অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

মেক আপ / মেক ডাউন

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

আমার স্কুল ছিল – বিজয়গড় শিক্ষানিকেতন। বাঘাযতীনে মামার বাড়ী থেকে স্কুলে পড়তাম, কারণ মা- বাবা ওডিশাতে থাকতেন।
গড়িয়ার কাছেই ছিল পদ্মশ্রী সিনেমা হল। আর গড়িয়াহাটে ছিল – আলেয়া।
বাংলা সিনেমা প্রচুর দেখতাম, ক্লাস নাইনে উঠেই। তখন নাইন – ইলেভেনের হায়ার সেকেণ্ডারি !
লায়েক ভাবতাম নিজেকে – একথা মানতে দ্বিধা নেই। ইংরেজী সিনেমা দেখতাম না কারণ ইংরেজী সংলাপ বোঝার মত এলেম ছিল না। “পাতি” বাংলা ইস্কুলে পড়া অন্য ছেলেদের মত ইংরেজিকে ভয় পেতাম আর পাঁচটা ছেলের মত।
সিনেমা দেখার ব্যাপারে ছিল আমার দুই সহযোগী - সজল আর শান্তি। সজল থাকতো যোধপুর পার্কে। তখন অবশ্য এত রমরমা ছিল না ঐ অঞ্চলের। শান্তির আস্তানা ছিল – লায়েলকা মাঠের কাছে।

বিজয়গড় শিক্ষানিকেতনের পাশেই ছিল – বিখ্যাত গায়ক, সুরকার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী। ওনার কাছে সিনেমা জগতের প্রচুর লোক আসতেন। কাজেই “সচক্ষে” কোনো সেলাব্রেটিকে দেখা অন্তত আমাদের কাছে বিস্ময়ে র ব্যাপার ছিল না।
একবার শান্তি বলল – গুরুর ( উত্তমকুমার) একটা হেব্বী বই দিয়েছে আলেয়ায়। একটু পুরোনো, তবে আগে দেখিনি। যাবি নাকি দেখতে ?
বোঝো কাণ্ড ! এ যেন সেই – পাগলা খাবি নাকি, আঁচাবো কোথায় কেস ! তখন অবশ্য পাগলারা ক্ষীর খেতো না বা খেলেও জানা ছিল না, কারণ পকেট মানি ছিল ............ না ! বলবো না লজ্জা করছে বলতে।
তবে, এটুকু বলতে পারি- তখন এক আনায় এক বড় প্লেট ঘুঘনি আর চার আনায় দুশো এমএলের এক বোতল কোকাকোলা পাওয়া যেতো।
সজল বললো – এই বইটা দেখতেই হবে। শুনেছি অমরেশদা গল্পটা লিখেছে ! ( পরে জেনেছি এটা একটা বিদেশী গল্পের অনুপ্রেরণায় লেখা, চিত্রনাট্য – অমরেশদা বা বিধায়ক ভট্টাচার্যের।
পুরোনো বই বলে সেরকম ভীড় ছিল না আলেয়াতে, তবু পঁয়ষট্টি পয়সার লাইনে ভালই ভীড় ছিল বলে মনে আছে।
যোগজীবন সরকারের রোলটা কে করেছেন- প্রথমে বুঝি নি। খল প্রকৃতির নায়েব, কাটা কাটা উচ্চারণ , এক নিশ্বাসে নায়ক রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশলতিকা বলা , এতো এলেবেলে লোকের কম্মো নয়।
জানলাম এনার নাম বিকাশ রায়। নাকি, আমাদের কাছেই থাকেন। জানি না, বিকাশবাবুর আসল পদবী বন্দ্যোপাধ্যায় হবার জন্য, ওই পদবীটা বেছেছিলেন কিনা-প্রয়াত বিধায়ক ভট্টাচার্য।
সজল বলল – এমা জানিস না ? বিকাশ রায় তো রোজ মর্ণিং ওয়াক করেন – তাঁর পোষা অ্যালসেশিয়ানকে নিয়ে।

উত্তমকুমার তখন তো আকাশের চাঁদ, ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অন্তত বিকাশ রায়কে তো দেখতে পাবো, মেক আপহীন অবস্থায়। একজন সিনেমা তারকাকে নিজের চোখে দেখে বিস্ময় জিনিসটা উপভোগ করবো বলে মনস্থির করলাম। বাঘাযতীনে ফিরে যাওয়ার পথে ডান দিকে সেই বসত বাড়িটা ( যতদূর মনে পড়ে ফ্যাকাসে সবুজ রঙ ছিলো বাড়ীটার) মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম। এখানেই থাকতেন সেই বিকাশ রায়। সজলই দেখিয়ে দিল।

জনশ্রুতি আছে – হিন্দি সিনেমার নায়ক দেবানন্দ্ নাকি বিকাশ রায়ের চলন বলন – নকল করতেন । সেই ঘাড় ব্যাঁকানো , সেই আঙুল তোলা। যদিও দেব সাহাবের চুলের ছাঁট ছিল সাদা কালো যুগের ইংরেজি সিনেমার নায়ক গ্রেগরি পেকের এবং বলা হত দেব সাহাব গ্রেগরি পেকের নকল করতেন। বিকাশ রায় সম্বন্ধে কিন্তু সেই অভিযোগ ওঠে নি কোনোদিন। এটা তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈলী ছিল। জানি না কতটা ঠিক, এই জনশ্রুতি তবে – যা রটে, তা কিছুটা তো বটেই।

বাংলা উচ্চারণ ঠিক ভাবে করার জন্য বিকাশ রায়, তাঁর আত্মজীবনী মূলক বই “আমি” তে লিখেছিলেন :-

“অহীন্দ্র চৌধুরী থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী ছিলেন যুগলকিশোরের বন্ধু। প্রম্পট্ , অভিনয়ের সাজসরঞ্জাম যোগাড় করতেন। কিন্তু কোন অজানা কারণে তিনি ষ্টেজে অভিনয় করেন নি কখনও।”

একথা পরে বিকাশবাবুকে জানিয়েছিলেন স্বয়ং শিশিরবাবু পরিচয় হবার পর। উনি লিখেছেন :-

“সেই গোড়াপত্তন—বাবার কাছে। অর্থাৎ বংশপরম্পরা—gene—বাবার কাছ থেকেই আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। বাবা নিজে কোনদিন থিয়েটার—যাত্রায় অভিনয় করেননি, কিন্তু তিনি বড় অভিনয় শিক্ষক ছিলেন। এক সময় ভবানীপুরে একটা অপেশাদার নাটুকে দল ছিল।

এতে অভিনয় করতেন তিনকড়ি চক্রবর্তী, অহীন্দ্র চৌধুরী, ইন্দু মুখুজ্যে, হরিমোহন বোস প্রমুখ। এঁরা কখনো কখনো পাড়ায় চাঁদা তুলে যাত্রা করতেন, থিয়েটার করতেন। এখান থেকেই এঁরা পেশাদার নাটকে অভিনয় করতে যান। কর্ণার্জুন নাটকে তিনকড়ি চক্রবর্তী সেজেছিলেন ‘কর্ণ’, অহীন্দ্র চৌধুরী ‘অর্জুন’, ইন্দু মুখুজ্যে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ আর বহু নাটকে এবং ছবিতে চরিত্রাভিনয়ে হরিমোহন বোস।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস বলে, এইসময় একদিকে শিশির কুমার আর একদিকে এঁরা, বাংলা নাট্যাভিনয়ের ধারা পালটে দিয়েছিলেন। বাবার কাছে শুনেছিলাম, পরে অভিনয় করতে এসে এঁদের কাছেও শুনেছিলাম, বাবা এঁদের দলভুক্ত ছিলেন। মনে পড়ে, স্টেজে একবার, ‘চিরকুমার সভা’য় পূর্ণর ভূমিকা অভিনয় করেছিলাম। বৃদ্ধ বয়সে তিনকড়ি চক্রবর্তী মশাই আবার ওঁর বিখ্যাত চরিত্র ‘অক্ষয়’-এর ভূমিকা নিয়েছিলেন। শিশিরকুমারের ‘শ্রীরঙ্গম’-এর শেষের দিকের অভিনয়। সেই অভিনয়ের প্রাক্কালে রিহার্সালের সময় যখন প্রণাম করে পরিচয় দিলাম, তখন যুগলকিশোর রায়ের ছেলে বলে বিশেষ আদর জানালেন। বললেন যে, ওঁদের প্রথম যৌবনের যুগে বাবা ওঁদের বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। বললেন, ‘আমরা সাজতাম আর যুগল প্রম্পট করতো, অভিনয়ের জিনিসপত্তর যোগাড় করতো, আমাদের ম্যানেজারের মতো ছিল। ওকে আমরা কিছুতেই আসরে নামাতে পারিনি—ও আমাদের নেপথ্য ছিল। অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গেও বহুদিন ওঁদের সেই যাত্রা আর অ্যামেচার থিয়েটারের প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছে। বারবারই ওঁর আলোচনায় পিতৃদেবের কথা উঠেছে। এমনিই অহীনদা স্নেহপ্রবণ ছিলেন, আমার পিতৃবন্ধু হিসেবে আমাকে যেন বেশী স্নেহ করতেন। হরিমোহনদাও বলতেন, ‘যুগল যে কেন অ্যাকটিং করলো না ! ওর ভেতরে মালমশলা ছিল।’
পিতৃদেব যে কেন নিজে অভিনয় করেননি, ছেলেবেলায় আমিও তা বুঝতাম না। আমার কবিতা আবৃত্তি শিক্ষা ব্যাপারেই শুধু নয়, আমাদের গ্রামে, আমাদের বাড়ি দুর্গাপূজার সময়, বাবা থিয়েটার দল গড়লেন।”

বিকাশ রায় বলেছেন গ্রামের রঙলাল ঘোষের কথা। নিজের নামের প্রথম অক্ষর “র” পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারতো না। অংলাল ঘোষ বলতো- নাম জিজ্ঞেস করলে বর্ণপরিচয়হীন খাঁটি গোয়ালা। “অংলালের” ইচ্ছে হলো থিয়েটার করবে। দশাসই চেহারার জন্য পেলো ভীমের পার্ট। যুগলকিশোর রায়ের ট্রেণিংয়ে শিখলো উচ্চারণ।
ধুলোর ওপর বসে পড়ে যখন তখন বলতো :-

অথে কিবা পিয়জন
ভুজদদয় কামমুক আমার ........

অসীম ধৈর্যে যুগলবাবু শেখালেন সঠিক উচ্চারণ। ষ্টেজে অংলাল হয়ে গেল – রঙলাল। সঠিক ভাবে ষ্টেজে উচ্চারণ করেছিল :-

রথে কিবা প্রয়োজন
ভুজদ্বয় কার্মুক আমার .....................

সেই বাংলাদেশ যুদ্ধের ( ৭১-৭২) সময় আমি সজল আর শান্তির সঙ্গে বিশ্বরূপায় গিয়েছিলাম – “চৌরঙ্গী” নাটক দেখতে। নাটকে বিকাশবাবু প্রেক্ষাগৃহের সবচেয়ে পিছনের দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
স্টেজের ওপর থেকে তরুণকুমারের ডাক, ‘স্যাটা, Where is স্যাটা?’ পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বিকাশবাবু বলতেন, ‘I am here sir!’ তারপর অল্প ঝুঁকে এগিয়ে যেতেন ষ্টেজের দিকে। একটা আলো মুখের ওপর পড়তো। সমস্ত দর্শককে তিনি চৌরঙ্গীর হোটেল শাহাজাহানের অভ্যাগত করে নিতেন। অর্থাৎ স্টেজ আর অডিটোরিয়াম এক করে নিয়ে ‘Good evening sir. Have a nice time sir! ইত্যাদি একে ওকে বলতে বলতে স্টেজে উঠে যেতেন। প্যাসেজে একস্ট্রা চেয়ারও থাকতো ভীড় সামলানোর জন্য তবে সেই অসুবিধে গায়ে মাখতেন না বিকাশ বাবু। সেখানে মাইক না থাকলেও – বিকাশ বাবুর গমগমে স্বর সারা হলে ছড়িয়ে পড়তো।

সেই অসাধারণ কণ্ঠস্বর যাঁরা শুনেছেন, একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, এখনও মনে পড়লে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। আমার কেন জানি না – পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর “ মন্ত্রশক্তির” কথা মনে পড়তো! সেদিন কি খেয়ালে আমাদের তিন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন :- Good evening young men. Please have a nice time here!

জান লবেজান ! দিল তররররররররররররর্ !

শোয়ের শেষে দেখা করতে চাইলাম ওনার সঙ্গে ! প্রথমেই জবাব এলো- উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। শো করে হাঁফিয়ে যান। এখন দেখা হবে না ! তখনও বিকাশবাবুর ব্রঙ্কিয়াল অ্যাস্থমা সে ভাবে সেট ইন করে নি, তবে হবো হবো করছে, যেটাকে অনেক ডাক্তারই পরে ভুল ডায়াগনোজ করবে – হার্ট অ্যাটাক হিসেবে।
অনেক সাধ্য সাধনার পর তিনি গ্রীনরুম থেকে বেরিয়ে এলেন তারপরই তাঁর পেটেন্ট ভঙ্গী- তর্জনী উঁচিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন – কি চাই ? উনি ব্যবহারিক জীবনেও এই ভাবে কথা বলতেন।

স্যার ! আমরা আপনার শো দেখতে এসে পরিচিত হতে চাই !

মুচকি হেসেছিলেন কি? মনে নেই এতদিন পরে ! তবে নাম জিজ্ঞেস করে বলেছিলেন – এপার না ওপার?

প্রথমটায় বুঝি নি ! সজল বললো – ওপার !

হুম! নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে অনেকেই আসছেন বটে। প্রতিটা শোই হাউসফুল যাচ্ছে।

আমরা বললাম – স্যার আমরা ভারতীয় তবে ওপারের। সেই সাতচল্লিশেই চলে এসেছিলেন আমাদের বাপ – ঠাকুর্দা।

অটোগ্রাফ দিয়ে ঢুকে গেলেন। কেন জানি না মনে হয়েছিল অহংকারী বেশ বিকাশবাবু! ভুল হতে পারে আমার।

তবে , পাঁচশো রাত্রির সব শো ফুল হওয়া সত্ত্বেও রাসবিহারী বাবু বন্ধ করেছিলেন “চৌরঙ্গী”।
তর্জনী তুলে যে সংলাপ বলার অনবদ্য ভঙ্গিমা বা ব্যারিটোন ভয়েস বা হলেও হতে পারেন অহঙ্কারী – আমার মনে হয় তাঁর প্রপিতামহের সূত্রে পাওয়া , যদিও বিকাশ রায় একথা কোথাও বলেন নি, তবু তাঁর লেখা “ আমি” বইটি শুরুই হয়েছে প্রপিতামহের কথা এবং জিন তত্ব দিয়ে।

ক্যাবারে নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি উঠেছিল সেই সময়ে। অতৃপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষী লোকেরাই টিকেট কেটে চৌরঙ্গী দেখছে বলে কাগজে প্রচুর সমালোচনা।

অনেক পরে, চৌরঙ্গীর লেখক মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় -ক্যাবারে শিল্পী মিস শেফালীর ( আরতি দাস) আত্মজীবনীর উদ্বোধন করতে গিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার ২৪ শে জানুয়ারী ২০১৫ সালে পত্রিকা অংশে লিখেছিলেন :-

“ক্যাবারে হল ও রঙ্গমঞ্চের দূরত্ব ঘুচে গিয়ে দেশের সর্বনাশ হল! দিনের পর দিন হাউসফুলের জনস্রোত দেখে তখনও কেউ আন্দাজ করতে পারেননি যে বাংলায় শতাব্দীর ঐতিহ্যমণ্ডিত সাধারণ রঙ্গমঞ্চের দিন শেষ হতে চলেছে। এমন একদিন আসতে চলেছে যখন কলকাতায় থিয়েটারপাড়া বলে কিছু থাকবে না, যা সমস্ত ভারতে নাট্যামোদীদের বিস্ময় ও ঈর্ষার কারণ ছিল।”

বিকাশবাবুর দাদা বিলেত থেকে ফিরে এলেন চাটার্ড অ্যাকাউট্যাণ্ট হয়ে, বিয়েও করেছিলেন। ফিরে যাবার কথা মাস তিনেক পরে এবং দুভার্গ্যবশতঃ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলেন। সেই সময় এই রোগ সাংঘাতিক। মৃত্যু প্রায় অবধারিত। কোনো চিকিৎসাই ছিল না তখন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় পাঠিয়ে দিলেন এক স্যানেটোরিয়ামে। বিকাশবাবু অনেকবার গেছিলেন সেখানে। দেখেছেন – রোগীদের অসহ্য মনোবেদনা। সবাই বাঁচবে, অথচ আমরা মরে যাবো?- এই ছিলো রোগীদের মনোভাব। প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও দাদা বাঁচেন নি।

এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি নিয়ে এর বছর বাইশেক পর অনন্ত সিংহের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক ) প্রযোজনায় একটি ছবি করেছিলেন – “নতুন প্রভাত”। কাহিনী, চিত্রনাট্য ( সেই সময় বলা হতো – সিনারিও) পরিচালনা সবই বিকাশ রায়ের। ছবিটা ব্যবসায়িক সাফল্য পায় নি এবং সমালোচকরা প্রচুর গালমন্দ করেছিলেন ছবিটি নিয়ে। সার বক্তব্য ছিল – ছবিতে যক্ষ্মারোগীদের মানসিক অবস্থা পরিচালক ধরতে পারেন নি। প্রযোজক অনন্ত সিংহ কিছু বলেন নি বরং তিনি একটি ভালো ছবি করার আনন্দ পেয়েছিলেন। লসের কথা ভাবেন নি। ভাবতেই পারতেন। বিকাশবাবুও তাঁর ছবির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগীদের প্রণাম জানিয়ে শান্তি পেয়েছিলেন।

ভাগ্গিস বিকাশ রায়, বিশে মার্চ ১৯৮৪ সালে প্রেস কনফারেন্স ডেকে অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল অধুনা অ্যামেরিকা প্রবাসী বিকাশ রায়ের সুযোগ্য পুত্র শ্রী সুমিত রায়ের আশ্বাসে।
সুমিত রায় এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও কি রকম পিতৃঅন্ত প্রাণ, সেটা এই লেখার সূত্রে ফোনাফুনি করে বুঝেছি। বাবার মতই সোজাসুজি কথা বলেন – কোনো ভণিতা নেই। বিকাশ রায়ের দুর্ভাগ্য তিনি আজ সব কিছুর উর্ধ্বে !

এই ভাবে অবসর নেওয়ার নজীর আমার জানামতে আরেকজনই করেছিলেন – তিনি হলেন প্রয়াত অভিনেতা কমল মিত্র।

এই “ বিশ” তারিখটা কিন্তু বিকাশ রায়ের জীবনে খুব গুরুত্ব পূর্ণ। একটা প্রায় নাটকও হয়ে গেছে তারিখটা নিয়ে। সেটা অবশ্য - বিশে জানুয়ারী ১৯৩৮।
“আমি তো চাহিনি জীবনে, তুমি অভাগারে চেয়েছো” – নাটকের সঙ্গে বিকাশবাবুর সম্বন্ধ ছিল সেই রকম।

বিকাশবাবুর বাবা ঠিক করলেন – ছেলের বিয়ে দেবেন। দাদার যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর পর বৌমা চলে গেছে কারণ বিকাশবাবু বৌদির দুঃখ সহ্য না করতে পেরে তার আবার বিয়ে দিয়েছেন, ছোট দুই মেয়ের- একটা বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ীতে। বাড়ী গৃহিণীহীন তো থাকতে পারে না!

আর তারপরেই শুরু হলো জমজমাট নাটক।

দেখা শুনো করে পাত্রী এবং তারিখও ঠিক ! বিয়ের দিন পনেরো আগে কন্যাকর্তা বললেন – হাতে টাকা কড়ি নেই, বিয়ে একবছর পেছিয়ে দিন।

যুগলবাবু বললেন – আমাদের তো কোনো দাবী দাওয়া নেই ! আমরা বরযাত্রী না হয় নিয়েই যাবো না, নমো নমো করে বিয়েটা সেরে ফেলুন।

কন্যাকর্তা অনড় ! বিয়ে একবছর পেছোতেই হবে ! যুগলবাবু বিয়ে ভেঙে দিলেন।

আবার পাত্রী খোঁজা ! বিয়ের দিন এবারেও ঠিক ! বিশে জানুয়ারী, ১৯৩৮। বিকাশবাবু পদ্য টদ্য লিখে ফেললেন ! বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা শেষ !

এলো ভাংচি। মেয়ের বাড়ীতে উড়ো চিঠি – এই পাত্র বাজে। ছেলের বাড়ীতেও উড়ো চিঠি – এই মেয়ে খারাপ।

অতএব, এ বিয়েও ক্যানসেল ! অলক্ষ্যে প্রজাপতি হাসছেন !

বিকাশবাবুর মুখ দেখানোর উপায় থাকছে না ! দিদিকে চরমপত্র দিলেন :- বিশে জানুয়ারী বিয়ে দিলে দেবে, না হলে চলেই যাবো বাড়ী ছেড়ে।

যুগলকিশোর উতলা হয়ে পড়লেন। একটি মোটে ছেলে, সে যদি বাড়ী ছেড়ে চলেই যায়, তবে উপায় তো খুঁজতেই হবে। হাতে মাত্র সাত দিন সময়।

এক পারিবারিক বন্ধু আড়কাঠি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন – পাত্রীর খোঁজে !

এদিকে আরেক কাণ্ড ! কমলা দেবীর বিয়ে ঠিক হয়েছে এক দোজবরে লোকের সঙ্গে। বয়েস – ৩৫ বা ৩৬।

ও পক্ষের কোনো সন্তান সন্ততি নেই বিপত্নীক সেই ভদ্রলোকের ! গয়না গাঁটি, কাপড় চোপড় সব কেনাকাটা সারা। কি খেয়ালে হবু স্ত্রী এবং নিজের বাড়ীর কয়েকজনকে নিয়ে ভি শান্তারামের “দুনিয়া না মানে” হিন্দি ছায়াছবি দেখতে গেলেন।

গল্পটা একটা বিপত্নীক ভদ্রলোকের। দ্বিতীয়বার এক যুবতীকে বিয়ে করে কি ভাবে জেরবার হলেন – তারই বিস্তৃত অ্যাখ্যান। ব্যস্। ভদ্রলোকের মাথা গেল বিগড়ে। বাড়ী থেকে পালিয়ে গেলেন !

কমলাদেবীর বাড়ীর সবার মাথায় হাত। এদিক থেকেও আড়কাঠি বেরুলো পাত্র খুঁজতে।

প্রজাপতি মিলিয়েও দিলেন সেই আড়কাঠি দুজনকে।

অতএব মধুরেণ সমাপয়েৎ ! সেই বিশে জানুয়ারী ১৯৩৮ সালে, কমলা দেবী আর বিকাশবাবু পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন।

রেডিও তে কাজ করার সময়েই মাইক্রোফোনের প্রেমে পড়ে যান, বিকাশবাবু- নিজের থেকেই চলে নানা পরীক্ষা। ক্রমে মাইক্রোফোনের কারিকুরী বেশ ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছিলেন।

“ তখনকার সাউন্ড রেকর্ডিস্ট অবনী চক্রবর্তী বলতেন, বিকাশ সেটে থাকলে সাউন্ডের ব্যাপারে আমার কোনও প্রবলেমই হয় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ও চার-পাঁচরকম ভঙ্গিতে ভয়েস থ্রো করতে পারে।

সোজা কথাটা সোজা করে বলতে জানতেন বিকাশদা। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে। ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে নায়কের গলায় বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে ‘আয়ে ন বালম’ গাওয়ানোর বড় সাধ ছিল পরিচালক বিকাশ রায়ের। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তবে প্রথম রেকর্ডিং তাঁর পছন্দ হল না। সেটা অত্যন্ত বিনয়ের সুরে তিনি বড়ে গোলামকে জানিয়েওছিলেন।

তাঁর বক্তব্য ছিল, ছবির দৃশ্য অনুযায়ী তাঁর গান গাওয়া ঠিক হয়নি। ওঁর কথায় বড়ে গোলাম দ্বিতীয়বার গান রেকর্ডিং-এ বসেন। তারপর বিকাশদার মনে হয়েছিল সেই গানে সুরমণ্ডল থেকে সুরের ঝর্না নেমে এল।
এরকমই আরেকটি ঘটনা। চন্দ্রাবতী দেবী অভিনয় করবেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে। ভৈরবী চরিত্রে। পরিচালক বিকাশ রায়। তিনি চেয়েছিলেন ‘ভৈরবী’ যেন একদম নো-মেকআপ লুকে থাক। সেই মতো চন্দ্রাবতী দেবীকে সাবধানও করেছিলেন বহুবার। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বিকাশদাকে লুকিয়ে যেই না চন্দ্রাবতী দেবী মুখে পাউডারের প্রলেপ লাগিয়েছেন, অমনি সকলের সামনে বিকাশদা প্রচণ্ড ধমক দিলেন মেক-আপম্যানকে। শেষ পর্যন্ত প্যারাফিন দিয়ে মেক-আপ তুলতে হয়েছিল। কাজের সময় স্পষ্টবক্তা বিকাশদা কোনও আপস করতেন না।

১৯৫২ সালে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিখবেন বলে সামান্য পারিশ্রমিকে ‘চিরকুমার সভা’য় অভিনয় করেছিলেন বিকাশদা। কিন্তু নাটকে তাঁর মন বসেনি। বলেছিলেন, “মঞ্চে চড়া অভিনয় করে লোকে ক্ল্যাপ পায়, আমি অমন অভিনয় পারব না।”

( আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জুলাই, ২০১৪, অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার)।

তখনকার একজন ফ্লোর ম্যানেজার রঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর বায়োস্কোপিক বইতে বিকাশ রায়কে নিয়ে একটা গোটা পরিচ্ছেদই রেখেছেন। ওখান থেকেই জানতে পারি – ম্যাডাম মানে সুচিত্রা সেন, ফ্লোরে দশ মিনিট দেরি করে আসার জন্য কড়া ধমক খেয়েছিলেন, বিকাশ বাবুর কাছে।

কোনো আপোস তিনি করেন নি জীবনের প্রথম ছায়াছবির ক্ষেত্রেও। এক পরিচালক তাঁকে হয়রাণ করেছিলেন নানান উদ্ভট প্রশ্ন করে। বিকাশ রায় বলেছিলেন, ‘আমার চেয়েও মূর্খের কাছে আমি কাজ করতে পারি না।’

পিছন ফিরে ভদ্রলোককে দেখার জন্য অপেক্ষা করেন নি। রেকমেণ্ডেসন নিয়ে ফিল্মে নামার চেষ্টা সেই বিকাশ বাবুর প্রথম ও শেষ।

“৪২” ছায়াছবি ১৯৪৮ সালে মুক্তি পেলেও আমি দেখেছিলাম – বোধহয়, ১৯৭৫ সালে শেয়ালদার কাছে প্রাচী হলে। আমার সদ্য পরিণীতা স্ত্রী থেকে শুরু করে হলের অগণিত দর্শক পারলে জুতো খুলে মারেন – মেজর ত্রিবেদীকে। মেজর ত্রিবেদী যখন পদপৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে, দর্শকদের সে কি উল্লাস ছাব্বিশ বছর পরেও। হালে বাংলাদেশ হয়েছে, সেজন্যই রিপিট স্ক্রিনিং হচ্ছিল আর দর্শকদের তাই এই রকম প্রতিক্রিয়া। মেজর ত্রিবেদী যেন ইয়াহিয়া খানের প্রতিভূ !

তখন কারিগরি ব্যাপারটা অত উন্নত ছিল না, তাই বিকাশ রায়কে সত্যিই গালের ওপর পায়ের ধাক্কা খেতে হয়েছিল, স্যুটিংয়ের সময়। ফলে গালের ব্যথায় তিনি সাতদিন খেতে পারেন নি। খালি তরল জিনিস খেতেন।

প্রথম বই অভিযাত্রীতে নায়কের সুযোগ পেয়েও তাঁকে নেওয়া হয় নি প্রযোজকরা বেঁকে বসায় অন্য কারণে। বিকাশবাবু লিখছেন :-

“জ্যোতির্ময় রায় আমার রেডিয়ো আমলের বন্ধু। ওঁর লেখা ‘উদয়ের পথে’ তখনো বাজারে বেরোয় নি। ভদ্রলোক বলতেন এবং লিখতেন খুব তীক্ষ্ণ কথাবার্তা। বিশেষ কিছু নামধাম রোজগার তখনো হয় নি। বিমল রায় তাঁর ‘উদয়ের পথে’ ছবি করলেন। জ্যোতির্ময়বাবু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন।

আমার রেডিয়ো ছাড়ার বেশ কিছুদিন বাদে হঠাৎ একদিন ট্রামে ওঁর সঙ্গে দেখা। বন্ধু লাক। দেখা হতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। উনি একটি ছবি প্রোডিউস করছেন। আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজছেন। সেই বইয়ে নায়কের পার্ট আমাকে করতেই হবে। প্রোডিউস করছেন মানে অর্থ বিনিয়োগ নয় তার জন্য অন্য লোক আছে। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, শিল্পী, কলাকুশলী নির্বাচন ইত্যাদি সব কিছুর দায়িত্ব তাঁর। ফিল্ম সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা বলার আগেই ওঁর বাড়িতে ধরে নিয়ে গেলেন আর ওঁর কথায় মুগ্ধ না হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। সুতরাং কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে গেলাম এবং ওঁর সঙ্গে অর্থ বিনিয়োগকারীর বাড়ি গিয়ে নগদ হাজার টাকা নিয়ে চুক্তিপত্রে সই করে দিলাম।

বাড়িতে এসে গিন্নীর হাতে টাকাটা দিতেই সে অবাক। ভাবলো, কর্তা বোধহয় এবার পকেট মারা বা নোট জালের ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। আমি শুধু বললাম, ‘খোদা যব্ দেতা তব্ ছাপ্‌পড় ফাড়কে দেতা। বাইস্কোপের হিরোর বউ হলে গিন্নী। এখন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার টাকার নোট আসবে। তবে কাউকে এখন কিছু বোলো না।’

মাস দু’তিন বাদে বাবা জানতে পারলেন আমার নতুন কর্মকাণ্ডের কথা। কিন্তু তাঁর কাছে তাঁর পুত্রের সব অপরাধের অসীম ক্ষমা। তাঁর ছেলে কখনো কোনো অন্যায় করতেই পারে না। তিনি চুপি চুপি তাঁর পুত্রবধূকে জিগ্যেস করলেন, কথাটা সত্যি কি না। যখন জানলেন ব্যাপারটা ঠিকই তখন বললেন, অভিনয় একটা আর্ট। অনেকে তোর কাছে এই ফিল্ম করার জন্যে ওর নামে যা তা বলবে, তুই কানেও সেসব কথা তুলিস নি মা। ওর ভেতর যে সব গুণ আছে দেখিস ও কত নাম করে।’ আজ এতদিন ধরে সে কথা মনে হলে, আমার চোখ সজল হয়ে আসে। চুপি চুপি বলি, ‘থ্যাঙ্ক য়্যু ওল্ডম্যান, থ্যাঙ্ক য়্যু।’

ফিল্মে সুটিং - এর আগেই কিন্তু ও জগতের বড় বড় গাড্ডাগুলোর মারাত্মক একটায় পড়ে গেলাম। অফিসে চাকরি করি। ছুটিছাটার দিন জ্যোতির্ময়বাবুর বাড়ি যাই। সেখানে, অমায়িক ভদ্রলোক, পরিচালক হেমেন গুপ্তর সঙ্গে ভালো পরিচয়ও হয়। হঠাৎ একদিন শুনলাম ‘উদয়ের পথে’র নায়িকা বিনতা বসুকে আমাদের বইয়ের নায়িকা হিসাবে চুক্তি করা হয়েছে। আমার বাড়ি এসে হাজির। উনি বললেন আমার পক্ষে মহা বিপদ হয়েছে। যাঁরা অর্থ লগ্নী করছেন, তাঁরা বলেছেন যখন উদয়ের পথের নায়িকাকেই নেওয়া হচ্ছে তখন নায়ককেই বা নেবো না কেন। ওই জুড়ির যে নাম হয়েছে সেটা আমরা কেন কাজে লাগাবো না।’ কথাটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। কাজে কাজেই জ্যোতির্ময়বাবু চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। টাকা ফেরত দিয়ে জ্যোতির্ময়বাবুকে ধন্যবাদ জানাতে পারলে আমার পক্ষে সম্মানজনক হত। কিন্তু টাকা খরচ করে ফেলেছি। জ্যোতির্ময় বললেন, ‘মনে কিছু করবেন না বিকাশবাবু, হিরোর পরেই নেক্সট বেস্ট রোলটা আপনার।’ মনকে সান্ত্বনা এবং প্রবোধ দুইই দেওয়া গেল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আরও গোলমাল। হিরোর এক দাদার খুব জমকালো পার্ট আছে কিন্তু সে চরিত্রে আমাকে মানাবে না। ওটা করছেন শম্ভু মিত্র। আমার যতদূর মনে পড়ে, এটাই শম্ভু বাবুর প্রথম ফিল্মে নামা। হিরোইনের বাবার চরিত্র দারুণ—করছেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী। মানাবেও না, আর নির্মলদার সঙ্গে কম্পিটিশানে ওই চরিত্রের দিকে হাত বাড়াবো এতটা মুখ্যু আমি নই। তাহলে তো ফিল্ম অ্যাকটিংকে বিদায় জানাতে হয় কিংবা সদর্পে টাকা ফেরত। দ্বিতীয়টি অসম্ভব সে সময়, আর এতটা এগিয়ে প্রথমটি ইচ্ছে করছে না। জ্যোতির্ময় রায়ের জয় হোক, হিরোইনের ছোড়দার ছোট চরিত্রটি ওঁর কলমে বেশ একটা রূপ পেলো। অগত্যা আমি সেই ছোড়দা। গিয়েছিলাম এক নম্বর হতে। হলাম চার নম্বর। প্রথম ছবিতেই ফিল্ম লাইনের অনিশ্চয়তা জানলাম। ভবিষ্যতে অনেক কাজে লেগেছিল এই অভিজ্ঞতা।”

বিকাশ রায়ের অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কিছুই বলার নেই। তখন তো রেডিওর যুগ, প্রতি শুক্রবার রাত ৮টার অনেক বেতার নাটকে তাঁর অভিনয় এখনও যেন কানে বাজে। রেডিওর “চৌরঙ্গী” নাটকেও বিকাশবাবু স্যাটা বোসের চরিত্রায়ণ করেছিলেন। সেই আশির দশকের শেষভাগেই তাঁর মৃত্যুর পরও আরোগ্য নিকেতন, শ্রীকান্তের উইল, বাঘিনী এমন অনেক ফিল্মে তাঁর কাজ নিয়ে কোনও বিস্তৃত আলোচনা পড়িনি। কেন বাংলায় ফিল্মের অন্য ভাষা সন্ধানী চিত্র পরিচালকের কাছে তিনি অচ্ছ্যুৎ হয়ে রইলেন এও এক অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা।

অবশ্য- তিনি নিজেই একজায়গায় বলেছিলেন , নতুন করে বোম্বে ( এখন মুম্বই) গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ – সেই আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যেই তাঁকে আবার পড়তে হতো।

আমার তো আজও মনে হয় আরোগ্য নিকেতন ছবিতে শুধুমাত্র বিকাশ রায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল জীবন মশাই চরিত্রটি পর্দায় নির্মাণ করার।

অভিনয় করতে গেলে স্বাভাবিক চেহারায় ঔজ্জ্বল্য আনতে মেক আপ জরুরী আর কাঙ্ক্ষিত চেহারাকে অনুজ্জ্বল করতে মেক ডাউন করতে হয়। জীবনের অনেক উত্থান পতন , অনিশ্চিয়তা বিকাশবাবুর অহরহ সঙ্গী ছিল। তাই-তাঁর জীবনকে মেক আপ- মেক ডাউন বলেছি।

বিকাশবাবুর অনেক ছায়াছবি আর নাটক দেখে আমার মনে হয়েছে :-এই উপস্থাপনা , অভিনয় বা ভয়েস থ্রোয়িংয়ের গুণেই ভদ্রলোকের অভিনয় সত্তা চিরকালীন অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট হয়ে থাকার কথা। দুর্ভাগ্য সেটা এখনও পর্যন্ত হয়ে ওঠে নি।

তথ্যঋণ:
বিকাশ রায়ের লেখা, “আমি”, আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল পত্রিকা।

কৃতজ্ঞতা:
চন্দন গোস্বামী
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য


পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট, দোতালা বাস এবং নাট্যে উপেক্ষিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.