বিকাশ রায়: আমার স্মৃতি
পবিত্র সরকার
বিকাশ রায়কে আমি প্রথম দেখি, অন্য অনেকের মতো, 'ভুলি নাই' চলচ্চিত্রে। সে তো অনেক দিন আগেকার কথা, ১৯৪৮ বা তার কাছাকাছি হবে, কাজেই স্মৃতিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কিন্তু এখনও যা মনে আছে, বিপ্লবে বিশ্বাসঘাতী একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁর উপরে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল এবং ব্যক্তি হিসেবেও তাঁকে খারাপ লোক ভাবতে শুরু করেছিলাম -- বালকসুলভ এই প্রতিক্রিয়া বাদ দিয়ে, তাঁর অসামান্য অভিনয়। বিশেষ করে ওই দৃশ্যটি-- যেখানে অভিজাত হোটেলে বিকাশবাবু সাহেবি পোশাক পরে মদ খাচ্ছেন, আর বিপ্লবী প্রাক্তন বন্ধু প্রদীপকুমার তাঁকে খুন করার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছেছেন, একটু কথাবার্তার পর রিভলভার বার করেছেন প্রদীপকুমার। বিকাশ সে দৃশ্য দেখছেন তঁর মদের গ্লাসের মধ্য দিয়ে, ছবিটা বেঁকে চুরে তাঁর কাছে তৈরি হচ্ছে, কিন্তু পিস্তলটা যে তাঁরই দিকে তোলা হয়েছে তা বুঝতে তাঁর ভুল হয়নি। তখন তাঁর মুখটা কেমন বেঁকে যাচ্ছে, শরীরটাও কেমন এঁকেবেঁকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বন্ধুর কাছে প্রাণভিক্ষা করতে চাইছে। পিস্তল গর্জে উঠল, বিকাশ কী রকম এলোমেলোভাবে পড়ে গেলেন। প্রদীপকুমার বাইরে এসে আত্মসমর্পণ করলেন হোটেলের প্রহরীদের কাছে।
তখন সেই অপক্ক বয়সেই আমার মনে হয়েছিল বাংলা ছবিতে এক অসামান্য অভিনেতার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করছি আমরা। অথচ শুনে খুব অবাক লাগে যে, যৌবনে তাঁর অভিনয়ের দিকে কোনো বিশেষ ঝোঁকই ছিল না, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকার সময়ে 'বৈকুণ্ঠের উইল'-এর নাট্যরূপে অভিনয় করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল সাহিত্যে। সাহিত্য এবং শিল্পপাঠ যে তিনি সারাজীবন অব্যাহত রেখেছিলেন সেটা আমি তাঁর যোধপুর পার্কের বাড়িতে আলমারিতে খুব সযত্নে সাজানো বইপত্রের সঞ্চয় দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। সে কথায় পরে আসব।
গত শতকের চল্লিশের বছরগুলির বিখ্যাত লেখক জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে তাঁর অল ইণ্ডিয়া রেডিয়োর সূত্রে পরিচয় ও বন্ধুত্ব তাঁর জীবনের মোড় ফেরায়, তাঁকে চলচ্চিত্রে আসার সুযোগ করে দেয়। জ্যোতির্ময় রায়ের চিত্রনাট্য ভিত্তি করা ছবি 'অভিযাত্রী' -তে(১৯৪৭) নায়িকা বিনতা রায়ের ছোট ভাইযের ভূমিকায় তিনি ত্রুটিহীন অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত 'ভুলি নাই'-এর পর ছবিটি দেখেছিলাম বলেই আমার মনে হয়েছিল, তাঁর পুরো অভিনয়ের শক্তি আর সম্ভাবনা এখানে তিনি মেলে ধরতে পারেননি। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল নিশ্চয় নায়কোচিত, তাঁর চোখদুটি ছিল গভীর ও সুন্দর, বস্তুতপক্ষে ওই চোখ যে-কোনো অভিনেতার অভিনয়কেই অনেক বেশি বাঙ্ময় করে তোলে। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ একহারা চেহারা যেন তাঁকে নায়কের জন্য প্রস্তুত করেনি, এই রকমই মনে হয়েছিল।
কিন্তু তাই বলে তিনি কি ভিলেন চরিত্রের স্টিরিওটাইপ হওয়ার জন্য জন্মেছিলেন? তাও তো একেবারেই নয়। আমার মনে আছে, 'রত্নদীপ' ছবিতে তাঁর অভিনয় আমার অসামান্য লেগেছিল, যেমন লেগেছিল 'জিঘাংসা'য়। সারা জীবনে কত বিচিত্র চরিত্রেই যে তিনি অভিনয় করেছেন। অর্থাৎ তিনি পূরণ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের সেই চিরস্থায়ী অভাবের জায়গা, ভালো চরিত্রাভিনেতার অভাব। 'মরুতীর্থ হিংলাজ', 'কেরী সাহেবের মুন্সী', 'উত্তরফাল্গুনী' ইত্যাদি ছবিতে তাঁর অভিনয় ভোলবার নয়।
তাঁর সব ছবি আমি দেখিনি, মঞ্চের নাটক এক 'চৌরঙ্গী' ছাড়া কিছু দেখা হয়নি। কিন্তু 'শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-অন্নদাদিদি'-তে শাহজীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? কিংবা 'আরোগ্য নিকেতন'-এর অভিনয়? বা অরুন্ধতী দেবীর সঙ্গে অতি মিষ্টি একটি অভিনয় 'ছেলে কার'-এ? আর আমার মনে আছে 'জীবন-কাহিনী' বলে একটি ছবির কথা, সন্ধ্যা রায়ের বাবা ছিলেন তিনি, ইন্স্যোরেন্স এজেণ্ট চরিত্র, তাতে তাঁর যে কমিক অভিনয় আমি দেখেছি তাও অবিস্মরণীয়। 'চৌরঙ্গী'-তেও উত্তমকুমারের থেকে ভিন্ন একটি টাইপ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, তা আমার ভালো লেগেছিল।
আগেই বলেছি, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ভালো চরিত্রাভিনেতারা কম আসেন। ফলে একজন জহর গাঙ্গুলি, একজন ছবি বিশ্বাস বা একজন বিকাশ রায় চলে গেলে তাঁদের অভাব পূরণ হয় না।
এখন শুনছি অভিনয় শেখার অনেক স্কুল হয়েছে, দেশে দুটি ফিল্ম ইনস্টিট্যুট তো আছেই। সেখানে যারা অভিনয় শেখে তাদের সিলেবাসে এই সব অভিনেতার পুরোনো ছবির ডিভিডি দেখানো হয় কি না জানি না। না যদি হয় আমাদের সিলেবাস আমূল বদলাতে হবে।
আমার যাদবপুরে অধ্যাপনার সময়ে, বোধহয় ১৯৭৮ নাগাদ, কে যেন বলেছিলেন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা অধ্যাপক দেবীপদ ভট্টাচার্য-- যে বিকাশবাবু দীর্ঘ রোগভোগের পর সেরে উঠেছেন, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে একটু অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাঁর মনে। তাই তিনি তাঁর লাইব্রেরির বেশ কিছু বই আর রাখতে চান না, আমি চাইলে যোধপুর পার্কে তাঁর দোতলার বাসায় গিয়ে কিছু বই কিনতে পারি।
কেনাটা কথার কথা, বিলিয়ে দেওয়ার মতোই বলা চলে। এখনও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া অজস্র বিদেশি শিল্পীদের ছবিওয়ালা বই আমার কাছে আছে, আছে বাংলা সাহিত্যের বেশ কটি আকর গ্রন্থ, বি রায় স্বাক্ষরসুদ্ধ।
আমি নিজে এখন এই বইগুলি নিয়ে অনিশ্চিত বোধ করছি।
লেখক পরিচিতিঃ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ-শিক্ষা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহিত্য আকাদেমি, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি, প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০-এর বেশী।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.