অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

অন্যদের নিয়ে লেখা

বিকাশ রায়


[চারদশক ধরে বাংলা ছায়াছবির জগতে বিকাশ রায় ছিলেন এক সদালাপী উপস্থিতি, সেখানকার লোকজনদের সঙ্গে তাঁর ভালো চেনাজানা ছিলো, তাঁরাও বিকাশ রায়কে চিনতেন ভালো । তাঁর চারটি বইতেই তিনি সেসব মানুষদের নিয়ে লিখেছেন, দুটি বই তো শুধু তাঁদের নিয়ে সরস গল্পে ভরা। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। পর্দায় বা মঞ্চে মানুষদের ছায়ামাত্র দেখা যায়, আসল মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। এধরণের লেখা থেকে মানুষ অন্যদের সঙ্গে মানুষ বিকাশ রায়েরও এক ঝলক দেখা পাওয়া যাবে আমাদের এই আশা। তাছাড়া বিকাশ রায় সংবেদনশীল এবং গুণগ্রাহী লোক ছিলেন,তাঁর দৃষ্টিতে তখনকার চলচ্চিত্র-চিত্রকরদের ছবি, তাঁদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক, এরও হদিশ পাওয়া যাবে কিছুটা। বন্ধনী ভুক্ত পৃষ্ঠাসংখ্যার উৎস তাঁর বইয়ের একত্রিত খণ্ড "কিছু স্মৃতি, কিছু কথা"।]

 

এখানে কাজ করার সময়ে দুটি অসামান্য লোকের দেখা পেয়েছিলাম—একজন অন্নদা মুন্সী আর একজন সত্যজিৎ রায়। … সত্যজিৎ রায় বয়সে ছোট। অল্পদিন হল ছবি আঁকার কাজে ঢুকেছেন। আমার মনে পড়ে না যে আমার সঙ্গে তখন তাঁর আলাপও হয়েছিল কি না! আলাপ পরিচয় থাকলে, পরে তাঁর নামডাক হবার পর, পারি না পারি একটা পার্টও ওঁর কাছ থেকে আশা করতে পারতাম। ফিল্ম লাইনের সকলের কাছে নাক উঁচু করে বলতে পারতাম, ‘আরে মাণিককে ফিল্মে আসতে আমিই তো কফি হাউসের চেয়ারে বসে বসে ইনস্পায়ার করেছিলাম।’ কিন্তু বাস মিস করা, অর্থাৎ সুযোগের সুবিধে না নেওয়া আমার স্বভাব। (৪৪)




আর বীরেনদা [ভদ্র]! ব্রডকাস্টিং সম্বন্ধে যদি কিছু শিখে থাকি সে শুধু বীরেনদাকে অনুসরণ করে।(৪৩)




পুরাতনপন্থী অভিনয় সম্বন্ধে নির্মলদা [লাহিড়ী], আধুনিক কালের স্টেজের প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয় বিষয়ে শম্ভুবাবু [মিত্র], বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন রূপ সম্বন্ধে রাধামোহনদা [ভট্টাচার্য] আর সবার ওপরে বাগবৈদগ্ধ্যের চমৎকারিত্বে জ্যোতির্ময়বাবু [রায়] আমার অভিনয়ের সময়টুকু আনন্দে ভরিয়ে রাখতেন। পরিচালক হেমেনবাবু [গুপ্ত] ছিলেন ধীরস্থির মানুষ। কাজে একনিষ্ঠতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি আমার সামনে রেখেছিলেন, তা আমার কর্মজীবনে আমি কখনো ভুলি নি। (৫১)




আমাদের ফিল্মী দুনিয়ার রকমসকম বোঝা শক্ত। এখানে মাঝে মাঝে, মুখে মুখে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শিল্পীদের সম্পর্কে। একজন শিল্পী যখন নায়ক তখন যতটা লোকপ্রিয়, যখন নায়কের বাবা তখন নিশ্চয় ততটা থাকেন না। কিন্তু ততটা থাকেন না মানে লোকে যে তাঁকে একেবারে চায় না তা’ তো নয়। পাহাড়ীদা সম্বন্ধেও এক সময় এইরকম অলিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হোলো। বহু অকৃতজ্ঞ প্রযোজক, পরিচালক—যাঁদের জন্য পাহাড়ীদা হাসিমুখে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাঁরা ঠিক করলেন যে পাহাড়ীদা আর লোকপ্রিয় নন—সুতরাং তাঁরা ওঁকে বাদ দিলেন।

কিন্তু তাঁরা ভুল করলেন। আটষট্টি বছর বয়সে জীবনে প্রথম থিয়েটারে নেমে ‘আসামী হাজির’ নাটকে পাহাড়ীদা অভিনয় করলেন। এক সঙ্গে অভিনয় করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল—আমি দেখেছি তাঁর অভিনয় প্রতিভা দর্শককে কেমন মুগ্ধ করে রাখতো। তাঁর লোকপ্রিয়তা যে কমেনি, তা অগণিত দর্শকের অফুরন্ত প্রশংসা বার বার প্রমাণ করে দিত।

স্রেফ ভালো ভালো খাবার খেয়ে ও দুনিয়ার লোককে খাইয়ে, কাপড়জামা পরে, কলকাতার তাবৎ সংগীত আসর জমজমাট কবে, আর গোপনে কত লোককে কত টাকা দান ক’রে, একটা লোক লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিল—ভাবা যায়? ...

পাহাড়ীদা মারা যাবার পর ব্রজেন সেন কীর্তনিয়া আমাকে বলেছিলেন— ‘কী জানেন দাদা, গান গাইবার মজাটুকুই চলে গেল আসর খালি করে। ভালো লাগলে অমন হৈহৈ করে প্রশংসা আর কেউ করবে না।’ (১১৮)




চন্দ্রাবতী দেবী সাজতে ভালোবাসেন। এমনিতেই অপরূপ সুন্দর দেখতে—অল্প বয়সে ওঁর মত সুন্দরী বাংলা ফিল্‌ম-এ দ্বিতীয় আর একজনও ছিলেন না। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মনে পড়বে—মীরাবাঈ, দেবদাস, দিদি, এইসব ছবিগুলির কথা। স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে মেকআপ, সাজসজ্জার সাহায্যে আরও ফুটিয়ে তুলতে জানেন উনি। শুটিং-এ এই সব কাজের জন্য ওঁর বেশ কিছু সময় ব্যয় হতো।

... ছেলেমানুষের মত সরলমনের শিল্পীটি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। আজকাল বহু ছবিতে অভিনয় করেন না কিন্তু দশ-বারো বছর আগেও অনন্য স্ক্রীন পার্সোনালিটি, অভিনব প্রতিভা সব মিশে চন্দ্রাবতী দেবী সত্যি বাংলা ফিল্ম-এর ‘ম্যাডাম’ ছিলেন। (১২৮)




... এই মানুষটিকেই [ছায়া দেবী] ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিন, দেখবেন, কী অসামান্য অভিনেত্রী উনি। ওঁর ছবি আমি তো দেখছি প্রায় চল্লিশ বছর হোলো—সেই সোনার সংসার, বিদ্যাপতি, রিক্তা ছবি থেকে। আমি নিজেও অভিনয় করছি ওঁর সঙ্গে প্রায় সাতাশ আঠাশ বছর ধরে—‘আভিজাত্য’ ছবিতে ছায়াদেবী আমার মা সেজেছিলেন। তারপর কত ছবি—রত্নদীপ, অন্তরাল, আরোগ্য নিকেতন। বার বার মুগ্ধ হয়েছি ওঁর অভিনয়ে। ওঁর সঙ্গে একই সিনে অভিনয় করতে হলে কো-আর্টিস্ট- এর হৃদকম্প ধরিয়ে দিতে পারেন উনি। আর বড় ছোট পার্ট ওঁর কাছে নেই—আছে কোন পার্টে কী করবার আছে। ...

পুরোনো কথা ছেড়ে দিয়ে অধুনা কালের একটি ছবির কথা বলি! —হারমোনিয়ম্‌!’ শুধু ছায়াদেবীর অভিনয় দেখার জন্য আমি ছবিটি আরও বহুবার দেখতে পারি। (১৩০)




আমি বলি, ছবিদা ছিলেন, লাস্ট অফ দি অ্যারিস্টোক্র্যাট্‌স! তা কী অভিনয়ে, কী পারিবারিক চালচলনে। আগের দিন, জমিদার বাড়িতে মোলাকাত করতে গেলে যেমন না খেয়ে ফিরে আসা যেতো না তেমনি ছবিদার বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকেও কিছু না খেয়ে, আর বাগানের কিছু সবজি বগলদাবা না ক’রে আর মৌসুমী ফুলের তোড়া বা রাজকীয় গোলাপের একটা ছোট্ট ডাল হাতে না নিয়ে কেউ ফিরতো না। ছবিদাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। ছবিদা থাকতেন ভাড়াবাড়িতে কিন্তু বাড়িটাকে ব্যবহার করতেন নিজেদের বাড়ির মত। (১৭৪)




এই বারোটা স্টুডিয়ো তার সব কর্মী, কলাকুশলী! এদের কথা ভাবলে আজ মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। অর্ধেকের বেশী তো বন্ধই হয়ে গেছে—কর্মীরা কোথায় ছিটকে পড়েছেন, বেকার হয়ে কী করছেন কে জানে। ... প্রোডাকসন ম্যানেজার মণি দাশগুপ্ত। কী প্রতাপ ছিল, কথাবার্তার ঢঙ মেয়েলী ছিল বলে আমরা মণিপিসী বলতাম। বছরের পর বছর কাজ পেল না, আস্তে আস্তে ভিক্ষার জীবিকায় নেমে গেল, তারপর একদিন না খেতে পেয়ে কার বাড়ির রোয়াকে মরে পড়ে রইলো। নির্মল গুপ্ত ক্যামেরাম্যান—নিউ থিয়েটার্স-এর নামকরা ক্যামেরাম্যান। সপরিবারে কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্য টিউশানী, লটারীর টিকিট বিক্রি আরও কত কী করতেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি, প্রায় পনর বছর বাদে কি কিছু বেশীই হবে, ছবিতে আবার ক্যামেরাম্যানের কাজ করছেন। প্রাণ ধারণের উপায় করার গ্লানিতে ভদ্রলোক বেঁকে কুঁজো হয়ে গেছেন।

আরও কত কে—ইস্টার্ন টকীজের রামচন্দ্র, ইস্ট ইণ্ডিয়ার সাউণ্ড রেকর্ডিস্ট শচীনবাবু এম পির নারাণদা, রাধা ফিল্মসের হটো মাঝে মাঝে এদের কেউ কেউ খুচরো খাটতে স্টুডিয়োতে বা আউটডোরে আসেন।
দেখা হয় বলি, ‘কেমন আছো গো নারাণদা, হটো কেমন আছো? নারাণদা বলেন, ‘আছি দাদা, হেরে যাই নি।’ হটো বলে, ‘বাবু, আমাদের বোঝালে টেলিভিশন স্টুডিয়ো হ’লে কত বছর তোমরা লাইট নিয়ে নাড়াচাড়া করছো, তোমাদের আগে কাজ হবে, রাধা ফিল্ম-এর ঘর তোমরা ছেড়ে দাও। ... স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে গেল, মাইনে বন্ধ হোলো, খাবার টাকা বাইরে খেটে রোজগার করতে হতো। এখন ঘর ভাড়াটাও তার ওপর যোগ হয়েছে—দুঃখ কী বাবু, আপনারা সবাই আছেন, জুটে যাবেই।’

মণিপিসীদের মৃত্যুর লজ্জা আমরা স্বীকার না করলেও আমাদের বুকের ভেতর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকবে। নির্মল গুপ্তদের কুঁজো করে দেবার দায়িত্ব যে আমাদের, তা’ অস্বীকার করবার ক্ষমতা আমাদের নেই। হটোকে একথা বলার সৎসাহস আমদের নেই, যে যা যায়—তা’ যায়ই, ওদের জন্য আমাদের কারো কিছু করার ইচ্ছা, সময়, অবসর কিছুই নেই। (১৩১)




আমাদের ফিল্ম বাজারে লড়াইয়ের কাঁচা টাকার ঢেউ চলে গিয়ে, রীতিমত ভাঁটা এসে গেছে। এবং তার ধাক্কা আমাদের অর্থাৎ শিল্পীদের ওপরও এসে পড়েছে। বহু ক্ষেত্রে কন্ট্রাকট মত টাকা পাওয়া যাচ্ছে না, চুক্তির বহির্ভূত খাটতে হচ্ছে আর ছোটখাটো শিল্পীর তো নানারকম অসুবিধা ঘটেছে। আবার দু’ একজন নামী নামী আরো প্রযোজক বা সহশিল্পীদের সঙ্গে ব্যবহার ভালো করছেন না। আমাদের ঐক্য নেই সংহতি নেই, যে যার কাজ গোছাবার তালে ব্যস্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন ধরেই আমি ভাবছিলাম, সব শিল্পী মিলে একটি সংস্থা তৈরি করার কথা—যে সংস্থা শিল্পীদের ভালোমন্দ দেখবে, নিজেদের চেষ্টায় টাকাকড়ি সংগ্রহ ক’রে গরীব দুঃস্থ শিল্পীদের অল্পস্বল্প দেখাশোনা করবে, আবার, শিল্পীদেরও একটা ডিসিপ্লিনের আওতায় আনবে।

ভানু—ভানু বাঁড়ুজ্যে আমার ছোট ভাইয়ের মত। ওর সঙ্গে আমার আলাপ, বন্ধুত্ব অনেকদিন আগের—যখন আমরা কেউই ফিল্মে আসিনি। ... আমাদের দুজনের আড্ডা এবং পরামর্শ সব সময়েই সব ব্যাপারেই চলতো। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে একদিন শিল্পীদের এক সংস্থার আওতায় আনার কথা ভানুকে বললাম এবং সঙ্গে সঙ্গে সে লাফিয়ে উঠলো। যত শীগগির সম্ভব ব্যাপারটা ঘটিয়ে তোলবার জন্যে কাকে কী বলতে হবে তাই নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো। ... অগতির গতি ছবি বিশ্বাস। যে কোন সংগঠনমূলক কাজ, যে কোন নতুন উদ্যম—এই জমিদার নন্দনের কাছে পৌঁছুতে পারলেই হল। সব কিছু ছেড়ে উনি এগিয়ে আসবেনই।

... ছবিদার বলার ভঙ্গীতে সকলেই সংস্থা গড়তে রাজী হলেন। অভিনেতৃ সংঘের জন্ম হল।
অনেক শিল্পী এলেও প্রথমে আরও অনেকে আসতে রাজী হননি। কিন্তু পরে এই সংঘের উপকারিতা সবাই বুঝলেন—এক এক করে সবাই যোগ দিলেন। (১৭৫)




মাল খাওয়া! মানে মদ খাওয়া। মদ খাওয়া—মানে ‘প্রভু’। কে ‘প্রভু’? প্রভুর নিজের ভাষায় ‘প্রভৃতির আগের নৃপতি’। যে কোন ফিল্‌ম-এর আর্টিস্টদের নাম যখন বিজ্ঞাপনে দেওয়া হয় যেমন ‘ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, পাহাড়ী সান্যাল, অসিতবরণ, সন্ধ্যারাণী, চন্দ্রাবতী, রাম শ্যাম যদু নৃপতি প্রভৃতি’—সেই প্রভৃতি লেখার ঠিক আগেই যে নামটি বারবার দেখা যেতো সেই নৃপতি—নৃপতি চাটুজ্জে! নৃপতি চাটুজ্জে তার সময়ে প্রায় সব বইয়েই ছিল।

প্রভুর জোড়া নেই—ফিল্‌ম দুনিয়ায় কোথায় কার কাজ নেই, কোথায় কে খেতে পাচ্ছে না, সব ওর নখদর্পণে। পকেটে কিছু থাকলে দিয়ে দেবে। অন্যের কাছ থেকে ধার করে, ভিক্ষে করেও দেবে। আবার নিজের যখন কাজকর্ম নেই, খুব অভাব, তখনও আর একজনের জন্যে কাজ ঠিক করে তার বাড়ি বয়ে খবর দিয়ে আসবে। রোগা, ছিপছিপে, এতটুকু মানুষ, কিন্তু অত বড় হৃদয়—ভাবা যায় না (১৩৪)




সেবার হাওড়া জেলায় ভীষণ বন্যা হয়েছিল। মনে আছে অভিনেতা অভিনেত্রীর তরফ থেকে, বেঙ্গল মোশান পিক্‌চার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ খেকে আমরা কাজে নেমে পড়েছিলাম। পথে পথে লরী করে, পায়ে হেঁটে, সঙ্গীত শিল্পীরা গান গেয়ে আমরা অভিনেতা অভিনেত্রীর দল বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে বেরিয়েছিলাম। একদিন উত্তর কলকাতা, একদিন দক্ষিণ কলকাতা।

আর একদিন শুধু আমি আর উত্তম, সন্ধ্যার প্রাক্কালে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক পরিবৃত হয়ে সোনাগাছি পাড়ার মেয়েদের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কী সশ্রদ্ধ প্রাণখোলা আবাহন যে তাঁদের কাছে পেয়েছিলাম তা আজও ভুলতে পারি নি। স্পর্শ বাঁচিয়ে দূর থেকে প্রণাম করেছেন, আমাদের ঝুলি ভরে উঠেছে তাদের দানে। তাঁদের কাছেও সত্যিকারের কোন কাজে সাহায্যপ্রাথী হয়ে কেউ যে যেতে পারে, সেটুকু উপলব্ধি করে তাঁরা কৃতজ্ঞতায় অবনত হয়েছেন। আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকান নি পর্যন্ত। (১৪৭)




ওই বন্যার সময়েরই কথা— বিশুবেড়িয়া আর একটা গ্রামের কী যেন নাম—আমতা বাঁধের কাছে গাড়ি থেকে নেমে, মাইল তিন চার অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে হেঁটে ওখানে পৌঁছেছি। বাঁশের ওপর ছাউনি করে তখনো লোক বাস করছে বাঁধের ওপর—অন্ধকারেও তারা চাল চায়, কাপড় চায়।

ওই দুটি গ্রামকে বন্যার কবল থেকে উদ্ধার করে ঘরবাড়ি-মন্দির মসজিদ পাঠশালা পথঘাট তৈরি করে ওখানকার লোকদের খেতে পরতে দিয়ে আবার প্রায় স্বয়ম্ভর করে তুলবো-এই লক্ষ্য ছিল বেঙ্গল মোশান পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের। এক বছর লেগেছিল সব কাজ শেষ হতে। অনেকবার আমি ওখানে গেছি। (১৪৮)




তুলসী লাহিড়ী। তুলসীদা এমনই এক শিল্পী যিনি তাঁর সারাজীবনের পরিশ্রমের উপযুক্ত সম্মান পাননি। চিরকাল ইত্যাদি প্রভৃতির দলে রইলেন। তুলসী লাহিড়ী এক আঁতেল গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন বটে, কিন্তু নিজের নাম প্রচার কখনো চাননি—সেখানকার কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নাম প্রচারেই ব্যস্ত ছিলেন, তাই তুলসী লাহিড়ী আজ অচেনা।
তুলসীদার কথা আজকের মানুষ জানবেন না নিশ্চয় কিন্তু হাসির মধ্যে কান্নার আভাষ, যেরকম সহজ অভিনয় করে আজ আমরা নিজেদের পিঠ চাপড়াই সেইরকম অভিনয় তখনো কত সহজে তুলসীদা করতেন। এসব ছবির কাহিনী ও পরিচালনাও তুলসীদার ছিল। কমেডি নাট্যকার ও অভিনেতা বলেই আমরা তুলসীদাকে জানতাম। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর হাত থেকে বেরোলো ‘দুঃখীর ইমান’, ‘ছেঁড়া তার’ প্রভৃতি অসাধারণ সীরিয়াস নাটক—আর সে সব নাটকে তুলসীদা অভিনয় করলেন কড়া ভিলেন চরিত্রে। অভিনয় আমি নিজে অনেক করেছি কিন্তু তুলসীদার অভিনয়ের বিস্তৃতি কোন দিন অর্জন করতে পারিনি পারবোও না।

সেদিন পূজার রেকর্ড বাজিয়ে শুনছিলাম। হঠাৎ দেখি, অনুপ ঘোষাল সাহস করে সুন্দর গেয়েছেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া দুটি গান—‘আমায় বোলো না ভুলিতে বোলো না’, ‘আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশী বাজায়’। এই গান দুটি লিখেছিলেন তুলসী লাহিড়ী আর সবচেয়ে অবাক হবার কথা এই যে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর মত উঁচু দরের উচ্চাঙ্গসংগীত গায়ক, তুলসীদার দেওয়া সুরও গ্রহণ করেছিলেন।

... আত্মপ্রচার জানতেন না, সদানন্দ পুরুষ ছিলেন, উত্তরবঙ্গে কোন এক জমিদার বংশের সন্তান, আভিজাত্যের নকল গর্ব ছিল না—তাই সত্যিকার অভিজাত ছিলেন তিনি। (১৭৭)




‘মা ও ছেলে’ ছবির একটি তারকার কথা বলি। ... নতুন যাঁরা তাঁরা তো এই মধ্যবয়সীকে চিনবেনই না, আর পুরোনোদের মধ্যেও ক’জন যে চিনবেন তা’ আমার সন্দেহ আছে। এঁর নাম সাধনা বসু সে যুগের এক অসামান্যা নৃত্যকুশলী অভিনেত্রী। কেশবচন্দ্র সেন-এর নাতনী তিনি, বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা পরিচালক মধু বসুকে। বোধহয় আমাদের বয়সীই হবেন, হয়তো দু-এক বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু প্রথম যখন নিউ এম্পায়ারে ওঁদের দল ক্যালকাটা এমেচার প্লেয়ারস-এর ‘আলিবাবা’ দেখলাম, তখন আমি এবং আমার মত আরো অনেকে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠলাম। পার্ক সার্কাসে একটা বাড়িতে ওঁরা রিহার্সেল দিতেন। আমার মনে আছে আমরা সেই বাড়িটার চারপাশে ঘোরাফেরা করতাম। এই দলের মধ্যমণি ছিলেন সাধনা বসু—লাস্যে, নৃত্যে, অভিনয়ে একেবারে মাতিয়ে রাখতেন। ফিল্‌মেও ‘আলিবাবা’ করেছিলেন। তাঁর সেই ‘বাবা মুস্তাফা’ ডাকটা এখনো কানে বাজে। বাংলা, হিন্দী, ইংরাজীতে ছবি করলেন ‘রাজনর্তকী—কোরট ডানসার’।

তারপর কী সব হয়ে গেল-জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল সাধনা বসুর বহুদিন পরে তাঁর দেখা পেলাম ‘মা ও ছেলে’ ছবিতে। বাবুলালজী তাঁর নিজের ছবি ‘আলিবাবা’, ‘অভিনয়’ প্রভৃতির নায়িকাকে তারকার সম্মান দিয়েই নিয়ে এলেন কাজ করতে। আর ভালো কাজ করার কী প্রচণ্ড প্রচেষ্টা। কিন্তু হল না, আবার সব গুলিয়ে গেল। বহুদিন ধরে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে প্রথমে মারা গেলেন মধুদা আর তারও পরে সাধনা বসু। (১৯১)




আমার মনে হয় সঙ্গীতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া, অপরকেও সুরের ধারায় ডুবিয়ে দেওয়াই সত্যকে উপলব্ধি করা। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের সঙ্গীতের এই সত্য উপলব্ধি ছিল। মনে পড়ে কয়েক বছর আগের কথা। ইন্দিরা সিনেমায় কোন্ এক সঙ্গীত সম্মেলনে গাইছিলেন খাঁ সাহেব, ‘হরি ওঁ তৎসৎ’ ভজনটি। শাস্ত্রীয় মতে হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরুষ ভিন্ন ওঁ উচ্চারণ করার অধিকার নেই। কিন্তু এমনি একজন অনধিকারীর মুখে বার বার ‘হরি ওঁ’ শুনতে শুনতে আমার রোমাঞ্চ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এঁদেরই ঈশ্বর দর্শন হয়, এঁরাই সত্যের সন্ধান দিতে পারেন। (১৩৯)




নরেশদার [মিত্র] কথা বলতে শুরু করেছিলাম। একদা নাট্যশিক্ষক বলে নরেশদার নাম ছিল। আর তিনি যে কত বড় অভিনেতা ছিলেন, তা দু-চার কথায় বলে বোঝানো যাবে না। থিয়েটার বা ফিল্ম-এর উপযুক্ত চেহারা নয়—বেঁটেখাটো মানুষটি। কণ্ঠস্বর পাতলা—অন্য কারো এরকম গলার স্বর হলে কোন সুযোগ পাওয়ারই সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও নরেশদা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অভিনেতা হিসাবে। আর তাঁর শিক্ষকতার জোরে বহু সাকসেসফুল ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। সদানন্দ পুরুষ ছিলেন ... ‘অভিনেতৃ সংঘ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ওই সূত্রে প্রায়ই আমার যেতে হত তাঁর কাছে, আমাকে ভালোও বাসতেন খুব। (১৯৮)




[সাজঘর ছবিতে] সেও এক গল্প, ছবিদার পাহাড়ীদার মহানুভবতার গল্প, আমি একা প্রোডিউসার—টাকাকড়ি সবই আমার আর আমার ডিস্ট্রিবিউটর-এর। ভয়ে ভয়ে এগোতে হচ্ছে। ... ছবিদার ওই সেটে চার-পাঁচ দিনের কাজ। শুটিং শুরুর একদিন পরে খবর পেলাম ছবিদা খুব অসুস্থ। বিছানায় ব’সে বুকে বালিশ দিয়ে হাঁপানিতে অমানুষিক কষ্ট পাচ্ছেন, সারা মুখে এলার্জি বেরিয়েছে। অত কষ্ট পাচ্ছেন তবু ওরই মধ্যে আমার কথা ভাবছেন।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘এবার দু-চার দিনে তো সেরে উঠবো না। বিকাশ কত হাঙ্গামা করে, খরচ করে তুই সেট তৈরী করেছিস, তুই অন্য কাউকে নিয়ে নে।’
আমি বললাম, ‘না, তা কী করে হয়, সেট ভেঙে দেব—আপনি সুস্থ হলে আবার তৈরী হবে।’
বললেন, ‘পাগলামি করিস নে, কত টাকা ক্ষতি হবে বল তো! আমি তো একদিন মোটে কাজ করেছিলাম একটা ছোট ঘরের সেটে। সেই কাজটা ফেলে দে।’
অজয়বাবু [কর] এবং আমি আবার আপত্তি জানালাম। ছবিদা কানেই তুললেন না কথাটা।
বললেন, ‘পাহাড়ীকে পার্টটা দে!’
আমি বললাম, ‘কী বলছেন। পাহাড়ীদা করবেনই বা কেন?’
ছবিদা বললেন, ‘করবে, আমি বললেই করবে। পাহাড়ীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস।’
আমরা চলে এলাম, সেট ক্যানসেল করবো ঠিক করলাম। বিকেলের দিকে হঠাৎ পাহাড়ীদার ফোন, ‘হারামজাদা, ডেটগুলো পাঠিয়ে দাও শীগগির।’
আমি কিছু বলবার আগেই পাহাড়ীদা বললেন, "ছবি বিশ্বাস ছেলেকে দিয়ে টেলিফোনে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে হুকুম করেছেন। সে শালার কথা তো অমান্য করতে পারিনে। ডেটগুলো বল—’।
পাহাড়ীদাই শেষ পর্যন্ত পার্টটা করলেন।
এই ছিলেন আমাদের তখনকার দাদারা—এই ছবিদা পাহাড়ীদার সঙ্গে কাজ করা, তাঁদের ভালবাসা পাওয়া, এ আমার পরম সৌভাগ্য। (২০৫)




তপন সিংহের ছবিতে অভিনয় করতে আমার ভালো লাগে। ভদ্রলোকের একটা শান্ত ব্যক্তিত্ব আছে, চেঁচামেচি করেন না, জোর জবরদস্তি করেন না। কিন্তু শিল্পীকে দিয়ে নিজের চাহিদা মত অভিনয় করিয়ে নেন। (২১১)




শিশিরকুমারের [ভাদুড়ী] সমসাময়িক আর একজন স্বনামধন্য প্রতিভাবান নট—অহীন্দ্র চৌধুরী। নিজে তো অসাধারণ অভিনেতা ছিলেনই, এ ছাড়াও নাট্যপ্রযোজনা, নাট্যশিক্ষাদান ক্ষেত্রে তাঁর দানও অপরিসীম। শেষ জীবনে তো রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের ডীন হয়ে নাটক ও অভিনয় শিক্ষার সমস্ত কার্যক্রম একক প্রচেষ্টায় তৈরী করেছিলেন। অথচ প্রবেশিকা পরীক্ষার পর তাঁর আর কোন নিয়মমাফিক শিক্ষা ছিল না। সারাজীবন কি অভিনেতা হিসাবে, কি নাট্যপরিচালক, শিক্ষক হিসাবে অগাধ অধ্যবসায় এবং পড়াশুনা তাঁকে সবারই মধ্য থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছিল। (২৭৫)

 

আজকের নাট্যজগতে, তা’ পেশাদারী বা অপেশাদারী যাই হোক্ না কেন শম্ভু মিত্র একটি নাম! শম্ভু মিত্র অনন্য—গত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে তিনি প্রযোজনায়, পরিচালনায়, নাটক রচনা ও সর্বোপরি অভিনয়ে একটি নূতন ধারা প্রবর্তন ও প্রবর্ধন করেছেন। চল্লিশ দশকেরও আগে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে কিছুদিন যুক্ত ছিলেন, তারপরে কখনো পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে যান নি। তাঁর নেতৃত্বে যে নাট্য-আন্দোলন সুরু হয়েছিল, আজ তা’ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গেছে। এখন মোটামুটি অবসর নিয়েছেন বটে, কিন্তু কোন নাটকে কোন ভূমিকায় তিনি নামবেন বিজ্ঞাপিত হলে ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই হাউস ফুল হয়ে যায়। (২৮২)




এর পরে আসি আধুনিক কালের এক প্রখ্যাত নট, নাট্যকার ও পরিচালক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর অভিনয় বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার কথায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পেশাদারী লোক—যথেষ্ট কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পশ্চাৎপট নিয়েই এই পেশাকে বরণ করেছেন। নাক উঁচু কৃষ্টিবানদের নস্যাৎ ক’রে দিয়ে, উনি সাধারণ এবং সাধারণের বাইরে যাঁরা, তাঁদের সকলেরই প্রিয় হয়েছেন, অভিনয় জগতের বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে। (২৮৯)




ত্রিশ বছর আগে আলাপ। আলাপ থেকে পরিচয়। এবং পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর ধরে বড় ভাই আর ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক। একসঙ্গে অনেক ছবিতে অভিনয় করলাম। আমার পরিচালনায় উত্তম কাজ করল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘রাজা সাজা’, এবং ‘কাজললতা’—তিনটে ছবিতে। আমি ওর পরিচালনায় কাজ করলাম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে। কাজে কাজেই এতদিনের সম্পর্কে কিছু গল্প আসেই।

উত্তম আর আমার গল্প অনেক আছে। কিন্তু সব তো বলা যায় না। তবে শোকসভায় আমি একটা কথা বলেছিলাম সেটাই আবার বলি—আমরা দু’জন প্রায় সমসাময়িক, যদিও বয়সে আমি তার চেয়ে অনেক বড়—দশ বছরের। আমরা প্রায় একই সময় ফিল্মে অভিনয় করতে আসি। আমার খুব নাম হ’ল, লোকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল—ঐ বিকাশ রায়। আমি খুব খুশী হলাম। উত্তম কোথায় পেছনে ছিল—খেয়ালও করিনি। কিন্তু উত্তম একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায় দিয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এল। তারপর আমি কিছু বোঝবার আগেই ও আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেল। যখন বুঝতে পারলাম তখন সে অনেক দূরে, অনেক, অনেক দূরে—একটা জ্যোতিষ্ক। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে ক্ষোভ হল নিশ্চয়ই। কিন্তু সান্ত্বনা পেলাম এই ভেবে, আমি তো দশ বছরের বড়! শেষ রেসে আমি ওকে হারিয়ে দেবোই। কিন্তু এত নিষ্ঠুর, এত অকৃপণ উত্তম, যে এবারেও আমাকে হারিয়ে দিয়ে রাজার মতো চলে গেল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। (২২১)

 

"যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।"




(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.