ভ্রমণ কাহিনী

জুলাই ৩০, ২০১৫
ত্রিভুজের ফাঁদে
সুবীণ দাশ
সেবার তুতিকোরিণ বন্দরে বয়ে আনা মাল খালাস প্রায় শেষের দিকে, জাহাজের মালিকদের কাছ থেকে খবর এল চেন্নাই থেকে রাস্তা তৈরির পাথর জাহাজে তুলে যেতে হবে আমেরিকার ন্যুয়ার্ক বন্দরে। ঘি-মধুর দেশে সোনার নয়, পাথরের সড়ক তৈরি হবে। তুতিকোরিণ থেকে জাহাজ চলল চেন্নাই বন্দরে। আমি জাহাজের বাস্তুকার - মানে ইঞ্জিনীয়ার। জাহাজের দিকনির্ণয় করি না ঠিকই, কিন্তু আমরা কয়েকজন মিলে কলকব্জার এই বিশাল ইস্পাতের দানবকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে রাখি।
জাহাজে পাথর ভরা শুরু যখন হল তখন লোহার খোলে একটানা পাথর পড়ার শব্দে আমাদের সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু পাথর ভরার কাজটা শব্দহীন ভাবে করার কৌশল কেউ এখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি। কাজেই গর্জনে সকলের কান ঝালাপালা।
যদিও মনে হয় সমুদ্রে জাহাজের চলার পথে কোন বাধা নিষেধ নেই, নেই কোনও তৈরি করা রাস্তা, কিন্তু সেটা আসলে ভুল। জলের ওপরও বিশেষ কিছু পথ আছে যেখান দিয়ে জাহাজ নিয়ে গেলে দুটি বন্দরের মধ্যে দূরত্ব অনেকখানি কমে যায়, তাতে জ্বালানি বাঁচে অনেক। জাহাজের দিকনির্ণয় করে দেয় ন্যাভিগেশন। চেন্নাই বন্দর থেকে ভেসে পড়ার দিন সে পথটির নির্দেশ পেলাম। কিন্তু যে পথ আমাদের নিতে বলা হল, আমাদের জাহাজ যে ভাবে এগোবে, তাতে আমরা সেই কুখ্যাত বারমুডা ত্রিভুজের মধ্যে গিয়ে পড়ব। কথাটা নাবিকদের মধ্যে চাউর হওয়া মাত্র শুরু হল চাপা গুঞ্জন, ফিস্ফাস্। সব আলোচনার মধ্যমণি বারমুডা ত্রিভুজ। সাত সমুদ্র তের নদী গুলে খেয়েও নাবিকেরা সব চেয়ে বেশি ভয় পায় এই অদৃশ্য ছোট্ট জায়গাটাকে।
জলের ঢেউয়ে ঢাকা ত্রিভুজ আকৃতির এত্তটুকু একটুখানি জায়গা। ত্রিভুজের এক কোণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা প্রদেশের মায়ামি শহর, অন্য এক কোনায় পোর্তুরিকো দ্বীপের রিও হেইনা বন্দর,আর শেষ কোণ থেকে নাক বরাবর গেলে নারকেল গাছের সারিতে মোড়া বারমুডা দ্বীপ। এই ত্রিভুজের আয়তন ৩,৯০০,০০ বর্গ কিঃ/মিঃ, আর সেখানে অতলান্ত সাগরের গভীরতা প্রায় ৪,২৬৭মিটারের মতো। দুনিয়া জোড়া বিশাল দরিয়ায় সামান্য একটুকরো ত্রিভুজ। জায়গাটা আড়াআড়ি ভাবে পেরোতে যে কোন জাহাজের মোটামুটি চার থেকে পাঁচদিন লেগে যায়।
বারমুডা ত্রিভুজের কুখ্যাতি জগত জোড়া। এই ত্রিভুজের আওতার মধ্যে বহু জাহাজ, উড়ো জাহাজ, এবং বিভিন্ন জলযান হারিয়ে গেছে; মানে পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে উপে গেছে। অনেক অনুসন্ধান করেও সেগুলো আর কোনদিন কেউ খুঁজে পায়নি। আমরা জাহাজি। কোন জাহাজের কখন কী ঘটেছে সে সম্বন্ধে খোঁজখবর সকলেরই নখদর্পণে। তাই আমাদের জাহাজের নাবিকদের গল্পগাছার মধ্যে ঘুরেফিরে এল ভৌতিকভাবে হারিয়ে যাওয়া সেই সব জাহাজের ভয়াবহ খবর।
বারমুডা ত্রিভুজ সম্পর্কে প্রথম জানা খবর হল একটা পণ্যবাহী জাহাজ চলতে চলতে নিখোঁজ হয়ে গেছিল। তারপর গেল আমেরিকান নৌসেনার উড়ান নম্বর ১৯-এর ছটি উড়ো জাহাজ, একেবারে এক সঙ্গে। তারপর জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা ডোনাল্ড ক্রোহারস্ট্ আর তাঁর ছোট সৌখিন ইয়াট, আর একটা নাম না জানা জাহাজ যখন হারাল, শোনা যায় আমেরিকান নৌসেনা সেটা খুঁজে পেয়েছিল এই ত্রিভুজের আয়তনের মধ্যে। জাহাজের রান্নাঘরে তখনও চুলো জ্বলছে, তৈরি করা খাবার রাখা টেবিলে। জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ, কিন্তু হাওয়া, আলো সবই চলছে স্বাভাবিক ভাবে। অথচ কোন মানুষ নেই। জাহাজের সব কটি মানুষকে কেউ যেন শুষে নিয়েছে!
আমাদের জাহাজ যতই সে অভিশপ্ত জায়গাটির দিকে এগিয়ে চলেছে, বুঝতে পারছি পোড় খাওয়া নাবিকেরাও কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। সকলেই চাপা থমথমে মুখে কাজ করছে। জাহাজিদের সেই বিখ্যাত ফূর্তি কেমন যেন স্তিমিত। সমস্ত জাহাজে সে এক দমবন্ধ করা অবস্থা।শেষপর্যন্ত ক্যাপ্টেন আর আমি ঠিক করলাম সবাইকে ডেকে সোজাসুজি কথা বলে ভয় ভাঙাবো। মিটিং করে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করছি ভয়ের কিছু নেই, কারোর কোন ক্ষতি হবে না। আমরা জাহাজ নিয়ে শান্তিতে পেরিয়ে যাব এই অভিশপ্ত ত্রিভুজ। কিন্তু ভবি ভোলার নয়।
নাবিকেরা এমনিতেই অসম্ভব কুসংস্কার-গ্রস্ত হয়। তার কারণ বোধহয় জীবনের বেশির ভাগ সময় তারা এমন একটা কাজে আর জায়গায় কাটায় যেখানে কোন কিছুরই স্থিরতা নেই। সমুদ্র এই মুহূর্তে কাচের মতন শান্ত, আবার ঘন্টা চারেকের মধ্যে এমন রূপ ধারণ করতে পারে যে জাহাজ প্রায় তলিয়ে যায় আর কী! মানুষের মনের তো এটাই ধর্ম। যা আমরা বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারি না, তাকেই অলৌকিক শক্তির ধারক ও বাহক বলে ভাবতে শুরু করি। তাই আজ পর্যন্ত বারমুডা ত্রিভুজ পৃথিবীর সব নাবিকের মনে এক অজানা আতঙ্কের বাসা বেঁধে রেখেছে।
ধীরে ধীরে আমাদের জাহাজ দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ত্রিভুজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেই সময়ে মধ্য অতলান্তিক মহাসাগর গ্রামের পুকুরের মত টলটলে, শান্ত স্নিগ্ধ।তরতর করে জাহাজ জল কেটে এগিয়ে চলেছে উত্তর আমেরিকার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ন্যুয়ার্ক বন্দরের দিকে। প্রথম দুটো দিন কেটে গেল নির্বঘ্নে। তবুও জাহাজে কারোর মুখে হাসি নেই; কাজের শেষে হৈহৈ করে আড্ডাও বন্ধ। মুখ বুজে যে যার কাজ করে যাচ্ছে আর সময় পেলেই দু-একজন জাহাজের ডেকে উঠে দূর-দূরান্তে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। মনে হয় কার আসার অপেক্ষায় আছে বুঝি!
তৃতীয় দিন রাত সাড়ে এগারোটার সময়ে জাহাজের ইঞ্জিন বিপদ সঙ্কেত বাজিয়ে দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। তখন মোটামুটি প্রায় সকলেই নিজের কেবিনে বিছানায় শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ইঞ্জিনের বিপদ ঘণ্টার একটানা গোঙানি শুনে লাফিয়ে উঠলাম! সব ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের সাহায্যকারী খালাসীরা দৌড়ে নামতে শুরু করেছে জাহাজের খোলে ইঞ্জিন-ঘরের গর্তে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে আমাকেও ছুটতে হল। হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে তো হবে! বড় মুখে সবাইকে সাহস দিয়েছি, এখন আমারই মনে ত্রিভুজের ভয় মাথা চাড়া দিতে লাগল। সেদিন প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছিল গলদ বের করে, সে সব সারিয়ে,আবার ইঞ্জিন চালু করতে।
অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার ও সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে ওপরে উঠে দেখি জাহাজ অসম্ভব চুপচাপ আর শান্ত; কানে আসছে শুধু ইঞ্জিন চলার শব্দ। যেদিকে যাই কেউ কোত্থাও নেই; কোন লোকেরই দেখা পাইনা। আস্তে আস্তে মনের ভয় জোরদার হতে লাগল। হাজার হলেও আমিও নাবিক,জাহাজ নিয়ে চলেছি বারমুডা ত্রিভুজ ভেদ করে। কিছু অঘটন তো ঘটতেই পারে। আমরা ক'জন জাহাজের সবচেয়ে নিচে ইঞ্জিনঘরে যখন ছিলাম, তখন ওপরের তলায় কিছু হয়ে গেল কি? কিছু ঘটলেও আমরা শুনতে পাব কী করে! কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সহকর্মী সঙ্গীসাথীরা? এই ঘোর অন্ধকারে বিশাল সমুদ্রের বুকে আমরা ছাড়া আর কেউ আছে কি? তারা ভরা আকাশের নিচে এই যন্ত্রদানবের বুকে শুধু কি আমরাই বেঁচে আছি? সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল।
বারমুডা ত্রিভুজে এত মানুষ অন্তর্ধানের কোন কূলকিনারা না পেয়ে বহু অনুসন্ধানকারী বেশ কিছু আজব সমাধান পেশ করেছে। সব থেকে চালু ধারণা হল অন্য গ্রহের জীব পৃথিবীতে এসে এখান থেকে তাদের উড়ন্ত চাকিতে ভরে মানুষ নিয়ে গেছে। ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল; চারদিকে কেমন যেন শীত শীত ভাব। এ অবস্থায় কীই বা করতে পারি আমি! পরের মুহূর্তে মনে হল কেউ নেই, তবে কার পাহারায় জাহাজ সুস্থ ভাবে ঠিকঠাক পথে চলেছে? আরও ভয়ানক এক সম্ভাবনায় হৃদপিণ্ড চেপে ধরল কেউ।
চিন্তাটা মাথায় নিয়েই এক দৌড়ে চারতলার সিঁড়ি ভেঙে ব্রিজের বন্ধ দরজার সামনে উপস্থিত হলাম। জাহাজ যখন চলে, তখন ব্রিজটা অন্ধকার করে রাখা হয়। শুধু ম্যাপ দেখার সুবিধের জন্যে চার্ট টেবিলের বাতি অল্প জ্বালিয়ে রাখা হয়। অনেক সময়ে স্বল্প পাওয়ারের লাল বাতি জ্বলে সেখানে। এহেন অন্ধকারের কারণ মাঝ সমুদ্রে বা নদীতে কোন আলোর বন্দোবস্ত করা যায় না। সমুদ্র থাকে অন্ধকারে ঢাকা। সেই অন্ধকারে যদি দেখতে হয় তবে মানুষকেও অন্ধকারে নিজের দৃষ্টি সইয়ে নিতে হয়। অন্ধকারেও যে পরিষ্কার দেখা যায় তা যারা অন্ধকারে কাজ করে তারাই জানে।
ব্রিজের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। আলোর জায়গা থেকে সদ্য এসেছি, চোখ তখনো সহ্য হয়নি। চোখ বুজে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অল্পক্ষণ পরে চোখ খুলে দেখলাম কিছু ছায়া নড়ছে চড়ছে! সেই ছায়ার একটা এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল ইঞ্জিন ঘরে সব ঠিকঠাক চলছে কিনা। জাহাজের ক্যাপ্টেন!
আমাকে ব্রিজের সামনের জানলার কাছে নিয়ে গিয়ে ক্যাপ্টেন দেখাল সেই অন্তহীন সমুদ্র দুধের মত সাদা কুয়াশায় ঢাকা। ভারি দইয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা ভেসে চলেছি। কুয়াশা এতই নিশ্ছিদ্র যে পাঁচ মিটার দূরের কোন জিনিষ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। রেডারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমরা এগিয়ে চলেছি। ক্যাপ্টেনকেও দেখলাম একটু চিন্তিত। এতক্ষণ পরিষ্কার আকাশের তলায় ভেসে হঠাৎ এই কুয়াশার কারণ কি! এও কি বারমুডা ত্রিভুজের রহস্য? বছরের এই সময়টায় মধ্য অতলান্তিক মহাসাগরে সচরাচর কুয়াশা ঘনায় না। একে তো চলেছি বারমুডা ত্রিভুজের মধ্যে দিয়ে, তার ওপর অসময়ের কুয়াশা! ব্যাপারটা কেউই ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। কিসের এক অজানা ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠলাম আমরা দুজনে।
জাহাজে নিচের ডেকে কেউ নেই কেন জিজ্ঞেস করায় ক্যাপ্টেন জানাল সবাই খোলা ডেকে গিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। বুঝলাম, জাহাজের প্রতিটি মানুষ এক অজানা ভয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া, চারদিকের অপ্রাকৃত কুয়াশা, সব মিলিয়ে জাহাজে এক অশরীরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাপারটা যে কাকতালীয়, তা কাকে বলব!
নাবিক সমাজের বিশ্বাস যারা এই বারমুডা ত্রিভুজে নিখোঁজ হয়েছে তাদের অতৃপ্ত আত্মা অন্যান্য জাহাজিদের তাদের সংসারে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আর তা যদি নাও হয়, অন্য গ্রহের অজানা জীব অবশ্যই উড়ন্ত চাকতিতে ভর করে পৃথিবীতে এসে অজানা গ্রহে তাদের নিয়ে যাবে। অসময়ের এই ঘন কুয়াশা জাহাজের সবার মন মারাত্মক ভীতিতে ভরিয়ে তুলল। এই অতিপ্রাকৃত অবস্থায় মানুষের পাশাপাশি আরও অনেক ছায়া শরীরী যেন রয়েছে - তাদের কখনই চোখে দেখা যায় না। সেই মুহূর্তে জাহাজের অন্য নাবিকদের সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক কথা বলে ভয় ভাঙ্গাতে গেলে জ্ঞানদাতার সলিল সমাধি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। প্রত্যেকের চিন্তা তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে সেখান থেকে সরে গেলাম।
আশায় ছিলাম দিনের আলো ফোটার সঙ্গে খালাসীদের আতঙ্ক কিছুটা কমবে। ভয়টা ভূতের না অন্য কোন আধিভৌতিক, মহাজাগতিক, অচেনা প্রাণীর, সেটা তখনও সঠিক বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝলাম এই ত্রিভুজের ভীতি নাবিকদের মনের বিরাট এক অংশ জুড়ে বসে আছে। এই ভৌতিক ত্রিভুজ ভয়ের জালে আমাদের জড়িয়ে রেখেছে।
বারমুডা ত্রিভুজ থেকে বাইরে বের হতে আর মাত্র দেড় দিন বাকি। সেই সময়ে কিছু না কিছু অদ্ভুত শব্দ জাহাজের আনাচ কানাচ থেকে ভেসে আসছে, নাবিকেরা প্রায় সকলেই তা শুনতে পাচ্ছে। পারতপক্ষে একা কেউ কোন অন্ধকার জায়গায় যেতে চাইছে না। সে এক দম বন্ধ করা বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেকে জোর গলায় বলল জাহাজের নানান জায়গায় ছায়া ছায়া মূর্তি তারা দেখেছে। যে মানুষগুলো কখনই ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে না, তারাও মনপ্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করছে। সমস্ত জাহাজ চুপচাপ, চারদিকে কবরের শান্তি! কেউ হাসছে না, আড্ডা দিচ্ছে না। আগের বন্দরে নেমে কে কী করবে তা নিয়ে কোন আলোচনা, হুল্লোড় নেই।
এত কিছুর মধ্যে ঘটল আর এক অঘটন। দুজন নাবিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, জানাল ইঞ্জিন সারেং। সারা জাহাজে হইচই পড়ে গেল, প্রায় সবাই জানাল দুপুরের খাওয়ার পর থেকে তাদের আর কেউ দেখেনি। ক্যাপ্টেনকে জানাল হল ঘটনাটি। বাকি সবাই ধরেই নিল এদের অন্য গ্রহের জীব তুলে নিয়ে গেছে, সবার দৃষ্টি এড়িয়ে। সব লোকেদের আলাদা আলাদা দলে ভাগ করে নিখোঁজ দুই নাবিকের সন্ধানে পুরো জাহাজটিতে তল্লাসি চালাতে পাঠান হল। একে একে ডেকের ঘরগুলিকে খুঁজতে যাওয়া পার্টিরা ফিরে এসে খবর দিল তারা খুঁজে পায়নি তাদের দুজন সহ নাবিকদের। বাকি ছিল ইঞ্জিন ঘর ও স্টিয়ারিং ঘর যারা খুঁজতে গেছিল। এদিকে ক্যাপ্টেন ও আমি ঠিক করছিলাম আমরা যতটা পথ পেরিয়ে এসেছি, জাহাজ ঘুরিয়ে তাদের খুঁজতে ততটা পথ আমরা ফিরব। তার সাথে বারমুডা ও আমেরিকার জল রক্ষী বাহিনীকে ও আমাদের জানাতে হবে। এই সাতপাঁচ যখন ভাবছি, তখন স্টিয়ারিং ফ্ল্যাট যে পার্টি খুঁজতে গেছিল তারা দেখি দুই হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের সঙ্গে নিয়ে ডেক অফিসে ঢুকছে। ওদের দেখে হাঁসব না কাঁদব না টেনে দুটো চড় কষাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না! জিজ্ঞাসা করাতে জানাল জাহাজ বাঁধার হাসিল (দড়ি) যে কামরায় গুছিয়ে রাখা হয়, তার মধ্যে গেছিল নির্ভাবনায় ঘুমবে বলে। যে জায়গায় জাহাজ থেকে লোকেরা বহুবার নিখোঁজ হয়েছে, যে পথটি পেরতে প্রতিটি নাবিকের আয়ু দশ বছর কমে যায়,সেখানে দুটি জলজ্যান্ত মানুষের নিখোঁজ হওয়া কতটা মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে, তা যাদের দেখতে হয়নি, তারা বুঝবেও না।
এক দুপুরে জাহাজ বারমুডা ত্রিভুজ থেকে বের হল- আমরা কাউকে খোয়াইনি, কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটেনি। ক্যাপ্টেন মাইকে কথাটা ঘোষণা করল- জাহাজ এখন খোলা মধ্য অতলান্তিক সমুদ্রে ভেসে চলেছে। এক নিমেষে পাল্টে গেল জাহাজের ভোল। নাবিকদের আনন্দ, চিৎকার, চেঁচামেচি আরম্ভ হল; নাচগান হল দেখার মতন। সন্ধেয় আবহাওয়া ভাল থাকার জন্য খোলা ডেকে পার্টির ব্যবস্থা জমল ভালই। সবার সে কী বাঁধভাঙা আনন্দ ফূর্তি!
এত আতঙ্কের পরেও কিন্তু একজনের মুখে শুনলাম না আর কখনই আমরা ওই অভিশপ্ত ত্রিভুজের মধ্যে দিয়ে জাহাজ ভাসাব না। শহর বন্দরে মানুষের থেকে নাবিক জাতটাই আলাদা। এরা ভয় পাবে, অশরীরীর ছায়া দেখবে জাহাজে, তবু সমুদ্র ছেড়ে শক্ত মাটিতে চাকরি করতে যাবে না। এত সন্ত্রাসের পর যদি এই অভিশপ্ত ত্রিভুজের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাও সই, কিন্তু সমুদ্রকে 'অল-বিদা' বলে তাকে ত্যাগ করবে না।
লেখক পরিচিতি - মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক। চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বহু বছর নানান সাগর ঘুরে এখন অবসর নিয়েছেন। বেড়াতে ভালোবাসেন, ছবি তুলতেও।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।