বইয়ের খবর
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬
রূপঙ্কর সরকারের “নিভৃতে যতনে”
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
একাকী জীবনযাপনের নানা সুবিধের মধ্যে অন্যতম হলঃ নির্বাসিত যক্ষের অনুভূতি চাগাড় দিলেও “আজ ফুলকপিটা পচা এনেছ” বা “মা-কে কবে দেখতে যাবে” জাতীয় কথা শুনে রসভঙ্গ হওয়ার চান্স থাকে না। ফলে গীতবিতান নিয়ে বসে পড়া যায় নিশ্চিন্তে। আজকেও অফিস থেকে ফিরে সেই সৎকর্মে ব্যাপৃত হয়েছিলাম, কিন্তু মাথার মধ্যে একটা চিন্তা শান্ত পুকুরে বড়ো মাছের মতো এমন ঘাই মারল যে পড়া মাথায় উঠল।
ভাবলাম, আজকের এই “আমরা-ওরা”-য় ক্ষতবিক্ষত জীবনে টিন-এজার নয় এমন মানুষদের ভালোবাসার গল্প কেমন হবে?
বইয়ের নামঃ নিভৃতে যতনে
লেখকঃ রূপঙ্কর সরকার
প্রকাশকঃ সৃষ্টিসুখ
পেপারব্যাক, ৯৬ পৃষ্ঠা
প্রচ্ছদঃ পার্থপ্রতিম দাস
আই.এস.বি.এনঃ 978-163415699-8
আমার তারাবাজিঃ পাঁচে চার ★★ ★ ★ ☆
|
নিজস্ব জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, রসবোধ, পরিবেশচেতনা, ইতিহাসবোধ, এবং সততা দিয়ে যেসব বাঙালি একটি হার্ডকোর ফ্যানবেস এবং কট্টরপন্থী শত্রু (সমালোচক শব্দটা বড্ড মোলায়েম)-গোষ্ঠী তৈরি করতে সফল হয়েছেন তাঁদের অন্যতম, রূপঙ্কর সরকারের লেখার সঙ্গে আমরা অনেকেই সবিশেষ পরিচিত। সৃষ্টিসুখ থেকে এর আগেও তাঁর দুটি শীর্ণকায় বই আমরা পেয়েছি (“নামান্তর” এবং “অপ্রাকৃত”), যারা বিষয়বৈচিত্র্যে এবং স্বাদু গদ্যে ইতিমধ্যেই পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। ২০১৬-র বইমেলায় প্রকাশিত ওনার গল্প-সংকলন “নিভৃতে যতনে” নিয়ে উনি নিজেই বলেছেন, “আপাতদর্শনে এ বইয়ের গল্পগুলো ভালোবাসার”। লেখক নিজে উনিশ-কুড়ির পাঠকবর্গ থেকে একেবারে অন্য গোলার্ধের বাসিন্দা হওয়ায় আমি নিশ্চিন্ত হলাম, আমি ঠিক যেমনটি খুঁজছি তেমন বই পাওয়া গেছে।
তারপর?
তারপর পড়া হল গল্পগুলো। কেমন লাগল? একটু গুছিয়েই লেখার চেষ্টা করি।
১. তক্ষক: আদিম লালসা, ক্রোধ, ঘৃণা, আর অব্যক্ত শুদ্ধসত্ত্ব ভালোবাসা এমন ভাবে একে-অপরের সঙ্গে মিশেছে এই গল্পে, যাকে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ ছাড়া কিছু বলা যায়। অনাড়ষ্ট প্রকাশভঙ্গি আর নির্মেদ গদ্যের মেলবন্ধনে এই গল্প একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে, যা গোল গল্প পড়ে অভ্যস্ত আমাদের মেজাজকে রীতিমতো ঝাঁকিয়ে দেয়।
২. দেখা হবে প্রিয়: প্রথাগত গল্প নয়, ছকবাঁধা আর পাঁচটা গল্পের মতো করে বলাও নয়। এই গল্পটা বিশেষ তৃপ্তি দিল না, কিন্তু তবু এটা মনে থাকবে।
৩. সেফালিক: এই গল্পটাও শেষ অবধি একটা অন্য রকম ভালোবাসার, কিন্তু নন-লিনিয়ার ফর্ম্যাটে পরিবেশনের জন্যেই হয়তো বড়ো বেশি এক্সপেরিমেন্টাল ঠেকে ব্যাপারটা।
৪. নীলচাঁদ একবারই: ফ্যান্টাসি? কল্পবিজ্ঞান? ‘ইজম’-এর মনুষ্যায়িত রূপ নিয়ে মেটাফর? ‘হলেও হতে পারে এমন’ প্রেমের গল্প? বর্গীকরণের ব্যাপারটা আমি আপনার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।
৫. বসুধৈব: প্রেমের মিষ্টত্বের বা যন্ত্রণার বদলে এই গল্পটা এই সংকলনের সম্ভবত একমাত্র ব্যঙ্গাত্মক হালকা হাসির গল্প, কিন্তু কেন যেন মনকে ফুরফুরে করার বদলে একটু ভয়ই পাইয়ে দিল গল্পটা!
৬. একশো তেইশ: শাণিত পর্যবেক্ষণ, সম্পূর্ণ অনাড়ম্বর অথচ অনাবিল গদ্য, এবং যন্ত্রণার বিষাক্ত নীল রঙে রঙিন এই গল্পটা পড়তে গিয়েও কষ্ট হয়।
৭. গল্পগুজব: এই সংকলনের অন্যতম ফিল-গুড গল্প, যা আমাদের মতো আড্ডাবাজ (কিন্তু এখন ভয়ে বা বৈরাগ্যে চুপচাপ হয়ে যাওয়া) লোকেরা খুব ভালো চিনবে, এবং, গল্পটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আশে-পাশে ‘গল্পগুজব’ করার লোক খুঁজবে। সাধ্বীরা সাবধান, এই বেলা আমাদের সঙ্গে গপ্পো জুড়ুন, নইলে কিন্তু বিপদ হতে পারে!
৮. জাপানি পুতুল: এই সংকলনের সবচেয়ে মনোহারী গল্প, যা আমি ইতিমধ্যেই দু’বার পড়ে ফেলেছি, আরো বার কয়েক পড়ব।
৯. কাঁটাপুকুর: এই গল্পের বীভৎসতা এবং অসহায়তা ব্যাখ্যা করার মতো আঙুলের জোর আমার নেই। যাই লিখব তাতে গল্পের ইমপ্যাক্ট কমে যাবে। বরং গল্পটা দয়া করে পড়ুন।
১০. নিভৃতে যতনে: রাগে, অনুরাগে, সংরাগে, এবং উত্তাপে এই গল্পটি আলোচ্য সংকলনের মধ্যেও আলাদা ভাবে নজর কাড়ে। লেখক অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এটি দিয়েই বই শেষ করে, কারণ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ প্রেমের গল্পে যত রং দৃশ্যমান হওয়া সম্ভব, তার সব দেখানোর পালা সাঙ্গ হল এই গল্পটির মধ্য দিয়েই।
তাহলে শেষ অবধি ব্যাপার কী দাঁড়াল? বইটা পড়া যাবে, না কি ৯৯ টাকা বইয়ের পেছনে ব্যয় না করে সেটা দিয়ে অন্য কিছু করবেন?
আমি বলি কী, বইটা পড়েই ফেলুন। একে তো এমন চমৎকার, স্মার্ট, এবং সোজাসাপটা গদ্য পড়ার সুযোগই বিশেষ পাওয়া যায় না। তায় গল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটা আপনি বহু-বহু দিন মনে রাখবেন, এমনকি অপেক্ষাকৃত দুর্বল গল্পগুলোও আপনি না পড়ে থামতে পারবেন না।
পুজো ভালো কাটুক।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।