ভ্রমণ কাহিনী

নভেম্বর, ১৫, ২০১৬
"ম্যাকলাস্কিগঞ্জ"( A Colony without Economy )
শশাঙ্কশেখর লাহিড়ি
সারা দেশে হৈ-হৈ করে রেল লাইন পাতা হচ্ছে। প্রচুর জমির দরকার সারাদেশে। ব্রিটিশরা জমি অধিগ্রহণ আইন করে রেলের জন্য জমি নিচ্ছে। ছোটনাগপুর অঞ্চলে নাকি প্রচুর খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। দামোদরের উপত্যকায় নাকি প্রচুর কয়লার ভাণ্ডার।
শ্রীকৃষ্ণের এক নাম দামোদর। যার নাকি উদরে (পেটে) দাম আছে, মানে অঙ্গার আছে। খনিজ সম্পদ রেলে বহন করে বন্দরে অব্দি নিয়ে আস্তে হবে। তারপর সেই খনিজ সম্পদ জাহাজে করে বিদেশে পাড়ি দেবে। সাংঘাতিক মুনাফা সেই ব্যবসায়। বিভিন্ন বিলেতি কোম্পানির মধ্যে রেষারেষি লেগে গেল খনি ইজারা নেওয়ার। পৃথিবী জুড়ে লোহার চাহিদা বেড়েছে। লৌহ আকরিক গলিয়ে লোহা বের করতে প্রচুর কয়লার দরকার। তাই খনি এলাকা দিয়ে একটা লাইন পাতার চিন্তা ভাবনা সাহেবদের মাথায় এল।
গোমো থেকে লাইন পাতা শুরু হয়ে ডাল্টনগঞ্জ ছুঁয়ে ডেহেরি অবধি। এই লাইনটাকে রেলের লোকেরা বলে সি আই সি সেকশন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে রেল লাইন। আগে রেলের স্লিপার কাঠের হতো। প্রচুর কাঠের চাহিদা বেড়ে গেল। জঙ্গলের প্রচুর গাছ কাটা পড়লো। কলকাতা থেকে বাঙালি বাবুদের কাঠের স্লিপারের বরাত দেওয়া হল। এই ফাঁকে কিছু বাবু আর্থিক দিক দিয়ে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছিল। ডাল্টনগঞ্জে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ওঁদের পরিবার নাকি কাঠের স্লিপার সাপ্লাই দিয়ে ব্রিটিশদের এতো খুশি করেছিল যে তাদের পরিবারের এক সদস্যকে রায়বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল তারা।
চাকুরী জীবনের প্রথমে ডালটনগঞ্জের কাছে গিয়েছিলাম। তার অনেক আগেই "পালামৌ এর পথে" পড়েছি উচ্চ মাধ্যমিকে। ভাবতেই পারিনি যে আমাকেও চাকুরী করতে যেতে হবে পালামৌ এর জঙ্গলে। বুদ্ধদেব গুহর লেখায় জেনেছিলাম কেচকি, বেতলা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কথা। ট্রেনে ডাল্টনগঞ্জ যাওয়ার পথে প্রথম দেখলাম আমার স্বপ্নের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশন। স্টেশনের প্লাটফর্ম এ হলুদ বোর্ডের মধ্যে কালো কালি দিয়ে লেখা অদ্ভুত একটা ইংরেজি বানান।
জঙ্গলের মধ্যে ট্রেন কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াত। স্টেশনের আশেপাশে কিছু পুরনো বাংলো দেখতাম। দেখতাম প্রচুর আমের গাছ। গরমের সময় ঠিক বিকেলের দিকে হাওড়াগামী ট্রেন এসে পৌঁছত ম্যাকলাস্কিতে। প্লাটফর্ম চত্বরে কিছু লোক নানান জাতের গাছ পাকা আম বিক্রি করত। এই ম্যাকলাস্কিতেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ছাতা পোড়া আম। আমাদের দেশের বাড়িতে একটা গাছ ছিল ছাতা পোড়ার। সে আমের স্বাদ ভোলার নয়। সেই আম কিছু কিনে এনে বাবাকে দিয়েছিলাম।। বাবা দেখে অবাক হয়েছিলেন।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেল লাইন পাতার কাজ চলছে পুরোদমে। সাহেবরা বাঙালি বাবু আর বিহারি কুলিদের নিয়ে ঘন জঙ্গল কেটে রেল লাইন পেতে চলেছে মাইলের পর মাইল। প্রায় প্রতিদিন বাঘ মেরে সাহেব ছবি তোলে। মাথায় টুপি, হাতে বন্দুক। সামনে বাঘ শুয়ে আছে। সাহেবের একটা পা বাঘের পেটের উপর। সাহেব বেশ গর্বিত বাঘ মেরে। আশেপাশে সবাই সাহেবকে ঘিরে আছে। সেই সাদাকালো ফটো ফ্রেম বন্দি হয়ে সাহেবের ঘরের নাকি শোভা বাড়াত।
জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা সাহেবদের বেশ ভালো লাগলো। ঠিক ইংল্যান্ডের মতন পরিবেশ কিছুটা। আবহাওয়া সারা বৎসরই বেশ মনোরম। বেশ জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। জায়গাটা ঠিক বিলেতের মতন। মালভূমি অঞ্চল। চারিদিকে উঁচু নিচু জমি। ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর জায়গা। সাহেবদের ঘরোয়া টেবিলে জায়গাটা একটা আলোড়ন তুলল। এ যেন মিনি লন্ডন অফ ইন্ডিয়া।
এদিকে বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডের অর্থনীতির কোমর আস্তে আস্তে ভাঙছে। কলকাতার সাহেব কোম্পানির অফিসের ঝাঁপি আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। অ্যাংলো সাহেবদের চাকুরী থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে অ্যাংলো সাহেবদের সংখ্যা বেশ সারা দেশে। অফিস কাছারিতে তাদের ভীষণ দাপট। তারা খুব সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে আর নাকি নির্ভুল টাইপ করতে পারে। অফিসের আদব-কায়দা বেশ জানে। বিলেতের সাহেবরাও তাদের ফেলে দিতে পারে না।
চাকুরী যাচ্ছে একে একে অ্যাংলো সাহেবদের। তারা সবাই ঠিক করলো যে এক এক করে সবাই ব্রিটেনে চলে যাবে। ব্রিটেনের মহারানীর বিশাল সাম্রাজ্য। সেখানে নাকি সূর্য অস্ত যায় না। সারা পৃথিবী থেকে যদি সব অ্যাংলো সাহেবরাই ব্রিটেনে যেতে চায় তাহলে তো মহা মুশকিল। একটা নাক উঁচু ভাব
সাহেবদের ছিল। কিছু লোক ফাঁক ফোকর গোলে চলেও গিয়েছিল। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হওয়ায় সে দেশে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। কোথায় যাওয়া যায় ভেবে ভেবে দিন গোনে তারা। এদের কিছু একটা করতে হবে এই চিন্তা ইংরেজ শাসকদের ছিল। জলে ফেলে তো আর দিতে পারে না তাদেরকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের প্রতিনিধিরা বহুদিন আগে থেকেই নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে। দাবি আদায় করেই ছাড়ে তারা শেষ পর্যন্ত। ম্যাকলুস্কি সাহেব তখন এই জায়গার নাম সবাইকে বলে। চলো, আমরা সবাই মিলে সেখানে একটা কলোনি গড়ি। রাতু মহারাজের কাছ থেকে সেই জায়গা চাওয়া হল। তিনি জায়গা দান করলেন। তারা ভাবতে শুরু করল যে ইন্ডিয়াই আমাদের
মাতৃভূমি। এখানেই আমাদের থাকতে হবে। সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ম্যাকলুস্কিতে এসে থাকবার অনুরোধ করা হল।
জঙ্গলের মধ্যে গড়ে উঠলো প্রচুর বাংলো। সেখানে এসে সাত পাঁচ না ভেবেই তারা থাকতে শুরু করল। বাংলোর চারিদিকে বিশাল জায়গা আর তাতে নানান ফলের গাছ লাগল। প্রথমে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে একটু ঝামেলা শুরু হল। তবে অ্যাংলো সাহেবদের দাপটের কাছে তারা হার স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত। তাদের এলাকায় স্থানীয়দের যাওয়ার অনুমতি নাকি ছিল না। অ্যাংলো সাহেবরা নাকি সেই সময় ঘোড়ায় চেপে কাঁধে বন্দুক নিয়ে এক বাংলো থেকে অন্য বাংলোয় যাতায়াত করত।
দেখতে দেখতে দেশ স্বাধীন হল। ইংরেজরা দেশে ফিরে গেল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নতুন প্রজন্ম আস্তে
আস্তে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করলো। তবে বয়স্করা আর ফিরে যায়নি। আস্তে আস্তে বাংলো গুলো জলের দামে বিক্রি হয়ে যেতে লাগলো মাফিয়াদের হাতে। কিছু বাংলো আমাদের কলকাতার বাবুরা কিনে ছিল একসময়। কেউই শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারেননি। আজও বিশাল বিশাল বাংলো গুলো পরে আছে জীর্ণ অবস্থায়। বাংলোর জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতাম পুরনো আসবাবপত্র শুধু রয়েছে।
কর্মসূত্রে বহুবার গিয়েছি ম্যাকলাস্কির কাছে। সুযোগ পেলেই চলে যেতাম বাংলোগুলো দেখতে। কেন তারা এসেছিল এই জঙ্গলে, ভাবি। শুধু ফল বিক্রি করে তো আর জীবিকা নির্বাহ করা যায় না। আর ফলমূল কোথায় বিক্রি করবে তারা? কলকাতা থেকে অনেক দূরে তারা থাকতো। ট্রেনের লাইন ছিল তবে যাতায়াত ছিল বেশ সময় সাপেক্ষ। তারা অর্থনীতির কথা চিন্তা করেনি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চারশো পরিবার হারিয়ে গেল ইতিহাস থেকে। রেল লাইনের পাশেই রয়েছে একটা কবরখানা। সেখানে আজও শুয়ে আছে কত অ্যাংলো সাহেব ও মেম সাহেবরা।
যখন ট্রেনে করে ঘর আসতাম তখন বিকেলের দিকে ম্যাকলুস্কিগঞ্জ স্টেশনে দেখতাম দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। ঝুড়িতে কিছু ফল নিয়ে বিক্রি করছে। গায়ের তামাটে রং, নীল চোখ আর বাদামি চুল জানান দিতো যে সে আজও আছে ম্যাকলুস্কিতে সব কিছু আগলে। পরে জেনে ছিলাম তার নাম নাকি কিটি মেমসাহেব। সবাই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছে।
ছোট বেলায় আমিও থেকেছি সাহেবদের পাড়ার কাছে। সেখানে দেখতাম সাহেব কোম্পানিতে অ্যাংলো মেয়েরা অফিসে কাজ করত। বয়েজ কাট চুল কাটতো। ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক আর হাঁটু অব্দি ফ্রক পড়তো তারা। নিজেদের মধ্যে তারা সর্বদা ইংরেজিতে কথা বলতো। কেউ কেউ আবার তাদের কাছে স্পোকেন ইংলিশ শিখতে যেত দেখতাম। আমরা বলতাম মেম যাচ্ছে রিকশায় চেপে দুলে দুলে। হাতে একটা ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ।
এখন স্টেশনের পাশেই একটা ডন বস্কোর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল হয়েছে। আশেপাশের কয়লা খনি থেকে ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়ে। পুরনো বাংলোগুলো হাত বদল হয়ে এখন যাদের হাতে, তারা সবাই হোস্টেল খুলেছে বাংলোয়। গরমের সময় অফিসের কাজে সেখানে গেলেই নানান স্বাদের আম নিয়ে আসি। শীতের রবিবারে মাঝে মাঝেই চলে যাই সেখানে। ঘুরে ঘুরে খুঁজি হারানো ইতিহাস। ভাবি, একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম তাদের সময়ে!
লেখক পরিচিতিঃ শৈশব কেটেছে তৎকালীন বাংলা-বিহার সীমান্তবর্তী খনি অঞ্চলে। বাংলা মিডল স্কুলে হাতেখড়ি। হিন্দি আগ্রাসনে স্কুল ছেড়ে বাংলায়। ১৯৮১ সালে ক্লাস ফাইভ থেকে রামহরিপুর রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে। ১৯৮৯ এ উচ্চ মাধ্যমিক-এর পর মাইনিং-এর শাখায় পড়া ও কাজ। খনিতে কাজ। পালামৌ জঙ্গলের খনি ঘুরে এখন রাঁচিতে বছর পাঁচেক সেন্ট্রাল কোলফিল্ডস লিমিটেড কোম্পানির মুখ্যালয়ে থিতু।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।