অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


জন্মশতবর্ষে বিকাশ রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫

 

বিকাশ রায়: অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায় "ত্রিবর্ণরঞ্জিত"

উজ্জ্বলকুমার মজুমদার


বিকাশ রায় তাঁর সম সময়ের চলচ্চিত্র্র এবং নাট্যজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। পাশাপাশি প্রথম জীবনে রেডিওর প্রোগ্রাম এ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করার সূত্রে "শ্রুতি"নাটকে পরিণত বয়সেও তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তবে শুধু "শিল্পী" শব্দটি দিয়ে তাঁর পুরো পরিচয়টি বোধহয় দেওয়া যায় না। কারণ, শুধু অভিনয় নয়, পরিচালনা এবং প্রযোজনাও ছিল তাঁর বিশেষ মনোযোগের ক্ষেত্র। কাজেই শিল্পী হিসেবে শুধু আত্মচর্চাই নয়, অভিনয়-শিল্পের সামগ্রিক রূপটাকে প্রাণবন্ত করে তোলার দিকেও ছিল তাঁর সমান নজর। সামগ্রিকভাবে অভিনয়ের পারিপাট্য, তার দৃশ্য ও শ্রাব্য -- সব দিকটাই তাঁর নজরে ছিল। বাচিকশিল্প, চলচ্চিত্র ও নাট্যশিল্পই ছিল তাঁর চর্চার বিষয়।

চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের এই সামগ্রিকতার দিকে তাঁর নজর গেল কেন সে সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে বিকাশ রায়ের ব্যক্তিজীবন ও পারিপার্শ্বিকতার কথা একটু বলতেই হয়। "প্রতিভা" তো সব সময়েই নিজেকে স্বশিক্ষিত করতে করতে এগিয়ে যায়। তবু বলতে হয় আত্মীয়-স্বজন, পরিবেশ-পরিজন, স্কুল-কলেজের শিক্ষাদীক্ষার আবহাওয়া থেকে নিজেকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা একজন জাত-শিল্পীকে নিজের রুচি অনুযায়ী গড়ে উঠতে সাহায্য করে, নিজেকে ভেঙে গড়ে নিতে সাহায্য করে, যেটা কর্মক্ষেত্রে, বিশেষভাবে অভিনয়-জগতের মতো নানা ধরনের রুচির এবং মতামতের বদ্ধমূল কিংবা নির্দিষ্ট ধারণার মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। কাউকে ছোট না করেই বলতে পারি, যেখানে জীবিকার প্রশ্ন, সেখানে শিক্ষিত মার্জিত মুক্তমনের শিল্পীর মধ্যে একটা মানসিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সেটা তাঁকে কষ্ট দেয়, বাধ্যবাধকতার যন্ত্রণা দেয়। বোধহয় বিকাশ রায়ের অভিনয়জীবনের বিস্তৃত অভিজ্ঞতায় এই জাতীয় কষ্ট ছিল। নইলে অভিনয়, প্রয়োজনা ও পরিচালনা -- এই তিন দায়িত্বে ঘোরাফেরা করবেন কেন তিনি?

পারিবারিক পরিবেশের কথায় এলে বিকাশ রায়ের প্রসঙ্গে এই জাতীয় চিন্তাই আমার মনের মধ্যে জেগে ওঠে। কলকাতার ভবানীপুরে তাঁর জন্ম ও বড় হওয়া। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র! পরে প্রেসিডেন্‌সি কলেজের ছাত্র। আইনেরও স্নাতক। থিয়েটার সিনেমার প্রতি ঝোঁক প্রথম দিকে তেমন ছিল কি না জানিনা। তবে সহপাঠি অশোক মিত্রের (আইসিএস) কাছে শুনেছি গল্প্গুজব, হাসিঠাট্টা, লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ, প্রেসিডেন্‌সি কলেজের ম্যাগাজিনে লেখা, কলেজে থাকতেই "বৈকুণ্ঠের উইল" নাটকে অভিনয় করা -- সব মিলিয়ে "he was a gem"। পরে আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করার জন্য যাওয়া আসা শুরু করলেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকালতিতে মন গেল না। আইন পড়ার সময় আমার এক পিসতুতো দাদা প্রতুল গুপ্ত, রাধামোহন ভট্টাচার্যের সহপাঠী সুধীররঞ্জন ঘোষের কাছে গাইডেন্‌স নিতে আসতেন। তাঁর কাছেও বিকাশ রায়ের এই প্রাণখোলা রসিক বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের কথা শুনেছি। কিছুদিন ডি জে কীমার-এর বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজও করেছিলেন বলে শুনেছি। আর রেডিও-তে প্রোগ্রাম অ্যাসিস্টেন্টের কাজও করেছিলেন ১৯৪৩-৪৪ সালে। এছাড়া বাড়ির পরিবেশে সঙ্গীতচর্চার একটা প্রবণতাও ছিল। শুনেছি বিকাশ রায়ের বাবা পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরির পাশাপাশি ভবানীপুর সঙ্গীত সমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কাজেই পড়াশোনায় আগ্রহী ছাত্র, সাহিত্য-প্রেমিক ও লেখক, বন্ধুবৎসল, সঙ্গীতরসিক, চাকরিসূত্রে বিজ্ঞাপনের জগৎ-সূত্রে সামাজিক এবং অনুষ্ঠান পরিচালনায় অভিজ্ঞ বিকাশ রায় যখন "অভিযাত্রী" ছবির লেখক জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে পরিচিত হলেন তখন প্রাথমিক ভাবে নায়ক নির্বাচিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রযোজক ওই ছবিতে রাধামোহন ভট্টাচার্যকেই চাইলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত নায়িকার ছোট ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করার দায়িত্ব পেলেন। কিন্তু দর্শকদের নজর কাড়তে পারেননি। অবশ্য সে অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লেগেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি "ভুলি নাই"-এর অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ অভিনয় তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। আরো যে পাঁচ-ছটি ছবিতে তিনি প্রশংসনীয অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে "বামুনের মেয়ে", "বিষের ধোঁয়া", কিংবা "মায়াজাল"-এর কথাই মনে পড়ে। কিন্তু এই ছবিগুলো আমরা পরে পঞ্চাশের দশকেই দেখেছি, কারণ চল্লিশের দশকে আমরা স্কুলের ছাত্র। তখন ছোটদের পারিবারিক বা সামাজিক ছবি দেখার সুযোগ থাকত না। বড় জোর রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দ-এর জীবনচিত্র বা "ফল অফ বার্লিন"-এর মত ওয়ার পিকচার। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের প্রথম থেকেই কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যে "স্বাধীনতা" পেযেছি তাতে মর্ণিং, আফটারনুন বা ইভনিং -- সবরকম শোতে বিদেশি ও বাংলা সিনেমা -- নতুন বা পুরোনো -- প্রায় সবই দেখা হয়ে গেছে। আর এই সময়েই বিকাশ রায় তাঁর তিনটি ছবিতে অসাধারণ বা ছাত্রজীবনের ভাষায় "দুর্ধর্ষ" অভিনয় করে ভালো বাংলা ছবিতে অপরিহার্য হয়ে পড়লেন। সে তিনটি ছবি হলো "বেয়াল্লিশ", "রত্নদীপ" আর "জিঘাংসা"। খুব নৃশংস মানুষের অভিনয়ের পাশাপাশি ভালো মানুষের অভিনয় তাঁর অভিনয়দক্ষতারই প্রমাণ। অর্থাৎ শুধু টাইপ নয়, নানা বিপরীতধর্মী চরিত্র বিকাশ রায়ের অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল-- যা বিদেশি ফিল্‌ম-এর নামকরা অভিনেতাদের কথাই মনে করিযে দেয়।


"রত্নদীপ" ছবিতে বিকাশ রায় ও অনুভা গুপ্ত

"জিঘাংসা" ছবিটির সূত্রে একটা জরুরি কথা মনে পড়ে যায়। "জরুরি" এইজন্যে যে এই ছবিটিতে তিনি প্রযোজক, অন্যতম প্রযোজক। কারণ ছবিটি করার সূত্রে অজয় কর, বীরেন নাগ এবং সুবোধ দাস ছিলেন সহযোগী। আর শুধু অভিনেতা হিসেবে যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক বেশী পাওয়া যায় প্রযোজক-অভিনেতা হিসেবে। এই মনোযোগ দেবার স্বাধীনতা তিনি পেযেছিলেন "হাউণ্ড অফ বাস্কারভিল" অবলম্বনে চিত্রনাট্য তৈরি করে নিতে গিয়ে। একইসঙ্গে অপরাধ ও রহস্যমূলক ছবি হিসেবে "জিঘাংসা" তখন পর্যন্ত বাংলা ছবিতে তুলনাহীন। তার পরের প্রযোজনায় তৈরি ছবি "শুভযাত্রা" এবং "সাজঘর" (সুচিত্রা সেন ছিলেন) কিন্তু তেমন জমেনি।

এইবার পরিচালক বিকাশ রায়ের আত্মপ্রকাশ। বোঝাই যায় যে তিনি নিজের পছন্দ ও রুচির স্বাধীনতা চাইছেন, যেজন্য অভিনেতা, প্রযোজক-অভিনেতা, পরিচালক-অভিনেতা -- এই তিন পর্বে "ত্রিবর্ণরঞ্জিত" হয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ। "অর্ধাঙ্গিনী" ছবি তাঁর প্রযোজনায়, পরিচালনায় এবং প্রধান চরিত্রের অভিনয়ে মুক্তি পায় এবং দর্শকদের প্রশংশাও পায়। এই সাফল্যের সূত্রেই "সূর্যমুখী"। ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমন্বয়ে এই ছবিটিও সফল। বিকাশ রায় নিজে তো ছিলেনই। ছবিতে গানের উৎকর্ষের দিকেও তাঁর মন গেল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এই ছবিতেই গেয়েছিলেন "আকাশের অস্তরাগে"।


"সূর্যমুখী" ছবিতে বিকাশ রায় ও সন্ধ্যারানী

আর তার পরের ছবি তো গানেরই ছবি। "বসন্তবাহার"। সুরকার ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী ছিলেন বড়ে গোলাম আলি, এ.টি কানন, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হীরাবাই বরোদেকর। পরিচালক বিকাশ রায় যে সঙ্গীতপ্রেমিক (আগেই বলেছি, মনে করুন, বিকাশ রায়ের বাবাও ছিলেন ভবানীপুর সঙ্গীত সমাজের "সক্রিয়" সদস্য) তার একটা বড় প্রমাণ এই ছবির গানের রেকর্ডিং-এর একটি ঘটনা। বড়ে গোলাম আলি খানকে দিয়ে এই ছবির সঙ্গে গান রেকর্ডিং করিয়ে বিকাশ রায়ের মনে হয়েছিল, ঠিক তাঁর মনের মতো হচ্ছে না। সে কথা বড়ে গোলামকে বলতেই তিনি বুঝলেন, পরিচালক ঠিক কী চাইছেন। দ্বিতীয়বার স্টুডিয়োতে বসে গান রেকর্ডিং করছেন যখন, তখন বিকাশ রায় তাঁর নিজের অনুভবটি ব্যক্ত করছেন এই ভাবে: "সুরমণ্ডলের তারে ঝংকার দিলেন তিনি, আর সুরের ঝরনাধারা নেমে এল। এবার গাইলেন তিনি অন্য ভঙ্গিতে। গাইতে গাইতে তিনি কাঁদলেন, রেকর্ড করতে করতে সত্যেন কাঁদলো, শুনতে শুনতে জ্ঞানবাবুও কাঁদলেন, আমি কাঁদলাম; আর কারো চোখ শুকনো রইল না।"

খুবই ভালো লেগেছিলো "মরুতীর্থ হিংলাজ" ছবি তাঁরই পরিচালনায়। হিংলাজের ভৌগোলিক পরিবেশ দিঘার বালিয়াড়িতে খুবই মানিয়েছিল। কাশী থেকে একজোড়া উট আনিয়ে "মরুভূমি" ষোলো কলায় পূর্ণ হয়েছিল। তাছাড়া যে সাঙ্গীতিক মাধুর্য "সূর্যমুখী" ছবি থেকে বিকাশ রায়ের পরিচালিত ছবির গুণগত মর্যাদা বাড়িয়েছিল তা এই ছবিতে প্রায় মাদকতাই এনে দিয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর ও গীতা দত্ত কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন "পথের ক্লান্তি ভুলে" গানটিতে। সেই গান এবং সংশ্লিষ্ট পরিবেশ এখনও ভুলতে পারিনি। একই সঙ্গে দক্ষ পরিচালক ও অভিনেতা তো বেশি পাওয়া যায় না! "আরোগ্য নিকেতন"-এর জীবনমশাই-এর অভিনয়, "কাঁচকাটা হীরে" কিংবা "উত্তরফাল্গুনী"-র অভিনয় যেমন ভোলা যায় না, তেমনি "সূর্যমুখী", "বসন্তবাহার", কিংবা "মরুতীর্থ হিংলাজ"-এর পরিচালক, কিংবা "কেরী সাহেবের মুনশী"-র মতো ছবির তথ্যসন্ধানী গবেষক-পরিচালক -- এক সঙ্গে এমন বহুগুণান্বিত চলচ্চিত্রজগতের মানুষ কজন আমরা পেয়েছি?


"আরোগ্য নিকেতন"-এর জীবনমশাই-এর ভূমিকায় বিকাশ রায়

কিন্তু এখানেই বিকাশ রায়ের পুরো পরিচয় শেষ হয় না। মঞ্চে তাঁর উৎসাহ অবশ্যই ছবির জগতের মত ছিল না। তবু "চৌরঙ্গী"-র স্যাটা বোসকে ভোলা মুশকিল। এ ছাড়াও "আসামী হাজির", "বিষ" কিংবা "নহবৎ"-এর মঞ্চাভিনয় তাঁকে মনে রাখবে বহুকাল। মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা" উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি স্টেজের জন্য। অর্থৎ যাকে বলা যেতে পারে "মঞ্চের শ্রুতিনাটক"। হয়তো নাটকের মতো রঙ্গমঞ্চে বেশিদিন ধরে রাখা যায় না এই "শ্রুতিনাটক", তবু সময়ের ব্যবধানে ভালো না লাগার কথা নয়।

বোঝা যায়, অভিনয়জগতে "প্রথাগত" পরিচালনা, প্রযোজনা বা অভিনয় বিকাশ রায়কে কষ্টই দিত। সেই কষ্ট থেকেই বাধ্যবাধকতার মধ্যে অভিনয়ের "চরিত্র-বৈচিত্র্যের" দিকেও ঝুঁকছিলেন, নাট্যরূপের মধ্যেও দৃশ্য ও শ্রাব্য রূপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেযেছিলেন। মনে হয় এই শক্তিশালী, বৈচিত্র্যমুখী অভিনেতার সঠিক মূল্যায়ন এখনো হয়নি।


লেখক পরিচিতিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্তন অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের প্রধান। একসময়ে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা ও রেজিস্ট্রারের কাজ করেছেন। বর্তমান বাংলাসাহিত্যের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে এক উজ্জ্বল উপস্থিতি। গবেষণার মুখ্য বিষয় রবীন্দ্রসাহিত্য আর বাংলা উপন্যাস ও ছোটোগল্প। চল্লিশের বেশী বই লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.