অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

অনন্য কন্ঠসম্পদে সমৃদ্ধ

ভাস্কর বসু

 

বিকাশ রায় তাঁর জীবন শুরু করেন রেডিওর ঘোষক ও নাট্য প্রযোজক রূপে। সুতরাং তাঁর অভিনয়ের এক অন্যতম সম্পদ তাঁর কন্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গী। আমরা যারা ষাটের আর সত্তরের দশকে মফস্বলে বেড়ে উঠেছি, রেডিওর মাধ্যমেই অনেক বিখ্যাত অভিনেতাদের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটেছে। কলকাতা শহরে আমাদের যাতায়াত খুব বেশী হয়ে উঠত না আর গেলেও সেভাবে ছোটদের সিনেমা দেখার চল ছিলনা। দূরদর্শনের তখনো আবির্ভাব ঘটেনি। কাজেই বিকাশ রায়ের অভিনয়ের সঙ্গে একটি সদ্য কিশোর ছেলের প্রথম পরিচয় রেডিওর মাধ্যমেই। (ওঁর কবিতা পাঠ* শুনতে চাইলে ক্লিক করুন ; থামাতে চাইলে দ্বিতীয় বার ক্লিক করুন।)

তখন বিবিধ ভারতীতে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুষ্ঠান হত। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমরা নেহাৎই নাবালক। আমাদের জন্যই একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হত যার নাম ‘সুচিত্রার সংসার’। সুচিত্রার ভূমিকাতে ছিলেন জয়শ্রী সেন, তাঁর স্বামী শংকরের ভূমিকাতে ভানু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রাণের বন্ধু প্রিয়তোষের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হলেন এক তরুণ অভিনেতা পরবর্তী কালে যিনি ‘রেডিওর উত্তমকুমার’ নামে খ্যাতিলাভ করবেন – গৌতম চক্রবর্তী। আর গৌতম চক্রবর্তীর বিপরীতে থাকতেন পরবর্তীকালের এক বিখ্যাত মহিলা বাচিক শিল্পী শ্রী ঊর্মিমালা বসু। সুচিত্রা-শংকরের ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব ছিল ‘সরমা’ বলে একটি দুঃখী মেয়ের। তারপর তার সঙ্গে প্রিয়তোষ (গৌতম চক্রবর্তী) এর প্রেম ও পরিণয়। বলা বাহুল্য, এনারা সকলেই তখন আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছেন। এই সময় একটি এপিসোডে এলেন ‘বিকাশ রায়’!! ঘটনাচক্রে প্রিয়তোষ একটি অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে ফেলে এবং থানায় জানায়। তারপর পুলিশ সাক্ষী হিসাবে আদালতে পেশ করে প্রিয়তোষকে। আসামী পক্ষের উকিল ছিলেন বিকাশ রায়। উফফ!! তখনই প্রথম তাঁর বাচিক অভিনয়ের সাক্ষী ছিলাম। আশ্চর্য হয়েছিলাম, আসলে মুগ্ধতার চেয়ে রাগ হয়েছিল বেশী!! আমাদের প্রিয় প্রিয়তোষকে তিনি এইভাবে জেরায় জেরবার করছেন!! প্রায় চার দশকের ও আগের ঘটনা, কিন্তু মনে গেঁথে গেছে তাঁর সেই প্রাণবন্ত অভিনয়। শেষে প্রিয়তোষ রেগে মেগে হার স্বীকার করার পর সেই দুঁদে উকিল একটি “হে, হে” করে দারুণ হাসি দেন যা মনে করায় তাঁর আত্মপ্রত্যয়কে। তখনই প্রথম বড়োদের কাছে জেনেছিলাম, এই কন্ঠধারীর নাম বিকাশ রায়।

এরপর আরো একটি বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা প্রচারিত অনুষ্ঠানে শুরু হল শরৎচন্দ্রের “পথের দাবী”। এর মূল চরিত্র সব্যসাচীর ভূমিকাতেই ছিলেন বিকাশ রায়। সব্যসাচী চরিত্রটি তার নামের মতই বহুমুখী, শুধুমাত্র বাচনভঙ্গীর তারতম্যেই বিকাশ রায় সেই বহুমুখীনতাকে আমাদের কাছে এনে উপস্থিত করতেন। এই ধারাবাহিকটিতে অন্যান্য বহু নামী বাচিক শিল্পীরাও অভিনয় করেছিলেন। সুমিত্রার ভূমিকাতে ছিলেন শ্রীমতী কেয়া চক্রবর্তী। এই চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল সত্যিই শ্রুতিনন্দন! অনেক ছোট ছোট জায়গাতে মনে পড়ে যায় তাঁর বাচনভঙ্গী। যখন অপূর্বর অক্ষমণীয় অপরাধ প্রমাণিত হয়ে গেল, সুমিত্রা সমবেত সদস্যদের মতামত নিয়ে ঘোষণা করেন,-
-‘অপূর্ববাবু, আমরা ডেথ্‌সেন্‌টেন্স দিলাম। কিছু আপনার বলার আছে?’
এইটি উপন্যাসের পালাবদলের সময়। সব্যসাচীরূপী বিকাশ তাঁর গভীর কন্ঠস্বরে সুমিত্রাকে প্রশ্ন করেন-
-‘সুমিত্রা, তুমি বললে ডেথ্‌সেন্‌টেন্স আমরা দিলাম। কিন্তু ভারতী দেয়নি’
এরপরে যেন পুরো ঘটনার ওপর তাঁর কর্তৃত্ব তাঁর গলার স্বরের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়ে যায়। শেষে আবার যখন বলেন –
‘ভাল খেতে পাইনে ভারতী, আধপেটা খেয়েই প্রায় দিন কাটে,—তবুও ওরা জানে এই ক’টা সরু আঙুলের চাপে আজও ব্রজেন্দ্রের অতবড় বাঘের থাবা গুঁড়ো হয়ে যাবে, কি বল ব্রজেন্দ্র?’
তার মধ্যে সেই শান্ত, সমাহিত আত্মপ্রত্যয়।
উপন্যাসে পড়ি – ‘পিঠের উপর স্নেহস্পর্শ বুলাইয়া তেমনি সহজ গলায় কহিলেন, ভয় নেই ভারতী, অপূর্বকে আমি অভয় দিলাম’। বিকাশ রায়ের স্নিগ্ধ বাচিক অভিনয়ে সেই ‘স্নেহস্পর্শ’ আমরা যেন চোখ বন্ধ করে দেখতে পেতাম।

“পথের দাবী”র একটি উজ্জ্বল চরিত্র একজন মারাঠি ব্রাহ্মণ, নাম রামদাস তলওয়ারকর। সে অপূর্বর সহকর্মী। বয়স বোধ হয় তারই মত,—হয়ত বা কিছু বেশি। এই চরিত্রে ছিলেন আমার আর এক প্রিয় শিল্পী শ্রী দিলীপ রায়। দিলীপের গভীর অথচ একটু খসখসে কন্ঠস্বরের সঙ্গে তলোয়ারকরের চরিত্র খুবই মানানসই হয়েছিল। যখন রামদাস তলওয়ারকর জিগ্যেস করছে,
‘আবার কবে দেখা হবে’?
সব্যসাচীর উত্তরে-
‘নীলকান্ত যোশীর শিষ্য তুমি, এ আবার কি প্রশ্ন তলওয়ারকর’?
এই কথা বলার সময়ে যুগপৎ ভর্ৎসনা ও সেই বিপ্লবীর (নীলকান্ত যোশী) প্রতি শ্রদ্ধার মিশেল। সত্যি, শুধুমাত্র কন্ঠস্বরের ওঠানামা আর বৈচিত্র্য দিয়ে এইরকম বর্ণময় চরিত্রকে কিভাবে জীবন্ত করা যায় বিকাশ রায়ের সব্যসাচী তাঁর এক অত্যুত্তম উদাহরণ।

এর পরে পরেই এল মহানায়ক অভিনীত ছায়াছবি “সব্যসাচী”। আমরা দেখিনি, কিন্তু বড়রা, এমনকি মহানায়কের ভক্তরাও দেখে খুবই আশাহত হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন যে সব্যসাচী চরিত্রে বিকাশ রায়ের বাচিক অভিনয় এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যাকে অতিক্রম করা খুবই শক্ত। এমনকি ‘নহবৎ’ নাটকটিও আমার দেখার সুযোগ হয়নি। সেখানেও ভরসা ছিল ঐ রেডিওই। নাটকের বিজ্ঞাপনের রেডিও অনুষ্ঠান শুনেই আমাদের অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচয় হত। সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি মোলাকাত ছিল বাড়ীর জামাই তরুণকুমার আর বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বিকাশ রায়ের মধ্যে। আর শেষের কবিতার নাট্যরূপ ও সেখানে কথকের ভূমিকাতে তাঁর বাচিক অভিনয় তো বরাবরই শ্রেষ্ঠত্বর দাবী করে এসেছে।

এরপর কলকাতা দূরদর্শনের আবির্ভাব। আমি ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম তাঁর চিত্রাভিনেতা সত্ত্বার সঙ্গে। তবে আজও বিকাশ রায় মানেই আমার সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি কিন্তু – “পথের দাবী”র সব্যসাচী।


*রেকর্ডটি করা হয়েছিল বিকাশবাবুর ৭০ বছর বয়সে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - অডিও লিঙ্ক ইউটিউব থেকে নেওয়া

লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.