বইয়ের খবর
ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
..."কর্নেলের প্রথম আবির্ভাব প্রাপ্তবয়স্কদের
জন্যে হলেও আনন্দমেলা পত্রিকার সৌজন্যে কর্নেল এসে পড়লেন ছোটোদের
রাজ্যে, আর তাঁর সঙ্গে চলল আমাদের পাখি দেখা, প্রজাপতি ধরা, দেশ-বিদেশ
(এমনকি অন্য গ্রহেও) ঘোরা, আর রহস্যভেদ! "
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
দারুণ রহস্য! রাত একটু গভীর হলেই বাড়ির পেছনে ঝিলের ধারের পরিত্যক্ত
মন্দিরে কেমন যেন একটা আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এক-আধবার আলোও দেখা
গেছে জানলা দিয়ে, অথচ ব্যাপার কী সেটা দেখতে গেলেই সব শুনশান,
কোথাও কিচ্ছু নেই। ঠিক কী হচ্ছে ওখানে তা বোঝা যাচ্ছে না, এদিকে
এই মন্দির নিয়ে গালগল্পের শেষ নেই, তাই মনে হয় যে ব্যাপারটা থেকে
পরে বড়ো বিপদ হতে পারে। কিন্তু বাড়িতে একগাদা লোক তো আর নেই যে
তাদের দিয়ে মন্দির আর ঝিলের ওপরে পালা করে নজরদারির ব্যবস্থা করানো
যায়। থাকার মধ্যে এই আধবুড়ো, আর আরও কয়েকটি মানুষ, সময়ের গতিময়
স্রোত যাঁদের এখনও ভাসিয়ে নিতে পারেনি। তাহলে উপায়? বাংলায় সত্যান্বেষী
একজন আছেন; অপেশাদার রহস্যভেদী এবং পেশাদার গোয়েন্দা আছেন অনেক।
কিন্তু তাঁদের মধ্যে এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে যিনি এক বয়স্ক, হয়তো
কানে কিছুটা কম-শোনা আর চোখে কিছুটা কম-দেখা এক মানুষের, কথা আর
আশঙ্কার ভিত্তিতে আসবেন এই গণ্ডগ্রামে? এদিকে শীত পড়েছে জাঁকিয়ে,
তাই ঝিলের পাশে যে ঘাসবন সেখানে বাসা বেঁধেছে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক।
তাদের দেখতে আর ফটো তুলতে ট্যুরিস্ট আসছে, কিন্তু এমন কোন রহস্যভেদী
কি আছেন যিনি পাখি আর প্রজাপতির টানে এখানে আসবেন, আর তারই পাশাপাশি
(হয়তো বা ক্যামেরা আর বাইনোকুলার নিয়ে রাত-বিরেতে বেরিয়ে) তদন্ত
করে বের করে ফেলবেন আওয়াজ আর আলোর রহস্য?
বাকি গল্পটা আর বলার দরকার নেই, কারণ এই অবধি পড়েই আপনারা নিশ্চই
সন্ধান পেয়ে গেছেন সেই রহস্যভেদীর, যাঁকে পাখি আর প্রজাপতির লোভ
দেখালে তিনি পাড়ি দিতে পারেন বিশ্বের সর্বত্র। যেহেতু তিনি সেনাবাহিনি
থেকে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারও বটে, তাই দুর্গম এলাকায় যাওয়ার মতো সহিষ্ণু
শরীর আর প্রশিক্ষণ দুই-ই তাঁর আছে। ফাদার ক্রিস্টমাসের মতো চেহারা
(উচ্চতা, সাদা দাড়ি, টাক), মধুর ব্যবহার, দুর্জয় সাহস, বিপুল শারীরিক
শক্তি, দেশে-বিদেশে নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার ফলে এক্কেবারে ব্যবহারিক
উপায়ে লব্ধ বহু ভাষায় জ্ঞান, প্রচুর পড়ার অভ্যাস, আর ছেলেমানুষি
কৌতূহল: এও তাঁর আছে। আর নিশ্চই ক্লু লাগবে না। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা বলছি, যাঁকে আমরা স্রেফ কর্নেল নামেই
চিনে ও জেনে এসেছি।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত আসন পেয়েছেন অনেক
রচনার জন্যেই, যার মধ্যে রয়েছে “অলীক মানুষ”-এর উপন্যাস, আর অজস্র
সার্থক ছোটোগল্প। কিন্তু আমাদের ছোটোবেলায়, আরও নানা রহস্যভেদীর
মধ্যেও, তাঁর হাতে সৃষ্ট এই চরিত্রটি লার্জার-দ্যান-লাইফ হয়ে দেখা
দিয়েছিল। শুধু যে কর্নেলের চরিত্রটি দারুণ আকর্ষণীয় ছিল তাই নয়।
আনন্দমেলা বা শুকতারা হাতে পেলেই আমরা কর্নেলের লেটেস্ট রহস্যভেদ-তথা-অ্যাডভেঞ্চারের
ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম রহস্যের টানে যেমন, তেমনই চরিত্রটি ও তাঁর
সঙ্গে অন্যান্য নিয়মিত চরিত্র (কর্নেলের ‘পুরাতন ভৃত্য’ ষষ্ঠীচরণ
, অধিকাংশ গল্পের কথক: দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত
চৌধুরী, এবং প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ও বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ
কে.কে. হালদার)-দের দেখা পাব বলে, বা ইলিয়ট রোডে তাঁর জাদুঘর-সদৃশ
ফ্ল্যাট আর ছাদের “শূন্যোদ্যানে” সযত্নলালিত নানা ক্যাকটাসের সম্বন্ধে
জানব বলে।
এহেন কর্নেলের প্রথম আবির্ভাব প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে হলেও আনন্দমেলা
পত্রিকার সৌজন্যে কর্নেল এসে পড়লেন ছোটোদের রাজ্যে, আর তাঁর সঙ্গে
চলল আমাদের পাখি দেখা, প্রজাপতি ধরা, দেশ-বিদেশ (এমনকি অন্য গ্রহেও)
ঘোরা, আর রহস্যভেদ! ছোটোদের জন্যে লেখা কর্নেলের সেই সব রহস্যভেদ-তথা-অ্যাডভেঞ্চার
পড়তে ইচ্ছে হলে এখন আর চিলেকোঠা থেকে পুরনো ম্যাগাজিন নামাতে হবে
না, বা নানা প্রকাশকের নানা মাণের বই থেকে পছন্দের লেখাটি খুঁজতে
হবে না। দে’জ পাবলিশিং বড়োদের জন্যে লেখা কর্নেলের যাবতীয় কাহিনি
ষোলো খণ্ডে প্রকাশ করার পর, এবার ছোটোদের জন্যে লেখা (প্রায়)
সব লেখা চারটি খণ্ডে প্রকাশ করেছে। সেই বইগুলোর খবর নিচে দেওয়া
গেল।
কিশোর কর্নেল সমগ্র: খণ্ড-১
হার্ডকভার, পৃষ্ঠা: ৩৫২
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০০৫
ISBN: 81-295-0459-6
সূচিপত্র
১ কোকোদ্বীপের বিভীষিকা
২ ঘড়ি রহস্য
৩ প্যান্থার রহস্য
৪ মানুষখেকোর ফাঁদ
৫ অরুণাচলের ইয়েতি
৬ ডমরুডিহির ভূত
৭ কালো ছাতার উত্পাত
৮ অকালকুষ্মাণ্ড
৯ প্রতাপগড়ের মানুষখেকো
১০ গুর্গিন খাঁর দেয়াল
১১ টুপির কারচুপি
১২ টোরাদ্বীপের ভয়ংকর
১৩ হাট্টিমরহস্য
১৪ কালোকুকুর
১৫ ঘটোত্কচের জাগরণ
১৬ দুঃস্বপ্নের দ্বীপ
১৭ চিরামবুরুর গুপ্তধন
১৮ কিংবদন্তীর শঙ্খচূড়
১৯ তিব্বতী গুপ্তবিদ্যা
২০ লোহাগড়ার দুর্বাসামুনি
২১ তুরুপের তাস
২২ ভূত্রাক্ষস
২৩ যেখানে কর্নেল
২৪ সবুজ বনের ভয়ংকর
২৫ কালো বাক্সের রহস্য
২৬ কোদণ্ডের টঙ্কার
২৭ ওজরাকের পাঞ্জা
কিশোর কর্নেল সমগ্র: খণ্ড- ২
হার্ডকভার, পৃষ্ঠা: ৩৫২
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০৭
ISBN: 81-295-0669-6
সূচিপত্র
১ কঙ্কগড়ের কঙ্কাল
২ ইয়াজদগির্দের হিরে
৩ রামগরুড়ের ছানা
৪ ধূমগড়ের পিশাচরহস্য
৫ টাক ও ছড়ি রহস্য
৬ শ্মশান রহস্য
৭ কা-কা-কা রহস্য
৮ অশ্বডিম্ব রহস্য
৯ কঙ্কগড়ের রহস্য
১০ তিতলিপুরের জঙ্গলে
১১ জুতো রহস্য
১২ কালো গোখরো
১৩ কর্নেলের জার্নাল থেকে - ১
১৪ কর্নেলের জার্নাল থেকে - ২
১৫ আফগান হাউন্ড রহস্য
১৬ হিকরি ডিকরি ডক রহস্য
১৭ অলক্ষ্মীর গয়না
কিশোর কর্নেল সমগ্র: খণ্ড-৩
হার্ডকভার, পৃষ্ঠা: ৩৫২
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০৮
ISBN: 978-81-295-0775-4
সূচিপত্র
১ আলেকজান্ডারের বাঁটুল
২ লাফাং চু দ্রিদিম্বা রহস্য
৩ বলে গেছেন রাম শন্না
৪ কোদণ্ড পাহাড়ের বা-রহস্য
৫ ভীমগড়ের কালো দৈত্য
৬ পদ্মার চরে ভয়ঙ্কর
৭ ভূতুড়ে এক কাকতাড়ুয়া
৮ রাজবাড়ির চিত্ররহস্য
৯ প্রেতাত্মা ও ভালুক রহস্য
১০ সিংহগড়ের কিচনি-রহস্য
১১ রাজা সলোমনের আংটি
১২ বত্রিশের ধাঁধা
কিশোর কর্নেল সমগ্র:
খণ্ড-৪
হার্ডকভার, পৃষ্ঠা: ৩৩৫
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১০
ISBN: 978-81-295-0803-4
সূচিপত্র
১ ব্যাকরণ রহস্য
২ . আজব বলের রহস্য
৩ পোড়ো খনির প্রেতিনী
৪ নীলপুরের নীলা রহস্য
৫ হায়েনার গুহা
৬ হিটাইট ফলক রহস্য
৭ ঠাকুরদার সিন্দুক রহস্য
৮ রায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য
৯ কালিকাপুরের ভূত রহস্য
ছোটো-বড়ো মিশিয়ে এই মোট ৬৫টি উপাখ্যানের গুণগত মাণ নিয়ে আলোচনায়
আমি যাচ্ছি না। শিশু-কিশোর সাহিত্যে সত্তর-আশির দশকে যে জোয়ারটা
এসেছিল তার ধাক্কায় পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। আনন্দমেলা
এক্ষেত্রে একটা গেম-চেঞ্জারের ভূমিকা নেয়, আর তাতে পাঠকের ও সম্পাদকের
দাবিতে নিয়মিতভাবে লিখে যেতে হয়েছে সিরাজকে। এর ফলে সবক’টি লেখাই
উত্কৃষ্ট হয়নি। কিশোর পাঠক হিসেবেও এই লেখার যে জিনিসগুলো আমায়
মাঝে-মাঝে রাগিয়ে দিত সেগুলো হল: -
a) অনেক লেখায় রহস্যের মধ্যে বিজ্ঞানের উপাদানের বদলে এক-ধরণের
সিউডো-সায়েন্স এসে পড়েছে। ফেলুদা বা কাকাবাবুর নতুন অ্যাডভেঞ্চার
থেকে যেমন আনন্দের পাশাপাশি নতুন কিছু জানা আর শেখাও যায়, কর্নেলের
কাহিনীতে সেই শেখার জায়গাটায় খামতি থেকে গেছে।
b) অনেক লেখায় কমিক এলিমেন্টের আধিক্যের ফলে রহস্য থেকে গল্পের
ফোকাস নড়ে গিয়ে শেষে লেখাটাই মাটি হয়ে গেছে। এটা বিশেষ ভাবে সেই
গল্পগুলোয় হয়েছে যেখানে সিরাজের অন্য এক চরিত্র, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত
তাঁর নানা উদ্ভট ও আজগুবি আবিষ্কার নিয়ে কর্নেলকে সাহায্য/সঙ্গ
দিয়েছেন কোন অ্যাডভেঞ্চারে।
c) কর্নেলের প্রায় কোন অ্যাডভেঞ্চারই বাস্তবে চেনাজানা জায়গায়
ঘটেনি। হয়তো বা এই লেখার শুরুতে বলা সীমাবদ্ধতা (মানে এমন একটা
পটভূমি তৈরি করা যেটা রহস্যভেদী হিসেবে কর্নেলের স্বভাব আর পছন্দ-অপছন্দের
সঙ্গে খাপ খাবে)-ই এর জন্যে দায়ী।
এবার আসি এই বিশেষ “সমগ্র” নিয়ে আমার কয়েকটি অস্বস্তি ও আক্ষেপের
কথায়।
প্রথমত, এটি কর্নেলকে নিয়ে ছোটোদের জন্যে লেখা সমস্ত কাহিনির
সংকলন নয়। কল্পবিজ্ঞান আর রহস্যের অনবদ্য অ্যাডভেঞ্চার “চাঁদের
পাথর” আমি এই বইগুলোর কোথাও খুঁজে পাইনি। আশা করি যে পরবর্তী সংস্করণে
লেখাটা কোন না কোন খণ্ডে জায়গা পাবে।
দ্বিতীয়ত, লেখাগুলো কালানুক্রমিক ভাবে সাজানো হয়নি, যেটাকে সম্পাদকীয়
ত্রুটি (বা পাতি আলসেমি) ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছেনা।
তৃতীয়ত, এবং আমার মতে সবথেকে গর্হিত অপরাধ, লেখাগুলোর প্রথম প্রকাশ
(পত্রিকায় ও পরে বই হিসেবে)-সংক্রান্ত কোন তথ্যই দেওয়া হয়নি। এটা
দেখে আরও বেশি খারাপ লাগে যে, যেখানে স্রেফ সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসায়,
কোন রকম অর্থলাভের প্রত্যাশী না হয়ে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে একের
পর এক মানুষ এই লেখাগুলোর প্রথম প্রকাশ এবং মূল অলঙ্করণ সবার মধ্যে
ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সেখানে প্রকাশক হিসেবে দে’জ এটুকুও দায়িত্ববোধ
দেখাতে পারলেন না?
যাইহোক, সে সব কথা পরে ভাবা যাবে। আপাতত বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে,
বা পড়ব-পড়ব করছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে হাতে যেকোন একটা খণ্ড নিয়ে বসে/শুয়ে
পড়ুন, আর সোজা ঢুকে পড়ুন পাহাড়-জঙ্গল-পরিত্যক্ত খনি-নদী-ঝিল-কুয়াশা-খুনখারাপি
আর অ্যাডভেঞ্চারের জগতে। ঘাবড়াবেন না, কারণ যেখানে বিপদ, সেখানে
কর্নেল।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।