প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

অক্টোবর ৩০, ২০১৬

 

বিলাত ফেরৎ (প্রথম পর্ব)

ভাস্কর বসু

লন্ডন ও তার আশেপাশে
--১--
রাজধানী


“নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
'বিলেত ফেরনি?' প্রবাসী-বন্ধু ক'ন, 'এই তব বিদ্যে, ছি!'”

বিলেত দেশটা মাটির কিনা তা দেখতে যাওয়ার জন্য ঐ নজরুলের দুটি লাইন এক্কেবারে যাকে বলে “আমার কৈফিয়ত”। লন্ডন এর হিথরো এয়ারপোর্ট সম্পর্কে আগেই অনেক ট্র্যাজিক কাহিনী শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাতে কর্ণপাত করিনি। আমার আগের বার মাত্র দশঘন্টার লন্ডন ভ্রমণের সুখকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটা ১৯৯৪ সাল।  ট্রানজিট ভিসা পাওয়া যাবে কিনা ছিল সংশয়। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের ভদ্রলোক নাম দেখেই জিজ্ঞেস করলেন আমি “বোস স্পীকার” খ্যাত অমর বোসের আত্মীয় কিনা। বললাম একেবারে না হলেও লতায় পাতায় কুটুম্বিতা ---- !! “গ্রেট গায়, গ্রেট স্পীকার” – বলে আমার পাসপোর্টে ছাপ মেরে দিলেন। খুব অল্প সময়ে কাজ সাঙ্গ হয়েছিল। এবারে কিন্তু বিশাল লাইন। আর লাইনের চরিত্র দেখে যদি বড় বাজারের কথা মনে পড়ে যায়, তাহলে দোষণীয় নয়। দুর, দুর! এই কি বিলেতের এয়ারপোর্ট? ঢের ভাল আমাদের ব্যাঙ্গালোরের হাওয়াই আড্ডা, আর দিল্লীর T3 Terminal – তার কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। বেশ দম বন্ধকরা পরিবেশ, সেখানে দুটি বাচ্চা আবার মনের সুখে কাঁদতে লেগেছে। তাই সব কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে গাড়ী তে উঠে বেশ মুক্তির আনন্দ। তারপর প্যাডিংটন স্টেশনের কাছে আমাদের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় রাত নটা।
        সেদিন আর কিছুই করার নেই। তবু বাইরে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটতে গিয়েই বেশ একটা ‘কাছের মানুষ’ অনুভূতি এল।
        প্যাডিংটন স্টেশনটি বেশ বিখ্যাত। তার থেকে কিছু দূরেই সারি সারি হোটেল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কিন্তু তাহলেও হাওড়া-শিয়ালদহর সঙ্গে খানিকটা পরিচিতি দেখে আমরা উল্লসিত।



ছবি – ১ - লন্ডনের হোটেলের সামনে



ছবি – ২ - প্যাডিংটন স্টেশনের কাছে হোটেলের সারি – আমাদের পরিচিত দৃশ্য

পরদিন লন্ডনে দোতলা বাসে সফর করতে গিয়ে পুরো ছোটবেলা ফিরে এল। সত্তর-আশির দশকে যারা কলকাতাতে দোতলা বাসে চড়ে শহর ঘুরে দেখেছে, তারাই এর মাধুর্য বুঝতে পারবে। দোতলা বাসের কিছুটা ঢাকা, কিছুটা খোলা।



ছবি – ৩ – খোলা বাসে লন্ডন ভ্রমণ

                খোলা জায়গাতে বসে ঘুরতে ঘরতে আমরা দেখে ফেললাম, বিগ বেন, হাইড পার্ক, ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে, ট্রফালগার স্কোয়ার, বাকিংহাম প্যালেস এর মত সুন্দর জায়গা গুলি। সময় কম, তাই মাদাম তুসো তে এসে লাইনে দাঁড়ালাম।



ছবি – ৪ বিখ্যাত বিগ বেন

     আমার এক শুভানুধ্যায়ী দম্পতি আমাকে বারংবার বলেছিল, “কাকু, তুমি এত কোন্যান ডয়েল ফ্যান, মাদাম তুসো দর্শন থেকে সময় বার করে ঐ রাস্তাতেই ২২১বি, বেকার স্ট্রীটে শার্লক হোমস মুজিয়ামটা ঢুঁ মের। মিস কোর না!” কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। কাজেই মাদাম তুসোতে সব মোমের পুতুলের পাশে পোজ দিয়ে ফটো তোলাতে অনেক সময় নষ্ট করতেই হল।  ডায়ানার সঙ্গে সস্ত্রীক ছবি তোলা হল।  এসব ছবি না হলে প্রমাণ দাখিল করা যাবে না। আর ভারতীয়দের মূর্তি গুলি দেখলে রাগে গা জ্বলে, এত খারাপ শিল্পী আছে এরকম নামী একটা ম্যুজিয়মে? তবে তুসোতে দশ মিনিটের ঐ প্রাক্তন লন্ডন ভ্রমণ ভারী চমৎকার। প্রায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। কিন্তু সেই করতে গিয়ে ডয়েল সাহেব বাদ পড়লেন। ভাবলুম এডিনবার্গ তো ওঁর জন্মস্থান, কিন্তু --- সে কথা যথাস্থানে।



ছবি – ৫  ডায়ানার সাথে ছবি – মাদাম তুসো

        টেমসের বুকে সফর কিন্তু বেশ মনোগ্রাহী। নদীর পাড় থেকে দেখা যায় ওঁদের বিধানসভা। আরো সুন্দর সন্দর হর্ম্যরাজি। এছাড়া ও লন্ডন ব্রিজগুলোর তলা দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও বেশ মনোরম। আমরা যাচ্ছিলাম গোধূলি লগনে, হাওয়া হাওয়ায় খুশীর সানাই। লন্ডনে সেদিন রীতিমত গরম ছিল, বাসে ঘুরে আমরা বেশ ক্লান্তই ছিলাম। এই ভ্রমণ যেন আমাদের একেবারে তরতাজা করে দিল।



ছবি – ৬ ভ্রমণ-কালীন দেখা যেতে পারে নদীতীরবর্তী আইনসভা

        এরপরে শেষ ভ্রমণ ছিল “কোকাকোলা লন্ডন আই”! এটি কিন্তু বেশ সুন্দর ব্যবস্থা। এখানে একটি অত্যুচ্চ নাগরদোলা রাখা আছে। নাগরদোলার বসার জায়গাগুলি পুরোপুরি বদ্ধ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। চারদিক আটকানো, কাজেই এই নাগরদোলাতে একেবারেই পড়ার ভয় নেই। ভেতরে খুব ভাল বসার জায়গা আছে। খুবই মন্দ-মন্থর গতিতে ঘোরে, কাজেই মাথা ঘোরা বা আনুষঙ্গিক অসুস্থতার সম্ভাবনা প্রায় নির্মূল।



ছবি – ৭ লন্ডন আই কোকাকোলা – মন্থর গতি নাগরদোলা থেকে লন্ডন দর্শন

        কিন্তু এভাবে পুরো লন্ডনের একটি অসম্ভব সুন্দর “পক্ষী-চক্ষু” দর্শন লাভ হয়। আস্তে আস্তে উচ্চতা বাড়তে থাকে তার ফলে দেখার জায়গার পরিধিও বাড়তে থাকে। একবার ওঠার সময় একদিক আর নামার সময় তার উল্টো দিক দেখা সম্ভব। আস্তে আস্তে যখন উঠছি, লন্ডন ছাড়িয়েও দূরে তার তার গ্রামাঞ্চলের কিছু দৃশ্যও চোখে পড়ে। গতিবেগও খুব অল্প, প্রায় বোঝাই যায়না। আস্তে আস্তে সিনেমার ট্রলি ক্যামেরার মত যেন উঠে যায়, আর সেই সঙ্গে ছবিগুলি পাল্টে যেতে থাকে। যাঁরা লন্ডনে যেতে চান, তাঁদের অনুরোধ করব এই অভিজ্ঞতাটি থেকে নিজেকে বঞ্চিত না করতে। তবে একটা কথা – আমরা কিন্তু খুব আশা করেছিলুম যে ‘কোকাকোলা’র টিকিট কাটলে ভ্রমণ-কালীন বিনি-পয়সাতে কোকাকোলা পাওয়া যাবে। জিজ্ঞেস করতে সহাস্য তরুণী জবাব দিলেন, আপাতত এরকম কোন ব্যবস্থা নেই, অদূর ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে।



ছবি – ৮ লন্ডন ব্রিজ – রাতের আলোকমালাতে অন্য রূপ



ছবি – ৯ রাত্রের অপরূপা লন্ডন নগরী

        লন্ডনকে দেখে কলকাতার কথা না মনে পড়ে উপায় নেই। কেমন যেন ভীষণ আপন, আপন ভাব। রাস্তাঘাটে ভিড়, বাঁদিকে গাড়ী চলা, ফুটপাতেও বেশ অনেক লোক, কাজের দিনেও দুপুর বেলাতে বহু লোক রাস্তাতে ঘুরছে, হাইড পার্কেও বেশ লোক সমাগম – সব মিলিয়ে “সরগরম কিংবা বাইরে রাস্তা পানের দোকান” – অবশ্য রেডিওতে হঠাৎ কোন পুরনো গান বাজছে কিনা জানিনা, - শোনা হয়নি।



ছবি – ১০ – অনেকটা যেন কলকাতা



ছবি – ১১ – বড় চেনা লাগে, রাস্তা ঘাটের মানুষজন

        কলকাতাকে লন্ডন করার পরিকল্পনা নিয়ে বেশ হাসাহাসি হত। কিন্তু কিছু পরিকল্পনা কিন্তু বাস্তবায়িত করা সম্ভব। যেমন ধরা যাক, দোতলা বাসে শহর ভ্রমণ। আমাদের নিশ্চয় পুরনো বাস আছে। সেগুলিকে যদি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে এভাবে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে তা কার্যকরী হবে।

এমনকি কোকাকোলা কলকাতা আই ও নিঃসন্দেহে করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন উচ্চতা থেকে “City of Joy” কে পরিদর্শনের এমন অনন্য অভিজ্ঞতাও হতে পারে – সঙ্গে বিনি-পয়সার কোকাকোলা  বা অন্য কিছু –কে স্পন্সর করবেন তার উপর নির্ভর করে তা ঠিক করা যেতে পারে।  সম্প্রতি কানাঘুষো শুনছি যে নাকি কিছু ভাবনা চিন্তা হচ্ছে। আমি তো যারপরনাই আনন্দিত। ভাবা যায়, পুজোর সময়ে অনেক দূর দূর থেকে আসা যাত্রীরা অনেক ওপর থেকে ও বিভিন্ন পুজোর সাজ দেখতে পারবেন!

যাঁরা পরে লন্ডন ভ্রমণ করবেন, তাঁদের কাছে আমার কতিপয় নিবেদন আছে। লন্ডনে কিন্তু অন্তত: দুদিন ঘুরে না দেখলে আমার মতই কপাল চাপড়াতে হবে। শার্লক হোমস মিউজিয়ামটা না দেখতে পারাটা খুব বড় মিস। এছাড়া লর্ডস এর কাছেই ছিলাম, কিন্তু তালে গোলে আর দেখা হল না। ভাবুন তো ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে কিরকম দুর্ভাগ্যজনক! সেই বিখ্যাত ব্যালকনি – যেখানে নাকি ১৯৮৩ সালের ২৫শে জুন ভারতীয় ক্রিকেটের জয়পতাকা উড়িয়েছিলেন কপিলদেব ও তাঁর সতীর্থরা। আর ঐ ব্যালকনি থেকেই তো জামা খুলে উড়িয়েছিলেন ‘দাদা’!  তাছাড়া বাকিংহাম প্যালেসের গার্ড পাল্টানো বা ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে তে যাওয়া বা হাইড পার্কে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালেও ভাল লাগবে। হাজার হোক এইটাই তো আসল বিলেত। এছাড়া লন্ডনের আনাচে কানাচে বহু শিল্প-সাহিত্যের, খেলাধুলোর, সিনেমার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, একটু খোঁজ করে গেলে তাও সুচারুভাবে দেখে নিতে পারেন। চার্লস ডিকেন্সের স্মৃতি বিজড়িত বেশ কিছু জায়গাও আছে, আছে সেই কোহিনূর হীরাটি। আমি অন্তত: আর একবার যাবোই।

আর যদি আপনাদের দলে তিনি-চারজন একসঙ্গে থাকেন, তাহলে ট্যাক্সি কিন্তু হরে দরে হপ-অন হপ অফ বা মেট্রোর চেয়ে সস্তা পড়তে পারে। এতে অনেক সময় বেঁচে যাবে, তাতে আপনারা আরো কিছু জায়গা দেখে নিতে পারেন। তবে একা বা দোকা হলে গত্যন্তর নেই, বাস বা মেট্রোই ভাল, ট্যাক্সির দাম চড়া।

যাই হোক, পরের দিন আবার যাচ্ছি ওয়ারউইক প্যালেস, অক্সফোর্ড আর সেই স্ট্র্যাফোর্ডশায়ারের ‘Bard of Avon’ এর বাড়ী দেখতে।

---২---
ওয়ারউইক, স্ট্রাফোর্ডশায়ার, অক্সফোর্ড

        নীরদ চৌধুরী বরাবর অক্সফোর্ড এ থাকতেন। তাঁকে একবার কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি ভারতবর্ষে ফেরার কথা ভাবেন না কেন। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে শারীরিক ভাবে তিনি খুবই দুর্বল মানুষ। তা সত্ত্বেও তিনি যে এতদিন বেঁচে ছিলেন তার একমাত্র কারণ অক্সফোর্ডের ঐ অপূর্ব জল-হাওয়া। নীরদবাবুর বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে। প্রাক স্বাধীনতা আমলের সেই কিশোরগঞ্জের পরমা প্রকৃতি তাঁকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। পরবর্তী কালে তিনি যখন অক্সফোর্ড এ থাকতেন আর সান্ধ্য-ভ্রমণে বার হতেন, তাঁর নাকি বারে বারে কৈশোরের কথা মনে আসত। সেই রকম আকাশ, সেই রকম খোলা মাঠ, হাওয়া। 

        আমরা যখন লন্ডন থেকে বেরিয়ে ওয়ারউইক প্রাসাদের দিকে যাচ্ছিলাম, সেই রাস্তা আর আশপাশ দেখে আমার নীরদবাবুর এই কথাগুলি বারবার মনে পড়ছিল। ষাটের দশকে আমাদের ছোটবেলাতেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও এরকম সুন্দর পরিবেশ ছিল। শীতকালে আমরা যখন সদলবলে লরি বা ট্রেনে চেপে পিকনিক করতে বারুইপুর, জয়নগর বা ডায়মন্ড হারবার যেতাম ঠিক একই রকম ফাঁকা মাঠা, ধান ক্ষেত, ছোট ছোট বাড়ি চোখে পড়ত। এত দূষণ ছিল না, আকাশ ছিল পরিষ্কার,- শীতের দিনে রোদ এসে পড়ত গাছের ডালে ডালে। নীরদবাবুর মত আমারও মনে পড়ছিল কৈশোরের সেই চড়ুইভাতি করতে যাওয়ার দিনগুলির কথা। 
বনলতা সেনকে পাওয়ার জন্য হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছিলেন কবি। হাজার বছর ধরে অনেক কীর্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়ারউইক প্রাসাদ। শেকসপীয়ার এর স্মৃতি বিজড়িত “এভন” নদীর তীরেই এই প্রাসাদটি, একাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়।     

        এখন এই প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন মারলিন এন্টারটেইনমেন্ট বলে একটি কোম্পানি যাঁরা তুসো মুজিয়মটির ও দেখা শোনা করেন। আহা, আমাদের কেন এরকম কোন সংস্থা নেই যারা পেশাদার ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন? এই ব্যবসা লাভজনক ও হবে আবার তার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিরও ঠিকঠাক দেখাশোনাও হবে। কেউ যদি এই নিয়ে গবেষণা করতে চান, তার পক্ষেও একটু নিরিবিলিতে বেশ কিছুদিন বসে তা করা সম্ভব। সংস্থার পক্ষ থেকে সেরকম ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। সরকার আর কতদিক দেখবেন?

এই প্রাসাদের সামনে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। সেইখানে বহু ভ্রমণার্থীর ভিড়।



ছবি – ১২ - ওয়ারউইক প্রাসাদের প্রাঙ্গণ

একটি বলিদান যজ্ঞের অনুষ্ঠানের জায়গা রয়েছে, সহজ ভাষায় যাকে বলে ‘হাড়িকাঠ’। সে যুগে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড খুব কার্যকরী ছিল। আজ সব্বাই সেখানে ছবি তুলছেন।



ছবি – ১৩ – হাড়িকাঠে মাথা

        প্রাসাদের ভিতরে ঢুকলে সত্যিই মন ভরে যায়। তখনকার দিনে রাজা বা জমিদারদের পঠন পাঠনের ও বিশেষ শখ ছিল তা বোঝা যায় তাঁদের গ্রন্থাগার দেখলে।



ছবি – ১৪ – সুসজ্জিত গ্রন্থাগার

        আরো আছে সুসজ্জিত শয়নকক্ষ, শৌচালয়, রান্নাঘর, সাজঘর – সত্যি তারিফ করতে হয় এই তত্ত্বাবধায়কদের।  সব কিছুই রাখা হয়েছে ঐতিহ্য কে বজায় রেখে। আবার আধুনিক চিন্তা-ভাবনা বা প্রযুক্তিরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এই মেলবন্ধনটি ও সুচারু ভাবে সম্পন্ন। সত্যিই শিক্ষণীয়।

এই প্রাসাদে নাকি ভূতেরা মাঝে মাঝে দেখা দেন। তবে সব্বাই তো আর অত ভাগ্যবান নন। সেই কথা ভেবে কর্তৃপক্ষ কিছু “সাজানো” ভূতের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তাঁদের ওয়েবসাইটে (https://www.warwick-castle.com/)  তার খবর পাওয়া যাবে।

আমার মনে হচ্ছিল, শরদিন্দু তো নেই, অন্তত শীর্ষেন্দু যদি কিছুদিন এখানে থেকে যেতে পারতেন, তাঁর কলমের ডগা দিয়ে সুড়সুড় করে বেশ কিছু অতি উৎকৃষ্ট সাহেবি ভূতের গল্প-উপন্যাস বেরিয়ে আসতে পারত। ‘নবীগঞ্জের দৈত্য’ বা ‘গোঁসাইবাগানের ভূত” এর চেয়ে তারা কম চিত্তাকর্ষক হতনা।

এরপরেই আমরা রওয়ানা দিলাম সেই বহু প্রতীক্ষিত শেকসপীয়ারের বাড়ির দিকে। প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে যাবার মত।



ছবি –১৫ – সেই তীর্থস্থান –

        বাড়িটিকে চার্লস ডিকেন্স ও অন্যান্য সাহিত্যিকেরা কিনে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন উনবিংশ শতাব্দীতে। প্রথম ডিকেন্স ওখানে যান ১৮৩৮ – ১৮৪০ সালে, তখনো অবধি বাড়িটির মালিকানা বেসরকারি হাতেই ছিল। ১৮৪৭ সাল নাগাদ ডিকেন্স ও তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা মিলে বাড়িটি কেনার ব্যবস্থা করেন। নেতৃত্বে ছিলেন ডিকেন্স স্বয়ং। এক পূর্ববর্তী সাহিত্যিক, যাঁকে তিনি প্রায় ভগবান মনে করতেন তাঁর জন্য ডিকেন্সের এই প্রচেষ্টার কথা আজও সেখানে বেড়াতে গেলে গাইডরা গর্বভরে শুনিয়ে থাকেন। শেকসপীয়ারের জন্মের ঠিক তিনশো বছর পর, ১৮৬৪  সাল নাগাদ যখন ডিকেন্স আবার সেখানে যান। সেই সময় খুব উৎসাহের সঙ্গে বর্ষপূর্তি উৎসব হয়।  শেকসপীয়ারের বাবা চর্মশিল্পী ছিলেন। এখনো বেশ অনেক গ্লাভস রাখা আছে। এমনকি সুন্দর করে লেখাও আছে কিভাবে শেকসপীয়ারের কাব্যে বাবার জীবিকার প্রভাব পড়েছিল। তিনি ছিলেন খুবই সুদক্ষ শিল্পী আর ব্যবসাটিও লাভজনক ছিল। প্রথমদিকে শেকসপীয়ার হাত লাগালেও অচিরেই হাতে তুলে নেন কলম। জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে বেশ আশ্চর্য অনুভূতি হয় কিন্তু। বেশ মনে হয় উনি যেন ঘোরাফেরা করছেন, কলমগুলিকেও বেশ সুন্দর করে রাখা আছে। শিলাইদহে, জোড়াসাঁকোতে বা শান্তিনিকেতনের ঘরগুলিতে এরকম আবহাওয়া তৈরী করলে মন্দ হতনা।

শেকসপীয়ারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ও একটি রূপ ফুটে ওঠে বাড়িটি ঘুরে দেখলে। তিনি কোথায় বসে লিখতেন, তাঁদের পারিবারিক খাবার জায়গা, উঠোন, দালান – সব কিছুর মধ্যেই এক আশ্চর্য রক্ষণাবেক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়।



ছবি – ১৬ – খাবার জায়গা, যত্নের ছাপ সর্বত্র - !!

        এরপর অক্সফোর্ড। আহা, কি সুন্দর এক শিক্ষা নগরী। রাস্তা জুড়ে বেশ কলেজ কলেজ ভাব।



ছবি – ১৭ – অক্সফোর্ডে একটি কলেজের প্রবেশপথ - !!

বহু ছাত্র ছাত্রীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অনেক ভারতীয়। সাইকেল হচ্ছে এক প্রধান যান। যে যাই বলুন, আমার কিন্তু একটু যাদবপুর-যাদবপুর ভাব লাগছিল। নিঃসন্দেহে অনেক বড় পরিসর, বড় বড় রাস্তা, ভেতর দিয়েও বাস যাতায়াত করছে। কিন্তু তাও – ছাত্র ছাত্রীদের আড্ডা মারা বা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকার ধরন যেন বেশ পরিচিত। সাইকেলে চড়ে গলি দিয়ে ও চলে যাচ্ছে ছেলে মেয়েরা।



ছবি – ১৮ –  গলি দিয়ে সাইকেল  - !!

এখনো যত্ন করে রাখা রয়েছে আগেকার টেলিফোন বুথ। এছাড়াও রয়েছে খুব সুন্দর পোস্ট বক্স। এতই সুন্দর যে সক্কলে মিলে ছবি তোলার লোভ সামলানো দায়।



ছবি – ১৯ – প্রায় মুছে যাওয়া অতীতের সেই সঙ্গী



লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।