প্রসঙ্গ রেডিও - কিছু কথা
বিকাশ রায়
[বিকাশ রায়ের বিনোদন-কর্মক্ষেত্রের মানচিত্রে বেতার মাধ্যমের যে জগৎ তার মাপ বেশ বড়ো। এখান থেকে তিনি শিখেছেন, পরিচয়পত্র পেয়েছেন, অভিনয় জগতের দিকপালদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন। ঋণ স্বীকার করেছেন মুক্তকণ্ঠে তাঁর লেখাতে। কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো সেখান থেকে। বন্ধনীভুক্ত পৃষ্ঠাসংখ্যার উৎস তাঁর সব রচনার একত্রিত খণ্ড "কিছু স্মৃতি, কিছু কথা" (করুণা প্রকাশনী ২০১১)]
সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো থেকে এ আর পি অর্থাৎ এয়াররেড হলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা নিয়ে রোজ দু- চারবার বক্তৃতা হত। ইংরেজিতে বলতেন ড্রুকার নিজে, আর ওঁর বক্তব্য অনুবাদ করে বাংলাতেও বলা হত। ... এবং একদিন চাকরি করতে গেলাম। আগেই আমাকে বলে দেওয়া হল কী করতে হবে। একটা সাউন্ডপ্রুফ ঘরে চেয়ারে বসে, টেবিলের ওপর কাগজ রেখে, সামনে ঝুলন্ত মাইক্রোফোনে কাগজে লেখা কথাগুলো পড়ে যেতে হবে। পড়ে গেলাম। পরে শুনলাম, ব্রডকাস্টও হল। ওটা আমার অডিশনও। রেকর্ড করা হল, স্টেশন ডিরেক্টর শুনবেন। তিনি পাস করলে চাকরি, নাহলে ওই একদিনেই ইতি। এই প্রথম ব্রডকাস্টের সঙ্গে আমি রেডিয়োতে এক মস্ত বড় বন্ধু লাভ করলাম। মিঃ পি কে দেব, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ইঞ্জীনীয়ার, ওঁদের ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘কোথায় ছিলেন মশাই এতদিন! আপনার এত ভালো কণ্ঠস্বর, ব্রডকাস্ট করেন না? আসুন আপনাকে শুনিয়ে দিই আপনার ভয়েস।’ মুগ্ধ হয়ে শুনলাম, আরে এই আমি নাকি! সেইদিন থেকে দেব আমার বন্ধু এবং আজও বন্ধুই আছে। (৪১)
আমার তো কাজ দুবেলা মিলিয়ে বড় জোর আধ ঘন্টা । বাকি সময়টা কী করা যায়? আমি ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের প্রেমে পড়ে গেলাম। ওই যে যন্ত্রটা মুখের সামনে ঝুলতে থাকে ওর ফুটোগুলোর মধ্যে কত রহস্য আছে আমার জানতে ইচ্ছে করে। আমার কণ্ঠস্বরকে ভালো করে লোকের সামনে কী করে প্রকাশ করে। বীরেন ভদ্র মশাইয়ের ভাঙাভাঙা কিন্তু অপূর্ব ব্যক্তিত্ব সস্পন্ন কণ্ঠস্বরকে কী অদ্ভূত মর্যাদাই না দেয়, কত মৃদুস্বরে কত মধুর কথা, গোপন করা পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ করে, মাইক্রোফোনের কত কাছে এসে পরিষ্কারভাবে কথা বলা যায়! একটু আধটু সরে দাঁড়িয়ে কথা বললে স্বর পালটে গিয়ে কথার প্রায় অন্য রকম মানে হয়ে যায়। আমি এইগুলোই লক্ষ্য করতাম। মাইক্রোফোনের আশেপাশেই থাকতাম। ... ব্রডকাস্টিংয়ের গোড়ার কথা জানা, রেডিয়ো নাটক বলতে কী বোঝা যায় তা বুঝে কিছু রচনা করার চেষ্টা করা, আর্টিস্টদের রিহার্সাল দেওয়ানো এবং কোন শিল্পী অনুপস্থিত থাকলে সে পার্টও করে দেওয়া, এ সবই আমি করতাম। আর বীরেনদার কোন প্রোগ্রাম থাকলে হাঁ করে শুনতাম। অত স্বচ্ছ বাচনভঙ্গী—শ্রোতাদের সঙ্গে যেন খেলা করছেন। (৪২)
রেডিয়োতে এখন কীভাবে কর্মকর্তাদের কাজ বন্টন হয় জানি না, কিন্তু আমাদের যুগে কাজও কম ছিল, কর্মীও কম ছিল। তাই সবাইকে সব কাজ জানতে হত। প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্টদের সব ডিপার্টমেন্টে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাজ শেখানো হত। আজকের তুলনায় কাজ কম হলেও কর্মীও কাজের তুলনায় অনেক কম ছিল। তাই আমরা যে ন-দশজন ছিলাম তাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে একাধিক ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব থাকত এবং প্রায়ই দিনরাত পরিশ্রম করতে হত। মজা এই যে, এই রকম খাটুনিতে আমরা কেউই খুব কষ্ট বোধ করতাম না। আমি তো করতামই না। তার কারণ, আমার প্রিয় নাটকের ডিপার্টমেন্টটি প্রায় সব সময় আমার হাতেই ছিল—চাকরিতে যোগ দেওয়া থেকে চাকরি ছেড়ে চলে আসা পর্যন্ত। নাটক বিভাগ বলতে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, আর মাঝে মাঝে সংস্কৃতও। অপেরা-টাইপের গানের অনুষ্ঠান হলেও, সেটা নাটক বিভাগেরই আওতার মধ্যে পড়তো।
যাইহোক, আমার কাজের শেষ নেই, আর মাইক্রোফোন নিয়ে খেলারও শেষ নেই। মাইক্রোফোনের কাছে থেকে কথা বললে একরকম, দূরে থেকে বললে অন্য রকম, ডান দিক থেকে বললে এক রকম, বাঁদিক থেকে বললে আরো এক রকম। ফিসফিস করে বলা কথা পরিষ্কার শোনানো, আবার তর্জন-গর্জন করে বলা কথা শ্রোতার কাছে শুধু হাউহাউ করে না পৌঁছোয় ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক রকমের চেষ্টা আমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো। বাংলা নাটকে মাঝে মাঝে কোন শিল্পী অনুপস্থিত থাকলে অভিনয়ও করতাম। বিশেষভাবে লক্ষ্য করতাম, বীরেনদার মাইক্রোফোনের সঙ্গে দোস্তি। ... অভিনয়ের সময় তাঁর কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপ করার ভঙ্গি আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করতাম।
রেডিয়োয় তখন প্রতি বুধবার এবং শনিবার রাতে ইংরাজি নাটক অভিনয় হত এবং কলকাতার তাবৎ ইংরেজি অভিজ্ঞ লোকজন এই নাটক লিখতেন, প্রযোজনা করতেন এবং অভিনয় করতেন। আমাদের স্টেশন ডিরেক্টরও ইংরেজি নাটক লিখতেন এবং প্রযোজনা করতেন। ডিপার্টমেন্টের চার্জে থাকার জন্যে আমাকেও এইসব নাটকের রিহার্সালে, অভিনয়ে উপস্থিত থাকতে হত।
সেই সময় রেডিয়ো অভিনয় সম্পর্কে অনেক কথা আমি স্টেশন ডিরেক্টরের কাছে শুনেছিলাম এবং অনুধাবনও করেছিলাম। রেডিয়োর অভিনয়ে কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপ কতটা প্রয়োজনীয়, তাই নিয়ে তিনি বলতেন, ‘সম্পূর্ণতৈরি না হয়ে কোনো চরিত্রে অভিনয় করা উচিত নয়। ভেবে দ্যাখো, সন্ধ্যাবেলা যখন অভিনয় শুরু হয়, তখন বাড়ির গৃহিণীর ছেলে ঠ্যাঙ্গানোর সঙ্গে তরকারিতে ফোড়ন দেওয়া, বাইরের ঘরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছেলেদের তারস্বরে পড়াশুনার চেষ্টা আর রকের ওপর বাড়ির কর্তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নানা তর্ক-বিতর্কে প্রায় হাতাহাতি শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু তোমার কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপের ভঙ্গিতে, কৌশলে তুমি তাঁদের সবাইকে রেডিয়ো সেটের কাছে নিয়ে আসছো, তোমার অভিনয় শুনতে বাধ্য করছো। কতখানি কন্ট্রোল কণ্ঠস্বরের ওপর থাকলে ব্যাপারটা করা সম্ভব হয়, সেটা ধারণা করার চেষ্টা করো।’
এইসব নানা উপদেশ অনুধাবন করে, কিছু অভিনয় দেখে শিখে, আমি রেডিয়োর জন্য শব্দপ্রধান নাটক লিখতাম, অভিনয় করতাম।
রেডিয়োতে কাজের সময় আমার আর একটা লাভ হয়েছিল। বহু গুণীজ্ঞানীর সঙ্গে আমার হৃদ্য আলাপ হয়েছিল। পরের জীবনে এইসব আলাপ-পরিচয়ে আমার ব্যক্তিগত অনেক উপকার হয়েছিল। বড় বড় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। তাঁদের কাছে অনেক কিছু শেখবার সুযোগ পাওয়া যেতো। আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর তো কথাই নেই। পরে যখন ফিল্মে অভিনয় করতে গেলাম, তখন অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র থেকে শুরু করে অনেক বড় শিল্পীর সঙ্গে অপরিচয়ের অস্বস্তিতে আমাকে পড়তে হয়নি। (৪৫)
আমার কাছে বেতারে অভিনয় সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে শ্রমসাধ্য ব্যাপার। বেতার অভিনয়ে তীব্র মনঃসংযোগ দরকার। তবেই অভিনয় রসোত্তীর্ণ হবার পথে এগোবে।
আমি কি এই রসোত্তীর্ণ অভিনয় বেতারে করতে পারি? কখনো কখনো হ’য়ে যায়, বুঝতে পারি। তবে কেন হ’ল বোঝাতে পারবো না। শেখাতেও পারবো না—কারণ আমি বিশ্বাস করি, এ শেখানো যায় না। (২৯৩)
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.