প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বইয়ের খবর

অগাস্ট ৩০, ২০১৬

“হারুণচাচা এবং পূর্বাশ্রমের গল্প” ও “আয়না মানুষ”

আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি



“গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার –
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে”।

আই.এস.বি.এনঃ 978-1-63415-666-0
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর, ২০১৫
প্রকাশকঃ সৃষ্টিসুখ
পেপারব্যাক, ১৫৯ পৃষ্ঠা
আমার তারাবাজিঃ ★★ ★ ★ ☆

না, যে বই থেকে লাইনগুলো উড়ে এসে মাঝরাতের এই বিচিত্র মেহফিলে ডানা গুটিয়ে বসল, তাকে নিয়ে দু-চার কথা লেখার ক্ষমতা আমার নেই।
বরং, মাত্র ওই ক’টা লাইন যেমন প্রত্যেক বাঙালির মনে অজস্র দৃশ্যকল্প-রূপক-ভাবনা হয়ে শেষে কিছু একান্ত নিজস্ব গল্পের জন্ম দেয়, আমিও তেমন করে কয়েকটা গল্পের কথা বলি।

শেষ অবধি, আমরা তো গল্পের জন্যেই বই পড়ি, তাই না?

আসুন, আপনাদের সঙ্গে আমি সৃষ্টিসুখ প্রকাশনার কর্ণধার, কবি, লেখক, এবং অবশ্যই “সফো” রোহণ কুদ্দুসের সাম্প্রতিকতম গল্পের বইটির পরিচয় করিয়ে দিই। বইটির নাম “হারুণচাচা এবং পূর্বাশ্রমের গল্প”।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল, শুধুমাত্র সাম্প্রতিক গল্প নিয়ে কিন্তু এই বই রচিত হয়নি, বরং তাঁর বর্তমানে অপ্রাপ্য সংকলনের পাঁচটা গল্পের সঙ্গে গত তিন বছরে রচিত গল্পের মধ্য থেকে পাঁচটা গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে এই বই। কেন? লেখকের সুস্বাদু ভাষা ধার করেই লিখিঃ “একজন সৎ লেখক হতে যতটা নির্লিপ্তি প্রয়োজন, সেটা অর্জন করতে পারিনি। তাই পূর্বাশ্রমের বল্কলের প্রতি টান এখনও ষোলো আনা। এমনকি এখন যা লেখালেখি হচ্ছে, তার প্রতি মমতাও অজিন ভেদ করে বেরিয়ে পড়ছে যত্রতত্র”।
কেমন গল্প লেখেন রোহণ?

বইটির শুরুতে প্রাককথন হিসেবে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের “অস্তিত্বনিবিষ্টতায় উত্তরণ” এই বইকে রোহণের কলমদক্ষতার বিবর্তনের দলিল বলে চিহ্নিত করেছে। কথাটা আপনি মানুন, বা না-মানুন, এই বই পড়তে গেলে এর দ্বিতীয়ার্ধ, অর্থাৎ “পূর্বাশ্রমের গল্প” আগে পড়া উচিৎ, কারণ ওটা গল্পকার রোহণের নীল-সাদা অধ্যায় (রাজনীতি নয়, আমি নক্ষত্রের দশার কথা বলতে চাইছি!), যখন তার লেখার দ্যুতি চোখকে ধাঁধিয়ে দেয় যতটা, ততটা লালিত করে না। এই পর্বে যেসব গল্প আছে সেগুলো হল:

১. দুর্যোধন মল্লিকের অসুখ-বিসুখ: এই অনবদ্য গল্পটি পড়ার পর “অন্তরে অতৃপ্তি রবে” বলে এটিকে রেগেমেগে ‘পরীক্ষামূলক’ বলে গাল দেওয়ার বাসনা জাগলেও আদতে এটি তেমন নয়, বরং প্রথাগত গল্পের ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ভেঙে চুরমার করে এই গল্পে লেখক একই সঙ্গে অনেক গুলো হাল্কা-অথচ-রঙিন সুতোর এক জটিল জট বুনেছেন।

২. প্রত্যেক শেষবার: এই গল্পে কোন চরিত্র নেই, বরং বিভিন্ন আইডিয়া পাক্কা থ্রিলারের ধরনে চলে-ফিরে বেরিয়েছে এই গল্পে, শেষে হত্যারহস্যও আছে, তবে শেষে গিয়ে এটা কিছু আইডিয়াকে গল্পের পোষাক পরানোর চেষ্টার গল্প।

৩. শিকারি, কবি এবং তীরন্দাজ: এই গল্পটা খাঁটি পরীক্ষামূলক জিনিস, যা পড়ে আপনার প্রচুর রাগ হবে লেখকের ওপর এই ভেবে যে এমন তাকতদার কলম/কিবোর্ডের মালিক হয়েও তিনি এই অদ্ভুত জিনিসগুলো কেন রচনা করছেন!

৪. বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক: যদি কখনও শিক্ষকতা করে থাকেন, সে স্কুল-কলেজে হোক বা টিউশন, এবং যদি কখনও খুব বুদ্ধিমান কোনও ছাত্রকে অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে দেখে থাকেন, এবং হাহাকার করে থাকেন, তবে এই গল্পটা পড়তে গিয়েও আপনার ঠিক তেমনই অভিজ্ঞতা হবে। এই অনবদ্য শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদগুলো দিয়ে একটা সেমি-রূপক না করে একটা গল্প বললে সেটা কী ভালোই না হত...!

৫. সুখধনবাবুর জীবন-মৃত্যু বিষয়ক আখ্যান: ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার নিয়ে এখানেও যখনতখন লোফালুফি করা হয়েছে বটে, কিন্তু টুকরো-টুকরো দৃশ্যগুলো জুড়ে শেষ অবধি একটা সঘন এবং আদ্যন্ত মানবিক গল্পই তৈরি হয়েছে বটে।

এবার আসা যাক বইয়ের প্রথমার্ধে, যার শীর্ষক হল “হারুণচাচা এবং”। এতে যেসব গল্প আছে তারা হল:

১) হারুণ চাচা: অলৌকিক এবং লৌকিকের মিশেলে এ এক আশ্চর্য গল্প, যেখানে সত্যি আর মিথ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, পড়ে থাকে ছোটোবেলার কিছু দগদগে স্মৃতি, আর হয়তো বা, খুব তাড়াতাড়ি ছোটোবেলাটা হারিয়ে গিয়ে বড়ো হয়ে যাওয়ার ব্যথা।

২) রবিঠাকুরের ফেসবুক: কল্পবিজ্ঞান, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং আরব্য রজনীর ঘরানা মিশিয়ে তৈরি এই গল্পটা যেভাবে বিন্দুতে সিন্ধুরূপী সমকালকে ধরতে চেয়েছে, সেটা তো তারিফযোগ্য বটেই, সঙ্গে গল্প হিসেবেও এটি অত্যন্ত সুপাঠ্য।

৩) কুবের সেনের ধারবাকি: দুর্যোধন মল্লিক এবং সুখধনবাবুর সঙ্গে আমাদের আগেই আলাপ থাকলে গল্পের শেষটা আপনারাও ধরে ফেলবেন, তবে বুকের মধ্যে হওয়া চিনচিনে ব্যথাটা টা বলে গায়েব হবে না।

৪) চাঁপা ঠাকুমার উত্তমপুরুষ: এই গল্পটি এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, এবং আমার পড়া সবচেয়ে নরম, অনুক্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট প্রেমের গল্পের মধ্যে অন্যতম। এই গল্পটা সবার শেষে পড়ুন, এই অনুরোধ রইল।

৫) বোধন সেন সরণি: কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে একটা ছিমছাম, অথচ শাশ্বত অনুভূতির গল্প বলা হয়েছে এতে। তবে মনে এই গল্প খুব গভীর দাগ কাটে না।

তাহলে সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল?

বইটা অনলাইনে পাবেন, কাউন্টারে পাবেন, আর তারপরেও দশটা গল্প পড়ার সুযোগ ছেড়ে দেবেন? সেটা একদম ঠিক হবে না। অবশ্যই পড়ুন।

এবার আসছি দ্বিতীয় বইয়ের খবরে। এই বইটির লেখক হলেন বিশ্বদীপ দে, আর বইটির নাম: “আয়না মানুষ”।

কেন জানি না, এই বইটা নিয়ে লিখতে গিয়ে চোখের সামনে শুধু কালীপুজোর রাত, আর তুবড়ি-‘ইলেকট্রিক তার’-রংমশালের কথা মনে পড়ছে।

আই.এস.বি.এনঃ 978-9-38270-664-9
প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০১৬
প্রকাশকঃ সপ্তর্ষি প্রকাশন
পেপারব্যাক, ৮৯ পৃষ্ঠা
আমার তারাবাজিঃ ★★ ★ ★ ★

বিশ্বদীপের গল্পের সঙ্গে যদি আপনাদের আগে পরিচয় থেকে থাকে, তাহলে আপনারা বুঝবেন, কেন আমার এমনটা মনে হচ্ছে। আর যদি আমার মতো আপনাদেরও এটাই হয় ‘ফার্স্ট কনট্যাক্ট’, তাহলে হে পাঠক, প্রস্তুত হোন গল্পের এমন এক প্রদর্শনী দেখার জন্যে যা আপনার চোখ-মন-ভুবন ধাঁধিয়ে তো দেবেই, সব আলো নিভে যাওয়ার পরেও যার রোশনাই-এর রেশ আপনার চোখের পর্দায় আঁকিবুকি কেটে চলবে, এমনকি ঘুমের গভীরেও।

এই বইটা পড়ার আগে বিশ্বদীপের লেখার সঙ্গে আমার একমাত্র পরিচয়ের সূত্র ছিল ‘দুকূল’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ। তারপর, এই বইটা পড়ে, আমি আক্ষরিক অর্থে স্তম্ভিত হয়েছি এটা ভেবে যে আমাদের নজরের আড়ালে এমন এক গল্পকার লুকিয়ে ছিলেন! শুধু প্লটের অভিনবত্ব নয়, নয় শুধু ভাষার কারিকুরি, বরং প্রায় থ্রিলারের পরিমিতিবোধ আর একান্ত বাস্তব চরিত্রায়ন: এই দুয়ের সমন্বয়ে এই গল্পগুলো হয়ে উঠেছে দেদীপ্যমান রত্নতুল্য।

যেসব গল্প আছে এই বইয়ে তারা হল:

১. ওয়ান শটার
২. সমুদ্রবীজ
৩. তারার তিমির
৪. গুপ্তধন
৫. আয়না মানুষ
৬. আটলান্টিস
৭. শেষ চিঠি
৮. শিখণ্ডী-স্থূণাকর্ণ সংবাদ
৯. কথোপকথন
১০. দৃশ্যের জন্ম

এর মধ্যে একটি গল্প পৌরাণিক, কিন্তু তার মূল সংকট যে বিষয় নিয়ে, তা চিরন্তন। শেষ গল্পটি গল্পের একরৈখিক চরিত্র ভেঙে বরং দৃশ্যের পর দৃশ্য তুলে ধরে গল্পকে নিয়ে গেছে তার নির্মম পরিণতির দিকে। কিন্তু গল্পগুলো পড়লে একটাই কথা মনে হয়।

এই সময়, তার বিপুল সমুদ্রে মথিত হয়ে চলা অজস্র ছোটো-বড়ো চরিত্র, তাদের ক্ষুধা-হাহাকার-ব্যর্থতা-সাফল্য-ক্লান্তি, তাদের যৌনতা, তাদের লোভ: এরাই আসলে মানুষের আকার নিয়ে আমাদের চেনাজানা মানুষদের মতো ভাষায় কথা বলেছে, রংরূপ নিয়েছে, এই গল্পগুলোয়।

কিছুই কি ত্রুটি নেই এই গল্পগুলোয়? আছে, কিন্তু আমি সেই নিয়ে গজগজ করব না, কারণ গল্পের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া অজস্র পাঠকের মতো আমিও যখন হঠাৎই সন্ধান পেয়েছি এমন এক গল্পকারের, তখন আমি সব পাঠককে অনুরোধ করব এই বইটা পড়তে, এবং লেখককে মতামত জানাতে।

এমন একজন দক্ষ কাহিনিকার ‘ওয়ান শটার’ হয়ে থেমে যান, সেটা নিশ্চয়ই আমরা কেউই চাই না, তাই না?


আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।