বইয়ের খবর
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬
'গল্পকথা' ও 'গল্পের খোঁজে'
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
“মেঘ বালিশে মাথা রেখে তারারা যে শোনে, আকাশ গল্প বলে”।
ছোটোবেলায় রেডিও থেকে ভেসে আসা পুরোনো গানের এই লাইনটা আমার বড্ড ভালো লাগত। মনে হত, শুধু আমি নয়, অযুত-নিযুত তারায় ভরা রাতের আকাশ-ও এক গল্পের আসর যখন হয়ে উঠেছে, তখন মা’কে “গল্প বলো” বলে জ্বালানোই যায়।
গল্প শুনতে আমি এখনও ভালোবাসি, তবে এখন তো ‘বড়ো’ হয়ে গেছি, তাই শোনার বদলে পড়াই ভরসা। আর তেমন ‘গপ্পোবাজ’ বইয়ের সন্ধানে বেরিয়েই সম্প্রতি আলাপ হল দুটি বইয়ের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যেই আজকের ‘বইয়ের খবর’।
বইয়ের নামঃ গল্পকথা
লেখকঃ শুভেন্দু দত্ত
প্রকাশকঃ ইন্ডিক হাউস
প্রথম প্রকাশঃ জুন, ২০১৬
হার্ডকভার, ২৩৬ পৃষ্ঠা
প্রচ্ছদঃ টকিং ট্রি
আই.এস.বি.এনঃ 978-81-926774-8-4
আমার তারাবাজিঃ পাঁচে এক ★☆ ☆☆ ☆
|
প্রথম বই
এমন একটি পরিচ্ছন্ন, বানানভুল-বর্জিত, সুমুদ্রিত, সু-অলংকৃত বইকে বাজে রেটিং দিতে মন চাইছে না, কিন্তু কেন দিলাম সেটা গল্প ধরে-ধরে স্পষ্ট করেই লিখবার চেষ্টা করছি।
১) ছায়ামূর্তি: কৌতূহলোদ্দীপক সূচনা, ঝরঝরে ভাষা, কিন্তু গল্পটা শেষে গিয়ে ছকে বাঁধা ‘লটের মাল’ হয়ে গেল।
২) চ্যাটরুম: সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে পুরোনো দিনের লোকেদের মনে যে ভীতিগুলো থাকে, তারই প্রতিফলন হয়েছে এই গল্পে, যা যেমন অবাস্তবিক, তেমনই গতবাঁধা, তেমনই পরিণতিহীন।
৩) উত্তাপ: এই গল্পের প্রটাগনিস্ট, তথা অ্যান্টাগনিস্ট-কে নিয়ে লেখক যে ঠিক কী করতে চেয়েছেন, সেটা বোধহয় তাঁর কাছেও স্পষ্ট ছিল না। তুলনাটা অত্যধিক উচ্চমাণের হলেও বলতেই হচ্ছে, বঙ্কিম যেমন রোহিণীকে তিলোত্তমা করে তুলেও সমকালের চাপে গোবিন্দলালকে দিয়ে তাকে খুন করিয়েছিলেন, লেখকও সম্ভবত এমন একটি ব্যতিক্রমী নারী চরিত্র তৈরি করে তারপর দিশেহারা হয়ে গেছিলেন। সবাই তো আর দেবতোষ দাশের মতো করে “বিষকন্যা” নির্মাণ করতে পারেন না।
৪) টুসি: গল্পটা বেশ ভালোভাবেই শুরু হল নারী-পুরুষ সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং বালিকার ইনফ্যাচুয়েশন নিয়ে, শেষ হল একগাদা স্টিরিওটিপিক্যাল চরিত্রগঠন এবং সমাজকল্যাণের ধামা ধরে। ফলে যা হওয়ার তাই হল, অর্থাৎ মুখ্য চরিত্রটি শেষে কী করল তা জানার আগেই গল্পটা মারা গেল।
৫) জায়া, জননী, যৌবন: সত্তর দশকের হিন্দি সিনেমা, এবং অঞ্জন চৌধুরীর ‘বউ’ সিরিজের সার্থক উত্তরসূরী এই গল্পটি তার আদ্যন্ত কৃত্রিম চরিত্রদের ও সংলাপ নিয়ে একটি ‘পিরিয়ড পিস’। এই গল্পটিকে লেখক বইয়ের মধ্যে রেখে আমাদের মতো তুচ্ছ পাঠকের হাতে ছেড়ে না দিয়ে কোনও মিউজিয়ামে বা আর্কাইভে পাঠিয়ে দিলেই ভালো করতেন।
৬) বিযুক্ত অধ্যাস: আর একটু সংযম, আর একটু পরিমার্জনা, আর একটু সুন্দর ভাষা থাকলে এই একটি গল্প, তার ‘ডেটেড’ বহিরঙ্গ নিয়েও অনেক উঁচু হয়ে উঠত। তবে সেসব ছাড়াও আমি গল্পের শেষটা মনে রাখব।
৭) চোর: ধুর! এই সব বড়ো-বড়ো এবং অপ্রাসঙ্গিক জিনিসে ঠাসা লেখা পড়ার তুলনায় বনফুলের একটি পোস্টকার্ড সাইজের গল্প পড়লে মনের নিস্তরঙ্গ পুকুরে অনেক বেশি ঢেউ ওঠে।
৮) নকল বুঁদির গড়: লেখকের মনে হয় আজকের স্মার্টফোন এবং অবাধ (শরীরী) বন্ধুত্বের ডাকে সাড়া দেওয়া মেয়ে/মহিলা-দের নিয়ে কোনও কমপ্লেক্স আছে, যেজন্যে তিনি একের পর এক গল্পে তেমন চরিত্র তৈরি করছেন, আর তারপর তাদের মেটাফরিক্যালি বা লিট্যারেলি মেরে ফেলছেন, সঙ্গে গল্পটাও!
৯) মৌ-মহুয়া: এক ধরনের গল্প হয়, যার শুরু থেকে শেষ অবধি প্রেডিক্টেবল হয়, যাতে নারী চরিত্রেরা শুরুতে স্মার্ট ও সুন্দরী হয়েও শেষে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হয়, যাতে পুরুষ চরিত্রেরা বেশির ভাগ সময় “তুমি অমনি চেও না, আমি ক্যাবলা হয়ে যাই” স্টাইলে থাকে, এবং যাকে আমরা ‘গোল’ গল্প বলি। এটি তেমনই একটি ‘গোল’ গল্প, যা এই সময়ে কোনও লেখক সম্ভবত লিখতে বসেও সিঁটিয়ে থাকবেন গোলাগুলির আশংকায়। ড. দত্ত বীরপুরুষ, তাই এই জিনিস বইয়ের মাধ্যমে আমাদের কাছে পেশ করেছেন।
১০) চাকরি: এই গল্পটা প্লট, চরিত্রায়ন, সংলাপ, আদি-মধ্য-অন্ত সবেতেই এমন ক্লান্তিকর রকম বোরিং এবং চর্বিতচর্বণ, তথা ক্লিশে হয়ে যাওয়া সিরিয়ালের-অধম, যে এটা পড়াটাও একটা ঝকমারি ছিল।
১১) একদিন বন্ধনহীন: আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে এই গল্পটা সত্যি হলেও হতে পারত, কিন্তু আজকের বাংলায় এটা হাস্যকর রকমের কৃত্রিম। এই ‘পিরিয়ড পিস’-টিকেও বই থেকে দূরে রাখলেই পারতেন লেখক।
১২) নববর্ষ আসে, নববর্ষ যায়: এই বইয়ের মূলত খাজা গল্পের ভিড়েও এটি বিশিষ্ট খাজা, এবং পড়ার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
ঠিকই ধরেছেন, আমার দেওয়া একমাত্র তারাটির জন্যে পুরো কৃতিত্ব লেখকের নয়, বরং প্রকাশকের। আপনি যদি ড. দত্তের অধীনে গবেষণারত হন, এবং এই বইয়ের বিভিন্ন নারী চরিত্রের স্টাইলে তাঁকে, ইয়ে, প্রভাবিত করে ভালো গ্রেড পেতে চান, একমাত্র তাহলেই দু’শো কুড়ি টাকা গচ্চা দিয়ে এই বই পড়ুন, নইলে নয়।
বইয়ের নামঃ গল্পের খোঁজে
লেখকঃ অদিতি ভট্টাচার্য্য (বানান অপরিবর্তিত)
প্রকাশকঃ সৃষ্টিসুখ
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৪
পেপারব্যাক, ৭২ পৃষ্ঠা
প্রচ্ছদঃ তৌসিফ হক
আই.এস.বি.এনঃ 978-1-63415-048-4
আমার তারাবাজিঃ পাঁচে তিন ★ ★ ★ ☆ ☆
|
দ্বিতীয় বই
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনার অন্য বইগুলো যেমন হয়, তেমনই ছিমছাম, সুদৃশ্য, এবং বোনাস হিসেবে গল্পগুলোর প্রথম প্রকাশ সংক্রান্ত তথ্যে সমৃদ্ধ এই বইটি হাতে নিয়েই পড়তে ইচ্ছে করে।
গল্পকার হিসেবে অদিতি ভট্টাচার্য সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং পাঠক-মহলে সমাদৃত। তাঁর স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে লেখা যে গল্পগুলো এই বইয়ে স্থান পেয়েছে তারা হলঃ
১) প্রতীক্ষা: সহজ ভঙ্গিতে লেখা এই গল্পটা প্লটের দিক দিয়ে খুব একটা অভিনব নয়, তবে গল্প বলার ভঙ্গিটা আকর্ষণীয় বলে একবার পড়তে ভালো লাগে।
২) গল্পের খোঁজে: এই গল্পটা সার্থকনামা, কারণ অনেক কথা এবং বিভিন্ন চরিত্রের অনেক আন্তঃক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আমি এতে শেষ অবধি পড়েও ঠিক গল্প খুঁজে পাইনি। হয়তো আপনি পাবেন।
৩) মনের দেওয়াল: নিতান্ত সহজ বিষয়, যা নিয়ে আজ অবধি হিচককিয়ান মার্ডার মিস্ট্রি থেকে শুরু করে রঞ্জিৎ মল্লিকের সিনেমার প্লটের মতো কত গল্প যে লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই গল্পটা না লিখলেও বোধহয় ক্ষতি হত না।
৪) বৃত্ত: প্লটটা সম্ভাবনাময় হলেও গল্পটা লেখা হয়েছে একেবারে রুটিন ধাঁচে। ফলে প্রথম কিছুটার পর আর পড়তে একটুও ভালো লাগেনি।
৫) সম্পর্ক: আরও একটি ‘গোল’ গল্প, যা শুরু থেকে শেষ অবধি পড়ার জন্যে নিজেকে রীতিমতো টানতে হল। এখানে একটি পুরুষ চরিত্র খল, কিছু নারী চরিত্র হালের টিভি সিরিয়ালের থেকে ‘কিউ’ নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে কুচক্রী, সর্বোপরি গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি দীর্ঘশ্বাসে ভরা (প্রধান চরিত্রের, হয়তো বা পাঠকেরও)।
৬) খেয়াল: ইশশশ! এই প্লট নিয়ে একটা দুর্দান্ত গল্প বলা যেত, কিন্তু লেখকের হাতে সেটা যা-তা একটা ফিচারের অধম হয়ে গেছে।
৭) তাগিদ: এই গল্পেও একটা চমৎকার প্লট ছিল, একটা ক্রাইসিস ছিল, বেশ কিছু বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র ছিল। কিন্তু লেখক বিরিয়ানির মশলা দিয়ে চচ্চড়ি রেঁধেছেন।
৮) অসাধারণ: ‘জয়ঢাক’-এ পড়া এই গল্পটা পড়ে আমি বছর সত্তরের চিত্রা বন্দোপাধ্যায়ের ফ্যান হয়ে গেছিলাম। গল্পটা সত্যি ভালো, এবং অনলাইনে উপলব্ধ। সুযোগ পেলে অবশ্যই পড়ুন।
৯) ওই দুজন: হ্যাঁ, এই গল্পটার ইমোশনাল পাঞ্চ তার প্রেডিক্টেবলিটি, এবং কিছু জায়গায় সংলাপের আড়ষ্টতা লঙ্ঘন করে দ্বিতীয়, এমন কি তৃতীয় পাঠেও অনুভূত হয়। ভালো গল্প।
১০) অন্তরালে: সহজ, ছিমছাম গল্প, কিন্তু সেটাই বলা হয়েছে এমন এক পরিমিতির সঙ্গে যা যথার্থ ভাবে সম্ভ্রম-উৎপাদক। বেশ ভালো লাগে এই গল্পটা।
মাত্র ৭৫ টাকা দামের এই বইটা তাই, শেষের ওই গল্পক’টার জন্যে কিনতেই পারেন। হয়তো উৎসাহিত লেখক ভবিষ্যতে এমনই পরিমিতি নিয়ে ভালো-ভালো প্লটগুলো দিয়ে আরও ভালো গল্প আমাদের উপহার দেবেন। তারারাও যখন গল্প শোনে, তখন আমি-আপনি গল্পের জন্যে এটুকু তো করতেই পারি, তাই না?
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।