বইয়ের খবর
জুন ১৫, ২০১৫
" বইটা আজকের এই ইয়েলো জার্নালিজমের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সত্যিই এক মুঠো অক্সিজেনের মত কাজ করবে। ..."
★★★★★
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
- বইয়ের নাম: প্রসঙ্গ রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ
- লেখক: বিজন ঘোষাল
- প্রকাশক: পত্রলেখা
- প্রচ্ছদ: মৃণাল শীল
- ISBN: 978-93-81858-55-4
- পৃষ্ঠা: ২২৩ পৃষ্ঠা
- বাঁধাই: হার্ডকভার
গত কয়েক বছরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাণিজ্যে উদ্যোগী এক লেখক এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষক এক প্রকাশনা সংস্থার সৌজন্যে বাজারে রকমারি সুমুদ্রিত ও সুশোভন কেচ্ছা কাহিনির সমাবেশ ঘটেছে, যার আবার সবই বেস্টসেলার। এই নিয়ে ফেসবুক উত্তাল, আর সংস্কৃতির ধ্বজাধারীদের (মানে যারা গীতাঞ্জলি আর কথাঞ্জলি একাকার করে ফেলেছেন) উল্লাস: বাংলায় নতুন Siল্প হচ্ছে! কোন কারণে খুব অসহায় বোধ করলে আমি নিজের কাছের বইটাকে হাতে তুলে নিই কয়েক মুঠো অক্সিজেন-এর সন্ধানে। এবার আমি আর গীতবিতান হাতে তুলতে সাহস পেলাম না। কী জানি, কোন কবিতা পড়ে আবার মনে হবে এটা রবীন্দ্রনাথের “বৌদিবাজি” (ভাষা আমার নয়, ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণির দৈনিকের, যা না পড়লে আবার পিছিয়ে পড়তে হয়)-র প্রকাশ! তাই আমি একটি অপেক্ষাকৃত পুরনো এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্প-পরিচিত বই-এর রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিলাম নিম্নলিখিত কারণে: -
(১) এই বইটিতে এমন দুজন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে যাঁরা হাজার কুৎসা আর নিন্দা সত্বেও নিজেদের কথা আর কাজ দিয়ে কোটি-কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছেন, আর যাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য মানুষ একটু ভালো ভাবে বাঁচার মত সাহস আর উৎসাহ পেয়েছেন।
(২) জীবনী রচনার উপাদান অনেক রকমের হয়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ (তবে সব থেকে নির্ভরযোগ্য নয়) উপাদান অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মানুষটির নিজের স্মৃতিচারণ। তারপরেই আসে সেই মানুষটির দ্বারা অনুমোদিত দ্বিতীয় ব্যক্তির রচনা। এরপরে একে-একে আসে তৃতীয় ব্যক্তির স্মৃতি বা গবেষণা-ভিত্তিক রচনা, মানুষটির নিজের রচনা আর কথা থেকে আহৃত তথ্য, ইত্যাদি। আলোচ্য বইটি এজন্যেই উল্লেখযোগ্য যে এতে সব ক’টি উপাদানের সাহায্য নিয়ে, এবং তার সঙ্গে প্রায় গোয়েন্দা বা উকিলের মত করে উপলব্ধ যাবতীয় তথ্যের সত্যাসত্য বিচার করে, এবং আপন মনের মাধুরী যথাসাধ্য বর্জন করে, নিজের প্রতিপাদ্য বিষয়টি নিয়ে ধাপে-ধাপে এগিয়েছেন লেখক। এই বাজারে, যখন চালাকির দ্বারাই একমাত্র মহৎ কার্য সম্ভব: এমন ধারণা সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তখন এমন একটি বই সর্বার্থে দুর্লভ।
কিন্তু ঠিক কী বলতে চেয়েছেন লেখক?
শ্রীরামকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সময়টায় কলকাতা তথা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছিল, রবীন্দ্রনাথের জীবনেও সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। তখনও তিনি বিশ্বকবি হননি, কিন্তু তাঁর প্রতিভার বিচ্ছূরণ ততদিনে কবিতায়, গানে, সংগঠনে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বিশেষত, যদি এটা আমরা মাথায় রাখি যে প্রায় পঁচিশ বছর এই দুজন মানুষ একই সময়ে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভৌগলিকভাবে খুব কাছাকাছি ছিলেন, তখন মনে হতেই পারে: এঁদের মধ্যে কি দেখা হয়েছিল? হয়ে থাকলে, কী হয়েছিল তার ফলাফল? এই বই-এর প্রথম অংশ (লেখকের ভাষায় বৃত্ত) এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তাঁকে, এবং আমাদেরকেও নিয়ে গেছে শ্রীরামকৃষ্ণ এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ প্রান্তে, যেখানে নরেন্দ্রনাথ দত্তের গলায় “এ কি এ সুন্দর শোভা...” শুনে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর অবস্থাতেও গভীর ভাব-সমাধিতে মগ্ন হওয়ায়। এরই মধ্যে আমরা পেয়েছি তাঁদের সম্ভাব্য প্রথম সাক্ষাৎ (যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স সম্ভবত ৫ বছরের কম!) এবং বাস্তবের প্রথম তথা একমাত্র সাক্ষাৎ। যেভাবে তথ্যের পর তথ্য বিশ্লেষণ করে লেখক এই বৃত্তটি রচনা করেছেন, তা ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এই সময়টায় কি রবীন্দ্রনাথ আদৌ শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? লেখক দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে ‘কড়ি ও কোমল’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ রচনার প্রস্তুতিপর্ব ছিল এই সময়টি, তবে সেটা কিন্তু তাঁর বক্তব্য হয়েই থেকেছে, প্রমাণিত হয়নি।
এই বই-এর দ্বিতীয় অংশ ১৮৮৬-তে শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যু থেকে ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু অবধি সময়কে বিশ্লেষণ করেছে মূলত রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা তথ্য-তত্ত্ব-ঘটনা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক শুধু ইতিহাস বা ঘটনাক্রম তুলে ধরতে চাননি। তিনি দুটি জিনিস প্রমাণ করতে চেয়েছেন বলেই আমার মনে হয়েছে:
(১) রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিপুল ঔদার্য ও সৌজন্য দিয়ে ব্রাহ্মধর্মের পৌত্তলিকতা-বিরোধী মনোভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এক আন্দোলনের পুরোধাকে সম্মান জানিয়েছেন আজীবন।
(২) শ্রীরামকৃষ্ণের বিভিন্ন কথাকে কখনও “ভক্তবাণী”-তে শামিল করে, কখনও ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে নায়িকা নীরজাকে তাঁর পরমভক্ত হিসেবে উপস্থাপন করে, রবীন্দ্রনাথ একথা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ঈশ্বর-সাধক এক মানুষ হিসেবে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে সম্মান করেন। কিন্তু তাঁর কথাকে আদর্শ করে যে ধর্মীয় ভাবনা আন্দোলনের আকার নিয়েছিল, তাকে তিনি কখনোই নিজের করে নেননি।
বইটা পড়তে গিয়ে বারবার কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় গোত্তা মারছিল, আর সেগুলো হল: -
(১) রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম সংস্কার এবং পারিবারিক ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় ভাবনা ও আন্দোলনের থেকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, কিন্তু রামকৃষ্ণ সংঘও কি আদৌ রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেতে চেয়েছিল?
(২) ১৮৮৬ থেকে ১৯৪১, এই সময়টায় শ্রীরামকৃষ্ণের নিজের কথার তুলনায় স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর হাতে গড়া রামকৃষ্ণ সংঘ অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, বিশেষত সামজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে (বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে বিবেকানন্দের প্রভাব অনস্বীকার্য)। এর মধ্যে একটা সময়ে বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে কলকাতায়, বাংলায়, এবং তার বাইরে প্রভাব ফেলেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল?
কঠোর পরিশ্রম, বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা, এবং আলোচ্য চরিত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেও নির্মোহ হয়ে তাঁদের নিয়ে লিখতে পারা: যেকোন ভালো লেখকের কাছ থেকে যে ক’টি বৈশিষ্ট্য আমরা দাবি করি, তার প্রত্যেকটিই এই লেখায় তুলে ধরেছেন লেখক। সঙ্গে যোগ করা যাক বইটির তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে থাকা প্রাসঙ্গিক তথ্য, বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য চিঠি ও প্রবন্ধ, এবং পত্রলেখা-র ট্রেডমার্ক মুদ্রণ-সৌকর্য। পাঁচে পাঁচ তো দিতেই হবে!
বইটা আজকের এই ইয়েলো জার্নালিজমের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সত্যিই এক মুঠো অক্সিজেনের মত কাজ করবে। পড়ে ফেলুন।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।