বিকাশ রায় - তাঁর চলচ্চিত্রে গান
পুষ্পেন্দুসুন্দর মুখোপাধ্যায়
[সাহেবরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীনলণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্ত, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত ও গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, ষ্টুয়ার্ট্ প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র।-- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: বাঙ্গালার ইতিহাস]
পর্দার বাইরে আমি বিকাশ রায়কে দেখেছি মাত্র চারবার, তিনটি ভিন্ন গৃহে কিন্তু একটি মাত্র বিশেষ দিনে-- দুর্গা পূজার মহাষ্টমীর দিন। বন্ধুবর সুমিতের বাড়ীতে রবিবার আমি অনেকবার গিয়েছি, সুমিতের পিতৃদেব বিকাশ রায়ের কণ্ঠস্বরও শুনতে পেয়েছি; কিন্তু চাক্ষুষ দেখা ঐ চারবার। এবং তাতেও তাঁর কোন কথা শুনতে পাই নি যে তাঁর সম্বন্ধে কিছু একটা ধারণা করব। সুমিতের কাছ থেকে যতদূর জেনেছি, তিনি চলচ্চিত্র জগৎ ও পরিবার- এই দুইয়ের মিশ্রণ করতেন না। আর আমিও কোন শিল্পীর গুণের চর্চাতেই চিরকাল আবদ্ধ থেকেছি, তাঁর সাধারণ বা বিশেষ জীবন, অন্য গুণাবলী সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহ কখনও আমার হয় নি। কিছু কিছু ভাসা ভাসা টুকরো-টাকরা কথা কানে এসেছে এই পর্যন্ত এবং যথা সময়ে স্মৃতি থেকে বেরিয়েও গেছে। ফলে কোন কৃতী শিল্পীর বিশেষ দিক সম্বন্ধে আলোচনা করার মতন জ্ঞান আমার কখনও হয় নি- বিকাশ রায়ের ক্ষেত্রেও একই। বাড়ীতে লংপ্লেয়িং রেকর্ডের সংগ্রহ দেখে ও প্রায়ই শোনা থেকে এইটুকু আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় নি যে বিকাশ রায় ভালো গান শুনতে ভালোবাসতেন। কিন্তু এইটুকু দিয়ে তাঁর সঙ্গীত-দর্শন এবং চলচ্চিত্রে তার প্রয়োগ সম্বন্ধে কিছু লেখার পক্ষে তা যথেষ্ট নয় এবং অনেক চেষ্টা করেও বিশেষ লিখিত তথ্য জোগাড় করতে পারিনি, বঙ্কিমচন্দ্রের কথা ধ্রুব সত্য হয়ে আছে।
বিকাশ রায়ের সিনেমায় আবির্ভাব (এক্ষেত্রে আমরা ছবি মুক্তির তারিখই দেখব) ১৯৪৭ সালে 'অভিযাত্রী’ চলচ্চিত্রে এবং পর্দায় শেষ ছবি 'মন্দির' মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। সংখ্যা ২৫১ টি, কিছু কম বা বেশী হতে পারে। এর মধ্যে পর্দার জন্য অভিনয়ের আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে প্রথম দিকের কয়েকটি বছর এবং শেষ দিকের বয়সজনিত দক্ষতা লাঘব বা শেষ কয়েকটি বছর চলচ্চিত্রের শৈলী গত পরিবর্তনের সঙ্গে মানাতে পারার অভাব (সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' চলচ্চিত্রের 'মুকুন্দ লাহিড়ী' স্মরণ করুন), বাদ দিলে তাঁর সেরা সময়টি দাঁড়ায় ১৯৫১ ('৪২') থেকে ১৯৮২ ('সোনার বাঙলা') -- প্রায় ২২২-টি ছবি, প্রায় চল্লিশ বছর। এত ছবি একজনের জীবত্কালে দেখা সম্ভব নয়। আর অন্যের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করাটা 'পরের মুখের ঝাল খাওয়া' হয়। অতএব, আমি খোঁজার পরিসর একটু খাটো করে নিলাম।
কেমন ছিল সেই সময়টা বা সেই যুগ? এক কথায় বাঙলা সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও মঞ্চাভিনয়ের বৈচিত্র্যভরা এক স্বর্ণযুগ। সঙ্গীতের পথে পরে আসব, আগে চলচ্চিত্র আর মঞ্চের কথা সেরে নি সংক্ষেপে। বছরে অন্তত: দশ-বারোটা ছবি মুক্তি পেত সাড়া কলকাতা জুড়ে: উত্তরা-উজ্জলা-পূরবী, মিনার-বিজলী-ছবিঘর, রাধা-পূর্ণ-প্রাচী, রূপবাণী-অরুণা-ভারতী, দর্পণা-ইন্দিরা, বসুশ্রী-বীণা ইত্যাদি চেন ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মেনকা, আলেয়া, কালিকা ইত্যাদি। ছবিগুলি অক্লেশে তিন-চার সপ্তাহ চলত, কোনও কোনও ছবি রৌপ্যজয়ন্তী বা সুবর্ণজয়ন্তী ছাড়িয়ে যেত। হিন্দি ছবি এই সব হলে ঢুকতে পেত না, কেবল দুটি ছবির নাম আমার মনে পড়ে যা ভারতী হলে রিলিজ করেছিল 'চৈতন্য মহাপ্রভু' ও 'বৈজু বাওরা'। প্রতিটি ছবির একটি করে চটি পুস্তিকা পাওয়া যেত হলে। কাহিনীর চুম্বক, শিল্পী, পরিচালকবৃন্দ, কলাকুশলীদের নাম তো থাকতোই- একেবারে শেষে থাকত গানগুলির বাণী। হলের টিকিট ছাড়াও এই বইগুলি বিক্রি হতো। দুপুর তিনটের শো ছিল বাড়ীর গৃহিণী ও ক্লাস পালানো ছাত্র-ছাত্রীদের সমাগমে ভরা। আর রাত্তির ন-টার শো ছিল সপরিবারে দেখার। মোটমাট সিনেমাজগত ছিল জমজমাট; আর এখন সেই হলগুলির অনেকই সিনেমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
নাটকের এখনকার দুর্দশা তখন ছিল না। সারা কলকাতা জুড়ে মঞ্চের হলগুলি ছিটিয়েছিল , অবশ্য উত্তর কলকাতায় অনেক বেশী। শ্রীরঙ্গম, স্টার, বিশ্বরূপা, রঙ্গনা, সারকারিনা, রঙমহল, কালিকা, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ, প্রতাপ মেমোরিযাল হল, তপন থিয়েটার ইত্যাদি; এ ছাড়াও ছিল ছোট ছোট গ্রুপের জন্য কিছু হল। গমগম করে চলতো; বহু নাটক পাঁচশ' রজনী অতিক্রম করেছে। এ ছাড়াও নিউ এম্পায়ার, মহাজাতি সদন, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, রবীন্দ্র সদন, একাডেমী অফ ফাইন আর্টস প্রভৃতি হলে মাঝে মাঝেই নাটক দেখান হতো।
কণ্ঠসঙ্গীতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বিরাজ করছেন পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেব-বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সুপ্রীতি ঘোষ, আর কত নাম করব? এঁদের প্রত্যেকেরই গায়কীর একটা নিজস্ব ভঙ্গী বা শৈলী ছিল, যা প্রায় ঘরানার মতন, যা কেউ কেউ অনুকরণ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সেই উচ্চতায় পৌঁছোয় নি। উপরোক্ত শিল্পীরা পূর্বসূরিদের ভঙ্গী নকল করেন নি, অমর রয়ে গেছেন স্মৃতিতে।
গানের সুর দেবার জন্য ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অনিল বাগচী, অনুপম ঘটক, বিশু মুখোপাধ্যায়, চিত্ত রায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (তিনি আবার সুন্দর সুন্দর বাণী লিখে গেছেন গানের জন্য), দেবেশ বাগচী, দুর্গা সেন, (সুরসাগর) হিমাংশু দত্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কালীপদ সেন, রবীন চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ মজুমদার, অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবল দাশগুপ্ত, অধীর বাগচী প্রভৃতি , আরও কত নাম করব- (এবং সর্বোপরি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ও কাজী নজরুল ইসলাম) কালজয়ী সুরসৃষ্টি বেরিয়েছে এঁদের মাথা থেকে। এঁদের সঙ্গে সমৃদ্ধ বাণী সৃষ্টি করে গেছেন অনিল ভট্টাচার্য, (কবি) বিমলকৃষ্ণ ঘোষ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রণব রায়, রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, শৈলেন রায় প্রমুখ।
এইখানে কিছুটা বাঁক নিই এবং উত্তমকুমার সম্বন্ধে সত্যজিৎ রায়ের মূল্যায়নের কিছুটা অংশ তুলে ধরি:
- I understand Uttam worked in something like 250 films. I have no doubt that well over 200 of them will pass into oblivion, if they have not already done so. This is inevitable in a situation where able performers outnumber able writers and directors. Even the best of actors loses his edge and languishes without a reasonable steady supply of worthy material to keep him on his mettle.
স্বর্ণযুগের পরবর্তী দুই বা তিন প্রজন্মের শিল্পীদের এই দুর্ভাগ্যে পড়তে হয়েছে, যে তাঁরা উপযুক্ত উপাদান পান নি, যে কারণে তাঁদের কোনও সৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, প্রচুর প্রতিবাদ এবং গালাগালি খাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই। ইংরাজী ২০১০ সালে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল 'অটোগ্রাফ'। বইটি নাকি সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' চলচ্চিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং পত্রিকাগুলির রিভিউতে খুবই সুখ্যাতি পেয়েছিল (অবশ্য পশ্চিম বঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্রী গোপালকৃষ্ণ গাঁধি 'paid publicity' বলে একটা কথা বলে গেছেন)। ছবিটির একটি গান 'আমাকে আমার মত থাকতে দাও, নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি আমি' (আমার আবার একটু শ্রবণ দোষ আছে- আমি শুনেছিলাম 'কেমন লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়েছি আমি’)-- জনশ্রুতি গানটি নাকি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, অর্থাৎ আজকের ভাষায় একটা craze তৈরী করেছিল। অথচ কজন এই চিত্রটি সম্বন্ধে আজ আগ্রহ দেখায়, কজনেই বা গানটির কথা মনে রেখেছে? এঁদের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘস্থায়ী হবার মতন বাণী বা সুর তাঁরা পান না। কিন্তু দেখুন, এখনও টিভি-তে 'নায়ক’, 'হাত বাড়ালেই বন্ধু', 'ভ্রান্তিবিলাস', 'ছদ্মবেশী' দেখানো হলে লোকে কাজ ফেলে টিভির সামনে বসে যায়; ''আকাশের অস্তরাগে'' এখনও মনে দাগ কাটে। অর্থাৎ এখনকার গায়নশিল্পীদের সৃষ্টি 'ফুচকা খাও, শালপাতা ফেলে দাও' পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
এই রকম যে সময়ের পশ্চাত্পট, তখন ছবিতে গান প্রয়োগ করার প্রবণতাও ছিল এবং দর্শক তার সমাদর করেছে। বহু দর্শক গানগুলি আবার শোনার জন্য ছবিগুলি ফিরে দেখেছে, কারণ সে যুগে ছবি মুক্তির সাথে সাথেই গানের রেকর্ড বেরুত না। আমি নিজেই ‘ভাদুড়ীমশাই' বলে একটি ছবি তিনবার দেখেছিলাম খালি গানগুলি শুনব বলে (প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কয়েকটি অপূর্ব গান ছিল) এবং শেষ গানটি হয়ে গেলে হল থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
আগে বলেছি, আমি খোঁজার পরিসর ছোট করে নিয়েছি। বিকাশ রায়ের সেরা সময়ের ২২২-টি ছবি থেকে সিনেমা জগতে সঙ্গীতের ভূমিকা, বিশেষ করে বিকাশ রায়ের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব-জনিত প্রভাব-ধারণা ইত্যাদি আন্দাজ করা যাবে না। তাই নজর দিলাম সেই সব ছবির দিকে যাতে চলচ্চিত্র সম্বন্ধে ও তার সঙ্গীত কি রকম হওয়া উচিত সে ব্যাপারে বিকাশ রায়ের অবদান থাকতে পারে; অর্থাৎ সেই সব চলচ্চিত্র যাতে অভিনয় ছাড়াও প্রযোজনা, পরিচালনা, চিত্রনাট্য ইত্যাদিতে তিনি যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণার ছাপ থাকতে পারে। এই রকম ছবির সংখ্যা ১২, যে গুলি হল:
সাল | ছবির নাম | ভূমিকা | সঙ্গীত পরিচালক |
১৯৫১ | জিঘাংসা | সম্মিলিত প্রযোজনা | হেমন্ত মুখোপাধ্যায় |
১৯৫৪ | শুভযাত্রা | প্রযোজনা | সত্যজিৎ মজুমদার |
১৯৫৫ | সাজঘর | প্রযোজনা | সত্যজিৎ মজুমদার |
১৯৫৫ | অর্ধাঙ্গিনী | প্রযোজনা ও পরিচালনা | নচিকেতা ঘোষ |
১৯৫৬ | সূর্যমুখী | প্রযোজনা ও পরিচালনা | হেমন্ত মুখোপাধ্যায় |
১৯৫৭ | বসন্তবাহার | প্রযোজনা ও পরিচালনা | জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ |
১৯৫৭ | নতুন প্রভাত | কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা | নচিকেতা ঘোষ |
১৯৫৮ | স্বর্গ-মর্ত্য | প্রযোজনা | কালীপদ সেন |
1959 | মরুতীর্থ হিংলাজ | প্রযোজনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা | হেমন্ত মুখোপাধ্যায় |
১৯৬০ | রাজাসাজা | প্রযোজনা, কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা | কালীপদ সেন |
১৯৬১ | কেরী সাহেবের মুন্সী | চিত্রনাট্য ও পরিচালনা | রবীন চট্টোপাধ্যায় |
১৯৭৫ | কাজললত | চিত্রনাট্য ও পরিচালনা | নচিকেতা ঘোষ |
১২- টি ছবি, ২৪ বছর এবং ছ-জন সঙ্গীতস্রষ্টা। এর মধ্যে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একক ভাবে গানের বাণী লিখেছেন এগারোটি ছবিতে এবং 'বসন্তবাহার' ছবিতে শ্যামল গুপ্ত ও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ এই দুজনের সাথে তিনিও গানের বাণী লিখেছেন। দেখা যাচ্ছে সত্যজিৎ মজুমদার ছাড়া আর কেউ পরপর দুটি ছবির সুর দেবার দায়িত্ব পান নি। বাণিজ্যিক ভাবে সব চেয়ে সাফল্য পেয়েছে 'সূর্যমুখী' ও 'মরুতীর্থ হিংলাজ' এই দুটি ছবির গানের রেকর্ডগুলি- বিক্রির মাপকাঠিতে এবং স্থায়িত্বের মাপকাঠিতেও। দুটি ছবিরই সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
বিকাশ রায় যখন ছবি প্রযোজনার কথা ভাবলেন, 'জিঘাংসা' হচ্ছে তাঁর এই লাইনে প্রথম প্রয়াস (যদিও আরও তিন জন তাঁর সঙ্গে ছিলেন), তখন স্বাভাবিক ভাবেই গানের ব্যাপারে তাঁর দুটি নামই মাথায় আসে- গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-কে দায়িত্ব দেবার ব্যাপারে পূর্বপরিচিতি কাজ করেছিল- 'অভিযাত্রী', 'ভুলি নাই' এবং '৪২' এই তিনটি ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং তিনটি ছবিই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই বিকাশ রায় হয়তো সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। অসাধারণ কণ্ঠ, গানে সুর দেবার দক্ষতা এসব ছাড়াও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছিল- প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সহজাত ও বাস্তব জ্ঞান। নীচের যে ঘটনার কথা বলছি, সেটি আমি শ্রীকান্ত আচার্যকে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলতে শুনেছি।
'বাঘিনী' ছবিতে সুরসৃষ্টি করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিতে মান্না দে-র গাওয়া একটি গান ছিল- 'ও কোকিলা তোরে শুধাই রে' (শুনতে চাইলে কালো অংশে ক্লিক করুন বন্ধ করতে হলে আরেকবার)। গান রেকর্ডিং-এর ব্যাপারে মান্না দে খুব খুঁতখুঁতে (অর্থাৎ সহজ আজকের বাংলায় বলতে গেলে perfectionist) ছিলেন; কোন গান তিনি একটি মাত্র টেকে রেকর্ড করাতেন না, বেশ কয়েকবার গেয়ে তার মধ্যে সেরাটি বেছে নিয়ে রেকর্ড করার অনুমতি দিতেন। 'ও কোকিলার ক্ষেত্রেও তাই চলছে, এর মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরিচালক বিজয় বসু ও সাউন্ড রেকর্ডিষ্ট- কে একপাশে ডেকে নিয়ে বলে দিলেন, উনি (মান্না দে) যাই বলুন না কেন ওই এক নম্বর টেকটাই রাখবেন। যা হোক, মান্না দে সাত-আটবার গেয়ে সব কটি শুনে তাঁর রায় দিলেন সেই এক নম্বর টেক।
'জিঘাংসা' ছবিতে মাত্র একটিই গান ছিল, ‘আমি আঁধার, আমি ছায়া' (শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন )। গানটি জনপ্রিয় হয়েছিল কি না আমি বলতে পারব না তবে ছবির ভাবানুগ হয়েছিল, সন্দেহ নেই- যেমন হয়েছিল 'মহল' ছবিতে 'আয়েগা আনেওয়ালা'। আমার খুবই ভালো লাগে। পরে এই সুরের আদলেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 'বিশ সাল বাদ' ছবিতে তৈরি করেছিলেন 'কঁহি দীপ জ্বলে, কঁহি দিল'।
এরপর পর পর দুটি ছবি 'শুভযাত্রা' ও 'সাজঘর'- বাণী সৃষ্টি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুর সত্যজিৎ মজুমদারের। 'শুভযাত্রা' আমি দেখিনি, আর সাজঘরের কোন গান আমার মনে পড়ে না। বোঝা যায়, গানের ব্যাপারে জনসাধারণের মনে কোন সাড়া ফেলে নি। কোন রেকর্ড বা সিডি পাওয়া যায় না। এর পর বিকাশ রায় করলেন, এবং নিজের পরিচালনায়- 'অর্ধাঙ্গিনী'। একটি যৌথ পরিবারের ছবি। হালকা ভাবের, যতদূর মনে পড়ে, একটিই গান ছিল, 'মাধবীর কুঞ্জে, মৌমাছি গুঞ্জে’। গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন ) । কথা আবার সেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, তবে এবারে সুরকার নচিকেতা ঘোষ, যিনি অনেক সার্থক এবং জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন জীবনে। কোন রেকর্ড বা সিডি এখন আর পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। খুবই শ্রুতিমধুর গান। যতদূর জানি, ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল।হিন্দি ছবি 'পরিবার' এই ছবির রূপান্তর।
এর পর এলো 'সূর্যমুখী' গজেন্দ্র মিত্রের কাহিনী অবলম্বনে। বিকাশ রায় আবার নির্ভর করলেন সেই পুরনো জুটির উপরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল, ছবির গানগুলিও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, আজও গানগুলির সিডি পাওয়া যায় এবং বাজান হয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন, 'আকাশের অস্তরাগে', 'আমার সূর্যমুখী তোমার মুখের পানে' ও 'আর যে পারি না সহিতে"- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজে গেয়েছিলেন 'ও বাঁশীতে ডাকে যে'। এ ছাড়া একটি কথকতা গানও ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ('শ্রীরাম কহেন সীতা শুন এ বচন')। একটি গান সাজাচ্ছি, যেটি আমার খুবই ভালো লাগে (শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন )
সিনেমাতে গানের ব্যাপারে বিকাশ রায়ের একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলে আমার ধারণা হয়েছে। সেটা হল তিনি প্রয়োজন ছাড়া গান ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না। নাটকে বা চলচ্চিত্রে পরিস্থিতি বা মনের ভাবাবেগ দেখাতে স্বগতোক্তি বা কথোপকথনের চেয়ে একটি ভাবাপযোগী বা পরিবেশানুগ গান দর্শকের মনে অনেক বেশী প্রভাব ফেলে এবং সব পরিচালকই এ ক্ষেত্রে গানের প্রয়োগ করে থাকেন। বিকাশ রায় প্রয়োজনের অপেক্ষা বেশী অর্থাৎ অহেতুক গান কখনই ব্যবহার করেন নি। কিন্তু এর পরে যে ছবি তিনি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন- 'বসন্তবাহার'- তার কথা স্বতন্ত্র । এটি ছিল একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীর সাধনার কাহিনী, প্রেম এসেছে সাহচর্যের ফল হিসেবে- অতিরিক্ত। এ ছবি ছিল গানে ভরা। যতদূর মনে পড়ে বারোটি গান ছিল শিল্পীও ছিলেন অনেক: এ টি কানন, হীরাবাই বরোদেকর, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক ভার্মা, বড়ে গুলাম আলী খান, আমীর খান, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাধবী ব্রহ্ম। সুর রচনার দায়িত্বে এলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, যাঁর শিষ্য অগণন, বিশেষ করে তবলার ক্ষেত্রে। নিজে গাইতেন, অসংখ্য গানের বাণী ও সুর রচনা করেছেন, অত্যন্ত কুশলী হারমোনিয়াম বাদক ছিলেন (বহু গায়ক হারমোনিয়ামে তাঁর সঙ্গত পেলে সুখী হতেন)। আকাশবাণীর রম্যগীতি বা সুগমসঙ্গীত বিভাগে বহু গান ছিল যার কথা ও বাণী তাঁর রচনা। কাজেই গান খুবই উজ্জ্বল ছিল এই ছবির।দুটি গান আমি তুলে ধরছি: প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া 'বারে বারে ছুটে যাই, চরণের ধ্বনি শুনে’ ( শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন ) ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'ললিতা গো, বলে দে কোন পথে গেল শ্যাম' ( শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন )।
এর পরের দুটি ছবি 'নতুন প্রভাত' (বিকাশ রায় প্রযোজনা করেন নি কিন্তু অভিনয় ছাড়াও কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন)আর 'স্বর্গমর্ত্য' (বিকাশ রায়ের প্রযোজনা কিন্তু পরিচালনা নয়)- গানের দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই, যদিও বিকাশ রায়ের মতে নতুন প্রভাত তাঁর পরিচালিত ছবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। 'স্বর্গ-মর্ত্য' ছবিটি মাঝে মাঝে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে দেখান হয়; ছবিটিতে একটিই গান আছে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু ও অন্যান্যের কণ্ঠে, উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
এর পরের বিকাশ রায় প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ আমার মতে কাহিনী, পরিচালনা, অভিনয়, সঙ্গীত সব বিভাগে বিকাশ রায়ের সফলতম সৃষ্টি, এবং বাণিজ্যিক সাফল্যের দিকেও সর্বোত্তম। সঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির মধ্যে একটি। গানগুলি জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে ছিল এবং এখনও সমাদর পায়। শিল্পীদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বয়ং একক দুটি গান ‘পথের ক্লান্তি ভুলে' ও 'তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ' ছাড়াও একটি শিবস্তোত্র গেয়েছিলেন যাতে তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর ও গীতা দত্ত ( শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন )। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে শম্ভু কাওয়াল ও সম্প্রদায়ের এই কাওয়ালিটি (শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন ) । একটি চণ্ডীস্তোত্রও ছিল ('সর্বস্য বুদ্ধিরূপেণ')।
ছবি 'রাজা সাজা' - সঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন কালীপদ সেন। একটি গান ছিল সমবেত কণ্ঠে; কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। পরের ছবি প্রমথ-নাথ বিশীর একই নামের কাহিনী অবলম্বনে 'কেরী সাহেবের মুন্সী' বিকাশ রায়ের নিজের কথায় 'বড় ক্যানভাসের ছবি'। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সর্বোত্তমদের একজন রবীন চট্টোপাধ্যায়। তথ্যপঞ্জি ঘেঁটে দেখছি কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র ও মিন্টু দাশগুপ্ত। দুটি গান সংগ্রহ করতে পেরেছি: শ্যামল মিত্রের 'কি হলো রে জান' (শুনতে বা থামাতে চাইলে ক্লিক করুন ) ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'ননদিনী বোলো নাগরে' (শুনতে বা থামাতে চাইলে ) ।
এর পর বিকাশ রায় ছবি প্রযোজনা বা পরিচালনার ভার থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তবে চোদ্দ বছর পরে 1975 সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবি নীহার-রঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে 'কাজললতা' তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। শিল্পী ছিলেন মান্না দে ও স্বপ্না দাশগুপ্ত, তবে কোন গানের রেকর্ড সংগ্রহ করা যায় নি।
সূত্র - গানের সব লিঙ্কগুলি ইউটিউব থেকে নেওয়া।
লেখক পরিচিতিঃ ১৯৬১ সালে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট । কর্ম জীবনের পুরোটাই কেটেছে জেসপ কোম্পানী ও Gullick Dobson-এ। শখের মধ্যে ভালো লেখা পড়া এবং অব্শ্যই পছন্দের গান বারবার শোনা, যার সিংহভাগই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত- এ ছাড়া ভক্তিমূলক গান, সাড়া জাগানো বাউল ও ভাটিয়ালী, রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ফেলে আসা দিনের আধুনিক বাংলা গান। সময়ের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করেন। অবসর-এ ওঁর লেখা রাগসঙ্গীত প্রবেশিকা একটি বহুপঠিত রচনা।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.