অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বইয়ের আলোচনা

মে ৩০, ২০১৭

 

দিলীপ রায়চৌধুরী রচনা সমগ্র

ঋজু গাঙ্গুলী

দিলীপ রায়চৌধুরীর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় অনীশ দেব-এর সম্পাদনায় নব্বই দশকের গোড়ায় প্রকাশিত “সেরা কল্পবিজ্ঞান” বইটিতে স্থান পাওয়া গল্প “শিলাকান্থ” পড়ে। গল্পটা পড়ে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম।

 বইয়ের নাম: দিলীপ রায়চৌধুরী রচনা সমগ্র
 পেপারব্যাক, ২০৮ পৃষ্ঠা
 ‘হযবরল’ (সৃষ্টিসুখ) থেকে জানুয়ারি ২০১৭-য় প্রকাশিত
 মূল্য ২৯৯/- টাকা

কেন?

সেই সময়ে “আনন্দমেলা” সহ যেক’টা শিশু-কিশোর পত্রিকা বেরোত (কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য তখন কঠোরভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই রচিত হত), তাদের সবক’টার নিয়মিত পাঠক হওয়া সত্বেও এই লেখকের লেখা আগে চোখে পড়েনি। বইয়ের শেষে থাকা লেখক-পরিচিতি দেখতে গিয়ে আমার চোখ কপালে ওঠে। প্রায় তিন দশক আগে আমাদের ছেড়ে যাওয়া এক সাহিত্যিকের রচনা কীভাবে এতটা আধুনিক, গতিময়, এবং স্মার্ট হতে পারে সেটা নিয়ে বিস্ময়ের পাশাপাশি তখন থেকেই মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন দানা বাঁধে: এই লেখকের বাকি লেখাগুলো কোত্থেকে জোগাড় করব?

সেই প্রথম আলাপের পর দু’দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। ইতিমধ্যে দিলীপ রায়চৌধুরীর কল্পবিজ্ঞান রচনাবলির একটা বড়ো অংশই আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, ‘ধুলোখেলা’ ‘জয়ঢাক’, এবং অনেকটাই লেখকের কন্যা যশোধরা রায়চৌধুরীর অসীম বদান্যতায়। কিন্তু মনের মধ্যে তবু দুটো আক্ষেপ গুমরে মরত।

প্রথমত, এমন এক লেখকের সব লেখা পড়তে পাচ্ছি না কেন?

দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আমি, এবং আমার মতো আরো কিছু মানুষ হয়তো এই লেখাগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু তার বাইরেও কল্পবিজ্ঞান তথা জঁর ফিকশনের যে বিরাট সংখ্যক অনুরাগী রয়েছেন, তাঁদের কাছে এই লেখাগুলো কীভাবে পৌঁছবে?

অবশেষে, অ..ব..শে..ষে, ২০১৭-র বইমেলার আগে “সৃষ্টিসুখ” থেকে তাদের শিশু-কিশোর সাহিত্যের জন্য নিবেদিত ইমপ্রিন্ট ‘হযবরল’ থেকে প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকায় যখন এই বইটাকে খুঁজে পেলাম, বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করেছিল “ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস” বলে চেঁচিয়ে উঠতে।

সেই বইয়ের খবর, বিশদে, এবং কিঞ্চিৎ বিষাদে, দেওয়ার জন্যই আজকের লেখা।

কী কী রয়েছে এই বইয়ে?

বই শুরু হয়েছে দুটো অসম্ভব দামি সুখপাঠ্য অথচ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা দিয়ে। প্রথমে রয়েছে বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ মজুমদার-এর লেখা “দিলীপ রায়চৌধুরী রচনা সমগ্র সম্পর্কে”। তারপরে আছে যশোধরা রায়চৌধুরী-র লেখা “দিলীপ রায়চৌধুরী: কল্পবিজ্ঞানসাহিত্যের ক্ষণিকের অতিথি”। যেটা এর আগে ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজিনের প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় বাংলায় মৌলিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ-দের সঙ্গে এযুগের পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াসের অঙ্গ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা, বিশেষত যশোধরার লেখাটা ভবিষ্যতে বাংলায় কল্পবিজ্ঞান তথা জঁর ফিকশন নিয়ে গবেষণা করতে গেলে অবশ্যপাঠ্য উপকরণ হিসেবে কাজ করবে, এবিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে গল্পপাঠে আগ্রহী পাঠকের জন্য সলিড ভোজ শুরু হয়েছে এর পরেই।

সূচিপত্রটা এবার তুলে দেওয়া যাক।

কল্পবিজ্ঞান কাহিনি

১. শিলাকান্থ
২. নেরগাল
৩. ধূসর চাঁদ
৪. প্লুটোর অভিশাপ
৫. টিথোনাস
৬. শুক-সমুদ্র
৭. ক্যুগেল ব্লিৎস
৮. সৌর-ঝঞ্ঝা
৯. অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস

বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা

১) চলো যাই যাদুঘর
২) মহাশূন্যে জন গ্লেন
৩) টেলস্টার

অন্যান্য রচনা

[১] দূরের মাটির ধুলো – চার্লসটন
[২] নিউ ইয়র্ক (রাত্তিরে যারা কাজ করে)
[৩] হিদারামগলির রূপকথা
[৪] চিত্ত ভাবনাহীন

গল্পগুলো নিয়ে বিশদে লেখার আগে বিষাদের কথাক’টা লিখি।

সুমিত রায়-এর চমৎকার প্রচ্ছদ ও গতিময় অলঙ্করণে ভরা এই ঝকঝকে বইটি হাতে নিয়েই মন ভরে যায়, কিন্তু লেখাগুলো পড়তে গিয়ে অজস্র মুদ্রণ প্রমাদ সামলাতে হয়। বৈজ্ঞানিক তথ্যে ভরা, একইসঙ্গে টেনশন আর কৌতূহলের জন্ম দেওয়া, রচনার পাঁচ দশক পরেও দারুণ স্মার্ট থেকে যাওয়া এই লেখাগুলোর কি আরেকটু সযত্ন সম্পাদনা ও কুশলী নির্মাণ প্রাপ্য ছিল না?
দুঃখের কথা বলে দিয়েছি, এবার আসা যাক লেখাগুলোর প্রসঙ্গে।

যদিও আমরা সবাই দিলীপ রায়চৌধুরীকে কল্পবিজ্ঞান কাহিনির রচয়িতা হিসেবেই চিনি, ‘অন্য’ রকম সাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবেও যে তিনি কতটা দক্ষ ছিলেন তার অসাধারণ নিদর্শন হল এই বইয়ের ‘অন্যান্য রচনা’ বিভাগটি। তাই আমি আগে সেখান থেকেই কথা শুরু করি।

  • “দূরের মাটির ধুলো – চার্লসটন” লেখাটা প্রবাসের ছোটো প্রাণ, ছোটো কথা, ছোটো-ছোটো দুঃখ ব্যথা, প্রাণের পরশ, আর ধারাজলে যে আসে তারই সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে। জীবনের কবি বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। দিলীপ রায়চৌধুরীর মধ্যে যে একটি সার্থক কবি বিজ্ঞানীর ব্যস্ত পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন, তা বোঝার সেরা উপায় এই লেখাটা পড়া।
  • “নিউ ইয়র্ক (রাত্তিরে যারা কাজ করে)” লেখাটা রম্য রচনা, তথা ভিনেট (vignette)-এর সার্থক নিদর্শন।
  • “হিদারামগলির রূপকথা” একটা নাটিকা আকারে লেখা, কিন্তু কিনু গোয়ালার গলি যদি কথা বলতে পারত, তাহলে সে যা বলত সেটাই লেখা হয়েছে। এর কোথায় রূপক, আর কোথায় চিত্রকল্প আছে, সে বিচার কবিরা করুন। আমাকে কিন্তু লেখাটা কিছুতেই ছাড়ছে না।
  • “চিত্ত ভাবনাহীন” কতটা ফ্যাক্ট, আর কতটা ফিকশন, সেটা ভবিষ্যতে গবেষকদের মধ্যে তুমুল তর্কের জন্ম দিতে বাধ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল দেশ ও কালের পটভূমিতে একটি ছেলের বালক থেকে যুবক হয়ে ওঠার এই আখ্যান যেমন সজীব, তেমনই অকপট, যা পড়ে একথা মনে হতে বাধ্য যে এই লেখার মধ্যে আত্মজৈবনিক উপাদানের প্রাচুর্য আছেই। দুঃখের বিষয়, লেখাটা যেভাবে থেমেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে লেখাটা শেষ হয়নি।

বিজ্ঞানবিষয়ক রচনাগুলোর মধ্যে “মহাশূন্যে জন গ্লেন” এবং “টেলস্টার” হল সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার বা কোনো ঘটনার সরস অথচ তথ্যনিষ্ঠ পরিবেশনের চমৎকার নিদর্শন। তবে এই ঘরানায় লেখা কেমন হওয়া উচিৎ তার একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দিয়েছে তাঁর “চলো যাই যাদুঘর”, যে লেখাটি ‘জয়ঢাক’-এর শরৎ ২০১৬-য় সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়েছিল।

এবার আসি দিলীপ রায়চৌধুরী-র কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের প্রসঙ্গে।

( ১ ) শিলাকান্থ : ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এই গল্পটা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি রোমাঞ্চকর, এবং মনের বোতলে কাত হয়ে থাকা কল্পনার রকেটগুলোকে দনাদ্দন উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে আদর্শ কল্পবিজ্ঞান কাহিনি হলেও এটি প্রকাশের দু’বছরের মধ্যে সত্যিই আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের কাছে পাওয়া যায় সিলাকান্থ মাছ, যাদের সৌজন্যে আজ জীবজগতে ল্যাজারাস ট্যাক্সন, মানে সেইসব প্রাণী যাদের ফসিল নিদর্শন মাঝে সুদীর্ঘদিন পাওয়া না গেলেও পরে যাদের জীবিত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। আজকের কল্পবিজ্ঞান যে কালকেই বিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে, এই তত্ত্বের এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কী হতে পারে?

( ২ ) নেরগাল : ১৯৬৯ সালে প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গে বিপুল জনপ্রিয়তা এবং সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল মাইকেল ক্রিকটন-এর “দ্য অ্যান্ড্রোমিডা স্ট্রেইন”। অথচ ১৯৬৫ সালেই প্রকাশিত, এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়াল মাইক্রোঅর্গ্যানিজম বা ইটিএম-কে কেন্দ্রে রেখে, কল্পবিজ্ঞানের কাঠামোর মধ্যেও সন্দেহ আর ভয়ের আবহকে যথার্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলে লেখা এই বাংলা গল্পটির কথা আমরা ক’জন জানি?

( ৩ ) ধূসর চাঁদ : নির্মেঘ আকাশে যাকে দেখলে আমাদের মনে আপনা থেকেই কবিতা আর গানের জন্ম হয়, তেমন-তেমন লেখকের হাতে পড়লে তা যে দস্তুরমতো রোমাঞ্চকর অ্যাকশনে ভরপুর কাহিনির পটভূমি হয়ে উঠতে পারে, তা বোঝার জন্য এই বিজ্ঞান-সুবাসিত ফ্যান্টাসিটি অবশ্যপাঠ্য।

( ৪ ) প্লুটোর অভিশাপ : অনীশ দেব-এর সম্পাদনায় শিশু কিশোর আকাদেমি থেকে প্রকাশিত “সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান: সেকাল থেকে একাল” গ্রন্থে স্থান পাওয়া এই বিজ্ঞান-সুবাসিত ফ্যান্টাসিটি রহস্য, রোমাঞ্চ, এবং অনাগত বিপদের সম্ভাবনায় ভরা। গল্পটা যদি রাতের দিকে পড়েন, তাহলে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে বারবার চোখ কিন্তু চলে যাবেই, আগেই বলে রাখলাম।

( ৫ ) টিথোনাস : শিশু-কিশোর সাহিত্যের আঙিনা ছেড়ে দিলীপ রায়চৌধুরীর রচনা প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জগতে প্রবেশ করল এই অসামান্য গল্পটির মধ্য দিয়ে। কোনো রকম প্রাপ্তবয়স্ক উপাদান ব্যবহার না করেও এই গল্পটিতে কল্পবিজ্ঞান, কিংবদন্তি, বিশ্বাস, আশা, এবং ভয়ের রঙিন সুতো দিয়ে যে নকশাটি ধীরে-ধীরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা জঁর ফিকশনের বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভারেও দুর্লভ। এই গল্পটিকে এযুগের পাঠকের কাছে নতুন করে পেশ করার উজ্জ্বল কৃতিত্ব অবশ্য ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজিনের, যাদের প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায়।

( ৬ ) শুক - সমুদ্র : এটি আরেকটি বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্যান্টাসি, তবে পরবর্তীকালের শঙ্কুকাহিনির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে যেসব অপবিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানমূলক উপাদানগুলো আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি, সেসব এতে নেই। বরং পঞ্চাশের দশকে লে ব্র্যাকেট এবং সি.এল.মুর-এর লেখা সায়েন্টিফিক রোমান্সের সঙ্গেই এটি, বা এর আগে লেখা ‘ধূসর চাঁদ’-এর তুলনা চলে।

( ৭ ) ক্যুগেল ব্লিৎস : এই অসামান্য রোমাঞ্চকর গল্পটা পড়ে আমার স্রেফ হাহাকার উঠে এল বুকের ভেতর থেকে, বিশ্বাস করুন। এমন একটা দুরন্ত, এবং হার্ড সায়েন্স ভিত্তিক লেখা পাঁচ দশক আগেই বাংলায় লেখা হয়েছে, আর এই বাংলায় এখনও নানা পত্রপত্রিকার তথাকথিত ‘কল্পবিজ্ঞান’ সংখ্যায় পাঠকদের হাতে কল্পবিজ্ঞানের নামে যা খুশি তাই তুলে দেওয়া চলেছে তো চলেইছে! এই গল্পটাও ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজিনের প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যার মাধ্যমে এই সময়ের পাঠকের কাছে পেশ হয়েছে, তবে আশা করা যায় যে মুদ্রিত আকারে এটি এবার আরো অনেক বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হবে।

( ৮ ) সৌর - ঝঞ্ঝা : এই দুর্ধর্ষ গল্পটা অপার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েও অসমাপ্ত থেকে গেছে। এই সময়ের কোনো লেখক কি এই গল্পটাকে ডক্টর সুশোভন রায়, তার বিশ্বস্ত ছাত্র অমরেশ, এবং কথক সঞ্জয়ের সুর-তাল-লয় দিয়ে যথাযথভাবে সম্পূর্ণ করতে পারবেন? ভরসা রাখি, কেউ না কেউ এই কাজে এগিয়ে এসে এই রোমাঞ্চকর আখ্যানকে প্রাপ্য পূর্ণতা দেবেন।

( ৯ ) অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস : ওস্তাদের মার যদি হয় শেষ রাতে, তাহলে সেরা খাবারও শেষ পাতেই খাওয়া উচিৎ। তাই, এই বইয়ের সেরা লেখা, বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে প্রাপ্তমনস্ক কল্পবিজ্ঞান কাহিনিগুলোর মধ্যে একেবারে ওপরের দিকে থাকা এই লেখাটার প্রসঙ্গ তুলেই বইয়ের আলোচনার শেষ পর্যায়ে ঢুকছি। যশোধরা বলেছেন, দিলীপ রায়চৌধুরীর মতোই ১৯২৮ সালে জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা কল্পবিজ্ঞান লেখক ফিলিপ কে ডিক। আলোচ্য বড়োগল্পটিও কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে স্পাই থ্রিলার, ভয়ার্ত অথচ শক্তিশালী এক সত্তার চিন্তন-মন্থন, একাকিত্ব, বিষাদ, এবং রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা দিয়ে গড়া হয়েছে, যাদের আমরা ফিলিপ কে ডিকের লেখার সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য হিসেবেই চিহ্নিত করি।

লেখাগুলো শেষ করে কেমন যেন ঝিম ধরে গেছিল। হিদারামগলির মতো আমিও যেন শরতের আকাশ আর বাতাসে এক অনন্ত ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়ে ভেবেছিলাম, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের চেহারাটা একদম অন্য রকম। কিন্তু বইটা শেষ হতেই মনে হল, নাঃ, উঁচু-উঁচু বাড়ির ছায়ায় একফালি হয়ে পড়ে থাকা, আবর্জনা আর ড্যাম্পে হতশ্রী গলিটাই বাস্তব, যেখানে সূর্যের দেখা পেতে না পেতেই সে কোথায় গায়েব হয়ে যায়। এই লেখাগুলোর বাইরেও থেকে গেছে বারোয়ারি উপন্যাস “মহাকাশযাত্রী বাঙ্গালি”-র একটি অধ্যায়, যা ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজিনের প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল, এবং ‘বেতার জগৎ’-এ প্রকাশিত অবিস্মরণীয় বারোয়ারি (আদতে চারজন লেখক: প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, দিলীপ রায়চৌধুরী, এবং অদ্রীশ বর্ধন-এর লেখা) উপন্যাসের একটি অংশ। পরবর্তী সংকলনে এগুলো যুক্ত হবে, এমনটাই আশা করি।

দিলীপ রায়চৌধুরী মাত্র ৩৮ বছর আমাদের মধ্যে ছিলেন। যদি এটা ৩৮ না হয়ে ৮৮ হত, তাহলে আমরা কি লাভবান হতাম? নিঃসন্দেহে হতাম, কারণ তাঁর মতো এমন স্বচ্ছ বিজ্ঞানচেতনার অধিকারী এক সুলেখক কলম চালিয়ে গেলে বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক সাহিত্য (পপুলার সায়েন্স) এবং কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য দুই-ই যে সাবালকত্ব পেত, এবিষয়ে আমি নিশ্চিত। আবার মুজতবা আলির কথাটাও মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, তাজমহল যদি আরো অনেক বড়ো হত, তাহলে তার সৌন্দর্যের বদলে বিশালত্ব দেখেই লোকে বাকরুদ্ধ হত। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের মরুভূমিতে মেঘের স্বপন দেখে বাসা যাঁরা বেঁধেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বুড়ো হয়েছেন, অনেকে দড়কচা মেরেছেন (সত্যভাষণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী), বড়ো হয়েছেন খুব-খুব কম লেখক। কিন্তু দিলীপ রায়চৌধুরী, এই স্বল্প পরিমাণ রচনা দিয়েই, রয়ে গেছেন ও থাকবেন চিরতরুণ, হাস্যোজ্জ্বল, সপ্রাণ।
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনের উদ্দেশে অনন্ত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি এই বইটি, ত্রুটিবিচ্যূতি নিয়ে হলেও, আমাদের কাছে পেশ করার জন্য। আর, এখনও যদি এই বইটি না কিনে থাকেন, তাহলে দয়া করে এটি যত দ্রুত সম্ভব হস্তগত করুন, এবং বিশুদ্ধ বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য যে কত মনোজ্ঞ, কত রোমাঞ্চকর, কত সম্ভাবনাময় হতে পারে, তার এক ঝলক দেখে নিন।
পাঠ শুভ হোক।


লেখক পরিচিতি: এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।                   

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.