অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

অভিনয় নিয়ে লেখা

বিকাশ রায়


[১৯৮২ সালে বিকাশ রায়ের বই "প্রসঙ্গ:অভিনয়" প্রকাশিত হয়। বইটি অভিনয়কলা নিয়ে লেখা, প্রথমে দেশী-বিদেশী নানান উৎস থেকে অভিনয় সম্বন্ধে সটীক উদ্ধৃতি দেবার পর তাঁর চিন্তা আর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নিজের মতামত লিখেছেন। যাঁরা অভিনয়কলা শিখতে চান, বইটি তাঁদের কাজে লাগবে তো বটেই, এছাড়া যাঁরা অভিনয় আর নাট্যকলার ব্যাপারে কুতূহলী,তাঁদেরও ভালো লাগবে। আরো বেশী, এখান থেকে বিকাশ রায়ের প্রায় চার দশক ধরে গড়ে ওঠা চিন্তাধারার একটা চমৎকার ছবি পাওয়া যায়। সেই বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো, শেষের বন্ধনীবদ্ধ সংখ্যা "কিছু স্মৃতি কিছু কথা" বইয়ের পৃষ্ঠাঙ্ক।]

শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু ক’রে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই অভিনয়কে চাপরাশ দিয়েছেন। নীতিবাগীশের কচ্‌কচি আমল দেননি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেননি।

আমরা, নোটোরা কেউকেটা নয় (২৩৪)




এই টেক্‌নিক শেখা এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞ হওয়া প্রাথমিক। স্টেজে কীভাবে প্রবেশ ও প্রস্থান করতে হবে, চরিত্রানুযায়ী কীভাবে চলাফেরা করতে হবে, হাত-পা নাড়া কতটুকু প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন এগুলি জানা অবশ্যই উচিত। কিন্তু এ নিয়ে আবদ্ধ থাকার কোন প্রয়োজন নেই—তাহলে অভিনয় করা হবে না। ... কিন্তু যত শীঘ্র সম্ভব সজ্ঞানে, টেক্‌নিক জানি, শিখেছি, এই জ্ঞানটাকে ত্যাগ করাও দরকার। যখন অভিনয় খাঁটি হবে তখন ওই প্রাথমিক অর্জিত জ্ঞান, অজ্ঞাতসারে সাহায্য করবে। (২৯১)




রেডিয়ো এবং রেকর্ড এমন একটা মাধ্যম যেখানে … প্রয়োজন শুধু কণ্ঠস্বরের—আর এই কণ্ঠস্বরের খেলায়, তার বিস্তৃতিতে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে হ’লে, কণ্ঠস্বর উঁচু পর্দায় বেঁধে, চেঁচামেচি, চীৎকার করলে চলবে না। রেডিয়ো বা রেকর্ডে অ্যাক্‌টিং টেক্‌নিকের মূল কথা হ’ল ওই মাইক্রোফোন সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। ওকে ভালোভাবে চিন্‌তে হবে। কেমন স্বরে কথা বললে শ্রোতার কানে সেটা কেমন আসবে, সেটা প্রণিধান করতে হবে। …

আমার কাছে বেতারে অভিনয় সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে শ্রমসাধ্য ব্যাপার। বেতার অভিনয়ে তীব্র মনঃসংযোগ দরকার। তবেই অভিনয় রসোত্তীর্ণ হবার পথে এগোবে। আমি কি এই রসোত্তীর্ণ অভিনয় বেতারে করতে পারি? কখনো কখনো হ’য়ে যায়, বুঝতে পারি। তবে কেন হ’ল বোঝাতে পারবো না। শেখাতেও পারবো না—কারণ আমি বিশ্বাস করি, এ শেখানো যায় না। (২৯২-৩)




[ফিল্মের] টেকনিক আলাদা! টুকরো টুকরো করে নেওয়া হবে ছবি, মাসের পর মাস ধ’রে। তা’ও আবার প্রত্যহ নয়। আগেরটা পরে, পরেরটা আগে … আগে পরে কী হয়েছে, কী হবে—কোন কিছু ভুললে চলবে না। মনের কম্পার্টমেন্টগুলি ভালো করে তৈলাক্ত রাখতে হবে—প্রয়োজন মত তৎক্ষণাৎ যা’তে খুলে যায়, আগের অভিনয় করা অংশ বা পরে কীভাবে অভিনয় করা যাবে তার বিচারবুদ্ধি নিমেষে চোখের সামনে প্রতিভাত হয়। অভিনেয় চরিত্রের রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, অনুরাগ ইত্যাদি বিবিধ sentiment গুলোর ওপর এমন অধিকার থাকার দরকার যে মুহূর্তেই প্রয়োজনমত সেগুলির ব্যবহার করা যায়। … Sentiment-কে হাতের পুতুল করে রাখতে হবে।

ইলেকট্রিক আলোর সুইচ অন্‌অফ্ করার মত switching on and off sentiments যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি দুরূহ, আবার একাগ্রতা থাকলে তেমনি সাবলীল ও সহজ। অথচ, এই টুকরো টুকরো অভিনয়ের জন্য এবং অভিনয়ের সম্পূর্ণতার জন্য পরনির্ভরতার কারণে গোঁড়া অভিনয়শিল্প আলোচকরা ফিল্ম অ্যাক্‌টিংকে কোন মর্যাদাই দিতে চান না। আমি বলবো, সেটা ঠিক নয়। অভিনয় দ্বারা রস সৃষ্টির এটা একটা নতুন মাধ্যম। বরং বলা যাবে এটা আরও কঠিন। … সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে একটি চরিত্রের যে রূপ গ’ড়ে ওঠে, সে রূপে, সে রসে অভিনেতার অংশটা তো কম নয়! (২৯৩)




হ্যাঁ, ফিল্ম অ্যাক্‌টিং-এরও নিয়মকানুন আছে। …

ক্যামেরা ... ক্যামেরার যাদু একটা আছে, সেই যাদুর অংশীদার না হ’তে পারলে ফিল্মে অভিনয় করা যাবে না। ক্যামেরার পর সাউণ্ড।… ব্রড্‌কাষ্টিং সম্পর্কেও যা, ফিল্মের বেলায়ও তাই। … নিজের হাত-পা গুলোকে নিয়ে কি করা যাবে … মেকআপ ও সাজসজ্জা ফিল্ম অ্যাক্‌টিংএর একটা বড় অংশ | … সাজপোষাক অভিনেতার আর এক প্রয়োজনীয় হাতিয়ার।...

সব শেষে এবং সব চেয়ে বড় প্রবলেম হ’ল, চরিত্রটি সম্বন্ধে নিজের চিন্তা (যদি কিছু থাকে) আর পরিচালকের সমস্ত বইটির পরিপ্রেক্ষিতে ওই চরিত্রটির চিন্তা—এই দু’টিকে মিলিয়ে দেওয়া। সাধারণত মেলে, হাঙ্গামা হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে মুশকিল হয় বইকি! … [অহীন্দ্র চৌধুরী] বলতেন, একটা ছবির কাজের সময় পরিচালকই সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি যা বলবেন সেটা মানতে আমি আইনত বাধ্য। আইনত হয়তো বাধ্য, কিন্তু তবু একথা পুরোপুরি মানতে আমার মন চায় না। (২৯৪-৬)




ফিল্ম অভিনয়ে সব চেয়ে সুবিধে হ’চ্ছে—অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ, যাকে বলা যাবে অভিনয়ের চিকন কাজ, তা এর মধ্যে দিয়েই দেখানো যায়। … অভিনেতার দাঁড়ানো, হাঁটা, চলা, পিছন ফিরে তাকানো, সবই অভিনয়কালে অর্থবহ করা উচিত। তাহ’লেই অভিনয় সুডৌল সুসম্পূর্ণ হয়। ফিল্ম অ্যাক্‌টিং-এ সে সুযোগ আছে।
সত্যি কথা বলতে কী, অধুনা কালে ফিল্মে অভিনয় করা যে কোন অভিনেতার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। (২৯৭)




…ফিল্ম-এর তক্‌মার জোরে আমি স্টেজেও বড় অ্যাক্‌টর। রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করতে গেলে কি কি প্রাথমিক প্রয়োজন তা’ আমি বিশেষভাবে কোনদিন জানি নি, জানবার সুযোগ হয়নি, আর চুপি চুপি বলি, জানবার প্রয়োজনও হয়নি।

পেশাদার মঞ্চে বেশ কয়েক বছর অভিনয় করতে করতে আমি এখানকার কলাকৌশল, টেক্‌নিক সম্পর্কে একরকম রপ্ত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, একনিষ্ঠভাবে নিজের চরিত্রটির মর্মকথা আয়ত্ত করতে পারলে এবং সেটি প্রকাশ করার সৎ প্রচেষ্টা থাকলে ভালো অভিনয় হবেই। সৎ প্রচেষ্টা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, ফাঁকি দিয়ে নয়, সস্তা চমকটুকু শিখে নিয়ে নয়। অভিনেতার সহজ সাধারণ বুদ্ধি, হাঁটাচলা, দাঁড়ানো, বাচনভঙ্গী, প্রবেশ, প্রস্থান সব কিছুই, চরিত্রানুযায়ী করতে সাহায্য করবে। আঙ্গিক, কলাকৌশল জানা ভালো, নিশ্চয়ই ভালো—কিন্তু কিভাবে স্টেজে চলাফেরা করতে হবে তার জন্যে বিভিন্ন রকমের ব্যায়াম, গলা তৈরীর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা নানা ভঙ্গীতে গলা সাধা ইত্যাদি জানা একেবারে অবশ্যকর্তব্য নয়। (২৯৭)




… আঙ্গিকের ভারে বিপর্যস্ত না হ’য়ে অভিনয়ের মূল সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে। অপেশাদারী মঞ্চের অভিজ্ঞতা আমার দর্শকের ভূমিকায়। এখানে আমি দু’রকম দেখেছি—এক আঙ্গিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ অভিনেতা, অতিষ্ঠ দর্শক। দুই, একটি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বাকী সকলের ঘুরে মরা। দু’একটি বিরল অভিনয় অনুষ্ঠান দেখা যায় যেখানে অভিনয় ও অভিনেতা রসোত্তীর্ণ হ’ন, দর্শক ধন্য হ’ন। (২৯৮)




অনেকের ধারণা, অভিনয়ের সময় নিজেকে অভিনেয় চরিত্রের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে পারলে তবে সু-অভিনয় হ’ল। আগেই বলেছি, এ মত মানেন না, এমন অভিনেতার সংখ্যাও কম নয়। আমিও মানি না—অভিনয় করতে হবে অত্যন্ত সচেতন থেকে। কোথায় দাঁড়াচ্ছি, কি বলছি, কেমনভাবে বলছি, দর্শক আমার কথায় সাড়া দিচ্ছেন কিনা, আলোর বৃত্তে আছি তো, ইত্যাদি ব্যাপারে মন সজাগ রাখতে হবে। (২৯৯)




আবার বলি, আঙ্গিক জানা ভালো—সুরুতে না জানলেও বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই—ও আপনিই আসবে। অভিনয়ের সব চেয়ে বড় প্রয়োজন সহজ সাধারণ বুদ্ধি, যাকে ইংরাজীতে বলা যাবে Strong Common Sense, আর সেই বুদ্ধি প্রয়োগের জন্য একনিষ্ঠ সৎ প্রচেষ্টা। অভিনেতার পক্ষে অবশ্য সংগ্রহণীয়।

আর একটি কথা ব’লে আমার বক্তব্য শেষ করবো। সেটা হল অভিনেতার ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা। সাধারণ জীবনে আমরা বহু মানুষের সাক্ষাৎলাভ করি যাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিত্ব আছে—দশের মাঝে তাঁরা একক। এটা বহু সময় জন্মগত, কেউ কেউ এই ব্যক্তিত্ব নিয়েই জন্মান। অভিনেতার পক্ষেও তাই। এমন অনেকে আছেন যাঁরা স্টেজে, ফিল্মে এসে দাঁড়ালেই, রেডিয়োতে একটি কথা উচ্চারণ করলেই এই জন্মগত ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়। অভিনয়ের ব্যাপারটা তাঁদের কাছে অনেক সহজ হ’য়ে যায়। কিন্তু যাঁদের এই জন্মগত ব্যাপারটা নেই? তাঁদের দ্বারা কি অভিনয় হবে না? আমি বলি, না হবে, ব্যক্তিত্ব অর্জন করা যায়। নিরলস সাধনায় এই ব্যক্তিত্ব অর্জিত হয়। এর বহু বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে।

হতাশ হবার কিছু দেখি না। অভিনয় এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় যা সকলের নাগালের বাইরে। (৩০০)



(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.