বইয়ের খবর
বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫,
২০১৭
রহস্য!
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
শব্দটা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কি আপনার মাথায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে
শুরু করেছে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কর্নেল, কিরীটী ইত্যাদি বেশ কিছু
নাম, এবং মানানসই খড়্গনাসা, ছ’ফুটিয়া, পাইপ বা চারমিনারে আসক্ত
কিছু চেহারা?
হে পাঠক, “গোয়েন্দা” ও “রহস্য”-কে গুলিয়ে ফেলার এই রোগ আপনার একার
নয়, আমাদের সব্বার। আদতে যে শব্দটা কত ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত
হয়, এবং জীবনের কত বিচিত্র আবেগ ও অনুভূতির সিন্ধু জমা হয় ওই বিন্দুবৎ
শব্দটিতে, তা আমরা ভুলতে বসেছি এর ঠেলায়।
তাই, আজকের ‘বইয়ের খবর’ আপনাদের এমন দুটি বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিচ্ছে, যারা পুরোনো থেকে নতুন, লৌকিক থেকে অলৌকিক, দেশি থেকে
বিদেশিঃ সব রকমের রহস্যের একেবারে খাসমহল।
প্রথম বইঃ
ফিরে যাওয়া যাক আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগের সেই সময়টায়, যখন নিয়মিত
প্রকাশিত হচ্ছে রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের তিনটি পত্রিকাঃ ‘মাসিক
রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’, এবং ‘মাসিক গোয়েন্দা’। কিন্তু
সেই তথাকথিত স্বর্ণযুগেও রহস্য নিয়ে লেখালেখি ছিল তাচ্ছিল্য ও
পরিহাসের শিকার। তার মধ্যেই কিছু প্রতিষ্ঠিত ও কিছু উদীয়মান লেখক
সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা শুধুমাত্র রহস্য গল্পের একটি সংকলন প্রকাশ
করবেন তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে, তাও আবার শুধুমাত্র সেই লেখকদেরই
লেখা নিয়ে যাঁরা জঁর ফিকশন লেখেন। আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া এবং
সেলফ-পাবলিশিং মডেলের সসম্মান স্বীকৃতির যুগে আমাদের পক্ষে ধারণা
করা কঠিন, এই কাজটা সেই সময়ে কতটা দুঃসাহসিক ছিল। কিন্তু সেই কঠিন
কাজটি সম্পন্ন হল। ‘ভ্যাম্পায়ার’ প্রকাশনীর প্রথম উপহার হিসেবে
১৩৮০-র মহালয়ায় আত্মপ্রকাশ করল সেই বইটি, যা শুধু ঐতিহাসিক মূল্যের
দিক দিয়ে নয়, বরং বিশুদ্ধ বিনোদন-মূল্যেও অনেক সংকলনকে টেক্কা
দিতে পারে। গুণমানের দিক দিয়ে আপস না করা হলেও বইটি দীর্ঘদিন অমুদ্রিত
ছিল। ১৯৬৮ থেকে রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ অনুরাগী এবং
কিংবদন্তী লেখক অনীশ দেব-এর সম্পাদনায় বইটি আবার ফিরে এল পত্র
ভারতী-র নিবেদন হয়ে।
বইটির নামঃ রক্ত ফোঁটা ফোঁটা
সম্পাদনাঃ অনীশ দেব
বর্তমান সংস্করণের প্রকাশকঃ পত্র ভারতী
বর্তমান সংস্করণের প্রকাশকালঃ জানুয়ারি ২০১৪
হার্ডকভার, ২৪০ পৃষ্ঠা, মূল্য ১৫০/- টাকা
|
মানস চক্রবর্তীর ঝকঝকে প্রচ্ছদ, এবং নানা বিদেশি পত্রপত্রিকার
থেকে আহৃত অলঙ্করণ দিয়ে সাজানো এই বইটি জঁর ফিকশনের একটি ল্যান্ডমার্ক,
একথা আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই। আসুন, চোখ বুলিয়ে নিই বইটির
সূচিপত্রে, আর টাইম-মেশিনে চড়ে ফিরে যাই চার দশকেরও বেশি আগের
সেই সময়ে, যখন একঝাঁক লেখক বাংলা জঁর ফিকশনে নতুন এক ঘরানা নিয়ে
আসার জন্য কলম ধরেছেন।
(*) অনীশ দেব-এর স্মৃতিচারণ, তথা বইটি প্রকাশের ইতিহাস “চল্লিশ
বছর আগে”;
(*) প্রথম সংস্করণের “ভূমিকা”, ভাস্কর রাহা-র জবানিতে;
১. ভাস্কর রাহা-র গল্প “সর্পিল কোনও রাতে”
২. অনীশ দেব-এর গল্প “সাগরে অন্তরীণ”
৩. শ্রীধর সেনাপতি-র নভেলেট “অস্পষ্ট ইঙ্গিত”
৪. উপেন মান্না-র গল্প “শেষ কিস্তি”
৫. উৎপল ভট্টাচার্য্য-র গল্প “নীল ধোঁয়ার আড়ালে”
৬. মঞ্জিল সেন-এর নভেলেট “রাতের বাদুড়”
৭. অনিরুদ্ধ চৌধুরী-র গল্প “দুঃস্বপ্নের অভিশাপ”
৮. অসিত মৈত্র-র গল্প “নিছক ইন্দ্রজাল”
৯. অমিত চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাস “খুনের বাইরে”
এই বইয়ে যাঁদের লেখা আছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ লেখকের নাম বাংলা
সাহিত্য থেকে প্রায় মুছে গেছে, অথচ এমনটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিলনা।
হ্যাঁ, এর মধ্যে বেশ কিছু গল্প বিদেশি সাহিত্যের দ্বারা বড়ো বেশি
প্রভাবিত। হ্যাঁ, বেশ কিছু গল্প বড়ো বেশি ‘অনুপ্রাণিত’ ও ‘চমক-নির্ভর’।
এবং হ্যাঁ, বেশ কিছু গল্প এযুগের দীক্ষিত পাঠকের কাছে বড্ড প্রেডিক্টেবল।
তবুও এদের মধ্যে এমন গল্পও আছে যারা বুদ্ধির দীপ্তি আর মিতকথনের
জাদুতে পাঠকের মনে অনুরণন তৈরি করে, আর ভাবায়, এই লেখকের একটা
আস্ত গল্প-সংকলন পেলে বেশ হত।
এই লেখকদের মধ্যে একমাত্র অনীশ দেব ছাড়া অন্য কারো রহস্য-রোমাঞ্চ
সাহিত্যের কোনো নিদর্শন এই মুহূর্তে বাজারে না থাকা হয়তো জঁর ফিকশনের
অনিবার্য নশ্বরত্বকেই চিহ্নিত করে। তবু, শেষ বিচারে এটুকুই বলিঃ
রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, এমনকি অলৌকিক সাহিত্যের যে বিপুল ও মোহক প্রদর্শনী
তুলে ধরেছে এই বইটি তাতে একথা অনস্বীকার্য যে শীতের সন্ধে বা বর্ষার
রাতে এই বইটি হাতে নিয়ে গায়ে একটা চাদর টেনে নেওয়ার আরামদায়ক অনুভূতি
থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলে সেটা ঘোর অন্যায় হবে।
দ্বিতীয় বইঃ
এবার চলে আসুন এই সময়ে।
গোয়েন্দা বা রহস্য সাহিত্য এখনও মেইনস্ট্রিম হয়নি ঠিকই, কিন্তু
বাজার অর্থনীতি নামক শাহি দরবারে সে এখন রীতিমতো সম্ভ্রমোৎপাদক
মনসবদার। প্রায় প্রতিটি পত্রিকা নিয়ম করে কিছুদিন পর-পর রহস্য
সংখ্যা প্রকাশ তো করেই, এমনকী একটি আস্ত গোয়েন্দা-রহস্য পত্রিকা
অজস্র ত্রুটি নিয়েও সদর্পে আজ বিরাজমান। সিনেমার বিষয় রহস্য বা
থ্রিলার/রোমাঞ্চ হলে প্রযোজক পয়সা উশুল হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত
হয়ে পরের সিনেমা নিয়ে ভাবেন। এফ.এম থেকে টিভি চ্যানেল, আনন্দবাজার
রবিবাসরীয় থেকে সদ্য-প্রকাশিত পত্রিকার রবিবার-স্পেশাল, সর্বত্র
রহস্য তথা গোয়েন্দাদের নিশ্চিন্ত আনাগোনা। রহস্য বা গোয়েন্দা সাহিত্যের
লেখক এখন আর উপেক্ষার নয়, বরং পরম প্রীতি ও ঈর্ষার পাত্র।
তাহলে কি সেই কথাগুলো অবশেষে সত্যি হয়ে উঠেছে, যেখানে গোয়েন্দা
বা রহস্য সাহিত্য নিছক পলায়নী বিনোদন না হয়ে জীবনের দর্পণ হিসেবেই
প্রতিভাত হচ্ছে? ৪ঠা কার্তিক ১৩৭৫ পার্থ চট্টোপাধ্যায়-কে দেওয়া
এক সাক্ষাৎকারে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “...গোয়েন্দা
কাহিনিকে আমি ইন্টেলেকচ্যুয়াল লেভেলে রেখে দিতে চাই। ওগুলি নিছক
গোয়েন্দা কাহিনি নয়। প্রতিটি কাহিনিকে আপনি শুধু সামাজিক উপন্যাস
হিসেবেও পড়তে পারেন। কাহিনির মধ্যে আমি পরিচিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে
চাই। মানুষের সহজ সাধারণ জীবনে কতগুলি সমস্যা অতর্কিতে দেখা দেয়
– ব্যোমকেশ তারই সমাধান করে”। এই কথারই তো সক্ষম বা অক্ষম প্রতিফলন
দেখছি এখনকার সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে।
এই পরিস্থিতিতে সেরা রহস্য বা গোয়েন্দা গল্প বাছতে গেলে তো পুরোনো
দৃষ্টিভঙ্গি চলবে না। সম্পাদকীয় চয়ন হতে হবে জীবনের প্রতিটি স্তরকে
ছুঁয়ে যাওয়া সর্পিল অথচ রক্তিম এক পথ বেয়ে, যেখানে অপরাধী ও গোয়েন্দার
ইঁদুর-বেড়াল খেলার চেয়ে অনেক বড়ো ভূমিকা নেবে চির রহস্যময় এই জীবন।
অতঃপর, সেই কিংবদন্তী মানুষটির অভিজ্ঞ কাঁধেই আবার দায়িত্ব চাপল
এক নতুন সংকলনের জন্য ‘এই সময়ের’ সেরা রহস্য গল্প নির্বাচনের।
তবে এবার মাপকাঠি আলাদা। এবার গল্পকে হতে হবে খুন, অথবা খুনিকে
নিয়ে। আর বাছাইয়ের জন্যেও তাই রয়েছে শুধু জঁর ফিকশন নয়, বরং গোটা
সাহিত্য সম্ভার।
১৯৫৮-য় প্রকাশিত গল্প থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক, প্রচার
এবং অনেকাংশে প্রসার থেকে বঞ্চিত নানা পত্রিকায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত
মোট ২৯ টি খুন বা খুনির গল্প নিয়ে গড়ে ওঠা, সৌরীশ মিত্র-র প্রচ্ছদ
এবং রঞ্জন দত্ত-র অলঙ্করণে সমৃদ্ধ এই আনকোরা সংকলনটি প্রকাশ পায়
জানুয়ারি ২০১৬-য়।
বইটির নামঃ খুনির রং
সম্পাদনাঃ অনীশ দেব
প্রকাশকঃ সাহিত্যম
হার্ডকভার, ৩৪৪ পৃষ্ঠা, ২০০/- টাকা
|
‘রহস্যসন্ধানী পাঠকদের’ উদ্দেশে নিবেদিত
অতিসংক্ষিপ্ত প্রাককথন “এক মিনিট, আপনাকে বলছি”-র মাধ্যমে এই বইয়ের
উদ্দেশ্যটুকু পাঠকের কাছে তুলে ধরেই সম্পাদক আমাদের হাত ধরে এক
রকম টেনে নিয়ে গেছেন সেই ভাঙাচোরা বাড়িটায়, যেখানে আপনাকে লুকিয়ে
পড়তে হবে খুনিদের হাত থেকে। বাড়িটার কড়িবরগা, চৌকাঠ, পেছনের পুরোনো
মজা ইঁদারা, চামচিকের বাসা হয়ে যাওয়া ঘুলঘুলি, পাতলা ইঁটের ঝাঁঝরা
দেওয়াল, চিলেকোঠায় তক্ষকের বাসা, আর সিঁড়ির নিচে সাপের খোলসের
সঙ্গে এবার তাহলে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই?
১) প্রণব রায়-এর “নীল রুমাল”: গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেও যে কত শিল্প,
কত সৌন্দর্য, আর কতখানি ট্র্যাজেডি লুকিয়ে থাকে, তারই সার্থক উদাহরণ
এই গল্পটি।
২) অমলেন্দু সামুই-এর “তুমি জানো না”: রহস্য বা খুনের আড়ালে এই
গল্পটিও এক মর্মান্তিক উপাখ্যান, যা গড়ে উঠেছে সন্দেহ, বিশ্বাসঘাতকতা,
আর অবশ্যই ভালোবাসা দিয়ে।
৩) অসিত মৈত্র-র “খুন খুন খেলা”: এই ক্লাসিক গল্পটি রঞ্জিৎ চট্টোপাধ্যায়ের
সম্পাদনায় প্রকাশিত রোমাঞ্চ পত্রিকার সংকলনে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
অল্পেও যে কত ভালো রহস্য গল্প হয়, তার একটি কেস-স্টাডি বলা যায়
একে।
৪) বিমল সাহা-র “আঁধারে সাপ চলে”: গোয়েন্দা না হলেও এই গল্পে একটা
ক্ষীণ রহস্য আছে, তবে তার ব্যাখ্যা খোঁজার দায় পাঠকের ওপরেই ছেড়ে
দেওয়া হয়েছে নেহাত কাঁচা হাতে। ভালো লাগল না।
৫) নির্বেদ রায়-এর “খগনিশা”: এই সময়ে শিকার কাহিনি রচনায় লেখক
অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আর তারই সফল নিদর্শন এই গল্পটি, যাতে শিকার ও
শিকারী স্থান পরিবর্তন করেছে মুহূর্তের ব্যবধানে।
৬) অমিতাভ সমাজপতি-র “অব্যক্ত”: রহস্য গল্প নয়, বরং এক অবিশ্বাস্য
কথোপকথনের আড়ালে এও এক টানাপোড়েনের উপাখ্যান।
৭) স্বপ্নময় চক্রবর্তী-র “যে মেয়েটি মোহময়ী হতে চেয়েছিল”: এই সময়ের
শ্রেষ্ঠতম গদ্যশিল্পীদের অন্যতম স্বপ্নময় নিপুণ বর্ণনা ও শাণিত
সংলাপ দিয়ে যে কাহিনিটি নির্মাণ করেছেন, তার বুক-কাঁপানো যন্ত্রণা
রহস্য বা গোয়েন্দা গল্পের সীমা অতিক্রম করে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রা
ও গভীরতা পেয়েছে। এই গল্পটি লেখকের আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত অমনিবাস-উপন্যাস
“হলদে গোলাপ”-এও ঠাঁই পেয়েছে।
৮) অনীশ দেব-এর “অর্ধেক পুরুষ”: এই কাহিনিটির সঙ্গেও আমার আগেই
পরিচয় হয়েছিল, এবং তখনও যুগপৎ দুঃখিত ও বিকর্ষিত হয়েছিলাম এই বিচিত্র
প্রেম ও তার ভয়াবহ পরিণতি দেখে। সত্যিকারের ভয়ের গল্প যে আমাদের
মধ্য থেকেই উঠে আসে, সেই কথাটাই স্বপ্নময়ের গল্পের পর আরো একবার
প্রমাণ হয় এটি পড়লে।
৯) প্রচেত গুপ্ত-র “একটি খুনের কাহিনি”: এই গল্পটির প্রধান শক্তি
এর তিল-তিল করে গড়ে ওঠা, আর দুর্বলতা এর শেষের ট্যুইস্ট, তবে জীবন-রহস্যের
বেশ কিছু বাঁক এই নাতিদীর্ঘ গল্পেও ধরা পড়েছে দক্ষ কাহিনিকারের
হাতে।
১০) সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর “বোবা রাজপুত্র”: শুধু এই বইয়ের নয়, সাম্প্রতিক
কালে রচিত যেকোনো রকমের লেখার মধ্যে অতি বিশিষ্ট এই গল্পটি বিশ্বাস-অবিশ্বাস,
যুক্তি-আবেগ, শীতল নৈপুণ্য আর ভোঁতা ক্রোধ, সর্বোপরি ঘৃণা ও ভালোবাসার
যে আশ্চর্য টানাপোড়েন আর সহাবস্থান নিজের বুকে ধারণ করছে, তা পড়ে
শিহরিত হতে হয়। সেলাম জানাই লেখককে।
১১) বাণী বসু-র “মর্তৃকাম”: মার্ডার মিস্ট্রি? তা বলা যায় ঠিকই,
কিন্তু আদতে যে ভঙ্গিতে শোভন অথচ সাঁপুড়ের বাঁশির মতো অমোঘ ভাষা
আর ন্যারেটিভ দিয়ে এই গল্পটাকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে
গেছেন লেখক তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কত রহস্যময়
এই জীবন।
১২) শুভমানস ঘোষ-এর “পাগলাবাবার কুঠি”: হিসেবি বুদ্ধি আর বোধহীন
ভয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আদিম রিপুর জান্তব প্রকাশের এক অদ্ভুত এলোমেলো
গল্প বলেছেন লেখক, যাতে শেষ অবধি এটাই বোঝা যায়না, কে এই গল্পে
‘আসল’ খুনি।
১৩) উল্লাস মল্লিক-এর “হন্তারক”: নাঃ, এই গল্পটা খুন বা খুনির
নয়, বরং বহু-ব্যবহৃত ছকে বন্দি একটা রুটিন লেখামাত্র।
১৪) রাজেশ বসু-র “স্টার অফ ডেভিড”: একটি রহস্য গল্প, যা পড়তে মন্দ
লাগেনা। কিন্তু জীবন-রহস্যের জোরালো নেশা ধরানো আগের গল্পগুলোর
পর এটা পড়তে গিয়ে নেহাত জোলো ঠেকে।
১৫) অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী-র “প্রফেসর ইয়াকোয়ার মৃত্যুরহস্য”: একাধিক
সংকলনে স্থানপ্রাপ্ত এবং পাঠক-সমাদৃত এই গল্পটা নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য,
কিন্তু এই লেখকেরই ‘সব লজিকের বাইরে’ তার ত্রিমাত্রিক প্রকৃতি,
লাল ও কালোর মায়া, এবং ট্র্যাজেডি নিয়ে এই সংকলনের সার্বিক টোন
ও টেনরের সঙ্গে অনেক বেশি মানানসই হত বলেই আমার ধারণা।
১৬) ইন্দ্রনীল সান্যাল-এর “দুই-এ পক্ষ”: কাইমেরা-অপারেটিভ প্রথমা
লাহিড়ীর হাতে সমাধান-হওয়া এই ঠাসবুনোট মার্ডার-মিস্ট্রিটি শুধু
লেখকের ‘রহস্যের ধারাপাত’ সিরিজে নয়, বরং দেশি-বিদেশি যেকোনো রহস্য
সংকলনের সম্পদ।
১৭) সায়ন্তনী পূততুণ্ড-র “সীতা”: মানবচরিত্রের অন্ধকারে লুকিয়ে
থাকা অন্ধ বিশ্বাস আর হননেচ্ছার এক মর্মন্তুদ নিদর্শন এই পূর্ব-পঠিত
গল্পটি, যা আবারো পড়তে গিয়ে আমার মনে হল, যেন এক আলো-বাতাসহীন
কুয়োয় নেমে চলেছি আমি, আর বৃত্তাকার আকাশটা ক্রমেই দূরে, আরো দূরে
সরে যাচ্ছে ।
১৮) কাবেরী রায়চৌধুরী-র “লাল জোছনা”: সংকলন সপাটে মাটিতে আছড়ে
পড়ল এই রাবিশটির মাধ্যমে। ঠিক কোন যুক্তিতে যে... যাকগে।
১৯) বিনোদ ঘোষাল-এর “দুই পৃথিবী”: নিতান্ত সহজ ও সরল এই গল্পের
শুরু থেকে শেষ অবধি সবটাই প্রেডিক্টেবল, এবং চমকহীন। এর তুলনায়
অনেক বেশি ধারালো গল্প প্রায় রোজ পড়ার সৌভাগ্য হয় বংপেন-এর সৌজন্যে।
২০) দীপান্বিতা রায়-এর “জীবনের রংমশাল”: একান্তই একমাত্রিক এবং
একরঙা এই গল্পটা পড়ে মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেল, কারণ ‘আঁধারে মানিক
জ্বলে’ আর রোজকার কাগজ পাঞ্চ করে দিলেই তো এই জিনিস পাওয়া যায়।
এর জন্য পড়ার টেবিলে খুনির রং লাগাবো কেন?
২১) জয়ন্ত দে-র “গোলা”: এই সময়ের দিশাহীন রাজনীতি আর রাংতা-মোড়া
অর্থনীতির চক্করে ফেঁসে যাওয়া যুবসমাজের একটি হতাশাদায়ক, এবং বেসিক্যালি
বাকসর্বস্ব গল্প, এছাড়া কোনোভাবে একে বোঝাতে পারছি না।
২২) অনন্যা দাশ-এর “মরীচিকা”: আবার আমরা রহস্য তথা খুনখারাপিতে
ফিরলাম এই গতিময়, সুখপাঠ্য, এবং উপভোগ্য ট্যুইস্ট-সমৃদ্ধ গল্পটার
মাধ্যমে। তবে গল্পটা পড়ে মনে হল, খুনিরা কি এত বোকা হয়? হয় বোধহয়।
২৩) যশোধরা রায়চৌধুরী-র “আততায়ী”: দারুণ! অল্প কথায়, কিছু আভাসে
কয়েকটি আপাদমস্তক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র কীভাবে তৈরি করতে হয়, এবং
আক্ষরিক অর্থে শেষ রাতে, তথা শেষ লাইনে কীভাবে ওস্তাদের মার দিতে
হয়, তা শেখা যায় এই গল্পটা থেকে।
২৪) হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত-র “প্রস্তর ঘাতক”: ইতিহাস, রোমান্স,
আতঙ্ক, যন্ত্রণা, আর হত্যা মিলেমিশে গেছে এই কুয়াশাচ্ছন্ন জ্যোতস্নাহত
গল্পে। হয়তো বা রক্তমাংসের খুনের চেয়েও কিছুটা বেশি গভীর প্রভাব
ফেলে যায় এই গল্প আমাদের মনে।
২৫) ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর “হিসেবে কিছু ভুল ছিল”: এই নাতিদীর্ঘ
অথচ সার্থক গল্পেও রহস্যভেদ বা হু/হাউ-ডান-ইট-এর চেয়ে অনেক বেশি
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে একটা প্রকাণ্ড সংকটঃ হত্যাকারীর প্রতিই
যদি আপনার সহানুভূতি থাকে, তাহলে রহস্যভেদীর কী কর্তব্য হওয়া উচিৎ?
২৬) পিনাকী মুখোপাধ্যায়-এর “ঋতির উপহার”: বাঙাল হিসেবে নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে কোনো আত্মঘাতী রকমের বোকা মানুষের জন্য আমি একটিই বিশেষণ
নির্দিষ্ট করিঃ বলদ! এই গল্পটা, সখেদে জানাই, আদতে একটি বলদের
গল্প। সখেদে এও লিখি, যা কোনোদিন লেখার কথা কল্পনাও করিনি, যে
এর তুলনায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “মারণ বাতাস” অনেক ভালো গল্প।
২৭) জয়দীপ চক্রবর্তী-র “পালটানো যায় না”: আরো একটি আদ্যন্ত হতাশাদায়ক
রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়নের গল্প, যার সঙ্গে রহস্য
বা খুনের কোনো সম্পর্ক নেই।
২৮) সুজন ভট্টাচার্য-র “চিত্রনাট্য”: আহাহাহা! অবশেষে ফুটিফাটা
মাঠের বুকে আছড়ে পড়া মুষলধারার মতো হয়ে এল এক জম্পেশ গল্প, যা
পড়তে গিয়ে আমি প্রায় ভাবাবিষ্ট হলাম এই কল্পনায় যে বাংলার পক্ষপাতদুষ্ট
ও অনেকাংশে ক্লীব সম্পাদকেরা যদি কোনো দৈবক্রমে এই অসামান্য লেখকটিকে
নিয়মিত লেখার সুযোগ দেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যে কী বিশাল বিপ্লব
আসতে পারে। হায়, এই কল্পনা সত্যি হতে কি দেখব এই জীবদ্দশায়? কে
জানে।
২৯) দেবার্চন বসু-র “ব্ল্যাক উইডো”: জনজাতির আদিম সংস্কার, শরীর
ও আত্মার নানা মেটাফর, এবং যৌনচেতনার বাধাহীন প্রকাশ মিলেমিশে
এই গল্পকে যে রূপ দিয়েছে তা শুধু ভয়ংকর নয়, রীতিমতো রহস্যময়-ও
বটে। খুন বা রহস্য গল্পের আড়ালে এতটা বহুমাত্রিক এক আখ্যান পেশ
করতে যে কব্জির জোর লাগে তা বলাই বাহুল্য। এই লেখকের কাছ থেকেও
আগামী দিনে বাংলা সাহিত্য অনেক-অনেক কিছু পেতে পারে, যদি সম্পাদকেরা
ক্ষমাঘেন্না করে লবিবাজ বা ফুরিয়ে যাওয়া লেখকদের পাশে এঁর জন্যেও
কিছুটা জায়গা বরাদ্দ করেন।
এই দুটি বইয়েই গল্পের মোহময় আবরণের আড়ালে আসলে কথা বলেছে জীবন
আর মৃত্যু। ‘ক্রাইম ডাজ নট পে’ নয়, বরং ‘পেব্যাক’ আর ‘রিডেম্পশন’,
প্রতিশোধ আর প্রতিদানের এক অনিঃশেষ আখ্যান বিধৃত হয়েছে তাদের শব্দে,
ভঙ্গিমায়, নিস্তব্ধতায়। রক্ত, অশ্রু, অট্টহাসি, আর ক্রোধের মশাল
জ্বালিয়ে মানুষের অনন্তযাত্রার কিছু খণ্ডদৃশ্য ধরা পড়েছে এই গল্পগুলোতে,
যাদের মধ্যেই রয়ে গেছে আরো গল্পের বীজ, আরো অনেক দুর্জ্ঞেয় সম্ভাবনা।
আসুন, রক্তে লাল আর কালো হয়ে ওঠা পিচ্ছিল এই পথে নামা যাক। পথেই
হবে পথ চেনা, কী বলেন?
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।