অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

আত্মপ্রকাশ

দিলীপ দাস

সেটা ছিল ১৯৪৭ সাল। বিকাশ রায় আত্মপ্রকাশ করলেন হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। ছবির নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এক নতুন অভিনেতার প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু তারপর কি হল? শুরুতেই কি তাঁর অভিনয় দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল? চিত্র সমালোচকরা কি বুঝতে পেরেছিলেন এই নবাঙ্কুর টালিগঞ্জের আগাছা নয়, ভবিষ্যতের মহীরুহ? সেই যুগের পত্র-পত্রিকাগুলি কি লিখেছিল তাঁর সম্বন্ধে? এই রকম কয়েকটি প্রশ্নের আলোচনা নিয়ে এই প্রবন্ধের অবতারণা।

প্রশ্নগুলির জবাব খোঁজার আগে বিকাশবাবুর আত্মপ্রকাশের সময় বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ কেমন ছিল একবার দেখে নেওয়া যাক। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের শুরুর পর দুই দশকও পেরোয়নি। ১৯৪৭ সালে বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ২৮টি ও পরের বছর ৩৯টি (দেশ, পৌষ, ১৩৫৫)। বিমল রায় ১৯৪৪ সালে ‘উদয়ের পথে’ তৈরি করে বাংলা সিনেমাকে নতুন পথ দেখিয়েছেন কিন্তু তার পর নিউ থিয়েটার্সের গৌরব মরুপথে হারাল ধারার মতন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চে নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর তেজ মধ্যাহ্ন থেকে পশ্চিমে হেলে পড়লেও তাঁর খ্যাতি বিন্দুমাত্র কমেনি, তাঁর সাথে আছেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গাঙ্গুলী, যোগ দিয়েছেন ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, প্রমুখ আর পশ্চিম আকাশে সমস্ত রং উজাড় করে দিয়ে অস্ত যাচ্ছেন প্রমথেশ বড়ুয়া। মহিলাদের মধ্যে কানন দেবী একাই রূপালী পর্দার দুকূল ছাপিয়ে বিরাজ করছেন। সাথে আছেন মলিনা দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, বিনতা বসু, সন্ধ্যারাণী, প্রমুখেরা।

বাংলা সিনেমা জগতে গেলো-গেলোটা এখন যেমন আছে, তখনো ছিল। ইংরেজি সিনেমাকে লোকে অশ্লীলও বলবে, আবার হলভর্তি করে দেখতেও যাবে, বোম্বের সিনেমাকে বাজার কেড়ে নিচ্ছে বলে গালাগালিও দেবে, আবার শিল্পীরা বাংলা ছেড়ে বোম্বে পাড়িও দেবেন। বাংলা সিনেমার কোনো এক নায়িকার (যিনি পরিচালকের স্ত্রী ছিলেন) কোমরের কিছু অংশ অনাবৃত দেখানোর জন্য, দর্শকের দল সৃষ্টি রসাতলে গেল বলে হৈ হৈ করে উঠেছিল। অতি উৎসাহী কয়েকজন আবার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে সিনেমাকেও জাতীয়করণ করা হোক। আর বর্তমানের মতই সেযুগেও সিনেমার মৌলিক কাহিনীর ভাণ্ডারে মা ভবানীর পক্ষপাত বেশী রকম ছিল।

তখনকার জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রবাণী’তে (শারদীয়া, ১৩৫৭) কবি বিমল চন্দ্র ঘোষের লেখা একটি কবিতা থেকে ক’লাইন তুলে দিচ্ছি, যা থেকে সেযুগের বাংলা সিনেমার হাল-হকিকত বেশ কিছুটা বোঝা যায়।

“নাচ গান হল্লা আর সিনেমার বেলেল্লাপনায়
মার্কিন-বোম্বাই মার্কা ব্যভিচার আকাশে ঘনায়।
......
“যাদের স্বপ্নের রঙে রক্তরাঙা বিশাল ভারত
তাদেরই সন্তান আজ হেঁটমুণ্ডে নাকে দেয় খৎ।
হিন্দীর সাম্রাজ্যবাদী ঘৃণ্যতম রিরংসার ফাঁদে
বোম্বায়ের পদাঘাতে হতদর্প ‘টলিউড’ কাঁদে।
........
স্টুডিয়োতে কাহিনীর মর্মভেদী লাশ কাটা ঘরে
বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরতের শেষ রক্ত ঝরে।
......
চলচ্চিত্রশিল্পীদল পলাতক বোম্বায়ের ডাকে
চাঁদির চুক্তির মোহে হিন্দী প্রেম-রাগিণীর পাঁকে”।

কবি-সাহিত্যিকেরা সেকালে সিনেমাকে কি চোখে দেখতেন, সেটা বোঝা যায় কবিশেখর কালিদাস রায়ের লেখা এই কবিতাটিতে (চিত্রবাণী, আষাঢ় ১৩৫৬)

“এযুগে সিনেমা দেবী তোমারি তো জয়জয়কার,
আমাদের মনোরাজ্যে রাজত্ব তোমার।
সাহিত্যকে দিন দিন তুমিই তো করিতেছ গ্রাস
দলে দলে সাহিত্যিক তোমারি তো দাস।
নাটক তোমার হাতে হ’ল ঝুমঝুমি
নভেল পড়ার নেশা ঘুচায়েছ তুমি”।

ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা টালিগঞ্জকেও রেহাই দেয়নি। বেশ কিছু কলা-কুশলীদের ওপর এর আঁচ পড়েছিল। ছবি বিশ্বাসকে তাঁর পার্ক সার্কাসের বাসা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে হয়েছিল, কিন্তু কমল মিত্তির মশাইয়ের বিরাট চেহারা দেখে ও গম্‌গমে কণ্ঠস্বর শুনে ভবানীপুরের গুণ্ডারা তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস করে নি।

বাংলা সিনেমার সেই টাল-মাটাল যুগে, বিকাশ রায়, এক প্রাক্তন বেতারকর্মী, একরকম হঠাৎই যোগ দিলেন সিনেমায়। ছোটোবেলা থেকে হিরো হব সেরকম কিছু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু তাঁর এবং বাংলা সিনেমার ভাগ্যের লেখা খণ্ডায় কে? তাঁকে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করতেই হল। তাঁর আত্মজীবনী ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’তে সিনেমায় অভিনয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে, ‘অভিযাত্রী’ সিনেমায় প্রথমে তাঁর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে নায়ক নয়, শেষে নায়িকার ছোড়দার চরিত্রে অভিনয় করতে হল তাঁকে।

যেভাবেই হোক বাংলা সিনেমা জগতের এক মাহেন্দ্রক্ষণে ভবিতব্য তাঁকে টেনে আনল স্পটলাইটের তলায়, যা পরবর্তী চার দশক ধরে বাংলাকে দিয়ে যাবে অসামান্য কিছু ছবি ও কিছু অবিস্মরণীয় কিছু মুহূর্ত। বিকাশবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে তাঁর এই আত্মপ্রকাশ সম্বন্ধে লিখেছেন -

“আমার সেই Gene, অস্থি, মজ্জা, মাংস, হৃদয়ের পরতে পরতে পূর্বপুরুষ থেকে ইনজেক্ট করা যে অভিনয় আকাঙ্ক্ষা, যে এতদিন ঘুমিয়ে ছিল আমার মধ্যে, সেই Gene এতদিন বাদে তার সাগরসঙ্গমে গিয়ে ভিড়লো। আমি অভিনেতা হলাম”।

‘অভিযাত্রী’ তখনকার বাজারে মোটামুটি সুনাম পেয়েছিল। সেযুগে ‘বঙ্গীয় চলচ্চিত্র দর্শক সমিতি’ নামে দর্শকদের এক সমিতি প্রতি বছর দর্শকদের ভোটের মাধ্যমে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করত, তখনকার এক জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকা ‘রূপমঞ্চ’র মাধ্যমে। ১৩৫৩ সালে এই প্রতিযোগিতায় ‘অভিযাত্রী’র স্থান ছিল শ্রেষ্ঠ চিত্রের মধ্যে নবম, মৌলিক কাহিনীর মধ্যে তৃতীয়, চিত্রনাট্যের মধ্যে চতুর্থ। অভিনেতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারিত হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস, বিরাজ বৌ ছবির জন্য, তৃতীয় স্থানে ছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী ‘অভিযাত্রী’ ছবির জন্য। আর দর্শকের বিচারে ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য, ২০১টি ভোট পেয়ে বিকাশ রায় ছিলেন দ্বাদশ স্থানে। রূপমঞ্চ পত্রিকার এই পাতাটির ছবি এখানে তুলে দিলাম। সংখ্যার হিসেবে হয়তো এটা অন্যান্যদের তুলনায় নগণ্য, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে যে সেই যুগের বিশাল ব্যক্তিত্বদের মাঝে, বিকাশবাবুর মতো সম্পূর্ণ আনকোরা এক অভিনেতাকে প্রথম ছবিতেই অন্তত ২০১ জন দর্শকের শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছিল, এটা কম কথা নয়। এই ২০১ জনই পেয়েছিলেন এক অঙ্কুরের মাঝে আগামী মহীরুহের সন্ধান।

বিকাশবাবু তাঁর আত্মজীবনী ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’তে এই সম্বন্ধে লিখেছেন -

“এতগুলি বড় অভিনেতাদের মাঝে আমি নতুন একটি ছোট চরিত্রের অভিনেতা অন্তত ২৮৬ জনকে খুশী করতে পেরেছি, তাঁরা শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান আমাকে দিয়েছেন। এই জনের একজনকেও আমি চিনি না কিন্তু আমি তাঁদের পায়ে প্রণাম জানালাম, তাঁদেরই মধ্যে দিয়ে আমি জনগণের আদেশ পেলাম”।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে প্রতিযোগিতার আয়োজক ‘বঙ্গীয় চলচ্চিত্র দর্শক সমিতি’ কোনো হেঁজিপেঁজি পাড়ার ক্লাব ছিলনা, এর সভাপতি ছিলেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সম্পাদক অধ্যাপক নির্মল কুমার ভট্টাচার্য।

চিনতে পেরেছিলেন আরো একজন। সেযুগের সিনেমার আকাশের একটি উজ্জ্বল তারা চিনতে পেরেছিলেন কিশোর বিকাশ রায়ের মধ্যে ভবিষ্যতের অভিনেতাকে। তাঁর ভাইয়ের বন্ধুত্বের সংযোগে সেই তারার বাড়িতে গেছেন বিকাশবাবু। দু’একটা কথা বলার পর তাঁর কি মনে হল, বিকাশবাবুকে অফার দিলেন দেবদাস ছবিতে পার্বতীর সৎ ছেলে মহিমের ভূমিকায়। বিকাশবাবু রাজী হন নি। তার প্রায় পনের বছর পর আবার দেখা সেই তারার সাথে, তখন তিনি অস্তগামী। চিনতে পারলেন, বললেন – ‘বিকাশ সেই ফিল্‌মে এলে, তবু আমার ডাকে এলে না।’ আশা করি দেবদাস শুনে চিনতে পেরেছেন সেই তারাটিকে। ঠিক ধরেছেন - প্রমথেশ বড়ুয়ার জহুরী চোখ প্রথম আলাপেই চিনতে পেরেছিল ভবিষ্যতের বিকাশ রায়কে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়া হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছিল বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি। হেমেন গুপ্ত নিজে ছিলেন এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। যাঁদের আত্মত্যাগ আর অশ্রু-ঘাম-রক্তের পথে স্বাধীনতা এসেছে, তাঁদের স্মরণ করে এই ছবিটি গড়ে তুলেছিলেন হেমেনবাবু। এই ছবিতে বিশ্বাসঘাতক মহানন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিকাশবাবু। তাঁর অভিনয় এতই ভালো হয়েছিল যে, এর পর তাঁকে আর অভিনয় জীবনে পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।

সত্যজিৎ রায় হেমেনবাবুর পরিচালিত দুটি ছবি ‘ভুলি নাই’ ও ‘৪২’ (এই ছবিটির কথায় পরে আসছি) সম্বন্ধে লিখেছিলেন-

“Hemen Gupta’s films Bhuli Nai and ’42 had a major asset: the director’s sincerity. Besides both films can claim complete originality in their subject matter. One doesn’t need to be told that the feeling of patriotism that runs through these films is the director’s own – it is not borrowed from anywhere. It is that feeling that touches the heart of every viewer, in spite of various technical faults.” (Speaking of Films, Penguin, 2005, p.94)

সেকালের আর একটি জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকা রূপমঞ্চ ‘ভুলি নাই’ সিনেমাটির আলোচনা করে লিখেছিল-

“বাংলা চিত্রজগতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা......পৃথকভাবে কোনো শিল্পী বা কর্মীকে আমরা অভিনন্দন জানাতে চাই না – আমরা মনে করি সকলের সমবেত প্রচেষ্টায়ই এরূপ সার্থক সৃষ্টির সম্ভব হয়েছে” (রূপমঞ্চ, শারদীয়া ১৩৫৫)।

বিকাশবাবু নায়ক হবার সু্যোগ পেলেন তাঁর তৃতীয় ছবিতে। সেটি ছিল শ্রীমতী পিকচার্সের ‘অনন্যা’। বিকাশ রায় ও অনুভা গুপ্তা কমবয়সী রোমান্টিক নায়ক-নায়িকা সুকান্ত ও উমার ভূমিকায়। এই তাঁদের প্রথম জুটি, এর পরেও তাঁরা অনেক সিনেমাতে একসাথে অভিনয় করেছেন। সিনেমায় প্রধান ‘অনন্যা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কানন দেবী আর কমল মিত্র হয়ে ছিলেন ভিলেন রাঘব ডাক্তার।

রূপমঞ্চ পত্রিকাতে ‘অনন্যা’র সমালোচনাতে প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল কানন দেবীর প্রশংসা। কানন দেবী সেযুগে একাই একশো হয়ে আছেন আর শ্রীমতী পিকচার্স কানন দেবীর নিজের প্রোডাকসন হাউস, তাই এরকম লেখা হবে আশা করা যায়। কিন্তু সমালোচনার এক জায়গায় চোখ আটকে গেল।

“অনুভা গুপ্তা ও বিকাশ রায়কে অভিনয়ের কোন সুযোগই দেন নি চিত্র নাট্যকার”। (রূপমঞ্চ, চৈত্র-বৈশাখ ১৩৫৫-৫৬)।

সমালোচক বিকাশবাবুর আগের দুটি ছবি দেখে তাঁর অভিনয় প্রতিভার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, তাই তৃতীয় ছবিতে খেদ করেছেন যে এঁকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাঁর দূরদর্শিতাকে নমস্কার জানাই। সমালোচকের খেদ অবশ্য বেশীদিন স্থায়ী হয় নি!

এর পরে বছরই চিত্রবাণী পত্রিকাতে তখনকার কয়েকজন বিখ্যাত অভিনেতার তুলনামূলক বিচার করে একটি লেখা বেরিয়েছিল, তাতে সেযুগের জনপ্রিয় নায়ক ‘উদয়ের পথে’ খ্যাত রাধামোহন ভট্টাচার্যের পরেই স্থান দেওয়া হয়েছিল বিকাশবাবুকে। সেই লেখা থেকে কয়েক লাইন তুলে দিচ্ছি –

“এঁর পরই মনে পড়ে বিকাশ রায়ের কথা। এঁর তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় দর্শক-চিত্ত জয় করেছে। এঁর চেহারা নিয়ে অনেকে অভিযোগ করেন। চিত্রনট হলেই যে কার্তিকের মত দেখতে হবে এমন ধারণা করা অন্যায়। চিত্রনটের সুশ্রী হওয়া প্রয়োজন। তাঁর মধ্যে সুশ্রীতার অভাব আছে বলে মনে হয় না। তবে এঁর চলন-ভঙ্গীটি উন্নত হওয়া দরকার। উপযুক্ত ভাবে পরিচালিত হলে ইনি শক্তিমান নটদের অন্যতম হবেন নিঃসন্দেহে” (চিত্রবাণী, আষাঢ় ১৩৫৭)।

সেলাম করি চিত্রবাণীর সম্পাদক ও সমালোচক গৌর চট্টোপাধ্যায়কে - কি বিরাট ভবিষ্যদ্‌বাণী করে গিয়েছিলেন তিনি, তাঁর কথাগুলি ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করি যে সেযুগের সিনেমা পত্রিকাগুলির মধ্যে গৌর চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রবাণী বা কালীশ মুখোপাধ্যায়ের রূপমঞ্চকে প্রামাণ্য বলে সম্মান দেওয়া হয়। এ বিষয়ে Encyclopedia of India Cinema-থেকে উদ্ধৃতি করলাম -

Gaur Chattopadhyay initiated initiated Bengali Film monthly Chitrabani, the most reliable record of 40’s-50’s Bengali cinema along with Rupmancha.” (Encyclopedia of Indian Cinema, Ashish Rajadhyaksha, Paul Willemen, p. 20)

গৌরবাবু বা কালীশবাবু কারো রেয়াত করতেন না, সোজাসাপটা বলে দিতেন নিজেদের মতামত। যেমন ‘শ্যামলী’ ছবিটির সমালোচনা করে গিয়ে চিত্রবাণী পত্রিকা লিখেছিল, প্রযোজক পয়সাটা জনহিতকর কাজে দিলে বরং ভালো হতো, কিংবা রূপমঞ্চ পত্রিকা দেবকী বসুর মতো পরিচালককে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের চিত্রনাট্যর জন্য রীতিমতো ক্ষমা চাওয়া করিয়েছিল (হায় রে সে দিন!!)।
বিকাশবাবুর গোড়ার দিকের আর একটি ছবি ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ (১৯৫০)। সমালোচকের কাছে ছবিটি কোনো দিক দিয়েই প্রশংসা পায় নি। বিকাশবাবুর অভিনয় নিয়ে সমালোচক লিখেছেন –

“প্রেমার্ত্ত দৃশ্যগুলির আগে পর্য্যন্ত বিকাশ রায়কে ভালো লাগে”। (চিত্রবাণী শ্রাবণ-ভাদ্র ১৩৫৭)

একজন দর্শকও সম্পাদকের দপ্তরে চিঠি দিয়ে এই কথাই জানিয়েছিলেন। বোধ হয় এঁরা বিকাশবাবুর কাছে তাঁর সহজাত বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় আশা করেছিলেন, তাই প্রেমিক বিকাশ রায়কে এঁরা ভালো ভাবে নেন নি। এই ছবিটি আরো একটি কারণে স্মরণে রাখা উচিত – এটি ছিল মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অভিনীত প্রথম সিনেমা।

দেবকী বসু ছিলেন তখনকার কালে এক বিরাট মাপের মানুষ, একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। তাঁর ছবিতে অভিনয়ের জন্য অভিনেতারা মুখিয়ে থাকতেন। ‘দিনের পর দিন’ ছবিতে বিকাশবাবুর অভিনয় দেবকী বসুর নজরে পড়েছিল, তিনি তাঁকে ডাকলেন ‘ফুটপাথ’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ফুটপাথ আর পর্দায় উঠতে পায় নি। তার বদলে দেবকী বসু যখন ‘রত্নদীপ’ ছবিটি করতে মনস্থির করলেন তখন বিকাশবাবুকে দিলেন নায়ক রাখালের চরিত্র। রত্নদীপ খুব চলেছিল আর হিন্দী আর তামিলেও তৈরী হয়েছিল (চিত্রবাণী, কার্তিক ১৩৫৮)। বিকাশবাবু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন-

“আমি তো মনে করি, আঙুলে গোনা যে কটি চরিত্রে আমি ভালো অভিনয় করতে পেরেছি, তার মধ্যে ‘রত্নদীপ’ বোধহয় সবার উপরে”।

রত্নদীপের পরেই মুক্তি পেয়েছিল বিকাশবাবুর আর এক দুরন্ত ছবি ‘জিঘাংসা’, শার্লক হোমসের গোয়েন্দাকাহিনী ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস্‌” এর ছায়া অবলম্বনে। পরিচালক ছিলেন অজয় কর, যিনি নিজে ছিলেন সেযুগের বিখ্যাত ক্যামেরাশিল্পী। বিকাশবাবু ছিলেন প্রধান কুচক্রী এক প্রতিহিংসাপাগল বটানিস্ট-এর চরিত্রে। তাঁর গলার আওয়াজ ও মডিউলেশন ছিল অসাধারণ। এই ছবিটি নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকা লিখেছিল-

“ক্রাইম-ড্রামা এখানে এপর্যন্ত যতো তোলা হয়েছে, ‘জিঘাংসা’ তাদের মধ্যে সবচেয়ে তেজী। তার কারণ ক্রাইম-ড্রামার ক্রাইমকে, অর্থাৎ অপরাধের সূত্র ও মোক্ষকে, অর্থাৎ হত্যাদিকে সাংঘাতিক করে তুলতে কলাকুশলতার বাহাদুরি যতোখানি থাকা দরকার, অভিনয় যে-ধাপে পৌঁছোনো দরকার, সেসব দিক থেকে ‘জিঘাংসা’ এদেশের ছবির একটা নিরিখ হ’য়ে ওঠার যোগ্যতা নিয়ে হাজির হয়েছে” (দেশ, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৮)।

কি দারুণ এক মন্তব্য!! এরকম একটা রিভিউ পাওয়া সোজা কথা না।

বিকাশবাবুর জনপ্রিয়তা যে ক্রমশ বেড়ে উঠছিল তার আরো কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। চিত্রবাণী আষাঢ় ১৩৫৯ সংখ্যায় কেউ একজন মন্তব্য করেছেন ও মন্তব্যটি ১৪ সাইজের মোটা (Bold) অক্ষরে পাতার মাঝখানে ছাপা হয়েছিল - “অভিনেতা বিকাশ রায়ের হাতে সমারসেট মম-এর ‘স্যানাটোরিয়াম” বইটি বেশী সময়ে দেখা যায়, বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন”।

এসময় খ্যাতির বিড়ম্বনা তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছিল। মনে হয় অনেকটা paparazzi ধরণে কেউ বিকাশবাবুকে কাছ থেকে ফলো করে যাচ্ছিল, তাদেরই কেউ ছাপিয়েছে ব্যাপারটা।

বিকাশবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে দেবকী বসুর ‘ফুটপাথ’ ছবিটি শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি বলেছেন, কিন্তু তাঁর অন্তত আর একটি ছবিও যে পর্দার পেছনেই থেকে গেছে সেটা উল্লেখ করতে ভুলেছেন। বড়ুয়া চিত্র প্রতিষ্ঠানের প্রথম চিত্র ‘অস্তরাগ’ ছবিতে বিকাশবাবুর অভিনয় করার কথা ছিল। ছবিটির রচয়িতা ও পরিচালক ছিলেন পুষ্পিতানাথ চট্টোপাধ্যায়, শ্রেষ্ঠাংশে স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, বিকাশ রায়, মলিনা দেবী, ছবি বিশ্বাস, প্রভৃতি। ছবিটি বোধহয় শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে নি। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে বিকাশবাবুর নাম শিল্পী তালিকায় ছবি বিশ্বাসের আগে ছাপা হয়েছিল (চিত্রবাণী, শ্রাবণ-ভাদ্র ১৩৫৭)।

বিকাশবাবুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ’৪২’ মুক্তি পেয়েছিল আগস্ট ১৯৫১ তে। উনিশশো বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় এই ছবির পরিচালক ছিলেন হেমেন গুপ্ত, যিনি নিজে ছিলেন জেল খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। আর ক্রূর অফিসার মেজর ত্রিবেদীর চরিত্ররূপায়ণে ছিলেন বিকাশবাবু। শুনেছি সিনেমা হলে তাঁর ক্রূরতা দেখে দর্শক গালাগালি করেছিল, জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। বিকাশবাবু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে শুটিং-এর সময় জনতার পদদলিত হওয়ার শেষ দৃশ্যটিকে বাস্তব করতে গিয়ে তাঁর মুখের একদিক ফুলে গিয়েছিল। আজও বাংলা সিনেমার সেরা ভিলেনের তালিকায় পড়ে বিকাশবাবুর অভিনীত ‘৪২। আত্মপ্রকাশের বছর চারেকের মধ্যে তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি ও স্বীকৃতি। ‘অভিযাত্রী’র বিকাশ রায়, সেই নবাঙ্কুর, পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হলেন এই ছবিতে।

কিন্তু অনেকেই বোধহয় জানেন না যে ‘৪২’ ছবিটি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যে দেখানোর অনুমতি পেয়েছিল, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ ছিল এর ব্যতিক্রম, যেখান সেন্সর ও আমলাতন্ত্র আটকে দিয়েছিল পরিচালক ও অভিনেতাদের প্রাণ দিয়ে গড়া এই ছবিটিকে। সেটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম-সেন্সর বোর্ডের এক কালিমাময় অধ্যায়।

গৌর চট্টোপাধ্যায় লেখা চিত্রবাণীর সম্পাদকীয় পড়ে এই ছবির প্রদর্শন বন্ধ হওয়ার পেছনের কাহিনী জানা যায় এবং সম্পাদক তথা জনমানসের প্রতিক্রিয়াও খোলাখুলি ভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায় -

“রোষকষায়িত ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল হয়েছিল বিয়াল্লিশের বিপ্লব। আর সেদিন যারা ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ধ্বনি তুলে বিপ্লবের নায়কত্ব করেছিলেন সেই কংগ্রেস সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিয়াল্লিশ’ ছবিখানি। ......সেন্সর বোর্ড অভিমত দিয়েছিলেন, ছবিখানি ‘likely to excite passion and encourage disorder’। কিন্তু এতগুলি মাস ধ’রে যে ছবিখানি বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জনসাধারণের কোনো passion জাগায় নি এবং disorder সৃষ্টি করে নি তখন পশ্চিমবঙ্গেই বা এই ছবি নিয়ে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা কেন? তবে কি পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এতই সঙ্গীন যে একটা ছবি থেকেই গোলযোগের সূত্রপাত হতে পারে?...... এই ছবির কর্ম্মকর্ত্তারা সেন্সর বোর্ডের নির্দ্দেশ অনুসারে দফায় দফায়... মূল ছবিতে রদ-বদল, কাটা-ছেঁড়া, জোড়া-তালি করেছেন – তাতেও ভবি ভোলবার নয়। আরো তাজ্জব ব্যাপার হোল যে সম্প্রতি সেন্সরের নির্দেশ অনুযায়ী সংশোধিত ‘বিয়াল্লিশ’-এর এই সংস্করণটি পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ভোটাধিক্যে অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন মন্ত্রী ছবিটি দেখে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন (সেই শর্তে)। (পরে)...সেন্সর বোর্ডের সম্পাদক এক চিঠিতে এই ছবির প্রযোজককে জানিয়েছেন, ‘সমস্ত বিবেচনা ক’রে এই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে ছবিটি এবং তার পরিবর্ত্তিত সংস্করণটিও এ রাজ্যে দেখানো চলবে না’। ...বিয়াল্লিশের সংগ্রাম ফুটিয়ে তুলেছিল মদমত্ত স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপ আর আজ ‘বিয়াল্লিশ’ ছবির দুর্গতি প্রকট করে তুললো স্বাধীন ভারতের তথাকথিত গণতন্ত্র তথা প্রজাতন্ত্রের নির্লজ্জ স্বরূপকে’। (চিত্রবাণী, শ্রাবণ-ভাদ্র, ১৩৫৭)

এটা পড়ে মনে হয় যে শিল্প ও শিল্পীর ওপর সরকারি খবরদারি পশ্চিমবঙ্গের বহু পুরনো ট্র্যাডিশন (অসুখ?) আর সেটা এখনো সমানতালে চলছে। ‘৪২’ পশ্চিমবঙ্গে দেখানোর ছাড়পত্র পেয়েছিল মুক্তির প্রায় বছর দুই পরে। যতদূর জানি ‘৪২’ পরেই হেমেন গুপ্ত বোম্বে থেকে ডাক পান।

‘৪২’ এর মুক্তির বছরখানেকের মধ্যে বিকাশবাবু খান পাঁচেক ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘মন্দির’। ততদিনে বিকাশবাবুর রীতিমত বেশ একটা ফ্যানের দল তৈরী হয়েছে, তাদের মধ্যে বালিগঞ্জ নিবাসী দুই যুবতী মন্দির ছবিটি নিয়ে চিত্রবাণীর সম্পাদককে লিখেছিলেন -

“বিকাশ রায়ের অভিনয় খুবই ভালো লেগেছে, তবে তাঁর চলনভঙ্গীটির এখন একটু পরিবর্ত্তন হওয়া দরকার। এক সময়ে তাঁর অনন্যসাধারণ চলনভঙ্গী ও বাচনভঙ্গী দিয়েই তিনি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁর চলনভঙ্গীটি একটু একঘেয়ে মনে হয়। তবুও তাঁর অভিনয় আমাদের খুবই ভাল লেগেছে”। (চিত্রবাণী, মাঘ ১৩৬১)।

এটি পড়ে একেবারে পুরোদস্তুর ফ্যান মেল মনে হয়। পত্রলেখিকা খুব মনোযোগ দিয়ে বিকাশবাবুর বিভিন্ন সিনেমা দেখেছেন, বোধহয় মনে মনে প্রেমেও পড়েছেন, তাই বাকী চিঠিতে পরিচালককে কাহিনী ও চিত্রনাট্য নিয়ে গালাগালি দেবার পরেও বিকাশবাবুর সম্বন্ধে এই উক্তি।

অনেকেই জানেন চিত্র পরিচালক হিসেবে বিকাশবাবুর আত্মপ্রকাশ ১৯৫৫ সালের ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবিতে। কিন্তু তারও আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ ছবিটিকে বিকাশবাবুর পরিচালনায় তৈরী করার কথা হয়েছিল। তবে কোনো কারণে এটি হয়ে ওঠে নি। বিকাশবাবুকে প্রযোজক হিসেবে আমরা প্রথম দেখি ‘সাজঘর’ ছবিতে (১৯৫৫)। এটি পরিচালনা করেছিলেন অজয় কর, নায়ক নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন বিকাশ রায় ও সুচিত্রা সেন ।

বিকাশবাবুর অভিনয় নিয়ে চিত্রবাণী লিখেছিল –

“বিকাশ রায়ের অভিনয় দক্ষতার নতুন পরিচয় পাওয়া গেল এ ছবিতে...মত্ত অবস্থায়, বস্তিতে ও শেষ দৃশ্যে তাঁর অভিনয় প্রশংসার দাবী রাখে”। (চিত্রবাণী, মাঘ ১৩৬১)।

বিকাশবাবু কমেডিয়ান চরিত্রে কবার অভিনয় করেছিলেন জানি না, তবে প্রথম দিকে বিকাশবাবু সিরিয়াস ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে একসময় ক্লান্তি বোধ করেছিলেন।, তাঁর মতো অভিনেতাকে যদি তাঁর বহুমুখী চরিত্র না দেওয়া হয় তাহলে এটা স্বাভাবিক। ১৯৫২ সালে এক ফিল্ম পত্রিকা তখনকার অভিনেতাদের জিজ্ঞাসা করেছিল, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তনিয়ে কোনো ছবি তৈরী করা হলে কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করতে ইচ্ছুক। (মনে রাখতে হবে যে তখনও শ্রীকান্ত নিয়ে কোনো ছবি তৈরী হয় নি। এর অনেক পরে ১৯৫৮ সালে হরিদাস ভট্টাচার্য ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ তৈরী করেছিলেন।) কোন চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক জিজ্ঞাসা করাতে বিকাশবাবু যেটি বলেছিলেন সেটা চট করে আন্দাজ করা মুস্কিল। উনি যা বলেছিলেন তা নীচে তুলে দিলাম-

“একটি ‘লবেজান’ snob role করিবার ইচ্ছা আমার অনেকদিন হইতে আছে। Character acting করিয়া করিয়া আমার এমন অবস্থা দাঁড়াইয়াছে যে নিজেকে অত্যন্ত Serious ছাড়া কল্পনা করা নিজের পক্ষেই দুষ্কর হইয়া গিয়াছে। অথচ, আমি যে serio-comic role কত দক্ষতার সহিত করিতে পারি তাহার খোঁজ বোধ করি আমার গৃহিণী ছাড়া কেহই খবর রাখেন না (কথাটা তাঁর কাণে না পৌঁছাইলেই ভালো হয়)। সত্যসত্যই “নতুনদাদার” চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে গিয়া যেন একটা নূতন উদ্যম পাইলাম। এখন একটা departure –এর জন্য প্রাণটা ছটফট করিতেছে – আপনারা বিশ্বাস করিবেন কিনা জানিনা। .........”। (শারদীয়া চিত্রবাণী ১৩৫৯)

পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আর কে কোন ভূমিকা করতে চেয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্ত তালিকা দিলাম।
রাজলক্ষ্মী – চন্দ্রাবতী দেবী, অন্নদাদিদি – কানন দেবী, কমললতা – ভারতী দেবী, অভয়া – সুমিত্রা দেবী, শ্রীকান্ত (বড়ো) – রাধামোহন ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনাথ – কমল মিত্র। শাহজী – কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, গহর – অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়, বজ্রানন্দ – উত্তমকুমার, ছিনাথ বহুরূপী – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

সত্যি সত্যি এই ছবি শেষ পর্যন্ত হয় নি। যদি সত্যিই হতো তাহলে একটা মাস্টারপিস হত এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিকাশবাবুর ‘নতুনদা’ ও তাঁর অভিনয়ে ‘ঠুন ঠুন পেয়ালা’ গানটি আজও লোকে মনে রাখত।
শ্রীকান্ত হয়ে ওঠেনি বটে, কিন্তু তার বদলে অন্য এক আনকোরা পরিচালক এর কয়েক বছর পরেই বাংলা ভাষায় এক ছবি বানিয়েছিলেন যা দেখে সারা ফিল্ম দুনিয়া অবাক হয়ে ভেবেছিল রূপালী পর্দায় এমন এক অসাধারণ মহাকাব্য কি করে তৈরী হতে পারে! বিকাশবাবুর নতুনদা করা হয়নি কিন্তু তিনি তাঁর চার দশকের অভিনয় জীবনে নিদান হাঁকা ‘জীবন মোশাই’-এর মতো কতো অসামান্য চরিত্র আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। যতদিন বাংলা ফিল্ম থাকবে ততদিন এই চরিত্রগুলি ভবিষ্যতের অভিনেতাদের উদ্বুদ্ধ করে যাবে। কিছু হল আর আরও কত কিছু হয়নি, চিরন্তন এই পাওয়া-না-পাওয়ার বোধের মধ্যেই বিমূর্ত হয়ে ওঠে শিল্পভাবনা, এটাই নিয়ম।

প্রধান তথ্যসূত্র -
১। চিত্রবাণী পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২
২। রূপমঞ্চ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮
৩। দেশ পত্রিকা, পৌষ ১৩৫৫ ও জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৮
৪। বিকাশ রায়ের আত্মজীবনী ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’

অনুপ্রেরণা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার – শ্রী সুমিত রায়।


পরিচিতি - যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্‌টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বর্তমানে আমেরিকার সেন্ট লুইস্‌ (মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়, নেশা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.