বিকাশ রায়কে নিয়ে লেখা -- সঙ্কলন
[চার দশক পর্দা আর মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কাগজে-পত্রে এমন লোককে নিয়ে অনেক কিছু লেখা থাকার কথা, বিকাশ রায়ের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। তার বেশীর ভাগই হারিয়ে গেছে, পাওয়া গেলেও প্রসঙ্গ-বহির্ভূত সেসব লেখার আজকে খুব একটা দাম হতো না। তবে তাঁর তদানীন্তন সহকর্মীদের মতামত থেকে শিল্পী ও মানুষ বিকাশ রায়ের একটা ছবি পাওয়া যায়, তাঁর চরিত্রের কিছু নতুন দিকও প্রতিভাত হয়। বিকাশ রায়ের বই "কিছু স্মৃতি কিছু কথা"-তে সম্পাদক অমিয় সান্যাল মশায় পরিশিষ্ট হিসেবে তার এক সঙ্কলন দিয়েছেন, সেখান থেকে কিছু (এবং অন্য দুয়েকটা) উদ্ধৃতি দেওয়া হলো।
বিকাশ রায়ের প্রয়াণ ১৯৮৭ সালের ষোলোই এপ্রিল। পশ্চিমবাংলার ইংরেজী আর বাংলা সব পত্র-পত্রিকায় সে সংবাদ দেওয়া হয়েছিলো, অনেক বিশেষ স্মরণ সংখ্যাও প্রকাশ করা হয়। সংক্ষিপ্ত কিন্তু সেই কালের বিচারে তাঁর উৎকৃষ্টতম কাজের হদিশ পাওয়া যায়। সন্ধানী পাঠক তাঁর শৈলীর ব্যাপ্তির একটা আন্দাজ পাবেন। প্রয়াণনৈকট্যের কারণে সব বিবরণ শাণিত নাও হতে পারে কিন্তু গভীর অনুভূতিস্পৃষ্ট।]
উত্তমকুমার :
কাননদেবী :
রঞ্জিত মল্লিক :
সন্ধ্যা রায় :
মৃণাল সেন :
তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সভ্য, সচেতন এবং সজাগদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। আমার সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।-- আজকাল পত্রিকা, ১৭ই এপ্রিল ১৯৮৭, বিকাশ রায়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর।
তপন সিংহ :
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় :
অনিল চট্টোপাধ্যায় :
সব ধরণের চরিত্রে তিনি ছিলেন সাবলীল। বিকাশদা আসলে খুব উঁচুমাপের অভিনেতা। খারাপ চেহারা নিয়েও শুধু ভাল অভিনয়ের গুণেই বিকাশ রায় বিকাশ রায় হতে পেরেছিলেন। আজকে যারা চেহারা না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র অভিনয়ের জোরে জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে তুলনা না করেও বলা যায় বিকাশ রায় অনেক আগেই এটা প্রমাণ করেছিলেন। কিন্তু সে ধরণের সম্মান তিনি পাননি এটাই বড় দুঃখের। -- আজকাল পত্রিকা, ১৭ই এপ্রিল ১৯৮৭, বিকাশ রায়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর।
তরুণকুমার :
বসন্ত চৌধুরী :
অসিতবরণ :
রামানন্দ সেনগুপ্ত :
বেলা মুখোপাধ্যায় :
বিকাশ রায়ের ছবি। ওঁর ছবি মানেই গানের ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষার চূড়ান্ত। পর পর একই সুরকারকে দিয়ে কাজ করানোর পক্ষপাতী নন বিকাশবাবু। সূর্যমুখী-র সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমার স্বামীকে। পরের ছবি নতুন প্রভাত। দায়িত্ব পেলেন নচিকেতা ঘোষ। পরের ছবি -- বসন্তবাহার-এর সঙ্গীত পরিচালক আবার ধ্রুপদী সঙ্গীতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, যিনি সদ্য প্রয়াত হলেন। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনা হল তার পরের ছবি মরুতীর্থ হিংলাজ-এ। (১৩১) --, "আমার স্বামী হেমন্ত", সাহিত্যম্, ১৯৯৯
প্রয়াণের পরে ....
(পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত)
![]() |
সৌমিত্রবাবু বলেন, অভিনয় ছাড়াও বিকাশদা অসাধারণ আবৃত্তিও করতে পারতেন। শ্রুতিনাট্য যে আজ অত জনপ্রিয় হয়েছে, তার পিছনে বিকাশদার অবদান কম নয়। আরো বলেন ১৯৫৮/৫৯ সালে এক ভয়াবহ বন্যা হয় পশ্চিমবঙ্গে। বন্যার পর অর্থ সংগ্রহের জন্য তখনকার দিনের খ্যাতনামা শিল্পীরা পথে নেমেছিলেন। শিল্পীদের সেই মিছিলেই বিকাশ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। অসিতবাবু [অসিত চৌধুরী, নামকরা পরিবেশক] বলেন, সেদিনের সংগ্রহ করা টাকা দিয়ে হাওড়া-আমতায় দুটি গ্রামকে তাঁরা নতুন করে দাঁড় করিযেছিলেন। বিকাশবাবু তখন ওই গ্রামে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
-- আনন্দবাজার পত্রিকা
এক নিঃশ্বাসে মনে পড়ার মত কয়েকটা [ছবির] নাম আরোগ্য নিকেতন, উত্তরফাল্গুনী, কাঁচকাটা হীরে, মরুতীর্থ হিংলাজ. কেরী সাহেবের মুন্সি। ... ওঁর অভিনয়ের স্বীকৃতি সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ক্ষমতাবান শিল্পী ছিলেন তিনি চরিত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ রায় পরিণত হয়েছিলেন।
সিনেমা পরিচালক হিসাবে বিকাশ রায়কে প্রথম দেখা গেল "অর্ধাঙ্গিনী" ছবিতে। রুচিপূর্ণ ব্যবসায়িক ছবির নির্মাতা হিসাবে তাঁর নাম টালিগঞ্জে অস্বীকৃত নয়। "বসন্ত বাহার"-এর মতো মিউজিকাল, "রাজা সাজা"-র মতো ব্ল্যাক কমেডি কিংবা "কেরী সাহেবের মুন্সি"-র মতো ইতিহাস আশ্রিত আবেগধর্মী আমোদদায়ী ছবি করায় তিনি ছিলেন অনন্য। "মরুতীর্থ হিংলাজ"-ও তাঁর একটি জনপ্রিয় ছবি।
--যুগান্তর (নির্মল ধর)
ভুলি নাই, জিঘাংসা, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-ও-অন্নদাদিদি, সাজঘর, সূর্যমুখী, বসন্তবাহার, রাজাসাজা, উত্তরফাল্গুনী, কাঁচকাটা হীরে, অভয়া ও শ্রীকান্ত, অগ্নিসংস্কার, দাদু, না, মেঘ ও রৌদ্র, সব্যসাচী প্রভৃতি অসংখ্য ছবির কথা উল্লেখ করা যায় যা তাঁর অভিনয়-প্রতিভার স্বাক্ষরে ভাস্বর হয়ে আছে।
-- আজকাল নিজস্ব সংবাদদাতা, আজকাল
বাংলা চলচ্চিত্রাকাশের সর্বজনপ্রিয় বিকাশ রায় দুশোর বেশী বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের বিশাল দর্শকের কাছে বিকাশ রায় ছিলেন মধুর স্মৃতি ও কিংবদন্তীতুল্য অভিনেতা। তাঁর ভুলি নাই, রত্নদীপ, উত্তরফাল্গুনী, কে তুমি, কাঁচকাটা হীরে, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-ও-অন্নদাদিদি, '৪২, আরোগ্য নিকেতন, মরুতীর্থ হিংলাজ প্রভৃতি ছবির অভিনয় দর্শকেরা কখনো ভুলবেন কি? ... [এছাড়া] পরিচালক ও প্রযোজক হিসাবে ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিকাশ রায়ের নাম দীর্ঘদিন উচ্চারিত হবে।
-- বর্তমান
SKILLED ACTOR
In 1984, Bikash Roy did something unheard of for a film actor. He called a press conference and announced his retirement frrom the show business. ... Since he had hs training in the days of live broadcsats, his subsequent success in "Shruti Natak" became a foregone conclusion.
Though Roy was not particularly good-looking, through sheer acting skill he could play hero to Suchitra Sen in Amar Bou. ... [Carey Sahhber Munshi] features his memorable Ramram Basu. Equally impressive is his portrayal of an insurance agent in Jiban Kahini. ... On the commercial stage, Roy's credits consist of Arogya Niketan (he also appeared in the film), Chowringhee and Nahabat. His Rasik in a play-reading of Chirakumar Sabha found many admirers.
---STATESMAN April 18, 1987
HERO AND VILLAIN PAR EXCELLENCE
With the death of Bikash Roy, the golden era of Bengal film industry ends. The versatile hero who could play villain and hero wth equal ease retired three years ago, but remained an inspiration to aspiring stars. The Bikash Roy-Chhabi Biswas duo was a power to reckon with for over three decades and today Tollygunge loses one of its last stalwarts. ... When he retried from films in 1984, critics and filmgoers alike were dismayed. His death brings down the curtain on an illustrious career and the Bengali screen, crippled as it is by lack of virtuoso performers, loses an actor with parallel.
-- Telegraph April 18, 1987
On hearing of his death Satyajit Roy said though he never worked with Bikash Roy, he had a great regard for him. Mrinal Sen said "as an actor Bikash Roy made his mark. He was a pleasant, civilised, and informed person with whom one could talk for hours."
Some of his notable films include Jighansa, Saajghar, Chheley Kar, Carey Sahaber Munshi, Uttar Phalguni, Marutirtha Hinglaj, Kanch Kata Heeray, Jatugriha, Arogya-Niketan, Arohi, Prastar Swakhar. ... The popular image of Bikash Roy had been that [of] a villain and his portrayals in such roles were indeed remarkable. He had also brought out with ease the intricacies of human emotions as evinced by his performances in Arogya Niketan and Ratnadeep. Not quite handsome in the conventional sense, his face did demonstrate a measure of plastic sensibilities complemented by his sonorous voice.
-- AmrtiaBazar Patrika
প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, এডিটর থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই একবাক্যে বিকাশ রায়ের সুন্দর ব্যবহারের কথা বলেছেন। শুধু এঁরা নন, স্টুডিওর সাধারণ কর্মী, প্রোডাকশন এ্যাসিস্টাণ্টদের সাথেও বিকাশ রায়ের ছিল এমনি মধুর ব্যবহার। সে কথাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানালেন প্রোডাকশনের লক্ষ্মীকান্ত দত্ত। স্টুডিওতে কাজে লেগেছেন সেই বড়ুয়া সাহেবের আমল থেকেই। কর্মসূত্রে বহুবার বিকাশ রাযের সংস্পর্শে এসেছেন। কতবার কত অভাব অভিযোগে বিকাশ রায় মুক্তহস্তে সাহায্য করেছেন। শোনা ছিল বড় শিল্পীরা নাকি নানা রকম বায়না করেন। তাই এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই লক্ষ্মীদা জানালেন -- না বাবু। অমন নিপাট ভালমানুষ আমার এই স্টুডিও-জীবনে খুব কমই দেখেছি। ... বাবু, ওনার মত বড় মনের মানুষ আজ আর দেখি না। কখনও আমাদের হেনস্তা করতেন না। ভাল মুখে বাবা-বাছা বলে কথা কইতেন। কাজ ছেড়ে চলে যাবার পরও যখনই ওনার সাথে দেখা হযেছে আমাদের সবার কুশল জিজ্ঞেস করেছেন। এমন কজন হয় বলুন?
-- মানব ব্রহ্ম, প্রসঙ্গ বিকাশ রায়, উল্টোরথ, মে ১৯৮৭
বিকাশবাবু চার বছর সংকল্প নিয়ে দুর্গাপূজা করেছিলেন। দ্বার খোলা ছিলো, সবাই আসতে পারতেন, পর্দা-মঞ্চ-বেতারজগতের অনেকেই আসতেন।
সবচেয়ে জমকালো আসাটা ছিলো বিজয়া দশমীর দুপুরে। সেদিন আসতেন কোলকাতার সমস্ত স্টুডিও আর মঞ্চের কর্মীরা, সপরিবার ও সবান্ধবে। এঁদের প্রোডাকশন অ্যাসিস্টেণ্ট বলা হতো, কায়িক শ্রমের সব কাজ করতেন এঁরা, লাইট ফেলা থেকে শুরু করে ফ্লোর ঝাঁট দেওয়া। প্রথম পুজোতে বিকাশবাবু সব স্টুডিও-মঞ্চ ঘুরে এঁদের নিমন্ত্রণ করে এসেছিলেন। ভিয়েন করে, ম্যারাপ বেঁধে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা হতো -- খিচুড়ি, বেগুনী, পাঁচমিশালী তরকারী, চাটনি, পাঁপড়, দই, বোঁদে আর পানতুয়া। বিকাশবাবুর অন্য কোনো সহকর্মী -- অনিল চ্যাটার্জি, অসীম পাল, গুরু বাগচীর কথা মনে আসছে -- পান সিগারেট জোগান দিতেন। আমাদের বাড়ী ছিলো তখন ফাঁকা যোধপুর পার্কে, মাঠের শেষে। নিমন্ত্রিতরা আসতেন সদলে মাঠ পেরিয়ে, কোনো কোনো দল হতো দশ-পনেরো জনেরও বেশী। তারপর দীয়তাং ভুজ্যতাম্, আমরা পরিবেশন করতে হিমসিম খেয়ে যেতাম, আমন্ত্রিতদের মধ্যেই জোয়ান যাঁরা তাঁরা আমাদের সরিয়ে দিয়ে কাজে লেগে যেতেন। খাওয়ার পর "দুর্গামাইকী জয়" বলে তাঁরা ঠাকুর বিসর্জন দিতে চলে যেতেন, পরের বছরে আসার নিমন্ত্রণ নিয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকের এটিই ছিলো বছরে সপরিবারে ভূরিভোজনের একমাত্র সুযোগ।
-- সুমিত রায়, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ
সেবার একই বছরে বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির জগৎ হারাল বেশ কয়েকজনকে। প্রথমেই বিদায় নিলেন বিকাশ রায়। সুভদ্র, সুরসিক, সংস্কৃতিবান হিসেবে বাংলা ছবির জগতে যে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তিত্ব আছেন, বিকাশ রায় তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।(২২৫)
-- বেলা মুখোপাধ্যয়, "আমার স্বামী হেমন্ত", সাহিত্যম্, ১৯৯৯
বিকাশ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতা। তাঁর অভিনয় ছিল বহুমাত্রিক। বাংলা ছবির গড্ডলিকা প্রবাহে বহু আজে বাজে ছবিতে কাজ করলেও, বিকাশ রায়ের অভিনয় বরাবরই ছিল অসাধারণ।
--অনুপকুমার, আজকাল
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.