য তাকে চাকরির সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়েছে, অনেকবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে। সমাজসেবী অবলা বসুর পরামর্শে পিসিমা হেমবালা সেন শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং শ্রীসদনে ছাত্রীনিবাসের অধ্যক্ষা হিসাবে কাজে যোগদান করেন। পড়াশোনার সুবিধার জন্য সঙ্গে নিয়ে গেলেন খুকুকে ও তার পরের বোন ললিতা দাস বা তাতুকে।

ছো্টবেলা থেকেই মায়ের কাছে গান শিখত খুকু। মা তাকে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে উৎসাহিত করতেন। এভাবে গান শ্বাস প্রশ্বাসের মতই খুকুর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে যে সঙ্গীত ভবন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খুকু ও তাতু সেখানেই ভর্তি হ’ল।

খুকুর বয়স যখন মাত্র ছ’বছর তখন গান্ধীজিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিল সে, পরে কবিতাটিতে সুর সংযোগ ক’রে পাটনায় বাঁকিপুর সেমিনারির ময়দানে পরিবেশন করেছিল। ঐ বয়সের একটা মেয়ের পক্ষে কবিতা রচনা করা এবং সুর দিয়ে সেটা জনসমক্ষে পরিবেশন করা কি করে সম্ভব সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই ঘটনা ভবিষ্যতে তার সৃষ্টিক্ষম প্রতিভা বিকাশের ইঙ্গিত দিয়েছিল। গান্ধীজিকে নিয়ে কবিতাটি ছিল –

“ ধীর, স্থির, দেশহিতব্রতী, স্বাধীনচেতা
ওহে গান্ধী বীর। তব বীরত্বের তুলনা নাই,
তুমি স্বদেশের তরে গেলে কারাগারে
ওহে গান্ধী বীর।
দেশহিত তরে প্রাণ দিতে পার
দেশহিত তরে এসেছ
দেশহিতব্রত সমাপ্ত করে চলে যাবে
ওহে গান্ধী বীর।”

পিসিমা হেমবালা সেন খুকুকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যান এবং গান্ধীজিকে নিয়ে লেখা গানটি কবিগুরুকে শোনাতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য হয়ে যান মেয়েটির প্রতিভায়। তিনি খুকুকে তার গানের জগতে টেনে নেন। দিনেন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন তাকে গান শেখাতে।

শান্তিনিকেতনে তিন কন্যা। মাঝে অমিতা সেন (খুকু), তার ডান পাশে বোন ললিতা সেন (তাতু) ও বা-পাশে আশ্রমকন্যা অমিতা সেন (অমর্ত্য সেনের মা)

খুকু শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ন’বছর বয়সে। শান্তিনিকেতনে তখন তিন জন অমিতা। বড় অমিতা ছিলেন অধ্যাপক অজিত চক্রবর্তীর কন্যা, পরে যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র অজিন ঠাকুরকে বিয়ে করে অমিতা ঠাকুর হন। দ্বিতীয় অমিতা কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের কনিষ্ঠা কন্যা। আগাগোড়া শান্তিনিকেতনেই মানুষ হয়েছেন তিনি এবং নিজে ‘আশ্রমকন্যা’ নামে পরিচিত হতেই ভালবাসেন। পরে ইনি বিজ্ঞানী আশুতোষ সেনকে বিয়ে করেন; তাদেরই সুযোগ্য পুত্র অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। আর তৃতীয় অমিতা সেন হলেন খুকু।

আশ্রমকন্যা অমিতা আর খুকুর বয়স ছিল প্রায় একই, একই ক্লাসের ছাত্রীও ছিল তারা। ‘শ্রেয়সী’ পত্রিকায় আশ্রমকন্যা স্মৃতি রোমন্থন করেছেন –

“আজও সেদিনের স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বালিকা বয়সে যেদিন খুকু শান্তিনিকেতনে প্রথম এল, গুরুপল্লির মাঠে আমরা বুড়ি বুড়ি খেলছিলাম। আনন্দ-উচ্ছ্বল পায়ে খুকু দৌড়ে এসে আমার হাতখানি ধরে ব’লে উঠল, ‘তোমারও নাম নাকি ভাই অমিতা সেন? আমারও নাম অমিতা সেন। আজ থেকে আমরা দু’জন দু’জনের বন্ধু হয়ে গেলাম’। ব্যাস, সেদিন থেকে আমরা বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেলাম।”

এরকমই সহজ সরল ছিল খুকু। দ্বিধা সঙ্কোচের বাইরে বেরিয়ে তার নির্মল হৃদয় দিয়ে যে কোন মানুষকেই মুহূর্তে আপন করে নিতে পারত সে।

শান্তিনিকেতনে খুকুর সহপাঠী উমা দত্ত শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ফিরে গিয়েছেন সেই সময়ের কথায় –

“ ...... খুকু আমার চেয়ে পাঁচ মাসের বড়। কিন্তু ওর ম্যাচিওরিটিটা ছিল আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ও কি অনায়াসে সকলের সঙ্গে মিশতে পারত, আর খুকু নামটা তো সার্থক। খুকুর মতই সহজ ও সরল ছিল। একদম খিলখিল করে হাসত। খুকু গান গাইত বলে বড়দের সঙ্গে ওর যোগাযোগ – ওর ভাব। বড়, ছোট, বা ছেলেমেয়ে – এরকম ভাগাভাগির কোন সঙ্কোচ ওর মধ্যে ছিল না। বিদ্যাভবনের পিনাকীনদা (পিনাকীন ত্রিবেদী, মারাঠি ছাত্র) হয়তো শ্রীভবনের (মেয়েদের হস্টেল) সামনে দিয়ে যাচ্ছে, খুকু ঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও পিনাকীনদা কোথায় চললে ?’ ওর পিসিমা হেমবালাই তো ছিলেন হস্টেল সুপার। ব্রাহ্ম। বেশ কড়া। এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু থামাতেও পারেন নি। খুকু ওই সরল স্বভাবের বলেই হয়তো ওরকম গলা ছেড়ে গান গাইতে পারত। অনায়াসে খোলা গলায় গান গেয়ে ওঠাও অনেকের পছন্দ ছিল না।”

হস্টেলে কয়েকজনের ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে হঠাৎ সে গেয়ে উঠল –‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে।’ বিরক্ত হয়ে অনেকে বলে উঠলো –“দেখ দেখ খুকু আবার গান ধরেছে।”

খুকুর পরের বোন ললিতা দাস (তাতু), তার প্রিয় দিদির সম্বন্ধে যা লিখে গেছেন তা থেকেই খুকুর চরিত্রের অন্যান্য দিক গুলি সুন্দর ফুটে ওঠে। তার লেখা থেকে উধৃত করা যাক –

“ দিদির এই ছ’বছরের জীবনেই আমরা তার সর্বতোমুখী প্রতিভার কত পরিচয় পেয়েছি। চিত্রাঙ্কন, সেলাই, ডিজাইন আঁকা, বীণা বাজানো, আলপনা দেওয়া, যখন যেটিতে হাত দিয়েছে কী অদ্ভুত মন্ত্রজালে তা কী সুনিপুণ হয়ে উঠেছে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দিদি সেগুলি কী সুন্দরভাবে আয়ত্ত করেছে দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। ......... দিদির স্বভাব বড়ই মধুর ছিল। প্রাণটি ছিল শিশুর মত সরল। এত বয়সেও শিশুদের সঙ্গে খেলা করা, শিশুদের কাছে বড় বড় উপন্যাস কী আশ্চর্য ভাবে শিশুজনোচিত করে গল্পের আকারে বলতে পারত। এ একটি বিশেষ গুণ তার দেখেছি। ওদের সঙ্গে যে কী প্রাণখোলা হাসি! তখন মনে হবে না দিদি এত বিদুষী। ছোট্ট শিশুটা মনে হত। অথচ তার স্বভাবের আর একটা দিকও খুব উজ্জ্বল ছিল। শৈশব থেকেই অত্যন্ত সপ্রতিভ, নির্ভীক ও তর্কেকি ছিল। অতি শিশুকাল থেকেই সে উচিত কথা বলতে কখনও পশ্চাৎপদ হত না। একটি ছোট গল্প আজ মনে পড়ছে – শৈশবে একবার বাবা-মাকে ছেড়ে আমরা দু’টি বোন জেটিমার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম সাত দিনের জন্য। একদিন আমি অসাবধানে একটি বোতল ভেঙে ফেলেছি, সেজোকাকা যেই সামান্য তিরষ্কারের স্বরে আমায় ডেকেছেন, ছোট্ট দিদি আমার কোথা থেকে দৌড়ে এসে ভীরু স্বভাব ছোট বোনটিকে আগলিয়ে দাঁড়িয়ে সেজোকাকাকে ধমক দিয়ে বললে –‘জান না ‘জ্যা’মাকে ছেড়ে এসেছে, তুমি কাকে বকছ?’ সেদিনের ছ’বছরের দিদিটির সেই জ্যোতির্দীপ্ত মূর্তিটি আজও আমার চোখে ভাসছে।
“ভাই বোনদের প্রতি কী অসীম স্নেহ ছিল তার। তাদের সামান্য অসুখে কী ব্যস্ততা এবং মায়ের মত সেবা করতে দেখেছি ওকে! ...... নিজের প্রতি দিদি চিরদিনই উদাসীন। কোন প্রকার শখ-শৌখিনতা কোনদিনই ছিল না তার। সে যেন চির-সন্ন্যাসিনী। কেবল অধ্যয়ন অধ্যাপনাতেই মগ্ন। জ্ঞান পিপাসা তার মিটল না এ সংসারে।”

খুকুর স্নেহ-কোমল স্বভাবের সঙ্গে তার প্রতিবাদী চরিত্রের কথাও অনেকের জানা ছিল। পরবর্তী কালে আমরা এর আরও পরিচয় পাব। বহু ক্ষেত্রে অন্যায় দেখলে সে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করত। বাইরের কলেজের ছেলেদের বাচালতা দেখলে ফোঁস করে উঠত। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্যই শান্তিনিকেতনের নিশিকান্ত রায় চৌধুরী খুকুকে নিয়ে কবিগুরুর ‘কৃষ্ণকলি’র ধাঁচে একটি প্যারোডি তৈরি করেছিলেন –

“ কালনাগিনী আমি তারে বলি কালো তারে বলে পাড়ার
লোক শুনেছিলাম বইগুদামের ঘরে
কালো মেয়ের কালো মুখের ফোঁস।” [বইগুদাম অর্থ লাইব্রেরী]।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে দিনু ঠাকুরের কাছে গান শিখতে শুরু করেছিল খুকু। খুকুর সহাধ্যায়ী রমা চক্রবর্তী লিখেছেন –

“ মেয়েদের মধ্যে, এতটা সতেজ, খোলা অথচ সুমিষ্ট দরদি কন্ঠস্বর, বিরলই বলা চলে। মনে পড়ে ওর কথা, বলেছিল, ‘জানো রমা, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গানটা আমি যখন গাই, সাঁওতালি মেঝেনদের [মেয়েদের] চোখে জল আসতে দেখেছি। অথচ দেখ, এইসব কথার মানে ওরা কতটুকুই বা বোঝে।”
“ এমনই ছিল খুকুর গানের যাদু। না হলে সত্যিই তো, মেঝেনদের এই গানের মর্ম বুঝতে পারবার কথা নয়, খুকুর মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে গান গাওয়াই, তাদের মনে মর্ম পৌঁছে দিত। তাদের চোখে জল আসত। ......
“দিনদার (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বড় প্রিয় ছিল সে। প্রকৃতপক্ষে, খুকু দিনদার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কন্যাসম শিষ্যা ছিল। খুকুর কথায়, ন’বছর বয়স থেকে সে দিনদার কোলের কাছে বসে গান গাইতে শুরু করে। দিনদা তাকে মেয়ের মতই স্নেহ-ভালবাসা ভরে দিয়েছিলেন। একদিন যদি খুকু ওঁর কাছে না যেত, উনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন। আমরা কেউ ক্লাস করতে গেলে বলতেন, ‘খুকু কেন এল না বলতে পারিস ?”

গান তো খুকুর প্রিয় ছিলই, পড়াশোনাতেও তার গভীর আগ্রহ ছিল। বিদ্যালয়ের পাঠ শান্তিনিকেতনে বসেই হয়েছিল। শান্তিনিকেতন তখন কোন স্বীকৃত পরিষদের অধীনে না থাকায় খুকু ব্যক্তিগত পরীক্ষার্থিনী হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসেন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বাংলায় তিনি শতকরা ৯৬ নম্বর পেয়ে সে বিষয়ে সবার শীর্ষে থাকেন।

খুকুকে দেখতে কেমন ছিল ? সতীর্থদের ভাষায় – “গায়ের রঙ ছিল খুকুর কালো, মুখ চোখ ছিল খোদাই করা মূর্তি যেন, বুদ্ধিদীপ্তিতে সে ছিল শ্রীময়ী।” খুকুর জন্মের পরেই তার গায়ের কালো রঙ নিয়ে আত্মীয়বর্গের অনেকের মধ্যেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল। একে মেয়ে, তারপর রঙ কালো। তার ছোটবেলায় তাই একটা ঠাট্টা চালু ছিল – ‘ কে বেশি ফর্সা কাক, না কোকিল, না খুকু ?’ অন্যকে খ্যাপাতে বা tease করতে রবীন্দ্রনাথ কম যেতেন না, দিনেন্দ্রনাথ তো শোনা যায় এ ব্যাপারে একেবারে সিদ্ধ ছিলেন। এটা তাদের বংশগত বলে অনেকে বলেছেন। একবার খুকু রবীন্দ্রনাথের কোল ঘেঁসে বসে আছে। হঠাৎই রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন – “তোকে আমার পাশে দেখে এরা সবাই কি বলবেন ?” খুকু হেসে খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল –“ কি আর বলবে ? বলবে চাঁদের কলঙ্ক।” অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। নিজের সম্বন্ধে এ ধরণের কথাবার্তা তখন হয়ত তার গা-সওয়া হয়ে গেছে।

তবে এ সবই রবীন্দ্রনাথের বাহ্যিক রূপ। তিনি প্রকৃতপক্ষে খুকুকে শুধু স্নেহের চোখে দেখতেন তা নয়, তিনি হয় তো দিনেন্দ্রনাথের পরে ভবিষ্যতে তাকেই তার নিজের গানের ভান্ডারী, ধারক এবং বাহক হিসাবে মনে মনে স্থির করে রেখেছিলেন। গায়িকা হিসাবে খুকুর স্বীকৃতি ধরা রয়েছে খুকু সম্বন্ধে কবিগুরুর কয়েকটি কথায়। আশ্রমকন্যা অমিতা সেনের একটি লেখায় সেটি সুন্দর ভাবে ধরা রয়েছে –

“ এই সময় তিনি (রবীন্দ্রনাথ) একদিন ‘আমি তোমার সঙ্গে’ গানটি শুনতে চান। খুকু গানটি তাকে গেয়ে শোনালে তিনি হেসে তাকে বললেন, ‘কী রে, গানটি শুনে তোর কি কিছু মনে পড়েছে’ ? উচ্চস্বরে হেসে উঠল খুকু। প্রাণখোলা হাসিই তো ছিল তার স্বভাব। রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, ‘ওকে উদ্দেশ্য করেই গানটি আমি বেঁধেছিলাম।’ সেখানে তখন যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা পরে অমিতাকে [খুকুকে] বলেছিলেন, ‘পরম সৌভাগ্যের এমন দামি কথাটা তুমি মনের মধ্যেই চেপে রাখলে? আমরা হলে উচ্চকন্ঠে এই কথাটা গেয়ে বেড়াতাম।’ উত্তরে অমিতা [খুকু] বলেছিল, ‘ও কথা গুরুদেব মুখে বললেও আমি কি বুঝি না এ গানের কী গভীর অর্থ ? এই গভীর অনুভূতি কী কোনো একটা ছোট আধার ধারণ করতে পারে ? ওঁর এই ভাব কোন গভীরে, কোন পরমার দিকে বয়ে যাচ্ছে, আমি তো উপলক্ষ মাত্র।’

রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা নিয়ে এক সময়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সহ সেকালের অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও লেখক কবিগুরুর অনেক কবিতা সম্বন্ধে অস্পষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। কবি কি বলতে চেয়েছেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় না বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এসব কবির অজানা ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে একদিনের ঘটনা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। কবি একদিন শান্তিনিকেতনে তার বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের ডেকে পাঠালেন। সবাই উদয়নের দোতলায় এসে হাজির। কবি তখন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে সেখানে বসে রয়েছেন। বাকিটা পড়া যাক আশ্রমকন্যা অমিতা সেনের লেখা থেকে –

“ আমাদের দেখেই হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আয়, সবাই এসে আমার কাছে বোস।’ সবাই তাকে ঘিরে বসতে তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোরা আমার সোনার তরী কবিতাটি পড়েছিস?’ আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘পড়েছি’। বললেন, ‘কবিতাটির মানে বুঝেছিস?’ আবার আমাদের সমস্বরে উত্তর, ‘হ্যাঁ, বুজেছি।’ আমাদের স্বরে দারুণ আস্থার সুরে রবীন্দ্রনাথ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘বল তো কি বুঝেছিস?’ আমাদের মধ্যে সুগায়িকা খুকু – অমিতা সেন, পড়াশোনায় ছিল সবার আগে এবং স্বভাবটি ছিল তার নির্ভীক, উচ্ছল। সে সুন্দরভাবে কবিতাটির অর্থ বলে গেল, ‘ঘোর বর্ষা, চাষি ধান কেটে নদীর কিনারে বসে আছে নৌকার আশায়। দূরে নৌকা দেখে সে নেয়েকে ডেকে বলল, ‘আমার ফসল তোমার নৌকায় নিয়ে যাও।’ নেয়ে নৌকা ভিড়িয়ে চাষির সব ফসল তুলে নিল। চাষি বলল, ‘এবার আমাকেও তোমার নৌকায় তুলে নাও, কিন্তু চাষিকে নেবার ঠাঁই নেয়ে দিতে পারল না। চাষি একা পড়ে রইল’। এতখানি খুকু উচ্ছলভাবে বলে গেল – রবীন্দ্রনাথের মুখে তৃপ্তির হাসি। এরপর খুকু সংক্ষেপে কবিতার ভাবটিও বলল। রবীন্দ্রনাথ ভাবার্থের ব্যাখ্যায় নজর না দিয়েই ভদ্রলোকদের দিকে হেসে বললেন, ‘দেখছেন তো, আমার স্কুলের ছেলেমেয়েরা যা এত সহজে বুঝতে পারে, বিদ্বান ব্যক্তিদের সেই কবিতার মানে খুঁজে বার করতে এত পরিশ্রম কেন বলুন তো।’ আমাদের মুখে যখন কিছু বিহ্বল গর্বিত ভাব দেখে ফিরে যাবার ইঙ্গিতে হাত নেড়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘পালা, পালা, এখান থেকে পালা। নয়তো তোদেরও সহজ বুদ্ধি পাকা বুদ্ধিতে ঘুলিয়ে যাবে।’

শান্তিনিকেতনের শান্তিময় পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক গান লিখে চলেছেন, নব নব সুর সৃষ্টির মাধ্যমে তার গানে তিনি প্রাণসঞ্চার করছেন। কত সুর যে ভিড় করে আছে তাঁর মনে। মুশকিল একটাই, সুর বেশিক্ষণ কবি মাথায় ধরে রাখতে পারেন না, হয় তো অন্য কোন গানের সৃষ্ট সুর প্রথমটিকে সরিয়ে দেয়। তাই সুর মনে এলেই গানটি কারো গলায় তুলে নিতে হত অথবা স্বরলিপি তৈরি করে তাকে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে হত। কোন গানের সুর শুনে অনায়াস দক্ষতায় সেটিকে গলায় তুলে নিতে খুকুর সমকক্ষ কেউ ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই ঘন ঘন তার ডাক পড়েছে। হয়তো ফাল্গুন মাসের প্রচন্ড রোদ মাথায় করে সবে তিনি উত্তরায়ণ থেকে শ্রীভবনে ফিরে এসেছেন, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন তার। ঠিক সেই সময়েই গুরুদেব আবার তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন উত্তরায়ণে। এইমাত্র একটা গানে সুর দিয়েছেন, এখনই সেটা খুকুর গলায় তুলে নিতে হবে, নয় তো সেটা মনেই বিলীন হয়ে যাবে। ক্লান্তিহীন খুকু আবার চলে উত্তরায়ণে।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ রমা চক্রবর্তীর লেখা থেকে আমরা সেদিনের অনেক কথা জানতে পারি। বিয়ের পর তিনি (রমা) শান্তিনিকেতন ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থলে চলে গেছেন। সেবার খুকুর আন্তরিক আহ্বানে একমাসের জন্য শান্তিনিকেতনে এসে শ্রীভবনে খুকুর ঘরে এসেই উঠেছেন রমা। একদিনের অভিজ্ঞতার কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন –

“একদিন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, আমরা উঠব উঠব করছি, এমন সময় গুরুদেবের সেবক বনমালী এসে ডাক দিল – খুকু উঠে দরজা খুলে দিতেই বনমালী বলে উঠল, ‘খুকু দিদিমণি শিগগির চলো, বাবামশাই সেই কোন রাত থেকে গান নিয়ে বসে আছেন। তোমায় শিগগির করে যেতে বলেছেন।’
খুকুর সঙ্গে আমিও তৈরি হয়ে নিলাম। উত্তরায়ণের পথে আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম। গুরুদেব তখন ‘উদীচীতে’ ছিলেন। নীচের ঘরে তাঁর বেতের চেয়ারটিতে তিনি বসেছিলেন, পাশেই একটি মোড়া রাখা। বোঝাই গেল, খুকুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।”

১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। খোলা গলায় উদাত্ত সুরে গাইতে পারার জন্য এবং ছেলেদের মত গলায় একটা জোয়ারি থাকায় খুকুই নির্বাচিত হয়েছিলেন বাল্মীকির ভূমিকায়। বিধুশেখর শাস্ত্রী তখন শান্তিনিকেতনে। বাল্মীকির ভূমিকায় খুকুর গলায় গান শুনে তিনি মোহিত হয়ে খুকুকে ডাকতেন ‘বাল্মীকি কোকিলম’ নামে।

রবীন্দ্রনাথ তার স্নেহের খুকুর অটোগ্রাফ খাতায় একবার লিখেছিলেন –

“তব জীবনের গ্রন্থখানিতে
প্রতিদিন হোক লিখা,
মধুর ছন্দে গভীর বাণীতে
ভরে দিক লেখনিকা।”

গান খুকুর অত্যন্ত প্রিয় হলেও লেখাপড়াতেও ছিল তার সমান আগ্রহ। ১৯৩০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন হল থেকে ৫ই জুন লিখেছেন

“খুকু তুই ভাল করে পাস করেছিস শুনে খুব খুশি হলুম। এইবার বোধহয় একটু গান বাজনায় মন দিতে পারবি। গান শুধু তোর কন্ঠের কুশলতা নয়, তোর অন্তরের সম্পদ – বিধাতার দুর্লভ দান – এই কথা মনে রেখে তাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার ও যত্নের সঙ্গে রক্ষা করবি।”

উল্লেখ করা যেতে পারে, খুকু নন্দলাল বসুর কাছে চিত্রাঙ্কন শিক্ষাও করেছিলেন কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেদিকে বেশি মন দিতে পারেন নি। তিনি আরবি, উর্দু, পালি এবং জার্মান ভাষাও রপ্ত করেছিলেন।

শান্তিনিকেতন থেকেই ১৯৩২ সালে ব্যক্তিগত পরীক্ষার্থিনী হিসাবে তিনি আই. এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হ’ন। সংস্কৃতে তার নম্বর ছিল ৮০%। বাংলাতে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে লাভ করেন নগেন্দ্র স্বর্ণপদক। সে বছরের শেষেই তিনি বি. এ. পড়তে কলকাতায় চলে আসেন এবং সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হ’ন। সংস্কৃতে তিনি ছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শান্তমণি রৌপ্যপদক লাভ করেন। বেস্ট লেডি গ্রাজুয়েট হয়ে লাভ করেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। খুকু শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে এলে কিছুদিন পরেই, ২১শে ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছেন –

“জানি ইচ্ছাক্রমে তুই আশ্রম ছেড়ে যাস নি। তোর উপর রাগ করে থাকব কি করে ? আশ্রমের বাইরে গেলেও আশ্রমে তোর মন আছে সে আমি নিশ্চয় জানি।”

এর কিছুদিন পরে খুকু কোন কারণে হয়ত শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। সেখান বসেই ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারী কবিগুরুকে একখানি চিঠি লেখেন। দীর্ঘ সেই চিঠি। বয়স তখন তার উনিশ, কিন্তু চিঠিটি পড়ে মনে হয় যেন একজন পরিণত বয়স্ক দার্শনিক তার গভীর উপলব্ধির কথা রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন। সব কথা মুখোমুখি বসে হয়ত বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে খুকু একটা দীর্ঘ পত্রে মনের মধ্যে জমে থাকা অনেক না-বলা কথা লিখে হাল্কা হতে চেয়েছেন। সে চিঠি সবটা উদ্ধৃত করা সম্ভব না। কিছু কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি -

“ শ্রীচরণকমলেষু গুরুদেব,

“ আপনাদের কাছ থেকে ফিরে এসে ‘শ্রীভবনে’ আমার (আগে যেটা আমার ছিল) ঘরে বসেছি, এখন রাত্রি এগারোটা। অনেক কথা মনের মধ্যে জমে উঠেছে, যে কয়দিন এখানে কাটালাম তারি মধ্যে অনেক হাসিকান্নায় মনটা ভ’রে উঠেছে, চিঠির মধ্যে ঝরিয়ে দিয়ে মনটা হাল্কা ক’রে নিতে চাই।
“ কাল আমার যাবার দিন। চোখের জলের মধ্যে বিদায় নিচ্ছি। আগে কোনদিন জানতে পারিনি, যে এই শান্তিনিকেতনের মধ্যে আমার নাড়ীর যোগ, -এ বাঁধন ছিঁড়তে এত বাজে।
“ কলকাতায় যে কয়মাস কাটিয়েছি, এরই মধ্যে সেখানকার কুৎসিত নোংরা আবহাওয়া আমায় দগ্ধে মারছে। যখন আশ্রমে দু’চার দিন কাটিয়ে যাই, এখানকার সঙ্গে তুলনায় সেখানকার সব কিছু আরো অসহ্য মনে হয়। ...... এখানকার শ্যামল তরুলতা, ছায়াস্নিগ্ধ শালবীথি, মাথার উপর অসীম নীল আকাশ, সুন্দর আলোভরা হাসিভরা দিনগুলি, এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্বন্ধ ...... আর কলকাতার atmosphere যেন আগুনের হলকা।
“ আপনাকে অনেক সময় দুঃখ করে বলতে শুনেছি, ‘হল না, এখানে কিছুই হল না।’ ...... আমি তো এখানেই গড়ে উঠেছি। সেই অধিকারে আমি আপনাকে বলতে চাই, কেন আপনি ওকথা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন ? ...... আমি জানি আপনি বলবেন আপনার সাধের স্বপ্ন সফল হয় নি,- বাস্তব তার থেকে অনেক পিছনে পড়ে আছে। কিন্তু Ideal তো চিরকাল Ideal-ই থেকে যায়, কখনও বাস্তবতার মধ্যে তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে আমলকখন্ডের মত ‘পেয়েছি’ বলা যায় কি ? ক্ষমা করবেন, দু’একটা ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম (তার যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাই না)। আমি কি জানি না আমাদের আশ্রমের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে কত ক্ষুদ্রতা, নীচতা, কুটিলতা আছে ? কত সময় আমরা এই পঙ্কিলতা দেখে ভয় পেয়েছি, দুঃখ করেছি, রাগ করেছি, নিন্দা করেছি, মনের জ্বালা মিটিয়ে ঝাঁঝালো কথা বলেছি। কিন্তু তবু বলব, - এইসব প্রতিদিনের তুচ্ছতাকে অতিক্রম করেও এখানে এই ছোট্ট গন্ডীটুকুর মধ্যে অসীম প্রকাশ পাচ্ছেন, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আর মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের যোগসাধনের চেষ্টার মধ্যে। সেই সাধনা এখানে জীবন্ত, সেই স্বর্গের হাওয়া এখানে বারোমাস বইছে – এখানকার শত সহস্র কলহ বিবাদকে শীতল করে আনছে। ………
“ আপনি এই বুড়ো বয়সে শরীরের দুর্ব্বলতা, মনের নানা অশান্তির মাঝখানে আর একটি কথা ভেবে এত দুঃখ পাচ্ছেন – যে বুঝি আপনার এত পরিশ্রম – তিল তিল করে জীবনদান সবই বৃথা হল, - কিছুই হল না – আমি বলছি আপনার এ ধারণা ভুল, নিশ্চয়ই ভুল। …… এখানে তো মানুষে মানুষে বাইরের কোন সমাজ, জাতি, ধর্ম্ম, আচারব্যবহার বা আর কিছুর জন্যই তফাৎ রাখা হয় নি। অন্য যদি কিছুই না শিখে থাকি, তবুও একটা পরম শিক্ষা পেয়েছি বলে আজীবন গৌরব অনুভব করব। সে শিক্ষা হচ্ছে এই যে, - মানুষ সবই এক, মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই – ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
“ তবুও কি আপনি বলবেন, ‘কিছুই হল না?’ নানা দুঃখে দারিদ্র্যে নিপীড়িত আমাদের এই দেশ, শিক্ষা থেকে চিরবঞ্চিত,- সেই দেশের একটি কোনাতে আপনি এমন একটি atmosphere সৃষ্টি করেছেন, বাইরে থেকে এলে যার শান্ত নির্মল পবিত্র গভীর প্রভাব অন্তরে অনুভব না ক’রে থাকা যায় না। এত সংগ্রামের মধ্যেও যে এইটুকু হয়েছে সেই তো আশার কথা। .........
“ সমস্ত পৃথিবীর আকুল প্রার্থনার ধন সেই শান্তিকে আপনি সত্যদৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েছেন, বাস্তব জীবনে তাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন, কিছু পরিমাণে সফল হয়েছেন বই কি! তা’ নইলে বাইরের জগৎ থেকে কিসের আশায় মানুষ এখানে ছুটে ছুটে আসে ? এখানে যে তৃষ্ণার জল রয়েছে মানবাত্মার জন্য। এইসব কথাই আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছিল, মুখের কথায় গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই লেখার আশ্রয় নিতে হ’ল। যদি প্রগলভতা করে থাকি আপনার কাছে যে স্নেহের আশ্রয় লাভ করেছি, সেই অধিকারেই জানি, যে সে প্রগলভতা আপনি ক্ষমা করবেন।
“ আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে আশ্রম সম্বন্ধে আমার ধারণা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার আমার আছে। ............।

ইতি আপনার স্নেহের
খুকু।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, শান্তিনিকেতনের প্রতি তার নাড়ীর টান, আশ্রমদুহিতা হিসাবে তার সস্নেহ দাবী সবই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হয়ে বিধৃত রয়েছে এই চিঠির প্রতি ছত্রে।

খুকু শান্তিনিকেতন থেকে বি. এ. পড়তে কলকাতায় চলে এসেছেন ১৯৩২ সালের শেষের দিকে। এর কিছু পড়ে শান্তিনিকেতনে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ১৯৩৪-এর গোড়ার দিকেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে গেছেন। এ ব্যাপারে দিনেন্দ্রনাথের বক্তব্য জানা যায় নি। এ নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি কিছু বলে থাকলেও কোথাও লিপিবদ্ধ হয় নি। রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু মন্তব্য থেকে ব্যাপারটা অনুমান করা যায় মাত্র। এ বিষয়ে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক নিত্যপ্রিয় ঘোষ তার ‘কালনাগিনীর ফোঁস’ নামক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে কিছুটা তথ্য নেওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ অভিযোগ করেছেন - টাকা দিয়েও দিনেন্দ্রনাথকে দিয়ে স্বরলিপি করানো যাচ্ছে না। অথচ দিনেন্দ্রনাথ তার গান শেখানো বা বিশ্বভারতীর অন্যান্য কাজের জন্য অথবা সঙ্গীতভবন বা কলাভবন থেকে কোন পারিশ্রমিক নিতেন না। তা হলে কোন অর্থের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ? জমিদারি থেকে প্রাপ্য অংশ নিয়ে দিনেন্দ্রনাথের মনে ক্ষোভ ছিল বলে জানা যায়। স্বরলিপি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তার গানের যোগ্য কান্ডারী দিনেন্দ্রনাথের উপর সব সময়ে সুবিচার করেননি। ১৯২৬-এ দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অভিযোগ করার পরেও ‘গীতমালিকা-১’ (১৯২৬), ‘গীতমালিকা-২’ (১৯২৯)-এর অধিকাংশ এবং ‘তপতী’-র (১৯৩১) সব স্বরলিপি দিনেন্দ্রনাথই তৈরি করেছেন ; তবু তার নাম কোথাও থাকল না। হয় ত সব স্বরলিপি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি। রমা চক্রবর্তীর একটি ঘটনার উল্লেখ এ বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, একবার খুকু এবং অন্য সবাই উত্তরায়ণে গান শিখতে গিয়েছেন। দিনেন্দ্রনাথ তখনও সেখানে এসে পৌঁছোননি। রবীন্দ্রনাথই গান গেয়ে তাদের শেখাচ্ছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গাইয়েরা সব চুপ করে গেল। কি ব্যাপার ? সাহসী মেয়ে খুকু। সে বলল, দিনেন্দ্রনাথ তাদের অন্য সুর শিখিয়েছিলেন। নিত্যপ্রিয়র লেখা থেকে জানা যায়-

“ ১৯৩৩-এর শুরু থেকেই দিনেন্দ্রনাথ আশ্রমের কাজ থেকে সরে গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে গান তোলেন না, স্বরলিপি লেখেন না, গান শেখান না, নাটক এবং সঙ্গীত অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন না, শান্তিনিকেতনে থেকেও ব্রাত্য হয়ে গেলেন যেন। ১৯৩৪-এর শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের গানের ভান্ডারী এবং নাটের কান্ডারি দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান।”

গভীর অভিমান নিয়ে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছেন তিনি। অথচ ১৯১৬ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটক দিনেন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটেছে হয়ত।

১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে দিনেন্দ্রনাথ পরলোক গমন করেন। ১৯৩৫-এর ২৬শে জুলাই রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছেন –

“ খুকু তোর চিঠি পেয়ে খুব খুসি হলুম।
দিনু চলে গেল, আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের একটা অংশ যেন ভেঙে পড়ে গেল। আমার নিজের গান নিজে ব্যবহার করার শক্তি আমার নেই, নিশ্চিত ছিলুম এই ভেবে যে তার দানসত্র ছিল তারই হাতে – সেগুলি পরিবেষণ করতে সে কোনদিন কৃপণতা করে নি – শেখাতে তার ধৈর্য্য ছিল অসামান্য, অযোগ্যকেও সে প্রত্যাখ্যান করতে পারত না।
আমার দুঃখ পাবার দিন এখনও ঘোচেনি বটে কিন্তু শোক করবার সময় সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে। এই অল্প কয়দিনের জন্য সকল ক্ষতি সকল বিচ্ছেদ শান্ত চিত্তে স্বীকার করে নেওয়াই আমার পক্ষে শ্রেয়।– তোর চিঠিপড়ে মনে পড়ে গেল দিনু তার সকল ছাত্রের মধ্যে তোকেই সকলের চেয়ে স্নেহ করত- সেই স্নেহের দান তুই অজস্র পেয়েছিলি – তোর জীবনে তার সঞ্চয় ফুরোবে না। যা পেয়েছিস তা রক্ষা করার ভার এখন তোদেরই পরে রইল। কখনো কোন অবকাশ উপলক্ষ্যে আশ্রমে একবার এলে খুসি হব। ...”

[ প্রসঙ্গতঃ অমিতা সেন খুকুর লেখা ‘দিনেন্দ্রনাথ’ নামক একটি লেখা ‘অবসরে’ ‘নির্বাচিত কিছু পুরানো রচনা’ নামাঙ্কিত ধারাবাহিকে প্রকাশিত হয়েছে।]

এই চিঠি পড়ে কখনই মনে হয় না দিনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোন বিরূপ মনোভাব পোষণ করে রেখেছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের করা স্বরলিপি নিয়ে যে সব কথা শোনা যায় তার কোন প্রতিফলনই এই চিঠিতে পড়ে নি। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য অজানাই রয়ে গেছে।

দিনেন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে এলে তার অতি প্রিয় খুকু জোড়াসাঁকোতে এসে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন কি না সে তথ্য কোথাও নেই। সম্ভবত দেখা হয়নি কারণ, এর পরে খুকুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেক চিঠিপত্র আদান প্রদান হয়েছে, তাতে দিনেন্দ্রনাথের ঘটনার কোন ছাপ পড়ে নি। দিনেন্দ্রনাথের কলকাতা চলে যাওয়া সম্বন্ধে খুকু যদি বিতর্কিত কিছু জেনেই থাকে, তবে সেটা পরে শান্তিনিকেতনে এসে।

হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে খুকুর গানের প্রথম রেকর্ডটি বেরিয়েছিল ১৯৩৫ সালের মে মাসে। রেকর্ডের গায় লেখা ছিল :

মে ১৯৩৫
শ্রীমতী অমিতা সেন বি.এ. , খুকু
H 262 আধেক ঘুমে নয়ন চুমে
ওগো দখিন হাওয়া

খুকুর কটা গান কার তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করা হয়েছিল এ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। খুকুর ছোট ভাই অভিপ্রসাদের (ভানু) বড় মেয়ে নীলাঞ্জনা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন –“খুকু মাত্র দশ-বারোখানি গানই রেকর্ড করতে পেরেছিলেন।” রেকর্ড প্রসঙ্গে নিত্যপ্রিয় ঘোষ অনেক তথ্য দিয়েছেন সে সবের মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। তবে তিনি জানিয়েছেন সব গান ১৯৩৫-৩৯-এর মধ্যে রেকর্ড করা। এই সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ’ল, কোন গানই রবীন্দ্রনাথ ১৯৪০ সালের আগে প্রকাশ করার অনুমতি দেন নি। সঠিক কারণ জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথের খুকুকে গান শেখানো প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী তার ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ গ্রন্থে লিখেছেন
“ ... মায়ার খেলার গানের রিহার্সাল মনে পড়ে - অমিতা সেনের (খুকু) গান। কবি সঙ্গে গাইছেন – ‘অলি বার বার ফিরে আসে অলি বার বার ফিরে যায়, .....কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না।’ অমিতা একবার গাইছে, কবি আবার তাকে সংশোধন করছেন। অলির মত একই গানের কলি ফিরে ফিরে আসছে - কথাটা এখানেও অন্য অর্থে সত্য হচ্ছে - গানের কলি তার পূর্ণরূপে বিকাশ হচ্ছে না - আমার অশিক্ষিত কান বুঝতেই পারছে না কোথায় পার্থক্য বা ত্রুটি হচ্ছে কিন্তু কবি সেই একটি লাইন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাইছেন, বলছেন, - ‘কর্, আমার সঙ্গে কর্’। সেদিন আমি কবির ধৈর্য্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত সহিষ্ণু শিক্ষক আমি আর দেখিনি।”

বি. এ. পাশ করে কলকাতায় এসে খুকু বীণাপাণি পর্দা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তখন এটি মেয়েদের বেশ নাম করা স্কুলই ছিল। কিছুদিন বেথুন স্কুলেও পড়িয়েছেন তিনি। শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি ১৯৩৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

খুকু কলকাতায় চলে এলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। কোন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেও খুকুর সঙ্গে হয় ত দেখা হয়েছে।

১৯৩৫ সালের ১১ই ও ১২ই ডিসেম্বর কলকাতায় ‘নিউ এম্পায়ারে’ ‘রাজা’ ও ‘অরূপরতন’ মিলিয়ে একটা নাটক অভিনয় হয়েছিল। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ খুকুকে অনেকগুলি চিঠি লিখেছেন। খুকুর যে মঞ্চে অভিনয় করতে যথেষ্ট অনীহা ছিল রবীন্দ্রনাথ সেটা জানতেন। তাই ২৭শে নভেম্বর চিঠি লিখে জানিয়েছেন, -“খুকু, গোটা তিনেক নতুন গান হয়েছে বাকি সব পুরোনো। তোকে কিছু সাজতে হবে না, কিন্তু গাইতে হবে। আশ্রমে আজকাল সুকন্ঠের একান্ত অভাব।” এর পর ১৯৩৫-এর ২রা ডিসেম্বরের চিঠিতে ২১ টা গানের একটা তালিকা পাঠিয়ে লিখেছেন –

“তোকে গানের তালিকা পাঠাই – এর মধ্যে যে কয়টি তুই পছন্দ করিস বেছে নিস। আমরা বোধ হয় দশই তারিখে যাব দুটো দিন হাতে পাওয়া যাবে। ......”

নিজের লেখা গান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে সব সময়েই একটা অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার ভাব উদয় হয়েছে। কার ভরসায় রেখে যাবেন তার গানের বিপুল সম্ভার? অনেক চিঠিপত্রে এর উল্লেখ আছে। গানে খুকুর প্রতিভা পারদর্শিতা লক্ষ্য করে বহুদিন থেকে তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন খুকু যাতে আশ্রমে এসে এ কাজের ভার নেয়। খুকু উচ্চশিক্ষিত হয়ে শান্তিনিকেতনের বাইরে চাকরী করবে এটা রবীন্দ্রনাথ কোন ভাবেই চান নি। খুকুর উপর তিনি যে স্নেহ এবং স্বীকৃতি অকাতরে বর্ষণ করেছেন, তার মেধা ও প্রতিভাকে সম্মান জানিয়েছেন, তাতে খুকু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শান্তিনিকেতনে যোগদান করে তার ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে আসবে এমন চিন্তা অস্বাভাবিক নয়। ১৯৩৭ সালের ৬ই জানুয়ারী (তখনো সম্ভবত খুকু এম.এ. পরীক্ষা দেন নি) উত্তরায়ণ থেকে খুকুকে লেখা একটি চিঠি –

কল্যাণীয়াসু
সুদীর্ঘকাল পরে তোর খবর পাওয়া গেল। ...... আমরা একটি নতুন গান শিক্ষক পেয়েছি – গোপেশ্বরের ভাইপো – বয়সে অত্যন্ত কাঁচা কিন্তু বিদ্যায় পাক ধরেচে, একবার কোনো ছুটিতে এসে তার গান বাজনা শুনলে হয়তো তোর লোভ হবে – পরীক্ষার প্রতি বিতরাগ হওয়াও অসম্ভব নয়।
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৩৮-এর ১০ই ফেব্রুয়ারী “ C/O Sri Haripada Roy / 89 Raja Dinendra Street / Calcutta” ঠিকানায় খুকুকে লেখা আর একখানি চিঠি –

খুকুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রতিলিপি

কল্যাণীয়াসু
তুই যদি আশ্রমে এসে আমাদের কাজে যোগ দিতে পারিস তো খুশি হব। প্রথম কারণ, তোর স্বস্থানে তুই এখানে আসবি এবং আমাকে বিরক্ত করার প্রভূত উপলক্ষ্য পাবি। দ্বিতীয় কারণ, আমার রচিত গান সংগ্রহ করবি, ব্যবহার করবি, ও বিস্তার করবি এজন্য আমার মন উৎসুক আছে। তোর শক্তি আছে, অনুরাগ আছে, এবং কন্ঠ আছে সেই জন্য আমার এই কাজে তোকে পেতে অনেক দিন থেকে ইচ্ছা করছি। ভয় ছিল তোর দুরাশা হয়তো অন্য কোনো পথে ধাবিত। যদি তা না হয় এবং যদি আমার প্রতি থাকে তোর ভক্তি এবং আশ্রমের প্রতি নিষ্ঠা, তবে অন্য কর্মজাল থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে এখানে চলে আয়। এক মাস নোটিসের বিলম্বে ক্ষতি হবে না। আমি প্রত্যাশা করে থাকব।
স্নেহরত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কিশোরীর চিঠি থেকে জেনেছিস এই কর্মের জন্য মাসিক পঁচাত্তর টাকা তোর বৃত্তি আমরা স্থির করেছি।

রবীন্দ্রনাথ উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করলেও খুকু ১৯৩৮ সালের ২৮শে এপ্রিল বিনীত ভাবে ক্ষমা চেয়ে তাকে জানালেন একটি ব্যক্তিগত কারণে তার হাত-পা বাঁধা, কাজেই সঙ্গীত ভবনের কাজে সে যোগদান করতে অপারগ। রবীন্দ্রনাথ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই তবু তিনি উদার চিত্তে এটা মেনে নিলেন। মে মাসের প্রথম দিকে একটা চিঠিতে তিনি খুকুকে লিখলেন –

“আমার যে ইচ্ছা পূরণ করতে তোর শক্তিতে কুলোলো না তা নিয়ে দাবী করব কেন আর শাস্তিস্বরূপ তোকে আশীর্ব্বাদ থেকে বঞ্চিত করব কেন। পূর্ব্বের মতো এখনো আমারই কাছে হয়ত তোর প্রয়োজন ঘটতে পারে তখন আসিস। আমার ব্যবহারের কোন ব্যত্যয় দেখতে পাবি নে।”

যে কোনো কারণেই হোক খুকু মত পরিবর্তন করে ১৯৩৮-এর জুন (?) মাসে সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপিকার পদে যোগদান করেন। অনুমান করা যায় এই সময় হয় ত দিনেন্দ্রনাথের আশ্রম ত্যাগ সহ শান্তিনিকেতনের আরও অনেক অস্বস্তিকর বিষয় তার কানে এসেছে। এছাড়া তার একটা ব্যক্তিগত সমস্যাও ছিল, সে কথায় পরে আসছি।

প্রায় বছর খানেক খুকু শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এর পরে ১৯৩৯-এর ২০শে জুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ রমা চক্রবর্তীকে একটি চিঠি দিয়ে জানান যে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে রমা চক্রবর্তী লিখেছেন –

“ আমার স্বামী উত্তর বিহারে বদলী হয়ে গেলেন, তাই দূরে চলে গেলাম, আগের মত ইচ্ছা হলেই শান্তিনিকেতনে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তার মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটে গেল। দুর্ঘটনাই বলা যায় – দূরে বসে জানতে পারতাম না। যখন শান্তিনিকেতনে আসতাম তখনও সবিস্তারে কিছু শুনতে পেতাম না। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। খুকুর চিঠি পেতাম কিন্তু সেও কিছু জানত না। হঠাৎই খবর দিল যে, সে শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে গেছে। সেসময়কার একটা চিঠি পড়ে মনে হয়েছিল, তার মনে একটা অশান্তি, একটা আলোড়ন চলছে। খুকুর চরিত্রে একটা নির্ভীক দৃঢ়তা ছিল, নিজের ধ্যানধারণা আঁকড়ে থাকত। সেই খুকু অমিতার মন দুর্ব্বল হয়ে কষ্ট পাচ্ছে কেন তা বুঝতে পারি নি।”

খুকু তার একটা ব্যক্তিগত বিষয়ে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। কী সেটা? এটা জানতে হলে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। এম. এ. পড়ার সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শম্ভুনাথ গাঙ্গুলী নামে এক মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে খুকুর বন্ধুত্ব হয়। সব মেয়ের মতই খুকুর মনের গহনে বিয়ে করে সংসার করার বাসনা হয় ত ছিল। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই সুপ্ত ইচ্ছার অস্পষ্ট একটা আভাস মেলে ১৯৩৩-এর ৭ই জুলাই বি. এ. পড়াকালীন বন্ধু রমাকে তার লেখা এক চিঠিতে –

“ আমার ছোটবেলার গল্প বোধহয় তোমার কাছে কখনও করিনি,- আমি বই পড়তে এত বেশী ভালবাসতাম এবং সংসারের অন্য পাঁচদিকে নজরটা এত কম দিতাম যে সেই ত্রুটিটা এখনো আমার মধ্যে রয়ে গেছে – তাতে করে আমি rude, selfish – এই রকম হয়েছি। দেখো তাতু (খুকুর ছোট বোন) আর আমি, আমাদের মধ্যে কি তফাৎ? আমার তাই মনে হয় – যতই ভাল করে পাশ করতে চাই এবং intellectualism এর চর্চা করি না কেন, যতদিন সেবায়, স্নেহে, ত্যাগে আত্মবিসর্জন করতে না শিখি, ততদিন এ সবই মিথ্যে – শুধু সময় কাটানো। তাই মনে হয় অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে, যা হয়তো আমাকে ভালো স্ত্রী, ভালো মা, ভালো গৃহিণী বা ভালো পুত্রবধূ হ’তে বাধা দেবে। তুমি বোধ হয় হাসছো। ......”

হয়তো শম্ভুনাথ খুকুকে ভালবাসা জানিয়েছিল, খুকুর নির্মল তৃষিত হৃদয় আন্তরিক ভাবেই সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। খুকু এক বছর শান্তিনিকেতনে থেকে হঠাৎ চলে এসেছিলেন কেন তার সম্পূর্ণ কারণ গবেষকরা অনুমান করেছেন, কিন্তু অস্পষ্টতা থেকে গিয়েছে। দুটি কারণ অনুমান করা গিয়েছে। প্রথমটি হ’ল, ‘রিহার্সালের অশুচিকর ও দুঃখকর আবেষ্টন’। মঞ্চে অভিনয় করতে খুকু যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এটা রবীন্দ্রনাথের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল ; যে কারণে একবার তিনি খুকুকে লিখেছিলেন –“ তোকে কিছু সাজতে হবে না, কিন্তু গাইতে হবে। আশ্রমে আজকাল সুকন্ঠের একান্ত অভাব।” ভাল না লাগা এক জিনিস কিন্তু ‘অশুচিকর’, ‘দুঃখকর’ এই কঠিন শব্দগুলি ব্যবহার করার পিছনে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল সেটা বোঝা শক্ত। তবে এ বিষয়ে আশ্রম নিবাসী দীর্ঘায়ু উমা দত্তর স্মৃতিচারণ প্রণিধানযোগ্য –

“ সেই সময় তার ভাব হয় একটি ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি খুবই গরিব বাড়ি থেকে এসেছিল। নিজের স্কলারশিপের টাকায় নিজে আধপেটা খেয়ে খুকু ছেলেটিকে সাহায্য করত। এই ছেলেটির জন্যই খুকু কেমন বদলে গেল, অসুস্থ হল। মানসিকতাটাও অদ্ভুত বদলে গেল। শান্তিনিকেতনে পিসিমার কাছে আসত। একবার আমাকে বলল, আমরা যে এত ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম সেটা ঠিক ছিল না। আমি বলি, খুকু, এটা তুমি কি বলছ ? তুমি আমি কত সহজে সকলের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের বড় দাদাদের সঙ্গে মিশেছি। খুকু বলল, ‘না, আমরা তখন অনেক কিছুই বুঝতাম না, অনেক কিছুই বুঝি নি।’ ওই ছেলেটিই ওকে যেন গ্রাস করেছিল। গুরুদেব বলেছিলেন, ‘একটা মেয়ে বনের পাখির মতো খোলা গলায় গান করত। সেটা বন্ধ হয়ে গেল।’ এটা আমি নিজে ওকে বলতে শুনেছি।”

মঞ্চে রিহের্সাল ও অভিনয়ের সময় সকলের সঙ্গে যে স্বাভাবিক সৌহার্দ্যপূর্ণ মেলামেশা হত সেটাই কি খুকুর চোখে ‘অশুচিকর’ বা ‘নৃত্যকলার মলিন প্রভাব’ মনে হয়েছিল ? তা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছিলেন যে এ বিষয়টা তিনি অধ্যক্ষদের জানাবেন।

খুকুর আশ্রম ছেড়ে যাবার দ্বিতীয় কারণটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ খুকুকে লিখেছিলেন যে শুধু সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপিকা নয়, তার ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বও তাকে গ্রহণ করতে হবে। এর উত্তরে খুকু জানিয়েছিলেন যে তিনি রাজি, তবে তার সেই ছেলে বন্ধু শম্ভুনাথকেও একটা চাকরি দিতে হবে। আশ্রমে তখন কোন শূণ্য পদ ছিল না, তবু রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন বিষয়টা তিনি কর্ত্তৃপক্ষের নজরে এনেছেন। হয়তো চাকরিটা হয়েও যেত কিন্তু খুকু মনে করেছিলেন গুরুদেব তো ইচ্ছা করলেই তার বন্ধুটিকে চাকরিতে নিয়োগ করতে পারেন, তার জন্য আবার কর্ত্তৃপক্ষকে টানা কেন। রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য - তিনি একক ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ২৫শে মে ১৯৩৯-এ খুকুকে লিখেছেন,

‘এটা নিয়ম, এতে মানী লোকের মানহানী হয় না। ভাইসরয়কে নিযুক্ত করার সময়ও ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়ে থাকে। ব্যাপারটাকে যদি অপরাধজনক মনে করে থাকো সে অপরাধ তোমার একলার।’

খুকু তার চিঠিতে দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও কোনো প্রশ্ন হয়ত তুলে থাকবেন। এতে রবীন্দ্রনাথ নিরতিশয় ক্রুদ্ধ। তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘তোমার নিজের সাফাইয়ের প্রসঙ্গে তুমি দিনুর নাম টেনে এনেছ। এটা সম্পূর্ণ অসত্য ও তোমার অধিকার বহির্ভূত।’ তার বিরাগ তিনি চেপে রাখেন নি। ১৯৩৯-এর ২৪শে জুন কিশোরীমোহন সাঁতরাকে চিঠি লিখে বলেছেন, -

“ খুকুর কথা তোমায় বলিনি। তার সঙ্গে আমার একটি শেষ পত্র বিনিময় হয়েছে। তার দুর্বলতাকে আমি ক্ষমা করতে পারি কিন্তু তার ছলনা আমার কাছে অতিশয় ঘৃণ্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। আমি তাকে স্নেহ করেছিলুম বলে তার স্বভাবের অসরলতা বুঝতে পারিনি।” রবীন্দ্রনাথ কতখানি রুষ্ট হয়েছিলেন এ থেকে তা স্পষ্ট।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে খুকুর লেখা একটি দীর্ঘ চিঠির প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। নানা কথায় অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে খুকু পরিশেষে লিখেছিলেন, “আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে আশ্রম সম্বন্ধে আমার ধারণা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার আমার আছে।” কিছুটা সেই অধিকারের দাবীতেই হয় তো খুকু তার প্রেমিকের চাকরির জন্য কবিগুরুর কাছে দরবার করেছিলেন। খুকু ছিলেন স্বাধীনচেতা প্রকৃতির, রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও আচ্ছন্ন হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেন নি। এই নির্ভীক চরিত্রের জন্যই আশ্রমের অন্য সবাই যখন চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে, তখন দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে খুকু দ্বিধা বোধ করেন নি।

এদিকে খুকুর বন্ধু শম্ভুনাথ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তখন রোগটি দুরারোগ্য ছিল। একটা ঘর ভাড়া করে শম্ভুনাথকে সেখানে রেখে তার চিকিৎসা ও সেবার সম্পূর্ণ ভার খুকু তার নিজের হাতে তুলে নেন। খুকুর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। চিকিৎসার খরচ মেটাতে তার নিজের পুরস্কার প্রাপ্ত মেডেল বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করতে হয়েছে। একদিন বিকেলে তাকে দেখতে গিয়ে খুকু দেখে তার ঘরটি তালা বন্ধ। বাড়িওয়ালা তাকে জানায়, এক প্রফেসরের মেয়ে এসে তাকে নিয়ে চলে গেছে পাহাড়ে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য। খুকু যেন ভাড়া মিটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে ঘর খালি করে দেয়। অকৃতজ্ঞ ছেলেটির এই বিশ্বাসঘাতকতায় খুকুর মন ভেঙে পড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। যতদূর জানা যায় খুকুর রক্ষণশীল ব্রাহ্ম পরিবার খুকুর সঙ্গে ছেলেটির বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি করেছিল। যাই হোক না কেন, শম্ভুনাথ যক্ষারোগাক্রান্ত হ’লে যে মেয়েটি সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণপাত করে তার সেবা করেছে, অর্থের অভাবে নিজের পুরস্কার পাওয়া মেডেল বিক্রি করে দিয়েছে, যার চাকরির জন্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়েছে তাকে কিছু না জানিয়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে এভাবে চলে যাওয়া ছেলেটির অবশ্যই চরম স্বার্থপরতা ও হৃদয়হীনতার পরিচায়ক।

কিন্তু শান্তিনিকেতনের সেদিনের সেই ছোট্ট কালো মেয়েটির উপর ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন না। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল খুকু। তার ভাই দেবপ্রসাদ (দেবু) তখন কারমাইকেল (বর্তমান আর. জি. কর) কলেজে ডাক্তারি পড়ছে। সেখানেই তাকে ভর্তি করা হ’ল। ডাক্তার বললেন, ‘টি-বি’ হয়েছে। সেই মত চিকিৎসা চলল। খুকু ইচ্ছা প্রকাশ করল, তার সেই প্রেমিক শম্ভুনাথকে একবার সে দেখতে চায়। যে তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গিয়েছিল, তার প্রতি তখনো খুকুর ভালবাসা অটুট। ঠিক হ’ল দশ মিনিটের জন্য ছেলেটি আসবে কিন্তু কোন কথা বলা চলবে না। ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী আশ্রমিক উমা দত্ত তার সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, -

“আমি একদিন ভিজিটিং আওয়ার্স-এ দেখা করতে গেছি। তখনকার দিনে স্বশুরবাড়ি থেকে বেরোনো তো এত সহজ ছিল না। হাসপাতালে গিয়ে দেখি বিছানার পাশে সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে। খুকু দেবুকে অনুরোধ করেছিল একবার অন্তত ছেলেটিকে নিয়ে আসার জন্য। দেবু দশ মিনিটের জন্য ছেলেটিকে আসতে বলেছিল। দশ মিনিট সময় দিয়েছিল আর বলেছিল কোন কথা বলতে পারবে না। দেখি, ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে। খুকু নিজে তখন ডেলিরিয়ামে। দেখতে পাচ্ছে না। দেবুকে খালি বলছে, ওকে একবার নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। দশ মিনিট হবার পর ছেলেটিকে দেবু চলে যেতে ইশারা করল। ছেলেটি নিঃশব্দে ফিরে গেল। এটা আমার খুব মনে রয়ে গেছে।”

এদিকে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন রাগ পোষণ করে রাখেন নি। যখনই শুনেছেন তার সেদিনের স্নেহের খুকু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার আরোগ্য কামনা করে চিঠি দিয়েছেন। ১৯৪০-এর জানুয়ারী মাসের ২৭ তারিখে Carmichael Medical College, Female Medical Paying Ward, Bed No 87- ঠিকানায় প্রেরিত চিঠি –

“তোর শরীরের অবস্থা শুনে উদ্বিগ্ন হলুম। তোর আরোগ্য কামনা করি। আমার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ কর।”

আবার পরদিনই ২৮ তারিখে লিখেছেন –

“শৈলজার কাছে তোর রোগের সংবাদ পেয়ে পূর্ব্বেই তোকে আমার আশীর্ব্বাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। আরোগ্য লাভ করে তুই আমার কাছে আসবি সর্ব্বান্তকরণে এই কামনা করি।”

বুলা মহলানবীশকে ডেকে বললেন, খুকুর যে রেকর্ডগুলো এতদিন প্রকাশের অনুমতি পায়নি সেগুলি বাজারে ছেড়ে দিতে এবং হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিকেও নির্দেশ দিলেন যথাযথ রয়্যাল্টি দেবার জন্য। এমন কি খুকু খেতে ভালবাসত বলে তার প্রিয় হান্টলি পামারের বিস্কুট প্রতি রবিবার শৈলজারঞ্জনকে দিয়ে হাসপাতালে তার কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। অবশ্য আর. জি. কর হাসপাতালে রবীন্দ্রনাথ খুকুকে দেখতেও গিয়েছিলেন এরকম একটি তথ্য একমাত্র সুনন্দিতা সেনগুপ্তর (খুকুর পরের বোন ললিতা দাসের কন্যা) একটি লেখাতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও এটি উল্লেখিত হয় নি।

রোগ প্রশমিত হবার কোন লক্ষণ না দেখায় খুকুকে পাটনায় তার মেজোমাসিমার কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। সেখানে ড: শরদিন্দু ঘোষাল টি. বি. রোগের চিকিৎসা শুরু করেন। পরে নিজেই বুঝতে পারেন রোগ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে, এটি আসলে নেফ্রাইটিস। এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা তখন ছিল না। তিন বছর বয়সে খুকুর একবার এই রোগ হয়ে হাত-পা ফুলে গিয়েছিল, বাইশ বছর পরে আবার সেই রোগ ফিরে এসেছে। খুকু যখন জানলো এ রোগ ভালো হবার নয়, তখন যেখানে সে জন্মেছে সেই ঢাকাতেই সে ফিরে যেতে চাইল, সেখানেই সে মরতে চায়। ঢাকাতে খুকুর জেঠিমা, জেঠামশাই, কাকা-কাকিমা সবাই তাকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করল। শুরু হয় কবিরাজি চিকিৎসা। এরপর অনসূয়া সেনের লেখা থেকে –

“আত্মীয়র মতন কবিরাজমশাই একদিন বললেন এ রোগ সারবার নয়। নিদান দিলেন যা যা খেতে ভালবাসে তাই যেন খেতে দেওয়া হয়। যা খেতে ভালবাসত – সবই তো নিষিদ্ধ তার জন্য। সামনেই তার ছাব্বিশ বছরের জন্মদিন। জেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খেতে ইচ্ছে করে খুকু?’ খুকু বলল, ‘দেবে আমায় খেতে – যা চাইব ? আমার খেতে ইচ্ছে পোলাও ডিমের ডালনা মাছ এই সব।’
“কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে জন্মদিনের দিন সুন্দর ঢাকাই শাড়ি পরিয়ে মুখে একটু পায়েস দিয়ে পছন্দ মত খাবার দিলেন সাজিয়ে। পরদিনই খুকু কোমায় চলে গেল। মা-বাবা ভাই দেবু এল ঢাকায়। তারপর আর কী? ২৪শে মে দুয়ার ভেঙে এলেন জ্যোতির্ময়।”

২৭শে মে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি ঢাকায় এসে পৌঁছোয়। অবিনাশচন্দ্র সেনকে লেখা সেই চিঠিটি –

কল্যাণীয়াসু
অনেকদিন থেকেই আশঙ্কা করেছিলুম যে খুকুর মৃত্যু আসন্ন তবু মৃত্যু যখন এসে উপস্থিত হয় তখন তার বেদনা আঘাত করে। খুকুকে যথেষ্ট স্নেহ করতুম কিন্তু তাকে দুর্দৈবের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি নি।
পরলোকে সে শান্তি লাভ করুক এই কামনা করি। দৃঢচিত্তে অনিবার্য বিচ্ছেদের সান্ত্বনা তোমরা বহন কর এই আমার আশীর্বাদ।
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

খুকুর মৃত্যুর পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৪৭ আষাঢ় সংখ্যায় (এই লেখার সঙ্গে প্রতিলিপিটি সংযোজিত হয়েছে) এবং Visva-Bharati News-এ শোক সংবাদটি প্রকাশিত হয়। Visva-Bharati News-এ লেখা হয়েছে “ ......... By her death Bengal has lost one of her most talented daughters. She has ceased to be, her voice has for ever merged into the profound calm of death, but her memory will linger long in our minds and long shall we mourn the abrupt end of a youthful life so rich in possibilities. ……”

খুকুর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি। তবে সুনন্দা দাশগুপ্ত ‘মহিলা মহল’ পত্রিকার লেখা উধৃত করে জানিয়েছেন,

‘গুরুদেবের ইচ্ছা ছিল অনেক গানের রেকর্ড অমিতার কন্ঠস্বরে নির্ভুল পদ্ধতিতে করিয়ে দেশবাসীকে দিয়ে যাবার, কিন্তু বিধাতার ইচ্ছায় হ’ল না সে ইচ্ছাপূরণ। যে গুরুদেবের প্রিয়তম আত্মজনের অকালমৃত্যুতে কেউ কখনও অশ্রুজলের আভাস তার চক্ষে দেখেনি, সেই গুরুদেব ক্ষুদে, গুণী শিল্পী অমিতা সেনের (খুকু) মৃত্যুতে করেছিলেন অশ্রুবর্ষণ।’

খুকুর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪০-এর ২৪শে মে। এর এক বছর আড়াই মাস পরে রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। শরীর মোটেই সুস্থ নয় কবির। এই অবস্থাতেই প্রতিমাদেবীর চাপেতে, ”মুখে মুখে গল্প বলতে বলতে, ‘লগি ঠেলে-ঠেলে চলা যাকে বলে’ ” একটা গল্প লিখেছিলেন, নাম ‘প্রগতিসংহার’। আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল এটি। ‘নীহার’ এবং ‘সুরীতি’ গল্পটির দু’টি চরিত্র। এটা নিশ্চিত ভাবেই খুকু এবং তার প্রেমিক শম্ভুনাথকে নিয়ে লেখা। গল্পটিতে প্রেমের কাহিনী স্থান পেলেও খুকুর সঙ্গীত প্রতিভার কোন উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে ইলিনা সেন লিখেছেন –

“অমিতার মৃত্যুর পর কবি ‘প্রগতিসংহার’ নামে যে ছোট গল্পটি লিখেছিলেন অমিতার অপূর্ণ জীবনের পটভূমিকায় – এমনই মনে করা হয়। এই গল্পের চরিত্র দুটি সুরীতি (অমিতা) এবং নীহার (শম্ভু) নিতান্ত একমাত্রিক, সত্য ঘটনা বা চরিত্রগুলির হাস্যকর উপস্থাপনা। রবীন্দ্রনাথের যে সব গল্পে স্ত্রীচরিত্র গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কবির যে গভীর অনুভব আমরা উপলব্ধি করি, এখানে তা কোথায় ?”

প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটা ছোট্ট কালো মেয়ে শান্তিনিকেতনে এসে যে তার খুকুর মতই সারল্যে সকলের আপন হয়ে উঠেছিল, যা্র খোলা গলার গান আশ্রমের গন্ডী পেরিয়ে খোয়াই-এর উপর ভেসে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যেত, স্বয়ং গুরুদেব যাকে ভবিষ্যতে তার গানের ভান্ডারী নির্বাচিত করেছিলেন, স্বল্পায়ু জীবনের প্রান্তে এসে ব্যর্থ প্রেমের আঘাত যাকে অসহায় ভাবে সহ্য করতে হয়েছিল, প্রায় বিস্মৃতিতে চলে যাওয়া সেই অমিতা সেন খুকুর ছাব্বিশ বছর জীবনের কিছু কথা এখানে তুলে ধরা হল। এটা সম্ভব হয়েছে ইলিনা সেনের জন্য।


খুকুর মৃত্যুতে ‘প্রবাসী’র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।


[ বিঃ দ্রঃ - অমিতা (খুকু) সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য একত্রিত করে প্রকাশ করার কৃতিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিনায়ক সেনের স্ত্রী ইলিনা সেনের প্রাপ্য। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী ও সমাজসেবী ড: বিনায়ক সেন হলেন অমিতার ভাই দেবপ্রসাদ সেন (দেবু) ও তার স্ত্রী অনসূয়া সেনের বড় ছেলে। অসাধারণ মেধাবী ও সঙ্গীতপ্রতিভা অমিতা ছিলেন দিনেন্দ্রনাথের অতি প্রিয় ছাত্রী এবং দিনেন্দ্রনাথের পরে তাকেই রবীন্দ্রনাথ তার গানের ভান্ডারী স্থির করে রেখেছিলেন। কোনো সুর একবার শুনে মনে ধরে রেখে সেটা গলায় তুলে নেওয়ার অনায়াস দক্ষতার জন্য নতুন কোন গানে সুর সৃষ্টি করলেই গুরুদেব তাকে ঘন ঘন ডেকে পাঠাতেন।

ছোট বেলা থেকেই শান্তিনিকেতনে বহু লোকের স্নেহের সান্নিধ্যে এসে বেড়ে ওঠা এই আশ্রম দুহিতার কথা কেন সে ভাবে লিপিবদ্ধ হল না বা প্রচার লাভ করল না সেটা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মূল কারণ হয়তো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠা। শান্তিনিকেতনের কিছু অন্তর্দ্বন্দ, অব্যবস্থা ও অবিচার স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক প্রকৃতির খুকুকে বিচলিত করেছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিকে কেন্দ্র করে দিনেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়া খুকু মেনে নিতে পারে নি। এ সম্বন্ধে কিছু প্রশ্নও হয়ত তিনি তুলেছিলেন। তার লেখা সব চিঠি পাওয়া যায় নি। এ ছাড়া খুকুর সঙ্গে তার এক সহপাঠীর অনুরক্তি ও তাদের ব্যর্থ প্রেমের অধ্যায়টিকেও তার পরিবারের অনেকে প্রকাশ্যে আনতে চান নি। এই গড়ে ওঠা সম্পর্কের টানেই খুকু গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে ফিরে আসার সস্নেহ আহ্বান উপেক্ষা করেছেন ; রবীন্দ্রনাথ এটা ভাল ভাবে নেন নি। একান্ত ভাবে রবীন্দ্রভক্ত পরিবারটি তাই স্বেচ্ছাকৃত ভাবেই হয়তো বিষয়টি সম্বন্ধে মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন।

সম্প্রতি খুকুর আত্মীয়বর্গ ও বন্ধুদের বেশ কিছু লেখা সংগ্রহ ও একত্রিত করেছেন ইলিনা সেন। খুকুর লেখা অনেক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ এবং বেশ কিছু চিঠিপত্রও রয়েছে এই সংগ্রহে। একই পরিবারভুক্ত হওয়ায় তিনি হয়তো কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন তবু নিঃসন্দেহে তাকে ধৈর্য সহকারে বহু শ্রম স্বীকার করতে হয়েছে। এটা যদি তিনি না করতেন তাহলে এই স্বল্পায়ু মেধাবী সংগীত প্রতিভার ছোট্ট জীবন কথা এবং শান্তিনিকেতনে তার ফেলে আসা দিনের নানা কাহিনী এক সময়ে বিস্মৃতির অতল গর্ভে বিলীন হয়ে যেত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ইলিনা সেন কেন হঠাৎ উদ্যোগী হয়ে এ কাজটা করতে গেলেন। এ সম্বন্ধে তিনি নিজেই লিখেছেন –

“অমিতা সেনের জন্ম শতবর্ষে তাঁর নিজের লেখা এবং তাঁকে নিয়ে লেখার এই সংকলনের প্রকাশনা আমার নিজের কাছে আমার প্রয়াত শ্বশুরমশাই দেবপ্রসাদ সেনকে দেওয়া আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করবার একটি প্রয়াস। বিগত শতকের নব্বই-এর দশকের গোড়ার দিকে অমিতা সংক্রান্ত লেখাপত্রের যে অংশ ভবিষ্যতে প্রকাশের আকাঙ্খায় প্রভূত প্রচেষ্টায় তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন তা তিনি আমাকে দিয়ে যান।”

গভীর নিষ্ঠা সহকারে প্রকাশনার কাজটি করার জন্য ইলিনা সেনের তাই অসংখ্য সাধুবাদ প্রাপ্য।]


ঋণ স্বীকার –
‘অমিতা’ – ইলিনা সেন ;
‘যাত্রাপথে আনন্দগান’ – শৈলজারঞ্জন মজুমদার ;
‘বুলবুলি’ – পার্থ বসু ;
‘পথে চলে যেতে যেতে’ – রমা চক্রবর্তী ;
‘শান্তিনিকেতনে আশ্রমকন্যা’ – অমিতা সেন।


লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.