ছায়াছবির বিকাশ রায়
শক্তি সেনগুপ্ত
১ শিল্পীসত্তা - একটানা ট্র্যাকিং শটে
“অভিনেতার পক্ষে অবশ্য সংগ্রহণীয় আর একটি কথা......সেটা হল অভিনেতার ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা। সাধারণ জীবনে আমরা বহু মানুষের সাক্ষাৎ লাভ করি যাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিত্ব আছে – দশের মাঝে তাঁরা একক। এটা বহু সময় জন্মগত, কেউ কেউ এই ব্যক্তিত্ব নিয়েই জন্মান। অভিনেতার পক্ষেও তাই। এমন অনেকে আছেন যাঁরা স্টেজে, ফিল্মে এসে দাঁড়ালেই, রেডিওতে একটি কথা উচ্চারণ করলেই এই জন্মগত ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়। অভিনয়ের ব্যাপারটা তাঁদের কাছে অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু যাঁদের এই জন্মগত ব্যাপারটা নেই? তাঁদের দ্বারা কি অভিনয় হবে না? আমি বলি, না হবে, ব্যক্তিত্ব অর্জন করা যায়। নিরলস সাধনায় এই ব্যক্তিত্ব অর্জিত হয়।“১
দীর্ঘকায়, ঋজু ভঙ্গিমা, পরিমার্জিত বাচনভঙ্গী, পরিশীলিত উচ্চারণশৈলী, দৃঢ় পদক্ষেপে ছন্দোবদ্ধ অথচ ত্বরিতগতিতে চলার ঢং – এই সমস্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে যেন প্রস্তুত হয়েই বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকে চলচ্চিত্র জগতে বিকাশ রায়ের আগমন। সহজাত দক্ষতাকে অনুশীলনের মাধ্যমে ধারালো করতে হয়। বোধ করি, নিষ্ঠা ও কঠিন পরিশ্রম, চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে রেডিওতে নাট্য-বিভাগে কাজ, অ্যামেচার নাটকে অভিনয় এবং কলেজে আইন শিক্ষা - বীজকে পরিণত করেছে অঙ্কুরে।
কিছু বৈশিষ্ট্য অভিব্যক্ত করে চলচ্চিত্রাভিনেতার ব্যক্তিত্বকে। ব্যক্তিত্বের বাকিটা পরিস্ফুট করে ক্যামেরার শট যার পরিপ্রেক্ষিত আবার তৈরি করে দৃশ্যপট (mise-en-scene)। পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সের কাইয়ে-দু-সিনেমা (Cahiers du Cinema) কাগজের তরুণ লেখকগোষ্ঠী-প্রবর্তিত বিতর্কিত Auteur (ফরাসী ভাষায় ইংরাজি author ) Theory২ (ছবির পরিচালক-ই ছবির author) এক নতুন প্রজন্মের দুঃসাহসী সমালোচক-গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটানোর আগে সমালোচক-সমাদৃত ছবির মূল্যায়নে auteur হিসেবে ক্যামেরা, অভিনেতা ও পরিচালককে সমান গুরুত্ব দেওয়া হত।
চল্লিশের দশকে আগন্তুক বিকাশ রায় যে-চলচ্চিত্রজগতে হাজির হয়েছিলেন তাতে তখন নিত্যনতুন উদ্যমে যোগ দিচ্ছেন বিকাশ রায়েরই মতন অনেক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী যুবক – তাঁরাও ইতিহাসের চোখে নতুন প্রজন্মের শিল্পী। অভিনব টেকনোলজি, নতুন ধরনের ক্যামেরা, রকমারি লেন্স, বহু স্টুডিওর আবির্ভাব, নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় উৎসাহী চলচ্চিত্র-কর্মীর দল – সব মিলিয়ে উদ্দীপনাময় সময়, প্রকৃত অর্থে সূচনা হয়েছে এক অঘোষিত avant-garde আন্দোলনের। তিরিশ দশকের আগন্তুক এবং পরবর্তীকালের নামজাদা অভিনেতারা – স্বেচ্ছাচারী ও প্রচণ্ড রক্ষণশীল ছবি বিশ্বাস, দেবপ্রতিম ও সদা-সত্যবান জহর গাঙ্গুলি, প্রেমিক ও সৌম্য পাহাড়ি সান্যাল – ইতিমধ্যেই বয়স্ক আর্কিটাইপ হয়ে উঠেছেন। সে-যুগটাকে বলা চলে বাংলা সিনেমার ‘বাংলা সাহিত্য-নির্ভর’ যুগ (Age of the Bengali Literature : বাংলা সাহিত্য ছিলো ছবির চিত্রনা্ট্যের উৎস)। তখন আধুনিক, সনাতন প্রথা-বিরোধী যুবক-চরিত্রে অভিনেতার প্রয়োজন মেটালেন বিকাশ রায় ও উত্তমকুমারের মতন নবাগত শিল্পীরা। ছবি যাতে ভাল হয় তার জন্য নবাগতের দল নিজেদের নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও অন্য কাজ করতেন সেসময়। তাঁরা নিজেদেরকে celebrity বলে ভাবতেন না, তাঁরা ছিলেন চলচ্চিত্রজগতের পদাতিকবাহিনী। বিকাশ রায় নিজে খুঁজে নিয়ে এসেছেন নতুন অভিনেতাদের, শুরুতে কিছু ছবিতে অভিনয় করে ছাড়াও সহকারী পরিচালকের ভূমিকা নিয়েছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, নিজের নামে প্রোডাকশান কোম্পানি খুলে ছবি করেছেন (ছবি প্রযোজনার অর্থ লগ্নী করতেন অন্য লোকেরা), অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছেন ভানু ব্যানার্জী ও ছবি বিশ্বাসের সহযোগিতায়।৩ শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষাই নয়, এর মূলে ছিল আধুনিকতম শিল্পকলা – ফরাসীরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘সপ্তম শিল্পকলা’ (Seventh Art - স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্যকলা, চিত্রকলা, নৃত্যকলা, সংগীত-কলা, কাব্যকলা, তারপর চলচ্চিত্র) - ব্যবহার করে শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা।
বিকাশ রায় সপ্তম শিল্পকলা-র জগতে এসেছিলেন ১৯৪৬ সালে সেই প্রত্যয় নিয়ে যে প্রত্যয় প্রতীয়মান ছিলো তাঁর হাঁটার বিশেষ ঢঙে। সাদা-কালো-রঙ্গীন পর্দায় তাঁর উপস্থিতি ছিলো দীর্ঘ চল্লিশ বছর (১৯৪৭ থেকে ১৯৮৭) ধরে। জীবনে প্রায় ২৫০ ছবিতে কাজ করেছেন। ১৯৪৮-এর ভুলি নাই ছবির পর ১৯৪৯ সালে করেছেন ছ’টি, ১৯৫০-এ চারটি, ১৯৫১-তে পাঁচটি, ১৯৫২-য় পাঁচটি, ১৯৫৩য় ন’টি, ১৯৫৪য় দশটি, ১৯৫৫-তে চোদ্দো-টি, ১৯৫৬য় দশটি, ইত্যাদি। সম্ভবত তাঁর শিল্পীসত্ত্বার অন্য আরো দিক – অভিনয় ছাড়াও চিত্রনাট্য লেখার ও পরিচালনার যোগ্যতা, অর্থাৎ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা - ছিল বলে সেকালের চলচ্চিত্রকাররা তাঁকে বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু রোল যতো ভালো বা যতো মামুলীই হোক না কেন, শুরু থেকেই অভিনয়-দক্ষতার পূর্ণ বিকাশই তাঁর লক্ষ্য ছিলো। তাঁর মতন নিরলস শিল্পীরাই সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসকে, বহু নজির রেখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য।
গলার স্বরে কি এক যাদু ছিলো যার ফলে তাঁর মুখের সংলাপের প্রতিটি লাইন চমৎকার শোনাতো। চলচ্চিত্রে সংলাপের গুরুত্ব নিয়ে এক বিদেশি সমালোচক লিখেছিলেন,
উপরন্তু, সমসাময়িক জাঁদরেল অভিনেতাদের সঙ্গে কোনো কোনো দৃশ্যে তাঁর উপস্থিতি, ঠোঁটে গোঁজা জ্বলন্ত সিগারেট, সাহেবি কায়দা, কেতাদুরস্ত পোশাক, দাঁতে চেপে-ধরা পাইপের (সিগারেট আর পাইপকে তিনি প্রিয় প্রপের মতন ব্যবহার করতেন) মধ্যে প্রকটিত ধৃষ্টতা, আত্মবিশ্বাস, আত্মাভিমান ও আমি-তোমার-চেয়ে-উচ্চস্তরের-মানুষ-আর-তুমি-সেটা-ভালো-করে-জানো মানসিকতা এবং শটের ফ্রেমে তাঁর অবস্থিতি দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিতো।
চল্লিশ থেকে ষাট দশকের বহু ছবিতে দেখেছি তাঁকে পা-থেকে-মাথা অবধি ফুল শটে ধরে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন সিনেমাটোগ্রাফাররা। এমনকি, বিশেষ ভঙ্গিতে তাঁর হাঁটার দৃশ্যেও যেটার পুনরাবৃত্তি কয়েকটি পরিস্থিতিতে অপ্রয়োজনীয় ছিলো। মনে হোত তিনি মঞ্চে অভিনয় করছেন, যেমন আমরা থিয়েটার দেখি। অথচ তখন মিডিয়াম শটের চলন যে ছিলো না তা নয়! পরবর্তী কালের অনেক ছবিতে – নীল আকাশের নীচে, জতুগৃহ, জীবনতৃষ্ণা, সূর্য্য তোরণ, ইত্যাদি - মিডিয়াম আর মিডিয়াম লং শট তাঁকে অভিনয়ে অনেক সাহায্য করেছ এবং দর্শককেও সাহায্য করেছে অভিনীত চরিত্রের সাথে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হতে।
আবার, লো অ্যাঙ্গেল ক্লোজ ফুল শটে যখন তাঁর সুদীর্ঘ অবয়ব ধরা পড়তো (নিজের প্রযোজিত, পরিচালিত ও অভিনীত ১৯৫৬ সালের সূর্যমুখী ছবিতে এক বিশেষ মুহূর্তে নিজেকে ধরেছিলেন এরকম শটে – ছবির অন্যতম সেরা শট; এছাড়াও বিয়াল্লিশ, কাঁচ কাটা হীরে, জীবনতৃষ্ণা ও সূর্য্য তোরণ ছবিতে অনুরূপ শটের ব্যবহার আছে), তখন দেখে মনে হতো আলো-ছায়ার খেলাতে ঐ দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় ঐ চাহনিতে আছে আত্মপ্রত্যয়, রহস্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সর্বনাশের ইঙ্গিত কিংবা উগ্র, অপ্রতিরোধ্য পৌরুষ। এক্সট্রীম ক্লোজ-আপে তাঁকে প্রায় দেখাই যেতো না। আমি বলবো, এক্সট্রীম ক্লোজ-আপে তাঁকে ফ্রেম করার কোন দরকারই ছিলো না – তাঁর এক্সপ্রেশান আর রিঅ্যাকশান ফুটে উঠতো শুধু তাঁর চোখ-মুখ না, পুরো শরীরের সাড়ার ভিতর দিয়ে। এককথায়, তিনি (বহু-ক্ষেত্রে অভিনেতার শারীরিক এক্সপ্রেশানের সীমাবদ্ধতা ঢাকার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত) এক্সট্রীম ক্লোজ-আপের অভিনেতা ছিলেন না।
তাঁর অভিনয়-জীবনের প্রথম দুই দশকে অতি-উৎসাহী অনেকেই নিজেদের কল্পিত ক্ষমতা জাহির করার তাগিদে আর খ্যাতির লোভে ছবি পরিচালনা করতে নেমে গিয়েছিলেন। এবং, একটি-দুটি ছবির পরই উধাও হয়েছিলেন। প্রতিভাবান পরিচালকদের সাথে কাজ করার পাশাপাশি এরকম কিছু ক্ষণজন্মা ভুঁইফোড় পরিচালকদের সাথেও তিনি কাজ করেছিলেন। ‘স্টার’ ছিলেন না, নানানরকম চরিত্রে অভিনয় করতেন। মনে হয় তিনি সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে এক বিশেষ ধরণের চরিত্রে branded না হয়ে যান, তাঁর অভিনয়দক্ষতার পরিধি পরিসীমিত না হয়ে যায়। ‘স্টার’-এর কৃত্রিম চাকচিক্য, চটকদারী তাঁর মধ্যে ছিলো না। একজন জাত অভিনেতার ভিতর আমরা কি কি গুণ খুঁজি (অবশ্যই সব অভিনেতার মধ্যে সব গুণ একই রূপে প্রত্যক্ষ করা যায় না)? তা একদিকে কেবল শারীরিক উপাদান - মুখের হাসি, কণ্ঠস্বর, চোখের দৃষ্টির ব্যঞ্জনা, হাঁটার কায়দা, চেহারা, কেশবিন্যাস – নয়, অধিকন্তু, স্পর্শাতীত উপাদানও – ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা, আবেগ, মাধুর্য আর চরিত্রচিত্রণের বিশ্বাসযোগ্যতা। বিকাশ রায়ের নিন্দুকেরাও অন্তত একটা কথা স্বীকার করবেন যে, সিনেমার পর্দায় তাঁর ব্যক্তিত্বের কখনো উগ্র কখনো কোমল বিশিষ্টতা আর অভিনয়শৈলীর মধ্যে একটা বিশেষ কিছু ছিলো। তাঁর সংলাপ বলার ধরণে অতি-নাটকীয়তা ছিলো না, বরং ছিলো বক্তব্যের নির্যাস প্রকাশের আকুতি। ‘স্টার’ না হলেও তিনি কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন এক স্বতন্ত্র ‘screen personality’। এককালে, আর মনে হোত না তিনি তথাকথিত ‘অভিনেতা’, মনে হোত না তিনি ‘অভিনয়’ করছেন।
চার দশকের অভিনয় জীবনে তিনি ‘আর্ট’ (ভারতবর্ষে তিরিশ-চল্লিশ দশকের বাংলা সিনেমা-কে ‘আর্ট সিনেমা’ বলে গণ্য করা হতো – সেই সুবাদে; তিনি অবশ্য পরবর্তী কালের বাংলা সিনেমার নিউ ওয়েভ আন্দোলনের মুখ্য চলচ্চিত্রকারদের – মৃণাল সেন বাদে - সাথে কাজ করার সুযোগ পাননি), ‘জনপ্রিয়’ ও ‘মধ্য’ (Middle Cinema – আর্ট আর জনপ্রিয় সিনেমা-র মাঝামাঝি গোঁজামিল-দেওয়া এক শ্রেণীর ছবি) সিনেমার বেশ কিছু সেরা ছবি, সেরা পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন (দেবকী বসু, হেমেন গুপ্ত, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, রাজেন তরফদার, অজয় কর, সুশীল মজুমদার, অগ্রদূত) এবং স্মরণীয় চরিত্র (আমার বিচারে বাছাই করা শ্রেষ্ঠ আটটির আলোচনা করবো এই প্রবন্ধে) সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অভিনয়দক্ষতার ও শৈল্পিক অবদানের বিস্তার ও পরিব্যাপ্তি উপলব্ধি করতে হলে চল্লিশ দশক থেকে শুরু করতে হবে (১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯)। এই পর্বে মোট ৮৮-টা ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন।
মূলত নাটকীয় অভিনয়ের জন্যই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, কিন্তু, শিল্পী হিসেবে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে বিশ্লেষণের পরিধিটা আরো একটু বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। ১৯৬৪ সালের ড্রামাটিক কমেডি ছবি জীবন কাহিনী-তে (পরিচালক: রাজেন তরফদার) মরিয়া, অক্ষম, হয়রান, তাড়া-খাওয়া লাইফ-ইনসিওরেন্স বিক্রেতার চরিত্রে মজাদার অথচ মর্মস্পর্শী অভিনয় তাঁর শিল্পদক্ষতার এক খাঁটি দৃষ্টান্ত। বাংলা সিনেমা-জগতে এক যুগে তিনিই ছিলেন অবিসংবাদী অ্যান্টিহিরো – একদিকে ভয়াবহ-নীতিহীন-ইতর (ভুলি নাই, রত্নদীপ, ইত্যাদি), আরেকদিকে ট্র্যাজিক-অবহেলিত-প্রবঞ্চিত-ব্যর্থ (না, জীবন তৃষ্ণা, কাঁচের স্বর্গ, ইত্যাদি)। যেন কোনো পোয়েটিক রিয়ালিস্টের কল্পনায় সৃষ্ট চিরকালের-জন্য-দণ্ডিত এক মানুষ। দর্শকের মনে এমন চরমমাত্রার আবেগ তুলতে পারতেন যে মনে হোত চরিত্রগুলো তাঁর কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল। তাঁর বড়ো কৃতিত্ব হলো যে, তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি স্মরণীয় চরিত্রকে তিনি রূপালী পর্দায় নতুন জীবন দিয়েছিলেন।
চল্লিশ থেকে ষাট দশকের শেষ অবধি বাংলা ছবিতে বিকাশ রায়ের কাজ বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেবলমাত্র আপাদমস্তক বদমাইশিতে ভরা ভিলেন না, রোম্যান্টিক নায়ক (মা ও ছেলে, দুই বোন, ছেলে কার), ঠকে-যাওয়া সাদাসিধা অশিক্ষিত মানুষ, কর্মী ইউনিয়নের আদর্শবাদী নেতা (অনুপমা), সূর্য্য তোরণ-এ হাইনরিখ ইবসেনের Master Builder নাটকে মূল চরিত্র Halvard Solness-এর মতন সফল ও খ্যাতনামা অন্তহীন আত্মনাশী উচ্চাকাঙ্ক্ষা-তাড়িত আর্কিটেক্ট-শিল্পপতি, দাম্পত্য জীবনে চরম অসুখী পুরুষ (না), কর্তৃত্বপ্রিয় অভিজাত ব্যবসায়ী (কাঁচ কাটা হীরে), শুদ্ধ মনে শুদ্ধ দেহে ‘পরমানন্দ মাধব’-এর অনুসন্ধানে মত্ত কবিরাজ (আরোগ্য-নিকেতন), সর্বসংস্কারমুক্ত সন্ন্যাসী (মরুতীর্থ হিংলাজ), বন্ধুপত্নীর প্রতি যৌনকামনায় আবিষ্ট অনুশোচনা-তাড়িত মানুষ (সূর্যমুখী) প্রভৃতি বহু চরিত্রে তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবিষ্কার করে চমৎকৃত হয়েছি।
সমালোচক ও দর্শকের একটা অংশ ‘থিয়েটারি’ অভিযোগে তাঁর কাজকে যোগ্য মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেন। বলেন, তাঁর উচ্চসুরে বাঁধা অভিনয়রীতি ফিল্মের উপযুক্ত নয়। এঁদের বিচারকে অবশ্য বিচক্ষণতার অভাবের নমুনা বলে আমি হেয় করবো না। এ তাঁদের রুচির ও এস্থেটিকস্-এর ব্যাপার যা স্বভাবগত বা জন্মগত হয় না, যা শিল্পী ও শিল্পমোদী অর্জন করেন অভিজ্ঞতার (সিনেমার ক্ষেত্রে: কোন সময়ের কি ছবি দেখে আমি আপনি বড়ো হয়েছি – হলিউড না ফরাসী নিউ ওয়েভ না ওজু-মিজোগুচি-ইচিকাওয়া না কুরোসাওয়া-ওসিমার জাপানী ছবি, না বলিউডের ‘মসালা’ ছবি) মাধ্যমে, যার সাহায্যে তাঁরা বিভিন্ন জাতের সিনেমার মর্ম উপলব্ধি করেন। কিন্তু, একটা কথা জোর দিয়ে পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি – আলোচকের গভীর ইতিহাসচেতনাই হওয়া উচিত বিকাশ রায়ের মতন যুগ থেকে যুগান্তরের শিল্পীকে বিচারের প্রধান পূর্বশর্ত।
বিকাশ রায় যে আদ্যন্ত সিনেমারই (মাঝেমধ্যে ছবির চিত্রনাট্যের খাতিরে ও পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গির ফলে ‘থিয়েটারি’-সুলভ অভিনয় সত্ত্বেও) শিল্পী ছিলেন সে বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। অভিনয়ের স্টাইল নির্ভর করে ছবির বিষয়বস্তুর উপর। তিনি যে যুগে সিনেমায় কাজ করা শুরু করেছিলেন, সে যুগে পরিচালকদের মনে সিনেমার ক্ষমতা সম্বন্ধে তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তিরিশ দশকের বাংলা টকীজ ছিল এক ধরনের ‘canned theater’ (তাঁর দুই খণ্ডে লেখা What is Cinema বইতে ফরাসী চলচ্চিত্র সমালোচক ও তাত্ত্বিক Andre Bazin তিরিশ দশকের ফরাসী চলচ্চিত্রকার Maurice Pagnol-এর ছবিকে এই নামে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন)।
তিরিশ-চল্লিশের দশকে বাংলা মঞ্চের রথী-মহারথীদের নিয়ে করা ছবি দেখে ‘শিক্ষিত’ ‘ভদ্রলোক’-শ্রেণীর দর্শক নিরাশ হতেন। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে অভিনয় – সিনেমা তো নয়, যেন মঞ্চাভিনয় ক্যামেরায় রেকর্ড করা হচ্ছে! শিল্পরসিক বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায় ও বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশান-এর (১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) সদস্য ফিল্ম-জার্নালিস্টরা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, সিনেমার নিজের ভাষা আছে, তাকে ধরতে হবে। কিন্তু চলচ্চিত্রকর্মীদের কাছে ঠিক-বেঠিকের বিচারের মানদণ্ড কোথায়? সিনেমা আসলে কী? হলিউডের কিছু ছবি দেখার সুযোগ থাকলেও হলিউডের মতন আধুনিক ক্যামেরা, লেন্স, ইত্যাদি ছিল না বাংলার স্টুডিও-গুলোতে, ছিল না আর্থিক ক্ষমতা, বা কেনার সামর্থ্য থাকলেও সেসব ব্যবহার করার মতন উপযুক্ত শিক্ষার অভাব ছিলো। রাশিয়ান, ইটালিয়ান বা ফরাসী ছবির কথা বিদেশ থেকে আমদানি-করা পত্র-পত্রিকায় পড়লেও সে-ছবি দেখার সুযোগ ছিলো না।
তিরিশ পেরিয়ে চল্লিশ দশকে পৌঁছোবার যাত্রাকালে সেভেন্থ আর্ট সম্বন্ধে ধারণার ক্রমবিকাশ ঘটলো। স্টুডিওগুলো নতুন সরঞ্জামও জোগাড় করতে আরম্ভ করলো, বোম্বাই গিয়ে বিদেশী টেকনিশিয়ানদের কাছে তালিম নিয়ে ফিরে এলো বাংলার টেকনিশিয়ানরা। সিনেমাটোগ্রাফিক টেকনিক ও সাউণ্ড রেকর্ডিং টেকনিকের উন্নতির সাথে সাথে বাংলা সিনেমায় নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হলো। থিয়েটারের লোক ছাড়াও শিক্ষিত পুরুষ-নারীর দল অভিনেতা হিসেবে যোগ দিলেন। কিন্তু, নতুন প্রজন্মের কুশীলবেরা (সিনেমা-র) সিনেম্যাটিক অভিনয় করবেন অভিনয়শিল্পের কোন আদর্শ অবলম্বন করে? সে ঐতিহ্য কোথায়? তাঁরা শুরু করেছিলেন প্রায় শূন্য থেকে।
২০১১ সালের My Week With Marilyn ছবিতে একটি দৃশ্যে Laurence Olivier-রূপী Kenneth Branagh ‘The Prince and the Showgirl’ (১৯৫৭) ছবিতে Marilyn Monroe-রূপী Michelle Williams-এর অভিনয় দেখে আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘She’s quite wonderful. No training, no craft to speak of, no guile, just pure instinct. She’s astonishing.’ ঐ ‘পিওর ইন্সটিংট্’-এর প্রেরণায় ও গভীর সাহিত্যবোধ (আবার মনে করিয়ে দিই, সেসময়ের অধিকাংশ বাংলা ছবির চিত্রনাট্য লেখা হতো বাংলা ছোটো গল্প আর উপন্যাস অবলম্বনে) সম্বল করেই নতুন প্রজন্মের বাঙ্গালী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি ছবিতে নতুন ধরনের চরিত্র, নতুন চ্যালেঞ্জ।
বিকাশ রায় রাতারাতি বিশিষ্ট অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান নি। তবে এ-ও সত্য যে, অধিকাংশ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে ও সেসময়ের জনাকতক ভাল পরিচালকের সাথে কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিনয়জীবনের সূত্রপাত (হেমেন গুপ্তের অভিযাত্রী ও ভুলি নাই, জ্যোতির্ময় রায়ের – এই মানুষটিই বিকাশ রায়কে বাংলা সিনেমায় নিয়ে এসেছিলেন - দিনের পর দিন, দেবকীকুমার বসুর রত্নদীপ, আবার হেমেন গুপ্তের বিয়াল্লিশ)। এই সুযোগে তিনি একটু একটু করে নিষ্ঠাসহকারে সঞ্চয় করেছেন সিনেমাটিক আদবকায়দা, আবিষ্কার করেছেন নিজস্ব স্টাইল, ম্যানারিজম। চরিত্রচিত্রণের একান্ত নিজস্ব টেকনিকের উদ্ভাবন করেছেন, অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছেন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।
ভুলি নাই ছবি তৈরী করার সময়ের স্মৃতিচারণে বিকাশ রায় লিখেছিলেন,
পরবর্তীকালে, অনায়াসে সিনেমার পর্দায় তিনি বিচরণ করেছেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান বা স্যুট-টাই পরা নিখুঁত ম্যানারিজমে ভরা বাঙ্গালী ‘সাহেব’ বা ভিলেনের রূপে। এবং আমাদের চোখে আর ভাবনায় তাঁর সেই রূপান্তরের মধ্যে কোন ফাঁকি ছিলো না! ভিলেনের চরিত্রে তাঁর ইমেজ হয়ে উঠেছিলো ঠিক যেমন Guardian পত্রিকায় David Thomson ব্রিটিশ অভিনেতা James Mason সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন:
চলচ্চিত্রে থিয়েটারি ম্যানারিজম্ আজকালকার ‘মেথড’ অ্যাক্টিং-এ তালিম নেওয়া অ্যামেরিকান বা ব্রিটিশ অভিনেতাদের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়। এঁদের কারুর অভিনয় অভিব্যক্তিবাদী (Expressionistic - অভিব্যক্তিবাদী অভিনয়রীতির উৎস নাটকের মঞ্চে) – যেমন Al Pacino, Danielle Day-Lewis গলার স্বর চড়িয়ে, শরীর ও মুখের তীব্র ভঙ্গিমার ভিতর দিয়ে মানসিক চাঞ্চল্য ও আবেগ প্রকাশ করেন, আবার ঐ একই ধরণের মুহূর্তগুলোতে Robert De Niro থাকবেন স্থির, অচঞ্চল, আভাসে ইঙ্গিতে শান্তভাবে ফুটিয়ে তুলবেন তাঁর মেজাজকে।
প্রখ্যাত অ্যামেরিকান চলচ্চিত্র-সমালোচক Jonathan Rosenbaum কবুল করেছিলেন যে,
অভিনয়ের ভিতর দিয়ে অভিনেতাকে কিভাবে ও কতোটা চেনা সম্ভব?
অভিনেতা চরিত্রের ভূমিকায় কি ক্রিয়াকলাপ করছেন, কোন্ প্রকারে করছেন, তা নিরীক্ষণ করে আমাদের মনের মধ্যে চরিত্র সম্বন্ধে কি ও কতো স্বচ্ছ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে, আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে কতো তীব্রতার সাথে ছুঁতে পেরেছে – এ-সবের সংশ্লেষণে অভিনেতা বিকাশ রায়ের দক্ষতার ও শিল্পকীর্তির বিশ্লেষণ করবো এই প্রবন্ধে। আমার মতে, বিশ্লেষণের পদ্ধতি (শুধুমাত্র Manny Farber আর Pauline Kael-এর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেই নয়) এই প্রকারের সিন্থেটিক (Synthetic) হওয়া উচিত। তবে, তার আগে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের হিসাব-নিকাশ করা অতি প্রয়োজন।
২ ইতিহাসের মনতাজ : বাংলা টকীজের প্রথম তিন দশক
কিছু অনুযোগ ও অকপট স্বীকারোক্তি
সিনেমা সম্পর্কে তৎকালীন ফরাসী যুবসমাজের ইতিহাসচেতনার অভাবকে ভর্ৎসনা করে আর এক যুবক Andre Bazin ১৯৪৩ সালে লিখেছিলেন,
গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকে ফ্রান্সে প্রধানতঃ Andre Bazin ও পঞ্চাশ দশকে অ্যামেরিকাতে Pauline Kael, Andrew Sarris-এর মতন চলচ্চিত্র-সমালোচকদের দেশজ পুরানো সিনেমা সম্বন্ধে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক প্রবন্ধ একনিষ্ঠ দর্শকসম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সচেতনতাকে সমৃদ্ধ করেছিল, পুরানো ছবি দেখার মনোভাব ও বিচারের ধরণ পালটে দিয়েছিলো।
দু:খের কথা হচ্ছে, বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে তুলনীয় সচেতনতা এসেছে একমাত্র সাম্প্রতিক কালে - দেশী-বিদেশী শিক্ষায়তনে গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু, সে-সচেতনতা প্রধানতঃ শিক্ষায়তন, গবেষক ও বিদ্বজ্জনের মধ্যেই সীমিত। সমালোচক, সিনেমাবিশারদ বা রুচিবান দর্শককে তা এখনও যথেষ্টভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় নি। তদুপরি, অধিকাংশ সময়ে এসব গবেষণায় ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে শুধু পুরানো দিনের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য, পাশাপাশি উল্লিখিত ছবি দেখার অভিজ্ঞতা নয়। অর্থাৎ, ছবির সেট, ফোটোগ্রাফি, সাউণ্ড, কন্টিনুইটি, অভিনেতা, অভিনয়রীতি ... এক কথায় যাকে বলে ছবির মূল সব উপাদান, তা নিয়ে আলোচনা এসব গবেষণায় (যার অপার মূল্য আমি কোনোভাবেই খর্ব করছি না, এবং আমার এই প্রবন্ধে সেই ইতিহাসের যে যৎসামান্য উল্লেখ আছে তার উৎস ঐ গবেষণা-গ্রন্থগুলিই) পাওয়া যাবে না। পুরানো বাংলা ছবির প্রিন্টের দুষ্প্রাপ্যতা এই দুর্বলতার একটা কারণ। অ্যামেরিকার বেলায় Kael, Sarris যে-সময়ে (গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাট দশকে) পুরানো ছবি নিয়ে লিখছিলেন, সেসময়ে অ্যামেরিকান টেলিভিশনে প্রত্যেকদিন প্রায় একশোটা করে পুরানো ছবি দেখানো হতো।৯
বাংলা সিনেমার ইতিহাস সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা নিয়েই আমরা ষাটের দশকের যুবকরা মনোযোগ দিয়ে সমসাময়িক দেশী-বিদেশী ছবি দেখতে ও ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় তা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। বলবো, কিছুটা মূর্খের মতন পুরানো দিনের বাংলা ছবি, সে-ছবির পরিচালকদের অশ্রদ্ধা করেছি, তাঁদের অবদানকে তুচ্ছজ্ঞান করেছি। বস্তুত:, সে-যুগের সিনেমার মূল উপাদানগুলোর মধ্যে পরিবর্তনের চিহ্নগুলিকেও আমরা – আমাদের মধ্যে যারা নিজেরা ছবি পরিচালনার কাজকে বেছে নিয়েছে, তারা ছাড়া - অবহেলা করেছি। সিনেমা দেখার, তারিফ করার ও সিনেমা নিয়ে লেখার ব্যাপারে আমাদের প্রাথমিক অবলম্বন ছিলো ফ্রান্সের Cahiers du Cinema-র পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর প্রস্তাবিত ও প্রচলিত Auteur Theory। কফি হাউসে, কলেজ ক্যান্টিনে সত্যজিৎ রায়ের নতুন ছবি নিয়ে আলোচনার শেষে টেবিল চাপড়ে বলেছি, “A Ray film is a Ray film is a Ray film।“
কিন্তু আগ্রহ থাকলেও কোথায় মিলতো বাংলা সিনেমার ইতিহাস?
আমাদের অগ্রজেরা যাঁরা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের হোতা, ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় যাঁদের লেখা মন দিয়ে পড়ে সেরা বিদেশী ছবি দেখার উৎসাহ হয়েছে আমাদের - পরে একসময়ে উপলব্ধি করেছি যে সেই অগ্রজেরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের (অর্থাৎ ষাটের দশকের যুবসমাজের) প্রতি কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেননি। তাঁদের আভিজাত্যপূর্ণ উন্নাসিক মনোভাব ও ইতিহাস সম্বন্ধে সংশোধনবাদী সাদা-কালো দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা ‘পপুলার’ সিনেমার বিকাশে ও উন্নয়নে কোনো সহায়তাই করেনি। সাদা আর কালোর মাঝে ইতিহাসের যে-বর্ণচ্ছটা – তথ্যের মধ্যে নিহিত সত্য - তাকে ভাষা দেওয়াটা ঐতিহাসিকের কর্তব্য। ইতিহাস তথ্যচিত্রের নেগেটিভ নয়, তাকে নিজেদের স্বার্থে মনমতো এডিট করে নেওয়াটা অপরাধ। ‘পপুলার’ সিনেমার প্রতি তাঁদের বিরূপ মনোভাব ইতিহাস সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণারই জন্ম দিয়েছে। চলচ্চিত্রশিল্পের শুরুতে যে-উন্মাদনা, আশা ও স্বপ্ন নিয়ে বিদেশী এমনকি বাঙ্গালী ও ভারতীয় শিল্পীসমাজও তাকে স্বাগত জানিয়েছিলো, ১৯৪৪ সালের এক প্রবন্ধে Andre Bazin চমৎকারভাবে সেটার সারাংশ করেছিলেন:
চিদানন্দ দাশগুপ্তের মতন জ্ঞানী-গুণী রুচিশীল সমালোচক “Add culture to Indian films and you have the film society movement in India” ১১ -জাতীয় ব্যঙ্গাত্মক কটূক্তির বিষাক্ত বাণ হেনে আমাদের সিনেমার ঐতিহ্যকে ছোট করেছেন এবং বিগত দিনের চলচ্চিত্র শিল্পীসমাজের উন্মাদনা, আশা ও স্বপ্নকে আসম্মান করেছেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের আমরাও নিজেদের আলস্যের দোষে সহজ পথ অবলম্বন করেছি। বিদেশী ছবির উৎকর্ষতা ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে সম্মোহিত যুবকগোষ্ঠী আমরা – উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য কোলকাতার ভিন্ন ভিন্ন ফিল্ম ক্লাবে এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইত্যাদি সংস্থায় বিদেশী ছবি দেখানোর খবর পেলেই সব ফেলে ছুটেছি। বিগত যুগের বাংলা ছবি দেখার কোন উৎসাহ ও সময় ছিল না আমাদের। (অবশ্য, আমাদের বৈরাগ্যের একটা কারণ হচ্ছে, বিদেশী ছবির তুলনায় বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের অনেক নীচু মান)। পঞ্চাশ দশকে সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালি”-র মুক্তি একই সঙ্গে বাংলা সিনেমায় নিউ ওয়েভ-এর শুরু এবং বাংলা সিনেমার ‘Year Zero’ বলে চিহ্নিত করেছি (আমাদের অগ্রজেরা আর) আমরা। যেন, তিরিশ আর চল্লিশ দশক ছিলো বাংলা সিনেমার অন্ধকার যুগ।
ইতিহাসপাঠের ভূমিকা ও ইতিহাসের খসড়া
জন্মের পরবর্তী প্রথম চার দশকে বাংলা টকীজের শৈল্পিক বিকাশ, শিল্পীর দক্ষতার পরিপক্বতা ও জনপ্রিয়তা বুলেটের গতিতে না এগোলেও প্রত্যেক দশকেই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটি বিভাগে নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছে (যার অনুসন্ধান ঐতিহাসিক ও গবেষকের অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত) যা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করলে সেই দশকের মেজাজটাকে ধরা যায়। আবার, দশক অনুযায়ী সিনেমার অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ধারা নির্ণয় করা সম্ভব নয় কেননা এক একটা দশকে তৈরী ছবির সংখ্যা ও genre প্রচুর। দশ বছরের বাণ্ডিলে তাদের ভাগ করে নেওয়া যায় না।
বাংলা টকীজের প্রত্যেক দশকেই একাধিক প্রভাবশালী শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা তিরিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের স্টুডিওর চৌহদ্দির মধ্যে ছবি নির্মাণের প্রচলিত রীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
টকীজের আবির্ভাব থেকেই ফরাসীদের মতন বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সাহিত্যানুরাগ এবং সাহিত্যের জোরদার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নাটক, উপন্যাস ও কবিতার রূপের অনুকরণে ছবির চিত্রনাট্য, চরিত্র ও চরিত্রের সংলাপ রচনায় ছিলো সাহিত্যের প্রবল প্রভাব। তিরিশের দশকে চলচ্চিত্রে এই প্রবণতার আধিক্যের মূলে কেবলমাত্র সাউণ্ডের প্রবর্তনই নয়, এর আরো এক বড়ো কারণ হচ্ছে ভাষার বহুমুখী প্রকাশক্ষমতা।
টকীজে সংলাপের প্রয়োজনে উৎপত্তি হলো এক নতুন শ্রেণীর শিল্পীর – ‘সংলাপলেখক’ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের উপাধি ছিলো ‘চিত্রনাট্যকার’)। টকীজে সংলাপের কাজ হলো তিনটি - পরিচালকের ভাবনাকে অভিব্যক্ত করা, চরিত্রকে আকর্ষণীয় করে তোলা, এবং অভিনেতার জন্য চরিত্রচিত্রণের একটা ভিত্তি তৈরী করা।
ঐতিহ্যশালী বাংলা থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলেন সেরা অভিনেতা ও নাট্যপরিচালকের দল। তাঁরা একে একে যোগ দিলেন সিনেমায়, অভিনেতা (তিরিশের দশকে শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, দুর্গাদাস ব্যানার্জি প্রমুখেরা) ও পরিচালকের (যেমন, শম্ভু মিত্র প্রথমে অভিনেতা ও পরে পরিচালকের কাজও করেছিলেন) ভূমিকা নিলেন। ঐ দশকে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেছেন ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, প্রমথেশ বড়ুয়া, জহর গাঙ্গুলী, তুলসী চক্রবর্তী, হরিধন মুখার্জি, কানন দেবী (নির্বাক চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন), রেণুকা রায়, পদ্মা দেবী, ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, সন্ধ্যারাণী-র মতন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
সাহিত্য ও থিয়েটারের অত্যধিক প্রভাবে সেকালীন সিনেমার সংলাপ ছিলো কৃত্রিম ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ, অভিনেতারা সংলাপ বলতেন সোজাসুজি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। ক্রমে শৈশবাবস্থা পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখলো বাংলা সিনেমা। কিন্তু তখনও, সামান্য কয়েকজন প্রযোজক বা পরিচালক বাদে বাকীরা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হলেন যে চলচ্চিত্র থিয়েটার নয়, তার নিজস্ব ভাষা আছে – সেই ভাষাকে খুঁজে বের করতে হবে। বুঝতে পারলেন না যে, সিনেমাটোগ্রাফীর সুপ্ত সম্ভাবনার সৃজনশীল প্রয়োগে সে ভাষা তৈরী হবে, চরিত্রের অন্তর্জগতের সত্য প্রকাশ পাবে।
১৯৩১-১৯৪১ : শৈল্পিক প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয় নকশা
ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের বিবর্তনে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও-র অমূল্য অবদান অনস্বীকার্য। হলিউডের সিনেমা কলকাতায় দেখানোর চলন ছিলো তখন। হলিউড স্টুডিওর অনুকরণে (সাউণ্ড স্টেজ, ল্যাবরেটারী) গড়া এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিলো কলকাতার দক্ষিণ শহরতলীতে। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে একই সঙ্গে হিন্দি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় ছবির প্রযোজনা করেছে, প্রচুর অর্থ লগ্নী করে আকৃষ্ট করেছে মধ্যবিত্ত শিল্পসচেতন-প্রগতিশীল-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের শিল্পীদের, বাংলা সিনেমায় নতুন ধারা, কলাকৌশল, অভিনয়রীতি, টেকনিক, ইত্যাদির সূচনা করেছে, প্রবর্তন করেছে নামী-অনামী লেখক-লেখিকাদের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রনাট্য লেখার রেওয়াজ যা কালক্রমে হয়ে উঠেছে এই স্টুডিওর ট্রেডমার্ক। সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্রমে চালু করেছে ‘সংস্কৃতিবান’ বাঙ্গালির রুচিমাফিক পছন্দের সিনেমা।
তিরিশের দশকে সিনেমার অভিনেতাদের ঝোঁক ছিলো থিয়েটারি ঢঙে গলার স্বর চড়িয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে, হাত নাড়িয়ে, মুখের অতিরঞ্জিত ভাব ব্যবহার করে অভিনয় করা – যেন ছবির পর্দা হচ্ছে নাট্যমঞ্চ।
এবারে আলোচ্য দশকের দুটি ব্যতিক্রমী এবং তৎকালীন বিচারে আধুনিক প্রয়াসের উদাহরণ দিতে চাই।
এক: লেখক-অভিনেতা-পরিচালক দেবকী কুমার বোস-এর শুভাগমন। তিনি গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে পড়াশুনা ছেড়ে লেখাকে পেশা করেন এবং প্রমথেশ বড়ুয়ার সাথে স্বল্পকাল চিত্রনাট্যকার হিসাবে সিনেমায় কাজ করার পর ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন। ঐ বছরেই তিনি তাদের ব্যানারে চণ্ডীদাস ছবির পরিচালনা করেন। এ-ছবিতে ক্লোজ-আপ ও মিডিয়াম ক্লোজ-আপের অভিনব ব্যবহারে ছবির পর্দাকে নাট্যমঞ্চের মতন ব্যবহারের ফ্যাশনের বিকল্পের সূচনা করলো - ছবির পর্দা হয়ে উঠলো চরিত্রের অন্তঃস্থিত ভাবকে মূর্ত করার শক্তিশালী মাধ্যম। ঐ একই ছবিতে সাহসী দেবকী কুমার বোস ছবির এডিটিং-এ প্রচলন করলেন ক্রস-কাটিং টেকনিক। নরেন্দ্র দেব নামে এক সমালোচক লিখেছিলেন, চণ্ডীদাস-এ (বাংলা সিনেমায় এই প্রথম) কখনোই অভিনেতাদের পরিচালকের হাতের পুতুল বলে মনে হয় নি।১২
দুই: ১৯৩৫ সালে ফিল্ম-এডিটিং-এ অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ছবি দেবদাস-এর মুক্তি। দেবদাস চরিত্রে প্রচলিত, সাধারণ্যে স্বীকৃত অতিরঞ্জিত অভিনয়-রীতির বদলে প্রমথেশ বড়ুয়ার সংযত স্বাভাবিক অভিনয়ের স্টাইলে ছিলো অভিনবত্ব। এনে ছিলো নতুনত্বের স্বাদ (তবে তাঁর বাচনভঙ্গি যে একেবারে নাটুকে ছিলো না তা নয়)। তাছাড়া, সেসময়ে সিনেমার জগতে দেবদাস উপন্যাসের সার্থক রূপায়ণের সেরা দৃষ্টান্ত হিসাবে সমালোচক ও বিজ্ঞ দর্শকের অভিনন্দনও কুড়িয়েছিলো।
সমসাময়িক সমালোচক ও বিশেষজ্ঞদের মতে চণ্ডীদাস ও দেবদাস প্রথম দুই বাঙলা ছবি যাতে ‘ফোটোগ্রাফী’-র মান হয়েছিলো হলিউডের ছবির সিনেমাটোগ্রাফীর মানের তুলনীয়।১৩
তিরিশ দশকের শেষের দিকে নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিলেন বিভূতি লাহা (১৯৪৬ সালে যিনি আরও কয়েকজনের সাথে মিলে বিখ্যাত অগ্রদূত-গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)। এমন বহু প্রতিভাশালী লেখক-চিত্রনাট্যকার, টেকনিশিয়ান আর পরিচালকদের সম্বল করে নিউ থিয়েটার্স তথাকথিত ‘সামাজিক’ (Social) ছবি – পারিবারিক সুখ-দু:খ-বিবাদের নাটকীয় সংঘাতে ভরা ভাবালুতা-পূর্ণ কাহিনীর আধারে নির্মিত এক শ্রেণীর ছবি যা চিরাচরিত রক্ষণশীল হিন্দু সামাজিক অনুশাসনের আদর্শকে (আদর্শবাদ, আত্মত্যাগ, নীতিসর্বস্বতা) তুলে ধরতো - প্রযোজনার উপর জোর দিলো। অবশ্য, কালক্রমে, 'সামাজিক' ছবিতে বিষয়বস্তুর অনেক আধুনিকীকরণ হয়েছে, প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে।
চল্লিশ দশকের ‘পপুলার সিনেমা‘
সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী দর্শকের কাছে দ্রুত স্বীকৃতি লাভ ও বাণিজ্যিক সফলতার ফলে ‘সামাজিক’ বাংলা ছবি নির্মাণের ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠলো এবং চটপট টাকা বানাবার লোভে ছোটোখাটো অনেক নতুন প্রোডাকশন কোম্পানির জন্ম হলো।
পাশাপাশি, বম্বের হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে প্রধান উপাদান ছিলো রোম্যান্স যা ক্রমে বাংলা সোশ্যালেরও অন্যতম উপাদান হয়ে উঠলো। কেবল তাই নয় – যে কোলকাতা শহর বিশ ও ত্রিশ দশকে এককালে ভারতবর্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণের অগ্রবর্তী কেন্দ্র ও পীঠস্থানরূপে সম্মান অর্জন করেছিলো, যে বাংলা ছবি একসময়ে সারা দেশে ‘উচ্চমানের শিল্প’ বলে সর্ববন্দিত ছিলো, বম্বের আর্থিক ক্ষমতা, জাঁকজমক, চাকচিক্য ও সদ্যোজাত ‘স্টার’ সিস্টেমের (যা বাংলার স্টুডিয়োগুলি তিরিশ দশক থেকেই সচেতনভাবে উপেক্ষা করে এসেছে ও যাকে সমালোচকরা অবজ্ঞা করেছেন) সাথে টেক্কা দেওয়ার অক্ষমতা ও অনিচ্ছার ফলে, সেই শহর কলকাতা তার কদর হারালো। বাংলা সিনেমা ‘আঞ্চলিক’ সিনেমায় পরিণত হলো।১৪
বাংলার বাইরে মর্যাদা কমলো বাংলা সিনেমার। বাংলার একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা গেলো চলচ্চিত্রে। বিভিন্ন শ্রেণীর (Genre) ছবির সংযোজন হলো বাংলা সিনেমায়: বাঙ্গালীর খাঁটি ‘বাঙ্গালী’-চেতনা ও অনুভূতির মর্মকে ছুঁতে পারে, তাকে আবেগে অভিভূত করতে পারে বাঙলার এমন সব স্বাধীনতা সংগ্রামের ও সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে দেশাত্মবোধক ছবি ভুলি নাই (১৯৪৮), চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৪৯), বিয়াল্লিশ (নির্মাণ ১৯৪৯, মুক্তি ১৯৫১) এবং বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবন নিয়ে জীবনীবিষয়ক ছবি কবি জয়দেব (১৯৪১), মহাকবি কালিদাস (১৯৪২), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), বিদ্যাসাগর (১৯৫০); কালো ছায়া (১৯৪৮), কংকাল (১৯৫০), ভৈরব মন্ত্র (১৯৫১), জিঘাংসা (১৯৫১), সঙ্কেত (১৯৫১), হানাবাড়ি (১৯৫২), অদৃশ্য মানুষ (১৯৫৩)-জাতীয় ক্রাইম থ্রীলার ও সুপারন্যাচারাল ড্রামা; এছাড়া, কমেডি ও ভক্তিমূলক শ্রেণীর ছবিরও চলন ছিলো (কমেডি বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলো পঞ্চাশের দশকে)। এইসব শ্রেণীর ছবি অচিরেই সাধারণ বাঙ্গালী দর্শকের খুব প্রিয় হয়ে উঠলো এবং স্টুডিও আর প্রোডাকশন কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক সাফল্যকে নিশ্চিত করে দিলো। এই দশকে চলচ্চিত্র-জগতে আবির্ভূত হয়েছেন বিকাশ রায়, উত্তমকুমার, অসিতবরণ, কমল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্তা।
‘পপুলার’ ভারতীয় তথা বাংলা সিনেমার মান, সত্যমূল্য ও বৈচিত্র্য বা বৈচিত্র্যহীনতা নিয়ে গোড়া থেকেই এর সমর্থক (বিশেষত: প্রযোজক ও পরিচালক) আর নিন্দুকদের (বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবী, রুচিশীল প্রগতিবাদী দর্শক ও চলচ্চিত্র-সমালোচক) মধ্যে কিন্তু উত্তপ্ত বিতর্ক চলতো পত্র-পত্রিকার পাতায় ১৫
বিতর্ক
চল্লিশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলো। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ, পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত মিলে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন। বাংলা সিনেমায় এক নতুন এস্থেটিক্স, নতুন যুগের প্রবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখতে আরম্ভ করলেন এবং একই সঙ্গে ‘পপুলার’ বাংলা ছবির উদ্দেশ্যে হানলেন জ্বালাময়ী ভাষায় নির্মম আক্রমণ (আমার মতে গবেষক শুভজিত চ্যাটার্জী যেটাকে সঠিকভাবে “The vengeful reformism of film society tradition” বলে বর্ণনা করেছেন।)১৬
চলচ্চিত্র-সমালোচক মৃগাঙ্ক শেখর রায় এই বিতর্কের ব্যাপারে লিখেছিলেন,
তিনি আরো এক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন,
সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায় নামে আরেক সমালোচক তিরিশ আর চল্লিশ দশকের সিনেমা প্রসঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,
সত্যজিৎ রায় তাঁর Our Films, Their Films বইয়ের ভূমিকায় তাঁর জীবনের একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। চল্লিশ দশকের শেষদিকে স্টুডিয়ো-কর্মী এবং প্রতিষ্ঠিত কিছু টেকনিশিয়ানদের সাথে একবার একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনার সময় তাঁরা তাঁকে গল্পে কটা ক্লাইম্যাক্স আর নাচগানের সিকোয়েন্স আছে (সমকালীন ‘সামাজিক’ ছবিতে ঐ দুটি বৈশিষ্ট্যের প্রাচুর্য ছিলো) ইত্যাদি ধরণের ‘উদ্ভট’ প্রশ্ন করেছিলন।২০ কেননা, তাঁদের ধারণা ছিলো ক্লাইম্যাক্স আর নাচগানের সিকোয়েন্সের সংখ্যার উপরই নির্ভর করে সাদাসিধা দর্শকের ছবি পছন্দ হবে কিনা আর ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে কিনা।
অপরপক্ষে, বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রবাণী-র প্রথম সংখ্যায় (অক্টোবর, ১৯৪৮) ‘পপুলার’ সিনেমার সমর্থনে লেখা সম্পাদকীয় ও অন্যান্য প্রবন্ধের বক্তব্যের সারাংশ ভাস্কর সরকার করেছেন এইভাবে,
ভি. শান্তারাম আরো ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি পশ্চিমী সিনেমার প্রতি আসক্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দর্শকের চাইতে অশিক্ষিত গরীব দর্শক – প্রকৃতপক্ষে, যারা পপুলার সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতা করে - তাদেরই বেশি পছন্দ করেন।২২
রবি বাসুদেভান্ তাঁর গবেষণা-গ্রন্থে ‘পপুলার’ সিনেমার মেলোড্রামাটিক কাঠামো ও মেলোড্রামাটিক স্টাইলের নিন্দা করে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-র প্রতিষ্ঠাতাদের লেখা প্রবন্ধগুলো – বিশেষ করে চিদানন্দ দাশগুপ্তের লেখা – প্রসঙ্গে মন্তব্যে লিখেছেন,
১৯৪৯ সালে বিখ্যাত ফরাসী চিত্রপরিচালক Jean Renoir বাংলাদেশে এলেন তাঁর প্রথম রঙ্গীন (এবং ভারতবর্ষেরও) ছবি River-এর জন্য লোকেশান দেখতে। হরিসাধন দাশগুপ্ত এ-ছবিতে Renoir-র সাথে কাজ করেছিলেন। Renoir ঐ সময় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-তে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এবং বাঙ্গলায় থাকালীন তাঁর সাথে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎ হয়েছিলো বেশ কয়েকবার, দুজনে সিনেমা-সংক্রান্ত অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
১৯৫১-তে কলকাতায় এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত রুশ চলচ্চিত্র-নির্মাতা Vsevolod Pudovkin। তাঁকে গোপনে দুটি ছবির – নিমাই ঘোষ-এর ছিন্নমূল আর জ্যোতির্ময় রায়-এর (বিমল রায়-এর উদয়ের পথে ছবির চিত্রনাট্যকার) শঙ্খবাণী – এডিট না-করা rush দেখানো হয়েছিলো জানুয়ারী মাসে। উন্নত শৈল্পিক মান ও সামাজিক তাৎপর্যতার কারণে দুটি ছবিরই (দুটিরই মুক্তি ১৯৫১-তে) প্রশংসা করেছিলেন মূলধারার (mainstream) আর ‘পপুলার’ বাংলা সিনেমার নিন্দুক সমালোচকেরা। ছিন্নমূল-এর বিষয় হচ্ছে ১৯৪৭-এর দেশবিভাগ ও তার কুফলে বাস্তুহারা উদ্বাস্তুদের চরম দুর্দশা। ছবিটির বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে যে, বাংলা টকীজের ইতিহাসে এটাই প্রথম ছবি যা কলকাতা শহরের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাকে প্রকট করে তুলেছিলো। ছিন্নমূল-এ নিমাই ঘোষ স্টুডিয়োর চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে লোকেশন স্যুটিং করেছিলেন, অনামী ও আনকোরা নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। ছিন্নমূল আবার ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রে ইউরোপিয়ান নিও রিয়্যালিজম-এর (neo-realism) রীতিতে নির্মিত প্রথম ছবি। গবেষক শুভজিত চ্যাটার্জী তাঁর এক প্রবন্ধে শঙ্খবাণী সম্বন্ধে লিখেছেন,
১৯৫২ সালে কলকাতা-সহ ভারতবর্ষের অন্যান্য বড়ো শহরে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবে ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী, ইত্যাদি নানান দেশের ছবি দেখানো হয়েছিলো। ‘পপুলার’ বাংলা ও হিন্দি সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত বাঙ্গালী দর্শকের এক অংশ উৎসাহভরে দেখেছিলেন ছবিগুলি। দেখে তাঁরা উপলব্ধি করলেন সিনেমার অপরিসীম ক্ষমতা ও সিনেমার নিজস্ব ভাষার সৌন্দর্য। গতানুগতিক ছবির দর্শকদের মধ্যে এই প্রবল সাড়া লক্ষ্য করে ফিল্ম সোসাইটির বিদ্রোহী যুবকের দল আরো বেশিমাত্রায় অনুপ্রাণিত হলেন। উপরন্তু, মূলধারার সমালোচক-গোষ্ঠীও কমবেশি চাপ অনুভব করলেন – তাঁদের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি্র পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে সংশোধন করলেন। এবং ঐ একই চাপের ফলে কিছু মধ্যপন্থী পরিচালক সৃষ্টি করলেন ‘মিডল সিনেমা’ (Middle Cinema)।
প্রসঙ্গত, সেই বছরেই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সাথে যুক্ত নন এমন এক যুবক, ঋত্বিক ঘটক, নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পোয়েটিক রিয়ালিস্ট ছবি নাগরিক, যার কথা এমনকি ফিল্ম সোসাইটির যুবকদেরও অবিদিত ছিলো এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ ছবিটি তখন মুক্তিও পায় নি। ছবির নেগেটিভ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো বহু বছর পরে।
এমন সব নজিরবিহীন সাহসী প্রচেষ্টা ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলীর ঝোড়ো হাওয়া বয়ে নিয়ে এলো নতুনত্বের বার্তা। বাংলা সিনেমায় নতুন যুগের সূচনা করলো ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়-এর প্রথম ছবি পথের পাঁচালী। শুধু তাই নয় – শুরু হলো ‘পপুলার’ সিনেমা বনাম ‘আর্ট সিনেমা’, ‘মিডল সিনেমা’ বনাম ‘আর্ট সিনেমা’-র চিরন্তন বিবাদ।
বিকাশ রায় পঞ্চাশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে ‘পপুলার’ সিনেমাতে এবং কিছু Middle Cinema-তে অভিনয় করার ফলে ‘আর্ট’ সিনেমায় অনুরক্ত একপেশে চলচ্চিত্র-সমালোচকদের কাছে স্বীকৃতিই পান নি। কিন্তু, এককালের Avant-Garde আন্দোলনের অন্যতম পদাতিক থেকে নায়ক থেকে অধিনায়ক (বিকাশ রায় একাধিক ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন) অথচ খেতাবহীন এই শিল্পী প্রায় তিন দশক ধরে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন।
৩ মেলোড্রামা : প্রাসঙ্গিক পরিচয়পত্র
“I am not afraid of melodrama. To use melodrama is one’s birthright, it is a form।” ঋত্বিক ঘটক২৫
মেলোড্রামার কাছে সিনেমার ঋণ জন্ম থেকেই এবং অনেক। ঊনবিংশ শতাব্দীর থিয়েটারের রীতি-নীতি, বিশেষ করে মেলোড্রামার বহু উপাদানই আত্মসাৎ করেছে চলচ্চিত্র-শিল্প। মেলোড্রামা সর্বদেশীয় – সব দেশের সিনেমাতেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। Post-mdernist-রা Modernism-এর বিরোধিতা করতে গিয়ে মেলোড্রামাটিক ফর্মকে ব্যবহার করেছেন। বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা দরকার, কিন্তু এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য তা নয়। কেউ নিশ্চয় ইতিপূর্বে আলোচনা করেছেন বা, আশা রাখি, অদূর ভবিষ্যতে করবেন।
মেলোড্রামার রূপায়ণ নানা দেশে নানানরকম। মেলোড্রামা সাহিত্য, থিয়েটার, চলচ্চিত্রের এক অন্যতম রূপ (Form)। এই ফর্মের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তার জন্যই যথেচ্ছভাবে এর কুৎসা রটিয়েছেন (লেখার মাধ্যমে) বিংশ শতাব্দীর এক দল আধুনিকতাবাদী সমালোচক। ‘মেলোড্রামাটিক’ প্লট ও অভিনয়, এবং জনপ্রিয়তা ও আবেগপ্রবণতা-কে ছেঁদো, অকেজো বলে ঘোষণা করার মূলে অবশ্য মতাদর্শগত কারণও ছিলো।
লোকপ্রিয় সংস্কৃতিকে (Popular Culture)-কে ভিত্তি করে মেলোড্রামার বিকাশ হয়েছে। যার ফলে বিশাল জনসাধারণের মধ্যেই তার চিরস্থায়ী আবেদন। বাংলার আধুনিকতাবাদী সমালোচকরা একটা পরম সত্যকে কিন্তু বেমালুম অস্বীকার করেছেন - ‘মেলোড্রামাটিক’ ছবি নির্মাণে শুধু যথেষ্ট নয় বিশিষ্ট দক্ষতারও – পরিচালকের, অভিনেতার, এডিটরের, সিনেমাটোগ্রাফারের – প্রয়োজন হয়।
আশ্চর্য, আর কোনো দেশে এমন নিদর্শন মেলে না! ফ্রান্সের ‘নিউ ওয়েভের’ তরুণ প্রবক্তারা চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে কাইয়্যে দু সিনেমা-র পাতায় টকীজের পুরানো দিনের ‘পপুলার সিনেমা’-র পরিচালকদের – ফরাসী, অ্যামেরিকান এবং পরে জাপানী – কাজের গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন। সে-কাজে মেতে উঠেছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদের উৎসাহ নিয়ে। তাঁরা কিন্তু আলোচনার বিষয় হিসাবে অধিকাংশ সময়ে ‘মেলোড্রামা’-র পরিচালকদেরই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের সেই অমূল্য, জ্ঞানগর্ভ, চমকপ্রদ লেখা Dudley Andrew- নামে এক অ্যামেরিকান ছাত্র এবং Hugh Grey নামে Alfred Hitchcock-এর এক ছাত্র ইংরাজিতে অনুবাদ করে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন।২৬
বিভিন্ন দেশে সৃজনশীল চলচ্চিত্র-শিল্পীরা আবিষ্কার করেছেন মেলোড্রামার নিত্যনতুন ‘সিনেমাটিক’ প্রকাশভঙ্গী (Cinematic Idiom) - ক্যামেরার শট পরিকল্পনা, এডিটিং টেকনিক, অভিনয়ের স্টাইল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন বহু চিত্তবিনোদনকারী ‘মেলোড্রামা’-র হদিশ পাওয়া যায় যা সমকালীন সমাজব্যবস্থার সমীক্ষা হিসাবে সমালোচকদের কাছে অসীম গুরুত্ব পেয়েছে। ‘মেলোড্রামাটিক’ ছবিতে ছবির (পরিচালকের) আগ্রহের বিষয় ও মূল জিজ্ঞাসা, ছবিতে বিবাদ-বিরোধ-সংঘাত-অসংগতি নানা রূপে মূর্ত করা সম্ভব হয় এবং এসবের ফয়সালা ঘটে নানানভাবে : যেমন, মানুষের সাথে মানুষের ভগ্ন সম্পর্ক আর সম্পর্কের জোড়া লাগা; সামাজিক অনুশাসনে বা পারিবারিক চাপে সৃষ্ট বা ঘরের বাইরের জগতের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে নর-নারীর অসহনীয় শারীরিক-মানসিক কষ্ট-নিপীড়ন-ভীতি-আশঙ্কা এবং সহ্যক্ষমতা-চরম আত্মত্যাগ-আদর্শবাদ-নৈতিকতা-ঐতিহ্যবাদ-সাহসিকতার জোরে সেগুলো অতিক্রম করা।
মেলোড্রামার বৈশিষ্ট্য: উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি, আবেগপূর্ণ মুহূর্ত, অভাবনীয় সংকট, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণত্ব বনাম অপরিমিত নাটকীয় মুহূর্তগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত ভাবাবেগের অসামঞ্জস্যতা, সংকট ও সংঘাতের মুখে পড়ে চরিত্রের হিস্টিরিয়া। মেলোড্রামাতে এধরণের বিস্ফোরক পরিস্থিতির পরিণামে কিন্তু চলতি অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে (বিশেষ করে নারীর) আপোষ ও আত্মত্যাগের ফলে আসে ছবির পরিণতি ।
বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বাসগৃহ হচ্ছে সমাজের প্রাণকেন্দ্র। বাংলা সিনেমায় প্রথম থেকেই সেই নিরাপদ, আপন বাসস্থান – যেখানে মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা পরিবারের সবকিছু আগলে রাখে – ছিলো পারিবারিক বা ‘সামাজিক’ মেলোড্রামার প্রধান ক্রীড়াক্ষেত্র। চল্লিশের দশকে নারীকেন্দ্রিক মেলোড্রামার খুব চলন হয়েছিলো বাংলাদেশে। তাছাড়া, (আগে উল্লেখ করেছি) দেশাত্মবোধক, জীবনীবিষয়ক, কমেডি ও ভক্তিমূলক মেলোড্রামাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো।পঞ্চাশের দশকে চালু হয়েছিলো উত্তম-সুচিত্রার ‘রোম্যান্টিক মেলোড্রামা’।
পরবর্তীকালে আর এক ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক মেলোড্রামার সীমানাকে অতিক্রম করার মতন সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁর ছবির গুচ্ছ ভারতীয় সিনেমায় মেলোড্রামার বিবর্তনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
১৯৬৩ সালে Film and I নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “মেলোড্রামা’ হচ্ছে ‘much abused genre’ ” যার থেকে আমাদের খাঁটি ‘জাতীয়’ সিনেমা জন্ম নেবে তখনই যখন “truly serious and considerate artists bring the pressure of their entire intellect upon it।“২৭
ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে ‘মেলোড্রামাটিক’ স্টাইলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো: ওয়াইড অ্যাঙ্গেল (wide angle) লেন্সের সুচিন্তিত ব্যবহার, এক্সট্রীম হাই অ্যাঙ্গেল (Extreme High Angle) এক্সট্রীম লো অ্যাঙ্গেল (Extreme Low Angle) আর অপ্রচলিত অ্যাঙ্গেল থেকে শট, নাটকীয় আলোকসম্পাত, পরীক্ষামূলক সাউণ্ড-এফেক্ট (Sound-effect ) এবং সর্বোপরি অভিব্যক্তিবাদী (Expressionist) অভিনয় রীতি।
‘রিয়ালিজম’-এর সাথে ‘মেলোড্রামা’-র পার্থক্য কি? চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক ছবির (আজকের দিনের সেরা বিদেশি ছবিতেও) নিদর্শন মেলে যেখানে এ-দুটি ফর্ম একে অন্যের পরিপূরক। ‘রিয়ালিস্ট’ চলচ্চিত্রকারেরা ‘মেলোড্রামাটিক’ ফর্মের সদ্ব্যবহার করে স্মরণীয় শিল্পসৃষ্টি করেছেন ও করছেন। আবার, ‘মেলোড্রামাটিক’ ফর্ম ব্যবহার করেছে এমন ‘রিয়ালিস্ট’ ছবির ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে অন্যান্য দেশের সিনেমায়।
তাহলে, পপুলার সিনেমার অভিনেতাদের প্রতি নিউ ওয়েভ সিনেমার কট্টর উপাসকদের বৈষ্যম্যমূলক আচরণ কি যুক্তিযুক্ত? তাঁরা কি অস্বীকার করতে পারেন যে, বিংশ শতাব্দীর সেই আশি দশক থেকে শুরু করে বিদেশি সিনেমা্র পরিচালকরা ‘মেলোড্রামাটিক’ ফর্মের সম্ভাবনাময় সুপ্তশক্তি পুনরাবিষ্কারের কাজে মেতে উঠেছেন?
৪ আটটি ক্লোজআপ: ভূমিকায় বিকাশ রায়
এবার, চলচ্চিত্রের পর্দায় তাঁর আটটি চরিত্র রূপায়ণের আলোচনার মাধ্যম বিকাশ রায়ের পোট্রেট আঁকার চেষ্টা করবো । আমার বিশ্বাস, এই চরিত্রগুচ্ছ তাঁর নৈপুণ্যের সারমর্ম, প্রসারতা আর বৈশিষ্ট্যগুলিরই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাস।
আলোচিত প্রথম তিনটি চরিত্র – ৪২-এর মেজর ত্রিবেদী, না-র অনন্ত, অনুপমা-র নরেন – একে অন্যের থেকে ব্যক্তিত্বে ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের (নায়ক থেকে শুরু করে ভিলেন অব্দি)। অভিনয়-জীবনের প্রারম্ভিক দশ বছরে এসব ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি।
পরের দুটি ছবি ‘উত্তম-সুচিত্রা’-র আধিপত্যের যুগের। জীবনতৃষ্ণা-র দেবকমল আর সূর্যতোরণ-এর রাজশেখর – সামাজিক অসাম্য ও ১৯৪৭-এর অব্যবহিত পরবর্তী কালের কুবের-শ্রেণীর স্বৈরাচারে ক্রুদ্ধ যুবক এবং rags-to-riches বুর্জুয়ার (bourgeoise) সার্থক প্রতিকৃতি। এই দুটি চরিত্র-সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক-নির্ভীক-বিশুদ্ধ মনের নায়কের সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে।
প্রথম পাঁচটি আলোচিত ছবি তাঁর অভিনয়-জীবনের সবচেয়ে উর্বর (ছবির সংখ্যার বিচারে) সময়ের কীর্তি। শেষের তিনটি ছবি বিকাশ রায়ের মধ্যবয়সের কাজ। জীবনকাহিনী-র নবজীবন, কাঁচকাটা হীরে-র অম্বিকা গুপ্ত, আরোগ্য নিকেতন-এর জীবন মশায় বিকাশ রায়ের বহুমুখী, অথচ, হায়, আনুষ্ঠানিকভাবে (ভারতীয় জাতীয় পুরস্কার সমিতির এবং বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশানের সদস্য-বিচারকদের বিচারে) অ-স্বীকৃত শিল্পদক্ষতার ও খাসা চরিত্রাভিনয়ের (Character Acting) মহত্তম নিদর্শন।
এক/ মেজর ত্রিবেদী
বিয়াল্লিশ ছবি মুক্তির (৯-ই আগস্ট, ১৯৫১) আগে বিকাশ রায় মোট পনেরোটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এদের মধ্যে ভুলি নাই (১৯৪৮), রত্নদীপ (২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১) ও জিঘাংসা (২০ এপ্রিল, ১৯৫১) বাদে বিকাশ রায়ের অভিনয় সেসময় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি পায়নি। ঐসময়ে তিনি বাকি বারোটি ছবিতে হরেকরকমের রোল করেছিলেন যার অনেকগুলোর প্রিন্ট এখনও উদ্ধার করা যায়নি (হয়তো ভবিষ্যতে হবে)। শোনা যায় প্রমথেশ বড়ুয়ার বাংলা দেবদাস-এর প্রিন্ট বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার হয়েছে ভারতীয় ফিল্ম সংরক্ষণকারী পি. কে. নায়ার-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। তবে প্রিন্টের কিছু অংশ আগুনে-পুড়ে-নষ্ট-হওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে)।
ভুলি নাই আর বিয়াল্লিশ ছবি দুটির পরিচালক হেমেন গুপ্ত এককালে সক্রিয় স্বাধীনতা-সংগ্রামী ছিলেন, জেল খেটেছিলেন প্রায় সাত বছর (১৯৩২-৩৮)। শোনা যায়, সেসময় তিনি মৃত্যুদণ্ডেও নাকি দণ্ডিত হয়েছিলেন। সিনেমায় বিকাশ রায়ের হাতেখড়ি ১৯৪৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হেমেন গুপ্তের অভিযাত্রী ছবিতে নায়কের ভূমিকায়। সে ছবি তখন তেমন চলেনি।
হেমেন গুপ্ত - এককালে সুভাষ চন্দ্র বোস-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী, আত্মগোপনকারী সন্ত্রাসবাদী, জেল খেটেছেন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮, জেল থেকেই সাহিত্যে এম.এ. পাস করেছিলেন। সিনেমা ভালোবাসতেন বলে নিউ থিয়েটার্স-এ যোগ দেন সহকারী হিসেবে। ভুলি নাই হেমেনবাবুর দ্বিতীয় ছবি। তাঁর স্বদেশী আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্যেই পেয়েছিলেন গল্পটি লেখার প্রেরণা। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকের শেষ দিকে বাংলার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় তৈরী এক জনপ্রিয় নতুন শ্রেণীর (Genre) - স্বদেশভক্তিপূর্ণ মেলোড্রামা - ছবি সংযোজিত হল বাংলা সিনেমা-র ভাণ্ডারে: ভুলি নাই (১৯৪৮), চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৪৯), বিপ্লবী ক্ষুদিরাম (১৯৫১) এবং বিয়াল্লিশ (১৯৫১), ইত্যাদি।
ভুলি নাই বক্স অফিস ফ্লপ হলেও ছবিটি ও বিকাশ রায়ের অভিনয় বাংলা-র মানুষের কাছে বহু সাধুবাদ কুড়িয়েছিলো। ছবিতে ব্যবহৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই নেতা সুরেন্দ্রমোহন ও বিপিন চন্দ্র পালের উদ্দীপনাময় বক্তৃতা, চারণকবি মুকুন্দদাসের গান দর্শক-কে মাতিয়ে রেখেছিল।২৯ ভুলি নাই-তে বিকাশবাবু শুধু অভিনয়-ই করেননি, তিনি চিত্রনাট্য লেখায় সাহায্য আর সহ-পরিচালনার কাজ-ও করেছিলেন।
তিরিশ ও চল্লিশ দশকের প্রথম ভাগে বাংলা ভাষায় দেশাত্মবোধক ছবির নিদর্শন মেলে না। সেসময় বাংলাদেশের জনসাধারণ-শ্রমিক-কৃষক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে, দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছে, তাদের বীরত্বের গল্প ঘুরছে মানুষজনের মুখে মুখে। কিন্তু বাংলা সিনেমা, সিনেমার প্রযোজক আর পরিচালকরা এই উত্তাল সময়কে সিনেমায় ধরে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি তখন। এমনকি ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষকেও তাঁরা উপেক্ষা করেছেন। ওদিকে, ১৯৪৪ সালে, বম্বেতে খাজা আহমেদ আব্বাস বাংলার সেই দুর্ভিক্ষ নিয়েই বানিয়েছেন ধরতী কে লাল ছবি। ১৯৪৭-এর অব্যবহিত পরে বিদ্রোহী বাংলার ইতিহাস নিয়ে বাংলায় প্রথম সফল দুটি ছবি ভুলি নাই আর বিয়াল্লিশ। সরাসরি দেশাত্মবোধক-ই শুধু না, ছবি দুটি বাংলায় ‘রাজনৈতিক’ (Political) ছবিরও প্রথম নিদর্শন।
ছবি দুটির নির্মাণের সময় সর্বভারতীয় সেন্সর বোর্ডের অস্তিত্ব ছিলো না। প্রথমে দুটির একটিও আঞ্চলিক সেন্সর বোর্ডের কাছে ছাড়পত্র পায়নি। প্রতিবাদে তখন সেন্সরের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো। হেমেন গুপ্তের অভিমতে দর্শকেরাই হবে আসল সেন্সর, তারাই ভালো-মন্দের বিচার করবে – তার জন্য সরকারী আমলা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যে ভরা বোর্ডের প্রয়োজন নেই, আমলা-চক্র অর্থহীন সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পপুলার সিনেমার মান বিচার করছে, শিল্পীর স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে। বিয়াল্লিশ ছবিটিকে ছাড়পত্র না দেওয়ার কারণ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেন্সর বোর্ড ঘোষণা করেছিলো, ছবিটি -
ঐ একই ঘোষণায় ছবির দোষের ব্যাপারে বলা হয়েছিলো যে ছবিটিতে বহু “factual errors’ এবং বিকৃতি আছে যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামকে মহিমান্বিত করার পরিবর্তে হেয় করেছে।২৮
আসলে, বিয়াল্লিশ-এ ১৯৪২-এর Quit India আন্দোলনের নির্ভীক যোদ্ধাদের উপর পুলিশ ও মিলিটারির নৃশংস অত্যাচারের দৃশ্যগুলিই সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের শঙ্কার কারণ। আশ্চর্য লাগে যে, সদ্য-‘স্বাধীন’ (?) ভারতেও বেইমান রাষ্ট্রশক্তি ভবিষ্যৎ বিদ্রোহের অপচ্ছায়া দেখতে শুরু করেছিলো। আমলা-গোষ্ঠীর আশংকা হয়েছিলো, ঐ সব দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের মনে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা (পুলিশ, মিলিটারি ও আমলাতন্ত্র) সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা হবে (যেমন, সাধারণ মানুষ ভেবে বসতে পারে যে স্বাধীন দেশে কোন আন্দোলন হলে পুলিশ-মিলিটারি মানুষের উপর একইভাবে অত্যাচার করবে। অপ্রিয় সত্য হলো, স্বাধীন ভারতের পুলিশ ও মিলিটারি পরাধীন ভারতের পুলিশ ও মিলিটারির পুরানো কাঠামোকে মোটামুটি অক্ষত রেখেছিলো)।
নিঃসন্দেহে, উপরোক্ত আশংকার মূলে ছিলো ছবিতে জান্তব, বর্বর, অত্যাচারী, খুনে মিলিটারি অফিসার মেজর ত্রিবেদী-র ভূমিকায় বিকাশ রায়ের শিহরণ-জাগানো অভিনয়। আজও যার তাৎপর্য আর সত্যতা আমাদের প্ররোচিত করে।
তবে, বিয়াল্লিশ বাংলার বাইরে (বিহার, ত্রিপুরা, আসাম, ওড়িশা) প্রায় সর্বত্রই সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়েছিলো, দর্শকের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিলো। বিহারের এক দর্শক ছবি দেখে চিত্রবাণী পত্রিকার সম্পাদককে পাঠানো চিঠিতে অভিযোগ করেছিলেন, সিনেমার উদ্দেশ্য কি? সিনেমা কি শুধু ভাঁড়ামো আর সৌন্দর্য দেখাবার মধ্যে নিজেকে সীমিত রাখবে, না কি সে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলবে, সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতাকেও রূপায়িত করবে? স্বাধীন দেশে সিনেমার ভূমিকা কি হবে?২৯
পশ্চিমবঙ্গে বিয়াল্লিশ-এর মুক্তি হয়েছিলো আরও দুবছর পর।
১৯৪৮-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ভুলি নাই লর্ড কার্জনের আদেশে ১৯০৫ সালের বঙ্গ-বিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর ট্র্যাজিক পরিণতির কাহিনী। ছবিটি স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবময় অধ্যায়ের দলিল হিসাবে পত্র-পত্রিকায় খুব প্রশংসিত হয়েছিলো। ছবিতে বিকাশ রায়ের চরিত্রের নাম ছিল মহানন্দ। সে দলের নেতৃত্বকে ভুল বুঝেছিল – ভেবেছিল তার বদলে দলের নেতা অন্য একজন বিপ্লবী কর্মীকে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করছেন। আবেগের বশে দলের প্রতি সে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো, ব্রিটিশদের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করতে শুরু করলো। মহানন্দের প্রাণসংশয় আশংকা করে ব্রিটিশরা তাকে একটি হোটেলে সাহেবের সাজে লুকিয়ে রাখলো। ঠিক হলো তাকে বিলেতে পাচার করা হবে। কিন্তু তার আগেই বিপ্লবীরা তাকে গুলি করে হত্যা করলো।
ত্রিপুরায় বিয়াল্লিশ ছবির রিলিজের বর্ণনা দিয়েছেন বিকাশ রায় এইভাবে:
মঞ্চাভিনেতা যেমন curtain call-এর জন্য অপেক্ষা করেন, এমন বহু চলচ্চিত্রাভিনেতা ছিলেন ও আছেন যাঁরা সারা জীবন কাটিয়েছেন এরকম প্রশংসা আর প্রসিদ্ধির প্রত্যাশায়।
Quit India আন্দোলনের কয়েকটি দিনের ঘটনা নিয়ে ছবি। বিপ্লবীরা গান্ধীজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় মিলিটারি হেডকোয়ার্টার দখল করার ষড়যন্ত্র করছে আর সাথে সাথে দালাল আর খুনী পুলিশবাহিনীর অত্যাচারী সদস্যদের গুপ্তহত্যা করছে, অবিরাম বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে, প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে।
অন্যদিকে, মিলিটারির উচ্চপদস্থ অফিসারদের প্রিয় মেজর ত্রিবেদী (বিকাশ রায়) - যাঁর কর্মক্ষমতা, আনুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠা মিলিটারি মহলে সুবিদিত – হিংস্র অভিযান চালাচ্ছেন বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। মেজর ত্রিবেদী – খাঁটি আমলার ধাঁচে গোঁফ সুন্দরভাবে ছাঁটা, মুখে পাইপ, খাড়া চেহারা ও শরীর টানটান করে হাঁটার ভঙ্গিতে অনমনীয়তা। পুলিশ-মিলিটারিকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ও আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত শাণিত অস্ত্র তৈরি করে যে কারিগর দাশু (শম্ভু মিত্র), তার মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেও বিপ্লবীদের সম্বন্ধে কোন গোপন তথ্য জোগাড় না করতে পেরে তাকে হত্যা করে তার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুকুম দেয় ত্রিবেদী। পরে স্বয়ং দাশুকে গ্রেপ্তার করে অধস্তন কর্মচারীদের আদেশ দেন, "Do one thing … tie him to the truck… drag him…if he is still alive, I’ll meet him at my office।"
আন্দোলনের আত্মগোপনকারী নেতা অজয়-এর (প্রদীপ কুমার) বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিবেদী পাইপের ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করে অজয়ের বাচ্চা ছেলে ঐ বাড়ির ভিতর আছে জেনেও। শারীরিক অত্যাচার, হুমকি, হত্যা ছাড়া আর কোন ভাষা তার জানা নেই। বাচ্চাকে বাঁচাতে অজয় ছুটে আসে। বাঁচাতে পারে না, গ্রেপ্তার হয়। অজয়কে মিলিটারি হেডকোয়ার্টারে পাশবিক অত্যাচারের দৃশ্য এতো অসহনীয় যে তা আমাদের জঘন্যতম আবেগকে জাগিয়ে তোলে। ইটালিয়ান চলচ্চিত্রকার Roberto Rossellini-র Rome, Open City (১৯৪৫) ছবিতে পুলিশ থানায় এক বিপ্লবীকে অত্যাচারের বহু-বিতর্কিত মর্মান্তিক দৃশ্যের রিয়্যালিজমের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতন রিয়্যালিস্ট (সশস্ত্র-বর্বর অত্যাচারের মুখোমুখি আদর্শের পরাক্রম)।
অজয়ের স্ত্রী বীণা-কে (মঞ্জু দে) অত্যাচারের দৃশ্যে বীণার দেহ তল্লাসি করার আদেশ দেয় ত্রিবেদী। বীণা দাশুর বানানো ছুরি বিঁধিয়ে দেয় তল্লাশিকারীর শরীরে। এবার ত্রিবেদী নিজে বীণার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে, বীণাকে মিলিটারি হেডকোয়ার্টারের বাইরে অচৈতন্য অবস্থায় আবিষ্কার করে বিপ্লবীরা।
এতো অত্যাচার সত্ত্বেও বিপ্লবীরা পরিকল্পনা মতন সেতু, নদীর বাঁধ উড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশ শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি চালায়। বিপ্লবীদের কাবু করতে না পেরে ত্রিবেদী ক্ষ্যাপা জানোয়ারের মতন ছোটাছুটি করে। স্থানীয় মুসলমানদের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। স্থানীয় জমিদারকে ধরে এনে সে মিলিটারির হয়ে দালালির কাজে লাগায়। তবুও পুলিশ বিপ্লবীদের কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। ত্রিবেদীর গর্জন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তার বুটের দাবড়ানিতে, তার দাপটের চোটে গ্রামবাসী আতংকিত হয়ে বাড়ির বাইরে আসা বন্ধ করে দেয়।
ত্রিবেদীর চরিত্রে বিকাশ রায়ের অভিনয় বিয়াল্লিশ-এ অন্য সবার অভিনয়কে ম্লান করে দিয়েছে। চরিত্রের বিভিন্ন মুড ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিকাশ রায় ত্রিবেদীকে ছবির মুখ্য চরিত্র ও পরম বিক্রমশালী প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন অনায়াসে। প্রতিটি সংঘর্ষ-কে মনে হয় যেন অসুর আর নির্বল মানুষের মধ্যে লড়াই! এ-লড়াইয়ে সামান্য মানূষ জিতবে কি করে?
ক্লাসিক ব্রিটিশ ছবিতে ভিলেনকে চটকদার করার রীতি ছিলো। একটি প্রবাদ ছিলো ‘It’s good to be bad’: একমাত্রার (one-dimensional) সুন্দর নায়ক আর সুন্দরী নায়িকার তুলনায় রকমারি মুড এবং ক্রিয়াকর্ম ভিলেনের চরিত্রকে বহুমাত্রিক করে তোলে।
বিয়াল্লিশ-এর শেষ দৃশ্যে বিপ্লবীরা মিলিটারি হেডকোয়ার্টার দখল করতে এলে পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনীর সৈনিকরা রাইফেল না চালিয়ে দলে দলে আত্মসমর্পণ করলে একা ধেয়ে-আসা বিপ্লবীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে ত্রিবেদী। প্রমাণ করে যে সে হার মানার মানুষ না।
একজন উঠতি তরুণ অভিনেতার পক্ষে এরকম ধরনের রোল করতে রাজি হওয়া মানে ঝুঁকি নেওয়া। জনপ্রিয়তা নষ্ট হবে ভেবে বিকাশ রায় এই রোলকে প্রত্যাখ্যান করেননি। এবং, তাঁর মেজর ত্রিবেদী বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত অথচ আকর্ষণীয় কিংবদন্তী হয়ে আছে ও থাকবে।
দুই/ অনন্ত
১৯৫৪ সালের ছবি না (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বে) বিকাশ রায়ের পঁয়ত্রিশতম।
অনন্ত (বিকাশ রায়) আর কালী (রবীন মজুমদার) সম্পর্কে ভাই, অভিন্নহৃদয়। জমিদারের ছেলে অনন্ত লেখাপড়া করেনি, সে পেশাদার শিকারী হতে চায়, রাইফেল নিয়ে শিকার করে বেরোয়। কালী (এখন আলাদা নিজে বাড়ি ভাড়া করে থাকে) জমিদারের বাড়িতেই মানুষ - উচ্চশিক্ষিত, পড়াশুনা নিয়ে থাকে। অনন্ত জোর করে মাঝেমাঝে তাকে বনে শিকারে নিয়ে যায়। অনন্তের সাথে কালীর ব্যবহারে কালীর ঈষৎ উন্নাসিকতা আর অনন্তের হীনমন্যতা আঁচ করতে অসুবিধা হয় না। অনন্ত কিন্তু কালীকে খুব শ্রদ্ধা করে।
একদিন ভোরে অনন্ত কালীর বাড়ি গেছে তাকে শিকারে নিয়ে যাবে বলে। কালীর পড়ার টেবিলে হোমার-এর বই পড়ে আছে। কালী যখন তৈরি হতে অন্য ঘরে গেছে তখন অনন্ত বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টোতে লাগলো।
কালী ঘরে ঢুকে দৃশ্যটি দেখে মজার ছলে বললো, “ওটা রেখে দে। ও বইয়ের তুই কিছুই বুঝবি না।… তুই কি হোমারের বইটা পড়ে শেষ করার চেষ্টা করছিস?”
উত্তরে অনন্ত বিনীত হাসি হেসে বললো, “না, ছবিগুলো দেখছিলাম।“ সে এটাকে অপমান মনে করে গায়ে মাখে না।
দুজনে একসাথে বাইরে বেরোলে লোকজনের সাথে কথা বেশির ভাগ সময়ে কালীই বলে, অনন্ত তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে।
এক বাচাল ঘটক তাদের দুজনের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলো। অবশ্যই কালীর জন্য ঘটক শিক্ষিত মেয়ে ঠিক করেছে। জমিদারের আর জমিদার-গৃহিণীর ইচ্ছা দুজনের একই দিনে বিয়ে দেন। গৃহিণী স্বামীকে প্রস্তাব দিলেন যে, দিনকাল পালটে গেছে, দুই ছেলে আলাদা করে গিয়ে নিজের নিজের কনে নিজে চোখে দেখে আসুক। জমিদার বললেন, না, সেটা বংশের রীতিবিরুদ্ধ কাজ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কালী অনন্ত-র কনে (সাধারণ পরিবারের মেয়ে ব্রজরাণী) আর অনন্ত কালীর কনে-কে (উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত, দাম্ভিক মেয়ে মীনা) দেখে আসুক।
কনে দেখতে গিয়ে ব্রজরাণীর (সন্ধ্যারাণী) সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কালী মতলব আঁটলো এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে। সবার অজ্ঞাতে সে ভুয়ো চিঠি লিখে ব্রজরাণীর সাথে অনন্ত-র বিয়ে ভেঙ্গে দিলো। সেই চক্রান্তের ফলে কালীর সাথে বিয়ে হলো ব্রজরাণীর আর শিক্ষিত মীনার সাথে অনন্ত-র। বিয়ের রাতেই মীনা জানতে পারলো যে, তার স্বামী অনন্ত শিক্ষিত নয়, বুঝলো, তাকে ঠকিয়েছে জমিদার। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে সে চলে গেলো।
মীনার আর তার বাবার কাছে দিনের পর দিন অপমান, তাচ্ছিল্যে অসহ্য হয়ে উঠলো অনন্ত-র জীবন। তাদের কাছে সে খোলাখুলিভাবেই তার বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো। আশ্চর্য, তা সত্ত্বেও মীনা আর তার পরিবারের কাছে সামান্য স্বীকৃতি আর সম্মান অর্জন করার আশায় সে পড়াশুনা করতে রাজি নয়! অনন্তের ধারণা হলো, কালী সব ভালো গুণ নিয়েই জন্মেছে, জীবনের সব ভালো জিনিসগুলো তাই তার ন্যায্য পাওনা! অনন্ত দূর থেকে লক্ষ্য করে, সাদাসিধে, ঘরোয়া, রূপবতী ব্রজরাণী আর কালী একে অপরের প্রেমে মশগুল হয়ে থাকে।
একদিন রাইফেল নিয়ে শিকারে বেরোবার মুখে অনন্ত আড়াল থেকে তার বাবা-মার কথা শুনে ফেলে। জানতে পারে যে, ব্রজরাণী-র সাথে তার বিয়ে ভাঙ্গার মূলে হচ্ছে একটি বেনামি চিঠি। সে তার মার কাছ থেকে চিঠিটি চেয়ে নিয়ে পড়তে পড়তে ধরে ফেলে যে হাতের লেখা কালী-র।
স্তম্ভিত অনন্ত কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
অনন্ত মীনাকে জানায় যে, অপাত্রে মীনার বিয়ে হওয়ার পিছনে অনন্তের নিজের হাত ছিলো না। সে প্রতারক নয়। মীনা এতেও টলে না, সে নিজের বাড়ি থেকে ফিরে আসে না।
কালীকে পরীক্ষা করার জন্য অনন্ত তাকে চিঠিটি দিয়ে চিঠির লেখক কে বের করতে বলে। এবং হাসিখুশি রূপবতী ব্রজরাণীকে দেখে এই দ্বিতীয়বার (তার রূপ দেখে প্রথম চমকে উঠেছিলো বিয়ের রাতে) তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এরপর থেকে নানান ছুতোয় তাকে দেখতে আসে। কালীর বাড়িতে ঘন ঘন আসার আরেকটা উদ্দেশ্য সম্ভাব্য চক্রান্তকারী কালীকে পীড়ন করা।
মর্যাদা হারিয়ে বঞ্চিত, প্রতারিত, মর্মাহত অনন্ত বাড়ির বাইরেই বেশি সময় কাটায়। সর্বক্ষণ রাইফেল হাতে এখানে-সেখানে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায় যেন শিকারের খোঁজে। সে অশিক্ষিত, তার অযোগ্যতা অনেক, শিক্ষিত সমাজে সে বেমানান, কিন্তু সে যে দক্ষ শিকারী তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। শিকারী হিসেবেই তার পরিচিতি হোক। কাঁধে হেলান দিয়ে রাখা হাতে-ধরা রাইফেলের মধ্যে সে ফিরে পায় তার অজানা আত্মবিশ্বাস। তার বাবা জানতে চাইলে ছলনা করে বলে, নদীর পারে একটা চিতা বাঘ দেখা গেছে, তাকে মারার চেষ্টা করছে। হুঁ, ওস্তাদ শিকারী না সে?
একদিন রাইফেল হাতে কালীর বাড়িতে ঢুকতে যাবে, সেসময় কালী ও ব্রজরাণী-র কথা শুনে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। জানতে পারে, কুচক্রী শঠ মিথ্যাবাদী কালী চাকরী নিয়ে সস্ত্রীক কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার মতলব আঁটছে। এবং একই সাথে কালী অনন্ত-র দুর্ভাগ্যের জন্য মেকি দুঃখ প্রকাশ করছে। কালীর বাড়িতে না ঢুকে সে বনে নদীর পারে গিয়ে বসে। পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলো পড়েছে নদীর জলে। সেখানে (রাইফেল হাতে) কাটায় সারা রাত। ক্যামেরা স্ট্যাটিক লং শটে অনন্ত-র ছায়ামূর্তিকে ধরে রাখে। চমৎকার শট! অপরূপ সাজে সজ্জিত প্রকৃতির প্রান্তে বিভ্রান্তির অন্ধকারে বসে আছে বিচ্ছিন্ন মানুষ নিজের ছায়া হয়ে।
অনন্ত-র দূষিত অন্তর্জগতের আলোড়ন, চিন্তায় ভারাক্রান্ত অবস্থা, তার সন্দেহ অকাট্য সত্যি বলে প্রমাণ হওয়ার ব্যাপারে পূর্বাশঙ্কা – গভীরভাবে ব্যঞ্জনাময় কয়েকটি শটের ভিতর দিয়ে রূপায়িত করেছে ক্যামেরা। নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে ক্যামেরা অনন্ত-কে চোখের আড়াল হতে দেয় নি – তার পিছু পিছু ঘুরেছে তার ক্রম-অবক্ষয়ের প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্্য্যায়ে। তার প্রতিটি মুড-কে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিয়েছে আমাদের। বস্তুত, এ ছবির দুই auteur: ক্যামেরা এবং অনন্ত-র ভূমিকায় বিকাশ রায়ের অভিনয়। চরিত্র সৃষ্টি করেছেন বিকাশ রায়, তাঁর সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করেছে ক্যামেরা।
ভোরে কালীর বাড়ি যায় অনন্ত। কালী ঠাট্টা করে বলে, সারা রাত থেকেও শিকার পেলে না!
হঠাৎ মীনা নিজের বাপের বাড়ি থেকে জমিদার বাড়িতে এসে হাজির। অনন্ত খুব খুশি, সে মীনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু মীনা আবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, সে-ই মিথ্যা চিঠি লিখে কালীর সাথে তার বিয়ে ভণ্ডুল করেছে। এই (আমাদের জ্ঞাতসারে) প্রথম অনন্ত মদ্যপান করে। মীনাকে চাবুক দিয়ে মারে। মীনা ফিরে যায় নিজের বাড়িতে।
অনুশোচনার তাড়নায় অনন্ত যায় মীনার বাড়িতে। মীনা তাকে তাড়িয়ে দেয় এবং বেরোবার পথে এবার মীনার বাবা তাকে চাবুক পেটা করেন। বলেন, “মাতাল, মূর্খ, জানোয়ার। আমার মেয়ের সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছ।“ অনন্ত শরীর পেতে দেয় চাবুকের মুখে। বাধা দেয় না। ক্রোধের অসহনীয় নিপীড়ন সত্ত্বেও কেন সে এই সংযম বোধ দেখাচ্ছে? এ কি অনন্ত-র চরিত্রের হীনমন্যতার সূক্ষ্মতম প্রকাশ?
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে পায়চারি করতে করতে অনন্ত বিচার করে কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়। এতো অপমান কেন সহ্য করতে হবে তাকে? লোকের চোখে সে এতো নগণ্য হয়ে গেলো কি করে? আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে চাবুকের আঘাতে তৈরি গভীর ক্ষত হাত বুলিয়ে অনুভব করে। তার ভারী নিঃশ্বাস, ভ্রূকুঞ্চন, চোখের চাহনির মধ্যে ভয়াবহ ইঙ্গিত। জীবনের পরিবেশ আর অতি-পরিচিত ভালোবাসার মানুষের বেইমানি তার মনকে কলুষিত করেছে। সে ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো নানা রকমের রাইফেলের একটা হাতে তুলে নি্যে শটের ফ্রেম থেকে প্রস্থান করে। আশংকা হয় সে বেপরোয়া কিছু করতে চলেছে।
না ছবিতে আছে রহস্যময় মনুষ্যপ্রকৃতির – দুই অপরাধীর - মানচিত্র । ছবির চমকপ্রদ উপসংহারে ব্রজরাণীর ক্ষমা পাওয়ার পরেও অবক্ষয়িত অনন্ত-র ভবিষ্যত নিশ্চিতভাবে জানতে পারি না আমরা। সমাজে আর হয়তো ফেরা হবে না তার, কিংবা, তার যা পরিচয় আমরা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে মনে প্রশ্ন জাগে, তার মতন মানুষ কি আর ফিরে আসতে চাইবে? না George Buchner-এর নাটক অবলম্বনে তৈরি Werner Herzog পরিচালিত Woyzeck (১৯৭৯) এবং আদুর গোপালাকৃঞ্চান পরিচালিত Vidheyan-এর (১৯৯৪) মতনই মনস্তাত্ত্বিক ছবি (বোধহয়, না-র পরিচালকের অজান্তে)।
আমার মতে, বিকাশ রায়ের অভিনয়দক্ষতা প্রমাণ করার উপযুক্ত বাহন হয়েছে এই ছবি। সুচিন্তিত, পরিণত তাঁর অভিনয়। মেলোড্রামাটিক আ্তিশয্য বাদ দিয়ে চোখের দৃষ্টি ও মুখের ভাবের মধ্য দিয়েই তিনি অভিব্যক্ত করেছেন অন্তর্মুখী চরিত্রের দুর্বোধ্য অনুভূতি। প্রশংসনীয় পরিমিতিবোধ, তাঁর তরতাজা অভিনয় আর সিনেমাটোগ্রাফিতে আধুনিকতার ছাপ - শিল্পকর্মটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
তিন/ নরেন
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রিয়ালিজম-এর যুগে মেলোড্রামাকে সেকেলে, জরাজীর্ণ genre বলে ফিল্ম সোসাইটির উদ্যমী যুবকেরা বিনাশ করার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা বড় সত্যকে অস্বীকার করেছিলেন - মেলোড্রামার অন্যতম বড়ো অবদান হচ্ছে, মেলোড্রামা চিরকালই সমাজের ব্যাধিগুলোকে পুরোভাগে রেখে গল্প বেঁধেছে, প্লট তৈরি করেছে।
সুশীল জানা-র গতিময় সূর্যগ্রাস গল্প অবলম্বনে ছবি অনুপমা-তে ‘সামাজিক’ মেলোড্রামার যাবতীয় উপকরণের বাহুল্য থাকলেও ছবির বক্তব্যের সারমর্ম প্রগতিবাদী, আধুনিক। আছে রিয়্যালিজম-এর ছোঁয়া। সমসাময়িক সামাজিক আচারে রক্ষণশীলতা এবং সমাজে নারীর ভূমিকা সম্বন্ধে চিরাচরিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরের সময়ের পটভূমিকায় লেখা গল্প কলকাতার এক দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে: এম.এ. পাস করা সবার বড়ো বেকার ছেলে অবনী (তখনও স্টার না-বনে-যাওয়া উত্তমকুমার), বড়ো মেয়ে বাল্য-বিধবা কল্যাণী (অনুভা গুপ্তা) যে টাইপিং শিখছে, মেজো মেয়ে ম্যাট্রিক ফেল করা অবিবাহিত শান্তা (যমুনা সিংহ), আরো একটি নাবালিকা মেয়ে, নাবালক ছেলে, ও তাদের সবার মা (সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়) আর এককালের-আদর্শবাদী-এখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবনতিতে হতাশ স্কুলশিক্ষক বাবা (জহর গাঙ্গুলি) যিনি সংসারে একমাত্র রোজগারী মানুষ।
স্ত্রীজাতির ব্যাপারে মা-র রক্ষণশীল মূল্যবোধ যুদ্ধের পরবর্তীকালের ব্যাপক বেকারত্বর বাস্তবতায় অকেজো। স্বামী রিটায়ার করার পরেও কল্যাণীকে টাইপ শিখে চাকরি নিতে দেবেন না, এমনকি বড়ো ছেলে অবনী চাকরি না পেলেও। অথচ, সংসার এখন কি করে চলবে তা নিয়ে দিনরাত্রি স্বামীকে উত্যক্ত করে মারছেন।
অবনী যে চাকরির তেমন চেষ্টা করে তা না। সে এদিকে সুধা (সাবিত্রী চ্যাটার্জী) নামে এক বাপ-মা মরা মেয়ের সাথে প্রেম করে ও চাকরি-বাকরি পেয়ে থিতু হলেই তাকে বিয়ে করবার পরিকল্পনা।
বাবা-র এককালের প্রিয় ছাত্র ও অবনীর বন্ধু সমাজতন্ত্রবাদে বিশ্বাসী, নিজের অফিসের ‘সোসালিস্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর সেক্রেটারি কল্যাণীর প্রতি আকৃষ্ট স্থিতধী যুবক নরেন (বিকাশ রায়) এই পরিবারের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ। এ-বাড়িতে তার অবাধ আসা যাওয়া। ক্ষ্যাপাটে অবনী, ঘ্যানঘ্যান-করা মা, রক্ষণশীল পরিবারে পুরুষ-হয়ে-জন্মায়-নি বলে মনস্তাপে পীড়িত কল্যাণী – এদের সবার মধ্যে একমাত্র দৃঢ়মতি চরিত্র নরেন।
বিকাশ রায়ের ঋজু অঙ্গবিন্যাস, বলিষ্ঠ উচ্চারণ, উদ্দীপনাময় বাচনভঙ্গি, দীপ্তিপূর্ণ চোখের দৃষ্টি নরেনের চরিত্রকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। নরেনের আন্তরিকতা, নির্ভীকতা, অকপটতাকে সন্দেহ করার উপায় নেই। সে ছেঁদো কথা তো বলেই না, সারগর্ভ কথা বলে কিন্তু সে কথার বা প্রচারের সাথে তার কর্মজীবনের কোনো অসঙ্গতি নেই। তাই বলে চরিত্রটিকে মহিমানবাইত করার চেষ্টায় নরেনের প্রতি ক্যামেরার পক্ষপাতিত্ব নেই – প্রায় পুরো ছবিই তৈরি ওয়াইড (wide) ফ্রেমের মিডিয়াম শটে (কল্যাণীর একার কয়েকটি মিডিয়াম ক্লোজআপ শট বাদে - যার বিষয়গত তাৎপর্য আছে)।
অবনী বাবার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা দিয়ে দর্জির দোকানের ব্যবসা খোলে। পরিকল্পনা, কল্যাণী ও শান্তা-কেও ব্যবসায় সে কাজে লাগাবে (“ফ্যামিলি বিজনেস”)। নরেন তার বন্ধুর দৌড় কতোদূর তা ভালোভাবেই জানে। বন্ধুকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবনী বলে, “তুই মাছি মারা কেরানি। তুই এসবের কি বুঝবি?”
অবনীর ব্যবসা ‘ফেল’ করে অচিরেই। নরেন তার মাস্টারমশাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, প্রাচীন কুসংস্কারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে নারীর ভূমিকা বাড়ির মধ্যেই সীমিত রাখলে চলবে না, তাকে স্বাধীনতা দিতে হবে, পুরুষের সমান অধিকার তার জন্মগত অধিকার। মেয়েমানুষের চাকরি করার মধ্যে অন্যায় কি আছে? মাস্টারমশাই বলেন, না, মেয়েদের মনের জন্মগত দুর্বলতা তারা কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
তারপর স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু হওয়ায় সংসারের আর্থিক অবস্থা এমন হয় যে নরেনের কাছে টাকা ধার করে ঘরের ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর মুখে ভাত যোগায় অবনী। কল্যাণীর মায়ের তীব্র প্রতিবাদের দাপট সত্ত্বেও নিজের অফিসে কল্যাণীকে টাইপিস্টের একটা অস্থায়ী কাজ যোগাড় করে দেয় নরেন। মা বলেন, কেন, কাজটা ছেলে অবনী করুক না।
নরেন বলে, ছুটি-নেওয়া এক মেয়ে টাইপিস্টের কাজেই দুমাসের জন্য আর একজন মেয়ে টাইপিস্ট চাইছে অফিস।
হাসিমুখে চাকরি করতে লেগে যায় কল্যাণী। অবশেষে সংসারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফিরে আসে। পুরুষের চাইতে সে কম কিসে?
কল্যাণী বাল্যবিধবা, শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী তার পুনর্বিবাহের প্রশ্নই ওঠে না। নরেনের সাথে কল্যাণীর মেশামেশি দেখে মা-র সন্দেহ হয় দুজনের নিশ্চয়ই প্রেম চলছে। ছোট মেয়ে শান্তাকে তিনি নরেনের পিছনে লাগিয়ে দেন – শান্তা নরেনের সাথে ঢলাঢলি শুরু করে দেয়।
কল্যাণীর মাইনে বাড়ে, চাকরি স্থায়ী হয়। সে সংসারের ভোল পাল্টে দেয় – বাড়ি সাজায়, সবাইকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেয়। সুযোগ পেয়ে অবনী চাকরি খোঁজার ব্যাপারে আরো ঢিলে দেয়। হঠাৎ একদিন সুধাকে বাড়িতে নিয়ে এসে বলে সুধা তাদের বাড়িতেই থাকবে, তারা বিয়ে করবে। নরেন অবনীর মা-কে রাজি করে, বিয়ে হয়।
এবার অবনী নরেনকে অনুরোধ করে কল্যাণীকে বিয়ে করতে – সংসারের জন্য বোনটা নিজের সুখ আর কতদিন বিসর্জন দেবে? নরেন বলে, কল্যাণীকে বিয়ে করে জেনেশুনে সে তাদের সংসারের আর্থিক সর্বনাশ করতে পারবে না। কল্যাণীর মা-ও মেয়েকে স্পষ্ট ভাষায় মনে করিয়ে দেন যে, বিধবা মেয়ে আবার বিয়ে করতে পারে না। শান্তাকে বিয়ে করুক নরেন। তাছাড়া, কল্যাণীর বিয়ে হলে সংসার ভেসে যাবে – মেয়ে এতো স্বার্থপর হয় কি করে!
মা-কে কল্যাণী কথা দেয় সে সংসারের জন্য নিজের সব আহ্লাদ-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দেবে, নরেনের থেকে দূরে সরে যাবে। নরেনকে বলে, তাকে ভুলে গিয়ে শান্তাকে বিয়ে করতে – “আমি নতুন মানুষ নরেনদা, আমি নতুন রূপ দেবো জীবনকে, সবার জীবনকে।“ ‘সবার জীবনকে’? কল্যাণী নিজের সুখ-দুঃখের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে সংসারের বাকি সবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে। নরেন জানিয়ে দেয়, সে কখনোই কল্যাণীকে ছেড়ে শান্তাকে বিয়ে করতে পারবে না।
কল্যাণী কিন্তু নরেনকে এড়িয়ে চলে। আর শান্তা, মায়ের মতলব অনুযায়ী নরেনকে প্রণয়পাশে বাঁধার সবরকম প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
এরপর নানা ভুল বোঝাবুঝি, স্বার্থপরতা আর ঈর্ষার করণে সংসার প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। উপরন্তু, কল্যাণীর অফিসের মালিক কর্মীদের গণ-ছাঁটাই করার পরিকল্পনা ঘোষণা করার ফলে কর্মী ইউনিয়ন ধর্মঘট করে। কল্যাণী ছাড়া সবাই যোগ দেয় ধর্মঘটে। চুপ করে প্রতিদিন সে কর্মীদের ধিক্কার শোনে।
কল্যাণীর ব্যবহারে বিভ্রান্ত নরেন তাকে একদিন অফিসের বাইরে পাকড়াও করে কল্যাণীর কাছে আবেদন জানায় - অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করতে হবে, কল্যাণী এভাবে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা বাঁচার লড়াই করতে পারবে না। নরেনের (অভিনেতা বিকাশ রায়ের) কণ্ঠস্বরে অচঞ্চলতা, গভীরতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন তাঁর মনের বিশুদ্ধতা ও গভীর জীবনবোধ। নরেনের ভাবমূর্তি আরো দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায় হয় বিকাশ রায়ের অভিনয়ের মাধ্যমে।
ছাঁটাইয়ের লিস্ট বেরোয়, সবার প্রথমে কল্যাণীর নাম।
মালিক অকস্মাৎ মনস্থির করে যে, সে ছাঁটাই-য়ের নোটিশ তুলে নেবে।
মালিক কল্যাণীকে তার হয়ে ইউনিয়নের নেতা নরেনের সাথে নিকট সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ধর্মঘট বন্ধ করার মতলব করে। কল্যাণী রাজি হয় না সে-প্রস্তাবে। মালিক ছাঁটাই-এর নোটিশ তুলে নেয়, সব কর্মীকে কাজে ফিরিয়ে নেয় একমাত্র কল্যাণী ছাড়া।
ছবির ক্লাইম্যাক্স ঘটে পরপর কয়েকটি নাটকীয় আচমকা ঘটনার মধ্য দিয়ে: সহ্যসীমার শেষে পৌঁছে কল্যাণী ঠিক করে সে সংসার ছেড়ে চলে যাবে; নরেনের পিছনে অতো ঘোরাঘুরির পরও নরেনকে কিছুতেই বশে আনতে পারবে না বুঝতে পেরে শান্তা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়; অফিসের কর্মীদের নিয়ে এসে কল্যাণীর পথ আটকে হাতজোড় করে দাঁড়ায় নরেন। “আমি এসেছি তোমার চারশো সহকর্মীর মনের ও বুকের সাহস নিয়ে। আমাদের দুঃখ-দুর্দিনে তোমার সবটুকু স্বপ্ন, সবটুকু সাধ দিয়ে গড়ে দাও সেই ঘর যেখানে শান্তার অপঘাত থাকবে না, তোমার এই তিল তিল অপমৃত্যু থাকবে না, তোমার জীবন-জোড়া বঞ্চনা থাকবে না, অবনীর এই ব্যর্থতা থাকবে না। দাও কল্যাণী গড়ে দাও সেই ঘর যার জন্য মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছে।“ নরেনের আকুতিপূর্ণ আবেদনে আন্তরিকতা, ভালবাসা ও মানবিকতার দাবি। অনুভব করি তার মাধুর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বরের উত্তাপ। এ-ডাকে সাড়া না দিয়ে কল্যাণী চলে যাবে কি করে?
নরেন মোটেও cardboard চরিত্র নয়। বিকাশ রায়-এর নরেন রক্ত-মংসের মানুষ। নরেনের মতাদর্শ তাকে পথের হদিশ পাইয়ে দিয়েছে যার অভাব আমরা লক্ষ্য করি অবনীর চরিত্রের মধ্যে।
১৯৪৭-এর পরেই দেশের ভগ্ন অর্থনৈতিক অবস্থার কবলে পড়ে যুবসমাজের রাজনৈতিক জাগরণ, গণবিক্ষোভ, এবং নারীজাতির স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতনতা – ইতিহাসের এই বিশেষ অধ্যায়ের পটভূমিকায় তৈরি ছবি অনুপমা। অতীতের সনাতন ও নূতন যুগের নূতন মূল্যবোধ নিয়ে ১৯৫০-এর দশকের নবীন প্রজন্মের মানসিক বিভ্রান্তি এবং তার একটিকে বেছে নেওয়ার অধুনা সংগ্রাম নরেন আর কল্যাণীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়েছে।
ছবি শেষ হয় নূতন যুগের শহর কলকাতার রাস্তায় শ’য়ে শ’য়ে মানুষের মিছিল দিয়ে।
অনুপমা-র আগে অনুভা গুপ্তা আর বিকাশ রায় (কখনো নায়ক-নায়িকা রূপে) একসাথে বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছিলেন। যেমন, আভিজাত্য (১৯৪৯), অনন্যা (১৯৪৯), রত্নদীপ (১৯৫১) ও জয়দেব (১৯৫৪)। দুই শিল্পীর সুন্দর বোঝাপড়ার জাদুবলে দুজনেই অনুপমা-তে আপন আপন চরিত্রে সার্থক অভিনয় করেছেন।
ঋত্বিক ঘটক-এর মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) আর সত্যজিৎ রায়-এর মহানগর (১৯৬৩) বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুটি সেরা শিল্পকর্ম। অনুপমা ১৯৫৫ সালের ছবি। ছবির শৈল্পিক মান ঐ দুটি ছবির তুলনায় অনেক নীচু। তবে, এ-ছবির মানবতা মন ছুঁয়ে যায়, মনকে নাড়া দিয়ে সজাগ করে তোলে।
কিন্তু, শুধু পুরুষশাসিত সমাজে নারীর পরাধীনতার নগণ্য রূপ এই ছবিতে দেখতে পাই, তার বেশি কিছু না। নরেনের আদর্শবাদ কল্যাণী আর তার সংসারকে ভবিষ্যতে কোন অবস্থার মধ্যে ফেলবে তা আন্দাজ করা যায়। মেঘে ঢাকা তারা আর মহানগর নারী- স্বাধীনতার বিষয়কে আরো পোয়েটিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়ে ও রিয়্যালিস্টিক ফর্ম ব্যবহার করে উপস্থিত করেছে।
চূড়ান্ত বিচারে, অনুপমা বাংলা পপুলার মেলোড্রামাটিক ছবির বিষয়বস্তুতে আধুনিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেও পরিশেষে নারীজাতির কাঁধেই দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে – নরেনের শেষ আবেদনে যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চার/ দেবকমল
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাট দশকের উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন-অভিনীত বাংলা পপুলার রোম্যান্টিক মেলোড্রামার একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সমালোচক-গোষ্ঠী এ-দুই দশকের শিরোনাম দিয়েছিলো ‘উত্তম-সুচিত্রা-র দশক’। ১৯৪৭-এর পরবর্তী যুগের প্রজন্মের বাঙ্গালীর কাছে এই দুই অভিনেতার হলিউড-অনুপ্রাণিত রোম্যান্টিক ছবির সংবেদন এবং তার সাথে আবেগপূর্ণ একাত্মতা এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাঙ্গালীর মানসজগতে ও মননে এঁরা হয়ে উঠেছিলেন আদর্শ বঙ্গনারী এবং আদর্শ ও নীতিবাদী বাঙ্গালী পুরুষের বাস্তবায়িত রূপ। বিকাশ রায়ের ৭৩-তম ছবি জীবনতৃষ্ণা এ-যুগেরই।
‘উত্তম-সুচিত্রা’ যুগের রোম্যান্টিক মেলোড্রামার আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভয়ালসুন্দর ভিলেন যে আগেকার যুগের দ্ব্যর্থহীন মামুলী ভিলেনের থেকে একেবারেই আলাদা। অতীতে ভিলেন ক্যামেরার সামনে নিজেকে জাহির করতো, নিজের শয়তানির বড়াই করতো। যেমন, Peter Brooks তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে:
নতুন যুগের ভিলেন হলো এমন এক প্রতিপক্ষ যার সহজাত প্রবৃত্তিসুলভ গভীর মানবতাবোধ মানুষকে আকর্ষণ করে, তবে একই সাথে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তার জাত-ক্রোধ তাকে বিপথগামী করে। ক্রোধান্ধ সে তার চারপাশের মানুষের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করার স্পর্ধা রাখে।
১৯৫৭ সালের ‘সিরিয়াস’ রোম্যান্টিক মেলোড্রামা জীবনতৃষ্ণা-য় (মূল কাহিনী: আশুতোষ মুখোপাধ্যায়) বিকাশ রায় এমনই এক কুটিল ভিলেন। প্রায় দশ বছর ধরে আদর্শহীন বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, আভিজাত্যের অহংকারে অন্ধ যুবক বা নির্দয় অত্যাচারীর – ভুলি নাই (১৯৪৮), রত্নদীপ (১৯৫১), জিঘাংসা (১৯৫১), বিয়াল্লিশ (১৯৫১), ঢুলি (১৯৫৪), সূর্যমুখী (১৯৫৬) ইত্যাদি, এবং নায়কের (রোম্যান্টিক বা অ্যান্টিহিরো) – অভিযাত্রী (১৯৪২), মা ও ছেলে (১৯৫৪), না (১৯৫৪), ছেলে কার (১৯৫৪), অনুপমা (১৯৫৫), দুই বোন (১৯৫৫) ইত্যাদি – ভূমিকায় কাজের মধ্য দিয়ে তিনি যে সিনেম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, তাতে ইতি টানলো জীবনতৃষ্ণা-য় দেবকমল চরিত্র। বিগত দশ বছরে রকমারি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে যে দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন তাকে পুঁজি করে তিনি রূপ দিয়েছেন দেবকমলের মতন জটিল চরিত্রের।
দেবকমল “অনাথের কাণ্ডারী”। নিজেও অনাথ (শৈশবে তার বিত্তবান বাবা তার মাকে ত্যাগ করেছিলেন মা অশিক্ষিত হওয়ার দোষে), ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছে, খাবারের জন্য নিজের চামড়া কেটে বিক্রি করেছে। দরিদ্রকে নয় দারিদ্র্যকে, বিত্ত নয় বিত্তবান মানুষদের সে ঘৃণা করে। সম্ভব হলে, দরিদ্রের কল্যাণের জন্য, তাদেরকে সে সর্বস্বান্ত করতেও দ্বিধা করবে না । এমনই বিকৃত মানবিকতার মানুষ দেবকমল। প্রাণোচ্ছল কিন্তু তার ক্রোধ তাকে গ্রাস করে। দেবকমলের পরস্পরবিরোধী দ্বৈত নৈতিকতা গোলমেলে। তার মা স্বামী-পরিত্যক্ত হওয়ার পর এক ধনী-গৃহে আশ্রয় পান। সে বাড়ির মেয়ে শকুন্তলা-র সাথে ভাইয়ের মতন বড়ো হয় দেবকমল। আশ্রয়দাতা আর আশ্রিতার পরপর মৃত্যুর ফলে ভাই-বোন অনাথ আশ্রমে আশ্রয় নেয়। ঘটনাচক্রে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, যদিও বড়ো হওয়ার পর দুজনে দুজনকে খুঁজে পায়। স্বাধীনচেতা শকুন্তলা (সুচিত্রা সেন) ছবি আঁকে আর শিক্ষকতা করে নিজের ভরণপোষণ চালায়। দেবকমল চালায় অনাথ আশ্রম। সে শকুন্তলার সাথে থাকে না।
হরনাথ সামন্ত (পাহাড়ি সান্যাল) নামী ও ধনী ডাক্তার, সাতটি বাড়ির মালিক। তার একটিতে ভাড়া থাকে শকুন্তলা। হরনাথের ছেলে রাজনাথ (উত্তমকুমার) ভাড়া আদায়ের ছলে অহরহ শকুন্তলার বাড়িতে হানা দেয়। হরনাথ দেবকমলের সেই নির্দয় বাবা – এ-সত্য দেবকমলের অজানা। তার মা-কে ছেড়ে তাঁর এক রুগীর মেয়েকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন – রাজনাথ তাদেরই সন্তান। এ-সত্য হরনাথ সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন সারাজীবন, এমনকি রাজনাথের কাছ থেকেও (রাজনাথ তার আসল মা-কে ‘মাসি’ বলে জানে)। রাজনাথের পারিবারিক সচ্ছলতা আর আভিজাত্য তার বেশভূষা, হাঁটাচলা, কথা বলার বিশেষ কায়দায় স্পষ্ট ফুটে বেরোয়। যেমন স্পষ্ট বোঝা যায় শকুন্তলার প্রতি তার আকর্ষণ।
(গল্পের খাতিরে) দেবকমল হঠাৎ এসে উপস্থিত হয় শকুন্তলার বাড়িতে। হরনাথের বাড়িতে কয়েকদিন যাতায়াত করার পর দেবকমল বুঝতে পারে যে হরনাথ প্রচুর টাকা ও সম্পত্তির মালিক। চাইলে তিনি বহু অনাথের সংস্থান করে দিতে পারেন। দেবকমল শকুন্তলাকে বলে রাজনাথ-কে বিয়ে করতে। শকুন্তলা তার এই প্রস্তাবের কারণ জানতে চাইলে দেবকমল বলে, কারণ, রাজনাথের বিশাল সম্পত্তি। ছবি এঁকে আর শিক্ষকতা করে যে সামান্য রোজগার করে তাই দিয়ে শকুন্তলা তো সারাজীবন ভালোভাবে থাকতে পারবে না। রাজনাথকে বিয়ে করলে সচ্ছল জীবন কাটাতে পারবে।
এমনকি, একদিন দেবকমল হরনাথ সামন্তকে স্পষ্টভাবে বলে বসে, “আপনাদের এতো টাকা থাকবে কেন?”
সেটাকে দেবকমলের ঈর্ষাকাতরতা ভেবে হরনাথ উপহাসের সুরে উত্তর দেন, “বেশ, তাই যদি তোমার মনে হয় তো একদিন এসো, সব ভাগ করে দেবো।"
দেবকমলের প্রত্যুত্তরে বিদ্বেষ, “ভিক্ষা চাইতে আসি নি।"
প্রাণচঞ্চল সজীব সংবেদনশীল দেবকমলের ব্যক্তিত্বের আর একটা দিক দেখে শকুন্তলার মতনই চমকে উঠি আমরা – সে শীঘ্রই হরনাথ আর রাজনাথ-বিদ্বেষী কুচক্রী হয়ে ওঠে। তার চলাফেরায় ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত। শকুন্তলা দেবকমলের মতন না – সে পুরানো দিনের কথা ভুলে গেছে, সে শুধু বর্তমানে বাস করে।
শকুন্তলার প্রতিবেশী বিধবা মেয়ে সবিতা-র (দীপ্তি রায়) মধ্যে দেবকমল খুঁজে পায় তার সহমর্মী। সেই সহমর্মিতা ক্রমশঃ পরিণত হয় দুজনের একে অন্যের প্রতি চাপা আকর্ষণে। অথচ, সবিতাকে দেবকমল কোনোদিনই ভালোবাসার কথা সরাসরি বলতে পারে না। রাজনাথ-হরনাথের আর্থিক সচ্ছলতা দেবকমলের মানসিক বিশৃঙ্খলতার কারণ যা তাকে তাদের ক্ষতি করতে প্ররোচিত করে। তার ব্যক্তিত্বের কোমল দিকটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই প্রবল আবেগোচ্ছ্বাস। ছবির শেষেও দেবকমল আর সবিতার অব্যক্ত প্রেম পরিপূর্ণতা পায় না। ঘটনার স্রোতে কোথায় ভেসে যায় সবিতা আর প্রেম।
হরনাথ অজ্ঞাতবাসে চলে যান।
একসময়ে দেবকমল যখন জানতে পারে যে, হরনাথ সামন্তই তার বাবা যার বেপরোয়া নারী-আসক্তির শিকার হয়েছে সে ও তার মা, তখন সে সামন্তদের সব সম্পত্তি দাবী করে বসে। এমনকি সে রাজনাথের কাছে ফাঁস করে দেয় যে, যাকে রাজনাথ ‘মাসি’ বলে জানে, সে আসলে রাজনাথের মা।
বিনা প্রতিবাদে রাজনাথ তার হাতে তুলে দেয় সব সম্পত্তি। অথচ, সেই দৃশ্যে আমরা দেখি, রাজনাথের কথা না শুনে দেবকমল ঘুমে ঢুলে পড়ছে। কারণ, সম্পত্তির লোভে নয়, সে হরনাথ আর রাজশেখরের উপর শোধ নেওয়ার জন্যই যা করার করেছে।
ছবির শেষ দৃশ্যে, সামন্তদের প্রাসাদে এসে সামন্ত পরিবারের সব চিহ্ন মুছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেয়াল থেকে বংশের সবার ছবি তুলে ফেলার আদেশ দেয় দেবকমল। শুধু, রাজনাথের ছবির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। উপলব্ধি করে, যে ছেলেটির মুখে-চোখে এতো পবিত্রতার দীপ্তি, যার ঔদার্যের দয়ায় আজ সে এই প্রাসাদ দখল করেছে, তাকে সে এতোদিন শত্রু ভেবে এসেছে? সে আরো দেখে যে, সব জানা সত্ত্বেও এমনকি শকুন্তলাও রাজনাথের কাছে চলে এসেছে। সেও তাহলে দেবকমলের ব্যবহারে রুষ্ট। আক্রোশের বশে বোধশক্তি হারিয়ে যে মানুষ চরম ভুল করতে চলেছিলো, সে অবশেষে পরাজয় স্বীকার। সবার অগোচরে সামন্তবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় রাজনাথের মায়ের কাছে। তিনি তাকে সস্নেহে আমন্ত্রণ জানান।
যেতে পারে না দেবকমল। বোধকরি, এবার সে সবিতাকে খুঁজে বের করে আপন করে নেবে এবং তার বিক্ষুব্ধ জীবন পরিপূর্ণতা পাবে।
জীবনতৃষ্ণা-য় উত্তমকুমারের মুখ্যত নায়কোচিত প্রেমকাতর অভিনয় দেবকমল-রূপী বিকাশ রায়ের সাবলীল, বহুমাত্রিক – দরদী, কঠোর, শাণিত - চরিত্রায়ণের তুলনায় গৌণ হয়ে গেছে।
জীবনতৃষ্ণা-য় তাড়িত দেবকমল-ই ছবির আসল হিরো।
পাঁচ/ রাজশেখর
সূর্য্য তোরণ-এর (১৯৫৮) গল্প (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) সে-যুগের রেওয়াজ-অনুযায়ী উত্তম-সুচিত্রা জুটির জন্য ‘বানানো’ (‘manufactured’) গল্প। কিন্তু, প্রাসঙ্গিকতার কারণে, এই আলোচনা ছবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রাজশেখর-কে (বিকাশ রায়) ঘিরেই করা হবে।
রাজশেখর-এর শৈশব-স্মৃতি দেবকমলের স্মৃতির মতন বেদনাবহ, তিক্ততায় ভরা। কলকাতার বস্তিতে কেটেছে তার ছেলেবেলার প্রথমটা। বস্তির মালিক কলকাতার নামকরা আর্কিটেক্ট ক্ষমতালোভী মিঃ চ্যাটার্জি (কমল মিত্র) তাদের - রাজশেখরকে আর তার মা-কে - বস্তি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সময় বাচ্চা ছেলে রাজশেখর প্রতিবাদ করাতে চ্যাটার্জির সাগরেদরা তাকে জেলে পোরে। কারাবাসের পর ফিরে এসে সাবালক রাজশেখর তার মা-র মৃত্যুর খবর পায়। বহু বছর পর সে আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার এক প্রতিষ্ঠিত অতি-আত্মম্ভরি শিল্পপতি রূপে। আজকের যে রাজশেখরকে আমরা দেখি সে শান্তপ্রকৃতির কিন্তু তার ব্যবহারে স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব, সে ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব করে প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়, তার ধারালো কথাবার্তায় প্রচ্ছন্ন ধূর্ততা। তার বোধ গূঢ় যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিজের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সে যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না। দৃঢ়প্রত্যয়ী বিবেকদংশনহীন মানুষটির কোনো বন্ধু নেই। বিষাদগ্রস্ত রাজশেখর রিভলভার নিয়ে খেলে।
ছবির শুরুতে সামনাসামনি তার দেখা পাই না আমরা। কয়েকটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের দৃশ্যে তার off-frame গলার স্বর শুনতে পাই, দেখি শটের ফ্রেমের foreground-এ তার রিভলভার-ধরা হাত। বস্তির লোকেশানে আরেকটি ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যে (রাজশেখর আর তার মা-কে বস্তি থেকে উচ্ছেদ করার দৃশ্য) ফ্রেমের foreground-এ বাঁদিকে তার ক্যামেরার দিকে পিছন-করা স্যুট-পরা শরীরের ডান অংশ দেখি মাথা থেকে কোমর অবধি, কোমরের পাশে সেই তার রিভলভার-ধরা হাত। ছবির প্রারম্ভিক পর্যায়ে এরকম কিছু প্রায়-দুর্বোধ্য শটের মধ্যে কিসের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে তা বোঝা যায় না, তবে এটুকু আন্দাজ করা যায় যে লোকটা হয়তো এমন কোন গুপ্ত চক্রের মাথা যেটা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যিক ক্রিয়া-কর্ম আর ধনী-সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ ও একায়ত্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরে যখন ছবিতে রিভলভার-ধারী রাজশেখরের আবির্ভাব ঘটে তখন তার ক্রিয়াকলাপ-কথাবার্তাতে ধরতে পারি যে, এই মানুষটার যে-সামান্য পরিচয় আমরা আগে পেয়েছি সেটা তার সম্পূর্ণ পরিচয় নয়।
সোমনাথ (উত্তমকুমার) মেধাবী আর্কিটেক্ট, নিজের মনে থাকতে ভালোবাসে। আর্কিটেক্ট হিসাবে সে মৌলিক কাজ করতে চায়, কারুর পরিকল্পনা মতো ডিজাইন সে করে না। তার আপোষহীনতার জন্য ন্যায্য পেশাগত সাফল্য পায় না সে। কলকাতা শহরে চাকরি না পেয়ে সে শ্রমিকের কাজ করতে মফঃস্বলে চলে যায়।
অনীতা (সুচিত্রা সেন) মিঃ চ্যাটার্জির একমাত্র মেয়ে। অনীতা সমাজসেবী, সে শহরের শোষিত মানুষদের হয়ে আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখে। বাবা-কে বলে, “আচ্ছা বাবা, তুমি তো এতো বড়ো একজন আর্কিটেক্ট। পারো না ওই বস্তিটা ভেঙ্গে ফেলে এমন একটা কিছু গড়তে যাতে ওখানকার লোকগুলো মানুষের মতো বাঁচতে পারে?”
মিঃ চ্যাটার্জি তাকে জানান যে, বস্তির জমিতে রাজশেখরেরও ভাগ আছে।
অনীতা রেডিয়ো-শিল্পীও বটে। একদিন রেডিয়োতে এক লম্বা-চওড়া বিবৃতিতে সে বলে, “এ যুগে সুখ-সম্পত্তির জন্য বিজ্ঞানের ভাবনার শেষ নেই। … টেলিভিশনের মারফতে এক দেশের সাথে আর এক দেশের বন্ধুত্ব ঘটিয়ে দিচ্ছে দূরত্বকে জয় করে। সেই যুগেই জব চার্ণকের স্বপ্ন এই কলকাতা শহরকে” এখনও এক উপনিবেশ করে রেখেছেন “একদল স্বার্থপ্রণোদিত মুখোশধারী। আজ শুধু তাদেরই আত্মলোভী জঘন্য মনোবৃত্তির” শাপে এই মহানগর-এর বহু মানুষ বাধ্য হয়ে বস্তিবাসী হয়েছে। এসব বিবৃতি তার বাবা - যার নিজের কোম্পানির আর্কিটেক্টরা স্বাধীন দেশের কলকাতা শহরকে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর হিসাবে গড়ে তুলছে এবং আরো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষকে আশ্রয়হীন করে ছাড়ছে – নিতান্ত বাগাড়ম্বর ছাড়া বেশি কিছু মনে করে না।
ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে অনীতা আর সোমনাথের পরিচয় হয়। পরবর্তী কালে অনীতা, সোমনাথ আর রাজশেখরের একে অন্যের সাথে পরিচয় হওয়া, তারপর প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনের স্বার্থে তিনজনের অস্বচ্ছন্দ মিত্রতা এবং পরিশেষে অনিবার্য সংঘর্ষ – এই নিয়ে ছবি সূর্য্য তোরণ।
অনীতার ইচ্ছা বস্তি ভেঙ্গে ফেলে এক বাসস্থান তৈরি হোক যেখানে বস্তিবাসীরা ভদ্রভাবে থাকতে পারবে, যার নাম হবে ‘সুর্য্যতোরণ’। ইতিমধ্যে, অর্থলোভী মিঃ চ্যাটার্জির অজ্ঞাতে রাজশেখর তাকে প্রায় দেউলিয়া করে প্রতিশোধ নিয়েছে, নিজেও টাকার পাহাড়ের উপর বসে আছে। তবে তার একটা সাধ এখনো অপূর্ণ আছে। এতো সাফল্য পেয়েছে অথচ তার নিজের বলে কেউ নেই। সে একা। তাই, মিঃ চ্যাটার্জির মেয়ে অনীতার উপর তার বিশেষ নজর। অনীতাকে যেভাবেই হোক সে নিজের সম্পত্তি করতে চায়। কিন্তু, করার কোন সুযোগই আসছে না।
অনীতার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার নাটকীয় দৃশ্যে রাজশেখরকে দেখা যায় হাতে-ধরা রিভলভার কপালে ঠেকিয়ে তার পেন্টহাউস অফিসের দেওয়ালের এক কোণা থকে আর এক কোণা অবধি চওড়া কাঁচের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে – যে্ নিজের প্রাণ নিতে চলেছে। যেন, অনীতা এসে পড়াতেই তার রিভলভার চালানো হলো না। তবে, যে-সুযোগের অপেক্ষায় সে ছিলো, তা মিললো অবশেষে।
অনীতা ও ধূর্ত রাজশেখরের মধ্যে অলিখিত চুক্তি হয়: সূর্য্যতোরণের তুল্য, শহরের সর্বোচ্চ একটি কীর্তিস্তম্ভ তৈরি করার স্বপ্ন রাজশেখরও দেখতো। তাই, সে সুর্য্যর্তোরণ তৈরির সব অর্থ জোগাবে আর বিনিময়ে অনীতা তাকে বিয়ে করবে। সোমনাথকে – যার আকাঙ্ক্ষা শহরের বুকে খাড়া করবে এমন এক স্বপ্ন-সৌধ যা আধুনিক স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে - রাজশেখর নিযুক্ত করে সূর্য্যতোরণে আর্কিটেক্ট হিসাবে। সোমনাথের সাথে মৈত্রী করে এইভাবে: “জানো সোমনাথ, আমার কোনো বন্ধু নেই। (পিঠে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে) আমার মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে আমার সেই বন্ধুকে আমি খুঁজে পেয়েছি।“
বিবাহ-চুক্তি পাকা করতে অনীতাকে এনগেঞ্জমেন্টের আংটি উপহার পরিয়ে দেয় রাজশেখর। কিন্তু, ক্রমশঃ বুঝতে পারে, তাকে অনীতা ভালোবাসে না। ভালোবাসে সোমনাথকে। (একটি দৃশ্যে অনীতা সোমনাথকে জিজ্ঞাসা করে, “রাজশেখরের হাত থেকে আমাকে মুক্ত করতে পারবে সোমনাথ?”)
পরাক্রমশালী রাজশেখর মানুষের মন পাওয়ার অভিযানে পরাহত। তাহোলে, আর কিছু পাওয়ার নেই জীবনে। এবার তার বিদায় নেওয়ার পালা।
রিভলভারের গুলিতে আত্মনাশী হওয়ার আগে সে অনীতা ও সোমনাথের জন্য টেপরেকর্ডারে টেপ করে রেখে যায় আবেগপূর্ণ ও উদ্দীপনাময় বিদায়বার্তা:
সোমনাথের প্রচেষ্টায় রাজশেখরের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর শহরের সবচেয়ে উঁচু আকাশছোঁয়া অট্টালিকা সূর্য্যতোরণ মাথা তুলে দাঁড়ায়। সূর্য্যতোরণের উদ্বোধনের দিন ভোররাতে সোমনাথ ও অনীতা তার ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সূর্য্যোদয় দেখে। অনীতার মনে পড়ে রাজশেখরের কথা। সোমনাথ বলে, “একজনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আর একজন পায় তার আরব্ধ। এই যে তার কীর্তি সূর্য্যতোরণ, এর থেকে সে অনেক উঁচু, অনেক বড়ো।“
ছবিতে যে রাজশেখর-কে দেখি সে কখনও বিষাক্ত সরীসৃপের মতন, কখনও অতৃপ্ত দানব, কখনও পরহিতব্রতী – অথচ, এর কোনটাই বিশ্বাস্যোগ্য নয়। ছবির চিত্রনাট্য (অগ্রদূত) এবং সংলাপ যে-চরিত্রকে প্রথম থেকেই মূলতঃ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখিয়েছে, এমনকি ক্যামেরার angle যার নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব প্রকাশের উপরই জোর দিয়েছে, তার সম্বন্ধে সোমনাথের এই স্তুতিবাক্য সত্যিই আমাদের পক্ষে হজম করা কঠিন।
চিত্রনাট্যের এরকম ন্যারেটিভ বিশৃংখলা (এই প্রকারের অসঙ্গতি তখনকার রোম্যান্টিক ও সামাজিক মেলোড্রামার পরিচিত লক্ষণ ছিলো), পরিচালকের কল্পনাশক্তির অভাব ছবির সর্বনাশ ঘটিয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, চিত্রনাট্যকার সোমনাথ ও অনীতার চরিত্র নিয়ে এতো মশগুল হয়ে ছিলেন যে, রাজশেখর চরিত্রের অতি সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলিকে আবিষ্কার করার সামান্য সুযোগ আমাদের দিয়েও সেটাকে নগণ্য করে ফেলেছেন তাঁর ঘোলাটে আর বিভ্রান্তিকর শৈল্পিক দৃষ্টিকোণের দোষে। রাজশেখর মানুষটির প্রকৃত রূপ কি? কিছু দৃশ্যে তার চরিত্রের সহানুভূতিশীলতা আর ঔদার্য্যের দিক দেখার সুযোগ পেয়েছি, অনুমান করতে পেরেছি যে, সে কেবলমাত্র অসদুপায়ে ধনার্জনই করে নি, পাশাপাশি বস্তিতে তার আনাগোনা ছিলো নিয়মিত, বস্তিবাসীদের আর্থিক সাহায্যও সে করেছে। ছবি প্রতিপন্ন করেছে যে, রাজশেখরের ব্যক্তিত্ব bi-polar। কিন্তু, তাঁর split personality কোন চিকিৎসাযোগ্য (clinical) রোগ নয়।
সূর্য্য তোরণ-এ রাজশেখর চরিত্রের বিশেষ কিছু করার (Action) নেই, আছে অনেক কিছু বলার (Dialog)। তাই বলবো, উপযুক্ত দৃশ্য পরিকল্পনায় দুর্বলতার কারণে রাজশেখরের সংলাপের প্রতিটি শব্দ মন দিয়ে না শুনলে, সংলাপ বলায় সুরের বৈচিত্র্য ও ভাবাবেগের খেলা লক্ষ্য না করলে তার চরিত্রের একদিকে মাধুর্য অন্যদিকে দানবিকতা যা তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে নির্ণয় করে তা উদ্ধার করে যাবে না। রাজশেখর খাঁটি দানব বা আত্মত্যাগী দানবই হোক, বিকাশ রায়ের সুললিত কণ্ঠস্বর, উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও আবেগের উচ্ছ্বাসহীন গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিনয় চরিত্রকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
ছয়/ নবজীবন চক্রবর্তী
‘পঞ্চাশোত্তর কলিকাতা’-নিবাসী এক দুঃস্থ পরিবার নিয়ে শক্তিপদ রাজগুরুর বাঁচোয়া কাহিনী অবলম্বনে রাজেন তরফদার পরিচালিত ছবি জীবন কাহিনী (১৯৬৪)।
জীর্ণ স্যুট-প্যান্ট-টাই-পরা ন্যুব্জ-দেহ বয়স্ক ইন্সিওরেন্স এজেন্ট নবজীবন চক্রবর্তী (বিকাশ রায়) কুকুরের তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে লোহার গেট খুলে বেরিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফুটপাথে ও একদল পকেটমারের হাতে। যে-মুহূর্তে তাদের সাহায্যে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছেন, “কারুর ভালো করতে নেই, বুঝলেন“, সে-মুহূর্তে তারা তার মানি-ব্যাগ গায়েব করতে ব্যস্ত। চায়ের দোকানে চা খেয়ে পয়সা দিতে না পারাতে দোকানের ক্যাশিয়ার গালি-গালাজ করলো।
অন্য খদ্দেররা টিটকারি দিয়ে উঠলো। "সাহেবি পোষাক পরে লোক-ঠকানো?...নিন না দাদা, কোটটা খুলে নিন না।" ক্যাশিয়ারের উত্তর, “ওতে কি হবে? তাও যা গন্ধ।“
নবজীবনের ইন্সিওরেন্স বিক্রি করার উদ্ভট কায়দার এক নমুনা দিচ্ছি।
মক্কেলের নাম কালীকিংকর। তার বউ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছে।
বিতাড়িত হয়ে রাস্তায় পা দিয়ে নবজীবন দেখেন পাঠান পাওনাদার আসছে। উলটো দিকে ছুটে গিয়ে একজন পথচারীর ছাতার তলায় আশ্রয় নিলেন। পথচারী খেঁকিয়ে উঠলো, “চান-টান করেন না নাকি?”
আবার ছুটতে শুরু করলেন নবজীবন, পেছনে ধেয়ে আসছে পাওনাদার।
বাড়িতে ফিরে মেয়ে শ্যামলী-র (সন্ধ্যা রায়) কাছে শোনেন রাত্রে খাবার কিছু নেই। বিড়-বিড় করে বলে চলেন, “মানুষ তো নই, ঘোড়া। তাও হতাম যদি রেসের ঘোড়া – খায়-দায় ভালো, মেজাজে থাকে। আর আমি ব্যাটা, ছ্যাকড়া গাড়ির ফকড়ে ঘোড়া। জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে, তবুও ছুটছি, ছুটছি, ছুটছি…“।
জল খেয়ে শুয়ে পড়েন।
শ্যামলী দিনের বেলায় একা বাড়িতে থাকে – পাওনাদাররা জনে জনে হানা দেয়। আর, ভাড়া বাড়ির মালিকের নচ্ছার নাতি – ভাড়া মকুব করে দিয়ে শ্যামলীর একাকীত্বের সুযোগ নিতে চায়, তার সাথে ছেনালি করে। শ্যামলী একদিন হাতে ধারালো অস্ত্র (মানে, বঁটি) নিয়ে তাকে আক্রমণ করার ভয় দেখিয়ে তাড়ালো।
মেয়ের সাথে সংসারের অভাব নিয়ে নবজীবনের ঝগড়া হয় নিয়মিত। একদিন মাঝরাতে ঝগড়া (নবজীবনের মুখে সেটা গালিগালাজের মতন শোনায়) করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন হাওড়া ব্রিজ থেকে নীচে গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে। সেখানে দেখা হলো এক যুবকের সাথে – সেও জলে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নবজীবন নিজে ঝাঁপ দেওয়ার বদলে ঐ যুবককে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। তাঁর মতলব একটু পরেই পরিষ্কার হয়ে গেলো।
অর্থাৎ, যুবকের নামে নিজেকে বেনেফিশিয়ারি (Beneficiary) করে তিনি ইন্সিওরেন্স পলিসি খুলবেন এবং যুবক মরলে পলিসির ডেথ বেনেফিট নিজে পেয়ে যাবেন।
যুবকের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, “নাম একটা আছে, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অচল…”| নাম তার অমর (অনুপ কুমার)। থাকবার জায়গা নেই, নিজের বলে কেউ নেই এই শহরে।
দুই জীবন্ত অসঙ্গতি – নবজীবন আর অমর, এবং দুয়ের মাঝে স্বাভাবিক অথচ বদমেজাজী ডাগর-ডোগর মেয়ে শ্যামলী। এই তিন স্পর্শকাতর, অপ্রকৃতিস্থ প্রাণীকে ঘিরে ঝাল-মিষ্টি ব্যঙ্গকৌতুকে ভরা আবেগপূর্ণ রুচিকর ট্র্যাজিকমেডি জীবন কাহিনী । ১৯৫৪ সালের ছেলে কার ছবিতে বিকাশ রায় নায়কের ভূমিকায় কমিক অভিনয় করেছিলেন – দেখে মনে হয়েছিলো সেসময় ঐ রোলটিতে তিনি তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। কিন্তু, নবজীবনের চরিত্রে জাঁকালো অভিনয় করেছেন তিনি। এখানে তাঁর কমেডি ভাবলেশহীন (deadpan) নয়, বরং যথাযথভাবে mannered। যেমন mannered কমেডি করতেন অ্যামেরিকান অভিনেতা Jack Lemmon (The Out-of-Towners, Irma La Douce, How to Murder Your Wife)।
মৃত্যুচুক্তিবদ্ধ অমরকে বাড়িতে নিয়ে আসেন নবজীবন, ধারের পয়সায় তার তোয়াজ করেন। রাজভোগ খাওয়ান। FIRPOS-এও খাওয়ান। অমরের আবদার-অনুযায়ী ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
শ্যামলী ওদের গোপন চুক্তির কথা জানেই না। গজর-গজর করতে করতে বাবার নির্দেশ-মাফিক অমরের সেবা-যত্ন করে। জ্যাকপট হিট করেছেন ভেবে নবজীবন আর দুর্গন্ধময় স্যুট পরে বাড়ি বাড়ি পলিসি বা মৃত্যুভয় বেচতে যান না। আজকাল তাঁর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পিঠে চাদর। অপেক্ষা কবে অমরের নামে করা ইন্সিওরেন্স পলিসি কোম্পানির অনুমোদন পাবে।
পলিসি অনুমোদিত হলো, নবজীবন ধারের টাকা থেকে অমর-এর নতুন ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে শুরু করলেন। দৈবাৎ, অমরের আবার বাঁচার ইচ্ছার কথা জানতে পারলেন। ভয় পেয়ে গেলেন। আর, এদিকে অমর যখন-তখন নবজীবনের কাছ থেকে টাকা বাগিয়ে নিচ্ছে। নবজীবন কিন্তু অমরকে তোয়াজ করতেই থাকলেন।
শ্যামলী পড়লো অমরের প্রেমে।
একদিন সকালে অমর উধাও হলো। শ্যামলীর জন্য নতুন শাড়ি কিনে ফিরে এলো।
অধৈর্য নবজীবন অমরের কাছে তার মরার প্রসঙ্গ তোলেন – “কিভাবে মরবে বলে ঠিক করেছো?” ঠিক হলো গঙ্গায় বান আসার সময় স্নান করার জন্য জলে নামবে অমর, দুর্দান্ত শক্তিশালী জোয়ারের ঢেউ বারবার আছড়ে ফেলে তার প্রাণনাশ করবে। পরে তার তালগোল-পাকানো নিষ্প্রাণ দেহ ডাঙ্গায় নিশ্চয়ই ভেসে উঠবে।
বান আসবে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে। অমর মরতে চলে গেলো, আর নবজীবন নিজের বাড়িতে টেবিল-ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। অ্যালার্ম বাজতেই নবজীবন আনন্দে নাচতে আরম্ভ করলেন। অমর কিন্তু মরতে পারলো না, গম্ভীরমুখে ফিরে এলো। হয়েছে কি, ঠিক যখন ও জলে নেমেছে, সেই সময় এক সাধু ওকে চেপে ধরে রেখেছিলো – কিছুতেই অমরকে মরতে দেবে না। হ্যাঁ, অমর হয়তো জোর করে মরতে পারতো, কিন্তু সাক্ষী রেখে আত্মহত্যা করলে ইনসিওরেন্স কোম্পানি যে টাকা দেবে না।
নবজীবন সাফ বলে দিলেন, অবশ্যই, সাক্ষী না রেখে ‘এক চান্সে’ মরতে হবে।
দুজনের এ-ফন্দীও কাজ করলো না।
অমর নতুন প্রস্তাব আনলো, সে ময়দানের মনুমেন্টের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরবে। উৎফুল্ল হয়ে নবজীবন বললেন, “এ যদি পারো তো দেখতে হবে না। অতো উঁচু থেকে মাথাটা নীচু করে পড়লে না তুমি নিজেও বুঝতে পারবে না কি হয়ে গেলো। একেবারে ছাতুর ছাতু।“
মরার ব্যাপারে অমর দ্বিধাগ্রস্ত। অমর আর শ্যামলীর প্রেম জমে উঠেছে।
মনুমেন্ট সার্ভে করার জন্য দূরবীন নিয়ে ময়দানে গেলেন নবজীবন। দূরবীনের ভিতর দিয়ে মনুমেন্টের আশপাশ নিরীক্ষার সময় অমর আর শ্যামলীকে একসাথে বসে হাসাহাসি করতে দেখে ফেললেন।
বাড়ি ফিরে ক্লায়েন্ট অমরকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে শাসালেন, “স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বাঁচার সমস্ত সিম্পটম গ্রো করছে তোমার ভেতরে। তাই মরতে পারছো না। মানুষ বাঁচে কিসে? আকর্ষণ। ঐ মেয়েটার প্রতি তোমার আকর্ষণ হয়েছে।“
নবজীবনের স্বভাবের ছকটা অনেকটা এরকম - নিজের দুঃখ আর বিষণ্ণতা ঢাকতে অসভ্যের মতন চেঁচিয়ে অমরকে, শ্যামলীকে গালিগালাজ করা; মুখে মাঝে-মধ্যেই আচমকা, নিদারুণ-যন্ত্রণাক্লিষ্ট কথার তুবড়ি ছোটা; পরমুহূর্তেই নির্ভেজাল অশ্রুপাত; তারপর, যে-মনোবেদনা তাঁর বিস্ফোরণের কারণ, সেই মনোবেদনার সাময়িক প্রশমন হলে আবার হঠাৎই শান্ত হয়ে যাওয়া। এইসব মুহূর্তে তাঁর মনের বিতরের খবর ঠাওর করতে পারি আমরা। দেখি, জমে আছে তাঁর জীবনের তীব্র হতাশাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। হতাশা তো চোরাবালির মতন – একটু একটু করে গ্রাস করে মানুষকে। স্ত্রী না-খেতে পেয়ে মরেছেন, চিকিৎসার অভাবে ছেলেকে খুইয়েছেন, ভেবেছিলেন অমর মরলে তার পলিসির টাকাটা শ্যামলীর জন্য রেখে যাবেন। সেটা না-হওয়ার ‘সিম্পটম’ কিছু কিছু দেখতে পারছেন। দেয়াল-ঘড়ির পেন্ডুলামের মতন মুডের এমন দোলনের ও আচমকা রূপান্তরের মুহূর্তগুলোতে বিকাশ রায়ের অভিনয় মুগ্ধ করে। আমাদের অতি-পরিচিত অভিনেতার এক নতুন দিক আবিষ্কার করার ব্যাপারটাও সমান আকস্মিক ব্যাপার।
নবজীবনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁর অজ্ঞাতে অমর হকারীর ব্যবসা করছে। শ্যামলী লুকিয়ে তাকে সাহায্য করে, তার জন্য রোজ টিফিন নিয়ে যায়। অমরের আর মোটেও ইচ্ছে নেই মরার। শ্যামলী আর সে একত্রে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে।
একদিন বিকেলে, অমর রোজ যে-সময়ে বাড়ি ফেরে, ঠিক তখন পাড়ায় সোরগোল পড়ে গেলো। মোড়ের মাথায় জনৈক নাকি গাড়ি চাপা পড়েছে। নবজীবন ছুটে গিয়ে দেখতে গেলেন কে গাড়ি চাপা পড়েছে, অমর নাকি? তাহলে তো কেল্লা ফতে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলেন, অমরই আহতকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে!
বাবার মতলব জানতে পেরে শ্যামলী খিঁচিয়ে উঠলো - কি ধরনের মানুষ তুমি! সত্যি-মিথ্যের কোন দাম নেই তোমার কাছে?
হ্যাঁ, নিরুপায় হয়ে জীবনে কতো ছোট কাজ করেছেন নবজীবন। মানুষের মৃত্যুভয়কে পণ্য করে প্রতারণার ব্যবসা করেছন্ন। ঠিক করলেন, অমরের যদি মৃত্যু না হয় তো তিনি নিজেই মরবেন। ক্লায়েন্টের তাড়া খেয়ে নয়। তাছাড়া, অমরই শ্যামলীর দায়িত্ব নেবে।
আফিম কিনে খেয়ে খাটে শুয়ে পড়লেন। এবার মৃত্যু নিশ্চিত।
কিন্তু, অমরের কারসাজি আর আকস্মিক সৌভাগ্যের ফলে মরা আর তার হলো না। আরেকবার মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখে নতুন করে বেঁচে থাকার সুযোগ পেলেন নবজীবন। এবার বেঁচে থাকাটা প্রাণভরে উপভোগ করবেন।
ক্লায়েন্ট কালীকিংকর ঠিকই বলেছিলো - ‘জীবনটা বাঁচবার’।
বিকাশ রায়ের নবজীবন নানা রঙের কারুকার্যে ভরা।
সাত/ অম্বিকা গুপ্ত
শিল্পপতি অম্বিকা গুপ্ত (বিকাশ রায়) আর পুত্র সুব্রত-র (সৌমিত্র চ্যাটার্জি) মধ্যে অসম সম্পর্ক, মূল্যবোধের সংঘাত এবং মানসিক যোগাযোগের অভাব নিয়ে ছবি কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৬। কাহিনী: প্রবোধ কুমার সান্যাল /চিত্রনাট্য: মৃণাল সেন /পরিচালনা: অজয় কর)।
সুব্রত-র প্রতি অম্বিকা গুপ্ত-র ভালোবাসা কোন কোন ক্ষেত্রে ভয়ংকর-রূপে প্রকাশিত হয়। অম্বিকা গুপ্ত ভালোবাসা প্রকাশ করতে অক্ষম। ছেলেকে সম্পূর্ণ নিজের বশে রাখবার স্বার্থে তিনি কঠোরভাবে নির্দয়, নিষ্ঠুর হতে দ্বিধা করেন না। তিনি অবশ্য এটাকেই ভালোবাসা বলে মনে করেন। সফল, ধনী শিল্পপতি অম্বিকা, নিজের ভাষায় “sheer talent, imagination and hard labor” দিয়ে গুপ্ত এন্টারপ্রাইজ নামে এক সাম্রাজ্য গড়েছেন। শহরের সব প্রচার মাধ্যম, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তাঁর হাতের মুঠোয়। নিজের ব্যবসার বেলায় যেমন, তেমনি নিজের বাড়িতেও তিনি সমান স্বেচ্ছাচারী। বাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে সুব্রতকে, তিনি একমাত্র তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কয়েদি করে রাখতে চান। তাদের কাছে শর্তহীন আনুগত্য দাবী করেন।
কাঁচ কাটা হীরে ছবিতে চরিত্রটির রূপদানের মধ্যে যে-অম্বিকা গুপ্ত-কে আমি আবিষ্কার করেছি, এখানে তার কথাই বলছি। তাঁর কাজের সাথে দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতার জন্যই এটুকু হলফ করে বলতে পারি যে, ছবির পর্দায় এ-চরিত্রের স্রষ্টা বিকাশ রায় নিজেই।
কলকাতা বিমানবন্দরে ছবির প্রথম দৃশ্য । কারিগরি বিদ্যাতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়ে সাত বছর পর দেশে ফিরছে সুব্রত। অম্বিকা-র সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ অধীশ্বর সে। তাকে স্বাগত জানাতে এলাহি ব্যবস্থা করেছেন অম্বিকা। ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুপ্ত এন্টারপ্রাইজের প্রতিটি কোম্পানির প্রতিনিধি, আধ-ডজন ফোটোগ্রাফার। স্যুট-টাই, সাসপেন্ডার দিয়ে সার্ট-পরা অম্বিকা, মুখে পাইপ গুঁজে অপেক্ষা করছেন ছেলের জন্য। সঙ্গে শাড়ি পরে তাঁর স্ত্রী (ছায়া দেবী) – সুব্রত-র মা।
মা-কে জড়ানো অবস্থায় সুব্রত ছবি তুলতে গেলে, বিরক্ত হয়ে ফটোগ্রাফারকে অম্বিকা বলেন, “Don’t waste film।”
অম্বিকা পুত্রকে কলকাতা ময়দানে হর্স রাইডিং-এ নিয়ে যান। ফেরার পথে ছেলের সাথে দু-চারটে অন্তরঙ্গ কিন্তু নিজের পিঠ-চাপড়ানো কথা বলার চেষ্টা করে নিরাশ হন।
সুব্রত বাবার মতন সাহেবি ইংরেজিতে কথা বলে না, অধিকাংশ সময়ে বলে বাংলায়। সুব্রত-র চালচলনে, বেশভূষায় সাহেবি চটক নেই। ব্যবহারে আছে মাধুর্য, নম্রতা।
সুব্রত বাল্যবন্ধু শচীন-এর (শুভেন্দু চ্যাটার্জি) বাড়ি যায়। তার বোন উমা-র (লিলি চক্রবর্তী) সাথে মনে হয় সুব্রতর বাল্যপ্রেম। উমা (‘সামান্য’)টাইপিস্টের কাজ করে। সুব্রত ভালোভাবেই জানে যে, অম্বিকা তাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে খুশি হবেন না। উমা-ও সেটা জানে।
অম্বিকা সুব্রতর অফিসঘর প্রস্তুত করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। নিজের চোখে সব যাচাই করে ছেলেকে ফোন করে বলেন একবার এসে দেখে যেতে, কারণ, আগামীকাল থেকে সুব্রত এই অফিসেই বসবে। ছেলেকে একটু চেনেন, তাই ফোন রাখার আগে বলেন, “Please come properly dressed। বুঝতেই পারছো, office discipline।”
অম্বিকার অফিসে বাংলায় কথা বলার চলন নেই। কর্মচারীদের অনেকেই ৯-টা থেকে ৫-টা ভাঙা ভাঙা ভুল ব্যাকরণের ইংরেজিতে কষ্ট করে কথা বলে। মজা করে কর্মচারীরা গুপ্ত পরিবারের নাম দিয়েছে “ফ্যামিলি অফ দৈত্যজ্”।
বড়োলোকি শিষ্টাচার, লৌকিকতা নিয়ে মাথা ঘামায় না সুব্রত। বরং সেসবের পাকে পড়ে বেশ অসুস্থ বোধ করে। দায় সারতে যেন তেন প্রকারেণ হাই সোসাইটির লৌকিকতা পালন করে। ক্লাব, পার্টির কালচার তার ভালো লাগে না। অবশ্যই, তার বাবা তাতে উষ্মা প্রকাশ করেন। অম্বিকার স্ত্রী তাঁকে ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেন।
মিঃ গুপ্ত ছেলেকে গোটা এন্টারপ্রাইজের সব ব্যবসা, কারখানা ইত্যাদি পরিদর্শনে নিয়ে যান –দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সঁপে দেন তার হাতে। তবে, তাড়াহুড়ো করে নিজে এখনই রিটায়ার করেন না। এন্টারপ্রাইজের এক নম্বর হয়েই থেকে যান সাময়িকভাবে।
নতুন পরিবেশে সুব্রত অস্বস্তি বোধ করে। অফিসের পরে সময় কাটাতে উমার কাছে চলে যায়। উমা তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তেমন আশাবাদী নয়। তাদের দুই পরিবারের মধ্যে অর্থনৈতিক আর সামাজিক মান-মর্যাদার অনেক কৃত্রিম ও বাস্তব ফারাক।
গুপ্ত এন্টারপ্রাইজের একটি গভর্ণমেন্ট কন্ট্র্যাক্টে এন্টারপ্রাইজের এঞ্জিনিয়ারদের ডিজাইনে সন্দেহজনক বিচ্যুতি খুঁজে পায় সুব্রত। অথচ, তার বাবা ইতিমধ্যেই সেই কন্ট্রাক্ট অনুমোদন করে সই করেছেন! এই বিচ্যুতির - যেটাকে এন্টারপ্রাইজের এঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে দুর্নীতির নিদর্শন বলে সন্দেহ করছে সুব্রত – প্রতি সে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, বলে “জানো, এর জন্য তোমারও জেল হতে পারে”। বাবা তাকে মনে করিয়ে দেন যে, সে শীঘ্রই এন্টারপ্রাইজের এক নম্বর লোক হবে, এতো উত্তেজনা তাকে মানায় না।
সেইদিন রাত্রে নিজের ঘরে ডেকে এনে অম্বিকা গুপ্ত স্পষ্ট ভাষায় ছেলেকে কঠোর তিরস্কার করলেন। “সুব্রত, অফিসে তুমি আজ অনেক কিছু বলেছো। তার থেকে একটাই লাভ হয়েছে যে এতোদিন আমি তোমাকে অল্প অল্প করে জানছিলাম। আজ তা পরিষ্কার হয়ে গেলো।“ ছেলেকে আবার তিনি মনে করিয়ে দেন, “by sheer talent, imagination and hard labor…” দিয়ে সাম্রাজ্য গড়েছেন। “দ্যাখো, আমি ভাগ্য মানি না। (নিজের মগজে আঙ্গুল ঠেকিয়ে) আমি মানি this little bit of grey matter here। আর তারই জন্য আজ তুমি এখানে।“ হ্যাঁ, লোকে তাকে ‘king-maker’ বলে জানে।
এক এক সময়ে ক্লোজ-আপে (মাথা থেকে পা অবধি) ফুল শটে অম্বিকা গুপ্ত-র উদ্ধত, প্রচণ্ড রূপ দেখি আমরা। তিনি সুব্রতকে আরো স্মরণ করিয়ে দেন যে, সে এখনও প্রতিষ্ঠানের দু নম্বর লোক, এখনও সে ক্ষমতায় তাঁর নীচে, এবং আজকে অফিসে সুব্রত যে-ব্যবহার করেছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। আজ সে তাঁর “পলিসিকে” অমান্য করেছে। সুব্রত তাঁর “subordinate”, তাকে তাঁর হুকুম মতোন চলতে হবে। অম্বিকা ছেলেকে জানিয়ে দেন, জেনেশুনেই তিনি গভর্ণমেন্ট কন্ট্রাক্টে সই করেছেন। ভুল তিনি করেন না। যা করেন তা তাঁর “business plan implement” করার জন্য করেন। সবকিছু জেনেশুনেই করেন। সুব্রতও বাবাকে মনে করিয়ে দেয় যে, সে নাবালক নয়। “মালিককে খুশি করে চাকরি করা” তার “পোষাবে না”।
অম্বিকা-র দম্ভ এতো যে তিনি কখনো নিজের ভুল স্বীকার করবেন না। জেদের বশে তিনি এমনকি নিজের ভালোবাসার ছেলেকেও তাঁর আদেশ মতন কাজ করতে বাধ্য করে ছাড়বেন। এই দৃশ্যে বিকাশ রায়ের সংলাপ বলার ও সংলাপের মাঝে বিরতির (pause) টাইমিং, হাতে-ধরা গ্লাসের হুইস্কিতে চুমুক দেওয়ার মধ্যে ছেলের স্পর্ধাকে চূর্ণ করার তৃপ্তি, শটের প্রত্যেকটি ফ্রেমে তাঁর হুমকি-দেওয়া ভীতিকর আধিপত্য আমাদের সম্মোহিত করে রাখে। চরিত্রের খাতিরে তিনি যে নিজের ব্যক্তিত্ব দমন করে সক্লেশে, চেষ্টা করে অম্বিকা গুপ্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন - এমন কখনই মনে হয় না – তাঁর অম্বিকা গুপ্ত এতোই বিশ্বাসযোগ্য, অভ্রান্ত, সফল প্রচেষ্টা। যেন, আসল অম্বিকা গুপ্ত আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অভিনেতাকে অভিনীত চরিত্রকে আলাদা করা যায় না। আমাদের দেশে এমন কোন চলচ্চিত্র সমালোচক কি আছেন যিনি এই নিখুঁত অভিনয়কে অবজ্ঞা করতে পারবেন?
সুব্রত বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। অম্বিকা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাদের দুজনের বিরোধ যে এই পর্যায়ে আসবে সেটা ।
“Excitement”-এর জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান অম্বিকা গুপ্ত এবং প্রচুর ভোটে জেতেন। কিন্তু, আজ তাঁর মনে আনন্দ নেই, তিনি ছেলের কথা ভেবে চলেন। কেউ কথা বলতে এলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। অন্ধকার ঘরে থমকে দাঁড়িয়ে থাকেন। ছেলের সাথে নিজের সম্পর্কের একপেশি হিসাব-নিকাশ করেন: ছেলে বুঝলোই না, সর্বদা তিনি ছেলের মঙ্গলের কথাই ভাবেন। সুব্রত-র ঘরে ঢুকে দেয়ালে টাঙানো তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। দূরত্ব কি তাঁদের সম্পর্ক শেষ করতে পারে? চিন্তা করেন, কি কি কথা একজন বাবা ছেলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা বোঝানোর জন্য বলতে পারেন কিন্তু তিনি কখনোই বলে উঠতে পারেননি। ছেলে কোথায় গিয়ে উঠেছে তাও তিনি জানেন না। তাঁর অন্তর জ্বলে যায়। ছোটো ছোটো দৃশ্যের মধ্য দিয়ে অল্প অল্প করে আমরা অম্বিকা গুপ্তর আসল পরিচয় পাই। ছেলের ওপর অভিমানে মনের ভিতরে টালমাটাল অবস্থা। তবুও তিনি ছেলের কাছে হার মানবেন না।
গুপ্ত এন্টারপ্রাইজের তৈরি ন্যাশনাল হাইওয়ে ব্রিজ, তাতে কতগুলো গলদ সরকার ধরতে পেরেছে। তদন্ত চলছে। আর সে তদন্তের (নতুন চাকরির সূত্রে) দায়িত্ব পড়েছে সুব্রতর ওপর। জানতে পেরে, অম্বিকা গুপ্তর ব্রেকডাউন্ হয়, তিনি শয্যাশায়ী হন।
মনুষ্যপ্রকৃতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসায় ভরা ছবি কাঁচ কাটা হীরে। ছবির পরিণতিতে গাঁথা আছে জিজ্ঞাসার উত্তর। খুঁজে নিতে হবে। নির্ভুল উত্তর না-ও মিলতে পারে। সে-কারণেই ছবিটি একাধিকবার দেখা যায়। প্রথমে বোধ হয়, ছবির দ্ব্যর্থহীন সংলাপের সাহায্যে অম্বিকা গুপ্ত আর সুব্রতকে আমরা হয়তো ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে পেরেছি। বাবা আর ছেলের মধ্যে অনুচ্চারিত স্নেহ-ভালোবাসার বিচিত্র প্রকাশ আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
ছবিতে ভিস্যুয়াল স্টাইলের কোন বড়াই নেই, নেই কোন কেতাদস্তুর সিনেম্যাটিক টেকনিকের বাহার।
তার পরিবর্তে পরিচালক অজয় কর বিকাশ রায় ও সৌমিত্র চ্যাটার্জির অকৃত্রিম এবং মর্মস্পর্শী অভিনয়কেই উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন।
আট/ জীবনমশায়
“…ওঁরা আমাকে ‘জীবনমশাই’ চরিত্রটিতে অভিনয় করার সুযোগ দেন। তখন বারবার উপন্যাসটি পড়েছি, নাট্যরূপটি পড়েছি—চেষ্টা করেছি, ওই সুকঠিন চরিত্রের ভিতরের কথাটি জানার, তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার।
কতটকু পেরেছিলাম তা জানি না, তবে সত্যি সত্যিই ওই ছবির শুটিং-এর সময় আমার আহার নিদ্রা প্রায় ঘুচে গিয়েছিল। শুটিং-এ গিয়ে গোঁফদাড়ি চুল লাগিয়ে, ধুতি পরে, চাদরটি অঙ্গে জড়িয়ে অরোরা স্টুডিয়োর পুকুর ধারে কিংবা আউটডোর লোকেশনে কোন গাছের তলায় একলা বসে থাকতাম।
আমার সহকর্মীরা, পরিচালক এঁরা আমাকে একলাই থাকতে দিতেন। চিন্তা করতাম ওই নিদান হাঁকা, সত্যনিষ্ঠ গ্রাম্য কবিরাজটির কথা! কোন্ পথে চলতো তাঁর মন, কোন অন্যায়ের সঙ্গে কেন তিনি আপোস করলেন না সারাজীবন, যে মৃত্যুকে পৃথিবীর মানুষ ভয় করে যার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চায়—সেই মৃত্যুকে ঋষিকল্প দৃষ্টিতে দেখলেন যে জীবনমশাই তিনি কী, কেমন মানুষ!”৩২
জীবনবন্ধু মশায় (বিকাশ রায়) – নবগ্রামের মানুষেরা ডাকে ‘মশায়’ – মূল উপন্যাসে লেখকের বর্ণনায় “প্রায় সত্তর বছর বয়স; - স্থবির, ধূলিধূসর, - দিক-হস্তীর মতো প্রাচীন। এককালের বিশাল দেহের কাঠামো কুঞ্চিত দেহচর্মে ঢাকা; বক্ষপঞ্জর প্রকট হয়ে পড়েছে, মোটা মোটা হাত – তেমনি দুখানি পা, সামনে দেখবেন প্রকাণ্ড আকারের অতিজীর্ণ একজোড়া জুতো, পরনে থান-ধুতি – তাও সেলাই-করা; শোভা শুধু শুভ্র গজদন্তের মতো পাকা দাড়ি-গোঁফ; মাথার চুলো সাদা কিন্তু খাটো করে ছাঁটা।“৩৩
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস আরোগ্য-নিকেতন অবলম্বনে (?) বিজয় বসু-পরিচালিত (চিত্রনাট্যও বিজয় বসু-র) ছবি আরোগ্য নিকেতন (১৯৬৯)-এর সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। জীবন-মৃত্যুর, বিশেষ করে মৃত্যুর রহস্য নিয়্ মশায়ের তথা মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসা-সংশয়-ভীতি এবং মশায়ের অন্তর্দর্শন তারাশংকরের গল্পের বিষয়বস্তু। বিজয় বসু-র ছবিতে অপ্রয়োজনীয় মেলোড্রামাটিক মুহূর্ত আছে প্রচুর, কিন্তু, উপন্যাসে যেমন, ছবিতে তেমন মশায়ের এই অধিবিদ্যামূলক সত্যের অনুসন্ধানে ধ্যানমগ্নতার মুহূর্তের হদিশ আদৌ সে-পরিমাণে নেই।
উপন্যাসে মশাইয়ের সাথে আমাদের পরিচিতি ঘটে তাঁর দীর্ঘ স্মৃতি রোমন্থনের ভিতর দিয়ে। সে-স্মৃতির মধ্যে আছে না-পাওয়ার আর যৌবনের প্রতিদানহীন নারীপ্রেমের বেদনা। যার ফলে, স্ত্রী আতর বউ (ছায়া দেবী)-এর সাথে বিবাহিত জীবনে কোনদিনই তাঁর মনের মিলন হয় নি। এ-সমস্ত সূক্ষ্মতার স্পর্শন ছবিতে পাওয়া যায় না। কষ্টে-সৃষ্টে ছবির রস নিংড়ে বার করার চেষ্টা করলে হয়তো বিষয়বস্তুর আবছা ছায়া চোখে পড়বে। এখানে-সেখানে অস্থানে-কুস্থানে জীবন-মৃত্যুর রহস্য ঘিরে মশায়ের দার্শনিক উপলব্ধি-সম্পর্কিত কিছু অমূল্য কথাবার্তার (মূল উপন্যাস থেকে যথেচ্ছভাবে উদ্ধৃত) দৃষ্টান্ত মিলবে।
মশায়ের ভুমিকায় অভিনেতা বিকাশ রায়ের মেক-আপ তারাশংকরের বর্ণনা মতন হলেও, তাতে ছবির বিশেষ কিছু পরিস্থিতির সাথে সংগতিপূর্ণ সূক্ষ্ম ডিটেলের অভাব অতি প্রকট। প্লট বস্তুটি হবে রেলগাড়ির মতন – চরিত্রকে আর গল্পকে নিয়ে যাবে এক স্টেশান থেকে আরেক স্টেশানে, যে-যাত্রার মধ্য দিয়ে চরিত্রের আরো গভীরে আরো নিভৃত কক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হবো আমরা। আরোগ্য নিকেতন ছবিতে প্লটের সেই শক্তি নেই। অতএব, এহেন বেদনাদায়ক পরিস্থিতে আসুন আমরা (যারা হাই স্কুলে ছাত্রাবস্থায় গ্রীষ্মের ছুটিতে গভীর রসবোধের পরিণত অনুভূতির অভাবসত্ত্বেও বিমোহিত হয়ে মূল উপন্যাসটি পড়েছি) ভুলে যাই যে (বিজয় বসু-র হাস্যকর দাবী অনুযায়ী) তারাশংকরের অমন একটি মাস্টারপিসের সাথে ছবিটির কোন নিকট সম্পর্ক আছে। ছবিটি দেখার পর মনে যদি তৃপ্তি অনুভব করে থাকি, তার একমাত্র কারণ, শুরু থেকে শেষ অবধি প্রবীণ অভিজ্ঞ শিল্পী বিকাশ রায়ের তারিফ করার মতন career-definining অভিনয়।
মশায়-রা তিন বংশ আর প্রায় একশো বছর ধরে কবিরাজি-ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। তাঁদেরই গড়া চিকিৎসালয় ‘আরোগ্য নিকেতন’। নবগ্রামে এর মাঝে এসেছে কতো মেডিক্যাল ডাক্তার। কেউ বেশিদিন থাকে নি। আজ সে-চিকিৎসালয়ের ঝড়তি অবস্থা।
নবগ্রামের লোকে বলে, জীবন ডাক্তার নাড়ী ধরলে মরণের পায়ের শব্দ শুনতে পান। রুগীর আয়ু গণনা করে বলে দেন।
জীবন মশায়ের নিদান নাকি কখনও ব্যর্থ হয় না!
আজকাল মশায় ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ বসে রুগী দেখে দর্শনী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। নবগ্রাম-বাসী কম্পাউণ্ডার শশী (রবি ঘোষ), যে নিজেকে ডাক্তার হিসাবেও জাহির করে, বলে, “মশাই বংশের ‘আরোগ্য নিকেতন’ একশো বছর ধরে এ-গ্রামের হেলথ সেন্টার ছিলো। …জীবন ডাক্তার, তিন বংশ অতো বড়ো কোবরেজ, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী, কি রমরমে ব্যবসা ছিলো…আর আজ কি অবস্থা! কেন? মুখ ফুটে কারো কাছে ফি চাইতে পারে না। বলে, আমরা হ’লাম গিয়ে ‘মশাই’ বংশ, আমার ধর্ম হোল গিয়ে রুগীর সেবা করা…পাগল ছাড়া কেউ এ কথা বলে? আজ কি অবস্থা! হাঁড়ি ঠনঠন…”।
তাঁর একমাত্র পুত্র সত্যবন্ধু-কে (দিলীপ রায়) জীবন ডাক্তার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে পড়ার জন্য। আশা ছিলো ছেলে বংশের প্রথম ডাক্তার হবে। কেননা তাঁর নিজের চিকিৎসা-পদ্ধতি সেকেলে হয়ে গেছে। তিনি নাড়ী দেখে বলে দেন মৃত্যু আসন্ন কিনা, কিন্তু, আজকের মেডিক্যাল সায়েন্স সেই মরণকে সাময়িকভাবে ঠেকিয়ে রাখার অনেক ওষুধ আবিষ্কার করেছে। তাঁর সুযোগ হয়নি, ছেলে সেই বিদ্যা অর্জন করে ফিরে আসুক। কিন্তু, সত্যবন্ধু বাবার অজান্তে পড়াশুনা ছেড়ে খ্রীষ্টান মেয়ে সুধা-কে (রুমা গুহ ঠাকুরতা) বিয়ে করে বসলো। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে বলে মশায় তাকে ত্যাগ করলেন। সত্যবন্ধু ও সুধার একটি পুত্রসন্তান হয়েছিলো। অসুস্থ অবস্থায় সত্যবন্ধু একাই (স্ত্রী অন্য ধর্মের ব’লে বাবা-মা যদি তাকে গ্রহণ না করেন) নবগ্রামে হাজির হ’লো এক রাত্রে। তার নাড়ী দেখে মশায় বুঝতে তার মৃত্যু আসন্ন। সেন্ট্রাল হসপিটালের ডাক্তারকেও ডাকলেন। সে-ও ভরসা দিতে পারলো না। মশাইকে বললো আবার একবার পরীক্ষা করতে। মশায় আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেকে আর চেষ্টা করেও বাঁচানো যাবে না। সেই রাত্রেই এক গ্রামবাসীর ডাকে মুমূর্ষু রুগী দেখতে চলে গেলেন ছেলেকে ঐ অবস্থায় ফেলে – যদি অন্ততঃ অন্য রুগীকে বাঁচাতে পারেন। রুগীর সেবা তাঁর বংশের ধর্ম।
সত্যবন্ধু মারা গেলো। মশায় ভাবলেন তিনি নির্বংশ হলেন।
মানুষের জীবনে মৃত্যুর অনিবার্য্যতা তিনি মেনে নিতে শিখেছেন সঞ্চিত জীবন-অভিজ্ঞতা আর দার্শনিক উপলব্ধির জোরে। “কালের বিধান… সহজে মেনে নিতে কোন মানুষই পারে না। দুঃখ, ক্ষোভ, অতৃপ্তি তার অন্তরে জেগেই থাকে…। পুত্রশোক আমি জয় করেছি। আমার দুঃখ যে, পরমানন্দ মাধবকে উপলব্ধি করা হোল না, অমৃতকেও না…।“
জীবন সম্বন্ধে এ কি উদাসীন মনোভাব তাঁর!
একদিন সত্যবন্ধুর বিধবা স্ত্রী সুধা শহরের মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ-করা তার ডাক্তার ছেলে প্রদ্যোত (শুভেন্দু চ্যাটার্জি)–কে নিয়ে নবগ্রামে হাজির হলো। আশা, যদি মশায় বংশের সাথে ছেলের রক্তের সম্পর্ককে স্বীকার করে নেন জীবনমশায়। নবগ্রামে আধুনিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা শুরু করলো প্রদ্যোত। মশায়ের সাথে সম্পর্কের কথা কিছুই না জেনে। মশায়-ও জানলেন না কি সম্পর্ক।
প্রথম থেকেই মশায়ের সাথে প্রদ্যোতের আচরণে দম্ভ ও বৈরিতা প্রকাশ। সে তার মা-কে বলে, “That ‘Moshai’ of this place, ওর ঐ হাতুড়ি-বিদ্যের ভেলকে আমি ভেঙ্গে দেবো, It’s a challenge।“
মশায় কিন্তু তাকে সাদরে শ্রদ্ধাসহকারে আমন্ত্রণ জানান – দেখা হলেই কপালে দুহাত ঠেকিয়ে মাথা হেঁট করে নমস্কার জানান প্রদ্যোতকে। ‘ডাক্তারবাবু’ বলে ডাকেন তাকে। প্রথম দেখায় প্রদ্যোত মশায়কে রূক্ষভাবে বলে, “এখন এযুগে এভাবে নিদান হাঁকবেন না। এটা মরার যুগ নয়, এটা বাঁচার যুগ। আজকের মেডিক্যাল সায়েন্স যে কতো উন্নত, সে আপনি জানেন না।“
মশায় ইদানিং রুগী দেখতে চান না। তাদের যেতে বলেন হাসপাতালে, মেডিক্যাল ডাক্তার প্রদ্যোতের কাছে। “বয়স হয়েছে। ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে।“
তবুও রুগীর দল নাছোড়বান্দা।
জন্মাষ্টমী পূজো উপলক্ষে মশায়ের বাড়িতে গেলো সুধা। প্রসাদ না-খেয়ে ফিরে আসায় পরের দিন মশায় প্রদ্যোতের কোয়ার্টারে গেলেন প্রসাদ হাতে। মশায়কে কিছু খেয়ে যেতে বললো সুধা।
প্রদ্যোত মা-কে বললো, ওঁকে খেতে বলছো, কিন্তু উনি কি আমাদের মতন ছোট জাতের লোকের বাড়িতে খাবেন?
না, মশায় জাতে বিশ্বাস করেন না।
প্রদ্যোত তাকে বলে, তবে ম্লেচ্ছ জাতের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো বলে নিজের ছেলেকে ত্যাগ করেছিলেন কেন?
মশায় থমকে গেলেন। তারপর শান্ত, দৃঢ়কন্ঠে জানিয়ে দিলেন যে, সে-প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না – এ তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ব্যাপার।
রাত্রে মশায়ের মাথা ধরলো, অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য নিজের নাড়ী ধরে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতন চোখ বুঁজে থাকলেন, ওষুধ বানিয়ে খেলেন, স্ত্রী আতর বউ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, বিশেষ কিছু হয় নি। আতর বউ অভিমানে ফুঁসলে উঠলেন। “মশায়, আমি তোমার কেউ না, তাই না? তোমার সুখ, তোমার দুঃখ, সবই তোমার একলার? কি হয়েছে তোমার? বলো, তোমাকে বোলতেই হবে।“
মশায় উত্তর দিলেন, “শুনতে চেয়ো না, সইতে পারবে না।“
আতর বউ চোখের জল মোছেন। “তুমি বিধাতার চেয়েও নিষ্ঠুর”।
মশায় আতর বউকে এরকমই একলা করে রেখেছেন। তিনি নিজেও একলা – একান্তে নিজের উপলব্ধির জগতে পরমানন্দের সন্ধান করেন। (লোকের চোখে) তিনি সত্যবাদী, পবিত্র মানুষ হলেও তাঁর সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটালে বোঝা যাবে যে তিনি পরম দার্শনিকও বটে, মৃত্যুর অধিবিদ্যা নিয়ে তাঁর জিজ্ঞাসা অফুরন্ত।
মশায় একদিন এক মরণাপন্ন বাচ্চা রুগী নিয়ে এলেন প্রদ্যোতের কাছে। “ডাক্তারবাবু, যেমন করে হোক বাচ্চাটিকে বাঁচান, দরিদ্র বিধবার একমাত্র সন্তান। আমাদের শাস্ত্রে এর কোন ওষুধ নেই।… ২৪ থেকে ২৬ ঘন্টা। ওর শরীরে বিষ ঢুকেছে। মৃত্যু ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। এখুনি কিছু করুন, ডাক্তারবাবু।“
মশায়ের এসব ভুতুড়ে গণনা প্রদ্যোত সহ্য করতে পারে না। “আপনি নিষ্ঠুর, নির্মম।“
সত্যিই মাশায় অদ্ভুত! রোগী আসে মশায়ের কাছে চিকিৎসার জন্য, উল্টে তিনি তাদের মৃত্যুর দিন-ক্ষণ গণনা করেন! নবযুগের টাটকা ডাক্তার প্রদ্যোত ভেবে বসলো, মশায় জীবন-বিরোধী। কিন্তু, মশায় তা নন। তাঁর মতবাদ ব্যাখ্যা করে বললেন, “জীবনে মৃত্যুই একমাত্র ধ্রুব, ডাক্তারবাবু। তাকে রোধ করা যায় না। আমরা সাধ্যমতো মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। কিন্তু, মৃত্যু যেখানে নিশ্চিত, আমরা নিদান ঘোষণা করি। কেন জান, তাকে জানিয়ে দিই যে, মৃত্যু চিরকাল আছে, মৃত্যু চিরকাল থাকবে, মৃত্যুকে ভয় কোরো না। মৃত্যুভয় জয় করো। তুমি অমৃতের সন্তান, মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়ে অমৃতলোকে প্রবেশ করো তুমি। ডাক্তারবাবু, এ আমার নিষ্ঠুরতা, এ আমার অপরাধ?”
প্রদ্যোতের হাতে রুগীকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন না। তার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ালেন সর্বক্ষণ। আবার, সেন্ট্রাল হস্পিটালের ডাক্তারকে ডাকা হলো। সে-ও আশাপ্রদ কিছু বলতে পারলো না। মশায়কে আমন্ত্রিত ডাক্তার বললেন, রুগীকে আরেকবার দেখতে।
বাড়ি ফিরে মশায় খাটে বসে চোখ বুঁজে নিজের নাড়ী পরীক্ষা করেন। আর কতোদিন তাঁর আয়ু?
আতর বউ ওষুধ নিয়ে এলে ফিরিয়ে দিলেন। আর তিন মাস। বউকে জানিয়ে দিলেন, “আর যুদ্ধ নয়, এবার আত্মসমর্পণ।“
জীবন মশায় নিজের মৃত্যুর প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। মশায়ের উপলব্ধির চিত্র তারাশংকর এঁকেছিলেন এইভাবে,
“… সে আসছে তিনি জানেন। তার পায়ের ধ্বনি যেন তিনি শুনতে পেয়েছেন। শেষ মুহূর্তে সজ্ঞানে তার মুখোমুখি হতে চান। তার রূপ থাকলে তাকে তিনি দেখবেন, তার স্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর শুনবেন। তার গন্ধ থাকলে সে গন্ধ শেষ নিঃশ্বাসে গ্রহণ করবেন; তার স্পর্শ থাকলে সে স্পর্শ তিনি অনুভব করবেন। সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অতীত, বর্তমান, স্মৃতি, আত্মপরিচয় স্থান, কাল সব। আবার ফিরে আসছেন। চোখ চাইছেন। সে এলো কী?”৩৪
মশায়ের চরিত্রে অভিনেতা বিকাশ রায় তারাশংকরের উপন্যাসের উপরোক্ত অংশের নিজস্ব ব্যাখ্যা করে লিখেছিলেন,
বিজয় বসু-র আরোগ্য নিকেতন-এ মশায়ের ‘অন্তরের পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, পরিশুদ্ধতা’৩৬, মানুষের প্রতি তাঁর দরদ, অমৃত ও জীবনের পরম কাম্য শান্তির অন্বেষণে তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির সার্থক এবং মহত্তম রূপায়ণের কৃতিত্ব বিকাশ রায়েরই প্রাপ্য। আমার এই বিচারের ভিত্তিস্বরূপ তাঁর স্মৃতিকথা থেকে কিছু অংশ ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি ছবির এই আলোচনায়।সন্দেহ হয়, বিকাশ রায় “যখন জীবনমশাই চরিত্রের মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয় করছি তখন চিত্রগ্রহণের নানারকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকেও আমি তারাশঙ্করের লেখা অনুভব করার চেষ্টা করেছি” মন্তব্যের মধ্য দিয়ে চিত্রনাট্যে ও ছবির পরিচালনায় মূল উপন্যাসের ভয়াবহ বিকৃতি ও লঘুকরণকে কটাক্ষ করেছেন কিনা!
এ-ছবি দেখার অনেকদিন পরেও ছবিটির কথা মনে পড়লে বা চোখ বুঁজে ছবিটি নিয়ে ভাবলে, যাঁরা ছবিটিকে ঘোরতরভাবে অপছন্দ করেন এমনকি তাঁদেরও মনশ্চক্ষে ভেসে উঠবে “শুভ্র গজদন্তের মতো পাকা দাড়ি-গোঁফ; মাথার চুলো সাদা কিন্তু খাটো করে ছাঁটা” মশায়-রূপী বিকাশ রায়ের মুখচ্ছবি। ছবিটি বছরের সেরা বাংলা ছবি হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলো! বিকাশ রায় কিন্তু সেরা অভিনেতার স্বীকৃতি পান নি!
থাক, সে কথা আলোচনা করার আর প্রয়োজন দেখি না।
৫ শেষ কথা
এতো ছবি করেছেন জীবনে! এর কিছু মামুলি, কিছু চরিত্র আটপৌরে - তাঁর যোগ্যতাকে খর্ব করেছে।
নানা কারণে শিল্পীর উদ্দীপনা্র আগুন চিরকাল জ্বলে না। উপযুক্ত স্বীকৃতি না মিললেও পেশায় আর জীবনের সাথে তাঁকে আপোষ করতে হয়।
আজ আরোগ্য নিকেতন আবার দেখলে মনে হয়, এ-ছবিই ছায়াছবির সত্তর দশকের দ্রুত পরিবর্তনশীল ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে তাঁর swan song হতে পারতো। তিনি কি ভেবেছিলেন নবীন আরও পারদর্শী পরিচালকের সাথে কাজ করার সুযোগ পাবেন, আরও চ্যালেঞ্জিং জটিল চরিত্রে অভিনয় করার আমন্ত্রণ আসবে?
আসেনি।
কিন্তু, অভিনয়-জীবনের অন্তিমেও তাঁর শিল্পকলার ধার কমে নি।
শেষ কথা তিনি তাঁর অভিনয়জীবনের স্মৃতিচারণে নিজেই লিখে গেছেন:
আজ এতো বছর বাদে অহীনদার কথার পুরো মানে আমি হদয়ঙ্গম করছি।“৩৭
তপন সিংহ পরিচালিত জতুগৃহ ছবির স্যুটিং-এর সময় বিকাশ রায়ের প্রথম ছবির নায়িকা বিনতা রায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বিকাশবাবু, আবার যদি ‘অভিযাত্রী’ করার সময়ে ফিরে যাওয়া যেতো তাহলে বেশ হত, না?”৩৮
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কোন ‘বিদগ্ধ’ ঐতিহাসিকের বিচারে অভিনেতা বিকাশ রায় হয়তো সামান্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বা পাদটীকা হিসাবে স্থান পাবেন। তবে, এটাও সত্য যে, ইতিহাস বার বার লেখা হয়। নতুন দৃষ্টিকোণ-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে গবেষণা হয়। গত দশকের নব্বই দশক থেকে সে-গবেষণার এক পর্যায় শুরু হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নেবার সময় বিকাশ রায় ছিলেন এক ঐতিহাসিক প্রজন্মের শিল্পীদের একক জীবিত সক্রিয় প্রতিনিধি - ‘the last man standing’।
বাংলা চলচ্চিত্রের অবিকৃত ও অবিক্রিত ইতিহাসের পাতায় এক অনুপম ব্যক্তিত্বের শেষ ও একমাত্র অভিনেতার স্বীকৃতি নিয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।
[ছবিগুলি ইউ-টিউব ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া। ]
[এই প্রবন্ধ লেখায় উৎসাহ ও স্নেহপূর্ণ আশীর্বাদ পেয়েছি দুজন পরম-শ্রদ্ধেয় - সুমিত রায় ও সুজন দাশগুপ্ত - অগ্রজের কাছে। আর, বিকাশ রায় রচিত তাঁর স্মৃতিকথার গ্রন্থগুলি আমার হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুমিত রায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।]
ব্যবহৃত নথিপত্রের তালিকা
[১] ‘প্রসঙ্গ : অভিনয়/ বিকাশ রায়/ পৃঃ ১৫১
[২] Auteur Theory সম্বন্ধে অনেক লেখা ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে
[৩] ‘কিছু ছবি কিছু গল্প’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ২৪-২৫
[৪] ‘Actor and Text: La Grande Illusion’ / Sylvie Gendron / ফরাসী থেকে অনুবাদ করেছেন Anne Golden ও Carole Zucker
[৫] ‘কিছু ছবি কিছু গল্প’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ২৪-২৫
[৬] Guardian পত্রিকা/ David Thomson / মে, ২০০৯
[৭] ‘Introduction to the Chinese Edition of ACTING IN THE CINEMA’ / Jonathan Rosenbaum / ফেব্রুয়ারি, ২০০৩
[৮] Francois Truffaut সম্পাদিত Andre Bazin রচিত প্রবন্ধের সংকলন French Cinema of the Occupation: The Birth of a Critical Esthetic পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত ‘Let’s Rediscover Cinema!’-শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত / জুন ২৬, ১৯৪৪
[৯] ‘Politics and Cinema’ পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত Sixties Cinema-শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত / Andrew Sarris / পৃঃ ১৮৮
[১০] Francois Truffaut সম্পাদিত Andre Bazin রচিত প্রবন্ধের সংকলন French Cinema of the Occupation: The Birth of a Critical Esthetic পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত ‘The Cinema and Popular Art’-শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত / জুন ২৫, ১৯৪৪
[১১] ‘Indian Film Culture’ পত্রিকার (১৯৬১) প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় এবং ‘The Birth of a Film Culture’ পুস্তকে মৄগাঙ্ক শেখর রায় কর্তৃক উদ্ধৃত / পৃঃ ১৯
[১২], [১৩] Bengali Cinema – ‘An Other Nation’ পুস্তকের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ Bengal and a ‘National’ Cinema: New Theatres Ltd./ শর্মিষ্ঠা গুপ্তু / পৃঃ ৪৩, ৬৭
[১৪] Bengali Cinema – ‘An Other Nation’ পুস্তকের তৃতীয় পরিচ্ছেদ Transition to a Regional Cinema / শর্মিষ্ঠা গুপ্তু / পৃঃ ৭২-৭৩
[১৫] ‘Mourning the Nation - Indian Cinema in the Wake of Partition’ পুস্তকের তৃতীয় পরিচ্ছেদে A regional “National” Cinema: Audiences and Taste Cultures-শীর্ষক অংশ থেকে উদ্ধৃত / ভাস্কর সরকার / পৃঃ ১৩৫-১৩৭
[১৬] Journal of the Moving Image পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ ‘Remapping Transitions of Bengali Cinema into The 50s’ / শুভজিৎ চ্যাটার্জি / পৃঃ ১২৩<
[১৭], [১৮] ‘The Birth of a Film Culture’ / মৃগাঙ্ক শেখর রায় / পৃঃ ১৯, ১৯
[১৯] পার্থ রাহা সম্পাদিত ‘বাংলা চলচ্চিত্র চিন্তা’ পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত ‘মহানয়ক উত্তমকুমার: স্বদেশ ও সময়‘-শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত / পৃঃ ১০৭
[২০] ‘Our Films Their Films’ / সত্যজিত রায় / পৃঃ ৮
[২১], [২২] ‘Mourning the Nation - Indian Cinema in the Wake of Partition’ পুস্তকের তৃতীয় পরিচ্ছেদে A regional “National” Cinema: Audiences and Taste Cultures-শীর্ষক অংশ থেকে উদ্ধৃত / ভাস্কর সরকার / ১৩৫, ১৩৫
[২৩] ‘Making Meaning in Indian Cinema’ পুস্তকের ‘Shifting Codes, Dissolving Identities: The Hindi Social Film of the 1950s as Popular Culture’-শীর্ষক পরিচ্ছেদ / রবি বাসুদেভান্ / পৃঃ ৯৯-১২১
[২৪] Journal of the Moving Image পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ ‘Remapping Transitions of Bengali Cinema into The 50s’ / শুভজিৎ চ্যাটার্জি / পৃঃ ১৩৯-১৪০
[২৫] ‘Ritwik Ghatak, face to face : conversations with the master 1962-1977’ / পৃঃ ৭৬-৮৮
[২৬] Francois Truffaut সম্পাদিত Andre Bazin রচিত প্রবন্ধের সংকলন French Cinema of the Occupation: The Birth of a Critical Esthetic পুস্তকের ভূমিকা / Francois Truffaut / পৃঃ ৫ / ১৯৭৫
[২৭] ‘Rows and Rows of Fences’ / ঋত্বিক ঘটক / পৃঃ ৮
[২৮], [২৯] ‘Mourning the Nation - Indian Cinema in the Wake of Partition’ পুস্তকের তৃতীয় পরিচ্ছেদে Film Censorship and the Fear of Popular Dissension-শীর্ষক অংশ থেকে উদ্ধৃত / ভাস্কর সরকার / পৃঃ ১৩৭, ১৩৯
[৩০] ‘মনে পড়ে’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ৮৬-৮৭
[৩১] ‘Virtue and Villainy in the Face of the Camera’-শীর্ষক প্রবন্ধ / William Rothman
[৩২] ‘কিছু ছবি কিছু গল্প’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ১০৮-১০৯
[৩৩] ‘আরোগ্য-নিকেতন’ / তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / তারাশংকর রচনাবলী, দশম খণ্ড / পৃঃ ৭
[৩৪] ‘আরোগ্য-নিকেতন’ / তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / তারাশংকর রচনাবলী, দশম খণ্ড / পৃঃ ৩১০
[৩৫] ‘কিছু ছবি কিছু গল্প’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ১০৯
[৩৬] ‘আমার সাহিত্য জীবন’ / তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় / ১৯৫৩
[৩৭] ‘মনে পড়ে’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ৯৪-৯৫
[৩৮] ‘কিছু ছবি কিছু গল্প’ / বিকাশ রায়/ পৃঃ ৩৬
(শেষ)
লেখক পরিচিতি - আমেরিকার নিউ জার্সি শহরের প্রথম ও একমাত্র বাৎসরিক চলচ্চিত্র উৎসব নিউ জার্সি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট সাউথ এশিয়ান সিনে ফেস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক শক্তি সেনগুপ্ত-র বহু লেখা গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটার ও ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রাঞ্জ কাফকা-র ছোট গল্প Metamorphosis অবলম্বনে তাঁর রচিত একটি নাটক প্রকাশিত হয়েছে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায়। অ্যামেরিকায় প্রবাসী জীবনে তিনি তাঁর পরিচালনায় কয়েকটি নাটক নিউ-ইয়র্ক শহরের অফ-অফ ব্রডওয়েতে মঞ্চস্থ করা ছাড়াও একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ভয়সেস ইন দ্য আফটারনুন পরিচালনা করেছেন। তাঁর লেখা ইংরাজি ভাষার বই ডিস্কাভারিং ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট সিনেমাঃ দ্য ফিল্মস অফ গিরীশ কাসারাভাল্লি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.