বইয়ের খবর - একবাক্স উপন্যাস (শিশু কিশোর আকাদেমি)
মার্চ ১৫, ২০১৬
'“ইয়াহুউউউ” বলে গর্জনটা সাবধানে করবেন। ৬৫ ডেসিবেলের একটা ব্যাপার আছে তো।'
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
ছোটোরা কী ধরণের লেখা পড়তে ভালোবাসে?
ধরুন, আপনি শিশু-কিশোর সাহিত্যের বিষয়বস্তু বাছতে গিয়ে রোলকলের মতো করে ডাক দিলেন। ভূত/ভয়, রহস্য-রোমাঞ্চ, হাসি, অ্যাডভেঞ্চার: এরা একডাকেই উঠে আসবে। সঙ্গে প্রায় নিঃশব্দে আসবে মূল্যবোধ-বিষয়ক/সামাজিক গল্পরাও, তবে সেই নিয়ে লিখতে পারার মতো লেখকের সংখ্যা এখন এতই কম, যে তাদের দিকে হয়তো আপনার নজর পড়বেই না।
তা লেখা নাহয় বাছা হল, এবার তাই নিয়ে বই বেরোলে সেটা ছোটোরা পড়বে তো? মানে লেখা বাছতে গিয়ে তার সঙ্গে আপনি কি এটা জানার আদৌ চেষ্টা করেছিলেন যে ছোটোরা কী ধরণের বই পড়তে ভালোবাসে?
কলেজ স্ট্রিটের ‘বড়ো’ ও ‘অভিজাত’ সংস্থা থেকে শুরু করে ধুমধাড়াক্কা বই ছাপিয়ে নাম কেনার আশায় ফিল্ডে নামা ভুঁইফোঁড় প্রকাশনা: এরা এই সরল প্রশ্নটির উত্তর না খুঁজে দিব্যি আছেন। কিন্তু নিছক কৌতূহলের বশে শুধু নয়, বরং ইংলিশ-মিডিয়ামে পড়া আমার মেয়েকে বাংলা বই পড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আমি উত্তরটা খুঁজে পেয়েছিলাম।
আজকের ছোটোরা তেমন বই চায় যাতে থাকবে:
রঙিন মলাট
ভেতরে প্রচুর (সম্ভব হলে রঙিন) অলংকরণ
ভালো বাঁধাই (হার্ডকভার বা পেপারব্যাক)
বড়ো সাইজের ফন্ট
নির্ভুল ছাপা
সহজ ও যুক্তিসঙ্গত বানানবিধি
বিষয়বস্তু যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, লেখক সেলিব্রিটি হোন বা অনামী, উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ না হলে আজকের ঝকঝকে ছোটোদের আপনি সে বই পড়াতে পারবেন না।
আর কেউ এই নিয়ে মাথা ঘামাক বা না-ঘামাক, তরজা আর প্রচারের থেকে অনেক দূরে, নীরবে, বাংলার ছোটোদের জন্যে সুস্থ ও সতেজ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্যে কাজ করে চলেছেন শিশু কিশোর আকাদেমির যে গুণী মানুষেরা, অন্তত তাঁরা যে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন সেটা বুঝলাম নন্দন চত্বরে আকাদেমির স্টল থেকে কেনা “একবাক্স উপন্যাস” পড়তে গিয়ে।
কী আছে এই বাক্সে?
জানুয়ারি ২০১৫-য় প্রকাশিত, মোট ৩৭৫/- টাকা দামের এই রঙিন বাক্সটি হাতে নিয়েই যেকোন শিশু বা কিশোরের ভালো লাগবে। বাক্স খুলে তিনটি শক্ত মলাটের, আর রঙে-রেখায় উজ্জ্বল বই হাতে নিয়েও চোখ জুড়িয়ে গেল এটা দেখে যে বইগুলো ছোটোদের মনের মতন হওয়ার প্রতিটি শর্ত পালন করেছে কঠোরভাবে।
এই বই তিনটে হল:
যক্ষপুরী: রেণুকণা পাকড়াশীর লেখায়, শিবশংকর ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ আর লা-জবাব অলংকরণে সমৃদ্ধ এই ৩২ পাতার উপন্যাস পঞ্চতন্ত্র-ভিত্তিক কাঠামো থেকে শুরু পথচলা শুরু করলেও চিরকালীন ‘কোয়েস্ট’-এর যে গল্পটি বলেছে সেটি ছোটোদের ভালো লাগতে বাধ্য।
আই.এস.বি.এন: 978-93-83376-22-3
হলধরের হলুদ হাত: শীর্ষেন্দুর ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজ পড়ে যাঁদের ছোটোবেলা কেটেছে তাঁরা যদি আজকের ছোটোদের জন্যে তেমন কোন মজা, রোমাঞ্চ, আর অবিশ্বাস্য জিনিসের উপাদেয় মিশ্রণ খোঁজেন, তবে বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়-এর এই ৬৩ পাতার উপন্যাসটি তাঁদের ভালো লাগবেই। সঙ্গে পাবেন শিবশংকর ভট্টাচার্যর অসামান্য অলংকরণ, যা দেখে পড়ুয়া ছোটোদের (এমনকি বড়োদেরও) আঁকার খাতা নেওয়ার জন্যে হাত নিশপিশ করবে।
সুরের কমল: এইরকম লেখা এখনকার তথাকথিত নামজাদা শিশু-কিশোর পত্রিকায় আপনি পাবেন না।
এ লেখায় খুনখারাপি নেই। কুটিলতা আছে, তবে তা ঠিক ততটাই আছে যতটা ছোটোরা জীবনে সত্যিই দেখে। আছে আনন্দ, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ। আছে সুরের সাম্পানে চেপে দারিদ্র্য আর শত প্রতিকূলতার উত্তাল নদী পার হওয়ার গল্প।
এমন লেখা লিখতে পারার জন্যে যে জাদুকরি কলম দরকার তা দীপান্বিতা রায়-এর আছে, এ আমরা সবাই জানি। আর এই কাজে তাঁকে, প্রচ্ছদ ও অলংকরণের মাধ্যমে, যোগ্য সঙ্গত করেছেন এক ও অদ্বিতীয় অনুপ রায়। এমন লেখা পড়লে চুপসে যাওয়া মনে অনেকটা অক্সিজেন আসে।
বই তিনটে পড়ে শুধু ভালো লাগল না, ভরসাও পেলাম এটা ভেবে যে, ছোটোদের জন্যে ভালো লেখা ভালোভাবে প্রকাশ করার বড়ো কাজটা শিশু কিশোর আকাদেমি শুরু করেছে। কিন্তু, যতক্ষণ না এই বাক্সভরা রঙিন লেখা ছোটোদের কাছে পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ তো পুরোটাই শিবহীন যজ্ঞের মতো।
তাই বাংলায় থাকুন, বা প্রবাসে, একবাক্স সন্দেশের মতো করে একবাক্স উপন্যাসকেও ব্যাগে ভরতে, আর বাংলা বইয়ের নাম শুনলেই মুখ বেঁকানো ছোটোদের হাতে গুঁজতে ভুলবেন না। যদি এতেও তার মুখ ভারই থাকে, তবে কিচ্ছু করার নেই। কিন্তু যদি দেখেন তাকে লেখায় ডুবে যেতে,....।
“ইয়াহুউউউ” বলে গর্জনটা সাবধানে করবেন। ৬৫ ডেসিবেলের একটা ব্যাপার আছে তো।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।