আলোছায়াময়
কেয়া মুখোপাধ্যায়
আমার ছেলেবেলায় মায়াময় দিনগুলোর একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল রেডিয়ো। শুক্র, শনি আর রোববারে বাড়ির সবাই মিলে নাটক শোনা- এই হারিয়ে যাওয়া ছবিটার জন্যে আজও ভারি মন কেমন! না, কিছুই দৃশ্যমান নয়। সবটাই শ্রাব্য। শুধু কন্ঠ দিয়ে আর আশ্চর্য স্বরক্ষেপণে অজানা, অদেখা কিছু মানুষ গল্পের এক একটা চরিত্র হয়ে উঠে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-আবেগ, হাসি-কান্না হীরা-পান্নার রোলার কোস্টারে চড়াতেন শ্রোতাদের। মা তো গলা শুনেই বলে দিতেন কোন চরিত্রে বিকাশ রায়, কোনজন বসন্ত চৌধুরী, কে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আর কোনটি নির্মলকুমার। টোনাল কোয়ালিটি সবার আলাদা আলাদা। আমার কাছে সেটা ছিল এক দারুণ মজার খেলা। গলা শুনে নাম মেলাবার চেষ্টা। নাটক শেষের ঘোষণা পর্যন্ত অধীর অপেক্ষা। মিলল কিনা! আর একটা খুশির ব্যাপার ছিল শনি কি রোববারের বিকেল থেকে সন্ধ্যে একসঙ্গে বসে টিভির পর্দায় কোন ভাল ছবি দেখা। শনিবার হিন্দি আর রোববার হত বাংলা ছবি। ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরি’ কি ‘সপ্তপদী’-র মত উত্তম-সুচিত্রার প্রেমময় বাংলা ছবি দেখি বা না-দেখি, তা নিয়ে খুব মাথা ঘামাতেন না কেউ। উঁহু, ভুল হল একটু। ওসব না দেখে পড়তে বসাই ভাল, সচরাচর এরকমই ভাবতেন বড়রা। কিন্তু ক্ষুদিরাম, সুভাষচন্দ্র, রাজা রামমোহন কি ভগিনী নিবেদিতা-র মত সিনেমা টিভিতে দেখনো হলেই অবধারিত ডাক পড়ত দেখার জন্যে। ছোট থেকেই মনে দেশপ্রেমের আদর্শ গড়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য ছিল নিশ্চয়ই!
রেডিয়োতে আগেই শুনেছি বিকাশ রায়ের অসামান্য কন্ঠ। মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর সিনেমা তখনো দেখিনি কিছু। ’৪২ সিনেমা সম্পর্কে জানাও ছিল না তত। শুধু শুনেছিলাম, গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল মানুষদের নিয়ে এই ছবি। রেডিয়োতে বসন্ত চৌধুরীর কন্ঠে মুগ্ধ হবার পরে যখন রাজা রামমোহন ছবিতে প্রথম তাঁকে দেখি, তাঁর ব্যক্তিত্ব চমৎকার লেগেছিল। প্রত্যাশা ছিল বিকাশ রায়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। যাঁর কন্ঠস্বরের জাদু না-দেখা চরিত্রগুলোতে প্রাণ দেয়, তাঁকে দেখার তুমুল আগ্রহ মনে মনে।
ভাল-মন্দ মিশিয়ে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে থেকে যায় আজীবন। যেমন করে মনে থেকে গেছে পুরীতে সাইকেল রিক্সায় যেতে যেতে হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরেই ফেনা ফেনা সাদা মুকুট পরে নীল আদিগন্ত জলের বালিতে আছড়ে পড়ার দৃশ্য, প্রথম সমুদ্র-দেখার আনন্দ হয়ে, তেমনি ছোটবেলার এক রোববারের বিকেলে দেখা ’৪২ সিনেমায় বিকাশ রায়ের চরিত্রায়ণ আমাকে তাড়া করে বেড়াত বহুদিন পর্যন্ত। হাড়-হিম করা আতঙ্ক হয়ে।
দাউ দাউ করে একটা জ্বলছে একটা ঘর। তার ভেতরে আটকে পড়ে আমার থেকে একটু ছোট একটা বাচ্চা ছেলে ‘মা মা’ বলে ডাক ছেড়ে কাঁদছে ভয়ে, আতঙ্কে। বাইরে দাঁড়িয়ে তার অসহায় মা, ঠাকুমা। কাতর অনুনয় করছে ছেলেটিকে বের করে আনার জন্যে। একটা পিশাচের কাছে। মেজর ত্রিবেদী। তার পরণে মিলিটারি পোশাক। পিশাচটা হাসছে। মজা দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে৷ ছোট ছেলেটির একমাত্র অপরাধ, তার বাবা অজয় স্বদেশী করে। ধরা যাচ্ছে না সেই নেতাকে। তাই পিশাচের এই নিষ্ঠুর ছক। ছোট শিশু আগুন-লাগা ঘরে আটকা পড়েছে খবর পেলে নিশ্চয়ই ছুটে আসবে বাবা। সন্তানকে বাঁচাতে ধরা দেবে। তাই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মেজর ত্রিবেদী পাইপের ধোঁয়া ছাড়ে শান্তভাবে। অপেক্ষা করে অজয়ের জন্যে। দেখতে দেখতে আতঙ্কে মা-র হাত চেপে ধরেছি। ওই ভয়াবহ দৃশ্য, ওই কান্না, ওই নৃশংসতা চোখ বুজলেই যেন ফিরে ফিরে আসত ছোটবেলায়।
আর একটা দৃশ্য।
স্ক্রীন-জুড়ে চরকা আঁকা তেরঙা পতাকা। বুট-পরা পা দিয়ে পতাকা মাড়িয়ে হেঁটে এসে, অসহযোগ আন্দোলনে সন্তানকে বাঁচাতে এসে ধরা দেওয়া স্বদেশী নেতা অজয়কে ব্রিটিশ-অনুরক্ত মেজর ত্রিবেদী চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে,
“দেখেছ? যাও হেঁটে এস। Walk on it. হেঁটে এস, যাও!”
গলা ফাটিয়ে চীৎকার নয়। তিরিশ কি চল্লিশের দশকের গোড়ায় অভিনেতাদের মত হাত মুখ নাড়িয়ে, অতিরঞ্জিত অভিনয় নয়। অনেকটা হলিউডি স্টাইল। ঠাণ্ডা মাথার খলনায়ক। যে সব সময় শেষ হাসিটা হাসে। হয়তো মাত্র এক পর্দা উঠল গলা। কিন্তু মেজরের কন্ঠস্বরের অভিঘাত ক্রমশ ইস্পাত-কঠিন।
অনড় অজয়। নির্বাক।
কঠিন দৃষ্টিতে সেটা দেখে দাঁতে দাঁত চিপে মেজর বলছে,
“You won't! Alright! Then take it. Take it....”
মারের পর মার। বীভৎস মার। তারপর, ঘাড় ধরে মেজর নেতাকে নিয়ে গেল পতাকার কাছে। ব্রিটিশ অনুরাগের সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা মিশিয়ে স্টিফ্ আপার লিপে মেজর বলল,
"Spit on it. I say, spit!”
দৃশ্যান্তর।
দাশু কারিগরকে গ্রেপ্তার করে সেপাইদের আদেশ দেয় মেজর ত্রিবেদী-
"Do one thing, tie him to the truck, drag him. If he is still alive, I’ll meet him at my office."
কি নিষ্ঠুর সহজতায় হাতে ধরা পিস্তল! দৃপ্ত হাঁটার ভঙ্গি আর মিলিটারি ছাঁট গোঁফের আড়ালে মৃদু কুচক্রী হাসি।
শিউরে উঠেছি এসব দেখতে দেখতে! ভয় পেয়েছি। বহুদিন পর্যন্ত মনে হয়েছে, এরকম ভয়ঙ্কর খারাপ লোক আর দুটো নেই। মেজর ত্রিবেদী। ছোটবেলায় আমার প্রথম চোখে-দেখা সাক্ষাত্ শয়তান, মনে মনে যার ধ্বংস কামনা করেছি বার বার।
৯-ই আগস্ট, ১৯৫১। মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছবি ’৪২। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি। বাঙালি তথা ভারতীয়দের অন্তর্লীন সত্তার দেশপ্রেমের আবেগটিকে ছুঁতে পারবে, এমন ছবি ’৪২। পরিচালক হেমেন গুপ্ত। এই ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে অসামান্য অভিনয়ের জন্যে একেবারে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে পড়লেন বিকাশ রায়। আলোছায়াময় চরিত্র পেয়ে বিকাশ রায় চিনিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জাত। তারপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি। অভিনেতা হিসেবে স্পটলাইটের সব আলোটুকু এসে পড়ল তাঁর মুখে। অসংখ্য ছবি নানা চরিত্র। অনেক জটিল ভূমিকায় অভিনয়। হ্যাঁ - পাশাপাশি ভিলেন হিসেবে টাইপকাস্টও হয়েছেন অনেক ছবিতে। তাঁকে পর্দায় দেখলেই মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল "এই রে! ভিলেন”!
নায়কোচিত গ্ল্যামার ছিল না তাঁর। নিজের ব্যক্তিত্বে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন একান্ত নিজস্ব একটা গ্ল্যামারের জগত। তাই সুচিত্রা সেনের বিপরীতেও নায়ক হিসেবে দাপটে অভিনয় করা বিকাশ রায়কে দর্শকরা গ্রহণ করেছেন সমাদরে।
ছোটবেলাতেই দেখা আরও দুটি ছবিতে বিকাশ রায় ছিলেন খলনায়ক। ১৯৫৯ এর ছবি- ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি।’ পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। অন্নদাদির সাপুড়ে স্বামী শাহজীর ভূমিকায় বিকাশ রায়। সেই স্কুলজীবনে চলচ্চিত্র শিল্প বিচারের বিশ্লেষণী শক্তি ছিল না। নতুন করেও আজ দেখতে পেলাম না ছবিটি পাওয়া গেল না বলে। তবে ছবিটির কথা ভাবতে গেলে ছোটবেলার স্মৃতি থেকে একমাত্র সামনে এসে দাঁড়ান বিকাশ রায়। আর সবাইকে ঢেকে দিয়ে। সাপুড়ে শাহজীর ক্রূর দৃষ্টি, কথা বলার ভঙ্গি, আর সাপুড়ে হয়েও সাপের কামড়ে মৃত্যুতে ঢলে পড়ার আগে প্রতিশোধ নিতে সাপটিকে মেরে ফেলার দৃশ্য মনে পড়লে মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে আজও। অভিনেতার কালজয়ী প্রতিভার এর থেকে বড় স্বাক্ষর আর কী হতে পারে?
আর একটি ছবি ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত কাহিনি নিয়ে আবারও হরিদাস ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। এক বড় সেগুনকাঠের কোম্পানিতে শ্রীকান্ত চাকরি পেয়েছে। জাহাজে আসার পথে আলাপ হয়েছিল রোহিনীবাবু আর অভয়ার সঙ্গে। অভয়ার স্বামী আট বছর নিখোঁজ। বর্মায় আসার পর প্রথম বছর দুই কয়েকটা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল। তারপর যোগাযোগ বিছিন্ন। সেই নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর খোঁজেই রোহিনীবাবুর সঙ্গে বর্মায় আসে অভয়া। চাকরিতে পদোন্নতির পর কাঠচুরির অভিযোগে সাসপেন্ড হওয়া এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আর অভিযুক্তের দরখাস্ত এল শ্রীকান্তের কাছে। কিছু পরেই সাক্ষাৎ করতে এল সেই কর্মচারী। চাকরি বজায় রাখার তদ্বির। শ্রীকান্ত অনায়াসে চিনল, এই অভয়ার স্বামী, পূর্ণচন্দ্র। “লোকটার প্রতি চাহিবামাত্র সর্বাঙ্গ ঘৃণায় যেন কন্টকিত হইয়া উঠিল।”
এই চরিত্রেই বিকাশ রায়। পুরনো, নোংরা হ্যাট কোট পরনে। ঠোঁটের কষে জমাট পানের রস। চাকরি রক্ষার তাগিদে অনর্গল বকে চলে। মুখোমুখি শ্রীকান্ত, বসন্ত চৌধুরী।
শ্রীকান্তের প্রশ্ন,
“আপনি অভয়াকে চেনেন?”
চমকে উঠল লোকটা। তারপর একটু চুপ করে থেকে পাল্টা জবাব দিল,
“আপনি তাকে জানলেন কী করে?”
“এমন তো হতে পারে, সে আপনার খোঁজ নিয়ে খাওয়া পরার জন্যে এ আপিসে দরখাস্ত করেচে”।
“ওঃ! তাই বলুন। তা স্বীকার করচি একসময় সে আমার স্ত্রী ছিল বটে...”
“এখন?”
“কেউ নয়। তাকে ত্যাগ করে এসেচি”।
“তার অপরাধ”?
পূর্ণচন্দ্র-র চোখে মুখে একটা কুটিলতা খেলা করে গেল মুহূর্তে। তারপর মুখে একটা মাপা বিমর্ষতার ভাব। চাপা গলায় সে বলল,
“কি জানেন? ফ্যামিলি সিক্রেট বলা উচিত নয়। কিন্তু আপনি যখন আমার আত্মীয়ের সামিল, তখন বলতে লজ্জা নেই যে সে একটা নষ্ট স্ত্রীলোক। তাই তো মনের ঘেন্নায় দেশত্যাগী হলাম...”
ধূর্ত, নীচ, নিষ্ঠুর, মিথ্যাবাদী লোকটির এর থেকে অব্যর্থ চরিত্রায়ণ আর হতে পারত না। শ্রীকান্তের মুখোমুখি এই দৃশ্যটিতে একবার অসহয়তা প্রকাশ, পরক্ষণেই খোশামুদে। আবার তারপরেই স্থূল হাসি আর ব্যঙ্গতে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের ছটা। পাল্টে পাল্টে যায় এক্সপ্রেশন।
এর পরে আর একটি দৃশ্য। চাকরিটি বেঁচে যাওয়ায় শ্রীকান্তকে ধন্যবাদ দিতে এসে একবার পায়ে পড়া আবার সহসা ভীত হয়ে পড়া, তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে নিজমূর্তি ধরা। কি অনায়াস পরিবর্তন মুখের আর বাচনভঙ্গির! দৃশ্যদুটিতে শ্রীকান্ত নয়, দর্শকের মনে থেকে যায় ওই মিথ্যাবাদী, নীচ পূর্ণচন্দ্র। নায়কের সীন হাসতে হাসতে চুরি করে নিয়ে বেরিয়ে যান খলনায়ক।
পরের আর একটি দৃশ্যে অভয়ার ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে স্বামীর হাতে চরম নিগ্রহের দৃশ্য। চাবুক হাতে নৃশংস মুখভঙ্গি পূর্ণ-র। চাবুক মেরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে দূর করে দেয় সে অভয়াকে। মালা সিনহার অসহায়তা আর বিকাশ রায়ের অমানুষ থেকে ক্রমশ দানব হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে লোকটির প্রতি ঘৃণায় হাত মুঠো করে ফেলেন দর্শক। এমনই পারঙ্গমতা অভিনেতার।
এরপরে আরও অনেক ছবি দেখেছি বিকাশ রায়ের। ছেলে কার, আরোগ্য নিকেতন, কাঁচ কাটা হীরে, জীবনতৃষ্ণা, উত্তর ফাল্গুনী, ছদ্মবেশী। আলাদা আলাদা ধরণের চরিত্র। নানা স্টাইলের অভিনয়।
১৯৬৫-র ‘কাঁচ কাটা হীরে’-তে অভিজাত ব্যবসায়ী অম্বিকা গুপ্ত চরিত্রে বিকাশ রায়। প্রবোধ কুমার সান্যালের কাহিনি নিয়ে মৃণাল সেনের স্মার্ট চিত্রনাট্য। পরিচালক অজয় কর। ভদ্র, শিক্ষিত, মার্জিত, ব্রিটিশদের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলা, দামী গাড়ি চড়া, সফল বাঙালি ব্যব্যসায়ী অম্বিকা গুপ্ত। সামান্য পিঠকুঁজো একটি মানুষ। ওই সামনে ঝুঁকে-পড়াটিও কি অসম্ভব স্টাইলিশ! এক্সপ্রেশনে কখনও পেশিশক্তি আস্ফালনের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ ভেতরে পুষে রাখেন ক্রূর ষড়যন্ত্রী মস্তিষ্ক। নিজের লাভটুকুই যাঁর কাছে মুখ্য। প্রথমদিকে তিনি বলে বটে, “জীবনে অনেক জিতেছি, জেতার আর কোনো এক্সাইটমেন্ট নেই। তাই মাঝে মাঝে হেরে যাওয়ার সাধ পেতে ইচ্ছা করে, বিশেষত ছেলের কাছে”, কিংবা স্ত্রীকে বলেন তাঁর স্বপ্ন, ছেলে হয়ে উঠবে, ‘A great above the greatest। A great architect of modern India।’ কারণ তিনিই King-maker। কিন্তু অচিরেই ছেলের সঙ্গে মূল্যবোধের সঙ্ঘাতে দাম্ভিক অম্বিকা গুপ্ত এটা স্পষ্ট করে দিতে ভোলেন না, যে ছেলে সুব্রত তাঁর subordinate, তাকে তাঁর হুকুম মতই চলতে হবে। জেদের বশে ছেলেকেও নিজের হুকুম-মত কাজ করতে বাধ্য করতে চান তিনি। আবার শেষের দিকে ভেঙে পড়তে পড়তেও চকিতে অনমনীয়।
পরনে কখনো সাহেবি স্যুট, কখনো ড্রেসিং গাউন। কি অসম্ভব অনায়াস, অথচ কি দারুণ স্টাইলে ক্যারি করেন তিনি। পাইপ হাতেই ধরা থাক কি ঠোঁটে, পাইপ টানা হোক বা না টানাই থাক গোটা দৃশ্যে, হাতে ধরা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেওয়া হোক বা না-দেওয়া, সবটাই এত স্বাভাবিক, যেন প্রপস্-এর আলাদা কোনও অস্তিত্বই নেই আর। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে একেবারে, যেন ওই গাউনটা পরে কি পাইপ হাতে ধরেই জন্মেছিলেন তিনি!
এ ছবিতে বিকাশ রায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মুখোমুখি অনেকগুলো দৃশ্যে। নায়ক মানে যদি পজিটিভ চরিত্র হয়, তাহলে এ ছবির নায়ক সৌমিত্র। কিন্তু মুখোমুখি প্রতিটি দৃশ্যেই আধিপত্য বিকাশ রায়ের। অম্বিকা গুপ্তের চরিত্রায়ণ এত স্বাভাবিক, এতটাই বিশ্বস্ত, এতই অভ্রান্ত, কখনো মনেই হয় না অভিনয় করছেন। সম্মোহনে দর্শকদের জয় করে নেন তিনি, নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেও।
১৯৫৭ সালের ছবি ‘জীবনতৃষ্ণা’। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ছবিটি করলেন অসিত সেন। টাইটেল কার্ডে তিনটি নাম একসঙ্গে- সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার, বিকাশ রায়। তিনটি চরিত্রকে ঘিরেই আবর্তিত কাহিনি। কিন্তু এ ছবির মূল স্তম্ভ নিঃসন্দেহে বিকাশ রায়। ডাক্তার স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গের আঘাতে দু’বছরের ছেলেকে নিয়ে ঘর ছাড়ে মা। মায়ের মৃত্যুর পর অনাথ আশ্রমে বড় হয় সেই ছেলে। দেবকমল। দারিদ্রের জ্বালা সে দেখেছে। দরিদ্রকে নয় দারিদ্র্যকে সে ঘৃণা করে। ঘৃণা করে বিত্ত-বৈভবশালী মানুষদের। অনাথ আশ্রম চালায় দেবকমল। তাদের কল্যাণকামনায় বিত্তশালী মানুষদের সে সর্বস্বান্ত করতেও দ্বিধা করবে না, এমনই অনমনীয় মনোভাব তার। একদিকে অনাথদের প্রতি তার নিঃশর্ত ভালবাসা ও মানবতাবোধে দর্শক মুগ্ধ। আবার বিত্তশালী মানুষের প্রতি তার জাত-ক্রোধ ও খল-আচরণে দর্শক বিভ্রান্ত। বহুমাত্রিক, আলোছায়াময় চরিত্র। কি অনায়াস, কোমল–কঠোর চরিত্রায়ণ বিকাশ রায়ের! জীবনতৃষ্ণা সিনেমাতে দেবকমলের আলোছায়াময়-রূপে বিকাশ রায়কে দেখে শেষ পর্যন্ত চোখে জল এসেছে দর্শকের। নায়ক উত্তমকুমার ও নায়িকা সুচিত্রা সেন ম্লান হয়ে যান তাঁর কাছে। নিয়তি-তাড়িত দেবকমলই হয়ে উঠেছে ছবির আসল হিরো। এখানেই তাঁর অভিনয়ের সার্থকতা।
আফসোস হয়, অনেক বাংলা ছবিতে মার্কামারা খলনায়কের ছকে বেঁধে দিতে চাওয়া হয়েছে বিকাশ রায়কে। অভিনয়ের সুযোগ কম বলা ভুল, সুযোগ প্রায় ছিলনা বললেই চলে। তবু তিনি ঠিক নিজের কুশলতায় চরিত্রগুলিতে আলাদা মাত্রা সংযোজন করে গিয়েছেন।
নায়কের বিপরীতে খলনায়ক। সে এমন এক চরিত্র, যে নায়কের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। নায়ক সাদা, আর খলনায়ক কালো। কিন্তু এতটাই কি সহজ-সরল ব্যাপারটা? সাদা-কালোর মাঝামাঝি নানা ধূসর শেডস্ কি নেই খলনায়কের? থাকে নিশ্চয়ই। তাই সে অভিনয়ের কোনও স্বীকৃত ব্যাকরণ থাকে না। খলনায়কের ভূমিকায় প্রোটোটাইপ অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনও জয় করা যায় না। কখনো মেথড্ অ্যাক্টিং, আবার কখনো নিজস্বতার ছোঁয়া, তাই দিয়েই এক একটি ছবিতে তাঁর খল-চরিত্রের অভিনয়কে স্মরণীয় করে রেখেছেন বিকাশ রায়, সমকালে এবং আগামী দিনের কাছেও।
বাংলা ছবির সর্বকালের সেরা ভিলেন কে? বা, একটু অন্যভাবে বললে, আজ পর্যন্ত বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ ভিলেন চরিত্র কোনটি? এ নিয়ে আলোচনায় যে নামগুলি সেরার তালিকায় উঠে আসবে, তাঁরা হলেন- অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (হাটেবাজারে, গণদেবতা, কপালকুণ্ডলা), উৎপল দত্ত (ফেলুদার শত্রু মগনলাল মেঘরাজ, হীরক রাজার দেশের হীরকরাজ, অমানুষ-এর মহিম ঘোষাল), কালীপদ চক্রবর্তী (উত্তর ফাল্গুনী), মনোজ মিত্র (শত্রু)। উত্তমকুমারের নাম আসে ‘অপরিচিত’, ‘বাঘবন্দী খেলা’, ‘রাজা সাজা’ আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মনে পড়ে ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির জন্যে। একটা সময় অসংখ্য অতি সাধারণ মানের বাংলা ছবি উৎরে গেছে উৎপল দত্তের ভিলেনি দিয়ে। মুশকিল হল, আলাদা করে ওইসব টাইপকাস্ট ভিলেনের নাম কিন্তু মনে থাকে না, যেভাবে মনে দাগ কাটে তাঁর মগনলাল মেঘরাজ কি হীরকরাজ। শেখর চট্টোপাধ্যায় (কোরাস, ভুবন সোম), গঙ্গাপদ বসু (জলসাঘর), কমল মিত্র (লৌহকপাট) বা হাল-আমলের সুমন্ত মুখার্জীর (আতঙ্ক) নামও আসতে পারে। আর এ তালিকার শীর্ষে অনিবার্য বিকাশ রায়, তাঁর অভিনীত সবকটি আলোছায়াময় চরিত্রের জন্যে, সমকালীন সকলের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা দক্ষ শিল্পী এবং অভিনেতা হিসেবে।
কালীপদ চক্রবর্তী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, বিকাশ রায় প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ঘরানার অভিনেতা। এঁদের এভাবে তুলনা করা যায় না। তবু ‘সেরা’ ভিলেন হিসেবে, খুব অবাক হয়ে দেখেছি, সত্তোরোর্ধ প্রবীণ আর বছর তিরিশের কোনও নবীন, বিকাশ রায় অভিনয় ছেড়ে দেবার পরেই হয়তো যাঁর জন্ম, তাঁদের পছন্দ মিলে যায় বিকাশ রায়-এ এসে!
শুধু ভিলেনের ইমেজে আটকা পড়ে যাননি কখনো বিকাশ রায়। আলাদা আলাদা ধরণের চরিত্র তাঁর বিভিন্ন ছবিতে। নানা স্টাইলের অভিনয়ের স্বাক্ষর। বার বার নিজেকে পাল্টে নেওয়া। কমেডি থেকে সিরিয়াস- সব ধরণের চরিত্রে সমান স্বচ্ছন্দ। শুদ্ধ বাংলা আর চোস্ত ইংরেজি উচ্চারণ। অভিজাত স্ক্রীন প্রেজেন্স। এই সব কিছু নিয়েই বিকাশ রায়। এতরকম চরিত্র করেছেন অবলীলায়, তাদের এতরকম শেডস্, তাঁকে ভার্সেটাইল জিনিয়াস বলাই শ্রেয়। তবু যদি আলাদা করে মনে রাখার মত ভিলেন চরিত্রের অভিনয়কে ধরি- তাহলে ’৪২ এর মেজর ত্রিবেদী অনবদ্য চরিত্রায়ণ! অথচ, কি আশ্চর্য, ছবিটা তৈরি হয়েছিল আজ থেকে ৬৭ বছর আগে!!
আমার ভীষণ মনে হয় যে ’৪২-ছবির বিকাশ রায় আর বাকি অন্যান্য সব ছবির বিকাশ রায় যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটি ব্যক্তিত্ব। ’৪২-এর ভয়াবহতা এমন সাংঘাতিক, ওই নারকীয়তা এতটাই বীভৎস যে, তা যেন আজও তাড়া করে বেড়ায়। সম্প্রতি আরো একবার দেখলাম ছবিটা। সচেতন চেষ্টা করছিলাম খুব হালকা মেজাজে, নির্লিপ্ত হয়ে দেখার। কিন্তু তা হতে দিলেন না বিকাশ রায়। একটি শিশুকে ঘরে আটকে রেখে স্বদেশী নেতার বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, একটি নারীর ওপর হাড়-হিম করা অত্যাচারের দৃশ্য, আর সেই দৃশ্যে অল্প আলোয় নিচু থেকে ধরা ক্যামেরায় পিছনের দেওয়ালে ক্রমশ আরও আরও বড় হয়ে ওঠা ছায়ার ভয়াবহতা দিয়ে আবারও মেজর ত্রিবেদীর প্রতি সুতীব্র ঘৃণা অনায়াসে তৈরি করে দিলেন বিকাশ রায়।
বিকাশ রায় নিজে লিখেছেন, “সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে গুলি করার হুকুম দিচ্ছিলাম আমি৷ জনতার চাপে ওখানেই পিছলে পড়লাম৷ জনতা আমার মুখের ওপর পা দিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে গেল৷ হেমেনবাবু আমার এই শটের অনেকক্ষণ ধরে ক্লোজ আপ নিলেন৷... শট নেবার পর সাতদিন আমার মুখের একটা দিক অস্বাভাবিক ফুলে ছিল৷ চিবিয়ে কিছু খেতে পারছিলাম না৷ অতএব জলীয় খাদ্য৷ আর ওষুধ হিসেবে আর্ণিকা৷ এমনিভাবে নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত পণ করে '৪২ ছবি উঠলো৷”
কি অসম্ভব ডেডিকেশন আর প্যাশন!
’৪২ ছবিতে পর্দায় অভিনয় করেননি বিকাশ রায়। তিনি ওইরকম একজন সত্যিকারের ব্রিটিশভজা, অত্যাচারী লোক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই বোধহয় সে ঘৃণ্য অতাচার দেখতে দেখতে, প্যাশনেট অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা সেসব নারকীয়তা দেখতে দেখতে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের প্রতি বিদ্বেষে দীক্ষিত হয়েছি। আরও বেশি করে ভারতীয় হয়ে উঠেছি। আর আমার দেশকে আরও একটু বেশি ভালবেসেছি আমি।
বিকাশ রায় অভিনয় ছেড়েছেন তিরিশ বছর আগে। এই তিরিশ বছরে অজস্র বাংলা ছবি তৈরি হয়েছে। অসংখ্য নতুন অভিনেতা এসেছেন। খলনায়কের অভিনয়ে এসেছে নতুনতর ডাইমেনশন। তবু আজও যে কোনও আলোচনায় সেরা খলনায়কের মুকুটটি তাঁকেই পরাতে চান অধিকাংশ মানুষ। কোন আশ্চর্য ম্যাজিকে আজও তিনি এতখানি প্রাসঙ্গিক, আজ এত বছর পরেও মানুষের হৃদয়ে এমন ভালোবাসার স্থানটিতে তাঁর অনায়াস অধিষ্ঠান, তা আমার জানা নেই। শুধু মনে হয়, এই ভালোবাসাটুকুর নামই জীবন।
আমার অন্তরের দেশপ্রেমিক সত্তাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা বিকাশ রায়কে শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক পরিচিতিঃ কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে
আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে
বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে।
কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও
জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি
বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। অবসর-এর সহযোগী সম্পাদক।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.