প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭

 

প্রাণের মেলা

অভীক দত্ত


গত কুড়ি বছর ধরে কলকাতায় শীত শেষ হয়ে আসার দু’সপ্তাহ আগে আমি প্রত্যেকবার প্রেমে পড়ি। প্রেমই তো। প্রেম ছাড়া তো কিছু নয়। প্রেমিকার জন্য অপেক্ষায় যে শিহরণমেশানো উদ্বেগ থাকে, তেমন করেই অপেক্ষা করি। প্রথম চুম্বন ফিরে পাওয়ার যে আকুতি থাকে পরবর্তী সমস্ত ওষ্ঠস্পর্শে, সেই আকুতি নিয়েই আমি ২০ বছর ধরে প্রতিবার বইমেলার মাঠে গিয়ে দাঁড়াই। অনপনেয় এই আসঙ্গলিপ্সার শুরু ঠিক দুই দশক আগে এবং অসম্ভব রকম বর্তমান।

আজ থেকে ২০ বছর আগের একটা শীতবিকেল। একটা ছেলে কলকাতার ঠিক মধ্যিখানে একটা ধুলো মাখা বইমেলার এক কোণে কালোফ্রেমের চশমাপরা একটা লোকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে- বাবা কখন এই সব ঢাউস ঢাউস ইংরেজি বইয়ের দোকান ছেড়ে বেরোবে আর বেরিয়ে আসবে খোলা মাঠে। ছেলেটার মাথায় ঘুরছে টিনটিনের বই। ছেলেটা মন ফেলে এসেছে ক্যান্ডিফ্লসের দোকানে।

তারপর অনেকবছর ছুটে চলে গেলো আলোর গতিতে অনির্দেশ। বইমেলা সাকিন পাল্টালো। পাল্টালো জমিন। চারদিকের ভিড় পাল্টালো। পাল্টে গেলো শামিয়ানা যত। বইমেলা এখন শহরের বাইরে শক্তপোক্ত কাঠামোর এক প্রাঙ্গণে। ময়দানের ধুলো ঘাস শীতের বাতাস নিয়ে চলে গেছে ছেলেটার শৈশব। লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের ধারে বড় হয়ে যাওয়া অগোছালো ছেলেটা হাতে বইবোঝাই ব্যাগনিয়ে অপেক্ষা করেছে কোনো এক হলদে শাড়ির। দূরে যখন ভিড়ের পায়ে উড়তে থাকা ধুলোর মাঝে হলুদ শাড়ি আর কাঁধের ঝোলা ব্যাগটি নজরে পড়লে মুখে জোর করে আনা উদাসীনতার এক পরত মেখে দাঁড়িয়ে থেকেছে। পনেরো মিনিট দেরি কি কম নাকি?

কখনো সেই ছেলেটা তার মতো আরও তিন যুবকের সঙ্গে শামিল। এবং মুশায়েরার গ্যেটে সংখ্যা নিয়ে টানাটানি। পিছনদিকে সিগারেটের সুখটানে মুহূর্তে জ্বলে উঠছেন কিয়ের্কেগার্দ। কোনো এঁচোড়েপক্ক দস্তয়েভস্কিকে দুঃখবিলাসী বললে হাতাহাতি। শ্যামনগরের কোনো কবি গ্রাচুইটির টাকায় বই ছেপেছেন, তাকে মেলা ফিরিয়ে দিচ্ছে খালি হাতে। থীম দেশের প্যাভিলিয়নে দুর্গাপুজোর ভীড়। বইমেলাতেই জানা গেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক পৃথ্বীরাজ সেন।

বইমেলাতো সতত প্রসারণশীল ব্রহ্মাণ্ডের মায়ামুকুর। তলস্তয়ের ছোটগল্পের মতো বিষণ্ণতায় উজ্জ্বল, সাগানের প্রবন্ধের মতো ম্যাগনেটিক, বঙ্কিমের লেখার মতো দৃঢ়ভিত্তি আবার মার্কেজের উপন্যাসের মতো কুয়াশাস্তীর্ণ। জনসমুদ্রের একেক দিন 'জঙ্গম' উপন্যাসের একেকটি খন্ডের মতো বিচিত্রচরিত্রপ্লাবিত, বালজাকের কমেডি ইউমেন এর মতো পরস্পর সংশ্লিষ্ট মহাকাব্যিক চিত্রাভাস। মেদিনীপুরের যে গ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্রটি ট্যুইশন শেষে মেসে না ফিরে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে এসেছে মেলায়, তার পিছনের স্টলটিই দেবসাহিত্য কুটির। বছর কুড়ি আগে মনে হতো এখানেই রাখা থাকে সলোমনের রত্নপেটিকা। ওখানেই টম ব্রাউন নামে এক ছেলের সাথে আলাপ, যে সবে বোর্ডিংস্কুলে পড়তে এসেছে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে। ওখানেই নিকোলবি বাড়ির নিকোলাস আর গেঁয়ো ছোকরা জিম হকিন্সের কিস্যা জানতে পারা। লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের এক কোণে তাঁতের টিয়ারং শাড়ির যে মেয়েটি অবাধ্য চুল সামলে একটা সিগারেট ধরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তার তীক্ষ্ণ চিবুকটি খালি খালি। ঐখানে এক কৃষ্ণতিল থাকার কথা। মেয়েটির বাঁদিকের টেবিলটাও শূন্য। ওখানে তীব্রকুঠারের সম্পাদক মশাই বসতেন বই সাজিয়ে। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সামনে চল্লিশোর্ধ যে গৃহবধূটি ঝুঁকে দেখছে অনামা ছেলেটির হাতের আঁকা, সে কি জানে ওই প্যাভিলিয়নেই হুমায়ুন আজাদ একদিন প্রথম ঈশ্বর হয়েছিলেন! প্যাপিরাসের ছোট স্টলটির মধ্যে ঢুকে অফিস কেটে আসা যে খয়েরি জামার স্বল্পকেশ ভদ্রলোক আনমনে উল্টে যাচ্ছেন আলেক্স হেইলির রুটস্ এর পাতা, তিনি কি ওই বইয়ের পাতায় খুঁজে পাচ্ছেন কোনো বালকের ফেলে আসা মুগ্ধতা! অনুষ্টুপের স্টলে ভিড় বড্ডো বেশি। কোণের দিক ঘেঁষে কাশরঙা চুলের এক প্রৌঢ় গল্প করছেন। তাঁকে দেখলে সম্ভ্রম জাগে। পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাঁর কথা গিলছে দুই সুবেশী। ওঁদের তিনজন ঢেকে দিয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বইগুলো। ওঁদের অবয়বে ঢাকা পড়েছে প্রথম সুশৃঙ্খল চিন্তনের উন্মেষ, প্রথম উদ্ধত প্রশ্নের জন্মদাগ। বেঙ্গল পাবলিশার্সের পাশে একঝাঁক কলেজপড়ুয়া সেল্ফিব্যস্ত। ওদের উছ্বাস আর বেনফিশের প্রাণকাড়া গন্ধের দশহাত দূরে ঢোঁড়াই বরাবরের মতো আজও অপেক্ষায় সতীনাথ গ্রন্থাবলীতে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নতুন করে ছেপেছেন সাহিত্যসাধক চরিত, নতুন রূপে প্রকাশিত কবি নবীনচন্দ্রের আমার জীবন। চকচকে এই এডিশনগুলির পাশে হলদে হয়ে আসা তুলোট কাগজের সেই পুরোনো বইগুলি বড্ডো বেমানান। নিষ্পাপ কৈশোরের মতো তারা পাড়ি জমিয়েছে স্মৃতির ঘরে।

পেঙ্গুইনের স্টলে নাদুসনুদুস যে অবাঙালি ছেলেটি টেক্সটবইয়ের খোঁজকরে পৃথিবীটাকে প্রাণপণে ছোট করে দিচ্ছে, তার পাশের তাকে রাখা বইগুলো তার সেই প্রয়াসে বাধা দিচ্ছে সগর্বে। জোসেফ কনরাড আর ফিটজেরাল্ডের হলদে পেপারব্যাকের উপর হাতবোলাতে বোলাতে আজকের তিরিশের সেই ছেলে পৌঁছে যাচ্ছে সেই দিনে যেদিন তার পৃথিবী আকাশ ছুঁয়েছিল পেঙ্গুইনের স্টলে। যেদিন বাবা ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড। অক্সফোর্ড, হার্পার কলিন্স ক্রমাগত সমান্তরাল এক বাস্তব তৈরী করতে থাকে। সারামাগোর ডাবল উপন্যাসে নায়ক যেমন নিজের আরেক অস্তিত্বকে নিজের বাইরে দেখতে পায়, তেমনই আজ তিরিশের সেই ছেলে দেখতে পায় আঠেরোর নিজেকে- তুর্গেনেভ হাতে- আর ধন্দে পড়ে যায়। অবাস্তবের কুয়াশা বাস্তবের ঘর দখল করতে থাকে। পুরোনো প্রেমিকার চাউনির মতো ঘৃণামিশ্রিত আহ্বানের লুকোচুরি খেলতে থাকে জেরুজালেমের ইতিহাস আর ব্রহ্মাণ্ডসৃষ্টির পদার্থবিজ্ঞান।

২০ বছর পরে আজও মেলায় দাঁড়িয়ে হাতে তুলে নেওয়া বইয়ের সাথে প্রথম পরিচয়ের থেকে গভীরতর কোনো অনুভব, তীব্রতর কোনো আশ্লেষ, দৃঢ়তর কোনো বন্ধন আমি জেনে উঠতে পারিনি।


আলোচক পরিচিতি - লেখক রসায়নবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো ও লেখালিখিতে আগ্রহী।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।