বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে সহজে, এবং বিজ্ঞানের বিস্তৃত জ্ঞান না-থাকা মানুষের পক্ষে সহজবোধ্য ভাষায়, লেখার রেওয়াজ অনেক দিনের। সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র, এবং অন্য নানা জায়গায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে গত কয়েক দশকে সেই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে এসেছেন শ্রী পথিক গুহ। তাঁর বহু লেখার মধ্যে বাছাই করা সাতাশটি প্রবন্ধের সংকলন এই বইটি। দুঃখের বিষয়, বই-এ লেখাগুলো কালানুক্রমিক ভাবে সাজানো হয়নি, ফলে সূচিপত্র অনুসারে লেখাগুলো পড়লে লেখকের কলমের ক্রমবিবর্তন বোঝা যাবে না। লেখাগুলো প্রথম প্রকাশের স্থান, সময়ক্রম, এবং অতি সংক্ষেপে বিষয়বস্তু-সহ সাজিয়ে দিলাম:
(১)
এই বিশ্বের সত্যাসত্য: আনন্দবাজার বার্ষিক সংখ্যা, ১৩৯৫: এই বইয়ের সবচেয়ে পুরনো এই প্রবন্ধটিই এই বইয়ের দুর্বলতম লেখা। এতে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, বিশেষত গণিত নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে দার্শনিক “সত্য”-কে খোঁজার একটা চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু অত্যধিক ফেনানো এবং ভাবালুতার ফলে লেখাটা বিপজ্জনক রকম ঘুম-পাড়ানিয়া হয়ে উঠেছে।
(২)
সর্বনাশের আশায় – ১: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৩৯৯: কার্যত আগের প্রবন্ধটির একটু সংক্ষিপ্ত, এবং একটা অন্য প্রতিপাদ্য-ভিত্তিক রূপ এটি, এবং আগেরটির তুলনায় টাইট হলেও এতেও অকারণে কবিত্ব আর দর্শন মেশানোর চেষ্টা বিরক্তির কারণ হয়।
(৩)
আমি মানব, একাকী: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০১: এটিকে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ না বলে লেখকের গদ্য-পথে কবিত্বের প্রয়াস বললে ব্যাপারটা বেশি কর্কশ শোনাতে পারে, কিন্তু কার্যত সেটিই হয়েছে। এই ধরনের প্রবন্ধ পড়বে যে পাঠক সে কিন্তু এইসব হাবিজাবি বাদ দিয়ে বুঝতে চাইবে মোদ্দা কথাটা কী, আর সেই কথাটা হল: এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড উত্পত্তির পেছনে এমন কিছু ঘটনা দায়ী, সাধারণ মতে যেগুলো ঘটার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাহলে এই বিরলতম ঘটনাটি ঘটাই কি বিজ্ঞানের মতে “ঐশ্বরিক” শক্তির প্রকাশ বলে ধরে নেওয়া হবে?
(৪)
প্রণাম তোমায়, ঘনশ্যাম: বই সংখ্যা দেশ, জানুয়ারি ১৯৯৫: ফ্র্যাংক জে. টিপলার-এর লেখা “দ্য ফিজিক্স অব ইমমর্টালিটি” বইয়ের এই আলোচনাটি এই বইয়ের উত্কৃষ্ট লেখার মধ্যে পড়ে, কারণ এতে লেখক গণিতের পরিশ্রমী ও কর্কশ রূপটাকে অকারণে পেলব করার চেষ্টা করেন নি।
(৫)
আমাদের উত্তরাধিকার: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০২: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম (ও যান্ত্রিক) বুদ্ধিমত্তার বিকাশ নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধটিও লেখকের ভাবালুতা-দোষে দুষ্ট। কল্পবিজ্ঞান (বিশেষিত আসিমভ-এর ‘থ্রি ল’জ অফ রোবোটিক্স’) পড়ার সুবাদে গড় পাঠকও এই বিষয়টি নিয়ে জানতে আগ্রহী হবেন, কিন্তু লেখক সেই পাঠককে ‘দুধে-ভাতে’ করে নিজের দার্শনিক ভাবনা আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে গুচ্ছের পাতা ভরাট করেছেন!
(৬)
বিজ্ঞান, বিশ্বাস ও দাসত্ব: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০৩: একটি অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত লেখায় থিওরি অফ রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্রিং থিওরি, এবং (এযাবৎ নাগালের বাইরে থাকা) তথাকথিত ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক এই প্রবন্ধটিকে একটি কিম্ভুতকিমাকার বস্তু বানিয়েছেন, যা বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা-পাঠে আগ্রহী পাঠকের বিরক্তি উত্পাদন করবে অকারণে দার্শনিক (এবং লম্বা-লম্বা) ভাবালুতা দিয়ে।
(৭)
ধ্বংসের দুন্দুভি: বই সংখ্যা দেশ, জানুয়ারি ১৯৯৭: রিচার্ড রোডস-এর লেখা “ডার্ক সান: দ্য মেকিং অব দ্য হাইড্রোজেন বম্ব”-এর এই আলোচনাটি লেখা হয়েছে পুরোদস্তুর থ্রিলারের ঢঙে। সমকালীন রাজনীতি, নানা ষড়যন্ত্র, আর বিজ্ঞানের জটিলতম বিষয়কে যেভাবে এখানে তুলে ধরা হয়েছে সেটি অনবদ্য। এই বইয়ের অন্যতম সেরা লেখা এটি।
(৮)
আকাশের কাছাকাছি: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০৫: এডওয়ার্ড ও. উইলসন-এর লেখা “কনসাইলিয়েন্স: দি ইউনিটি অব নলেজ” নিয়ে কথা-প্রসঙ্গে লেখক এখানে দর্শন ও চিন্তনের আশ্রয় নিয়েছেন ঠিকই, তবে লেখাটি আদ্যন্ত সুপাঠ্য, এবং বিজ্ঞানের বদলে এর বিষয়টিই দর্শন-বিষয়ক বলে লেখকের ভাবালু কথনভঙ্গি এই লেখার পক্ষে লাগসই হয়েছে।
(৯)
সর্বনাশের আশায় – ২: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০৭: সময়ের সঙ্গে লেখকের কলমের সংযত ও লক্ষ্যভেদী হওয়ার বড়ো নিদর্শন এই লেখাটি, যাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুদূর-অথচ-অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে দার্শনিক ভাবনা এসেছে, কিন্তু পাঠকের বুদ্ধিমত্তাকে লঘু করে বিজ্ঞানের জায়গায় কবি-কবি ভাবের ভেজাল দিতে সেই ভাবনা ব্যবহৃত হয়নি। লেখাটি শুধু সুপাঠ্য নয়, অনেক চিন্তার খোরাক জোগানোর মতোও বটে।
(১০)
কাহিনির নাম, অন্বেষণ: দেশ, বইমেলা সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০১: পল স্ট্র্যাথার্ন-এর লেখা “মেন্ডেলিয়েভ’স ড্রিম: দি কোয়েস্ট ফর দি এলিমেন্টস” এবং জর্জ জনসন-এর লেখা “স্ট্রেঞ্জ বিউটি: মারে গেল-মান অ্যান্ড দি রিভলিউশন ইন টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি ফিজিক্স”, এই দুটি বইয়ের আলোচনার মাধ্যমে লেখক পরমাণুর জগতের আসল চেহারার সন্ধানে দুই পথিকৃতের কথা আলোচনা করেছেন। লেখায় অবশ্য অ্যানেকডোট বেশি, বিজ্ঞান কম (হয়তো ‘পপুলার সায়েন্স’-এর এই অর্থই বাজারে চালু)।
(১১)
বিপ্লবের বর্ণমালা: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪০৮: সৌরজগতের মডেল নিয়ে ইতিহাস, আর হিগস-বোসনের সন্ধান, দুই ভিন্নধর্মী বিষয়কে একটিই সংক্ষিপ্ত লেখার মধ্যে ধরতে গিয়ে এখানে লেখক একটু, সাদা বাংলায় বলতে গেলে, ছড়িয়ে ফেলেছেন।
(১২)
শতাব্দীর আসামি: ধিকৃত, বন্দিতও: দেশ, বইমেলা সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০২: স্যাম রবার্টস-এর লেখা “দি ব্রাদার” নিয়ে আলোচনা করে লেখা এই চমত্কার প্রবন্ধটিও আদ্যন্ত থ্রিলারের মতো করে পাঠককে ছুটিয়ে নিয়ে শেষ লাইন অবধি।
(১৩)
এক গণশত্রু ও তাঁর উপাখ্যান: দেশ, বইমেলা সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৩: রিচার্ড লুরি-র লেখা “শাখারভ: আ বায়োগ্রাফি” বিষয়ক এই লেখাটিও ধরতে চেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ঠাণ্ডা লড়াই, সেই সময়ে ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ভূমিকা পালন-করা এক বিজ্ঞানীর কথা প্রসঙ্গে। লেখাটি রিভিউ হিসেবে যেমন, একটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবেও তেমন সিদ্ধিলাভ করেছে।
(১৪)
বিজ্ঞানের ভবিষৎ, বিজ্ঞানীর ভবিষ্যদ্বাণী: বার্ষিক সানন্দা, ২০০৩: এই বইয়ের সেরা লেখা বাছতে গেলে এটি নির্বাচিত হতেই পারে। আগামী দিনের পৃথিবী কেমন হবে, এবং সেই পৃথিবীতে (ও তার বাইরে) মানুষের ভবিষ্যৎ কী হবে সেই নিয়ে, বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা পেশ করেছেন লেখক অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে। আমার মতে এই লেখাটি সার্থক হয়েছে এজন্যেই যে এতে পাঠকের কল্পবিজ্ঞান (বই ও সিনেমার মাধ্যমে)-প্রীতির ওপরে ভরসা রেখে সরাসরি বিজ্ঞানের জটিল তথ্য পেশ করেছেন লেখক, যাতে লেখাগুলো প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান-বিষয়ক আলোচনাই হয়েছে (আধা-দার্শনিক এলোমেলো ভাবনা হয়নি)।
(১৫)
মারণ আযুধের আরাধনা: দেশ, বই সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪: জুডিস শুলারি-র সাহায্য নিয়ে লেখা এডওয়ার্ড টেলর-এর “মেমোয়ার্স: আ টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি জার্নি ইন সায়েন্স অ্যান্ড পলিটিক্স” নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক এই লেখায়। নিছক রিভিউ বা পর্যালোচনা নয়, বরং বিজ্ঞানী, এবং তাঁর আমৃত্যু নতুনের খোঁজ করে যাওয়ার ইচ্ছে ও সাহসকে সেলাম জানিয়েছেন লেখক এই টানটান প্রবন্ধে।
(১৬)
সহস্র সূর্যের নীচে: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১১: পরমাণু গবেষণার ইতিহাস যে বিতর্কিত অথচ অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের আলোচনা ছাড়া অসম্পূর্ণ, সেই রবার্ট ওপেনহাইমার-কে নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধটি বিতর্ক, কুত্সা, আর অতিকথন এড়িয়ে “আসল” মানুষটিকে তুলে ধরতে চেয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যেই।
(১৭)
আইনস্টাইন এবং ফ্রয়েড, কাছাকাছি: সানন্দা পার্বণী, ২০০৫: রিচার্ড পানেকের বই “দি ইনভিজিবল সেঞ্চুরি: আইনস্টাইন, ফ্রয়েড, অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর হিডন ইউনিভার্সেস” প্রসঙ্গে এই ঠাসবুনট লেখায় লেখক ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীকে বদলে দেওয়া দুই মানুষের চিন্তন-প্রক্রিয়ার বিশেষত্ব এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। হ্যাঁ, এই লেখাটিও শুরু করলে শেষের আগে ছাড়া যায় না।
(১৮)
এক টুকরো আইনস্টাইন: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১২: মৃত্যুর আগে গোটা পৃথিবীর বিস্ময়ের পাত্র জিনিয়াসের মস্তিষ্ক নিয়ে কাঁটাছেড়ার কথা পড়তে যদি আপনার অস্বস্তি হয়, তবে এই লেখা আপনার জন্যে নয়। কিন্তু আইনস্টাইন-কে নয়, বরং তাঁকে, ও অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের বুঝতে ও জানতে চেয়ে মর্বিড হওয়া মানুষদের কথা যদি জানতে চান, তবে এই রিপোর্টটি আপনাকে পড়তেই হবে।
(১৯)
ক্যালকুলাস এবং দুই প্রতিদ্বন্দ্বী: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৩: দুই কিংবদন্তী চিন্তানায়ক আইজ্যাক নিউটন এবং গটফ্রিড লিবনিৎজ-এর রেষারেষি এবং আধুনিক পৃথিবীর নির্মাণে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া গণিত ক্যালকুলাসের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইতিহাসকে সংক্ষেপে অথচ নিপুণভাবে বর্ণনা-করা, অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও সহানুভূতি-পূর্ণ এই লেখাটি, আমার মতে, এই বইয়ের সেরা প্রবন্ধ।
(২০)
এক জীবন, অনেক আনন্দ, কিছু বেদনা: দেশ, বই সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭: রিচার্ড পি. ফাইনম্যান-এর লেখা “ডোন্ট ইউ হ্যাভ টাইম টু থিঙ্ক?” বইয়ের এই আলোচনাটি, দুর্ভাগ্যক্রমে, লেখককে আবার দার্শনিক ভাবালুতায় ভরা লাইনের-পর-লাইন দিয়ে বেশ কিছু পাতা ভরাট করার সুযোগ করে দিয়েছে শুধু।
(২১)
আবিষ্কারের লক্ষ্যে একা এবং কয়েক জন: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৪: আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে অজ্ঞাত এবং সমকালীন অন্য বিজ্ঞানীর আড়ালে ঢাকা পরে যাওয়া কয়েকজন বিজ্ঞানীর কথা আলোচিত হয়েছে এই লেখায়। দুঃখের বিষয়: এটিও বড্ড বেশি সজলনয়ন-টাইপের লেখা হয়ে গেছে।
(২২)
মানুষ, ময়ূর, ছারপোকা এবং ডারউইন: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৫: একগাদা বিষয়কে একসঙ্গে তুলে ধরতে গিয়ে জবরজং এবং উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়া এই প্রবন্ধটি পড়তে-পড়তে দুটো কথা মনে হয়: প্রথমত, লেখক নীতি নিয়ে আলোচনায় এতো সময় নষ্ট করে শেষে ঠিক কী বলতে চাইলেন সেটাই বোঝা যায়নি; দ্বিতীয়ত, পটলডাঙার টেনিদার সুবিখ্যাত গল্পগুলোর মতো করে লেখার নামকরণ করলেই সেই লেখা সুপাঠ্য হয়না।
(২৩)
মস্তিষ্কের মল্লযুদ্ধ: শারদীয় দেশ, ১৪১৫: ববি ফিশার, দাবার ইতিহাস, ঠান্ডা লড়াই, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সম্ভাবনা: চার-চারটি জটিল বিষয়কে নিয়ে লেখা এই অত্যন্ত উঁচু মাণের লেখাটি আমি প্রত্যেক পাঠককে, একটু সময় নিয়ে হলেও, পড়তে অনুরোধ করব।
(২৪)
এক বিশ্ব, দুই জানালা: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৬: বিজ্ঞান আর ধর্মের সম্পর্ক, এবং আপাত দৃষ্টিতে যুযুধান এই দুই বিষয়ের সমন্বয় নিয়ে বিভিন্ন মানুষের প্রয়াস ও সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধটি লেখকের অন্যতম শক্তিশালী লেখা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেখক এখানে অকারণ ভাবালুতার আশ্রয় নেন নি, বরং মাথা-ধরানো এক বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন চমত্কার গদ্যে।
(২৫)
প্রতীক্ষার পঞ্চাশ বছর: শারদীয় দেশ, ১৪১৭: মহাবিশ্বে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের তথা বুদ্ধিমত্তার সন্ধান চলেছে দীর্ঘদিন ধরেই। সেই নিয়ে, তথা ফের্মি প্যারাডক্স (অর্থাৎ মহাবিশ্বে অযুত-নিযুত নক্ষত্রের উপস্থিতি থাকলেও আমরা একা কেন?) নিয়ে লেখা এই লেখাটি দুটি দুর্বলতায় আক্রান্ত: (ক) স্থানাভাবে এতে ফের্মি প্যারাডক্স সমাধানের জন্যে চিন্তাবিদদের দেওয়া সাম্প্রতিক (ও অনেক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক)
থিওরিগুলো আলোচনা করাই যায়নি; (খ) কল্পবিজ্ঞান পড়ে ও দেখে অভ্যস্ত পাঠক-কে এতে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে দর্শন আর চিন্তনের পেছনে অনেক পাতা বরাদ্দ করা হয়েছে।
(২৬)
মহাবিশ্বের মহাসংগীত: শারদীয় দেশ, ১৪১৮: এই সময়ের বিজ্ঞান ভাবনা ও গবেষণার অন্যতম প্রধান (এবং জটিল) একটি বিষয়কে (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ-এর উপস্থিতির সন্ধান) সহজ-অথচ-অকাব্যিক ভাষায় পেশ করা এই প্রবন্ধটিই, আমার মতে, এই বইয়ের সেরা লেখা।
(২৭)
ঈশ্বরকণা এবং মানুষ: শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৯: বইয়ের প্রথম লেখা হলেও সময়বিচারে এটিই সাম্প্রতিকতম। কিন্তু এই লেখাও দুষ্ট একটি দোষে: পদার্থবিদ্যা বা সাধারণ ভাবে বিজ্ঞানে আগ্রহী পাঠক ছাড়াও অন্য পাঠকদের আকর্ষণ/কৌতূহলী করার জন্যে এই লেখায় স্রেফ অকারণে ‘ঈশ্বর’-কে জোড়া হয়েছে একটি কণা-র আগে, এবং যে সমীকরণগুলো ছাড়া বিজ্ঞান এই জায়গায় পৌঁছতেই পারত না, তাদের কোন ইঙ্গিত এতে দেওয়া হয়নি।
১. বইটিতে ঠান্ডা লড়াই-এর সময়ের গবেষণা ও আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বন্দ্ব একটু বেশিই গুরুত্ব পেয়েছে।
২. পরমাণুর অন্দরমহল নিয়ে যে পরিমাণ লেখালেখি হয়েছে তার একটি ভগ্নাংশও ব্যয় হয়নি ক্যান্সার, এইডস, এবং (এই সহস্রাব্দীর সবচেয়ে বড়ো মহামারী) অবসাদ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা-প্রসঙ্গে।
৩. সামগ্রিকভাবে বইটি পড়ে এই কথাই মনে হয় যে, দুই দশকেরও বেশি লেখালেখি করার পরেও এই পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান লেখককে যদি তাঁর লেখায় গণিত বর্জন করে দার্শনিক ভাবালুতার আশ্রয় নিতে হয় এই আশায় যে তাতে হয়তো কিছু বেশি লোকে লেখাটা পড়বে, তাহলে বাংলায় বিজ্ঞান-ভিত্তিক লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাদের এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি আছে।
মূল্যায়ন: অত্যন্ত আন-ইম্প্রেসিভ প্রচ্ছদ এবং উপরোক্ত যাবতীয় গজগজানি সত্ত্বেও লেখকের অধ্যবসায়, এবং আনন্দ পাবলিশার্স-এর সাহসকে কুর্নিশ করে, পাঁচে চার।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।