অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

আমার শ্রদ্ধার মানুষ

মাধবী মুখোপাধ্যায়


চলচ্চিত্রজগতে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ বিকাশদা বললেও অত্যুক্তি হবে না। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি অসাধারণ। বিকাশদার সঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেছি। সহ-অভিনেতা হিসেবে বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে পেয়েছি ওঁকে। ছদ্মবেশী-তে বিকাশদা জামাইবাবু, অদ্বিতীয়া-তে স্বামী, সুবর্ণলতা আর বিন্দুর ছেলে-তে ভাসুর- এইরকম সব নানা চরিত্র।  

কি অসামান্য বৈচিত্র্য বিকাশদার অভিনয়ে! '৪২-এ অত্যাচারী মেজর, অগ্নিযুগের কাহিনিতে সূর্য সেন, তীরভূমি-তে বাবা, দুরন্ত চড়াই, উত্তরফাল্গুনী- এক একটা দুর্দান্ত চরিত্রায়ণ। আসলে বিকাশ রায় এমন একজন বিরল অভিনেতা, যিনি ভীষণ ফ্লেক্সিবেল। হিরো/ ভিলেন, গ্রাম্য/ শহুরে, মধ্যবিত্ত/ উচ্চবিত্ত/ নিম্নবিত্ত কিংবা ভদ্র/ সৎ/ বদ/ কুচুক্কুরে- এইরকম নানা চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলতেন অনায়াস দক্ষতায়। এমন ভার্সেটাইল অভিনেতা সচরাচর দেখা যায় না। অভিনয়ের সময় তৈরী হয়ে নিয়ে টেক দিতেন খুব কনফিডেন্টলি। বেশিরভাগ দৃশ্যই এক টেক-এ উতরে যেত। 

বিকাশদা অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন আমার প্রতি। বিকাশদা ও তাঁর স্ত্রী-র ভালবাসায় আমি আপ্লুত। একবার আউটডোর শ্যুটিংয়ে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সেবার বৌদিও আউটডোরে গিয়েছিলেন বিকাশদার সঙ্গে। বেশ একটু বাড়াবাড়ির দিকে গেল অসুস্থতা। রাতে কেউ পাশে থাকলে ভাল হয়। বৌদি এগিয়ে এলেন। আমার ঘরে আর একটা বেড নিয়ে সারারাত শুশ্রূষা করলেন। কোনও বারণ শোনেননি। বলেছিলেন, ছেলেমেয়ের জন্যেও তো রাত জেগেছি, একটা রাত নাহয় তোমার জন্যেই জাগলাম। আমার সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। আমার বিয়েতে এসেছেন, আমার মেয়ের মুখে-ভাতে এসেছেন। বিদেশে গিয়ে নিউ জার্সি -তে তাঁর পুত্র সুমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। সুমিত সেসময় বিকাশদাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি ছবির কথা ভাবছিলেন।

বিকাশদাকে এত সম্মান করতাম যে তাঁর কথায় গুরু বাগচীর ‘তীরভূমি’ ছবিতে আমি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। আবার আমি যখন কিছু ছবি প্রযোজনা করতে এলাম- আমার সব ছবিতেই বিকাশদা ছিলেন অনিবার্য। ‘সুবর্ণলতা’ প্রযোজনা করার সময় বড়ভাইয়ের চরিত্রে বিকাশদা ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনি আমি।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। মানুষের খ্যাতি যশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু শত্রুও তৈরি হয়। যে মানুষটা প্রায় একক প্রচেষ্টায় একের পর এক হিট ছবি দিয়ে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে নিয়ে চলেছিলেন, নীরবে বহু মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন- সেই উত্তমকুমারের বিরুদ্ধে চলে গিয়ে তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করতে লাগলেন কিছু ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ। কেউ কেউ তো উত্তমকুমারকে ‘চোর’ বলে গালি পর্যন্ত দিলেন। সেই অপবাদ শুনে ঘনিষ্ঠ-মহলে কেঁদে ফেলেছিলেন উত্তমকুমার। টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সে এক কলঙ্কিত অধ্যায়।  বিকাশদা তখন ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’-র প্রেসিডেন্ট। বিকাশদার কাছে সব খবর পৌঁছল। উত্তমকুমারের মত বিকাশদাও চিরকাল শিল্পী কলাকুশলীদের পাশে দাঁড়াতেন, সাহায্য করতেন যথাসাধ্য। বিকাশদা উত্তমকুমারের পাশে এসে দাঁড়ালেন।  শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে গেল।  উত্তমকুমারকে প্রেসিডেন্ট করে  জহর গাঙ্গুলি আর বিকাশদার নেতৃত্বে তৈরি হল ‘শিল্পী সংসদ’।  শিল্পী সংসদের কর্মসমিতির  সাংগঠনিক নিয়মকানুন তৈরির সময় বিকাশদা পরামর্শ দিলেন,  প্রেসিডেন্টের কথাই শেষ কথা- তেমনভাবেই যেন সাংগঠনিক নিয়ম তৈরি হয়। ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে অভিনেতৃ সঙ্ঘ ছেড়ে বেরিয়ে আসার কারণ জানাতে হল। প্রেস কনফারেন্স-এ শিল্পী সংসদ-এর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন বিকাশ রায়।  আশ্চর্য দক্ষতায় সাংবাদিকদের যাবতীয় কূট প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন তিনি। বরাবরই  খুব স্পষ্টবাদী বিকাশদা। তিনি বলেছিলেন, শিল্পীদের আর রাজনীতিবিদদের প্রতিবাদের ধরণ আলাদা। শিল্পীদের প্রতিবাদ হবে নাট্যমঞ্চে, অভিনয়ে।

অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনা আর প্রযোজনাও করেছেন বিকাশদা। ‘শুভযাত্রা’ দিয়ে পরিচালনা শুরু। তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যারাণীও ছিলেন এই ছবির প্রযোজক। মঞ্জু দে-র অভিনয়ে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছিল সুপার হিট। বিকাশদা যে কেবল হালকা মেজাজের ছবি তৈরি করতেন তা কিন্তু নয়। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তাঁর আর এক অসাধারণ ছবি। প্রমথনাথ বিশীর লেখা উপন্যাস ‘কেরি সাহেবের মুন্সি’র মত উপন্যাস নিয়ে ছবি করা সেসময়ে বাংলা ছবির জগতে রীতিমত দুঃসাহসিক কাজ। সে সময়ে দীর্ঘদিন মঞ্জু দে কোনও ছবি করছেন না। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ইংল্যান্ড-এ ছিলেন। বিকাশদা মঞ্জু দে-কে ছবিতে নিতে চাইলেন। শ্যুটিং শুরু হয়ে গেছে। শিডিউল সব ঠিকঠাক। এমন সময় মঞ্জু দে-র পক্স হল। অন্য কেউ হলে হয়তো মঞ্জু দে-কে বাদ দিয়ে আর কোনও অভিনেত্রীকে নিতেন। মঞ্জু দে-র প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বিকাশদা। তিনি বললেন, সুস্থ হয়ে উঠে মঞ্জু দে-ই অভিনয় করবেন। শ্যুটিং ক্যান্সেল করে দিলেন তখনকার মত। এমন সৌজন্য সত্যিই বিরল।  অভিনয়জীবনে যেমন, তেমনি পরিচালক, প্রযোজক হয়েও সহ-অভিনেতা ও কলাকুশলীদের প্রতি তিনি চিরদিন ছিলেন খুব আন্তরিক আর সংবেদনশীল।

একবার বিকাশদার ‘রাজা সাজা’ ছবির শ্যুটিং চলছে। দিনের বেলা সূর্যের আলো থাকতে থাকতে শট দেওয়ার কথা ছবি বিশ্বাসের। এ দিকে সন্ধে নেমে আসছে। ছবি বিশ্বাসকে ডাকতে লোক পাঠানো হয়েছে। ছবি বিশ্বাস তো আসেনইনি, যাঁরা তাঁকে ডাকতে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও কোনও খবর নেই। বিকাশদা তো রেগে আগুন। সন্ধের পর এলেন ছবিদা। বললেন, “রাগ করিস না রে। আসলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠানোর কাজ চলছিল যে। আবীর সাজানো, চুমকি বসানো- এইসব। আমি চুমকি বসাচ্ছিলাম, তোর ছেলেদেরও কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের আবার বকিস না যেন।”  ছবিদাকে বিকাশদা কিছুই বলেননি সেদিন। ছবিদার প্রতি গভীর ভালবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল বিকাশদার।

পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গেও চমৎকার সম্পর্ক ছিল বিকাশদার। পাহাড়ী সান্যাল ছিলেন লখনউ-এর বাসিন্দা। লখনউ-এর নাম করে বিরূপ কিছু বললেই উনি খেপে উঠতেন। আর বিকাশদা ঠিক সেটা করেই ওঁকে খেপাতেন।

বহির্জগতের সবার ধারণা ছিল বিকাশদা বুঝি খুব ড্রিঙ্ক করেন। আসলে গ্যাসের সমস্যার জন্যে কোকাকোলা খেতেন শ্যুটিং-এর মাঝে মাঝে। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম আমি আর বিকাশদা। ছবিতে বিকাশদা আমার স্বামী, যাকে আমি খুন করব। প্রথমদিকে নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও একইরকম ভুল ভেবেছিলেন।

ছদ্মবেশী ছবির শ্যুটিং হয়েছিল এলাহাবাদে আমি আর অনুভাদি একটা ঘরে পাশের ঘরে উত্তম-সুপ্রিয়া জহর রায় আর আমি দুজনেই বরিশালের লোকআমি জহরদাকে বলতাম গুরু আর উনি আমাকে বলতেন চেলা অনুভাদির কাছে পান খেতে আসতেন জহরদা তবে আমরা অনেকে টানা আউটডোর লোকেশনে থাকলেও বিকাশদা কলকাতা ফিরে যেতেন মাঝে মাঝে অগ্রদূত-এর বিভূতি লাহা একেবারে সাহেব ডিরেক্টর পাঁচটার পর নো শ্যুটিং কখনো পার্টি হত, আবার কখনো গান, বাজনা, কবিতার আসর অসাধারণ কবিতা বলতেন বিকাশদা সেসব আসর মাতিয়ে রাখতেন

বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পড়াশোনা ছিল বিকাশদার। বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। একসময় আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি খুব কৌতূহল জাগল বিকাশদার। বেণীমাধব নামে এক আধ্যাত্মিক জগতের মানুষের বাড়ি যেতেন বিকাশদা। আলোচনা করে বহু সময় কাটাতেন।

শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিখবেন বলে সামান্য পারিশ্রমিকে শ্রীরঙ্গমে ‘চিরকুমার সভা’য় অভিনয় করেছিলেন বিকাশদা। পূর্ণ-র চরিত্রে অভিনয় করতেন। তবে মঞ্চ অভিনয়ে খুব মন বসাতে পারেননি বিকাশদা।

সেসময় ‘নহবৎ’ নাটক চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। শেষের দিকে একবার আমাকে বললেন, “ তোর বৌদির জন্যে সব ব্যবস্থা করে গেলাম। এবার কাজ ছেড়ে দেব।” কাননদেবী, সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছায় কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন এর আগে। ১৯৮৪-র মাঝামাঝি বিকাশদা সর্বপ্রথম প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা করলেন অবসর-এর কথা। কেউ কেউ ভেবেছিলেন বয়স আর অসুস্থতার জন্যে সরে গেলেন বিকাশদা। তবে দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছি বলে আমি বুঝেছিলেম কারোর কাছে কোনও অভিযোগ না করলেও টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে তাঁর অভিমানও কম ছিল না। আমাকে অনেকবার বলেছেন, “আমি চাই না আমার কোনও সন্তান অভিনয় জগতে আসুক। আমাদের পরিবারে আমাকে দিয়েই অভিনয়ে জগতে পদক্ষেপের শুরু। এর শেষও আমাকে দিয়েই হোক।’’

জীবদ্দশায় সরকারের তরফ থেকে কোনও সম্মাননা পাননি বিকাশদা। রাজ্য সরকার সম্মান প্রদানের জন্য নাম রেকমেন্ড কেন্দ্রকে পাঠালে তবে কেন্দ্র পুরস্কারের কথা বিবেচনা করে। পূর্বতন সরকারের সে বিষয়ে খুব একটা উৎসাহ ছিল না। তাঁর এই শতবর্ষে আজকের প্রজন্মের কাছে বিকাশদার প্রতিভাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় তুলে ধরতে পারলে সে ভুল কিছুটা সংশোধনের হয়তো চেষ্টা করা যায়।

একটা কথা আমার খুব মনে হয়, যেটা আগেও আমি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছি, যে কল্পনাশক্তি, ফ্রেমিং, কাহিনি বাছাই, অভিনয়, সাহিত্যবোধে, পরিচালক বিকাশ রায় কখনও কখনও মনে হয় অভিনেতা বিকাশ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন।

জীবনের উপান্তে এসে, তিনি যখন বুঝতে পারছিলেন আর বোধহয় বেশি দিন নেই, তখন একবার বলেছিলেন, “হে আমার ভগবান, আমার দর্শক, অতীতের মতো সামনের দিনও তোমাদের দক্ষিণমুখ আমার দিকে যেন উন্মোচিত করে রেখো।”

আজ বলতে ইচ্ছে করছে, বিকাশদা, তুমি তো আমাদের সামনে নেই, তবু আজও তোমার মাধুরীতে, সৃষ্টিতে ছড়ানো মধু, তোমার মৃত্যুর মধ্যেও অমৃত হয়ে জেগে আছে...তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, অসামান্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখা ছবির মধ্যে দিয়ে, মানুষকে ভালোবেসে সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়ানোর সহমর্মিতাবোধের মধ্যে দিয়ে তিনি আমাদের মনে চির ভাস্বর, চির অমর হয়ে আছেন, থাকবেন।

শতবর্ষে তাঁকে প্রণাম।

অনুলিখন - কেয়া মুখোপাধ্যায়

 

আনন্দবাজার, ২৬শে জুলাই, ২০১৪


পরিচিতি - বিখ্যাত অভিনেত্রী। বহু স্মরণীয় ছবি, যেমন সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা, মহানগর, ইত্যাদির নায়িকা। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (দিবারাত্রির কাব্য) হিসেবে জাতীয় সম্মান পেয়েছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.