অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

বিকাশ রায়: বইয়ের বিচার মলাটে নয়

নরসিংহ শীল

[মূল রচনাটি ইংরেজীতে, এইখানে ক্লিক করলে দেখা যাবে]

শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের পেশায় আইনজীবী ছেলে বিকাশ রায় ছিলেন একজন শিল্পী, এক উঁচুস্তরের অভিনেতা। হেনরী ফিল্ডিংএর "টম জোন্‌স" (১৭৪৯) বইয়ের এক চরিত্র, বাক্যবাগীশ বেঞ্জামিন পার্ট্রিজ, হ্যামলেটের ভূমিকায় এক অভিনেতাকে দেখে যেমনটি বলেছিলো , "আরে, আমিও তো ওর মতোই অভিনয় করতে পারি। ... ও সব কথা স্পষ্ট করে বলে ওর আর গলার আওয়াজ অন্যদের দেড়া। ও যে একজন নোটো, সে তো দেখাই যাচ্ছে।" -- বিকাশ রায় সে ধরণের অভিনেতা ছিলেন না। চেহারার দিক দিয়ে বিকাশ রায় ঠিক সাধারণ অভিনেতাদের মতো নয়। দৃঢ় চোয়াল, প্রশস্ত কপাল, তীক্ষ্ণ নাসা, গভীর চিন্তাকুল দৃষ্টি -- স্বাধীন হবার পরে বাংলা রূপালী পর্দায় এক নতুন জন্মের প্রথম নায়ক। আসল কথাটা হলো এই যে বিকাশ রায় হলেন একেবারে প্রথম সারির এক অভিনেতা, আর এই তথ্যটিই এই রচনার একটু দুরূহ নামকরণের মূলে (ল্যাটিন fronti nulla fides) -- "বইয়ের বিচার মলাটে নয়", cannot judge a book by its cover। ।

একদিকে শাপমোচন (১৯৫৫) ছবির পৌরুষমদগর্বী অথচ মূঢ় কুমারবাহাদুরের ভূমিকা থেকে শুরু করে জীবনতৃষ্ণা (১৯৫৭) ছবির সমাজ-পরিত্যক্ত অনাথ দেবকমল (এক যশস্বী চিকিৎসকের ঔরসে এক কুমারী মাতার গর্ভে জন্ম হলেও সে পরে এক রুচিবান, সমাজকল্যাণকারী, পরহিতৈষী পুরুষ হিসেবে স্বপ্রতিষ্ঠ) চরিত্র পর্যন্ত সব ভূমিকাকেই বিকাশ রায় পর্দার বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। গত শতকে পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে বাঙালী ছবির দর্শকেরা সূর্যতোরণ (১৯৬৮) ছবির স্বোপার্জিত লক্ষপতি, মার্জিত রুচির মানুষ রাজশেখর চরিত্রের মারফৎ তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে এক এমনই সমাজসচেতন, পরহিতৈষী কিন্তু নতুন ধরণের "আপাত" খলনায়ক চরিত্রের রূপায়ণ। রাজশেখর আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে এক বন্দুক নিয়ে অহেতুক নাড়াচাড়া করার কিছু অতিনাটকীয় শট, যা শুধু সিনেমার মধ্যবিত্ত দর্শকগোষ্ঠীর মনোমতো করার জন্যই তোলা -- তা দিয়ে ভারাক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এ ছবিতে বিকাশ রায়ের অভিনয় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। বিশেষ করে মনে আসে যেখানে তিনি সুচিত্রা সেন অভিনীত নায়িকা অনীতার সঙ্গে কঠিন বৈষয়িক সংলাপ ত্বরিতগতিতে চালিয়ে গেছেন। সাধারণ বাঙালীর কাছে সূর্যতোরণ উত্তম-সুচিত্রা জুড়ির আর এক পরম সফল ছবি হতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত ও মননশীল দর্শকদের বিকাশ রায় সন্ধান দিয়েছিলেন এক নতুন ধরণের "খল" চরিত্রের, যে চরিত্রে আমরা পাই একাধারে ক্রূরতা আর মহত্ত্বের চমকপ্রদ সমাহার।

সীমাহীন শয়তানীর চরিত্রালেখ্যেও বিকাশ রায় ছিলেন সমান সাবলীল, উদাহরণস্বরূপ '৪২ (১৯৫১) সিনেমার মেজর ত্রিবেদী আর বিভাস (১৯৬৪) ছবিতে এক খল গ্রাম্য চিকিৎসকের নীচ ও নিষ্ঠুর চাকর রাসুর কথা বলা যায়। অপ্রতিদ্বন্দ্বী কণ্ঠস্বর আর মার্জিত উচ্চারণভঙ্গী, বিশেষ করে ইংরেজী উচ্চারণ, -- এসবের কারণে বিকাশ রায়কে শিক্ষিত মানুষের ভূমিকাতেই মানাতো বেশী। বাঙালীর অতি প্রিয় ম্যাটিনী আইডল উত্তমকুমারের বাচনে যে জড়তা বা কৃত্রিমতা দেখা যায় (১৯৭১ সালের জয়জয়ন্তী ছবিতে ব্যারিস্টার হিসেবে বা নবরাগ ছবিতে সফল ব্যবসায়ীর চরিত্রে তাঁর কষ্টকৃত প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়) বিকাশ রায়ের সে দোষ ছিলো না। সংলাপের প্রতিটি দল, সিলেবলের স্পষ্ট ও পরিশীলিত উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি সেসময়ের কলেজমুখী দর্শকদের সামনে এক আধুনিক নাগরিক পুরুষের ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

এটা মনে রাখতে হবে যে দ্বৈতসঙ্গীত গাওয়া রোম্যান্টিক সুপুরুষ প্রেমিকের ভূমিকায় বিকাশ রায়কে কখনোই মানাতো না। অভিনতা হিসেবে বিকাশ রায়ের আর উত্তমকুমারের আলোকোচ্ছল দিন ছিলো সমকালীন, কিন্তু স্টেশন হলিউড ব্লগস্পটের এক অনামা সদস্য যা লিখেছেন -- যদি উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমাকে রোম্যান্টিক উৎকর্ষ এনে দিয়ে থাকেন তাহলে ত্রিশ বছর ধরে বহুবিধ পার্শ্বচরিত্রে সার্থক রূপদান করার সাহায্য মারফৎ বিকাশ রায় তাঁদের এ কৃতি সফল করেছেন -- সেটাও সমানভাবে সত্য।

সন্ধ্যাদীপের শিখা (১৯৬৪) ছবিতে সুচিত্রা সেনের জয়ন্তী চরিত্রের চমৎকার রূপায়ণের পাশে মেজর অনুপম ব্যানার্জী রূপে বিকাশ রায়ের ছোটো কিন্তু উজ্জ্বল অভিনয় একেবারে অতুলনীয়, এই আমার মত। এর আগের একটি ছবি উত্তরফাল্গুনীতে (১৯৬৩) নায়িকা দেবযানীর (সুচিত্রা সেন) প্রাক্তন প্রেমিক ব্যারিস্টার মণীশ রায় হিসেবে বিকাশ রায় যে এক স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল চরিত্রচিত্রণ করেছিলেন, তাতেই সন্ধ্যাদীপের শিখা ছবিতে তাঁর অভিনয়ের পূর্বাভাস আছে। অবশ্য এ ছবির প্রথম পর্বে এক শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্তা, স্নেহময়ী মহিলার ভূমিকয় রূপসী সুচিত্রা সেনও যেমন সহজ ও স্বাভাবিক, তেমনটি তাঁকে আর কোথাও দেখা যায়নি (দ্বিতীয়ার্ধে মদ্যপ, মানসিক রোগগ্রস্ত বিধবার ভূমিকায় যাতে তাঁর অভিনয় অতিনাটকীয়তা দোষে দুষ্ট না হয় সেজন্য পরিচালককে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিলো)। পরে ছদ্মবেশী (১৯৬৫) ছবিতে খামখেয়ালী কিন্তু আদরণীয় ব্যারিস্টার প্রশান্ত ঘোষের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে বিকাশ রায় তাঁর প্রবাদপ্রতিম প্রবীণ সহকর্মী ছবি বিশ্বাসের (হাত বাড়ালেই বন্ধু ছবিতে সুরেশ ঘোষ, ১৯৬০) সমতুল্যতায় পৌঁছে যান।

তর্কসাপেক্ষ হলেও যাঁকে বাংলা ছায়াছবির শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা বলা যেতে পারে, তাঁর সেই খ্যাতির অপলাপ হয়, ভালো সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ রায় এমন ছবিও করেছেন। একটা উদাহরণ, অগ্নিসংস্কার (১৯৬১) ছবিতে অজমূর্খ ও কাপুরুষ এক ফ্যাক্টরি ম্যানেজার বীরেন চ্যাটার্জীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয়, এটি তিনি না করলেই পারতেন। এই মন্তব্য অবশ্য তাঁর অভিনয়দক্ষতার প্রতি কটাক্ষপাত নয়, এটি যে চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে তাঁর সহজ ব্যক্তিত্ব চাপা দিতে বা বিকৃত করতে হয়, তেমন চরিত্রে তিনি আদৌ রূপদান করবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্তের ভালোমন্দের ওপর। বাংলা ছবির অভিনেতা তালিকায় এধরণের চরিত্রে রূপদান করার অন্য লোকও ছিলো সে সময় (যথা দীপক মুখার্জী), কাজেই অভিনেতার অভাব ঘটতো না।

"আরোগ্য নিকেতন" ছবিতে (১৯৬৯) এক গ্রাম্য কবিরাজ জীবনমশায়ের ভূমিকায় বিকাশ রায়ের অসামান্য অভিনয়ের কথা না বললে অভিনেতা বিকাশ রায়ের সম্বন্ধে কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ হয় না। জীবনমশায় তাঁর ঐতিহ্য ও সংস্কার থেকে পাওয়া প্রাচীন শাস্ত্রের বাহক, রক্ষকও বলা যায়, পশ্চিমী বিজ্ঞানের আগ্রাসিক আক্রমণে তিনি বিপর্যস্ত হলেও তার প্রতিরোধে তিনি অচঞ্চল ও দৃঢ়চেতা -- সিনেমাটিতে এরই এক প্রতীকী মাত্রার চরিত্রচিত্রণ বিকাশ রায়ের হাতে রূপ পেয়েছে। এ ছবিতে তাঁর রূপসজ্জা এবং তাঁর অভিনয়, দুইই অতি স্বাভাবিক এবং রুচিসম্মত -- তাঁর অভিনয়ক্ষমতার কথাই সোচ্চারে প্রকাশ করে। উপসংহারে এই বলতে হয় যে বিকাশ রায় ছিলেন জাতশিল্পী, artist par excellence.!

 


পরিচিতি - ওয়েস্টার্ন অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এমেরিটাস অধ্যাপক। বহু গবেষণা পুস্তকের রচয়িতা অধ্যাপক শীল এক সময়ে স্টেটসম্যান পত্রিকার অতিথি পুস্তক-সমালোচক ছিলেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.