অভাবনীয় ঘটনা
সুবীণ দাশ
বর্তমান যুগে মালবাহী জাহাজ নানান ধরণের হয়- Oil Tankers, Bulk Carriers, Pure Car Carriers , Chemical tankers, Reefer vessels, Log Carriers, General cargo, ইত্যাদি। নাম দেখেই মোটামুটি আঁচ করা যায় কোনটে কীসের জন্য লাগে। যেমন, অপরিশোধিত জৈবিক তেল বহনের জন্য ব্যবহার করা Oil Tankers, তরল গ্যাস (ন্যাপথা, হিলিয়াম, রান্নার গ্যাস) ইত্যাদি যায় Chemical tanker-এ, সাধারণ পণ্য যায় General cargo-র জাহাজে, Reefer vessels০এ যায় ফলমূল।
গাড়িবাহী জাহাজ
এবারে যে জাহাজটির আমি চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সেই জাহাজটি তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন ধরণের গাড়ি (Pure Car carrier or PCC) বহন করার জন্য। গাড়ি রাখবার জন্য ছিল ১৩টা ডেক বা তলা। প্রতিটি ডেক থেকে ওপরের ডেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার/আসার জন্য ছিল গাড়ি চলার মতন চওড়া লোহার পাত থেকে তৈরি পথ। সামুদ্রিক আবহাওয়া ও নোনা জলে গাড়িগুলো যাতে খারাপ না হয়ে যায়, তার জন্য ডেকগুলিকে চার পাশ থেকে ঘিরে দেওয়া দেওয়া ছিল লোহার দেয়াল (Bulk head) দিয়ে। ডেকগুলিতে পরিশ্রুত বাতাস পাঠানোর জন্যে ছিল শক্তিশালী ফ্যান (Blowers)। আবার কিছু ফ্যানের কাজ ছিল পেট্রোল বাস্প মিশ্রিত অসম্ভব দাহ্য হাওয়া ডেকগুলোর থেকে টেনে বাইরের খোলা সমুদ্রের আবহাওয়াতে মিশিয়ে দেওয়া। এই ফ্যানগুলোর কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ির জ্বালানীর ট্যাংকে যে Petrol থাকে তা evaporate করে আশেপাশের হাওয়ার সঙ্গে মিশে explosive mixture তৈরি হয়। এতটুকু অসাবধানতার জন্য এই ধরণের জাহাজ বিশাল এক বোমার মতন বিস্ফোরণের কবলে পড়তে পারে। এই কারণেই, গাড়ি বহনকারী জাহাজগুলো তেলবাহী জাহাজের থেকে অনেক বেশি বিপদ সঙ্কুল। জাহাজিদের ভাষায় এই ধরণের জাহাজকে নাবিকরা আদর করে বলে, “Riding a live time bomb”. এবার আসি ঘটনাটিতে।
সেবার জাপানের বেশ কয়েকটা বন্দর থেকে নতুন গাড়ি তুলে আমরা রওনা দিলাম উত্তর আমেরিকার পশ্চিম দিকের কয়েকটি বন্দরের জন্য। শেষে কানাডার দুটি বন্দরেও আমাদের যেতে হবে গাড়ি নামাবার জন্য। এই গাড়ি বোঝাই জাহাজগুলিকে সময় সীমা বেঁধে দেওয়া হয় যার মধ্যে তাদের নিয়ে যাওয়া পণ্য সেই সব বন্দরে নামাতে হয় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে। যদি কোন ভাবে জাহাজের পৌঁছতে দেরি করে তার গন্তব্যে, তার জন্য ভাড়ার(Charter) সিংহভাগ টাকা কেটে নেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে। তাই গাড়ি ভরা জাহাজে; ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাপ্টেন, ন্যাভিগেটররা প্রচণ্ড চাপে মধ্যে জাহাজ নিয়ে চলে গন্তব্যর দিকে। পণ্য কে সামুদ্রিক ঝড় ঝঞ্ঝার থেকে রক্ষা করাও তাদের একটা বিরাট দায়িত্ব।
সেইবারের যাত্রায় ঠিক সময়ে আমরা পণ্য পৌঁছে দিলাম উত্তর আমেরিকার সান পিডরো, সানফ্রানসিসকো ও সিয়াটলে বন্দরে। সেখান থেকে পাড়ি জমালাম “পোর্ট বেনিসিয়ার”(Port Benecia, W.Canada) উদ্দেশ্যে। আগের বন্দরগুলিতে নতুন গাড়ি নামানোর পর মাত্র এক হাজারটি গাড়ি নিয়ে আমরা যাত্রা করলাম বেনিসিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে। যাত্রা সময় প্রায় তিন দিন। পোর্ট ভ্যাংকুভার পেরিয়ে সমুদ্রের খাঁড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বেনিসিয়ায়। পরম যত্ন করে আনা বাকি হাজারটি গাড়ি নামিয়ে বন্দর ছাড়ল আমাদের জাহাজ। আমাদের ফেরার পথটি ছিল দারুণ সুন্দর। দুপাশে বেশ উঁচু পাহাড়মালা, মাঝে গভীর জলপথ। সেই যাত্রাপথে পড়ে “প্লামপার সাউন্ড”(Plumper Sound) ও “পুজিট্ সাউন্ড”(Puget Sound) বলে দুটো হ্রদ(Lagoon) যেগুলো অতলান্তিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত। জাহাজে খবর পৌঁছল মালিকদের অফিস থেকে আমাদের জাহাজ নোঙর ফেলে প্লামপার সাউন্ডে অপেক্ষা করবে পরের যাত্রার নির্দেশের জন্য।
যেহেতু এই ধরণের জাহাজগুলি কোন বন্দরে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার বেশি থাকে না, তাই নাবিকদের জীবন এই জাহাজগুলিতে অসম্ভব রকমের ব্যস্ততায় ঘেরা থাকে। বন্দরে কোন বিশ্রামের সময় পাওয়া এক রকমের দুষ্কর। জাহাজ Plumper Sound হ্রদে নোঙর করে অপেক্ষা করবে, যতদিন না জানান হয় কোথায় ও কবের মধ্য জাহাজকে পৌঁছে নতুন গাড়ির Consignment তুলতে হবে। অত বড় জাহাজ কে নোঙর করতে হয় যাতে ঢেউ বা স্রোতের জন্য জাহাজ ভেসে না যায়। এটা খুবই বিচক্ষণতার কাজ। জাহাজ থেকে নোঙর জলে নামানর পর যে শিকল বা chainএর সঙ্গে নোঙরটি যুক্ত থাকে সেই শিকল বা chain-এর বেশ কিছুটা অংশ জলের তলার মাটির ওপরে বিছিয়ে দিতে হয় যাতে নোঙর ও মাটিতে পাতা chain ধরে রাখতে পারে জাহাজটিকে সঠিক জায়গায়। এতে কখনই সোজাসুজি নোঙরের ওপর চাপ আসেনা যাতে ফেলা জায়গার থেকে নোঙর জাহাজের টানে সরে যেতে পারে।
জাহাজ নোঙরে থাকবে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই কে পাওয়া গেল বেশ খুশি মেজাজে। অন্তত কয়েক দিনের টানা সমুদ্রে ভেসে বেড়ানর থেকে নিস্তারের কথা ভেবে। জাহাজ ভেসে এসে পৌঁছল নির্ধারিত নোঙরের জায়গায়। সঠিক ভাবে নোঙর করল জাহাজ। জায়গাটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপূর্ব। চারপাশ ঘিরে ৫-৭হাজার ফুট উঁচু পাহাড়, মাঝে কাকচক্ষু নীল জল(স্বাদে যদিও নোনতা), সমস্ত পাহাড়ের গায়ে সবুজের সমারোহ। সময়টি ছিল বসন্তের শেষ ও শীতের আগমনের (Autumn)। চারপাশের পাহাড় গায়ে নানান রঙের গাছের পাতা। সূর্য অস্ত গেলে বেশ একটা শীত-শীত অনুভূতি। এই জায়গাগুলিতে একটাই ভয়, কোন জানান না দিয়ে যে কোন সময়ে ঝড় আরম্ভ হতে পারে। পাহাড়ের গা বেয়ে হাওয়া বীর বিক্রমে নেমে আসে, পথে যা কিছু পায় তা ধ্বংস করে আবার মিলিয়ে যায়। সেটা মাথায় রেখে জাহাজের মেইন ইজ্ঞিন রাখা হয়েছিল এমন ভাবে যাতে আধ ঘণ্টার মধ্যে চালু করা যেতে পারে। প্রথম দিনটি নিরাপদে কাটল। দ্বিতীয় দিনের বিকেল থেকে বুঝতে পারছিলাম হাওয়ার তেজ বাড়ছে। ব্যাপারটি ক্যাপ্টেনকে জানালাম এবং পরার্মশ দিলাম ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেবার জন্য। হয় সে কথাটি বুঝল না বা আমার পরার্মশের খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তার মতে হাওয়ার বেগ আর বাড়বে না, আর জাহাজের ফেলা নোঙর সেইটুকু তেজ সহ্য করতে পারবে।
এদিকে ধীরে ধীরে বাইরে হাওয়ার গোঙানির আওয়াজ বাড়ছে, জাহাজ দাঁড়ানো অবস্থায় দুলতে শুরু করেছে। এই জাহাজগুলির চার পাশের নিশ্ছিদ্র দেয়াল অনেকটা নৌকার পালের মতন কাজ করে, যেদিক থেকে হাওয়া আসে তার উল্টো দিকে জাহাজটি হেলে যায় ও হাওয়া সঙ্গে ঢেউ এর ধাক্কায় ভেসে যাওয়ার চেষ্টা করে।
প্রায় রাত ১১টার সময়ে ক্যাপ্টেনের থেকে ফোন পাই, নোঙর সরতে শুরু করেছে (Anchor dragging)। মানে, ঝোড় হাওয়া ও ঢেউয়ের ধাক্কা ঠেলে জাহাজটি কে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের যাত্রা পথের সঙ্গী করে। নোঙর সে ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে নিজের জায়গা থেকে সরতে শুরু করছে। তখন দরকার পড়ে জাহাজের ইঞ্জিন শক্তির। ইঞ্জিন চালিয়ে তার জোরে জাহাজ কে আবার সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে এনে নোঙর ফলতে হয়, না হলে জাহাজ ভেসে চড়ে যেতে পারে পাড়ের ওপরে। ১৫ মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন চালু করে ইঞ্জিনের কন্ট্রোল ব্রিজে ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেওয়া হল। যাতে সে অবস্থা বুঝে ইঞ্জিন সামনে পেছনে চালিয়ে নিয়ে অবস্থার মোকাবিলা করতে পারে। পরপর কয়েকবার ইঞ্জিন ব্যাবহার করে ইঞ্জিনের কন্ট্রোল আবার কন্ট্রোল ঘরে আমার হাতে ফেরত দিয়ে ক্যাপ্টেন অনুরোধ করে আমাকে ইজ্ঞিন চালাতে। টেলিগ্রাফে, মানে electronic device (Master & Slave system) যেটার সাহায্যে ব্রিজ থেকে ইঞ্জিন কন্ট্রোল ঘরে জানাতে পারে কখন কেমন ভাবে ইজ্ঞিন চালু করার দরকার। সাধারণত সমস্ত জাহাজে এই পদ্ধতিই ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। টেলিফোনের ব্যাবহার থাকে দ্বিতীয় পন্থা হিসাবে। টেলিগ্রাফে সামনে বা পেছনে ঘরগুলিতে লেখা থাকে, Dead Slow, Slow, Half ও Full। এগুলো থাকে Ahead বা Astern লেখা কাল বা লাল রঙে নিচে। দুটির মধ্যে খানে ইঞ্জিন বন্ধ (Stop) লেখা ঘরটি। ব্রিজ যে ঘরে নিয়ে যায় টেলিগ্রাফের হাতল, ইঞ্জিন ঘরের টেলিগ্রাফের হাতল সেই ঘরে রেখে ইঞ্জিন চালনা করা হয়। ব্রিজে থাকা ক্যাপ্টেন জানতে পারে তার দেওয়া আদেশ অনুসারে সঠিক ভাবে ইঞ্জিন চলতে শুরু করেছে।
জাহাজের পেটের মধ্যে থেকে তেমন করে জাহাজের নড়াচড়া বুঝবার কথা নয় কিন্তু সে সময়ে জাহাজের পাগলের মতন দোলা ভাল ভাবেই মালুম পড়ছিল। এদিকে নোঙরের ঠিকঠাক ভাবে মাটির থেকে তুলে আবার মাটিতে নামিয়ে জাহাজের গতি রোধের চেষ্টা করার জন্য চিফ অফিসার ও তার সঙ্গীদের পাঠান হয়েছিল জাহাজের সামনে(Forecastle)। জাহাজের অনিয়ন্ত্রিত গতিতে পাহাড়ের দিকে সরে যাওয়ার থেকে আটকাতে দ্বিতীয় নোঙরটি ও নামান হয়েছিল জলে। দুটি নোঙর জলে নামান হল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে পাগল হাওয়ার দাপটে জাহাজ নোঙর দুটির চার পাশে ঘুরতে শুরু করেছে। জাহাজের এই আচরণের জন্য জলে ফেলা দুটি নোঙর নিজেদের মধ্যে পেঁচিয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। ফলে কোনও নোঙরই আর জল থেকে টেনে তোলা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। এদিকে মাল নামিয়ে জাহাজ হালকা। হালকা জাহাজ হাওয়া ও ঢেউয়ের দাপটে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল কিনারার পাহাড়ের দিকে। শত চেষ্টা করে সেই ভেসে যাওয়া আটকান যাচ্ছিল না। আমি তখন নীচে ইঞ্জিন রুমে। চোখে না দেখেও বুঝতে পারছিলাম জাহাজটি তার সলিল সমাধির দিকেই ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। ক্যাপ্টেন ফোনে জানাল নীচে ইঞ্জিন রুমে আমাদের প্রাক ধাক্কার (Pre collision) ব্যবস্থাগুলি নিতে। তারপর আর সন্দেহ রইল না আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। বুঝতে পারছিলাম পাহাড় থেকে জলে খসে পড়া পাথরে জাহাজ ধাক্কা খেতে চলেছে। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথর সব সময়ে দেখা যায় বেশ কিছুটা পাহাড় পাদদেশ ছাড়িয়ে জলের ভেতরে এসে স্থিত হয়। তাই পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাওয়ার আগে জাহাজের তলা বিশাল বিশাল পাথরে ধাক্কা খাবেই।
জাহাজের ইঞ্জিন রুম
যে সব ইজ্ঞিনিয়াররা ইঞ্জিন ঘরে আমার সঙ্গে ছিল (সর্বসাকুল্যে তিনজন, আমাকে ধরে), তাদের সবাইকে বললাম যতগুলো জল আটকানো দরজা (Water tight doors) আছে, সবকটা বন্ধ করে ১০মিনিটের মধ্যে আমার কাছে ইজ্ঞিন কন্ট্রোল ঘরে আসতে। আমি চিফ ইঞ্জিনিয়ার, আমার ঠিক নীচের পদে যে রয়েছে সে হল ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ার। তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ওপরে ক্যাবিনে ছিলেন, ফাস্ট ইঞ্জিনিয়ার, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাপ্টেন ও চিফ অফিসার স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজে উঠতে পারে, আইন মোতাবেক। ওকে ক্যাবিনে যেতে বললে সে যেতে দেখি নারাজ, সেও থাকতে চায় নিচে ইঞ্জিন ঘরে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে। তাই এক রকম ধমকে ওকে পাঠিয়ে দিলাম স্ত্রীর কাছে। শুধু বললাম, যেন কখনোই আমাদের বিপদের কথা স্ত্রীকে না জানায়, যা হবার তো হবেই; আগে থেকে জানালে নানা রকমের অন্য ঝামেলার সন্মুখিন হতে পারে সে। আমার নিজের মনের অবস্থা যাতে কোনও ভাবেই আমার সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আর মোটরম্যানরা(মোট দুজন) বুঝতে না পারে সেই চেষ্টাই করছিলাম। মাঝে একবার ফোনে ক্যাপ্টেন কে জানালাম ঠিক ধাক্কা লাগার আগে যেন আমাকে জানায় যাতে আমি মেইন ইজ্ঞিন সময় মতন বন্ধ করে দিতে পারি। এতে জাহাজের প্রপেলারটি ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। ক্যাপ্টেন জানাল জাহাজ ও ডুবে থাকা পাথরের মধ্যে আর পাঁচ মিটারের ফারাক বাকি। জাহাজকে ধ্বংসের থেকে রক্ষা করার আর কোন উপায়ই সামনে নেই। যখন অপেক্ষা করছি প্রথম ধাক্কাটির জন্য; তখন জানি না কিসের বলে ঝড়টি হঠাৎ একেবারে শান্ত হয়ে যায়। আবহাওয়া স্তব্ধ হয়ে পড়ে। জাহাজের ওপর হাওয়ার বা ঢেউএর চাপ না থাকায়, চলতে থাকা ইজ্ঞিন জাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ফিরে পায়। ধীরে ধীরে জাহাজ সরে আসতে আরম্ভ করে গভীর জলে। এক এক করে জট ছাড়িয়ে দুটি নোঙরকে জল থেকে তুলে আবার ঠিক ভাবে জলের তলার জমিতে পাতা হয়(Anchor laying out)। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সব দিক সামলে আমি ও ক্যাপ্টেন নিজেদের জায়গা থেকে ক্যাবিনে ফিরে আসি। বাইরে ডেকে যেয়ে দেখি নীল আকাশ ও থালার মতন চাঁদ আকাশে যকযক্ করছে। এত বড় একটা বিপর্যয় যে আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল গত ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে, তা হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানতেও পারল না। এটা ঠিক যদি জাহাজটি পাথরে ধাক্কা খেত আর তলার লোহার চাদর ফেটে যেত তা হলে সবার আগে জল ঢুকত ইজ্ঞিন ঘরে। হয়ত উপস্থিত অনেকেই সময় মত ইজ্ঞিন রুম ছেড়ে ওপরে আসতে পারত না, আর চিফ ইঞ্জিনিয়ারহবার সুবাদে বাকি সমস্ত লোককে আগে ওপরের ডেকে পাঠিয়ে আমি হয়ত আমার পরম আদরের ইজ্ঞিন গুলোকে ছেড়ে ওপরে আসার সময় পেতাম না। আমরা এটা নিয়ে বিশেষ মাতামাতি করলাম না। জাহাজ কে যখন নিজের ঘরবাড়ি হিসেবে বেছে নিয়েছি আর সমুদ্রকে নিজের সংসার, তখন এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যে আমাদের যেতে হবে এ তো জানা কথা। এই রকমের জীবনই তো আমি নিজে বেছে নিয়েছি গড্ডলিকা প্রবাহের জীবন থেকে দুরে থাকব বলে।
লেখক পরিচিতি: মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক। চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বহু বছর নানান সাগর ঘুরে এখন অবসর নিয়েছেন। বেড়াতে ভালোবাসেন, ছবি তুলতেও।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.