অনন্য বিকাশ রায়
শেখর বসু
ছেলেবেলার কিছু কিছু ছবি আজও মাথার মধ্যে ধরা আছে। উজ্জ্বল টুকরো-টুকরো ছবি। এইসব ছবির সামনে পেছনে আর কিছুই নেই। বিচ্ছিন্ন ছবি, অনুষঙ্গ তৈরি হলে চোখের সামনে আপনা-আপনি ভেসে ওঠে। আলাদা করে দেখতে চাইলেও দেখা যায় পরিষ্কার। স্মৃতিভাণ্ডার থেকে তুলে আনা এমন একটি ছবি এই মুহূর্তে আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, ব্রিটিশ আমলের একজন নিষ্ঠুর মিলিটারি অফিসার মাটিতে ফেলে রাখা আমাদের জাতীয় পতাকার ওপর দিয়ে বুট পায়ে সশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। তার চোখমুখ, হাঁটার ভঙ্গিতে কী হিংস্র ভাব! এটি একটি সিনেমার দৃশ্য। ছেলেবেলায় ছবিটি দেখেছিলাম, কিন্তু অবাক কাণ্ড, এই একটিমাত্র দৃশ্য ছাড়া সেই ছায়াছবিটির আর কোনও অংশের কথা আমার মনে নেই।
দৃশ্যটি কোন ছবির খোঁজ করতে গিয়ে অনেক পরে জেনেছিলাম, ছবির নাম '42 , আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মস্পর্শী ঘটনা ছায়াছবির বিষয়বস্তু। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১ সালে, আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার বছর বাদে। নিতান্তই বালক তখন আমি। স্বাধীনতার উন্মাদনা, রোমাঞ্চ তখন পুরোমাত্রায় উপলব্ধি করি; কিন্তু পরাধীনতার জ্বালাযন্ত্রণা ও সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই। যা তখন জেনেছিলাম সবই শোনা কথা, তবে তার আবেদনও ছিল বিরাট। এমন একটি সময়েই '42 দেখেছিলাম, আর ওই যে নিষ্ঠুর মিলিটারি অফিসারের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন তিনি স্বনামখ্যাত অভিনেতা বিকাশ রায়।
ছবিটি আরও একবার দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। পরে জেনেছি ওই ছবিটিতে আরও কয়েকজন বড়-বড় অভিনেতা,অভিনেত্রী ছিলেন। ছিলেন অভী ভট্টাচার্য, মঞ্জু দে, শম্ভু মিত্র। সেই সময়ের পক্ষে কাহিনী ছিল রীতিমত আবেগমথিত। কিন্তু না, ওই একটিমাত্র দৃশ্য ছাড়া গোটা ছবিটির আর কিছুই আমার মনে নেই। স্মৃতি সঞ্চয়ের পদ্ধতি কখনোই কোনও নিয়ম মানে না। তার ফলে কত বড় বড় ঘটনা বেমালুম মুছে যায়, আবার কত তুচ্ছ ঘটনা মনে থাকে বিশদে। টুকরো-টুকরো কিছু ছবিও অমলিন হয়ে থেকে যায় স্মৃতিভাণ্ডারে।
আরও পরে শুনেছি, ওই ছবিটিতে বিকাশ রায়ের অভিনয় এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, উত্তেজিত দর্শকদের কেউ-কেউ প্রেক্ষাগৃহের পর্দা লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মেরেছিল। খবরটি শুনে বিকাশ রায় নাকি অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেছিলেনঃ এ আমার অভিনয়-জীবনের সেরা পুরস্কার। দর্শকের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে আমি ওই চরিত্রটিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।
এই ধরনের ঘটনা বাংলার রঙ্গমঞ্চে ঘটেছে কয়েকবার। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সাহেবদের অমানবিক কার্যকলাপ ও লাঞ্ছনা দেখে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের কেউ-কেউ বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে মধুসূদন সাহেবদের যে ছবি এঁকেছেন তা দেখেও চটে গিয়েছে শাসকদের একাংশ। বিনোদিনীর আত্মকথাতেও নাটক দেখে সাহেবদের আক্রমণাত্মক হওয়ার ছবি ধরা আছে।
কিন্তু এই সব প্রতিক্রিয়া তো মঞ্চাভিনয় দেখে। চরিত্রের রূপদানকারী মানুষটি সেখানে জীবন্ত। নাট্যকার ও নির্দেশকও বেশির ভাগ সময় সেখানে নাগালের মধ্যে। রাগ হলে সরাসরি রাগ দেখাবার সুযোগ আছে খানিকটা। কিন্তু ছায়াছবির ক্ষেত্রে তা হয় না। নানা কারণে একটি ছবির প্রদর্শন বন্ধ হওয়ার দাবি উঠতে পারে। ছবির পোস্টার বা ফেস্টুন ছেঁড়া বা কালি লেপে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। কিন্তু ছায়াছবির কোনও চরিত্রের কার্যকলাপে ক্ষেপে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহের পর্দা লক্ষ্য করে জুতো ছোঁড়ার ঘটনা খুব একটা ঘটে কি ? বোধহয় না। বিকাশ রায় অভিনীত নির্মম ওই মিলিটারি অফিসারটির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। অভিনয়ের জোরে দর্শকের ভাবাবেগকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিতে পারলেই বুঝি এমন একটি কাণ্ডজ্ঞানহীন ঘটনা ঘটানো সম্ভব।
ছবির ভালোমন্দ বোঝার বয়স হওয়ার পরে যাঁদের অভিনয় আমার মনোযোগ,ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিল তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিকাশ রায়। তাঁর ছবিজীবনের বয়স কম নয় এবং নানা ছবিতেই তাঁর অভিনয়-ক্ষমতার উজ্জ্বল পরিচয় ধরা আছে।
ছোট-বড় অসংখ্য ছবিতে তাঁকে দেখেছি। বেশি করে মনে পড়ে ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘নীল আকাশের নীচে ’, ‘জীবনতৃষ্ণা’ ইত্যাদি ছবিতে। ‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবিতে ব্যারিস্টার মনীশ রায়ের চরিত্রে বিকাশ রায় অনন্য। দ্বৈত চরিত্রে দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন। আর ভিলেন চরিত্রে তুলনাহীন কালীপদ চক্রবর্তী। তিনি এই ছবিটির নীতিহীন, মদ্যপ, লম্পট, কুচক্রী রাখাল ভটচাজের চরিত্রে রূপদান করেছেন।
‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে। এর বছর সাত-আট আগে কালীপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। পরিচয় নিতান্তই ঘটনাচক্রে। আমি তখন উত্তর-পূর্ব কলকাতার পৈতৃক বাড়ির বাসিন্দা। পাড়ার নাম ষষ্ঠীতলা। আমাদের পাড়াতেই স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাসাদোপম বাড়ি। উত্তরপুরুষরা বসবাস করেন ওখানে। ওই বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো হত ঘটা করে। পুজো উপলক্ষে একটি নাটক মঞ্চস্থ হত বাড়ির প্রাঙ্গণে। পাড়ায় ওঁদের বাড়িটি পরিচিত ছিল জজবাবুর বাড়ি বলে। আমি তখন স্কুলছাত্র, ক্লাস টেনে উঠেছি। হঠাৎ একদিন জজবাবুর বাড়ি থেকে দুজন এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, ওঁদের বাড়ির নাটকে একটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে আমাকে।
বছরখানেক আগে আমাদের স্কুলে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই নাটকে ছোট রাজপুত্র রাজধরের ভুমিকায় অভিনয় করে আমার বেশ একটু নামটাম হয়েছিল। জজবাবুর বাড়ির নাটকে অভিনয়ের জন্য ডাক পাওয়ার পেছনে সেই খ্যাতি বোধ হয় কাজ করেছিল খানিকটা। যাই হোক, বাড়ির মত পাওয়া গেল।
নাটকের নাম শাজাহান। সেই আমলের বিশিষ্ট কয়েকজন মঞ্চাভিনেতাও সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। বাকিদের মধ্যে ছিলেন জজবাবুর বাড়ি ও পাড়ার কয়েকজন। নাটকটির নির্দেশনার জন্যে ডাক পড়েছিল বিখ্যাত অভিনেতা কালীপদ চক্রবর্তীর। ইনিই কয়েক বছর বাদে ‘উত্তরফাল্গুনী’র হাড়-হিম-করা খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সারা দেশে।
মাসদুয়েক ধরে মহড়া চলেছিল শাজাহান নাটকের। চমৎকার রসবোধ ছিল নির্দেশকের। নানারকম মজার কথা বলে ও মাঝে মাঝে ছোটখাটো ধমকধামক দিয়ে নাটকের উপযোগী অভিনয় শিখিয়ে নিয়েছিলেন সবাইকে। জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠিত নাটকটি সেবার দর্শকদের খুব মনে ধরেছিল।
নাটক করতে গিয়ে একটি ব্যক্তিগত লাভ হয়েছিল আমার। নির্দেশকের সঙ্গে বেশ একটি হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উনি বোধহয় উত্তর কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন, তবে এ-পাড়ায় ওঁর দু-একজন বন্ধু থাকার সুবাদে মাঝে মাঝেই চলে আসতেন এখানে। দেখা হয়ে গেলে কথা হত কিছুক্ষণ।
তখন আমি বোধহয় কলেজে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, কালীপদ চক্রবর্তীকে ধরে আমরা দু-তিন বন্ধু একদিন ‘নাগিনী কন্যার কাহিনি’র শ্যুটিং দেখতে গিয়েছিলাম নিউ থিয়েটার্স টু-তে। আমার জীবনে সেই প্রথম সিনেমার শ্যুটিং দেখা। চোখের সামনে মঞ্জু দে, দিলীপ রায়কে অভিনয় করতে দেখেছিলাম।
‘উত্তরফাল্গুনী’র ভিলেন চরিত্রে দুর্ধর্ষ অভিনয় করার সুবাদে কালীপদ চক্রবর্তী যখন আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছিলেন, তখন এই চলচ্চিত্রটির নির্মাণ-পর্বের নানা গল্প শুনেছি ওঁর মুখে। বিকাশ রায়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন প্রায়ই। বলতান, তিনি শুধু বড় অভিনেতাই নয়, অত্যন্ত বড় মাপের মানুষও ছিলেন। টুকরো-টুকরো বেশ কিছু ঘটনার কথাও শুনিয়েছিলেন যাতে ওই মানুষটির হৃদয়বত্তার নানা পরিচয় ধরা পড়ে। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। ছায়াছবির জগৎ তো বরাবরই রহস্য-রোমাঞ্চে মোড়া, সেই সময় রহস্য বুঝি একটু বেশিই ছিল ; বিশেষ করে অল্পবয়সী শ্রোতাদের কাছে। অবাক হয়ে শুনতাম দাপুটে অভিনেতা বিকাশ রায়ের ভালোমানুষি ও ছেলেমানুষির কথা। শুনতাম আর রোমাঞ্চিত হতাম।
কালীপদবাবু বলেছিলেন, ওই ছবিতে তাঁর অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বিকাশ রায়। ওই প্রশংসা তাঁর আত্মবিশ্বাস এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকখানি। ছবি বিশ্বাসের তারিফের কথাও শুনিয়ে ছিলেন আমাদের। ‘উত্তরফাল্গুনী’ মুক্তি পেয়েছে সবে। এক সমাবেশে ওঁকে দেখতে পেয়েই ছবি বিশ্বাস গলা তুলে বলেছিলেন, ‘কী অভিনয় করেছিস তুই ! এ তো দেখছি দাদাদের মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছিস একেবারে ! ’
চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অনন্য ছিলেন বিকাশ রায়। ‘বিন্দুর ছেলে’তে সদাশিব বড় ভাই, ‘উত্তরফাল্গুনী’র দুঁদে ব্যারিস্টার ও প্রেমিক, ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর নিদান-হাঁকা জীবনমশাই, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ অবধূত, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’র শাহজি ইত্যাদির কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। তাঁর নানামুখী চরিত্র সৃজনের সামান্য কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলাম এখানে।
গম্ভীর,পরিশীলিত, শ্রুতিমধুর ছিল বিকাশ রায়ের কণ্ঠস্বর ; কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তা কখনও কৃত্রিম হয়ে ওঠেনি। তবে চরিত্রের দাবি মেনে কণ্ঠস্বরকে তিনি কমবেশি পালটাতে পারতেন। বেতারের বহু নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁর কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, শব্দের বিশেষ প্রক্ষেপণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চোখের আড়ালে থাকা চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলতে পারত। কবিতা আবৃত্তিও করতেন ভারী সুন্দর। তাঁর ‘ছবি’ কবিতাটি আবৃত্তির কথা মনে পড়ছে। অন্যান্য কবিতার মতো এই কবিতার মর্মার্থও সহজ-সাবলীল উচ্চারণে উঠে এসেছে চমৎকার।
বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের অভিনেতা ছিলেন বিকাশ রায়। তাঁর আশেপাশে ছিলেন অনেক শক্তিমান অভিনেতা, কিন্তু তাঁর উঁচু মানের অভিনয়-ক্ষমতা বিশিষ্টদের মাঝেও তাঁকে স্বতন্ত্র করে তু্লেছ সব সময়।
লেখক পরিচিতিঃ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.