প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বইয়ের খবর

অক্টোবর ১৫, ২০১৬

টগবগঃ সরল দে সংখ্যা ও উৎসব সংখ্যা

আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি



পুজো মানে কী?

আমার কাছে পুজো মানে ক’টা দিন সোফায় বা খাটে বই হাতে লম্বা হওয়ার সুযোগ।
আপনারা বলতেই পারেন, ওই রাজকার্যটি তো সারা বছর ধরেই চলে, তাহলে পুজোর ক’টা দিন একটু প্যান্ডেল-পরিক্রমা, একটু ভালো-মন্দ খাওয়াদাওয়া, কোথাও বেড়াতে যাওয়াঃ এসব করতে ক্ষতি কী? আমার উত্তর হল, ওই কাজগুলো তো সবাই করছে, অথচ পুজোর সময়ে কত ভালো-ভালো বই হাতে আসেঃ কোনোটা পূজাবার্ষিকী, কোনোটা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, কোনোটা বছরে এই একবারই প্রকাশিত হওয়া পত্রিকা, কোনোটা বা সদ্য-প্রকাশিত নতুন বই; সেগুলো না পড়লে বুকের ভেতরটা যে হু-হু করতে থাকে, তার কী হবে উপায়? এবারো আমি, পুজোর ক’দিন রণে-বনে-জলে কোথাও না গিয়ে স্রেফ বই পড়েছি। আর সেই পড়ার অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যেই আজকের “বইয়ের খবর”।

এবার পুজো উপলক্ষে আমার হাতে যত বই এসেছিল, সেই গন্ধমাদনের মধ্যে পুজোর ক’দিনের পাঠ, তথা বিশল্যকরণী বেছে নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। একটা ঝলমলে বই-এর পক্ষীরাজ তো আমাকে তার পিঠে প্রায় বসিয়েই ফেলেছিল। কিন্তু কেন জানি না, নজর আটকে গেল একটা পত্রিকার নেহাত ছেলেমানুষি প্রচ্ছদে, তারপর তার লে-আউটে, তারপর সেই পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায়; এবং শেষে “কী হইতে কী হইয়া গেল”, আমি দেখলাম যে ¬সেই দুটো নাতিস্থূল বই ব্যাগে ভরে আমি শিলচর হয়ে কলকাতা আসার জন্যে বেরিয়ে পড়েছি।

 বইয়ের নামঃ টগবগ পত্রিকাঃ “সরল দে সংখ্যা”
 প্রকাশকঃ হ য ব র ল
 সম্পাদনাঃ দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রোহণ কুদ্দুস
 প্রচ্ছদঃ রোহণ কুদ্দুস
 অলংকরণঃ সুমিত রায়
 পৃষ্ঠাঃ ৯৫়

সেই বইদুটো-র মধ্যে প্রথমটা, যাকে নিয়ে আমি আজকের লেখা শুরু করতে চলেছি, হল (ড্রামরোল-এর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন তো?):

শুধু প্রচ্ছদ নয়, গোটা পত্রিকাটিই হাতে নিলে কেমন একটা স্বপ্নের ঘোরে চলে যেতে হয়, এমন এই বইয়ের লে-আউট। যেমন বড়ো সাইজ, তেমন মোটা পাতা, তেমন ঝকঝকে বড়ো ফন্ট, তেমন পরিষ্কার ছাপা, তেমন নির্ভুল বানান আর ফর্ম্যাটিং, তেমন... মানে বুঝতেই পারছেন, বইটা হাতে নিয়ে আমার ততটাই ভালো লাগতে শুরু করল, যতটা লাগত ছোটোবেলায় ডিমের কুসুমটা খাওয়ার সময়, আর এখন রাতে বউ ঘুমিয়ে পড়লে ফ্রিজ খুলে সটাসট জলভরা সন্দেশ ভ্যানিশ করার সময়। আমি পারলে তখনই বইটা নিয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়তাম, নেহাত নানা রকম অকাজ পড়ে গেছিল!

বইটায় কী কী আছে?

বিশেষ ক্রোড়পত্রঃ

(*) মৃদুল দাশগুপ্ত-র স্মৃতিচারণঃ “সরলদা”
(*) সরল দে-র ১৭টি ছড়া এবং ৬টি গল্প, যেগুলো পড়লে আরো একবার আক্ষেপ হতে বাধ্য, যে এমন নিভৃতচারী শিশু-কিশোর সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবকের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন এখনও হয়নি, তবে তাঁর পত্রিকার গুরুভার যাঁরা তুলে নিয়েছেন হয়তো তাঁদের হাত ধরেই শুরু হবে এই কাজটি।
(*) শিশু-কিশোর সাহিত্যের আর এক নিরলস সেবক সমুদ্র বসু-র কলমে “এক নজরে সরল দে”।

লোককথাঃ

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র নির্ভার রূপান্তরে আমরা পাই আজটেক লোককথা “পৃথিবীতে গান এসেছিল”। এক সময় শিশু-কিশোর সাহিত্যে নানা দেশের ও সমাজের লোককথা অনূদিত হয়ে ছোটোদের মনের আকাশ বড়ো করে তোলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত। আশা করা যায় যে টগবগ সেই উজ্জ্বল ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবে।

গল্পঃ

১) তাপস মৌলিক-এর গল্প “শেয়াল গেল বনে”: এই অ..সা..ধা..র..ণ গল্পটা নিয়ে আমার শুধু এটুকুই বলারঃ এটা না পড়লে হে পাঠক, আপনি নিজেও জানেন না আপনি কী হারাচ্ছেন।
২) অদিতি ভট্টাচার্য্য-র “পোর্ট্রেট”: রহস্য, একটু অলৌকিক, আর অনেকটা অদ্ভুত রস দিয়ে গড়ে উঠেছে এই টানটান গল্পটা। আরো হোক।
৩) দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত-র “অশরীরী হাত”: ছোটোবেলা, সাসপেন্স, আর মানবিকতা মিশিয়ে গড়ে উঠেছে এই মর্মস্পর্শী গল্পটা। মনে রেশ রেখে যায় গল্পটা।
৪) প্রকল্প ভট্টাচার্য-র “চালাকলম”: ছোট্ট এই বুদ্ধিদীপ্ত গল্পটা শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়, এটাই দুঃখের।
৫) পুষ্পেন মণ্ডলের “মদনমোহনের গুপ্তধন”: শীর্ষেন্দুর ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজের ধাঁচে, সঙ্গে হেঁয়ালির ছন্দ আর একটু বেশি রকম ভায়োলেন্স মিশিয়ে তৈরি হয়েছে এই গল্পটা, যা তার পুরোনো ছাঁদ নিয়েও এই সময়ের পাঠকদের আনুকূল্য পেতে পারে সাসপেন্স এবং গতির সাহায্যে।
৬) অভীক দত্ত-র “মৃত্যুর গন্ধ”: লেখকের বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ না এনেই বলছি, রেবন্ত গোস্বামী-র ক্লাসিক গল্প ‘অণুঘ্রাণ যন্ত্র”-র সঙ্গে বড্ড বেশি মিল-থাকা এই গল্পটা সংকলনে না থাকলেই ভালো ছিল।
৭) সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “হাজারির বাড়ি’: গল্পটা লেখা হয়েছে ভারি ঝরঝরে ভঙ্গিতে, কিন্তু বিষয়গত ভাবে এই রকম গল্প বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে এত বেশি যে গল্পটার প্রথম থেকে শেষ অবধি কোথাও বিস্ময়ের কোনো অনুভূতিই জাগে না।
৮) মিমি রাধাকৃষ্ণান-এর “বদনচাঁদের বদান্যতা”: এত কষ্ট করে লেখা হাসির বা ভূতের বা হাস্যকর ভূতের গল্প এখনকার পাঠকদের মাথায় চাপানো বোধহয় ঠিক নয়।

বিজ্ঞান যখন ভাবায়ঃ

অনিন্দ্য ভুক্ত-র কলমে “গরমের বিপদ-আপদ” গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণ ও ফলাফল সহজ ভাষায় আজকের ছোটোদের কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু লেখাটা আরো একটু বেশি তথ্যসমৃদ্ধ এবং ভারত-কেন্দ্রিক করলে পাঠকের পক্ষে বিষয়টার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করাটা সহজ হত, লেখাটার রেফারেন্স-ভ্যালুও বাড়ত।

বেড়াতে যাওয়াঃ

রাখী নাথ (কর্মকার)-এর কলমে মার্কিন মুল্লুকের নানা জায়গার বর্ণনা আমরা এর আগেও নানা জায়গায় পেয়েছি, “স্ট্যাচু অফ লিবার্টির হাতছানিতে” নামক এই লেখাটিও যথেষ্ট সুখপাঠ্য লাগে। কিন্তু লেখাটার সঙ্গে ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত কয়েকটা ছবি দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাখীর বিভিন্ন ভ্রমণ-ভিত্তিক পোস্টের সঙ্গে যে ঝলমলে রঙিন ফটোগুলো পাই, তেমন কয়েকটা রঙিন ফটো পরের লেখাটার সঙ্গে থাকলে ব্যাপারটা আরো জুতসই হবে, তাই না?

মৃত্যুহীন প্রাণঃ
অরুণিমা রায়চৌধুরী-র কলমে এ.পি.জে আব্দুল কালাম-এর ছোটোবেলা নিয়ে লেখা “সত্যি গল্প” পড়ে সত্যিই মনে হয়, এমন মানুষকে আমরা দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেয়েছিলাম, এ কত বড়ো গর্বের বিষয় আমাদের সবার কাছে।

বড়ো গল্পঃ

বইয়ের শেষ লেখা হিসেবে আমরা পেলাম প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কলমে ইতিহাস, কিংবদন্তী, এবং কল্পনার উদাত্ত মিশ্রণে এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনি “ডাকিনী ও সিদ্ধপুরুষ”। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান যখন বিক্রমশীলা মহাবিহার ত্যাগ করে তিব্বতের পথে যাচ্ছিলেন, তখন পথের মাঝে হঠাৎ একটি বাচ্চা ছেলে তার শরণাপন্ন হয় একটাই দাবিতেঃ তার হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে দিতে হবে। ধীরে-ধীরে দীপংকরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে আরো অনেক কিছু, যার থেকে উন্মোচিত হয় এক ভয়াবহ সত্য। কিন্তু দীপংকর কি পারলেন সেই অন্ধকারের বুকে সত্য ও করুণার আলো জ্বালাতে? জানতে গেলে পড়তে হবে, কারণ আমি এর চেয়ে বেশি কিচ্ছু বলব না!

 বইয়ের নামঃ টগবগ পত্রিকাঃ “উৎসব সংখ্যা ১৪২৩”
 প্রকাশকঃ হ য ব র ল
 সম্পাদনাঃ দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রোহণ কুদ্দুস
 প্রচ্ছদঃ দোগন পদ্দিস (সৌজন্যে নির্ঘাত ক্যাপ্টেন নিমো)
 অলংকরণঃ সুমিত রায়
 পৃষ্ঠাঃ ৯৫

এই সংখ্যাটা পড়ে এতটা ভালো লেগে যাওয়ার পর কি নিজেকে আটকে রাখা যায়? তাই এর পর এল (আবার ড্রামরোল):

সম্পাদকীয় ভূমিকার বদলে নামপত্রে মাত্র দুটো খুদে প্যারাগ্রাফে দেবাশিস ও রোহণ বুঝিয়ে দিয়েছেন, উৎসবের মরসুমে ছোটোদের হাতে পড়ার মতো একরাশ জিনিস তুলে দেওয়ার জোগাড়যন্ত্র করার পর এখন তাদের আটকে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তাঁদের নেই। তাই, তার পরেই টগবগিয়ে চলতে শুরু করেছে লেখা-ছবি-ছড়ায় ঠাসা এই পত্রিকা।

বিভাগ-ওয়াড়ি সূচিপত্র না মেনে বরং যেভাবে লেখাগুলো আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছি, সেই অনুসারেই তাদের নিয়ে আমার ভালো লাগা বা আক্ষেপের কথাগুলো লিখি। গদ্যের মাঝে-মাঝে ফাঁক ভরাট করার জন্যে যেসব ছড়া গুঁজে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ভালো-মন্দ নিয়ে কিছু লিখছি না কারণ আমার মন তখন গদ্যের দিকে ছিল বলে ওদের ঠিকমতো বিচার করার অবস্থা ছিল না।

(১) ইমদাদুল হক মিলন-এর গল্প “সাপ আসে”: এই গা-ঘিনঘিনে গল্পটা পড়ে বইটা শুরু করতে গিয়ে সিরিয়াসলি মুষড়ে পড়েছিলাম। এপার বাংলায় কি শিশু-কিশোর সাহিত্যিকের এতই অভাব হয়েছে যে এইসব হাবিজাবি ইমপোর্টেড লেখা দিয়ে পাতা ভরাতে হচ্ছে?

(২) শিশির বিশ্বাস-এর গল্প “সাক্ষী ছিলেন পূর্ণচন্দ্র”: ভারত-ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায় সত্যিই কথা বলে উঠেছে এই লেখায়। দুঃখ শুধু এই যে এমন এক অসামান্য গল্পে অলংকরণ আরো একটু বেশি থাকলে গল্পটার রসাস্বাদন আরো মনোহর হত।

(৩) অরিন্দম বসু-র গল্প “টিকিট”: ভীষণ ভাবে প্রেডিক্টেবল গল্প, ভয়ের উপাদানগুলোও বড়ো বেশি আরোপিত, নইলে এই ঝরঝরে লেখাটা পড়তে মন্দ লাগে না।

(৪) প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্য অ্যাডভেঞ্চার “রাজধানীতে তুলকালাম”: বহু-প্রতীক্ষিত এই ‘ফেলুদা ফেরত’ কাহিনিটি নিয়ে আমাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা ছিল প্রবল। চরিত্র হিসেবে ফেলুদা পাবলিক ডমেইন-এ আসতে এখনও বছর পচিশ বাকি, কিন্তু আইনি কচকচানির বাইরে এই প্যাস্টিশে নিয়ে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল দুটো কারণেঃ

প্রথমত, সত্যজিতের নিজস্ব গদ্য ফেলুদার চরিত্র ও কাহিনি নির্মাণে যে কতটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল তা পরবর্তীকালে ফেলুদাকে নিয়ে বিভিন্ন সিনেমায় নতুন দৃশ্য ও চরিত্রের আমদানি করতে গিয়ে হওয়া রসভঙ্গ থেকে বোঝা গেছিল। দেখার ছিল, প্রবীরেন্দ্র সত্যজিতের গদ্যকে অবিকল অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন কি না। সেই নিরিখে এটা বলতে ভালো লাগছে যে এখানে সত্যজিতের দ্রুতগতি গদ্য ও ন্যারেটিভ গঠন অনুসৃত হলেও ভাষার ব্যাপারে অনেকটা নিজস্বতা দেখানো হয়েছে, এবং তাতেও রহস্য তথা কাহিনি উপভোগ করতে অসুবিধে হয়নি।

দ্বিতীয়ত, ফেলুদার সিনেমাগুলোতে সমকালীন উপাদান ব্যবহার করে ফেলুদাকে ‘আপডেট’ করার প্রয়াস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, প্রবীরেন্দ্র সেরকম কিছু করবেন কি না। দেখে আশ্বস্ত হলাম, দিল্লি ও রাজধানি বানান দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, গোটা লেখাতেই তাই ঘটেছে, অর্থাৎ সচেতনভাবেই এই কাহিনির ‘ঘটমান বর্তমান’ হল নব্বই-এর দশকের গোড়ার দিক। তাই ফেলুদা, সিধু জ্যাঠা, এবং আরো অনেকে বেশ সাবলীল ভাবে এমন সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন যা আজকের দিনে অসম্ভব। কিন্তু এটা এই প্রশ্নেরো জন্ম দিল যে, তাহলে কি ফেলুদাকে ‘আপডেট’ করা অসম্ভব? একমাত্র ভবিষ্যৎ-ই এই প্রশ্নের উত্তর দেবে, যখন কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর আরো অনেকে প্রদোষচন্দ্র মিত্র-র দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন।

আর হ্যাঁ, লেখাটা, কয়েকটা হোঁচট, কয়েকটা বাজে ঠোক্কর, এসব সত্ত্বেও সলিড হয়েছে। কিন্তু পত্রিকাটা নিয়ে আরো একটু হইচই না হলে, তথা কাহিনিটি বেশি সংখ্যক পাঠকের নজরে না পড়লে সেটা সত্যিই খুব খারাপ হবে, কারণ ফেলুদা ফিরেও চোখের আড়ালে থেকে যাবেন, এটা জাস্ট মেনে নেওয়া যাবে না!

(৫) সমুদ্র বসু-র ‘বিশ্বের জানালা’ সিরিজে “হারানো আটলান্টিস”: এই লেখাটা বেশ সহজ অথচ তথ্যপূর্ণ হয়েছে, কিন্তু তবু লেখাটা পড়লে আরো জানতে ইচ্ছে করে, আর এখানেই নিবন্ধকারের সাফল্য।

(৬) দেবদুলাল কুণ্ডু-র “ম্যাজিক প্রিজম”: ধুর! এই গল্পটা নেহাত হতাশ করল।

(৭) অরুণ চট্টোপাধ্যায়-এর নেওয়া শৈলেন ঘোষ-এর সাক্ষাৎকার “রূপকথার স্বপ্নের ক্ষয় নেই”: এই সাক্ষাৎকার পড়ে চূড়ান্ত হতাশ হলাম বললেও কম বলা হয়। এতে এই সময়ের শিশু-কিশোর সাহিত্যের সব থেকে বড়ো সংকটের (ছোটোদের মন থেকে বই সরে গিয়ে অন্য বিনোদনের উপাদানের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি) মোকাবিলা করার কথা তো দূরের কথা, তার অস্তিত্বকেই স্বীকার করা হয় নি। এমনকি, ছোটোদের জন্যে যাঁরা লিখছেন তাঁদের মধ্যে যাঁদের লেখা তাঁর ভালো লাগে বলে শৈলেন ঘোষ জানিয়েছিলেন, সেই তালিকায় থাকা লেখকদের মধ্যে শুধু নবনীতা দেবসেন ছাড়া আর কারো একটি বই-ও গত দশ বছরে এক কপিও বিক্রি হয়েছে বলে মনে হয় না। এই সাক্ষাৎকারের তুলনায় আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে সফল রূপকথাকার দীপান্বিতা রায়-এর সাক্ষাৎকার নিলে, বা তাঁর একটি গল্প নিলে সেটা অনেক-অনেক-অনেক বেশি ভালো হত।

(৮) শ্যামল চক্রবর্তী-র ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী’ বিভাগে “বিজ্ঞানী সুবোধচন্দ্রের দেড়শ বছর”: ভারতে শারীরবিদ্যা নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ভগীরথ, কিন্তু অধুনা প্রায় বিস্মৃত শ্রী সুবোধচন্দ্র মহলানবীশকে নিয়ে এই রচনাটি টগবগ-এর সম্পদ।

(৯) সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর গল্প “বাজবরণ”: কল্পবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-সুবাসিত গল্প লেখায় লেখকের দক্ষতা প্রশ্নাতীত; সেই ঘরানাতেই কিছুটা গথিক ভয়, কিছুটা বিজ্ঞান দিয়ে লেখা হয়েছে এই টানটান এবং সাসপেন্স-ভরা গল্পটা।

(১০) সুকুমার রায়-এর মূল রচনা অবলম্বনে সুনির্মল চক্রবর্তী-র নাটক “ভয় পেয়োনা”: ধুর! মূল রচনাটার মজার ভগ্নাংশও পেলাম না এতে।

(১১) ‘কত অজানারে’ বিভাগে কৌশিক মজুমদার-এর নিবন্ধ “সত্যিকার জেমস বন্ডঃ এক সাহিত্যিক চরবৃত্তি”: ইয়ান ফ্লেমিং-এর অমর সৃষ্টিকে নিয়ে এমন একটা লেখার ভীষণ দরকার ছিল, যা এযাবৎ আমার নজরে পড়ে নি। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এমন একটি তথ্যসমৃদ্ধ অথচ সুখপাঠ্য লেখা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্যে।

(১২) প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “মহাকালের মরণফাঁদ”: হিংস্রতা এবং লোভের পাশাপাশি এই সাসপেন্স-ভরা গল্পে প্রথম থেকে শেষ অবধি বয়ে গেছে আরো দুটো পরস্পর-বিরোধী স্রোতঃ লৌকিক, এবং অলৌকিক। গল্পের একেবারে শেষে ভয়াল ক্লাইম্যাক্স জমে ওঠার আগেই অবশ্য লেখক এক পক্ষকে জিতিয়ে দিয়েছেন। নাকি দেন নি? জানতে হলে পড়তেই হবে, এই রুদ্ধশ্বাস গল্পটি।

(১৩) ‘গ্রিক পুরাণ’ বিভাগে অমিতাভ কুণ্ডু-র লেখা “কবি গায়ক অরফিয়াসের কাহিনি”: গল্পটা অতি-পরিচিত, কিন্তু অনুবাদের ধরণটি বড়ো ভালো লাগল। ভবিষ্যতে স্বল্পজ্ঞাত আরো নানা কিংবদন্তী আর পৌরাণিক কাহিনি লেখকের দ্বারা অনূদিত হবে, এমন আশা রাখি।

(১৪) যশোধরা রায়চৌধুরী-র গল্প “আলাদিন ও তার আশ্চর্য শার্ট”: শক্তিশালী লেখকের হাত থেকে এত দুর্বল একটি গল্প পেয়ে নিদারুণ হতাশ হলাম।

(১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল-এর “টিফিনচোর”: গল্পটির পরিণতি সহজেই অনুমেয়, কিন্তু তবু লেখকের গুণে শেষ অবধি পড়তেই হয়, এবং বেশ লাগে।

(১৬) ‘প্রাচীন ভারত’ বিষয়ে প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত-র “ভারত-ভাস্কর্যে সেকালের সন্ধান”: এই লেখাটি বিন্ধুতে সিন্ধু-দর্শন করানোর যে চেষ্টাটা করেছে, কোনো প্রশংসাই তার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশের সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহীদের আলাদা ভাবে নিবন্ধটি পড়ে নিতেও অনুরোধ করছি, আর আশা রাখছি যে ইতিহাসের প্রসঙ্গ উঠলেই উচ্ছে-খাওয়া মুখ হয় যেসব ছোটোদের, তাদের মনেও কিছুটা কৌতূহল, কিছু প্রশ্ন তৈরি করে দেবে লেখাটা।

(১৭) দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র উপন্যাস “মৃত্যুদূত”: বিষবৈদ্য সিরিজের এই অতুলনীয় উপন্যাসটি পড়ে হওয়া রোমাঞ্চের এবং গা-শিরশিরানির অনুভূতি ব্যাখ্যাতীত। পড়ে ফেলুন, এবং নিজে উপভোগ করুন।

(১৮) ‘ছড়া ও কবিতা’ বিভাগে একঝাঁক কবিতা: এর মধ্যে অনেক কবিতাই ছোটোদের বিশেষ ভাবে ভালো লাগবে। আমি বিশেষভাবে রতনতনু ঘাটী, অপূর্ব দত্ত, প্রকল্প ভট্টাচার্য প্রমুখের কবিতার কথা আলাদা করে বলব, কারণ এই ছড়াগুলো আমাকে বারবার মেয়েকে পড়ে শোনাতে হয়েছে।

আনপুটডাউনেবল জিনিসে ঠাসা এই উৎসব সংখ্যা পড়ার পর দুটো কথা মনে হল, যাদের দিয়েই আমার লেখা শেষ করা যায়ঃ

প্রথমত, সরল দে পরলোকগত হলেও বর্তমান সম্পাদকীয় টিম যেভাবে পত্রিকার গুণমান নিশ্চিত করার কাজে মনোনিবেশ করেছে, সেটা খুউব ভালো জিনিস, এবং অনেক বাংলা শিশু-কিশোর পত্রিকার কাছে শিক্ষণীয়।

দ্বিতীয়ত, গতবারের উৎসব সংখ্যার তুলনায় এবারের সংখ্যাটা ছবিতে, মলাটে, এবং লেখার দিক দিয়ে অনেক-অনেক এগিয়ে, এবং প্রায় মডেল হওয়ার উপযুক্ত।

পুজো শেষ ঠিকই, কিন্তু ‘টগবগ’ পত্রিকার এই দুটো সংখ্যা হাতে এলেই যে ঢাকের বাদ্যি কানে আসবে, আর টুক করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আপনি পত্রিকাদুটো নিয়ে বসে (বা শুয়ে) পড়ার সুযোগ খুঁজবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাহলে শুভ কাজে আর দেরি কেন?



আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।