বইয়ের খবর
নভেম্বর ৩০, ২০১৬
আজকের লেখাটার জন্য স্রেফ সত্যজিৎ রায় দায়ী।
শীতের ছুটিতে বেড়ানো নিয়ে কথা হচ্ছিল বাড়িতে। তার সঙ্গেই যোগ
হল বাঘ দেখার, বা না-দেখার অনুভূতি নিয়ে কথাবার্তা।
আমারো, শরদিন্দুর ভাষায়, “কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল”, আর চোখের
সামনে ভেসে উঠল পাহাড়, জঙ্গল, শীত, শব্দের হেঁয়ালি, খুন, আর বাঘ।
তাক থেকে নেমে এল ফেলুদা সমগ্র। দ্রুত পাতা উল্টে পৌঁছে গেলাম
“ছিন্নমস্তার অভিশাপ”-এর শুরুতে। আমার মাথায় পোকাটা নড়েচড়ে উঠল
তখনই।
বাঙালির সার্কাস! এই জিনিসটা নিয়ে তো আমি কিছুই পড়িনি। কিন্তু
এই বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্যে সাধু ভাষায় লেখা কেঠো বই পড়ার
কথা ভাবলেই তো গায়ে জ্বর আসছে।
তার চেয়ে বরং ম্যাজিক নিয়ে পড়া যাক। সত্যজিৎ তো ওই বিষয়টি নিয়েও
গা-ছমছমে বেশ কিছু গল্প উপহার দিয়েছেন। কিন্তু বাংলায় জাদুবিদ্যা
এবং নামকরা জাদুকর-কে নিয়ে লেখা বই এখন আমি কোথায় পাব?
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। হল না সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে,
যা নানা রহস্যময় উপায়ে আমার চোখের সামনে একটা বিচিত্র প্রচ্ছদের
ছবি তুলে ধরলঃ
শারদীয়া দেশ ১৪২২-এ প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই আলোড়ন তোলা এবং বহু-প্রশংসিত
এই উপন্যাসটি আমার রাডারের বাইরে থেকে গেছিল নানা কারণে। কিন্তু
যে মুহূর্তে আমি জানতে পারলাম যে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু হল বাঙালির
সার্কাস, বইটা আমায় কিনতে এবং পড়তেই হল। কেমন লাগল? সে কথা বলার
জন্যই তো এত ভূমিকা।
বইয়ের নামঃ শার্দূলসুন্দরী
লেখকঃ শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স
প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৬
হার্ডকভার, ২০৭ পৃষ্ঠা
আই.এস.বি.এনঃ 978-93-5040-591-8
|
“শার্দূলসুন্দরী” ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ তিনটি দশক এবং বিংশ শতাব্দীর
প্রথম দুটি দশক-এ ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সত্য ও কাল্পনিক ঘটনার মাধ্যমে
তিনটি মানুষের জীবনযাত্রার চালচিত্র আঁকতে চেয়েছেঃ (১) দ্য গ্রেট
বেঙ্গল সার্কাসের প্রাণপুরুষ প্রিয়নাথ বসু, (২) বাঙালির, তথা ভারতীয়
জাদুবিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রদর্শক গণপতি চক্রবর্তী, এবং (৩)
এই দুটি মানুষের মধ্যে এক বিচিত্র সম্পর্ক বজায় রাখা, ভেঙে দেওয়া,
এবং শেষ অবধি বাঙালির সার্কাসের উত্থান ও পতন দুয়েরই সাক্ষী থাকা
ব্যাঘ্রদময়ন্তী সুশীলা।
একে তো এই সময়টায় এদেশের ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থে যুগান্তর ঘটে,
তায় এই সময়ের যেকোনো ছবি আঁকতে গেলেই তাতে এমন সব লার্জার দ্যান
লাইফ চরিত্রের ছায়া পড়ে যে লেখার বাঁধুনি রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এই উপন্যাসেও এসেছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সেই আনন্দময় আত্মভোলা
মহাপুরুষটি। এসেছে সেই সময়ের বিচিত্র সমাজ, তার টানাপোড়েন, তার
ভেতরে অদৃশ্যভাবে বয়ে চলা নানা স্রোত। কিন্তু এই উপন্যাস তার নন-লিনিয়ার
ন্যারেটিভে বদলাতে থাকা পয়েন্ট-অফ-ভিউ নিয়ে ওই তিনটি মানুষেরই
গল্প বলেছে।
কেমন সে গল্প?
সাংবাদিকের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে যখন প্রকৃত অর্থে মেলবন্ধন
হয় এক অনাড়ম্বর অথচ সুঠাম গদ্যভাষার, তখন এমন রচনাই সৃষ্ট হয়।
“প্রফেসর” প্রিয়নাথ বসু সর্বস্ব পণ করে, পারিবারিক চাওয়া-পাওয়া
ভুলে, স্বদেশি চেতনা এবং প্রখর আত্মসম্মানবোধ থেকে তৈরি করলেন
গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। নানা ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে তা প্রথমে পেল
বাঘের খেলা দেখানোর জন্যে সাংঘাতিক সাহসী সুশীলাকে, আর তারপর এক
রকম ঘটনাচক্রেই তখনও অবধি মঞ্চসজ্জার সামান্য কাজ করে দিন চালানো
কিন্তু সার্কাসে ‘ফিলার’ হিসেবে গণপতিকে। তারপর... বাকিটা ইতিহাসঃ
অনেক অর্থের, সম্মানের, হতাশার, দুঃখের, বিচ্ছেদের, আর মৃত্যুর।
জীবনের বৃত্তাকার সঞ্চারপথ হয়তো সবার জন্যেই এমন পরিণতিই নির্দিষ্ট
করে, তবু এই তিনটি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রের জীবনকাহিনি আমাদের
টেনে নিয়ে চলে শেষ অবধি।
এই তিনটি চরিত্রের মধ্যেই এমন কিছু আনন্দ, বেদনা, দুঃখ, আর ট্র্যাজেডি
ছিল যাদের নিয়ে ফেনিয়ে গল্পের বারোটা বাজাতে পারতেন লেখক। কিন্তু
তা না করে তিনি যথাসম্ভব তথ্যানুগ থেকে পাঠকের কৌতূহল শেষ অবধি
জাগিয়ে রেখে তাঁদের কাহিনির শেষটা পড়িয়ে ছেড়েছেন, এটা শুধুমাত্র
লেখকের গল্প-বলার দক্ষতার পরিচায়ক নয়। এটা এও প্রমাণ করে যে লেখক
এই সর্বব্যাপী মিডিওক্রিটি-র সময়েও আমাদের সামনে এমন তিনটি মানুষকে
নতুন জীবন দিয়েছেন যাঁদের কথা আমরা পড়তে চাইছিলাম, হয়তো নতুন করে
বাঁচার মতো মনের জোর খুঁজে পাওয়ার জন্য।
কিন্তু লেখক যে সবটাই আপন মনের মাধুরী দিয়ে বানাননি, বরং যতটুকু
তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই এই গল্পের প্রতিমা গড়েছেন, তা কীভাবে
বুঝব?
এবার ফিল্ডে নামল আর একটি ছিমছাম বইঃ
বইয়ের নামঃ জাদুসম্রাট গণপতি ও বাঙালির বিদ্যাচর্চা
লেখকঃ সমীরকুমার ঘোষ
প্রকাশকঃ সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৬
পেপারব্যাক, ২৩২ পৃষ্ঠা
আই.এস.বি.এনঃ 978-93-82-706-91-5
|
এই বইটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে বে-নজির, এবং সত্যজিতের
গল্প পড়ে বা পি.সি. সরকার-এর ইন্দ্রজাল দেখে ম্যাজিক নিয়ে কখনও
না কখনও কৌতূহলী হয়েছেন এমন প্রতিটি পাঠকের অবশ্যপাঠ্য। বাংলায়
তথা ভারতে জাদুবিদ্যা চর্চার বঙ্কিম গতিপথের একটি সহজ এবং আরো
পড়তে উদ্দীপ্ত করে এমন আখ্যান এই বইয়ে বর্ণিত হয়েছে নিতান্ত সহজ
ভাষায়, অত্যন্ত ছোটো-ছোটো অনুচ্ছেদে।
এর সবটা নিয়ে এখানে লিখছি না, তবে এই বইয়ে অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু-র
“বাঙ্গালীর সার্কাস” এবং দেবাশিস বসু সম্পাদিত “প্রোফেসর বোসের
অপূর্ব ভ্রমণবৃত্তান্ত” থেকে গণপতি, প্রফেসর বোসের সার্কাস, এবং
শার্দূলসুন্দরী সুশীলাকে নিয়ে যেসব তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে, তার
প্রতিটিই উপন্যাসটিতে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সাযুজ্য বজায়
রাখে। তার সঙ্গেই এই বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে আরো নানা ঘটনা এবং ভবিষ্যতের
জমাট বিতর্কের জন্য বেশ কিছু বীজ, যাদের নিয়ে এখানে লিখতে বসলে
বইটার অর্ধেকটাই তুলে দিতে হবে। তবে এই বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান
অঙ্গ হল বেশ কিছু সাদা-কালো ফটোগ্রাফ, যাদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছেন
প্রফেসর বোস, জাদুকর গণপতি, এবং শার্দূলসুন্দরী সুশীলাও।
আপনাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, দুটো বই-ই পড়ুন। অপরিসীম প্রতিকূলতার
মাঝেও নিজেদের মতো করে ভাগ্য গড়ে নেওয়ার জন্য জান-মান বাজিতে লাগিয়ে
যাঁরা পথে নেমেছিলেন, তাঁদের কথা পড়লে হয়তো চুপসে যাওয়া জীবনে
কিছুটা অন্য রকমের বাতাস লাগবে।
ভালো থাকুন।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।