অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

নিজেকে নিয়ে লেখা

বিকাশ রায়

[১৯৮৭ সালে প্রয়াণের দুবছর আগে বিকাশ রায় "আমি" নাম দিয়ে তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। চার দশকব্যাপী তাঁর অভিনেতা-জীবনে তিনি যা উল্লেখযোগ্য মনে করেছেন সেই বইতে বলেছেন নিজের মতো করে, সেখান থেকে সঙ্কলিত কিছু উদ্ধৃতি পাঠকদের কাছে মানুষটির চিন্তা, অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিত্বের একটা ছবি খাড়া করে দিতে পারবে। বন্ধনীভুক্ত পৃষ্ঠাসংখ্যার উৎস তাঁর সব রচনার একত্রিত খণ্ড "কিছু স্মৃতি, কিছু কথা" (করুণা প্রকাশনী ২০১১)]

 

মুখে রং মাখছি, সাজপোশাক পরছি, কণ্ঠস্বরের নানা কেরামতি দেখাচ্ছি—সে প্রায় চারদশকব্যাপী সময়ে। কিছু সুনাম দুর্নামও অর্জন করলাম এর মধ্যে। কেউ দিয়েছে বাহবা, কেউবা করেছে নিন্দে। কেউ ভালবেসেছে কেউ করেছে ঘেন্না। ছবি, রঙ্গমঞ্চ, বেতার, গ্রামোফোন রেকর্ড, বহুতর ক্ষেত্রে আমার বিচরণ। বহুতর আমার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সবই তো করেছি দিনগত অভ্যাসের ফলে। একটা থেকে আর একটা—সামান্য রোজগার থেকে কিছু বেশী পয়সা আয় করার প্রয়াস। কখনো তো ভাবিনি যে অন্য কোন কাজ না করে এই অভিনয় কাজটাই করছি কেন? অভিনয় করার জন্য আমার তো কোন প্রস্তুতি ছিল না! যে বয়সে মানুষ পেশা পছন্দ করে বা পছন্দ করতে বাধ্য হয়, তখনো কিন্তু আমি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রায় তিরিশ বছর তুলনামূলকভাবে অসফল জীবন কাটিয়ে, টেকনিক কিছু না জেনে, শুধু কমনসেন্স- এর ওপর নির্ভর করে এখানে এলাম—এবং মোটামুটি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলাম। (১৫)

 

এতদিন বাদে, বৃদ্ধ হয়ে যাবার পর পুরানো দিনের দিকে ফিরে দেখতে পাচ্ছি—নাটক আমাকে ঘিরে ধরে রেখেছে আমার বংশ পরিক্রমায়, আমার প্রতিদিনের জীবনে, দিনের পর দিন। “আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, তুমি অভাগারে চেয়েছ”—নাটকের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ অনেকটা সেই রকম। জ্ঞাতসারে নাটুকেপনা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু নাটকের ছোঁয়া আমার জীবনের সর্বত্র। (৩৩)

 

ছেলেবেলায় মাচা বেঁধে থিয়েটার থিয়েটার খেলা, আমাদের সময়ে খুব চালু ছিল। এ খেলা আমিও খেলেছিলাম আর সেসব পালায় আমিই দৃশ্য সংস্থাপক, আমিই মোশন মাষ্টার-পরিচালক, আমিই মূল অভিনেতা। ছাত্র অবস্থায় কলেজের ফাংশানে আর ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিট্যুটের সভ্য হিসেবেও অভিনয় করেছিলাম। কিন্তু এসব নিছক অ্যামেচার ব্যাপার ছাড়া অভিনয়কে আমার বিশেষ চিন্তার মধ্যে কখনোই আনি নি। রেডিও প্রথমে, তারপর সেখান থেকে পাকেচক্রে ফিল্ম!—স্টেজে অভিনয়, মানে পুরোপুরি পেশাদারী অভিনয় আমার সব চেয়ে শেষে। (২৯৭)

 

‘Made for each other!’ -- খবরের কাগজে, সিনেমায়, হোর্ডিং-এ একটি সিগারেট কোম্পানীর বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায়। একটি সুন্দর ছেলে আর একটি সুন্দরী মেয়ে নানা ভঙ্গীতে বসে দাঁড়িয়ে আছে—দেখলে ভালো লাগে! বিজ্ঞাপনের জন্যে ওরা Made for each other! আমি কিন্তু সজোরে বলবো ওই সিগারেট কোম্পানী ভুল করে। যে কোন সুন্দর সুন্দরীকে পাশাপাশি বসিয়ে দিলেই হয় না। Made for each other বলতে বা দেখতে গেলে আমার আর কমলার মানে আমার স্ত্রীর ছবি ছাপা দরকার আর পুরস্কারের টাকা কড়ি আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।

কারণ?

তাহলে বিকাশ কমলার কেচ্ছাটা বলতে হয়— … [এখানে তাঁদের পরিণয়-সম্পর্কিত মজার কাহিনী আছে] নাটক না? তাই বলছিলাম, আমি নাটকের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইলে কি হবে, নাটক আমাকে ছাড়বে না। একজনের দুটি ঠিক হওয়া সম্বন্ধ ভেঙে গেল, আর একজনের একটি। কোন মতেই সংযোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবু হল। পাকা দেখা হল। এবং সাতদিন বাদে, অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না হয়ে আমাদের বিয়েও হয়ে গেল। ...

পঞ্চম অঙ্ক চলেছে এখনো শেষ হয়নি। এখন আমরা পাখা গুটিয়ে বসেছি—আমরা তৃপ্ত। বাবার কথায় বাঁদরের গলায় মুক্তোর হার ঝুলেছিল ঠিকই। যত্ন করে রাখতে পেরেছিলাম কিনা তা’ মুক্তোর হারই জানেন। তবে গত বিশে জানুয়ারী চুয়াল্লিশতম বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছি। (163)

আমাদের দুজনেরই উড়নচণ্ডীপনায় এমনই সায় যে গহনা, গাড়ী, জমি বিক্রি করে ছবি তৈরী করার খেলা খেলি, চড়া সুদে টাকা ধার করে বিলেত আমেরিকা ঘুরে আসি। আমার শ্বশুরমশাই আমাদের স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে অত্যন্ত হতাশ হয়ে মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, ‘যেমন দেবা, তেমনি দেবী, দুটিই বেচারাম’। (১৬)

 

উনিশশো ঊনচল্লিশ—দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের শুরু। … আমার জীবনেও এই সময় লড়াইয়ের ঘনঘটা। বড়লোকের ছেলের কায়দায় ঘুরে বেড়িয়ে, টাকা উড়িয়ে, দিন কাটানোর দিন আমার ফুরোলো, বাবা, চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর। ... কিছুদিন আগে আইন পাস করা গিয়েছিল। শ্বশুরালয় সূত্রে এক নামজাদা ব্যারিস্টারের জুনিয়ার হলাম। কিন্তু এক বছর এক্‌টিনি করে সার্টিফিকেট যোগাড় না করলে কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে রোজগার করা যাবে না—সুতরাং জুনিয়ারী!

[কয়েক ঘাটের জল খাবার পর] অগত্যা আশি টাকা মাইনের চাকরিতে যোগ দিলাম রেডিয়োতে। কাজ কিছুই নয়, একবার দুপুরে আর একবার রাত্তিরে ড্রুকার সাহেব যা ইংরেজিতে এয়ার রেড প্রিকশান সম্পর্কে বলবেন, তার পরেই সেটা বাংলায় তর্জমা করে বলা। ... আমি ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের প্রেমে পড়ে গেলাম। বীরেন ভদ্র মশাইয়ের ভাঙাভাঙা কিন্তু অপূর্ব ব্যক্তিত্ব সস্পন্ন কণ্ঠস্বরকে কী অদ্ভুত মর্যাদাই না দেয়, কত মৃদুস্বরে কত মধুর কথা, গোপন কথা পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ করে, মাইক্রোফোনের কত কাছে এসে পরিষ্কারভাবে কথা বলা যায়! একটু আধটু সরে দাঁড়িয়ে কথা বললে স্বর পালটে গিয়ে কথার প্রায় অন্য রকম মানে হয়ে যায়। আমি এইগুলোই লক্ষ্য করতাম। মাইক্রোফোনের আশেপাশেই থাকতাম। ... ব্রডকাস্টিংয়ের গোড়ার কথা জানা, রেডিয়ো নাটক বলতে কী বোঝা যায় তা বুঝে কিছু রচনা করার চেষ্টা করা, আর্টিস্টদের রিহার্সাল দেওয়ানো এবং কোন শিল্পী অনুপস্থিত থাকলে সে পার্টও করে দেওয়া, এ সবই আমি করতাম। …(৪১)

রেডিয়োতে কাজের সময় আমার আর একটা লাভ হয়েছিল। বহু গুণীজ্ঞানীর সঙ্গে আমার হৃদ্য আলাপ হয়েছিল। পরের জীবনে এইসব আলাপ-পরিচয়ে আমার ব্যক্তিগত উপকার হয়েছিল অনেক। বড় বড় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। তাঁদের কাছে অনেক কিছু শেখবার সুযোগ পাওয়া যেতো। আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর তো কথাই নেই। পরে যখন ফিল্মে অভিনয় করতে গেলাম, তখন অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র থেকে শুরু করে অনেক বড় শিল্পীর সঙ্গে অপরিচয়ের অস্বস্তিতে আমাকে পড়তে হয়নি। (৪৭)…

[রেডিয়োর চাকরী ছেড়ে বিজ্ঞাপন কোম্পানীর কাজ নিয়েছিলেন। তারপর,] আড়াইশ প্লাস পঞ্চাশ মোট তিনশ টাকার চাকরি ছেড়ে ফিরে এলাম একশ পঁচাত্তর টাকার রেডিয়োর চাকরিতে। ওই মাইক্রোফোনের দাসত্ব করতে। ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে এলাম! (৪৫)

 

বীরেনদা [বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র] বললেন, ‘তুমি ফিল্মে যোগ দাও বিকাশ, তোমার হবে।’ ...
জ্যোতির্ময় রায় আমার রেডিয়ো আমলের বন্ধু। বিমল রায় তাঁর ‘উদয়ের পথে’ ছবি করলেন। জ্যোতির্ময়বাবু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। আমার রেডিয়ো ছাড়ার বেশ কিছুদিন বাদে হঠাৎ একদিন ট্রামে ওঁর সঙ্গে দেখা। বন্ধু লোক। দেখা হতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। উনি একটি ছবি প্রোডিউস করছেন। আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজছেন। সেই বইয়ে নায়কের পার্ট আমাকে করতেই হবে। … যাঁরা অর্থ লগ্নী করছেন, তাঁরা বলেছেন যখন উদয়ের পথের নায়িকাকেই নেওয়া হচ্ছে তখন নায়ককেই বা নেবো না কেন। … জ্যোতির্ময় রায়ের জয় হোক, হিরোইনের ছোড়দার ছোট চরিত্রটি ওঁর কলমে বেশ একটা রূপ পেলো। অগত্যা আমি সেই ছোড়দা। গিয়েছিলাম এক নম্বর হতে। হলাম চার নম্বর। প্রথম ছবিতেই ফিল্ম লাইনের অনিশ্চয়তা জানলাম। ভবিষ্যতে অনেক কাজে লেগেছিল এই অভিজ্ঞতা।

আমার সেই Gene জিন, অস্থি, মজ্জা, মাংস, হৃদয়ের পরতে পরতে পূর্বপুরুষ থেকে ইনজেক্ট করা যে অভিনয় আকাঙ্ক্ষা, যে এতদিন ঘুমিয়ে ছিল আমার মধ্যে, সেই Gene এতদিন বাদে তার সাগরসঙ্গমে গিয়ে ভিড়লো। আমি অভিনেতা হলাম। (৫০)

 

পরিচালক হেমেন গুপ্ত তখন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এক কোম্পানি খুলে নিজেই ছবি করবেন ঠিক করেছেন। একদিন সকালে উনি আমার বাড়িতে এসে ওঁর পরবর্তী ছবিতে অভিনেতা হিসাবে কাজ করার কথা বললেন। … বাড়িতে গৃহিণীর সঙ্গে একটু আলোচনা করলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, হেমেনবাবুর ছবিতে অভিনয় করবো, কিন্তু পুরো কাজটা অর্থাৎ ফিল্ম তৈরি করার কাজটা না শিখতে পারলে শুধু অভিনয় ঠিক মতো করা যাবে না। হেমেনবাবুকে বললাম, ‘আপনার সহকারী করে নিলে তবে আমি অভিনয় করতে রাজি।’ উনি খুশি হয়ে রাজি হলেন। বিজ্ঞাপন কোম্পানির চাকরি আমি ছেড়ে দিলাম। অভিনয় করার যে বীজ আমার রক্তের প্রতি কণিকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, বয়স আজ তিরিশ বছর পার হবার পর তার জিত হল। আমি পুরোপুরি অভিনেতা হলাম। (৫৬)

 

‘ভুলি নাই’ আমাকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ... সত্যি কথা বলতে কী, ‘ভুলি নাই’-এর পর আমাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। অর্থ সংগ্রহ হয়তো যথেষ্ট পরিমাণে হয় নি, কারণ তখনই যুদ্ধোত্তর ব্যবসায়িক ও আর্থিক অবনতি চেপে বসেছে। তাছাড়া দেশভাগের ফল আমাদের শিল্পে জটিল আকার ধারণ করেছে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়ছে। ক্রয়ক্ষমতা কমছে। কয়েক বছর বাদে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ছবি যাওয়াই নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তাই বলছিলাম অর্থ পাইনি কিন্তু শিল্পে স্বীকৃতি পেলাম। দর্শকদের কাছে পেলাম ভালোবাসা।
নতুন অথচ সিরিয়াস মাইন্ডেড লোক এলে সব শিল্পে, ব্যবসায়ে যা হয়ে থাকে আমাদের শিল্পেও ঠিক সেই রকমই রিঅ্যাকসান হল, আমি এবং আমার মত আরও কেউ কেউ লাইনে ঢুকে পড়ার জন্যে। সাধারণতঃ লোকে প্রতিযোগিতা পছন্দ করেন না। একচেটিয়া কাজে অন্য লোক অংশীদার হবে, এটা বরদাস্ত করা শক্ত হয়ে পড়ে। … [আস্তে আস্তে] ফিল্মে আমার সহকর্মীদের স্বীকৃতি আগে পেলাম। ছবির পর ছবি হল। দর্শকরা পছন্দ করলেন। সহকর্মীরা অনেক আগেই আমাকে সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে বাকি সবাই নিজেদেরই একজন হিসেবে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। (৬০)

 

কাজ চলে, নাম যশ হয়, কিন্তু মন খুশি হয় না। কী যেন আমার করা হল না, কী যেন আমার দেবার আছে। মন ছটফট করে। একটা ছবিতে শুধু অভিনয় ছাড়া আমার আর তো কিছু করার থাকে না। তবু মনে হয় আমার আরও কিছু করার আছে। … কিছু একটা করা ঠিক করলাম। অজয় কর, তখনকার দিনের খুব নামজাদা আর্ট ডিরেক্টর বীরেন নাগ, আমি আর সুবোধ দাস নামে আমাদের একটি বন্ধু, চারজনে এক কোম্পানী করলাম। নিজেরা ছবি করবো। আমরা তিনজন খাটবো। কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ ব্যাস্কার ভিল’ অবলম্বনে ‘জিঘাংসা’ ছবি শুরু করা গেল। … ‘জিঘাংসা’ ছবি সম্বন্ধে আজও প্রশংসা শোনা যায়। একটি অপরাধ ও রহস্যমূলক ছবি হিসেবে ‘জিঘাংসা’ অতুলনীয়। অজয়বাবু পরিচালক ও চিত্রশিল্পীরূপে কাজ করেন। বীরেন নাগের শিল্প-নির্দেশনা মনে রাখবার মত হয়েছিল। আমার অভিনয়ও দর্শকদের খুশি করেছিল। আমার এবং আরো দু-একজনের মেকআপ করেছিলেন প্রাণানন্দ গোস্বামী। সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ছবি চলেছিল ভালো। … আরও বছর দুয়েক কেটে গেল। আমি আবার প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করলাম। এবার অংশীদার হলেন পরিচালক চিত্ত বসু আর অভিনেত্রী সন্ধ্যারাণী। ‘শুভযাত্রা’ ছবি হল। লোকে প্রশংসা করলো। কিন্তু টাকা উঠল না। (৬৬)

 

আমার বিশ্বাস হল, দু’-একজন বন্ধুও বললেন, নিজে পরিচালনা না করলে, নিজের চাহিদা মিটবে না। অতএব নতুন পদক্ষেপ। নতুন পদক্ষেপ—চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা। আমার প্রথম ছবি ‘অর্ধাঙ্গিনী’। পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায়-এর একটি খুব ছোট গল্পের আমি চিত্রনাট্য করলাম, পরিচালনা করলাম, অভিনয় অবিশ্যি করলাম। … ‘অর্ধাঙ্গিনী’ দর্শকের খুব ভালো লেগেছিল এবং আমি বছর বছর ছবি করার দলে ঢুকে পড়লাম। (৬৭)

 

এই সময়ে, আমার নটজীবনের প্রথম দশ বছরের মধ্যেই, আর এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল আমার সামনে। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকটা কলকাতার স্টেজে সব চেয়ে খারাপ সময় চলছিল। এই সময় কিছু থিয়েটারের সঙ্গে সংযুক্ত লোক, কিছু দালাল শ্রেণীর লোক, কিছু বা চট করে ব্যবসা করে দু’একদিনের মধ্যে টাকা রোজগারের ধান্ধায় অর্থলগ্নীকারী লোক, সমবেত অভিনয়ের বাবস্থা করতে লাগলেন। … স্টেজ দু-এক রাতের জন্য ভাড়া করে পুরনো জনপ্রিয় নাটক পুরনো জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে সমবেত অভিনয় বা কম্বিনেশন নাইটের ব্যবস্থা করলে বিক্রি হতে পারে। …এই সব অভিনয় আমি কুড়ি-বাইশটি করেছিলাম। তাতে অভিনয় কিছুই হয়নি। কিন্তু আমার লাভ হয়েছিল অনেক। অর্থ তো বটেই, তা ছাড়াও অন্য কিছু: পাবলিক থিয়েটার কীভাবে চলে, সেখানে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে কেমনভাবে অভিনয় করতে হয়, সহঅভিনেতারা, বিশেষ করে যাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাঁরা নবাগতকে কেমনভাবে গ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য তাঁদের সঙ্গে কিভাবে অভিনয় করতে হয়, আমি ওই ক’দিনের থিয়েটার জীবনে খুব ভালো করে সেগুলি দেখেছিলাম এবং নিজেকে তৈরি করে নিতে চেষ্টা করেছিলাম।

কিন্তু এ হচ্ছে নেগেটিভ লাভ। পজিটিভ লাভ ছিল অনেকটা। সেদিনের স্টেজের মহারথীদের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ আমি ওই ক’দিনে পেয়েছিলাম। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, তিনকড়ি চক্রবর্তী, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রভা দেবী, রানীবালা, সরযূবালা প্রমুখ অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া যে কত ভাগ্যের কথা, সে শুধু দু কলম লিখে বোঝাতে পারা যাবে না। (৬৭)

 

আমার মনে হয়, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হল, মধ্য জীবনের দশ-বারো বছর। এই সময় আমার পরিবারেও অসম্ভব উন্নতির দিন। আমার ‘আমি’কে খুঁজে পেতে গেলে মাঝে মাঝে পরিবারের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। পরিবার সুখে-শান্তিতে না থাকলে নিজেকে অসুখী অশান্ত হতে হয়।

একটা ছোট্ট মজার কথা বলে নিই। বহু ছবিতে তখন কাজ করি মদ্যপ খলনায়কের ভূমিকায়। দর্শকদের অনেকে, ব্যক্তিগত জীবনেও আমাকে ঘোর মদ্যপ হিসেবে বিশ্বাস করেন। অথচ আমি জীবনে কোন দিন সখ করে বা ভুল করেও মদ খাই নি। কিন্তু আমার সন্তানদের সেকথা বোঝাই কী করে? তারা তো বাইরে বাইরে ঘোরে, পাঁচজনের সঙ্গে মেশে, পিতার মাতালপনার কথা শোনে। কমলার সঙ্গে পরামর্শ করে বাড়িতে আইন চালু হল যে, সবাইকে রাত সাড়ে নটায় খাবার টেবিলে হাজির হতে হবে। … দিনের পর দিন, খাওয়ার টেবিলে আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখে আমার ছেলেমেয়েও তাদের বাবা যে ঘোর মাতাল নয়, সে বিষয়ে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে চেঁচানোর নৈতিক অধিকার পেল। (৭৩)

 

একদিকে আমার এই পারিবারিক সাফল্য, অন্যদিকে নটজীবনের। আমার পরিচালনায় বছরের পর বছর ছবি হতে লাগলো। ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘সূর্যমুখী’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘বসন্ত বাহার’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘রাজাসাজা’, ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’। এর মধ্যে ‘নতুন প্রভাত’ আমার প্রযোজিত নয় এবং আরো একটি ছবি ‘স্বর্গমর্ত্য’ আমার প্রযোজিত কিন্তু পরিচালিত নয়। ‘নতুন প্রভাত’ প্রযোজনা করেছিলেন অনন্ত সিংহ। আমার নিজস্ব মতে নতুন প্রভাত আমার পরিচালিত সব ছবির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কিন্তু ছবিটি দর্শকসমাজে সমাদর পায় নি। অনন্তবাবু লোকসান খেয়েছিলেন।(৭৪)

 

আমি তো মনে করি, আঙুলে গোনা যে কটি চরিত্রে আমি ভালো অভিনয় করতে পেরেছি, তার মধ্যে ‘রত্নদীপ’ বোধহয় সবার উপরে। আমরা সকলে প্রাণ দিয়ে দেবকীবাবুর নির্দেশ পালন করেছিলাম—ছবি প্রচণ্ড বক্স অফিস হিট করেছিল।(৬২)

 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাস থেকে অরোরা ফিল্মস বিজয় বসুর পরিচালনায় ছবিটি করেছিলেন। ওঁরা আমাকে ‘জীবনমশাই’ চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দেন। এই অভিনয় করার আগে উপন্যাসটি বার বার পড়েছি। চেষ্টা করেছি, ওই সুকঠিন চরিত্রের ভিতরের কথাটি জানার। তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার। আমার নিজের মনে হয়, আজ পর্যন্ত যে প্রায় তিনশো ছবিতে কাজ করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্পূর্ণ, সবচেয়ে একাত্ম অভিনয়, এই ‘জীবনমশাই’ এর চরিত্রেই আমি করতে পেরেছিলাম। (৮৭)

 

ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে একটা ঝড় বইতে শুরু করল। চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি তৈরি হল। … আমাদের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেল। ১৯৫০-৫১ সালে আমি আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছবিদার ছত্রছায়াতলে অভিনেতা-অভিনেত্রীর একত্র হবার প্রতিষ্ঠান ‘অভিনেতৃ সংঘ’ গড়েছিলাম। আজ এতদিন বাদে যখন ছবিদা নেই, আমাদের ছায়া দেবার ছত্র যখন সরে গেছে তখন আমি আর ভানু আলাদা হয়ে গেলাম। রাধামোহনদা, জহর গাঙ্গুলী, উত্তম, আমি, অনেক নামকরা অভিনেত্রী—আমরা ‘অভিনেতৃ সংঘ’ থেকে বেরিয়ে এসে গড়লাম শিল্পী সংসদ। আজ … মনে হয় সব ব্যাপারটাই সাময়িক উত্তেজনার ফল। শুভ লক্ষণ এইটুকু যে, সেদিনে আমরা যারা পরস্পরকে গালাগালি না দিয়ে জল খেতাম না, তারা আবার মানসিক দিক থেকে এক হয়ে গেছি। আমার বিশ্বাস, আমাদের মনের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধে এতটুকু বিদ্বেষ নেই। কাজ একসঙ্গে করি, আড্ডা দিই, পরস্পরের আনন্দে আনন্দিত হই, দুঃখে বিচলিত হই। ... তবু সংগঠন আজও দুটো আছে এবং Vested interest-এর জন্য এক হয়ে যেতে পারছে না। … এই ভাঙার মধ্যে আমার নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারছি না এবং সেইজন্যই প্রার্থনা করছি, আমাদের আজকের প্রগতিশীল শিল্পীরা দুটো প্রতিষ্ঠানকে আবার এক করুন। আমরা যে ভুল করেছিলাম, আমাদের উত্তরসূরীরা সেই ভুলের সংশোধন করুন। (৮৮)

 

হঠাৎ একদিন একটা টেলিফোন এলো। ‘বিশ্বরূপা’ থিয়েটার থেকে রাসবিহারী সরকার করেছেন, আমি যদি তাঁর একটা নাটক শুনি। … বললেন যে, নাটকটার নাম ‘চৌরঙ্গী’—শঙ্করের নামকরা বইয়ের নাট্যরূপ। … আমার Career এবার একটা বড় বাঁক নিলো।’ ৫২-৫৩-৫৪ সালে এখানে ওখানে combination night অভিনয় করেছিলাম, সেকথা আগেই বলেছি। তারপর এই প্রথম, প্রায় পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বছর বয়সে নতুন রাস্তায় কপাল ঠুকে পা বাড়ালাম।

প্রথম নাটক করতে গিয়ে আমার একটি সুবিধে হল যে, আমার সহঅভিনেতা- অভিনেত্রী মোটমাট সবাই ফিল্মের লোক। কেউই স্টেজের মস্তান বলে নিজেকে মনে করেন না। কাজে কাজেই এঁদের সঙ্গে মিলে যেতে আমার দেরি হল না। মঞ্জু দে, জয়শ্রী সেন, সত্য ব্যানার্জি, তরুণকুমার, দিলীপ রায়, রবীন মজুমদার, প্রমোদ গাঙ্গুলী এঁরা সবাই ফিল্মের লোক। গোড়ার দিকে যখন আমার সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তখন এঁরা সবাই অকুণ্ঠভাবে আমাকে সাহায্য করলেন। তার ওপর পরিচালক রাসবিহারী সরকার আমার দু’-একটা Suggestion গ্রহণ করে আমার চরিত্রের অভিব্যক্তিকে স্বচ্ছ, সহজ করতে যথেষ্ট সাহায্য করলেন। আমি ‘চৌরঙ্গী’ নাটকের প্রধান আকর্ষণ হয়ে রইলাম। (৯১)

 

[১৯৭৪ সালে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে] মনে পড়তো ভারতবর্ষের যেকোন প্রান্তে আমি গেছি সেখানে বাঙালী থাকলেই ছুটে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন।
আর কি চাই? আমি সামান্য নট। আমি তো চিরকালের জন্য মানুষের মনে বাসা বাঁধতে পারবো না—কিন্তু যতদিন আছি ততদিন এত যে ভালবাসা, এত যে স্নেহ, তার কি শেষ আছে?’ (৯৩)

 

‘চৌরঙ্গী’ বন্ধ হবার পর শুরু হল বিমল মিত্রের লেখা ‘আসামী হাজির’। ঠিক আগের মতই বিক্রিবাটা। হাউস ফুল—এক্সট্রা সিট। রাসবিহারীবাবু ছশো সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ শো হবার পর ‘আসামী হাজির’ বন্ধ করে দিলেন।... বাড়িতে এসে দেখি, একদল ছেলে অপেক্ষা করছে। নতুন এক নাট্যকার পরিচালক অভিনেতা সমর মুখার্জির ‘বিষ’ নাটকে মুখ্য চরিত্র অভিনয়ের জন্য ওরা দরবার করতে এসেছে। টালা ব্রীজের তলায়, রেলের শান্টিং ইয়ার্ডের মধ্যে, নাম ‘শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চ’। তিনশ— সাড়ে তিনশ সিট। একশ ষাটটি শো হবার পর আমিও ছাড়লাম। … [পরের] নাটকটি ‘নহবত’, নাট্যকার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় ওরই। ‘নহবত’ শুরু হল। ‘দু’-তিন মাস পরে উঠে যাবে'—এই হিসেব কোথায় পড়ে রইল। আমি তো পাঁচ বছর বাদে ছাড়লাম। ‘নহবত’ আরও প্রায় দেড়-দু’বছর চলেছিল। ‘নহবতে’ অভিনয় করে আমি গ্রামবাংলা চিনেছিলাম। প্রথম বছরের শীতকাল থেকেই উত্তরের কোচবিহার থেকে দক্ষিণের ক্যানিং পর্যন্ত সকল জায়গা থেকে ডাক আসতো। যাত্রাদলের মত আমরাও বাসে রওনা হতাম। … পঁচিশ-তিরিশ হাজার দর্শক। স্টেজে দাঁড়ালে দর্শকের প্রায় শেষে দেখা যায় না।(৯২)

 

‘’নহবত’ শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৫ই এপ্রিল অর্থাৎ ১লা বৈশাখ, আর তারপর চললো, কলশোগুলো বাদ দিয়েই, ১৯৮১র জুন মাসের শুরুতেই ১২০০ রাত্রি। … আমি আর পারলাম না। ছেড়ে দিলাম। ১২০০ শোর প্রত্যেকটাতে একই কথা বলছি, একইভাবে হাত-পা নাড়ছি, একইভাবে প্রবেশ করছি, একইভাবে প্রস্থান করছি। ক্রমশঃ অসহ্য ঠেকলো। একঘেয়েমি যেন চারিপাশ থেকে অক্টোপাশের মতো চেপে ধরতে লাগলো। মনে হল, আমি তো সৎভাবে আমার কাজ করছি না। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমার অভিনয়ের দর্শক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছেন। আমি হয়তো সবার মতে ভালো অভিনয় করি না, কিন্তু আমার দর্শক আমাকে ভালোবেসেছেন। আমার Career -এ আমার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়েছেন। এখন কিন্তু তাঁরা ভালোবাসেন বলেই আমাকে সহ্য করছেন। স্টেজে আমি তাদের ঠকাচ্ছি। ... আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনি বহতা নদীর জল, পুকুরের চারিদিকের বাঁধা গন্ডীর মধ্যে আপনি আর ঢুকবেন না।’ (৯৫)

 

থিয়েটার করা ছেড়ে দিলাম বটে, কিন্তু রঙ্গমঞ্চের মায়া ছাড়তে পারলাম না। নতুন পথে রঙ্গমঞ্চকে ব্যবহার করার কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো। ... আমার মনে হল যে কোন একটি কাব্যপ্রধান উপন্যাস যদি অনেকে মিলে স্টেজে বসে পড়া যায়, তাহলে স্টেজের একটা নতুন ব্যবহার হতে পারে। ‘শেষের কবিতা’র চেয়ে কাব্যপ্রধান উপন্যাস আর কোথায় পাবো? তাই প্রথমে ‘শেষের কবিতা’র একটি পাঠ্যরূপ তৈরি করলাম। … এক রবীন্দ্র জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে আমরা ‘শেষের কবিতা’ মঞ্চস্থ করলাম। আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলো সবাই। কিন্তু প্রশংসার মূল ভাগটা পেলাম আমিই।

‘শেষের কবিতা’ অভাবিত সাফল্যের পর বন্ধুদের অনুরোধে ‘চিরকুমার সভা’ নাটককে মঞ্চে পাঠযোগ্য করা গেল। এবারও সাফল্য ও অকৃত্রিম প্রশংসা পাওয়া গেল। মঞ্চকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করার পথ খুলে গেল। আজকাল দেখি বহু নাটক, কাব্য, উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদি স্টেজে বসে পড়া হচ্ছে। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘শ্রুতি নাটক’। রসসৃষ্টি হচ্ছে, দর্শক উপভোগ করছেন। (৯৯)

 

জেনারেশন গ্যাপ বলে কথাটা এতদিন ঠিক বিশ্বাস করতাম না। সমাজেও যেমন, আমাদের এই সঙ্গীত, নাটকেও সেই গ্যাপ যে প্রবলভাবে বিদ্যমান, একথা এতদিনে বুঝতে পারছি। ... দিনে দিনে এই তফাৎ বেড়েই চলেছে। …কিঞ্চিৎ আহত হলেও হাল ছাড়ি নি। আধুনিক কালের পাশাপাশি না হলেও পিছু পিছু চলার চেষ্টা করেছি।

কিন্তু এবারে দেখলাম যে আর পারা যাচ্ছে না। দু’-চারজন নতুন পরিচালক আসছেন নতুন করে কিছু বলতে। নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী দু’-একজন আসছেন নতুন করে অভিনয়ের সংজ্ঞা দিতে। এঁরা আমাদের মতো পুরোনো মানুষদের পছন্দই করেন না। এঁদের কথা তবু বুঝি। কিন্তু অন্য যাঁরা পরিচালনায়, অভিনয়ে আমার চিন্তার চেয়ে বহু পিছিয়ে আছেন, অথচ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কৃপায় কয়েকটি ছবি দেখে নানা রকম বাক্য উচ্চারণ করেন এবং এঁদের অধীনে এবং এক সঙ্গে যখন অভিনয় করতে হয়, তখনই মনে হয়, আর নয়, এবার যাবার বেলা হল।

অনেক ভাবলাম। এক বছর ধরে ভাবলাম। চল্লিশ বছরের শেকড় তুলে ফেলবার চেষ্টা করে শেষে মনস্থির করতে পারলাম। ২০ মার্চ, ১৯৮৪ আমার প্রেসের বন্ধুদের ডেকে বললাম, ‘মন থেকে ছুটি পেয়েছি, শরীর ছুটি চাইছে— এবার অবসর নেবো ভাই।’ বললাম—

‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই
সবারে আমি প্রণাম করে যাই।’

অবাক হলেন বন্ধুরা, ক্ষুব্ধ হলেন, যা আমার প্রাপ্য নয় এমন সব ভালো ভালো কথা সেদিনে বললেন, পরে কাগজে কাগজে লিখলেন। কাগজে এই অবসরের খবর বেরোনোর পর অবাক হলাম আমি। দর্শকদের এত ভালোবাসার অধিকারী যে আমি, তা আমার ধারণায় ছিল না। কত যে টেলিফোন পেলাম, কত যে চিঠি পেলাম আমার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিতে। তাঁদের কাছে শ্রদ্ধাবনত হয়ে রইলাম। চল্লিশ বছরের সাধনা আমার শেষ হল। আমার দর্শককে জ্ঞাতসারে আমি কখনো ফাঁকি দিইনি। বরাবর, সর্বসময়ে সব পরিস্থিতিতে আমি অন্তর দিয়ে সৎ অভিনয় করার চেষ্টা করেছি। শেষের এই টেলিফোন, চিঠি বা সামনে দেখা করে বলা, তারই প্রমাণ। (১০১)

'যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই,
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’

 


(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.